নারীর অধিকার ও সচেতনতা

ফেরদৌসী খানম লাকী

আমরা যারা নারী কখনো কি ভেবে দেখেছি আমাদের অধিকার বলে কিছু আছে কিনা? অধিকার কী? আদৌ আমরা জানি কিনা? পত্রিকার পাতায় পাতায় যখন দেখি “নারীনেত্রী”গণ অধিকার আদায়ে সোচ্চার তখন মনে হয়, আসলে তা শুধু রাস্তায় বক্তৃতার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নাকি অধিকার কী তা কেন কী করে আদায় করতে হবে তা জানাটাও জরুরি?

একটি পরিবারে যখন ভাইবোন পাশাপাশি বেড়ে ওঠে তখন দেখা যায় বাঙালি বেশিরভাগ পরিবারেই ছেলে সন্তানটির প্রতি যত্নশীল হয়। তার খাওয়া, পড়া, বিভিন্ন চাহিদা মেটাবার আগ্রহ বেশি থাকে। তার পাশে যে মেয়েটি রয়েছে তার সঙ্গে প্রচ্ছন্ন অবহেলা থেকেই থাকে। অথচ একটি পরিবারে ছেলেমেয়ের চাহিদা বা অধিকার একই থাকা উচিত। বাবা, মাকে এই বিষয়ে আরও সজাগ থাকতে হবে। আবার দেখা যায় কোন কোন পরিবারে ছেলেটিকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার আপ্রাণ চেষ্টা থাকে আর মেয়েটিকে কোন রকমে স্কুল গন্ডি কিংবা এইচএসসি পাস করিয়ে “বিয়ে” দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে যেতে। মনে হয় পরিবারে সে বোঝা স্বরূপ। কোন রকমে অন্যের দায়িত্বে গছিয়ে দিতে পারলেই দায় শেষ। অথচ বাবা/মা ভেবে দেখে না মেয়েটিকে উচ্চশিক্ষিত করলে সেও ছেলেটির মতোই মাথা উঁচু করে সমাজে বাস করতে পারবে “পরনির্ভরশীল” না হয়ে।

এরপর বিয়ের পর আসে মেয়েটির জীবনের নানা পরিবর্তন। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে তাল মিলিয়ে নিতে হয় নানা প্রতিকূলতা। সেই প্রতিকূলতার সঙ্গে সঙ্গে তার অধিকার বিষয়টি অনেকাংশেই হারিয়ে যায় একটা ঘূর্ণিপাকে। নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় বাস্তবতার কঠিনতায়। তখন নারীটির আর একান্ত নিজস্ব ভাবনা থাকে না। পরিবারের সব সদস্যদের নিয়েই আলাদা এক জগৎ গড়ে ওঠে আর তার অধিকারটি কী সেটা চাপা পড়ে যায় নানা দায়িত্বের কারণে। তবে সংসারের কোন একটি বিষয় নিয়ে কিছু ব্যত্যয় ঘটলেই এই “অধিকার” বিষয়টি সামনে চলে আসে। তখন মনে হয়, তার যে পাওনা সে কী সঠিকভাবে পাচ্ছে?

মানবজাতির অর্ধেক নারী হয়েও নানা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তেমন বৈষম্য কমে আসেনি। আমরা আজো “পুরুষতান্ত্রিক” সামাজিক অনুশাসনিক “বেড়াজালে” আবদ্ধ। যেমন বাবার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের “অসম” অধিকার, পারিবারিক আইনে নারীর অসম অধিকার, জাতীয় সম্পদে নারীর অসম অধিকার, যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীকে উপেক্ষা করাই নারীর অধিকারে হস্তক্ষেপ করার শামিল। পরিবারের গার্হস্থ্য জীবনের চৌহদ্দিতে আবদ্ধ যে নারী তার কাজের কোন স্বীকৃতি নেই। অথচ সংসারের মূল প্রাণ এই “নারী” অথচ নানা সীমাবদ্ধতায় অধিকারের প্রশ্নটি হয়ে যায় ম্লান। যেন আজীবন তার “ত্যাগ” বিষয়টিই হয়ে যায় “অধিকার” নামক শব্দটির প্রতিশব্দ।

সারা বিশ্বের পরিবারগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে শুধু শহর নয়, গ্রামীণ নারীদের অবদান অনস্বীকার্য, কারণ তাদের হস্তশিল্প বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখে। কিন্তু “অর্ধমজুরী” কিংবা “মজুরীবিহীন” কাজ তার অধিকারে ব্যত্যয় ঘটায়। একজন পুরুষ শ্রমিক কিংবা নারী শ্রমিকের মজুরি একই হওয়া উচিত হলেও বাস্তবে তার তারতম্য নারীটির অধিকারকে খর্ব করা হয়- যা ন্যক্কারজনক শুধু নয়, এটাকে প্রহসনও বলা যায়।

আমাদের সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার রয়েছে। ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা। ২৮ (১) অনুচ্ছেদে কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যে প্রদর্শন না করা এবং ২৮ (২) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র ও গণ-জীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের “সমান অধিকার” লাভ করার অঙ্গিকার করা রয়েছে। তারপরও এদেশে এখনও নারীরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত অনেকাংশেই।

অধিকার শুধু অর্থনৈতিক নয়, এখানে নারীর দৈহিক ও মানসিক নিপীড়ন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করাও তার অধিকার খর্ব করা বোঝায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে নিজ পরিবারের কাছ থেকেই প্রথমত অধিকার বঞ্চিত হতে থাকেন নারীরা। আর তাই বিবাহপরবর্তী যে জীবন তাতে সে “অধিকার বঞ্চিত” হবে সেটাই সে স্বাভাবিক ধরে নিয়ে জীবন চালাতে অভ্যস্থ হন শুধুমাত্র “শান্তি” পাওয়ার আশায়। কিন্তু সে শান্তি কি আদৌ পায়? যদি কখনো সে প্রতিবাদী হয় তখন তার এই ত্যাগ মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়, নেমে আসে নিপীড়ন। যেটা পরিবারের কর্তাব্যক্তিই হোন বা কোন সদস্য। ঠিক তেমনি কর্মক্ষেত্রে প্রতিবাদী নারীর দুর্নামও কম নয় মুখরা হিসেবে। আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে চলে নানা কুটিলতা, আর জটিলতা দেখা দেয় তার অবস্থানে। তবুও যিনি “অধিকার” সচেতন তিনি এসব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন অনায়াসে।

শুধু এ যুগেই নয়, আদিম বর্বর যুগেও নারীরা অহেতুক “অপবাদ” থেকে রেহাই পায়নি। অধিকারের প্রশ্ন এলেই কেউ কেউ তুমুল “নারি বিদ্বেষী” হয়ে ওঠেন এবং তার চরিত্রে কালিমালেপন করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। কারণ নারী চরিত্রের দোষ দেওয়া খুবই সহজ ব্যাপার আজকাল। যেখানে নারী/পুরুষ পাশাপাশি কাজ করেন সেখানে নানাভাবে নানা পরিস্থিতিতে অহেতুক ঝামেলা আসতেই পারে। আর যিনি সচেতন তিনি তা কাটিয়ে উঠতেও পারেন। এ ধরনের মানসিক নির্যাতন একজন নারীর জন্য তার অধিকার খর্ব করার শামিল। তাই অযথা “কান কথা” বা “উড়ো খবরে” কান দেওয়া কোন সুসভ্য সমাজের সদস্যদের অনুচিত। আর তা এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। যে নারী বাইরে কাজ করেন তার উচিত তার কাজকেই সর্বপ্রথম গুরুত্ব দেওয়া।

অনেকেই বলবেন “পুরুষতান্ত্রিক” সমাজে শুধু পুরুষরাই নারীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে? নারীরা করছে না? আমি বলবো, হ্যাঁ করছে। তারা পুরুষের আজ্ঞাবহ বৈ কিছু নয়। তারা নিজেরাও জানে না তাদের অবস্থান কী? শিক্ষার অভাবেই তা হয়ে থকে। তারা শুধু অনুকরণ করতেই অভ্যস্থ অনুসরণ নয়। যে নারী সচেতন তিনি কোন অবস্থাতেই নারীর ক্ষতি করার চিন্তাই করেন না বরং তাকে সচেতন করার চেষ্টা থাকে কীভাবে ঐ নারীর “অধিকার” কতটুকু তা বোঝানো।

আজ আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের বাসিন্দা হয়েও অনেকেই বুঝতে চাই না যে, উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে নারী ও পুরুষ পরস্পর পাশাপাশি এগিয়ে না গেলে একটি রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই উন্নয়নের জন্য “নারীর” অধিকারগুলো মেনে নেওয়া, বৈষম্য দূর করা একান্ত প্রয়োজন। যারা মনে করেন “বল” প্রয়োগ করে “নারী”কে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায়, তবে তারা ভুলের রাজ্যে বাস করছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর বৈষম্য নিরসন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় নারী শিক্ষার বিকল্প নেই। একজন নারী যেন “বিয়ে” করার জন্য শিক্ষিত না হয়ে ওঠেন; তিনি যেন তার পরিবার, দেশ সমগ্রতাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের একটি পরিচয় তুলে ধরার প্রয়াস পান- সেভাবেই নিজেকে গড়ে তোলা উচিত। নিজে শিক্ষিত পরিবার শিক্ষিত। সেখানে যেন শুধু ঘর সামলানোর কাজটিই না করতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে জীবনের প্রয়োজনে বাধা, পারিপার্শ্বিকতা সব কিছুকে উপেক্ষা করেই এগুতে হবে নিজের মূল অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। জীবন ছোট তাই এই একটি ছোট জীবন যেন হয় মূল্যবান অর্থবহ। পরমুখাপেক্ষী নয়, নিজের সাহস, যোগ্যতা দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকারকে পাকাপোক্ত করে নিতে হবে। আর অন্যদেরও সেভাবেই গড়ে তোলার মানসিকতা থাকতে হবে। তবেই হবে নারী জনম সার্থক।

আধুনিক বিশ্বে নারী পুরুষের অধিকার অভিন্ন। তাই সর্বপ্রথম পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে নারী অধিকার প্রয়োগে। রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর জন্য যে সকল সুবিধাধি দেওয়া হয়েছে সে সমন্ধে সচেতনতা জরুরি। শিক্ষা সম্প্রসারে রাষ্ট্র যে নারীদের বিরাট সুযোগ করে দিয়েছে তা গ্রহণ করা অধিকার গ্রহণ করাই বোঝায়। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, কুসংস্কার কাটিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চাই শিক্ষা। অন্তরচক্ষুকে খুলে দিতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সেই শিক্ষাই পথ দেখাবে নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার। “উৎকট আধুনিকতা” যেন তার পথকে পিচ্ছিল না করে তার অধিকার আদায় করতে গিয়ে। আরো মনে রাখতে হবে একজন নারী শুধু নারীই নয়, তার রয়েছে বিভিন্ন সম্মানজনক পরিচয়। তিনি একজন মেয়ে, বোন, বধূ, মা। এই সম্মানিত সম্পর্কগুলো যেন অসম্মানিত কোন ব্যক্তির কারণে হারিয়ে না যায়, সেই সচেতনাটুকু একটি অধিকারের পর্যায়ে পড়ে।

পরিশেষে, পৃথিবীতে আমরা চাই একটি সুন্দর সমাজব্যবস্থা। যেখানে নারী/পুরুষ সম্মানজনকভাবে পাশাপাশি সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। আজ অনেক অধিকার নিয়েই সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তবে আমি আশাবাদী এমন দিন আসবে যে পথ আজ সংকটময় ভবিষ্যতে সে পথ হবে মসৃণ।

image

শিল্পী : সৈয়দ জাহাঙ্গীর

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

নারীর অধিকার ও সচেতনতা

ফেরদৌসী খানম লাকী

image

শিল্পী : সৈয়দ জাহাঙ্গীর

আমরা যারা নারী কখনো কি ভেবে দেখেছি আমাদের অধিকার বলে কিছু আছে কিনা? অধিকার কী? আদৌ আমরা জানি কিনা? পত্রিকার পাতায় পাতায় যখন দেখি “নারীনেত্রী”গণ অধিকার আদায়ে সোচ্চার তখন মনে হয়, আসলে তা শুধু রাস্তায় বক্তৃতার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নাকি অধিকার কী তা কেন কী করে আদায় করতে হবে তা জানাটাও জরুরি?

একটি পরিবারে যখন ভাইবোন পাশাপাশি বেড়ে ওঠে তখন দেখা যায় বাঙালি বেশিরভাগ পরিবারেই ছেলে সন্তানটির প্রতি যত্নশীল হয়। তার খাওয়া, পড়া, বিভিন্ন চাহিদা মেটাবার আগ্রহ বেশি থাকে। তার পাশে যে মেয়েটি রয়েছে তার সঙ্গে প্রচ্ছন্ন অবহেলা থেকেই থাকে। অথচ একটি পরিবারে ছেলেমেয়ের চাহিদা বা অধিকার একই থাকা উচিত। বাবা, মাকে এই বিষয়ে আরও সজাগ থাকতে হবে। আবার দেখা যায় কোন কোন পরিবারে ছেলেটিকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার আপ্রাণ চেষ্টা থাকে আর মেয়েটিকে কোন রকমে স্কুল গন্ডি কিংবা এইচএসসি পাস করিয়ে “বিয়ে” দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে যেতে। মনে হয় পরিবারে সে বোঝা স্বরূপ। কোন রকমে অন্যের দায়িত্বে গছিয়ে দিতে পারলেই দায় শেষ। অথচ বাবা/মা ভেবে দেখে না মেয়েটিকে উচ্চশিক্ষিত করলে সেও ছেলেটির মতোই মাথা উঁচু করে সমাজে বাস করতে পারবে “পরনির্ভরশীল” না হয়ে।

এরপর বিয়ের পর আসে মেয়েটির জীবনের নানা পরিবর্তন। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে তাল মিলিয়ে নিতে হয় নানা প্রতিকূলতা। সেই প্রতিকূলতার সঙ্গে সঙ্গে তার অধিকার বিষয়টি অনেকাংশেই হারিয়ে যায় একটা ঘূর্ণিপাকে। নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় বাস্তবতার কঠিনতায়। তখন নারীটির আর একান্ত নিজস্ব ভাবনা থাকে না। পরিবারের সব সদস্যদের নিয়েই আলাদা এক জগৎ গড়ে ওঠে আর তার অধিকারটি কী সেটা চাপা পড়ে যায় নানা দায়িত্বের কারণে। তবে সংসারের কোন একটি বিষয় নিয়ে কিছু ব্যত্যয় ঘটলেই এই “অধিকার” বিষয়টি সামনে চলে আসে। তখন মনে হয়, তার যে পাওনা সে কী সঠিকভাবে পাচ্ছে?

মানবজাতির অর্ধেক নারী হয়েও নানা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তেমন বৈষম্য কমে আসেনি। আমরা আজো “পুরুষতান্ত্রিক” সামাজিক অনুশাসনিক “বেড়াজালে” আবদ্ধ। যেমন বাবার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের “অসম” অধিকার, পারিবারিক আইনে নারীর অসম অধিকার, জাতীয় সম্পদে নারীর অসম অধিকার, যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীকে উপেক্ষা করাই নারীর অধিকারে হস্তক্ষেপ করার শামিল। পরিবারের গার্হস্থ্য জীবনের চৌহদ্দিতে আবদ্ধ যে নারী তার কাজের কোন স্বীকৃতি নেই। অথচ সংসারের মূল প্রাণ এই “নারী” অথচ নানা সীমাবদ্ধতায় অধিকারের প্রশ্নটি হয়ে যায় ম্লান। যেন আজীবন তার “ত্যাগ” বিষয়টিই হয়ে যায় “অধিকার” নামক শব্দটির প্রতিশব্দ।

সারা বিশ্বের পরিবারগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে শুধু শহর নয়, গ্রামীণ নারীদের অবদান অনস্বীকার্য, কারণ তাদের হস্তশিল্প বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখে। কিন্তু “অর্ধমজুরী” কিংবা “মজুরীবিহীন” কাজ তার অধিকারে ব্যত্যয় ঘটায়। একজন পুরুষ শ্রমিক কিংবা নারী শ্রমিকের মজুরি একই হওয়া উচিত হলেও বাস্তবে তার তারতম্য নারীটির অধিকারকে খর্ব করা হয়- যা ন্যক্কারজনক শুধু নয়, এটাকে প্রহসনও বলা যায়।

আমাদের সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার রয়েছে। ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা। ২৮ (১) অনুচ্ছেদে কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যে প্রদর্শন না করা এবং ২৮ (২) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র ও গণ-জীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের “সমান অধিকার” লাভ করার অঙ্গিকার করা রয়েছে। তারপরও এদেশে এখনও নারীরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত অনেকাংশেই।

অধিকার শুধু অর্থনৈতিক নয়, এখানে নারীর দৈহিক ও মানসিক নিপীড়ন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করাও তার অধিকার খর্ব করা বোঝায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে নিজ পরিবারের কাছ থেকেই প্রথমত অধিকার বঞ্চিত হতে থাকেন নারীরা। আর তাই বিবাহপরবর্তী যে জীবন তাতে সে “অধিকার বঞ্চিত” হবে সেটাই সে স্বাভাবিক ধরে নিয়ে জীবন চালাতে অভ্যস্থ হন শুধুমাত্র “শান্তি” পাওয়ার আশায়। কিন্তু সে শান্তি কি আদৌ পায়? যদি কখনো সে প্রতিবাদী হয় তখন তার এই ত্যাগ মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়, নেমে আসে নিপীড়ন। যেটা পরিবারের কর্তাব্যক্তিই হোন বা কোন সদস্য। ঠিক তেমনি কর্মক্ষেত্রে প্রতিবাদী নারীর দুর্নামও কম নয় মুখরা হিসেবে। আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে চলে নানা কুটিলতা, আর জটিলতা দেখা দেয় তার অবস্থানে। তবুও যিনি “অধিকার” সচেতন তিনি এসব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন অনায়াসে।

শুধু এ যুগেই নয়, আদিম বর্বর যুগেও নারীরা অহেতুক “অপবাদ” থেকে রেহাই পায়নি। অধিকারের প্রশ্ন এলেই কেউ কেউ তুমুল “নারি বিদ্বেষী” হয়ে ওঠেন এবং তার চরিত্রে কালিমালেপন করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। কারণ নারী চরিত্রের দোষ দেওয়া খুবই সহজ ব্যাপার আজকাল। যেখানে নারী/পুরুষ পাশাপাশি কাজ করেন সেখানে নানাভাবে নানা পরিস্থিতিতে অহেতুক ঝামেলা আসতেই পারে। আর যিনি সচেতন তিনি তা কাটিয়ে উঠতেও পারেন। এ ধরনের মানসিক নির্যাতন একজন নারীর জন্য তার অধিকার খর্ব করার শামিল। তাই অযথা “কান কথা” বা “উড়ো খবরে” কান দেওয়া কোন সুসভ্য সমাজের সদস্যদের অনুচিত। আর তা এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। যে নারী বাইরে কাজ করেন তার উচিত তার কাজকেই সর্বপ্রথম গুরুত্ব দেওয়া।

অনেকেই বলবেন “পুরুষতান্ত্রিক” সমাজে শুধু পুরুষরাই নারীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে? নারীরা করছে না? আমি বলবো, হ্যাঁ করছে। তারা পুরুষের আজ্ঞাবহ বৈ কিছু নয়। তারা নিজেরাও জানে না তাদের অবস্থান কী? শিক্ষার অভাবেই তা হয়ে থকে। তারা শুধু অনুকরণ করতেই অভ্যস্থ অনুসরণ নয়। যে নারী সচেতন তিনি কোন অবস্থাতেই নারীর ক্ষতি করার চিন্তাই করেন না বরং তাকে সচেতন করার চেষ্টা থাকে কীভাবে ঐ নারীর “অধিকার” কতটুকু তা বোঝানো।

আজ আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের বাসিন্দা হয়েও অনেকেই বুঝতে চাই না যে, উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে নারী ও পুরুষ পরস্পর পাশাপাশি এগিয়ে না গেলে একটি রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই উন্নয়নের জন্য “নারীর” অধিকারগুলো মেনে নেওয়া, বৈষম্য দূর করা একান্ত প্রয়োজন। যারা মনে করেন “বল” প্রয়োগ করে “নারী”কে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায়, তবে তারা ভুলের রাজ্যে বাস করছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর বৈষম্য নিরসন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় নারী শিক্ষার বিকল্প নেই। একজন নারী যেন “বিয়ে” করার জন্য শিক্ষিত না হয়ে ওঠেন; তিনি যেন তার পরিবার, দেশ সমগ্রতাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের একটি পরিচয় তুলে ধরার প্রয়াস পান- সেভাবেই নিজেকে গড়ে তোলা উচিত। নিজে শিক্ষিত পরিবার শিক্ষিত। সেখানে যেন শুধু ঘর সামলানোর কাজটিই না করতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে জীবনের প্রয়োজনে বাধা, পারিপার্শ্বিকতা সব কিছুকে উপেক্ষা করেই এগুতে হবে নিজের মূল অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। জীবন ছোট তাই এই একটি ছোট জীবন যেন হয় মূল্যবান অর্থবহ। পরমুখাপেক্ষী নয়, নিজের সাহস, যোগ্যতা দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকারকে পাকাপোক্ত করে নিতে হবে। আর অন্যদেরও সেভাবেই গড়ে তোলার মানসিকতা থাকতে হবে। তবেই হবে নারী জনম সার্থক।

আধুনিক বিশ্বে নারী পুরুষের অধিকার অভিন্ন। তাই সর্বপ্রথম পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে নারী অধিকার প্রয়োগে। রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর জন্য যে সকল সুবিধাধি দেওয়া হয়েছে সে সমন্ধে সচেতনতা জরুরি। শিক্ষা সম্প্রসারে রাষ্ট্র যে নারীদের বিরাট সুযোগ করে দিয়েছে তা গ্রহণ করা অধিকার গ্রহণ করাই বোঝায়। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, কুসংস্কার কাটিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চাই শিক্ষা। অন্তরচক্ষুকে খুলে দিতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সেই শিক্ষাই পথ দেখাবে নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার। “উৎকট আধুনিকতা” যেন তার পথকে পিচ্ছিল না করে তার অধিকার আদায় করতে গিয়ে। আরো মনে রাখতে হবে একজন নারী শুধু নারীই নয়, তার রয়েছে বিভিন্ন সম্মানজনক পরিচয়। তিনি একজন মেয়ে, বোন, বধূ, মা। এই সম্মানিত সম্পর্কগুলো যেন অসম্মানিত কোন ব্যক্তির কারণে হারিয়ে না যায়, সেই সচেতনাটুকু একটি অধিকারের পর্যায়ে পড়ে।

পরিশেষে, পৃথিবীতে আমরা চাই একটি সুন্দর সমাজব্যবস্থা। যেখানে নারী/পুরুষ সম্মানজনকভাবে পাশাপাশি সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। আজ অনেক অধিকার নিয়েই সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তবে আমি আশাবাদী এমন দিন আসবে যে পথ আজ সংকটময় ভবিষ্যতে সে পথ হবে মসৃণ।