নারী ও তার বিধাতা পুরুষ

জহিরুল হক

নারী-পুরুষের মধ্যে পৃথিবীর সর্বত্র কমবেশি শক্তির আধিপত্য ও অধীনতার সম্পর্ক বিরাজমান। এ সম্পর্ককে ‘সম্পর্ক’ না বলে বলা যায়- জেন্ডার বা লিঙ্গবৈষম্য। প্রাথমিকভাবে এ ভূভাগে বৈষম্যের সূত্রপাত পরিবার থেকে। একটি শিশুর জন্মের আগে থেকে পরিবারের সদস্যরা এ বৈষম্য শুরু করে। অনাগত শিশুটির জেন্ডার সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে এ বৈষম্যের সৃষ্টি। বর্তমানে নারীর গর্ভের সন্তানটি মেয়ে না ছেলে আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে তা বোঝার সহজ উপায় আছে। নারীর গর্ভের সন্তানটি যদি মেয়ে হয়, তাহলে অধিকাংশ নারী অখুশি হয়। কারণ ওই নারীরা দেখেছে, সমাজে তাদের অধিকার কী! আর এ ক্ষেত্রে পুরুষ তো অখুশি হয়ই। শিক্ষিত পুরুষ মুখে হয়তো বলে- মেয়ে বা ছেলে উভয়ই সমান কিন্তু অন্তরে ধারণ করে এ কথা- ‘আহ্! যদি একটি ছেলে হতো...!’ স্বামী কর্তৃক নারী কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো মনে মনে বিদ্বেষের শিকার হয়। পরিবারের অন্যরাও নারীর কন্যাসন্তান জন্মের সম্ভাবনাকে সুখকরভাবে নেয় না।

কন্যাসন্তানটি জন্ম নেবার পর ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে উঠতে পরিবারের ও সমাজের অবহেলার শিকার হয়। একটি পুত্রসন্তানকে পরিবারে ও সমাজে যেভাবে জোরে কথা বলতে বা যে কোনো সময় যে কারও সঙ্গে কথা বলতে ও যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে বেড়াবার সুযোগ দেওয়া হয়, কন্যা সন্তানটিকে সেভাবে কথা বলতে কিংবা বেড়াবার সুযোগ দেওয়া হয় না। একটু বড়ো হলেই মা তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। যখন ওই পরিবারে আরেকটি সন্তান অর্থাৎ পুত্র জন্ম নেয়, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা-মা’র আর আনন্দের শেষ থাকে না। কারণ, বংশের উত্তারাধিকারী সৃষ্টি হয়ে গেল।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা ছেলেদের মতো উত্তারাধিকারী হয় না। পরিবারে ছেলেটি মেয়েটির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। তা খাবার বেলায় হোক, জামা-কাপড় পরার বেলায় হোক, চলা-ফেরার স্বাধীনতার ব্যাপারে হোক- সব সময় ছেলেটি আগে। ছেলেটি বাইরে খেলাধুলা, নানা জায়গায় চলাফেরার মধ্য দিয়ে শারীরিক-মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে পারলেও মেয়েটি পেছনে পড়ে যায়। সমাজের আর দশটি পরিবারের মেয়েদের দেখে মেয়েটি বুঝতে পারে- সে মেয়ে, তার জীবন ছেলেদের মতো স্বাধীন নয়। আবার ছেলেটি বড়ো হলে পরিবারে ও বোনটির ওপরে প্রাধান্য বিস্তার করে।

শৈশবে বাবা-মা মেয়েটিকে শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শ্লীলতা-অশ্লীলতা শিক্ষা দেয়। বাবা-মা বা পরিবারের কোনো সদস্য মেয়েটিকে বলে, ‘এই মেয়ে তুমি ন্যাংটা কেন, প্যান্ট পর।’ মেয়েটির প্রতি এই যে শিক্ষা তা-ও জেন্ডার বৈষম্যের কারণ। প্রকৃতপক্ষে উভয় শিশুকেই এ কথা বলা উচিত। কিন্তু ছেলে শিশুটি এ ক্ষেত্রে কম গুরুত্ব পায়। অন্যদিকে মেয়েটিকে আরোপিত শিক্ষায় লজ্জায় ফেলে দেওয়া হয়। সে বুঝতে পারে, তার শরীরের কোনো প্রত্যঙ্গ খারাপ, যা মানুষের মধ্যে দেখানো উচিত নয়। এভাবে বলে মেয়েটিকে ছোট করা হয়। সে ছেলেটি থেকে নিজেকে আলাদা ভাবতে শুরু করে। অথচ ছেলেটি ন্যাংটা হয়ে বাড়ির সর্বত্র ঘুরে বেড়ালেও বাবা-মা কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের কারো পবিত্রতা নষ্ট হয় না। কিংবা কারো কাছে দৃষ্টিকটু লাগে না। কোনো অবস্থাতেই শিশুদের আরোপিত শিক্ষায় নৈতিকতা শেখানো উচিত নয়। নৈতিকতা শিশুরা বড়ো হতে হতে নিজে থেকেই শিখবে।

মেয়েটি যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করে, তখন প্রাথমিকভাবে অন্যদের সহায়তায় স্কুলে যায়। কিন্তু একটু বড় হয়ে যখন সে একাকী পথ চলতে শুরু করে, তখন অধিক জনসংখ্যা ও বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে রাস্তা-ঘাট, শপিং মলে হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকা সমাজের আর দশটা পরিবারের অপদার্থ ছেলেদের বা অসম্মানজনকভাবে জোরজবরদস্তি করে সবকিছু অর্জন করার মানসিকতাসম্পন্ন বখাটেদের নানা কটূক্তি ও কনুয়ের খোঁচা, বা হাতের স্পর্শ নিয়েই তাকে চলতে হয়। কোনো মেয়ে ছেলেদের এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করলে তাকে কটূক্তি শুনতে হয় বা নির্যাতিত হতে হয়। একটি মেয়ে যখন রাস্তায় হাঁটে তখন রাস্তার কোনো ছেলেকে কখনো কখনো দেখা যায় তার পেছনে পেছনে কিংবা সমান্তরালে হাঁটতে। কেউ যদি পরীক্ষামূলকভাবে একটি মেয়ের রাস্তায় চলাচলের সময় তার অবস্থাটি বোঝার জন্য কোনো ছেলে বা কোনো বয়স্ক পুরুষদের দিকে দৃষ্টি দেয়, তাহলেই বুঝতে পারবে যে কী পরিমাণ চোখ মেয়েটির দিকে পড়ছে! এসব চোখের দৃষ্টির মধ্যে বেশিরভাগেরই থাকে ক্ষুধা বা কোনো না কোনো অশ্লীল ইঙ্গিত! এভাবে বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় বা প্রাথমিক পেরিয়ে মেয়েটি যখন মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে, তখন কখনো তার সহপাঠী বা কখনো কোনো চরিত্রহীন শিক্ষাদাতা কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়। কোনো কোনো মেয়ে ছেলেদের উত্ত্যক্তকরণের কারণে বাধ্য হয়ে প্রেমে পড়ে নিজের নির্যাতনের পথ ত্বরান্বিত করে দেয়। প্রেমের ক্ষেত্রে নির্যাতিত মেয়েরাই বেশি হয়। কখনো কখনো ছেলেদের নির্যাতনে পড়ে মেয়েদের জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যায়।

বাইরে চলাফেরার সময় ছেলেরা যে কোনো পোশাক পরতে পারে কিন্তু একটি বড়ো মেয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিংবা বহির্বিশ্বের নারীদের অনুকরণে নতুন ডিজাইনের কোনো পোশাক পরলেই ছেলেদের দ্বারা নানা কটূক্তির শিকার হয়। কখনো কখনো এমনও দেখা যায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বুদ্ধিজীবী নামধারী কলাম লেখকেরা দ্বিতীয় লিঙ্গকে কালো কাপড়ে বন্দি করতে ইচ্ছুক শাস্ত্রান্ধদের মানসিকতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে মেয়েদের পোশাক নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। কে কী পরবে, সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। অথচ তাঁরা ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে মেয়েদের পোশাক পরা সম্পর্কে উপদেশ দিলেও বর্তমান কালে ছেলেদের পশ্চাৎভাগের কাপড় যে নিচে ঝুলে থাকে সেদিকে চোখ পড়লেও ছেলেরা পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি বলে স্বজাতির গ্লানি লুকিয়ে রেখে কোনো কথা বলেন না। অতএব নারীর কী পরা উচিত, বা উচিত নয় বা কী করা উচিত, বা উচিত নয়, সে পরামর্শ দেওয়া পুরুষের উচিত নয়। কারণ, পুরুষের ওইসব পরামর্শের মধ্যেও আছে জেন্ডার বৈষম্য।

নারীর প্রতি যৌনতার নীরব সন্ত্রাস শুরু হয় বিয়ের আগে থেকে। বিয়েতে সুন্দর ও অসুন্দর মেয়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। সুন্দরীকে নিয়ে সমাজের শক্তিমান পুরুষেরা টানাটানি করলেও অসুন্দরী বৈষম্যের শিকার হয়। বিয়েতে যৌতুকও একটি অপমানজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যৌতুক একটি মারাত্মক জেন্ডার বৈষম্য। যার মাধ্যমে নারীকে ছোট করা হয়। স্কুলে বা কলেজে পড়ার সময় মেয়েদের বিয়ে হলে অধিকাংশক্ষেত্রেই তারা পুরোপুরিই স্বাধীনতা হারিয়ে ভারবাহী পশুতে পরিণত হয়। তা শুধু স্কুল বা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় কিংবা লেখাপড়ার পরেও যখন বিয়ে হয়, তখন থেকেই মেয়েটি পুরোপুরি স্বাধীনতা হারায়। বাবার বাড়িতে মেয়েটি যে স্বাধীনতা নিয়ে উচ্ছল-উজ্জ্বল তরুণী হিসেবে বেড়ে উঠেছিল, সেই স্বাধীনতা তার আর থাকে না। স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ি তার ওপরে নানারকম কর্তৃত্ব ফলাতে থাকে। বিয়ের পরে ছেলেদের নিজস্ব পরিবেশ বজায় থাকলেও মেয়েরা এক ধরনের বন্দি জীবন নিয়ে শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা বাবা-মায়ের বাড়ি ছেড়ে চলে যায় অন্য ঠিকানায়! এ যে কতো বড়ো ত্যাগ তা ভাষায়ই প্রকাশ করা যায় না!

বিবাহিত জীবনে ছেলেরা একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক করলেও স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক টিকে থাকে। তেমন কোনো লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয় না। কিন্তু কোনো বিবাহিত নারী কোনো ছেলে বা পরপুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করা তো দূরে থাক, চাকরিস্থলের কোনো সহকর্মীর সঙ্গে ফোনে কথা বললেও নানা সন্দেহ থেকে কখনোবা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভেঙে যাবার উপক্রম হয়। ছেলেরা একাধিক মেয়ের সঙ্গে যৌনতা করেও পবিত্র থেকে যাকে। অথচ নারীর চরিত্র ছেলেদের কাছে অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আর এ কথায় কোনো স্বামী নামধারী পুরুষ দ্বিমত পোষণ করলেও বলতে হয়, মানুষ অনবরত কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বাঁচতে পারে না। সংসার জীবনের আনন্দ ও বেদনার ঘানি টানতে টানতে প্রত্যেককেই ডানে-বামে একটু শ্বাস-নিঃশ্বাস ফেলতে কিংবা তাকাতেই হয়। পুরুষকে সন্দেহ করে নারী কিছুই করতে পারে না, কিন্তু নারীর এই ডানে-বামে তাকানোকে কোনো পুরুষই সুখকরভাবে নেয় না।

নারী-পুরুষের নামকরণের ক্ষেত্রেও বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। বিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্ত্রীর নামের শেষে স্বামী নিজের নামটি লাগিয়ে দেয়। আর এ নিয়ে স্বামীরই আগ্রহ থাকে বেশি। বাবা কর্তৃক দেওয়া নাম অধিকাংশ স্বামীই রাখে না। যেমন কারো বাবার দেওয়া নাম যদি থাকে-সাবরিনা হক, আর স্বামীর নাম যদি থাকে-জাকির হোসেন, তখন স্বামী তাঁর নামটি স্ত্রীর নামের শেষে যোগ করে দিয়ে করে-সাবরিনা হোসেন। আমি মনে করি এটা নারীকে আটকানোর একটা পুরুষতান্ত্রিতক হীন মানসিকতা। যা নারীরা সংসার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মেনে নেয়। তাছাড়া, আমাদের দেশে এই সেদিনও কোনো মানুষের নাগরিকত্ব সনদ নিতে গেলে, পাসপোর্ট করতে গেলে, পরীক্ষা কিংবা চাকরির দরখাস্ত দিতে গেলে শুধু বাবার নাম লিখতে হতো, মায়ের নাম লেখার প্রয়োজন পড়ত না। এটা একটি অমানবিক পুরুষতান্ত্রিক ব্যাপার ছিল। বর্তমানে সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম লেখা হয়। আমি মনে করি, সন্তান জন্ম ও লালন-পালনে মায়ের যে ভূমিকা, তাতে মায়ের নাম বাবার নামের আগে থাকা উচিত। আবার বাবারা যখন মেয়ের নাম রাখে, তখন মেয়ের নামকরণের ক্ষেত্রে মায়ের চেয়ে বাবার কর্তৃত্বই বেশি প্রকাশ পায়। বাবা নিজের নামের অংশ জুড়ে দেয় মেয়ের নামের সঙ্গে। কিন্তু সন্তানের নামের সঙ্গে থাকা উচিত মা-বাবা দু’জনের নাম। যেমন, সাবরিনা জাকিয়া হক ‘মিতা’। এখানে ‘সাবরিনা জাকিয়া হক’ মেয়েটির প্রকৃত নাম, ‘সাবরিনা’ তার নিজের অংশ, ‘জাকিয়া’ মা, আর ‘হক’ বাবা, ‘মিতা’ মেয়েটির ডাক নাম। কিংবা এমনও হতে পারে নামকরণের ক্ষেত্রে বাবা-মা কারো নামই থাকবে না। মেয়েটি শুধু স্বাধীনভাবে তার নিজের নামেই পরিচিত হবে। আর যোগ্যতা দিয়ে সম্মানজনক কোনো কাজের মাধ্যমে সে সমাজ ও রাষ্ট্রে জায়গা করে নিবে।

বিবাহিত নারীর চাকরি করেও স্বাধীন সত্তা থাকে না। কখনো কখনো চাকরিজীবী স্ত্রীদের বেতন স্বামীরা নিয়ে নেয়। প্রয়োজনে স্বামীর কাছ থেকে এনেই স্ত্রীকে খরচ করতে হয়। তবে কেউ কেউ বলে, তারা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে এক হাত দিয়েই সংসারের খরচ চালায়। এটা কতটা যৌক্তিক তা অবশ্য বিচার্য বিষয়। তবে এক হাত দিয়ে খরচ করবার প্রস্তাব স্ত্রীকে তো স্বামীই দিয়ে থাকে। তাছাড়া, চাকরিস্থলও মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়। সেখানেও তারা কোনো সহকর্মী বা চাকরিদাতার নানা রকমের বৈষম্য-বঞ্চনা বা অন্যায় অচরণের শিকার হয়।

চাকরিস্থলের মতো পরিবারেও বাবার মৃত্যুর পরে বিবাহিত মেয়েরা ভাইদের বঞ্চনার শিকার হয়। ভাইদের কাছে বিবাহিত মেয়েদের বাবার সম্পত্তি চাওয়া যেন অপরাধের ব্যাপার। এমনকি কখনো কখনো ভাইয়েরা বিধবা বোনকে এ কথা বলে থাকে- ‘তোমার আবার সম্পত্তির দরকার কী, তুমি আমাদের সঙ্গে থাক।’ কখনো কখনো বোন অন্ধ হলেও তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়। আবার অসুস্থ বোনকে চিকিৎসা করিয়ে বোনের কাছ থেকে ভাই সম্পত্তি লিখে নেয়। আর বোন যদি মৃত্যুবরণ করে, তখন ওই ভাই বলে বেড়ায় যে বোন তাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছে। আর বাবার বাড়ি থেকে সম্পত্তি না আনতে পারলে নারীরা স্বামীদের কাছে নির্যাতনের শিকার হয়। বিয়ের পরে বিয়ের আগের প্রেমিক পুরুষটি আর প্রেমিক থাকে না সে হয়ে ওঠে নারীর একচ্ছত্র প্রভু বা রূপকার্থে বিধাতা।

বিয়ের আগে ছেলেরা মেয়েদের জয় করার জন্য সুন্দর সুন্দর কথা বললেও বিয়ের পরে দেখা যায় তাদের অন্য রূপ। বিয়ের পরে নারী-পুরুষের অবাধ যৌনতা স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রথম দিকে নারী পুরুষের কাছে যতটা আবেদনময়ী থাকে, যত দিন যায়, ততই আবেদন কমতে থাকে। তখন নতুন করে যৌতুকের ব্যাপারটি আবার চলে আসে। সাংসারিক জীবনে যৌতুকের কারণে দেশ জুড়ে অসংখ্যা নারী প্রতিবছর প্রাণ হারায়! আর যারা বেঁচে থাকে তাদের জীবনে একটা টানাপড়েন চলতে থাকে। বিবাহিত জীবনে অবাধ যৌনতার সনদপ্রাপ্তির ফলে নারী-পুরুষের সুখ লাভের পাশাপাশি এক ধরনের ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটে। সুখ লাভ আর ক্ষুধা নিবৃত্তির এক পর্যায়ে নারী গর্ভধারণ করে। এই যৌনসম্ভোগ ও গর্ভধারণ প্রক্রিয়াও একটা নিষ্ঠুর রাজনীতি। অধিকাংশক্ষেত্রে পুরুষ নারীকে অতৃপ্ত রেখেই যৌনমিলন থেকে উঠে পড়ে। এতে নারী যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে মনোবিকলনগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আবার কখনো কখনো নারীকে অত্যাধিক যৌনতায় বাধ্য করা হয়। তখনও নারীর প্রতি অত্যাচার করা হয়। সব নারীই হয়তো মা হতে চায়। কিন্তু নারী-পুরুষ উভয়ের যৌনতার ফলে নারী যে গর্ভবতী হয়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘটে। বিয়ের আগে যেসব মেয়ে ছেলেদের জোরাজুরির কাছে বাধ্য হয়ে যৌনমিলনে রাজি হয়, তাদের বেশিরভাগই ছেলেদের কাছ থেকে প্রতাখ্যাত হয়। আবার কখনো কখনো অল্প বয়সের কোনো সুন্দরীকে কোনো নষ্ট ছেলে প্রেমে প্রলুব্ধ করে বা ফুসলিয়ে বিয়ে করে স্ত্রী হারানোর নানা শঙ্কায় থাকে। ছেলেটি নিজে অধার্মিক হয়েও ধর্মের দোহাই দিয়ে বিয়ের পরে মেয়েটিকে ঘেরাটোপ-ঘুরকা-গিলাফ-কাপড়ের-ঢাকনা বা বোরকা কিংবা হিজাব পরিয়ে অন্যদের সঙ্গে যাতে করে কোনো সম্পর্ক করতে না পারে, সে জন্য তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে অল্প সময়ের মধ্যেই গর্ভবতী করে ফেলে। তবে কোনো কোনো মেয়ে নিজের ইচ্ছায়ই পারিবারিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় কারণে বোরকা ও হিজাব পরে থাকে। সেটা অবশ্য ভিন্ন কথা।

অধিকাংশ পুরুষ যৌনমিলনের মধ্য দিয়ে নারীকে গর্ভবতী করেই খোশমেজাজে থাকে। কিন্তু নারী গর্ভবতী হবার পরে সন্তান জন্ম দেওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের শরীর নিয়ে একটা কারাগারে বসবাস করে। আশপাশের মানুষ তাকে যতই সাহস দিক না কেন, সে একরকম মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে। গর্ভবতী নারীর গর্ভকালীন যেভাবে যত্ন নেওয়া উচিত, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বামী বা পরিবার পালন না করেও তার প্রতি অবিচার করে। নারী গর্ভবতী হলে ধীরে ধীরে তার গর্ভের আকার বৃদ্ধি পায়। তখন উঁচু পেট নিয়ে নারী সমাজের সর্বস্তরের পুরুষ কর্তৃক উপহাসের পাত্রী হয়। পুরুষেরা নারীকে নিয়ে তখন দূরে বসে বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা শুরু করে। এতে তাঁরা এক ধরনের বিকৃত আনন্দ লাভ করে। পুরুষদের অমানবিক আচরণের কারণে নারীরা কখনো কখনো বিব্রত বোধ করে বাড়ানো পেটটি কোনো অতিরিক্ত কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেই বাইরে চলাচল করে থাকে। ব্যাপারটি তখন এমন হয় যে, ওই নারী অসভ্য পুরুষসমাজে পুরুষ কর্তৃক গর্ভধারণ করে যেন অপরাধ করে ফেলেছে! গর্ভবতী নারীর কখনো কখনো স্বামীর অত্যাচারে-অনাদরে-অবহেলায়-অচিকিৎসায় মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে। কোনো কোনো লেখক নারীর সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়াকে কবিতা সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। নারীর সন্তান জন্মদানের ব্যাপারটি কবির কবিতা সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করেও নারীকে ছোট করা হয়। রূপকার্থে কথাটি বলা হলেও কবিতা সৃষ্টি ও নারীর সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ।

সন্তান জন্মদানের সময় নারীরা কখনোবা চিকিৎসক কর্তৃক অবিচারের শিকার হয়। একটি সন্তানসম্ভাবা মুমূর্ষু নারীকে অপারেশন থিয়েটারে রেখে কোনো কোনো লোভী ও ডাকাত চরিত্রের অমানবিক পুরুষেরা কিংবা মানুষ চিকিৎসার বেশধারী পশু ডাক্তারেরা দরকষাকষি শুরু করে। সব ক্ষেত্রে যে এ কথা প্রযোজ্য, তা নয়, অসংখ্য মানবিক চিকিৎসকও আছেন, তাঁদের বেলায় এ কথা প্রযোজ্য নয়; তবে কেউ কেউ নারীকে বিপদে ফেলে সিজারিয়ানের কথা বলে নারীর নিজের কিংবা স্বামী বা পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে থাকে। এটা বড়ো ধরনের নারী নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা বা বর্বরতা!

নারীর জন্ম, লেখাপড়া, বিয়ে, সন্তান জন্মদানের পরে দীর্ঘ সংসার জীবনযাপন করে, বা জীবনযাপনের নামে অন্যের গড়ে দেওয়া জীবনযাপন করে যখন বৃদ্ধা হয়, তখন বাবার অনুপস্থিতিতে ছেলেরাই তার অভিভাবক সাজে, কখনো কখনো কর্তৃত্ব করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই মায়ের বা বাবার সমস্যা আন্তরিকভাবে দেখে, তাদের যতœ নেয়। কখনো কখনো সমাজে বৃদ্ধার কথার চেয়ে একটি পুরুষের কথার মূল্য বেশি হয়। পুরুষের কোনো আলোচনায় নারীরা অংশগ্রহণ করলে কখনো কখনো এভাবে বলা হয়- ‘মহিলাদের কথা আর কী শোনার আছে।’ কিংবা ‘এখানে আবার মহিলারা কথা বলে কেন? কিংবা ‘মহিলাদের কথা কী শুনব।’ ‘মহিলাদের কথা না বলাই ভালো।’ এসব কথায় মনে হয়, নারীরা সব অত্যাচার-অবিচার-বৈষম্য মেনে নিলেই পুরুষেরা খুশি।

দীর্ঘ আলোচনায় আমরা দেখেছি, পরিবার থেকে শুরু করে রাস্তা-ঘাট-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-বাসে-অফিসে সমাজের সর্বত্র মেয়েদের প্রতি বৈষম্য করা হয়। এসব বৈষম্য পরিবারে করে বাবা-মা-আত্মীয়-স্বজন, স্বামী ও তার আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব, স্কুল কলেজে করে সহপাঠী কিংবা অন্য বিভাগের কোনো নষ্ট শিক্ষার্থী বা শিক্ষক, রাস্তা-ঘাটে করে দুষ্ট ছেলের দল ও নানা নষ্ট পুরুষ, অফিসে সুন্দর কথার মাধ্যমে কৌশলে করেন বড় সাহেব কিংবা কোনো সহকর্মী, বাসে ওঠার সময় মেয়েদের জায়গা নেই বলে বৈষম্য করে কনডাক্টর আর বাসে ওঠার পরে মেয়েদের জায়গায় বসে থেকে করে নানা নারী বিদ্বেষী কা-জ্ঞানহীন পুরুষ। সর্বোপরি জীবন সায়াহ্নে এলে একজন পুরুষের মৃত্যু সমাজে যেভাবে গুরুত্ব পায়, একজন নারীর মৃত্যু সেভাবে পায় না। নারীর মৃত্যুর পরে রেখে যাওয়া সম্পত্তিও উত্তরাধিকারীরা ন্যায্যভাবে পায় না। সে ক্ষেত্রেও মৃত নারীর প্রতি অবিচার করা হয়। আর সব ধর্মের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মা-বাবার মৃত্যুর পরে বাবার মৃত্যুবার্ষিকী যেভাবে ঘটা করে পুত্রসন্তানেরা পালন করে থাকে, মা তাদের কাছে সেভাবে গুরুত্ব পায় না। তাহলে দেখা যাচ্ছে- জন্মের আগে থেকে মৃত্যুর পর পর্যন্তই নারী পুরুষ কর্তৃক জেন্ডার বৈষম্যের শিকার।

image
আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

নারী ও তার বিধাতা পুরুষ

জহিরুল হক

image

নারী-পুরুষের মধ্যে পৃথিবীর সর্বত্র কমবেশি শক্তির আধিপত্য ও অধীনতার সম্পর্ক বিরাজমান। এ সম্পর্ককে ‘সম্পর্ক’ না বলে বলা যায়- জেন্ডার বা লিঙ্গবৈষম্য। প্রাথমিকভাবে এ ভূভাগে বৈষম্যের সূত্রপাত পরিবার থেকে। একটি শিশুর জন্মের আগে থেকে পরিবারের সদস্যরা এ বৈষম্য শুরু করে। অনাগত শিশুটির জেন্ডার সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে এ বৈষম্যের সৃষ্টি। বর্তমানে নারীর গর্ভের সন্তানটি মেয়ে না ছেলে আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে তা বোঝার সহজ উপায় আছে। নারীর গর্ভের সন্তানটি যদি মেয়ে হয়, তাহলে অধিকাংশ নারী অখুশি হয়। কারণ ওই নারীরা দেখেছে, সমাজে তাদের অধিকার কী! আর এ ক্ষেত্রে পুরুষ তো অখুশি হয়ই। শিক্ষিত পুরুষ মুখে হয়তো বলে- মেয়ে বা ছেলে উভয়ই সমান কিন্তু অন্তরে ধারণ করে এ কথা- ‘আহ্! যদি একটি ছেলে হতো...!’ স্বামী কর্তৃক নারী কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো মনে মনে বিদ্বেষের শিকার হয়। পরিবারের অন্যরাও নারীর কন্যাসন্তান জন্মের সম্ভাবনাকে সুখকরভাবে নেয় না।

কন্যাসন্তানটি জন্ম নেবার পর ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে উঠতে পরিবারের ও সমাজের অবহেলার শিকার হয়। একটি পুত্রসন্তানকে পরিবারে ও সমাজে যেভাবে জোরে কথা বলতে বা যে কোনো সময় যে কারও সঙ্গে কথা বলতে ও যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে বেড়াবার সুযোগ দেওয়া হয়, কন্যা সন্তানটিকে সেভাবে কথা বলতে কিংবা বেড়াবার সুযোগ দেওয়া হয় না। একটু বড়ো হলেই মা তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। যখন ওই পরিবারে আরেকটি সন্তান অর্থাৎ পুত্র জন্ম নেয়, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা-মা’র আর আনন্দের শেষ থাকে না। কারণ, বংশের উত্তারাধিকারী সৃষ্টি হয়ে গেল।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা ছেলেদের মতো উত্তারাধিকারী হয় না। পরিবারে ছেলেটি মেয়েটির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। তা খাবার বেলায় হোক, জামা-কাপড় পরার বেলায় হোক, চলা-ফেরার স্বাধীনতার ব্যাপারে হোক- সব সময় ছেলেটি আগে। ছেলেটি বাইরে খেলাধুলা, নানা জায়গায় চলাফেরার মধ্য দিয়ে শারীরিক-মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে পারলেও মেয়েটি পেছনে পড়ে যায়। সমাজের আর দশটি পরিবারের মেয়েদের দেখে মেয়েটি বুঝতে পারে- সে মেয়ে, তার জীবন ছেলেদের মতো স্বাধীন নয়। আবার ছেলেটি বড়ো হলে পরিবারে ও বোনটির ওপরে প্রাধান্য বিস্তার করে।

শৈশবে বাবা-মা মেয়েটিকে শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শ্লীলতা-অশ্লীলতা শিক্ষা দেয়। বাবা-মা বা পরিবারের কোনো সদস্য মেয়েটিকে বলে, ‘এই মেয়ে তুমি ন্যাংটা কেন, প্যান্ট পর।’ মেয়েটির প্রতি এই যে শিক্ষা তা-ও জেন্ডার বৈষম্যের কারণ। প্রকৃতপক্ষে উভয় শিশুকেই এ কথা বলা উচিত। কিন্তু ছেলে শিশুটি এ ক্ষেত্রে কম গুরুত্ব পায়। অন্যদিকে মেয়েটিকে আরোপিত শিক্ষায় লজ্জায় ফেলে দেওয়া হয়। সে বুঝতে পারে, তার শরীরের কোনো প্রত্যঙ্গ খারাপ, যা মানুষের মধ্যে দেখানো উচিত নয়। এভাবে বলে মেয়েটিকে ছোট করা হয়। সে ছেলেটি থেকে নিজেকে আলাদা ভাবতে শুরু করে। অথচ ছেলেটি ন্যাংটা হয়ে বাড়ির সর্বত্র ঘুরে বেড়ালেও বাবা-মা কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের কারো পবিত্রতা নষ্ট হয় না। কিংবা কারো কাছে দৃষ্টিকটু লাগে না। কোনো অবস্থাতেই শিশুদের আরোপিত শিক্ষায় নৈতিকতা শেখানো উচিত নয়। নৈতিকতা শিশুরা বড়ো হতে হতে নিজে থেকেই শিখবে।

মেয়েটি যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করে, তখন প্রাথমিকভাবে অন্যদের সহায়তায় স্কুলে যায়। কিন্তু একটু বড় হয়ে যখন সে একাকী পথ চলতে শুরু করে, তখন অধিক জনসংখ্যা ও বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে রাস্তা-ঘাট, শপিং মলে হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকা সমাজের আর দশটা পরিবারের অপদার্থ ছেলেদের বা অসম্মানজনকভাবে জোরজবরদস্তি করে সবকিছু অর্জন করার মানসিকতাসম্পন্ন বখাটেদের নানা কটূক্তি ও কনুয়ের খোঁচা, বা হাতের স্পর্শ নিয়েই তাকে চলতে হয়। কোনো মেয়ে ছেলেদের এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করলে তাকে কটূক্তি শুনতে হয় বা নির্যাতিত হতে হয়। একটি মেয়ে যখন রাস্তায় হাঁটে তখন রাস্তার কোনো ছেলেকে কখনো কখনো দেখা যায় তার পেছনে পেছনে কিংবা সমান্তরালে হাঁটতে। কেউ যদি পরীক্ষামূলকভাবে একটি মেয়ের রাস্তায় চলাচলের সময় তার অবস্থাটি বোঝার জন্য কোনো ছেলে বা কোনো বয়স্ক পুরুষদের দিকে দৃষ্টি দেয়, তাহলেই বুঝতে পারবে যে কী পরিমাণ চোখ মেয়েটির দিকে পড়ছে! এসব চোখের দৃষ্টির মধ্যে বেশিরভাগেরই থাকে ক্ষুধা বা কোনো না কোনো অশ্লীল ইঙ্গিত! এভাবে বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় বা প্রাথমিক পেরিয়ে মেয়েটি যখন মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে, তখন কখনো তার সহপাঠী বা কখনো কোনো চরিত্রহীন শিক্ষাদাতা কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়। কোনো কোনো মেয়ে ছেলেদের উত্ত্যক্তকরণের কারণে বাধ্য হয়ে প্রেমে পড়ে নিজের নির্যাতনের পথ ত্বরান্বিত করে দেয়। প্রেমের ক্ষেত্রে নির্যাতিত মেয়েরাই বেশি হয়। কখনো কখনো ছেলেদের নির্যাতনে পড়ে মেয়েদের জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যায়।

বাইরে চলাফেরার সময় ছেলেরা যে কোনো পোশাক পরতে পারে কিন্তু একটি বড়ো মেয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিংবা বহির্বিশ্বের নারীদের অনুকরণে নতুন ডিজাইনের কোনো পোশাক পরলেই ছেলেদের দ্বারা নানা কটূক্তির শিকার হয়। কখনো কখনো এমনও দেখা যায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বুদ্ধিজীবী নামধারী কলাম লেখকেরা দ্বিতীয় লিঙ্গকে কালো কাপড়ে বন্দি করতে ইচ্ছুক শাস্ত্রান্ধদের মানসিকতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে মেয়েদের পোশাক নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। কে কী পরবে, সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। অথচ তাঁরা ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে মেয়েদের পোশাক পরা সম্পর্কে উপদেশ দিলেও বর্তমান কালে ছেলেদের পশ্চাৎভাগের কাপড় যে নিচে ঝুলে থাকে সেদিকে চোখ পড়লেও ছেলেরা পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি বলে স্বজাতির গ্লানি লুকিয়ে রেখে কোনো কথা বলেন না। অতএব নারীর কী পরা উচিত, বা উচিত নয় বা কী করা উচিত, বা উচিত নয়, সে পরামর্শ দেওয়া পুরুষের উচিত নয়। কারণ, পুরুষের ওইসব পরামর্শের মধ্যেও আছে জেন্ডার বৈষম্য।

নারীর প্রতি যৌনতার নীরব সন্ত্রাস শুরু হয় বিয়ের আগে থেকে। বিয়েতে সুন্দর ও অসুন্দর মেয়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। সুন্দরীকে নিয়ে সমাজের শক্তিমান পুরুষেরা টানাটানি করলেও অসুন্দরী বৈষম্যের শিকার হয়। বিয়েতে যৌতুকও একটি অপমানজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যৌতুক একটি মারাত্মক জেন্ডার বৈষম্য। যার মাধ্যমে নারীকে ছোট করা হয়। স্কুলে বা কলেজে পড়ার সময় মেয়েদের বিয়ে হলে অধিকাংশক্ষেত্রেই তারা পুরোপুরিই স্বাধীনতা হারিয়ে ভারবাহী পশুতে পরিণত হয়। তা শুধু স্কুল বা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় কিংবা লেখাপড়ার পরেও যখন বিয়ে হয়, তখন থেকেই মেয়েটি পুরোপুরি স্বাধীনতা হারায়। বাবার বাড়িতে মেয়েটি যে স্বাধীনতা নিয়ে উচ্ছল-উজ্জ্বল তরুণী হিসেবে বেড়ে উঠেছিল, সেই স্বাধীনতা তার আর থাকে না। স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ি তার ওপরে নানারকম কর্তৃত্ব ফলাতে থাকে। বিয়ের পরে ছেলেদের নিজস্ব পরিবেশ বজায় থাকলেও মেয়েরা এক ধরনের বন্দি জীবন নিয়ে শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা বাবা-মায়ের বাড়ি ছেড়ে চলে যায় অন্য ঠিকানায়! এ যে কতো বড়ো ত্যাগ তা ভাষায়ই প্রকাশ করা যায় না!

বিবাহিত জীবনে ছেলেরা একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক করলেও স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক টিকে থাকে। তেমন কোনো লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয় না। কিন্তু কোনো বিবাহিত নারী কোনো ছেলে বা পরপুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করা তো দূরে থাক, চাকরিস্থলের কোনো সহকর্মীর সঙ্গে ফোনে কথা বললেও নানা সন্দেহ থেকে কখনোবা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভেঙে যাবার উপক্রম হয়। ছেলেরা একাধিক মেয়ের সঙ্গে যৌনতা করেও পবিত্র থেকে যাকে। অথচ নারীর চরিত্র ছেলেদের কাছে অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আর এ কথায় কোনো স্বামী নামধারী পুরুষ দ্বিমত পোষণ করলেও বলতে হয়, মানুষ অনবরত কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বাঁচতে পারে না। সংসার জীবনের আনন্দ ও বেদনার ঘানি টানতে টানতে প্রত্যেককেই ডানে-বামে একটু শ্বাস-নিঃশ্বাস ফেলতে কিংবা তাকাতেই হয়। পুরুষকে সন্দেহ করে নারী কিছুই করতে পারে না, কিন্তু নারীর এই ডানে-বামে তাকানোকে কোনো পুরুষই সুখকরভাবে নেয় না।

নারী-পুরুষের নামকরণের ক্ষেত্রেও বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। বিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্ত্রীর নামের শেষে স্বামী নিজের নামটি লাগিয়ে দেয়। আর এ নিয়ে স্বামীরই আগ্রহ থাকে বেশি। বাবা কর্তৃক দেওয়া নাম অধিকাংশ স্বামীই রাখে না। যেমন কারো বাবার দেওয়া নাম যদি থাকে-সাবরিনা হক, আর স্বামীর নাম যদি থাকে-জাকির হোসেন, তখন স্বামী তাঁর নামটি স্ত্রীর নামের শেষে যোগ করে দিয়ে করে-সাবরিনা হোসেন। আমি মনে করি এটা নারীকে আটকানোর একটা পুরুষতান্ত্রিতক হীন মানসিকতা। যা নারীরা সংসার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মেনে নেয়। তাছাড়া, আমাদের দেশে এই সেদিনও কোনো মানুষের নাগরিকত্ব সনদ নিতে গেলে, পাসপোর্ট করতে গেলে, পরীক্ষা কিংবা চাকরির দরখাস্ত দিতে গেলে শুধু বাবার নাম লিখতে হতো, মায়ের নাম লেখার প্রয়োজন পড়ত না। এটা একটি অমানবিক পুরুষতান্ত্রিক ব্যাপার ছিল। বর্তমানে সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম লেখা হয়। আমি মনে করি, সন্তান জন্ম ও লালন-পালনে মায়ের যে ভূমিকা, তাতে মায়ের নাম বাবার নামের আগে থাকা উচিত। আবার বাবারা যখন মেয়ের নাম রাখে, তখন মেয়ের নামকরণের ক্ষেত্রে মায়ের চেয়ে বাবার কর্তৃত্বই বেশি প্রকাশ পায়। বাবা নিজের নামের অংশ জুড়ে দেয় মেয়ের নামের সঙ্গে। কিন্তু সন্তানের নামের সঙ্গে থাকা উচিত মা-বাবা দু’জনের নাম। যেমন, সাবরিনা জাকিয়া হক ‘মিতা’। এখানে ‘সাবরিনা জাকিয়া হক’ মেয়েটির প্রকৃত নাম, ‘সাবরিনা’ তার নিজের অংশ, ‘জাকিয়া’ মা, আর ‘হক’ বাবা, ‘মিতা’ মেয়েটির ডাক নাম। কিংবা এমনও হতে পারে নামকরণের ক্ষেত্রে বাবা-মা কারো নামই থাকবে না। মেয়েটি শুধু স্বাধীনভাবে তার নিজের নামেই পরিচিত হবে। আর যোগ্যতা দিয়ে সম্মানজনক কোনো কাজের মাধ্যমে সে সমাজ ও রাষ্ট্রে জায়গা করে নিবে।

বিবাহিত নারীর চাকরি করেও স্বাধীন সত্তা থাকে না। কখনো কখনো চাকরিজীবী স্ত্রীদের বেতন স্বামীরা নিয়ে নেয়। প্রয়োজনে স্বামীর কাছ থেকে এনেই স্ত্রীকে খরচ করতে হয়। তবে কেউ কেউ বলে, তারা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে এক হাত দিয়েই সংসারের খরচ চালায়। এটা কতটা যৌক্তিক তা অবশ্য বিচার্য বিষয়। তবে এক হাত দিয়ে খরচ করবার প্রস্তাব স্ত্রীকে তো স্বামীই দিয়ে থাকে। তাছাড়া, চাকরিস্থলও মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়। সেখানেও তারা কোনো সহকর্মী বা চাকরিদাতার নানা রকমের বৈষম্য-বঞ্চনা বা অন্যায় অচরণের শিকার হয়।

চাকরিস্থলের মতো পরিবারেও বাবার মৃত্যুর পরে বিবাহিত মেয়েরা ভাইদের বঞ্চনার শিকার হয়। ভাইদের কাছে বিবাহিত মেয়েদের বাবার সম্পত্তি চাওয়া যেন অপরাধের ব্যাপার। এমনকি কখনো কখনো ভাইয়েরা বিধবা বোনকে এ কথা বলে থাকে- ‘তোমার আবার সম্পত্তির দরকার কী, তুমি আমাদের সঙ্গে থাক।’ কখনো কখনো বোন অন্ধ হলেও তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়। আবার অসুস্থ বোনকে চিকিৎসা করিয়ে বোনের কাছ থেকে ভাই সম্পত্তি লিখে নেয়। আর বোন যদি মৃত্যুবরণ করে, তখন ওই ভাই বলে বেড়ায় যে বোন তাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছে। আর বাবার বাড়ি থেকে সম্পত্তি না আনতে পারলে নারীরা স্বামীদের কাছে নির্যাতনের শিকার হয়। বিয়ের পরে বিয়ের আগের প্রেমিক পুরুষটি আর প্রেমিক থাকে না সে হয়ে ওঠে নারীর একচ্ছত্র প্রভু বা রূপকার্থে বিধাতা।

বিয়ের আগে ছেলেরা মেয়েদের জয় করার জন্য সুন্দর সুন্দর কথা বললেও বিয়ের পরে দেখা যায় তাদের অন্য রূপ। বিয়ের পরে নারী-পুরুষের অবাধ যৌনতা স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রথম দিকে নারী পুরুষের কাছে যতটা আবেদনময়ী থাকে, যত দিন যায়, ততই আবেদন কমতে থাকে। তখন নতুন করে যৌতুকের ব্যাপারটি আবার চলে আসে। সাংসারিক জীবনে যৌতুকের কারণে দেশ জুড়ে অসংখ্যা নারী প্রতিবছর প্রাণ হারায়! আর যারা বেঁচে থাকে তাদের জীবনে একটা টানাপড়েন চলতে থাকে। বিবাহিত জীবনে অবাধ যৌনতার সনদপ্রাপ্তির ফলে নারী-পুরুষের সুখ লাভের পাশাপাশি এক ধরনের ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটে। সুখ লাভ আর ক্ষুধা নিবৃত্তির এক পর্যায়ে নারী গর্ভধারণ করে। এই যৌনসম্ভোগ ও গর্ভধারণ প্রক্রিয়াও একটা নিষ্ঠুর রাজনীতি। অধিকাংশক্ষেত্রে পুরুষ নারীকে অতৃপ্ত রেখেই যৌনমিলন থেকে উঠে পড়ে। এতে নারী যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে মনোবিকলনগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আবার কখনো কখনো নারীকে অত্যাধিক যৌনতায় বাধ্য করা হয়। তখনও নারীর প্রতি অত্যাচার করা হয়। সব নারীই হয়তো মা হতে চায়। কিন্তু নারী-পুরুষ উভয়ের যৌনতার ফলে নারী যে গর্ভবতী হয়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘটে। বিয়ের আগে যেসব মেয়ে ছেলেদের জোরাজুরির কাছে বাধ্য হয়ে যৌনমিলনে রাজি হয়, তাদের বেশিরভাগই ছেলেদের কাছ থেকে প্রতাখ্যাত হয়। আবার কখনো কখনো অল্প বয়সের কোনো সুন্দরীকে কোনো নষ্ট ছেলে প্রেমে প্রলুব্ধ করে বা ফুসলিয়ে বিয়ে করে স্ত্রী হারানোর নানা শঙ্কায় থাকে। ছেলেটি নিজে অধার্মিক হয়েও ধর্মের দোহাই দিয়ে বিয়ের পরে মেয়েটিকে ঘেরাটোপ-ঘুরকা-গিলাফ-কাপড়ের-ঢাকনা বা বোরকা কিংবা হিজাব পরিয়ে অন্যদের সঙ্গে যাতে করে কোনো সম্পর্ক করতে না পারে, সে জন্য তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে অল্প সময়ের মধ্যেই গর্ভবতী করে ফেলে। তবে কোনো কোনো মেয়ে নিজের ইচ্ছায়ই পারিবারিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় কারণে বোরকা ও হিজাব পরে থাকে। সেটা অবশ্য ভিন্ন কথা।

অধিকাংশ পুরুষ যৌনমিলনের মধ্য দিয়ে নারীকে গর্ভবতী করেই খোশমেজাজে থাকে। কিন্তু নারী গর্ভবতী হবার পরে সন্তান জন্ম দেওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের শরীর নিয়ে একটা কারাগারে বসবাস করে। আশপাশের মানুষ তাকে যতই সাহস দিক না কেন, সে একরকম মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে। গর্ভবতী নারীর গর্ভকালীন যেভাবে যত্ন নেওয়া উচিত, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বামী বা পরিবার পালন না করেও তার প্রতি অবিচার করে। নারী গর্ভবতী হলে ধীরে ধীরে তার গর্ভের আকার বৃদ্ধি পায়। তখন উঁচু পেট নিয়ে নারী সমাজের সর্বস্তরের পুরুষ কর্তৃক উপহাসের পাত্রী হয়। পুরুষেরা নারীকে নিয়ে তখন দূরে বসে বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা শুরু করে। এতে তাঁরা এক ধরনের বিকৃত আনন্দ লাভ করে। পুরুষদের অমানবিক আচরণের কারণে নারীরা কখনো কখনো বিব্রত বোধ করে বাড়ানো পেটটি কোনো অতিরিক্ত কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেই বাইরে চলাচল করে থাকে। ব্যাপারটি তখন এমন হয় যে, ওই নারী অসভ্য পুরুষসমাজে পুরুষ কর্তৃক গর্ভধারণ করে যেন অপরাধ করে ফেলেছে! গর্ভবতী নারীর কখনো কখনো স্বামীর অত্যাচারে-অনাদরে-অবহেলায়-অচিকিৎসায় মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে। কোনো কোনো লেখক নারীর সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়াকে কবিতা সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। নারীর সন্তান জন্মদানের ব্যাপারটি কবির কবিতা সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করেও নারীকে ছোট করা হয়। রূপকার্থে কথাটি বলা হলেও কবিতা সৃষ্টি ও নারীর সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ।

সন্তান জন্মদানের সময় নারীরা কখনোবা চিকিৎসক কর্তৃক অবিচারের শিকার হয়। একটি সন্তানসম্ভাবা মুমূর্ষু নারীকে অপারেশন থিয়েটারে রেখে কোনো কোনো লোভী ও ডাকাত চরিত্রের অমানবিক পুরুষেরা কিংবা মানুষ চিকিৎসার বেশধারী পশু ডাক্তারেরা দরকষাকষি শুরু করে। সব ক্ষেত্রে যে এ কথা প্রযোজ্য, তা নয়, অসংখ্য মানবিক চিকিৎসকও আছেন, তাঁদের বেলায় এ কথা প্রযোজ্য নয়; তবে কেউ কেউ নারীকে বিপদে ফেলে সিজারিয়ানের কথা বলে নারীর নিজের কিংবা স্বামী বা পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে থাকে। এটা বড়ো ধরনের নারী নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা বা বর্বরতা!

নারীর জন্ম, লেখাপড়া, বিয়ে, সন্তান জন্মদানের পরে দীর্ঘ সংসার জীবনযাপন করে, বা জীবনযাপনের নামে অন্যের গড়ে দেওয়া জীবনযাপন করে যখন বৃদ্ধা হয়, তখন বাবার অনুপস্থিতিতে ছেলেরাই তার অভিভাবক সাজে, কখনো কখনো কর্তৃত্ব করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই মায়ের বা বাবার সমস্যা আন্তরিকভাবে দেখে, তাদের যতœ নেয়। কখনো কখনো সমাজে বৃদ্ধার কথার চেয়ে একটি পুরুষের কথার মূল্য বেশি হয়। পুরুষের কোনো আলোচনায় নারীরা অংশগ্রহণ করলে কখনো কখনো এভাবে বলা হয়- ‘মহিলাদের কথা আর কী শোনার আছে।’ কিংবা ‘এখানে আবার মহিলারা কথা বলে কেন? কিংবা ‘মহিলাদের কথা কী শুনব।’ ‘মহিলাদের কথা না বলাই ভালো।’ এসব কথায় মনে হয়, নারীরা সব অত্যাচার-অবিচার-বৈষম্য মেনে নিলেই পুরুষেরা খুশি।

দীর্ঘ আলোচনায় আমরা দেখেছি, পরিবার থেকে শুরু করে রাস্তা-ঘাট-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-বাসে-অফিসে সমাজের সর্বত্র মেয়েদের প্রতি বৈষম্য করা হয়। এসব বৈষম্য পরিবারে করে বাবা-মা-আত্মীয়-স্বজন, স্বামী ও তার আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব, স্কুল কলেজে করে সহপাঠী কিংবা অন্য বিভাগের কোনো নষ্ট শিক্ষার্থী বা শিক্ষক, রাস্তা-ঘাটে করে দুষ্ট ছেলের দল ও নানা নষ্ট পুরুষ, অফিসে সুন্দর কথার মাধ্যমে কৌশলে করেন বড় সাহেব কিংবা কোনো সহকর্মী, বাসে ওঠার সময় মেয়েদের জায়গা নেই বলে বৈষম্য করে কনডাক্টর আর বাসে ওঠার পরে মেয়েদের জায়গায় বসে থেকে করে নানা নারী বিদ্বেষী কা-জ্ঞানহীন পুরুষ। সর্বোপরি জীবন সায়াহ্নে এলে একজন পুরুষের মৃত্যু সমাজে যেভাবে গুরুত্ব পায়, একজন নারীর মৃত্যু সেভাবে পায় না। নারীর মৃত্যুর পরে রেখে যাওয়া সম্পত্তিও উত্তরাধিকারীরা ন্যায্যভাবে পায় না। সে ক্ষেত্রেও মৃত নারীর প্রতি অবিচার করা হয়। আর সব ধর্মের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মা-বাবার মৃত্যুর পরে বাবার মৃত্যুবার্ষিকী যেভাবে ঘটা করে পুত্রসন্তানেরা পালন করে থাকে, মা তাদের কাছে সেভাবে গুরুত্ব পায় না। তাহলে দেখা যাচ্ছে- জন্মের আগে থেকে মৃত্যুর পর পর্যন্তই নারী পুরুষ কর্তৃক জেন্ডার বৈষম্যের শিকার।