বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ

রুমা মোদক

প্রতিদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে অর্জনের থলে পূর্ণ করি তার নাম প্রতিবন্ধকতা। আর রাত ভোর হলে আবার মঞ্চে দাঁড়িয়ে সংলাপ আওড়াই তার নাম ভালোবাসা। বাংলাদেশে যখন চলচ্চিত্র, মিডিয়া নাটক পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে হুমকির মুখোমুখি, যাত্রা শিল্প প্রায় বন্ধ, তখন থিয়েটার বলতে গেলে এক ক্ষীণস্রোতা সংস্কৃতি মাধ্যম। বিন্দুমাত্র পেশাদারিত্বের সুযোগ যেখানে নেই সেখানে রাজধানীসহ সারা দেশে কিছু ছেলেমেয়ে দাপটের সঙ্গে বিরামবিহীন থিয়েটার চর্চা করে চলেছে এবং বলাবাহুল্য তারা তা করছে সচেতন সক্রিয়তায়।

এখানেই আমাদের শক্তি, এখানেই আমাদের ভাবনার বিস্তৃত অবকাশ। শুধুই আত্মকেন্দ্রিক সাফল্যের জোয়ারে গা ভাসানো সময়ে থিয়েটারের নামে যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় তারা কারা? কেন করে? এদেশে এ্যামেচার থিয়েটারের ভবিষ্যৎ কী, প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার আগে আমাদের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে।

আমরা যারা দিনরাত এক করে থিয়েটার করি, বিশেষত ঢাকার বাইরে সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, পৃষ্ঠপোষকতার তীব্র অভাব ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে আমাদের নিত্য বসবাস। ফলে এসবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তবু লড়াইটা চালু রাখার স্পর্ধিত সাহসের নাম থিয়েটার। থিয়েটার বাংলাদেশের সেই শিল্প মাধ্যম যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দায় এবং দায়িত্ব। জড়িত থাকে নিত্য নিরীক্ষার মাধ্যমে ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করে অন্যের সঙ্গে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের মঞ্চপ্রচেষ্টাকে ক্রমাগত উত্তরণের পথে নিয়ে যাওয়ার। থিয়েটার কর্মীরা এখানে অক্লান্ত।

বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার যাত্রা শুরুতে ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নবনির্মাণের স্বপ্ন। ছিল সদ্য অর্জিত স্বাধীনতার মৌল আদর্শ ও প্রগতির পথে যাত্রা শুরুর দায়বোধ। এবং মাঠে ময়দানে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা টগবগে তারুণ্যের হাতে এর উদ্বোধন। বিশ্বব্যাপী থিয়েটার চর্চার সঙ্গে বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার মৌল পার্থক্য এই যাত্রা শুরুর মুহূর্তেই নির্ধারিত হয়ে যায়।

পরবর্তীতে বাংলাদেশের থিয়েটারের গতি নানা সুযোগ সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতায় তার দায়বদ্ধতার প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছে সর্বাবস্থায়। থিয়েটার চর্চা এখানেই ব্যতিক্রম। উল্টো পথে হাঁটা স্বদেশে চলচ্চিত্র নীতিহীন অশ্লীলতার চোরাগলিতে পথ হারিয়েছে। সংগীত ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিনিধিত্বহীন অন্ধকারে। সাহিত্য গন্তব্যহীন বহুধা বিভক্ত আদর্শে। টিভি নাটক সামান্য ব্যতিক্রম বাদে পর্যবসিত হয়েছে ভাঁড়ামিতে।

সর্বত্র বিভেদ। আদর্শের। মৌল উদ্দেশ্য ও গন্তব্যের। সর্বত্র আপস আর লাভের লক্ষ্য। শুধু থিয়েটার কোন লাভ ও লোভের উদ্দেশ্যহীন আদর্শে আপসহীন এক শিল্পমাধ্যম।

কেন দেশব্যাপী সহস্র তরুণ এই শিল্পের প্রতি নিবেদিত? যেখানে কোন নগদ লাভের হাতছানি নেই, নেই সরকার কিংবা রাষ্ট্রের কোন প্রণোদনা। অথচ অবিচল আদর্শে অবিরাম কর্মমুখর তারা।

এর কারণ খোঁজার মধ্যেই নিহিত রয়েছে এই দেশ ও জাতির জাতীয় প্রবণতার মূল সুর। এ জাতি স্বেচ্ছাসেবী, এ জাতি একতাবদ্ধতায় উদ্বুদ্ধ, এ জাতি দেশ সমাজ ও কালের প্রেক্ষিতে সচেতন। তাই শিল্পের দায়ে শিল্পে সে সীমাবদ্ধ রাখে না নিজেকে, বরং বোধ করে দায় সমাজের প্রতি, তার ঐতিহ্য ও শিকড়ের প্রতি, সসমসাময়িক সংকট ও সম্ভাবনার প্রতি। তাই এদেশের সর্বত্র যে সব নাট্যপ্রযোজনা মঞ্চে প্রযোজিত হয় কী বিষয়ে, কী আঙ্গিক কৌশলে তা কখনো শেকড় সন্ধানী, কখনো বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক। কিন্তু যা হয় যেটুকু হয় তার সবটুকুই সচেতন ও পরিকল্পিত কর্মতৎপরতা। কখনোই তা প্রগতির বিপক্ষে দাঁড়ায় না। কখনোই তার ফল কোন অপতৎপরতা কিংবা পশ্চাৎপদতাকে প্রশ্রয় দেয় না। সেই অর্থে একটি থিয়েটার দল, একজন থিয়েটার কর্মী এক টুকরো স্বপ্নের বাংলাদেশের প্রতিনিধি বললে বাহুল্য হয় না।

এহেন শিল্পমাধ্যম এদেশে সবচে বেশি অবহেলিত, পৃষ্ঠপোষকতাহীন। এ এক ট্র্যাজেডির আখ্যান। প্রশ্ন উঠে কতজন দর্শকের কাছে পৌঁছায় থিয়েটার? এই না পৌঁছানোর দায় কেবল থিয়েটার কর্মীদের? পকেটের টাকায় নিজের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন করে থিয়েটারে নিজের মেধা ও শ্রমের সর্বোচ্চটুকু উজাড় করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘কজন দর্শক দেখে’ এই বদনামও ঘাড়ে নিতে হয় থিয়েটার কর্মীদের। যে শিল্পমাধ্যমটি পরিচালিত হয় প্রশিক্ষিত কর্মীদের দ্বারা, সৃজনশীলতা শিক্ষা এবং আদর্শের সর্বোচ্চ সংযোগ ঘটে যে শিল্পমাধ্যমে সরকার কবে উপলব্ধি করবে একে সর্বোচ্চ প্রণোদনা আর পৃষ্ঠপোষকতা করা দরকার। আমরা মাঠে ময়দানের থিয়েটারকর্মীরা সেই আশায় পথ চেয়ে রইলাম।

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ

রুমা মোদক

প্রতিদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে অর্জনের থলে পূর্ণ করি তার নাম প্রতিবন্ধকতা। আর রাত ভোর হলে আবার মঞ্চে দাঁড়িয়ে সংলাপ আওড়াই তার নাম ভালোবাসা। বাংলাদেশে যখন চলচ্চিত্র, মিডিয়া নাটক পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে হুমকির মুখোমুখি, যাত্রা শিল্প প্রায় বন্ধ, তখন থিয়েটার বলতে গেলে এক ক্ষীণস্রোতা সংস্কৃতি মাধ্যম। বিন্দুমাত্র পেশাদারিত্বের সুযোগ যেখানে নেই সেখানে রাজধানীসহ সারা দেশে কিছু ছেলেমেয়ে দাপটের সঙ্গে বিরামবিহীন থিয়েটার চর্চা করে চলেছে এবং বলাবাহুল্য তারা তা করছে সচেতন সক্রিয়তায়।

এখানেই আমাদের শক্তি, এখানেই আমাদের ভাবনার বিস্তৃত অবকাশ। শুধুই আত্মকেন্দ্রিক সাফল্যের জোয়ারে গা ভাসানো সময়ে থিয়েটারের নামে যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় তারা কারা? কেন করে? এদেশে এ্যামেচার থিয়েটারের ভবিষ্যৎ কী, প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার আগে আমাদের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে।

আমরা যারা দিনরাত এক করে থিয়েটার করি, বিশেষত ঢাকার বাইরে সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা, পৃষ্ঠপোষকতার তীব্র অভাব ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে আমাদের নিত্য বসবাস। ফলে এসবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তবু লড়াইটা চালু রাখার স্পর্ধিত সাহসের নাম থিয়েটার। থিয়েটার বাংলাদেশের সেই শিল্প মাধ্যম যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দায় এবং দায়িত্ব। জড়িত থাকে নিত্য নিরীক্ষার মাধ্যমে ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করে অন্যের সঙ্গে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের মঞ্চপ্রচেষ্টাকে ক্রমাগত উত্তরণের পথে নিয়ে যাওয়ার। থিয়েটার কর্মীরা এখানে অক্লান্ত।

বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার যাত্রা শুরুতে ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নবনির্মাণের স্বপ্ন। ছিল সদ্য অর্জিত স্বাধীনতার মৌল আদর্শ ও প্রগতির পথে যাত্রা শুরুর দায়বোধ। এবং মাঠে ময়দানে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা টগবগে তারুণ্যের হাতে এর উদ্বোধন। বিশ্বব্যাপী থিয়েটার চর্চার সঙ্গে বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার মৌল পার্থক্য এই যাত্রা শুরুর মুহূর্তেই নির্ধারিত হয়ে যায়।

পরবর্তীতে বাংলাদেশের থিয়েটারের গতি নানা সুযোগ সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতায় তার দায়বদ্ধতার প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছে সর্বাবস্থায়। থিয়েটার চর্চা এখানেই ব্যতিক্রম। উল্টো পথে হাঁটা স্বদেশে চলচ্চিত্র নীতিহীন অশ্লীলতার চোরাগলিতে পথ হারিয়েছে। সংগীত ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিনিধিত্বহীন অন্ধকারে। সাহিত্য গন্তব্যহীন বহুধা বিভক্ত আদর্শে। টিভি নাটক সামান্য ব্যতিক্রম বাদে পর্যবসিত হয়েছে ভাঁড়ামিতে।

সর্বত্র বিভেদ। আদর্শের। মৌল উদ্দেশ্য ও গন্তব্যের। সর্বত্র আপস আর লাভের লক্ষ্য। শুধু থিয়েটার কোন লাভ ও লোভের উদ্দেশ্যহীন আদর্শে আপসহীন এক শিল্পমাধ্যম।

কেন দেশব্যাপী সহস্র তরুণ এই শিল্পের প্রতি নিবেদিত? যেখানে কোন নগদ লাভের হাতছানি নেই, নেই সরকার কিংবা রাষ্ট্রের কোন প্রণোদনা। অথচ অবিচল আদর্শে অবিরাম কর্মমুখর তারা।

এর কারণ খোঁজার মধ্যেই নিহিত রয়েছে এই দেশ ও জাতির জাতীয় প্রবণতার মূল সুর। এ জাতি স্বেচ্ছাসেবী, এ জাতি একতাবদ্ধতায় উদ্বুদ্ধ, এ জাতি দেশ সমাজ ও কালের প্রেক্ষিতে সচেতন। তাই শিল্পের দায়ে শিল্পে সে সীমাবদ্ধ রাখে না নিজেকে, বরং বোধ করে দায় সমাজের প্রতি, তার ঐতিহ্য ও শিকড়ের প্রতি, সসমসাময়িক সংকট ও সম্ভাবনার প্রতি। তাই এদেশের সর্বত্র যে সব নাট্যপ্রযোজনা মঞ্চে প্রযোজিত হয় কী বিষয়ে, কী আঙ্গিক কৌশলে তা কখনো শেকড় সন্ধানী, কখনো বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক। কিন্তু যা হয় যেটুকু হয় তার সবটুকুই সচেতন ও পরিকল্পিত কর্মতৎপরতা। কখনোই তা প্রগতির বিপক্ষে দাঁড়ায় না। কখনোই তার ফল কোন অপতৎপরতা কিংবা পশ্চাৎপদতাকে প্রশ্রয় দেয় না। সেই অর্থে একটি থিয়েটার দল, একজন থিয়েটার কর্মী এক টুকরো স্বপ্নের বাংলাদেশের প্রতিনিধি বললে বাহুল্য হয় না।

এহেন শিল্পমাধ্যম এদেশে সবচে বেশি অবহেলিত, পৃষ্ঠপোষকতাহীন। এ এক ট্র্যাজেডির আখ্যান। প্রশ্ন উঠে কতজন দর্শকের কাছে পৌঁছায় থিয়েটার? এই না পৌঁছানোর দায় কেবল থিয়েটার কর্মীদের? পকেটের টাকায় নিজের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন করে থিয়েটারে নিজের মেধা ও শ্রমের সর্বোচ্চটুকু উজাড় করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘কজন দর্শক দেখে’ এই বদনামও ঘাড়ে নিতে হয় থিয়েটার কর্মীদের। যে শিল্পমাধ্যমটি পরিচালিত হয় প্রশিক্ষিত কর্মীদের দ্বারা, সৃজনশীলতা শিক্ষা এবং আদর্শের সর্বোচ্চ সংযোগ ঘটে যে শিল্পমাধ্যমে সরকার কবে উপলব্ধি করবে একে সর্বোচ্চ প্রণোদনা আর পৃষ্ঠপোষকতা করা দরকার। আমরা মাঠে ময়দানের থিয়েটারকর্মীরা সেই আশায় পথ চেয়ে রইলাম।