দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বলতে গেলে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে অবকাঠামো সবই ছিল বিধ্বস্ত। প্রশাসনিক কাঠামোও বিধ্বস্ত। স্বাধীনতার পূর্বে প্রতিটি সেক্টরেই পাকিস্তানিসহ বাংলাদেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংগত কারণেই দক্ষ ও কর্মজীবী জনবলের অনেকাংশই তখন দুদেশে ভাগ হয়ে যাওয়াতে এদেশের প্রশাসনে অনেক শূন্যতা ছিল। সেই শূন্যতা পূরণ করে ভগ্নদশা থেকে যখন ধীরে ধীরে সবকিছুই ঠিক হয়ে আসতে শুরু করেছিল তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে দেশের অগ্রগতিকেও হত্যা করা হলো। স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি, স্বপ্নদ্রষ্টা রাষ্ট্রপ্রধানের পরিবর্তনের ফলে বাহ্যিকভাবে জনমানুষের চোখে সেই পরিবর্তন ধরা না পড়লেও প্রশাসনের ভেতরে সন্দেহাতীতভাবে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছিল। একটি বৃক্ষ যখন কেবল শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দাঁড়াল তখনই বৃক্ষের কা- কেটে ফেলা হলো। সেই সময় প্রশাসনেরও নানা রকম রদবদল করতে হয়েছে এবং যারা দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশের হাল ধরেছিলেন তাদের অনেককে সরিয়ে দিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। তার মানে সাড়ে তিন বছর একটি দেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার পর যখন পা সোজা করে দাঁড়াতে চাইল তখন পা ভেঙে নতুন ক্র্যাচ নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল। তখন দেশের মানুষও খাই খাই মনোভাবে অস্থির ছিল এবং যেভাবে পারে সেভাবেই সম্পদ আহরণের জন্য ব্যতিব্যস্ত ছিল। সংগত কারণেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক অস্থিরতা ইত্যাদি সব অস্থিরতার মধ্য দিয়ে দেশের প্রত্যাশিত অগ্রগতি সাধিত হয়নি। যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সেই স্বপ্নও ভেঙে খান খান হয়ে গেল। ফলে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা জরুরি ছিল এবং শুরুও হয়েছিল সেখানে গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবর্তে অশুভ রাজনৈতিক আছরে রাজনৈতিক অঙ্গনে লাগামহীন অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ ঘটল ঠিক এবং তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পছন্দের ব্যক্তিদের দ্বারা দখলদারিত্বের কাজটিও সম্পন্ন হলো। ফলে প্রশাসনসহ প্রতিটি সেক্টরেই অযোগ্য ব্যক্তিদের দখলদারিত্বে চলে গেল। এর ধারাবাহিকতা থেকে বাংলাদেশ এখনও মুক্ত হতে পারেনি।

বর্তমান যুগের সঙ্গে সেই সময়কে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, অসংখ্য অভাব-অজুহাত নিয়ে বাংলাদেশকে পথ চলতে হয়েছে বন্ধুর পথে। নিপীড়নমূলক শাসনের ফলে পাকিস্তান আমলে সব অফিসের নিয়ন্ত্রণ ছিল পাকিস্তানিদের হাতে, শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তাও ছিল পাকিস্তানিদের হাতে। বাংলাদেশ থেকে দুয়েকজন অতিশয় প্রতিভাবানদের কাছে হয়তো দুয়েকটি সেক্টরের দায়িত্ব ছাড়তে হতো কিন্তু অধিকাংশ যোগ্যদেরই অবদমিত করে রাখা হয়েছে। প্রণোদনার ফলে পেতে হতো অবদমন। পুরস্কারের পরিবর্তে তিরস্কার। তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জায়গাটুকু রুদ্ধ করে রাখা হতো। এ কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অধিকাংশ সেক্টরের পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল মিডল লেভেলের অফিসারদের ওপর। পাকিস্তানিদের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে মিডল লেভেলদের অফিসারদের যখন অধিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তখন তারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেই হাল ধরেছিলেন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই দক্ষতা দিয়ে সেক্টরের কাজ হলেও অনেক সেক্টরে আশানুরূপ সাফল্য পাওয়া গেছে তা হয়তো জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই। মানুষের কর্মদক্ষতা নির্ভর করে অভিজ্ঞতার ওপর। অভিজ্ঞতা ব্যক্তি জীবনের ভিত্তি। একটি প্রাসাদের ভিত্তি শক্ত না হলে প্রাসাদকে উঁচু করার সুযোগ নেই, বড় করারও সুযোগ নেই। অস্বীকার উপায় নেই যে, তখন এদেশের মিডল লেভেলের কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল। অভিজ্ঞতার ঘাটতির জন্যই অনেক সেক্টরই প্রত্যাশিত মানে বিকশিত হতে পারেনি। একদিকে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতির ফলে প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য অনভিজ্ঞ, অদক্ষ ও অযোগ্য লোকের সমাগম ঘটেছে। অযোগ্যরাই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং বেশি অর্থলোভী হয়। পেশাদারিত্বে বিকাশের পরিবর্তে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে ওই সব অযোগ্যরা। প্রশাসনিক শৃঙ্খলাও ছিল ঢিলেঢালা। বিধি বিধানও ছিল অপরিপক্ব। নৈতিকতার স্খলন, শিথিল বিধি-বিধান, পরিবীক্ষণের তীব্র অভাব, দায়সারা দায়িত্ব পালন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব ইত্যাদি বিষয়গুলোর জন্য দুর্নীতি ধীরে ধীরে হলো অবাধ। ফলশ্রুতিতে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ক্ষমতায় থাকা মানুষদের রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার জন্য অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিরা লাগামহীন দুর্নীতির আশ্রয় নেয়।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে প্রতিটি সেক্টরেই ব্যাপক হারে দুর্নীতির মহামারি রয়েছে। ব্যাপক হারের দুর্নীতির কারণ কী? শুধু কি অর্থনৈতিক খারাপ অবস্থা? নিজের আখের গোছানো? নিরাপত্তাহীনতা বা রাতারাতি কোটিপতি হওয়া? গভীরভাবে খতিয়ে দেখলে আরও কারণ উদঘাটিত হতে পারে। স্বাধীনতার পর পরই মানুষের খাদ্য, পরিধেয়, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ বিবিধ অভাব ছিল যা নব্বইয়ের দশকে এসে সেই অভাবের তীব্রতা কেটে যায়। নতুন শতাব্দিতে বৈশি^ক অর্থনীতির প্রভাবে মানুষের খাদ্যের অভাব নেই, কাপড়ের অভাব নেই, লেখাপড়া ও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধাসহ অন্যান্য নিত্যদিনের জীবনধারনের বিষয়গুলোর কোনো অভাব নেই। বরং আছে প্রাচুর্য। তাহলে কেন এত দুর্নীতি? এক কথায় উত্তর দেওয়া সম্ভব না হলেও নৈতিক মূল্যবোধের দারুণভাবে অবক্ষয় ও পেশাদারিত্বে যথাযথ উন্নয়নের অভাবে জন্য হয়েছে তা জোর দিয়েই বলা যায়। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই সামাজিকীরণ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রক্রিয়াও দূষিত হয়েছে, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় যে, দুর্নীতিমুক্ত শুদ্ধ মানুষ হওয়ার সুযোগ খুব কম। জন্মের পর থেকে শিশুরা দেখছে বাবা-মায়ের কাছে দুর্নীতি, অনেক পরিবার থেকেও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখছে শিক্ষকরা দুর্নীতি করছে তাহলে প্রজন্ম কীভাবে শুদ্ধ মানুষ হবে?

তবে গত দশক থেকে কোনো ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় উন্নতি হলেও সেখানেই দুর্নীতির কারণে সেই উন্নতির আলোকছটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। স্থাপনায় বাঁশের ব্যবহার, অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পরিমাণমতো ও মানসম্মত কাঁচামাল ব্যবহার না করা, নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন না করা, কমিশন (ঘুষ) প্রদানসহ নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রত্যাশিত উন্নয়ন।

পেশাদারিত্ব ও দুর্নীতি বিপরীতমুখী, একসঙ্গে চলতে পারে না। যখন পেশাদারিত্বের বিকাশ ঘটবে তখন দুর্নীতি কমে যাবে। আবার যখন দুর্নীতি বেড়ে যাবে তখন পেশাদারিত্ব বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ, পেশাদারিত্বের জন্য অনিবার্য শর্ত বা বৈশিষ্ট্য হলো যোগ্যতা, নির্ভরযোগ্যতা, সততা, শুদ্ধাচার, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, নিজের উন্নয়ন, ইতিবাচক মনোভাব, অন্যকে সহযোগিতা করা, কাজের প্রতি নিবদ্ধ থাকা ইত্যাদি। এখন ভেবে দেখা যেতে পারে, বাংলাদেশে পেশাদারিত্বের বিকাশের অনিবার্য শর্তগুলো পূরণ হচ্ছে কি না। কতজন মানুষের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যাবলি পাওয়া যাবে? প্রতিটি সেক্টর, অফিস, ইউনিট খতিয়ে দেখলে এই শর্তাবলি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

আমরা যদি উন্নয়ন, দেশের পরিবর্তন, মানুষের কল্যাণ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই তাহলে পেশাদারিত্ব বিকাশের জন্য জোর দিতে হবে। গ্লোবাল ভিলেজের বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্ব রাখতে হলে পেশাদারিত্বের বিকল্প নেই। এখন চিন্তা করার দরকার কীভাবে প্রতিটি সেক্টরে পেশাদারিত্ব বাড়ানো যায়।

বর্তমান সরকার বিগত টার্ম থেকে পেশাদারিত্বের বিকাশের জন্য ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমনের জন্য কয়েকটি গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে যেগুলোর বাস্তবায়ন হলে দেশের মানুষ সুফল পেতে পারে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এই পদক্ষেপগুলো অনুমোদিত এবং মাঠপর্যায়েও কার্যকরী হতে শুরু করেছে। এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে প্রথমই গণ্য করা যেতে পারে ডিজিটালাইড পদ্ধতি। অনেক অফিসের কর্মকা- ডিজিটালাইড হয়েছে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করতে অফিসগুলো বাধ্য হচ্ছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে যেসব অফিসে কাজ হয় সেসব অফিসে সংগত কারণেই দুর্নীতি কম হয়। এই পদ্ধতি যদি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে চালু করতে পারে তাহলে দুর্নীতির লাগাম ধরা সম্ভব হতে পারে। পেশাদারিত্বেও বিকাশ ঘটবে। সেবাগ্রহীতাদের হয়রানির পরিবর্তে প্রকৃত সেবা যথাসময়ে পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে।

একইভাবে দুর্নীতি কমানোর জন্য এই পদ্ধতি ছাড়াও সরকার দুর্নীতি হ্রাস ও পেশাদারিত্ব বিকাশের জন্য আরও কিছু পদ্ধতি গ্রহণ করেছে যেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হলে আশানুরূপ কাজ হতে পারে বলে ধারণা করা যায়। সরকারি বিভিন্ন দফতর থেকে জানা যায় যে, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯, সিটিজেন চার্টার, অভিযোগ নিষ্পত্তি পদ্ধতি, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল, অ্যানুয়াল পারফরমেন্স অ্যাপ্রাইজালসহ আরও অন্যান্য গৃহীত পদক্ষেপ নতুনভাবে ভাববার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোর বাস্তবায়ন হলে জনগণ বিভিন্ন তথ্য জানতে পারবে, যথার্থ সেবা না পেলে কিংবা কোথাও দুর্নীতি হলে অভিযোগ করতে পারবে, প্রতিটি অফিসে শুদ্ধাচ্চার করতে হবে, প্রতিটি অফিসে কী কী সেবা দেওয়া হয় প্রকাশ্যে জানাতে হবে এবং সর্বোপরি প্রত্যেক কর্মচারী, কর্মকর্তাসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরও বার্ষিক কর্মসম্পাদন মূল্যালয় করা হবে। উল্লিখিত এই পাঁচটি নীতিনির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের আন্তরিকতাও রয়েছে এবং আশা করা যায় এগুলো বাস্তবায়ন হলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা, প্রশাসনের জবাবদিহি, স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে, দুর্নীতি কমে যাবে এবং পেশাদারিত্ব সুসংহত হবে।

সরকারি সেবাদান প্রতিষ্ঠাগুলোতে দেশের নাগরিকগণ যদি প্রকৃত সেবা পায়, সেবাদান প্রতিষ্ঠানগুলোতে পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে দুর্নীতি কমে প্রত্যাশিত উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

image
আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

image

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বলতে গেলে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে অবকাঠামো সবই ছিল বিধ্বস্ত। প্রশাসনিক কাঠামোও বিধ্বস্ত। স্বাধীনতার পূর্বে প্রতিটি সেক্টরেই পাকিস্তানিসহ বাংলাদেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংগত কারণেই দক্ষ ও কর্মজীবী জনবলের অনেকাংশই তখন দুদেশে ভাগ হয়ে যাওয়াতে এদেশের প্রশাসনে অনেক শূন্যতা ছিল। সেই শূন্যতা পূরণ করে ভগ্নদশা থেকে যখন ধীরে ধীরে সবকিছুই ঠিক হয়ে আসতে শুরু করেছিল তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে দেশের অগ্রগতিকেও হত্যা করা হলো। স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি, স্বপ্নদ্রষ্টা রাষ্ট্রপ্রধানের পরিবর্তনের ফলে বাহ্যিকভাবে জনমানুষের চোখে সেই পরিবর্তন ধরা না পড়লেও প্রশাসনের ভেতরে সন্দেহাতীতভাবে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছিল। একটি বৃক্ষ যখন কেবল শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দাঁড়াল তখনই বৃক্ষের কা- কেটে ফেলা হলো। সেই সময় প্রশাসনেরও নানা রকম রদবদল করতে হয়েছে এবং যারা দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশের হাল ধরেছিলেন তাদের অনেককে সরিয়ে দিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। তার মানে সাড়ে তিন বছর একটি দেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার পর যখন পা সোজা করে দাঁড়াতে চাইল তখন পা ভেঙে নতুন ক্র্যাচ নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল। তখন দেশের মানুষও খাই খাই মনোভাবে অস্থির ছিল এবং যেভাবে পারে সেভাবেই সম্পদ আহরণের জন্য ব্যতিব্যস্ত ছিল। সংগত কারণেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক অস্থিরতা ইত্যাদি সব অস্থিরতার মধ্য দিয়ে দেশের প্রত্যাশিত অগ্রগতি সাধিত হয়নি। যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সেই স্বপ্নও ভেঙে খান খান হয়ে গেল। ফলে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা জরুরি ছিল এবং শুরুও হয়েছিল সেখানে গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবর্তে অশুভ রাজনৈতিক আছরে রাজনৈতিক অঙ্গনে লাগামহীন অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ ঘটল ঠিক এবং তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পছন্দের ব্যক্তিদের দ্বারা দখলদারিত্বের কাজটিও সম্পন্ন হলো। ফলে প্রশাসনসহ প্রতিটি সেক্টরেই অযোগ্য ব্যক্তিদের দখলদারিত্বে চলে গেল। এর ধারাবাহিকতা থেকে বাংলাদেশ এখনও মুক্ত হতে পারেনি।

বর্তমান যুগের সঙ্গে সেই সময়কে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, অসংখ্য অভাব-অজুহাত নিয়ে বাংলাদেশকে পথ চলতে হয়েছে বন্ধুর পথে। নিপীড়নমূলক শাসনের ফলে পাকিস্তান আমলে সব অফিসের নিয়ন্ত্রণ ছিল পাকিস্তানিদের হাতে, শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তাও ছিল পাকিস্তানিদের হাতে। বাংলাদেশ থেকে দুয়েকজন অতিশয় প্রতিভাবানদের কাছে হয়তো দুয়েকটি সেক্টরের দায়িত্ব ছাড়তে হতো কিন্তু অধিকাংশ যোগ্যদেরই অবদমিত করে রাখা হয়েছে। প্রণোদনার ফলে পেতে হতো অবদমন। পুরস্কারের পরিবর্তে তিরস্কার। তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জায়গাটুকু রুদ্ধ করে রাখা হতো। এ কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অধিকাংশ সেক্টরের পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল মিডল লেভেলের অফিসারদের ওপর। পাকিস্তানিদের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে মিডল লেভেলদের অফিসারদের যখন অধিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তখন তারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেই হাল ধরেছিলেন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই দক্ষতা দিয়ে সেক্টরের কাজ হলেও অনেক সেক্টরে আশানুরূপ সাফল্য পাওয়া গেছে তা হয়তো জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই। মানুষের কর্মদক্ষতা নির্ভর করে অভিজ্ঞতার ওপর। অভিজ্ঞতা ব্যক্তি জীবনের ভিত্তি। একটি প্রাসাদের ভিত্তি শক্ত না হলে প্রাসাদকে উঁচু করার সুযোগ নেই, বড় করারও সুযোগ নেই। অস্বীকার উপায় নেই যে, তখন এদেশের মিডল লেভেলের কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল। অভিজ্ঞতার ঘাটতির জন্যই অনেক সেক্টরই প্রত্যাশিত মানে বিকশিত হতে পারেনি। একদিকে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতির ফলে প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য অনভিজ্ঞ, অদক্ষ ও অযোগ্য লোকের সমাগম ঘটেছে। অযোগ্যরাই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং বেশি অর্থলোভী হয়। পেশাদারিত্বে বিকাশের পরিবর্তে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে ওই সব অযোগ্যরা। প্রশাসনিক শৃঙ্খলাও ছিল ঢিলেঢালা। বিধি বিধানও ছিল অপরিপক্ব। নৈতিকতার স্খলন, শিথিল বিধি-বিধান, পরিবীক্ষণের তীব্র অভাব, দায়সারা দায়িত্ব পালন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব ইত্যাদি বিষয়গুলোর জন্য দুর্নীতি ধীরে ধীরে হলো অবাধ। ফলশ্রুতিতে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ক্ষমতায় থাকা মানুষদের রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার জন্য অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিরা লাগামহীন দুর্নীতির আশ্রয় নেয়।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে প্রতিটি সেক্টরেই ব্যাপক হারে দুর্নীতির মহামারি রয়েছে। ব্যাপক হারের দুর্নীতির কারণ কী? শুধু কি অর্থনৈতিক খারাপ অবস্থা? নিজের আখের গোছানো? নিরাপত্তাহীনতা বা রাতারাতি কোটিপতি হওয়া? গভীরভাবে খতিয়ে দেখলে আরও কারণ উদঘাটিত হতে পারে। স্বাধীনতার পর পরই মানুষের খাদ্য, পরিধেয়, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ বিবিধ অভাব ছিল যা নব্বইয়ের দশকে এসে সেই অভাবের তীব্রতা কেটে যায়। নতুন শতাব্দিতে বৈশি^ক অর্থনীতির প্রভাবে মানুষের খাদ্যের অভাব নেই, কাপড়ের অভাব নেই, লেখাপড়া ও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধাসহ অন্যান্য নিত্যদিনের জীবনধারনের বিষয়গুলোর কোনো অভাব নেই। বরং আছে প্রাচুর্য। তাহলে কেন এত দুর্নীতি? এক কথায় উত্তর দেওয়া সম্ভব না হলেও নৈতিক মূল্যবোধের দারুণভাবে অবক্ষয় ও পেশাদারিত্বে যথাযথ উন্নয়নের অভাবে জন্য হয়েছে তা জোর দিয়েই বলা যায়। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই সামাজিকীরণ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রক্রিয়াও দূষিত হয়েছে, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় যে, দুর্নীতিমুক্ত শুদ্ধ মানুষ হওয়ার সুযোগ খুব কম। জন্মের পর থেকে শিশুরা দেখছে বাবা-মায়ের কাছে দুর্নীতি, অনেক পরিবার থেকেও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখছে শিক্ষকরা দুর্নীতি করছে তাহলে প্রজন্ম কীভাবে শুদ্ধ মানুষ হবে?

তবে গত দশক থেকে কোনো ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় উন্নতি হলেও সেখানেই দুর্নীতির কারণে সেই উন্নতির আলোকছটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। স্থাপনায় বাঁশের ব্যবহার, অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পরিমাণমতো ও মানসম্মত কাঁচামাল ব্যবহার না করা, নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন না করা, কমিশন (ঘুষ) প্রদানসহ নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রত্যাশিত উন্নয়ন।

পেশাদারিত্ব ও দুর্নীতি বিপরীতমুখী, একসঙ্গে চলতে পারে না। যখন পেশাদারিত্বের বিকাশ ঘটবে তখন দুর্নীতি কমে যাবে। আবার যখন দুর্নীতি বেড়ে যাবে তখন পেশাদারিত্ব বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ, পেশাদারিত্বের জন্য অনিবার্য শর্ত বা বৈশিষ্ট্য হলো যোগ্যতা, নির্ভরযোগ্যতা, সততা, শুদ্ধাচার, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, নিজের উন্নয়ন, ইতিবাচক মনোভাব, অন্যকে সহযোগিতা করা, কাজের প্রতি নিবদ্ধ থাকা ইত্যাদি। এখন ভেবে দেখা যেতে পারে, বাংলাদেশে পেশাদারিত্বের বিকাশের অনিবার্য শর্তগুলো পূরণ হচ্ছে কি না। কতজন মানুষের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যাবলি পাওয়া যাবে? প্রতিটি সেক্টর, অফিস, ইউনিট খতিয়ে দেখলে এই শর্তাবলি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

আমরা যদি উন্নয়ন, দেশের পরিবর্তন, মানুষের কল্যাণ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই তাহলে পেশাদারিত্ব বিকাশের জন্য জোর দিতে হবে। গ্লোবাল ভিলেজের বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্ব রাখতে হলে পেশাদারিত্বের বিকল্প নেই। এখন চিন্তা করার দরকার কীভাবে প্রতিটি সেক্টরে পেশাদারিত্ব বাড়ানো যায়।

বর্তমান সরকার বিগত টার্ম থেকে পেশাদারিত্বের বিকাশের জন্য ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমনের জন্য কয়েকটি গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে যেগুলোর বাস্তবায়ন হলে দেশের মানুষ সুফল পেতে পারে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এই পদক্ষেপগুলো অনুমোদিত এবং মাঠপর্যায়েও কার্যকরী হতে শুরু করেছে। এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে প্রথমই গণ্য করা যেতে পারে ডিজিটালাইড পদ্ধতি। অনেক অফিসের কর্মকা- ডিজিটালাইড হয়েছে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করতে অফিসগুলো বাধ্য হচ্ছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে যেসব অফিসে কাজ হয় সেসব অফিসে সংগত কারণেই দুর্নীতি কম হয়। এই পদ্ধতি যদি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে চালু করতে পারে তাহলে দুর্নীতির লাগাম ধরা সম্ভব হতে পারে। পেশাদারিত্বেও বিকাশ ঘটবে। সেবাগ্রহীতাদের হয়রানির পরিবর্তে প্রকৃত সেবা যথাসময়ে পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে।

একইভাবে দুর্নীতি কমানোর জন্য এই পদ্ধতি ছাড়াও সরকার দুর্নীতি হ্রাস ও পেশাদারিত্ব বিকাশের জন্য আরও কিছু পদ্ধতি গ্রহণ করেছে যেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হলে আশানুরূপ কাজ হতে পারে বলে ধারণা করা যায়। সরকারি বিভিন্ন দফতর থেকে জানা যায় যে, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯, সিটিজেন চার্টার, অভিযোগ নিষ্পত্তি পদ্ধতি, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল, অ্যানুয়াল পারফরমেন্স অ্যাপ্রাইজালসহ আরও অন্যান্য গৃহীত পদক্ষেপ নতুনভাবে ভাববার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোর বাস্তবায়ন হলে জনগণ বিভিন্ন তথ্য জানতে পারবে, যথার্থ সেবা না পেলে কিংবা কোথাও দুর্নীতি হলে অভিযোগ করতে পারবে, প্রতিটি অফিসে শুদ্ধাচ্চার করতে হবে, প্রতিটি অফিসে কী কী সেবা দেওয়া হয় প্রকাশ্যে জানাতে হবে এবং সর্বোপরি প্রত্যেক কর্মচারী, কর্মকর্তাসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরও বার্ষিক কর্মসম্পাদন মূল্যালয় করা হবে। উল্লিখিত এই পাঁচটি নীতিনির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের আন্তরিকতাও রয়েছে এবং আশা করা যায় এগুলো বাস্তবায়ন হলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা, প্রশাসনের জবাবদিহি, স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে, দুর্নীতি কমে যাবে এবং পেশাদারিত্ব সুসংহত হবে।

সরকারি সেবাদান প্রতিষ্ঠাগুলোতে দেশের নাগরিকগণ যদি প্রকৃত সেবা পায়, সেবাদান প্রতিষ্ঠানগুলোতে পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে দুর্নীতি কমে প্রত্যাশিত উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।