বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা

ওবায়েদ আকাশ

অনেক গবেষণা ও ভাবনার অতল ডুবুরি হয়ে দেখা গেছে যে, বিস্মৃতি হলো মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু, সবচেয়ে বড় আততায়ী। মানুষের যদি স্মৃতি হারিয়ে যায়, কিংবা নিরন্তর যদি যে গতকালকে, বিগত দিনকে ভুলতে থাকে, তবে তার বেঁচে থাকা অর্থহীন এবং পরবর্তী দিনে জীবন ধারণের সূত্রগুলো মেলানো একেবারেই সম্ভব নয়। সিলেবাসহীন পাঠক্রম যেমন অথৈ সমুদ্রে খাবি খাওয়ার মতো, তেমনি মানুষের অতীত ঘটনা বা স্মৃতিহীন জীবন তার পরবর্তী পথচলায় অন্ধকারে পা ফেলার মতো।

বুদ্ধি হবার পর থেকে একটি স্বাধীন দেশে বসবাস করে গত প্রায় চারটি দশক ধরে দেখে আসছি, আমরা কতটা বিস্মৃতিপ্রবণ মানুষ, কত সহজে অনেক কিছু ভুলে যাই, আর পরবর্তী জীবনে হিসাব মিলাতে গিয়ে বারবার অন্ধকারে হাবুডুবু খাই।

গত চার দশকে আমাকে ভয়ঙ্করভাবে আতঙ্কিত করছে যে বিষয়টি, সেটি হলো প্রকাশ্য দিবালোকে, খুন, ধর্ষণ এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটলে আমরা সময়ান্তরে তা ভুলে যাই। এবং সেসব ঘটনার কতটা সুবিচার বা সমাধান হয়েছে তা আর আমাদের মনে থাকে না। এবং আমরা আবার পরের দিন নৈশনিদ্রা ভেঙে খুব ভোরে আর একটি ভয়াবহ ঘটনা শোনার জন্য প্রস্তুত থাকি, এবং তোড়জোড় শুরু করে দেই যে, এর অবশ্যই সুষ্ঠু বিচার হতে হবে, প্রকৃত আসামীদের অবশ্যই গ্রেফতার করতে হবে, ভুক্তভোগী বা নির্যাতনের শিকারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তার সামাজিক সম্মানজনক অবস্থান পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেখে আসছি যে, আমাদের শাসকগণ এই গণদাবির সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হাতছাড়া করে না। ব্যতিক্রম দু’একটি ঘটনা ছাড়া বেশিরভাগ অপরাধের অপরাধীদের প্রকাশ্যে গ্রেফতার করা হয়, তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়, পত্রিকায় বিবৃতি আসে, স্বীকারোক্তি আসে; কিন্তু সময়ান্তরে তাদের শেষ পরিণতি কী হলো তা আর জনসমক্ষে আসে না। শতকরা কিংবা হাজারে দু একটি ঘটনায় ফাঁসি বা জেল-জরিমানার ঘটনা ঘটলেও, বাকি ঘটনাগুলো আর জনসমক্ষে আসে না। কিন্তু প্রথম প্রথম প্রতিটি ঘটনা নিয়েই একটা রগরগে উত্তেজনা থাকে, পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিক বা সিরিজ প্রতিবেদন চলতে থাকে; একুশে আগস্ট কিংবা নুসরাত, কিংবা তনু, কিংবা সাগর-রুনি, কিংবা হলি আর্টিজান কিংবা রিফাত হত্যার মতো প্রত্যেকটি ঘটনার একটি করে লোগো তৈরি করে পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে এবং একটা সময় নতুন কোনো ঘটনার প্রবল প্রতাপে সেই লোগোগুলো মুছে গিয়ে জায়গা দখল করে নতুন কোনো লোগো। কিন্তু পত্রিকা থেকে মুছে যাবার মতো আমাদের মন থেকেও যে ঘনটাগুলো মুছে যেতে থাকে, তারই সুযোগ গ্রহণ করে ক্ষমতাশালীরা। ঘটনাগুলো ধামাচাপা দিয়ে পার পেয়ে যায়। অন্যদিকে আমাদেরও মনে নতুন নতুন ঘটনা তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও পরবর্তী ঘটনা আমাদের মনে নিস্তরঙ্গ ঢেউয়ের মতো ক্ষণপরে মিলিয়ে যায়। পরিণতিতে সবচেয়ে বড় যে ঘটনাটি ঘটে, তা হলো, খুন ধর্ষণের মতো বড় বড় অপরাধের আসামীরা আইনের ফোঁকর গলিয়ে পার পেয়ে যায়। তারা আবার অপরাধে লিপ্ত হয়, কিন্তু ভুক্তভোগীরা নীরবে চোখের জল মুছতে মুছতে এটাই নিয়তি বলে একদিন মেনে নিতে বাধ্য হয়। এভাবেই জনগণের ভাগ্য নিয়ে খেলা করে তার প্রশাসন। এভাবেই নির্যাতিতদের অধিকার নিয়ে উপহাস করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের এই চরিত্র সৃষ্টিতে ভূমিকা থাকে বিভিন্ন অপরাধীচক্রের। সেই চক্রে থাকে শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই। কিন্তু রাষ্ট্র কখনো তাদের নিয়ে খেলে না। খেললে তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। আর এই সংস্কৃতির কবলে পড়ে দিন দিন ক্রমশই বাড়ছে অপরাধীদের অপরাধ প্রবণতা। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন অপরাধের। অপরাধীরা যখন বিচারের আওয়াতায় আসছে না; কিংবা তাৎক্ষণিক গ্রেফতার হলেও তারা অনায়াসে দুদিন পর মুক্তি পাচ্ছে; তাই তাদের নতুন নতুন অপরাধ করতে একটুও বুক কাঁপছে না। আরো দ্বিগুণ প্রতাপে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে পরবর্তী অপরাধে। বরং একবার ক’দিন জেল খেটে আসলে নাকি তাদের বুকের পাটা আরো শক্ত হয়, অন্যান্য অপরাধীরা তাকে আরো বেশি সমীহ করে, তার র‌্যাংকিং বেড়ে যায়। আর এসব সুযোগ করে দিচ্ছে ক্ষমতাশালীরাই। আজ স্বাধীনতার এত বছর পরেও যদি সেই জাতির একটি সাধারণ নাগরিককে এতটা হতাশা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়, দুর্নীতি ও অসততাকে সবচেয়ে শক্তিমান ভাবতে হয়, তাহলে এই দীর্ঘ আটচল্লিশ বছরে আমরা কতটুকু স্বাধীনতা অর্জন করেছি বা তার সুফল ভোগ করছি- এ প্রশ্ন আজ সভ্য নিরীহ প্রতিটি মানুষের।

গণমানুষের এই বিস্মৃতিপ্রবণতা, অপরাধীর বিচার না হওয়া এবং ক্রমবর্ধমান হারে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, দখল এবং নতুন নতুন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ভেতর দিয়ে আমরা কোনদিকে এগিয়ে যাচ্ছি- এই ভয়াবহ আগামী আমাদের জন্য, নতুন প্রজন্মের জন্য কী উপহার বয়ে নিয়ে আসছে- সেই ভাবনাটা আজ কার? আপনার আমার নাকি রাষ্ট্রের?

রাষ্ট্র আমাদের দায়িত্ব নিয়েছে, আমাদের সমর্থন নিয়েছে, আমাদের কাছ থেকে কর আদায় করছে, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে তুলে নিয়েছে- সব দায়িত্ব যদি রাষ্ট্রের, আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বটাই কি শুধু ব্যক্তিগত? আমাদের নিজের?

রাষ্ট্র তো সবই পারে, দিনকে রাত এবং ধরাকে সরা জ্ঞান করার ক্ষমতাও তার আছে। কারণ সমস্ত শক্তিই তার হাতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত রাষ্ট্রের দখলে। যার হাতে এত এত ক্ষমতা, এত এত শক্তি সে শুধু পরাজিত হচ্ছে আজ কতিপয় অপরাধী আর দুর্নীতিবাজদের কাছে। এ লজ্জা, এত তিরষ্কার কি আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা পেতে নিয়েছি? আর কতদিন চলবে এই সংস্কৃতি? কবে বিচার পাবে আমাদের নির্যাতিত জনগণ? কবে বন্ধ হবে দুর্নীতি অপরাধ? কবে বন্ধ হবে পরের দিনের ক্রমবর্ধমান খুন, ধর্ষণ? আর অপরাধীদের জন্য বন্ধ হবে রাষ্ট্রের সকল সহানুভূতির দরজা? আর কবে থেকেইবা বন্ধ হবে জনগণের এই বিস্মৃতিপ্রবণতা?

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা

ওবায়েদ আকাশ

অনেক গবেষণা ও ভাবনার অতল ডুবুরি হয়ে দেখা গেছে যে, বিস্মৃতি হলো মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু, সবচেয়ে বড় আততায়ী। মানুষের যদি স্মৃতি হারিয়ে যায়, কিংবা নিরন্তর যদি যে গতকালকে, বিগত দিনকে ভুলতে থাকে, তবে তার বেঁচে থাকা অর্থহীন এবং পরবর্তী দিনে জীবন ধারণের সূত্রগুলো মেলানো একেবারেই সম্ভব নয়। সিলেবাসহীন পাঠক্রম যেমন অথৈ সমুদ্রে খাবি খাওয়ার মতো, তেমনি মানুষের অতীত ঘটনা বা স্মৃতিহীন জীবন তার পরবর্তী পথচলায় অন্ধকারে পা ফেলার মতো।

বুদ্ধি হবার পর থেকে একটি স্বাধীন দেশে বসবাস করে গত প্রায় চারটি দশক ধরে দেখে আসছি, আমরা কতটা বিস্মৃতিপ্রবণ মানুষ, কত সহজে অনেক কিছু ভুলে যাই, আর পরবর্তী জীবনে হিসাব মিলাতে গিয়ে বারবার অন্ধকারে হাবুডুবু খাই।

গত চার দশকে আমাকে ভয়ঙ্করভাবে আতঙ্কিত করছে যে বিষয়টি, সেটি হলো প্রকাশ্য দিবালোকে, খুন, ধর্ষণ এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটলে আমরা সময়ান্তরে তা ভুলে যাই। এবং সেসব ঘটনার কতটা সুবিচার বা সমাধান হয়েছে তা আর আমাদের মনে থাকে না। এবং আমরা আবার পরের দিন নৈশনিদ্রা ভেঙে খুব ভোরে আর একটি ভয়াবহ ঘটনা শোনার জন্য প্রস্তুত থাকি, এবং তোড়জোড় শুরু করে দেই যে, এর অবশ্যই সুষ্ঠু বিচার হতে হবে, প্রকৃত আসামীদের অবশ্যই গ্রেফতার করতে হবে, ভুক্তভোগী বা নির্যাতনের শিকারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তার সামাজিক সম্মানজনক অবস্থান পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেখে আসছি যে, আমাদের শাসকগণ এই গণদাবির সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হাতছাড়া করে না। ব্যতিক্রম দু’একটি ঘটনা ছাড়া বেশিরভাগ অপরাধের অপরাধীদের প্রকাশ্যে গ্রেফতার করা হয়, তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়, পত্রিকায় বিবৃতি আসে, স্বীকারোক্তি আসে; কিন্তু সময়ান্তরে তাদের শেষ পরিণতি কী হলো তা আর জনসমক্ষে আসে না। শতকরা কিংবা হাজারে দু একটি ঘটনায় ফাঁসি বা জেল-জরিমানার ঘটনা ঘটলেও, বাকি ঘটনাগুলো আর জনসমক্ষে আসে না। কিন্তু প্রথম প্রথম প্রতিটি ঘটনা নিয়েই একটা রগরগে উত্তেজনা থাকে, পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিক বা সিরিজ প্রতিবেদন চলতে থাকে; একুশে আগস্ট কিংবা নুসরাত, কিংবা তনু, কিংবা সাগর-রুনি, কিংবা হলি আর্টিজান কিংবা রিফাত হত্যার মতো প্রত্যেকটি ঘটনার একটি করে লোগো তৈরি করে পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে এবং একটা সময় নতুন কোনো ঘটনার প্রবল প্রতাপে সেই লোগোগুলো মুছে গিয়ে জায়গা দখল করে নতুন কোনো লোগো। কিন্তু পত্রিকা থেকে মুছে যাবার মতো আমাদের মন থেকেও যে ঘনটাগুলো মুছে যেতে থাকে, তারই সুযোগ গ্রহণ করে ক্ষমতাশালীরা। ঘটনাগুলো ধামাচাপা দিয়ে পার পেয়ে যায়। অন্যদিকে আমাদেরও মনে নতুন নতুন ঘটনা তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও পরবর্তী ঘটনা আমাদের মনে নিস্তরঙ্গ ঢেউয়ের মতো ক্ষণপরে মিলিয়ে যায়। পরিণতিতে সবচেয়ে বড় যে ঘটনাটি ঘটে, তা হলো, খুন ধর্ষণের মতো বড় বড় অপরাধের আসামীরা আইনের ফোঁকর গলিয়ে পার পেয়ে যায়। তারা আবার অপরাধে লিপ্ত হয়, কিন্তু ভুক্তভোগীরা নীরবে চোখের জল মুছতে মুছতে এটাই নিয়তি বলে একদিন মেনে নিতে বাধ্য হয়। এভাবেই জনগণের ভাগ্য নিয়ে খেলা করে তার প্রশাসন। এভাবেই নির্যাতিতদের অধিকার নিয়ে উপহাস করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের এই চরিত্র সৃষ্টিতে ভূমিকা থাকে বিভিন্ন অপরাধীচক্রের। সেই চক্রে থাকে শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই। কিন্তু রাষ্ট্র কখনো তাদের নিয়ে খেলে না। খেললে তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। আর এই সংস্কৃতির কবলে পড়ে দিন দিন ক্রমশই বাড়ছে অপরাধীদের অপরাধ প্রবণতা। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন অপরাধের। অপরাধীরা যখন বিচারের আওয়াতায় আসছে না; কিংবা তাৎক্ষণিক গ্রেফতার হলেও তারা অনায়াসে দুদিন পর মুক্তি পাচ্ছে; তাই তাদের নতুন নতুন অপরাধ করতে একটুও বুক কাঁপছে না। আরো দ্বিগুণ প্রতাপে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে পরবর্তী অপরাধে। বরং একবার ক’দিন জেল খেটে আসলে নাকি তাদের বুকের পাটা আরো শক্ত হয়, অন্যান্য অপরাধীরা তাকে আরো বেশি সমীহ করে, তার র‌্যাংকিং বেড়ে যায়। আর এসব সুযোগ করে দিচ্ছে ক্ষমতাশালীরাই। আজ স্বাধীনতার এত বছর পরেও যদি সেই জাতির একটি সাধারণ নাগরিককে এতটা হতাশা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়, দুর্নীতি ও অসততাকে সবচেয়ে শক্তিমান ভাবতে হয়, তাহলে এই দীর্ঘ আটচল্লিশ বছরে আমরা কতটুকু স্বাধীনতা অর্জন করেছি বা তার সুফল ভোগ করছি- এ প্রশ্ন আজ সভ্য নিরীহ প্রতিটি মানুষের।

গণমানুষের এই বিস্মৃতিপ্রবণতা, অপরাধীর বিচার না হওয়া এবং ক্রমবর্ধমান হারে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, দখল এবং নতুন নতুন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ভেতর দিয়ে আমরা কোনদিকে এগিয়ে যাচ্ছি- এই ভয়াবহ আগামী আমাদের জন্য, নতুন প্রজন্মের জন্য কী উপহার বয়ে নিয়ে আসছে- সেই ভাবনাটা আজ কার? আপনার আমার নাকি রাষ্ট্রের?

রাষ্ট্র আমাদের দায়িত্ব নিয়েছে, আমাদের সমর্থন নিয়েছে, আমাদের কাছ থেকে কর আদায় করছে, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে তুলে নিয়েছে- সব দায়িত্ব যদি রাষ্ট্রের, আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বটাই কি শুধু ব্যক্তিগত? আমাদের নিজের?

রাষ্ট্র তো সবই পারে, দিনকে রাত এবং ধরাকে সরা জ্ঞান করার ক্ষমতাও তার আছে। কারণ সমস্ত শক্তিই তার হাতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত রাষ্ট্রের দখলে। যার হাতে এত এত ক্ষমতা, এত এত শক্তি সে শুধু পরাজিত হচ্ছে আজ কতিপয় অপরাধী আর দুর্নীতিবাজদের কাছে। এ লজ্জা, এত তিরষ্কার কি আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা পেতে নিয়েছি? আর কতদিন চলবে এই সংস্কৃতি? কবে বিচার পাবে আমাদের নির্যাতিত জনগণ? কবে বন্ধ হবে দুর্নীতি অপরাধ? কবে বন্ধ হবে পরের দিনের ক্রমবর্ধমান খুন, ধর্ষণ? আর অপরাধীদের জন্য বন্ধ হবে রাষ্ট্রের সকল সহানুভূতির দরজা? আর কবে থেকেইবা বন্ধ হবে জনগণের এই বিস্মৃতিপ্রবণতা?