সবার উপরে মানুষ সত্য

বিমল গুহ

মন খারাপ হয়ে যেতে পারে সামান্য কিছুতেই। কিন্তু ভালো হতে সময় লাগে বেশি। এসবের নিয়ন্ত্রক মানুষের মন! ভালো-মন্দের যাচাই করে মানুষকে পরিচালিত করে। কখনও আমরা বলি বিবেক। আমি একবার ট্রাকের গায়ে একটা লেখা দেখে চমকে উঠেছিলাম। লেখাটি ছিল, ‘মানুষের বড় বিচারক তার বিবেক।’ সাধারণত ট্যাক্সি, রিকশা কিংবা ট্রাকের গায়ে রঙমিস্ত্রিরা কিছু না কিছু লিখে থাকেন। কিন্তু তাদের মধ্যে উন্নত মানসিকতা যে কাজ করে, এ লেখাটি তার প্রমাণ। এমনও দেখেছি, লেখা আছে ‘মায়ের দোয়া’। আরও কত কিছু। তাদের চিন্তায় সে মুহূর্তে যা আসে, কখনও তা হয় উন্নত চেতনার বহিঃপ্রকাশ!

এ যে বলা হলো, বিবেকই বড় বিচারক। কথাটা তো অনেক বড়। আমরা যে মানবাধিকারের কথা বলি, নীতির কথা বলি আর মানবিকবোধের কথা বলি- এসবের নিয়ন্ত্রক মন, মানে বিবেক অর্থাৎ এই মস্তিষ্কজাত বিবেচনা! আমরা যে সমাজে বাস করি, এই একবিংশ শতাব্দিতে সে সমাজ হবে অগ্রসর সমাজ। সেখানে মানবিকবোধ থাকবে, সহনশীলতা থাকবে, উদারতা থাকবে, সর্বোপরি ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধন থাকবে! কিন্তু তার ঘাটতি দেখতে হবে কেন এই শতাব্দিতে এসে এই সভ্য সমাজে!!

আমি ‘সভ্য সমাজ’ বলছি এ জন্য যে, এই সমাজের মানুষ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ভূখন্ডে বাস করে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এ সমাজকে চিনেছে বীরের জাতি হিসেবে। যে জাতি তার অধিকার আদায়ের জন্য রক্ত দিতে পারে, ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে নিরস্ত্র হয়েও আধুনিক যানের মুখোমুখি, বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতার বলিষ্ঠ নির্দেশে স্বাধিকার অর্জনের জন্য ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিতে পারে- সে জাতি আর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থাকতে পারে না। এই সমাজ আজ অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতেও শিখেছে। এ জাতির রয়েছে নিজস্ব মানসম্মত ভাষা, রয়েছে দিনপঞ্জিকা, রয়েছে নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি। তবুও আমরা হোঁচট খেয়ে পড়ি কেন মাঝে মাঝে?

আমরা যখন মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতের কথা ভাবি, তখন আঁতকে উঠতে হয়! যিনি যেভাবে দায়ী, তার শাস্তি সেভাবে হয়তো হবে। কিন্তু প্রশ্ন বিচারের নয়, প্রশ্ন জাতীয় অবক্ষয়ের। চেতনায় অবক্ষয় বিবেকের পচনের!! এর দায়ও একবিংশ শতাব্দির মানুষ হিসেবে আমাদের নিতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে পরবর্তী প্রজন্মর কাছে। এখনও বাসে ধর্ষণের কাহিনি শুনতে হয়, আমাদের মিডিয়ার যুগে দিনদুপুরে বরগুনায় স্ত্রীর সামনে স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করার মতো ঘটনা দেখতে হয় এ সমাজে। মুখ দেখাই কী করে পৃথিবীর মানুষের কাছে! আমরা কি দিন দিন অসভ্যতার দিকে ইউটার্ন করেছি-

এ প্রশ্ন বিবেকের কাছে আমরা করছি কি? কেউ অন্যায় করলে বিচারালয় আছে, রাষ্ট্র আছে, রাষ্ট্রের সংবিধান আছে, মানুষের অধিকার রক্ষার বিধান আছে। তা হলে কি সবই অকার্যকর বিবেচনা করতে হবে কিংবা ভাবতে হবে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানো স্পর্ধা দেখাতে শুরু করেছে এই সমাজ?

বলছিলাম ভালো-মন্দ বিচার করে মানুষের বিবেক। বিবেকবর্জিত মানুষ তো পশুর সমতুল্য? ‘বিবেক’ হলো ভালো-মন্দ, হিতাহিত বিবেচনা করার ক্ষমতা। আমরা জানি যে, এ ক্ষমতা জন্মগত এই ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা! তবে প্রাচীন মানুষেরও বিবেচনাবোধ ছিল বলে এতদূর এগোনো সম্ভব হয়েছে মানুষের পক্ষে। এখন বলি সুচিবেচনাবোধ। কারণ মানুষ এখন শিক্ষা-দীক্ষায়, প্রজ্ঞায় অনেক এগিয়ে। এ সুবিবেচনাবোধকেই আমরা বলছি মানবাধিকার। এক কথায়, প্রত্যেক মানুষের যৌক্তিক অধিকারই মানবাধিকার।

মানুষের কিছু সাধারণ বিবেচনাবোধ থাকবে- আমি বলতে চাই সুবিবেচনাবোধ। জাতিসংঘ এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৪৮ সালে সাধারণ সভায় ‘বিশ্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা’ গ্রহণ করে। এতে বলা আছে, প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে মুক্ত মানুষ এবং মানুষ হিসেবে তার মর্যাদা ও অধিকার সমান। এর অর্থ হলো, মানুষ হিসেবে জ্ঞানত কেউ কারও স্বার্থহানিকর কাজ করবে না। জাতিসংঘের সভ্য রাষ্ট্র বাংলাদেশও। আমরাও মানবাধিকার মানার জন্য জাতি হিসেবে সমাজের কাছে, সভ্যতার কাছে দায়বদ্ধ। তবুও সাম্প্রতিক কালের ঘটনা কিংবা এর আগেও এ জাতীয় যেসব অমানবিক আচরণ হয়েছে, তার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, এ লক্ষ্যে সরকার এবং পাশাপাশি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সোচ্চার হতে হবে। হতে হবে মানবাধিকারের স্বার্থে উচ্চকণ্ঠ।

যুবসমাজ আমাদের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথে চালনা করার দায়িত্বও অনেক বড়। এ জন্য দরকার সুশিক্ষা, দরকার নৈতিক শিক্ষার। তাদেরকে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, গৌরবগাথার সঙ্গে পরিচিত করানো আশু প্রয়োজন। আমরা পত্রপত্রিকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে অবক্ষয়জনিত সংবাদ পড়ি, তা যদি সত্যি হয়- তাহলে কিছু মানুষের মনোবৈকল্য যে হয়েছে, তা অনুমেয়। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিষয়ই হোক না কেন, চিকিৎসা, প্রকৌশল, বিজ্ঞান, সমাজনীতি, কলা ইত্যাদি পাঠক্রমে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, নৈতিক দর্শনের পাঠ সংযুক্ত থাকা দরকার, যা ভাবার সময় হয়েছে। কোন সুশিক্ষিত মানুষের পক্ষে নীতিহীন কাজ করা সম্ভব নয়। এর ব্যত্যয় হলে তাকে শিক্ষিত বলার অবকাশ কোথায়! আমরা প্রতিক্ষণ মহান ব্যক্তিদের স্মরণ করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করি, কাজী নজরুল ইসলামকে স্মরণ করি- এ রকম আরও অনেককে তাদের কর্মের জন্য, আলোকিত প্রজ্ঞার জন্য, মানবিক গুণাবলির জন্য। তাদের রচনা আমাদের জ্ঞানের ভান্ডার, আলোর দিশারি। আমরা আমাদের সন্তানদের বলি- তোমার পাঠ্যবই পড়ো, পাশাপাশি জ্ঞানের বইও পড়ো মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করতাম, তখন ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি জ্ঞানের বইয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়ারও পরামর্শ দিতাম। নীতিবর্জিত শিক্ষা কোন শিক্ষাই নয়। যে শিক্ষা প্রকৃত মানুষ হয়ে বড় হওয়ার পথ দেখাবে না- তা খন্ডিত শিক্ষা হয়ে থাকবে। এক সময় তা সমাজে পচন ডেকে আনবে।

আমাদের ভাবনার পুরোটা রয়েছে সুশিক্ষা আর মানবাধিকার। যা আমার কাছে যৌক্তিক- আমার বেলায় যৌক্তিক, তা যেন অন্যের বেলায়ও সমভাবে যৌক্তিক ভাবতে পারি। তা-ই মানবাধিকার। মানুষ জন্মগ্রহণ করে স্বাধীনসত্তা নিয়ে। তার ওই স্বাধীনসত্তা বা চিন্তায় কারও অনৈতিক হস্তক্ষেপকে আমরা বলছি মানবাধিকার লঙ্ঘন। সমাজের শৃঙ্খলা নষ্টের মূলে তা-ই। জাতিসংঘ সনদে উল্লেখ আছে, Everyone has the right to life, liberty and security of person. এটা একটা সাধারণ কথা। তবে প্রত্যেক মানুষের রয়েছে এতে অনিবার্য অধিকার। তারপরও একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে- আইন দিয়ে সব সময় সমাজের শৃঙ্খলা ফিরে আসে না। এ জন্য দরকার আইন উপলব্ধি করার মানসিকতা ও প্রকৃত শিক্ষা। নৈতিক দর্শন বলে- Human rights must be, at bottom, moral rather than legal rights.

মানুষ তো প্রাণিজগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও বিবেচনাবোধসম্পন্ন জীব। তারপরও নীতি থেকে বিচ্যুত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে কী করে? এমন সভ্য সমাজই আমরা কামনা করি- যে সমাজ হবে সুশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল। সমাজের প্রয়োজনে আইন থাকবে। সব মানুষের বিবেক জাগ্রত করা গেলে সমাজের বিশৃঙ্খলা দূর হবে, মানুষ হবে প্রকৃত মানুষ। বিবেক জাগিয়ে তোলার শিক্ষাই হবে আমাদের প্রত্যয়। আমরা যেন মানবিকবোধসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারি, অন্তত দাবি করতে পারি যে- মানুষই সৃষ্টির সেরা। তখন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’- এ কথার তাৎপর্য হবে যথাযথ ও অর্থবহ।

image
আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

সবার উপরে মানুষ সত্য

বিমল গুহ

image

মন খারাপ হয়ে যেতে পারে সামান্য কিছুতেই। কিন্তু ভালো হতে সময় লাগে বেশি। এসবের নিয়ন্ত্রক মানুষের মন! ভালো-মন্দের যাচাই করে মানুষকে পরিচালিত করে। কখনও আমরা বলি বিবেক। আমি একবার ট্রাকের গায়ে একটা লেখা দেখে চমকে উঠেছিলাম। লেখাটি ছিল, ‘মানুষের বড় বিচারক তার বিবেক।’ সাধারণত ট্যাক্সি, রিকশা কিংবা ট্রাকের গায়ে রঙমিস্ত্রিরা কিছু না কিছু লিখে থাকেন। কিন্তু তাদের মধ্যে উন্নত মানসিকতা যে কাজ করে, এ লেখাটি তার প্রমাণ। এমনও দেখেছি, লেখা আছে ‘মায়ের দোয়া’। আরও কত কিছু। তাদের চিন্তায় সে মুহূর্তে যা আসে, কখনও তা হয় উন্নত চেতনার বহিঃপ্রকাশ!

এ যে বলা হলো, বিবেকই বড় বিচারক। কথাটা তো অনেক বড়। আমরা যে মানবাধিকারের কথা বলি, নীতির কথা বলি আর মানবিকবোধের কথা বলি- এসবের নিয়ন্ত্রক মন, মানে বিবেক অর্থাৎ এই মস্তিষ্কজাত বিবেচনা! আমরা যে সমাজে বাস করি, এই একবিংশ শতাব্দিতে সে সমাজ হবে অগ্রসর সমাজ। সেখানে মানবিকবোধ থাকবে, সহনশীলতা থাকবে, উদারতা থাকবে, সর্বোপরি ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধন থাকবে! কিন্তু তার ঘাটতি দেখতে হবে কেন এই শতাব্দিতে এসে এই সভ্য সমাজে!!

আমি ‘সভ্য সমাজ’ বলছি এ জন্য যে, এই সমাজের মানুষ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ভূখন্ডে বাস করে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এ সমাজকে চিনেছে বীরের জাতি হিসেবে। যে জাতি তার অধিকার আদায়ের জন্য রক্ত দিতে পারে, ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে নিরস্ত্র হয়েও আধুনিক যানের মুখোমুখি, বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতার বলিষ্ঠ নির্দেশে স্বাধিকার অর্জনের জন্য ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিতে পারে- সে জাতি আর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থাকতে পারে না। এই সমাজ আজ অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতেও শিখেছে। এ জাতির রয়েছে নিজস্ব মানসম্মত ভাষা, রয়েছে দিনপঞ্জিকা, রয়েছে নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি। তবুও আমরা হোঁচট খেয়ে পড়ি কেন মাঝে মাঝে?

আমরা যখন মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতের কথা ভাবি, তখন আঁতকে উঠতে হয়! যিনি যেভাবে দায়ী, তার শাস্তি সেভাবে হয়তো হবে। কিন্তু প্রশ্ন বিচারের নয়, প্রশ্ন জাতীয় অবক্ষয়ের। চেতনায় অবক্ষয় বিবেকের পচনের!! এর দায়ও একবিংশ শতাব্দির মানুষ হিসেবে আমাদের নিতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে পরবর্তী প্রজন্মর কাছে। এখনও বাসে ধর্ষণের কাহিনি শুনতে হয়, আমাদের মিডিয়ার যুগে দিনদুপুরে বরগুনায় স্ত্রীর সামনে স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করার মতো ঘটনা দেখতে হয় এ সমাজে। মুখ দেখাই কী করে পৃথিবীর মানুষের কাছে! আমরা কি দিন দিন অসভ্যতার দিকে ইউটার্ন করেছি-

এ প্রশ্ন বিবেকের কাছে আমরা করছি কি? কেউ অন্যায় করলে বিচারালয় আছে, রাষ্ট্র আছে, রাষ্ট্রের সংবিধান আছে, মানুষের অধিকার রক্ষার বিধান আছে। তা হলে কি সবই অকার্যকর বিবেচনা করতে হবে কিংবা ভাবতে হবে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানো স্পর্ধা দেখাতে শুরু করেছে এই সমাজ?

বলছিলাম ভালো-মন্দ বিচার করে মানুষের বিবেক। বিবেকবর্জিত মানুষ তো পশুর সমতুল্য? ‘বিবেক’ হলো ভালো-মন্দ, হিতাহিত বিবেচনা করার ক্ষমতা। আমরা জানি যে, এ ক্ষমতা জন্মগত এই ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা! তবে প্রাচীন মানুষেরও বিবেচনাবোধ ছিল বলে এতদূর এগোনো সম্ভব হয়েছে মানুষের পক্ষে। এখন বলি সুচিবেচনাবোধ। কারণ মানুষ এখন শিক্ষা-দীক্ষায়, প্রজ্ঞায় অনেক এগিয়ে। এ সুবিবেচনাবোধকেই আমরা বলছি মানবাধিকার। এক কথায়, প্রত্যেক মানুষের যৌক্তিক অধিকারই মানবাধিকার।

মানুষের কিছু সাধারণ বিবেচনাবোধ থাকবে- আমি বলতে চাই সুবিবেচনাবোধ। জাতিসংঘ এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৪৮ সালে সাধারণ সভায় ‘বিশ্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা’ গ্রহণ করে। এতে বলা আছে, প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে মুক্ত মানুষ এবং মানুষ হিসেবে তার মর্যাদা ও অধিকার সমান। এর অর্থ হলো, মানুষ হিসেবে জ্ঞানত কেউ কারও স্বার্থহানিকর কাজ করবে না। জাতিসংঘের সভ্য রাষ্ট্র বাংলাদেশও। আমরাও মানবাধিকার মানার জন্য জাতি হিসেবে সমাজের কাছে, সভ্যতার কাছে দায়বদ্ধ। তবুও সাম্প্রতিক কালের ঘটনা কিংবা এর আগেও এ জাতীয় যেসব অমানবিক আচরণ হয়েছে, তার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, এ লক্ষ্যে সরকার এবং পাশাপাশি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সোচ্চার হতে হবে। হতে হবে মানবাধিকারের স্বার্থে উচ্চকণ্ঠ।

যুবসমাজ আমাদের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথে চালনা করার দায়িত্বও অনেক বড়। এ জন্য দরকার সুশিক্ষা, দরকার নৈতিক শিক্ষার। তাদেরকে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, গৌরবগাথার সঙ্গে পরিচিত করানো আশু প্রয়োজন। আমরা পত্রপত্রিকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে অবক্ষয়জনিত সংবাদ পড়ি, তা যদি সত্যি হয়- তাহলে কিছু মানুষের মনোবৈকল্য যে হয়েছে, তা অনুমেয়। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিষয়ই হোক না কেন, চিকিৎসা, প্রকৌশল, বিজ্ঞান, সমাজনীতি, কলা ইত্যাদি পাঠক্রমে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, নৈতিক দর্শনের পাঠ সংযুক্ত থাকা দরকার, যা ভাবার সময় হয়েছে। কোন সুশিক্ষিত মানুষের পক্ষে নীতিহীন কাজ করা সম্ভব নয়। এর ব্যত্যয় হলে তাকে শিক্ষিত বলার অবকাশ কোথায়! আমরা প্রতিক্ষণ মহান ব্যক্তিদের স্মরণ করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করি, কাজী নজরুল ইসলামকে স্মরণ করি- এ রকম আরও অনেককে তাদের কর্মের জন্য, আলোকিত প্রজ্ঞার জন্য, মানবিক গুণাবলির জন্য। তাদের রচনা আমাদের জ্ঞানের ভান্ডার, আলোর দিশারি। আমরা আমাদের সন্তানদের বলি- তোমার পাঠ্যবই পড়ো, পাশাপাশি জ্ঞানের বইও পড়ো মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করতাম, তখন ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি জ্ঞানের বইয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়ারও পরামর্শ দিতাম। নীতিবর্জিত শিক্ষা কোন শিক্ষাই নয়। যে শিক্ষা প্রকৃত মানুষ হয়ে বড় হওয়ার পথ দেখাবে না- তা খন্ডিত শিক্ষা হয়ে থাকবে। এক সময় তা সমাজে পচন ডেকে আনবে।

আমাদের ভাবনার পুরোটা রয়েছে সুশিক্ষা আর মানবাধিকার। যা আমার কাছে যৌক্তিক- আমার বেলায় যৌক্তিক, তা যেন অন্যের বেলায়ও সমভাবে যৌক্তিক ভাবতে পারি। তা-ই মানবাধিকার। মানুষ জন্মগ্রহণ করে স্বাধীনসত্তা নিয়ে। তার ওই স্বাধীনসত্তা বা চিন্তায় কারও অনৈতিক হস্তক্ষেপকে আমরা বলছি মানবাধিকার লঙ্ঘন। সমাজের শৃঙ্খলা নষ্টের মূলে তা-ই। জাতিসংঘ সনদে উল্লেখ আছে, Everyone has the right to life, liberty and security of person. এটা একটা সাধারণ কথা। তবে প্রত্যেক মানুষের রয়েছে এতে অনিবার্য অধিকার। তারপরও একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে- আইন দিয়ে সব সময় সমাজের শৃঙ্খলা ফিরে আসে না। এ জন্য দরকার আইন উপলব্ধি করার মানসিকতা ও প্রকৃত শিক্ষা। নৈতিক দর্শন বলে- Human rights must be, at bottom, moral rather than legal rights.

মানুষ তো প্রাণিজগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও বিবেচনাবোধসম্পন্ন জীব। তারপরও নীতি থেকে বিচ্যুত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে কী করে? এমন সভ্য সমাজই আমরা কামনা করি- যে সমাজ হবে সুশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল। সমাজের প্রয়োজনে আইন থাকবে। সব মানুষের বিবেক জাগ্রত করা গেলে সমাজের বিশৃঙ্খলা দূর হবে, মানুষ হবে প্রকৃত মানুষ। বিবেক জাগিয়ে তোলার শিক্ষাই হবে আমাদের প্রত্যয়। আমরা যেন মানবিকবোধসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারি, অন্তত দাবি করতে পারি যে- মানুষই সৃষ্টির সেরা। তখন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’- এ কথার তাৎপর্য হবে যথাযথ ও অর্থবহ।