যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

আলী সিদ্দিকী

কলেজবেলা থেকে দৈনিক সংবাদ আমার সঙ্গী হয়ে ওঠে। আমার মন ও মননের গঠনে সংবাদের ভূমিকা ছিল অনন্য দীপশিখা। প্রয়াত বজলুর রহমানের সম্পাদনায় দৈনিক সংবাদ হয়ে উঠেছিল প্রগতিবাদী চিন্তাচর্চার মূলকেন্দ্র এবং যুক্তিবাদী মানুষদের মিলন মোহনা। জনমানুষের মাটি সম্পৃক্ত ও প্রাত্যহিক সংগ্রামের বহুবর্ণিল কাহিনী এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নিয়ে প্রতিদিন সংবাদ নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে দেশবাসীর সামনে হাজির হতো। তথ্যবহুল সংবাদ পরিবেশনায় নিজস্বতার স্ফুরণ ছিল সংবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। আমরা “সংবাদ” পরিবেশিত সংবাদের চুলচেরা বিশ্লেষণে তর্ক-বিতর্ক করে নিজেদের সমৃদ্ধ করতাম এবং সেই আলোকে জনমত তৈরিতে আমরা নিজেদের ভাষায় প্রান্তিক মানুষদের আলোকিত করতাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের আবহে “সংবাদ” সকল প্রগতিবিরোধী নিউজ মিডিয়ার বানোয়াট হলুদ সাংবাদিকতাকে খ-ন করার জন্য অপরিহার্য হাতিয়ার হয়ে ওঠে। সামরিক শাসনবিরোধী লড়াই সংগ্রামে দৈনিক সংবাদ বরাবরই ছিল লড়াকু মানুষদের পক্ষে অকুতোভয়। সকল বিভ্রান্তিকর একপেশে ও ক্ষমতাতুষ্ট সংবাদের বিরুদ্ধে সংবাদ-এর নিরপেক্ষ এবং যৌক্তিক সংবাদ পরিবেশন ছিল প্রতিবাদস্বরূপ। তাছাড়া প্রান্তিক মানুষদের লড়াই সংগ্রামের সচিত্র প্রতিবেদন ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। মোনাজাতউদ্দিনের অনন্য সাধারণ সরেজমিন সংবাদ পরিবেশনা বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়া জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং সংবাদ মাধ্যমের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করে। মাটি ও মানুষের সাংবাদিকতায় মোনাজাতউদ্দিন অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

দৈনিক সংবাদ-এর উপসম্পাদকীয়সমূহ ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বিশেষত গাছপাথরের ‘সময় বহিয়া যায়’। আমরা সবাই গোল হয়ে বসে গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়তাম আর তুমুল তর্ক-বিতর্কের ভেতর দিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করতাম। গাছপাথরের বলার ভঙ্গি এমন ছিল যে, গল্পচ্ছলে পাঠককে সুকৌশলে বর্ণিত সমস্যার ভেতর টেনে নিয়ে গিয়ে পুরো সমস্যার পোস্টমর্টেম দেখিয়ে দেয়া হতো যাতে পাঠক নিজেই নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বিষয়টির বিচার করতে পারে। এই পদ্ধতিতে পাঠকসমাজকে যুক্তিনির্ভরতা ও প্রয়োগে উৎসাহিত করার বিষয়টি ছিল অনবদ্য।

দৈনিক সংবাদ এমন একটি সংবাদ মাধ্যম যা শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অদ্যাবধি তার গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনা জারিত চরিত্র ধারণ করে চলেছে। আমরা দেখেছি, প্রগতিবাদী মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের ওপর নেমে আসা চরম নিপীড়ন নির্যাতনের সময় সংবাদ তার মৌলিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেনি বরং সাহসিকতার সঙ্গে নির্যাতিতদের পক্ষাবলম্বন করেছে।

দৈনিক সংবাদের ‘সংবাদ সাময়িকী’ ছিল আমার জ্ঞানপিপাসার এক প্রকা- আধার। অপরাপর দৈনিকসমূহের সাহ্যিপাতার তুলনায় সংবাদ সাময়িকী ছিল (এখনও আছে) অনন্য সাধারণ এবং প্রাগ্রসর চিন্তা জগতের অবারিত দুয়ার। বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, গবেষকদের অনেকেই সংবাদ সাময়িকী বিলানো আলোয় আলোকিত হয়েছেন তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রতি বৃহস্পতিবার আমি বরাদ্দ রাখতাম সংবাদ সাময়িকীর জন্য এবং শুক্রবার পর্যন্ত সময় নিয়ে পুরো সাময়িকী শেষ করতাম। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্য, বই পরিচিতিসমৃদ্ধ সাহিত্যপাতা বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছিল স্বতন্ত্র বাতিঘর। একমাত্র সংবাদ সাময়িকীই ছিল দুই বাংলার চিন্তা জগতের সেতুবন্ধন। ভাষার কোন দেশ নেই এবং ভাষাই সংস্কৃতির মৌলিক বন্ধন। আমার আজকের যে নিজস্ব লেখনী ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার আকাশ তার অনেক কিছুই সমৃদ্ধ হয়েছে সাময়িকীর বৈচিত্র্যময় পরিবেশনায়। আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, বর্তমান সংবাদ সাময়িকীও দীপ্তমান কবি ওবায়েদ আকাশের সৃষ্টিশীল প্রয়াসে স্বাতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলেছে এবং নতুন প্রজন্মের অনেকের মনোজাগতিক কাঠামো গঠনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখে চলেছে।

দৈনিক সংবাদ-এর জনজীবন ঘনিষ্ঠতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চায় একনিষ্ঠতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমুন্নত ও একটি মানবতাবাদী রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার ভূমিকা অব্যাহত থাকুক আটষট্টি বছরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এটাই প্রত্যাশা।

image

শিল্পী : মনিরুল ইসলাম

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

আলী সিদ্দিকী

image

শিল্পী : মনিরুল ইসলাম

কলেজবেলা থেকে দৈনিক সংবাদ আমার সঙ্গী হয়ে ওঠে। আমার মন ও মননের গঠনে সংবাদের ভূমিকা ছিল অনন্য দীপশিখা। প্রয়াত বজলুর রহমানের সম্পাদনায় দৈনিক সংবাদ হয়ে উঠেছিল প্রগতিবাদী চিন্তাচর্চার মূলকেন্দ্র এবং যুক্তিবাদী মানুষদের মিলন মোহনা। জনমানুষের মাটি সম্পৃক্ত ও প্রাত্যহিক সংগ্রামের বহুবর্ণিল কাহিনী এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নিয়ে প্রতিদিন সংবাদ নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে দেশবাসীর সামনে হাজির হতো। তথ্যবহুল সংবাদ পরিবেশনায় নিজস্বতার স্ফুরণ ছিল সংবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। আমরা “সংবাদ” পরিবেশিত সংবাদের চুলচেরা বিশ্লেষণে তর্ক-বিতর্ক করে নিজেদের সমৃদ্ধ করতাম এবং সেই আলোকে জনমত তৈরিতে আমরা নিজেদের ভাষায় প্রান্তিক মানুষদের আলোকিত করতাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের আবহে “সংবাদ” সকল প্রগতিবিরোধী নিউজ মিডিয়ার বানোয়াট হলুদ সাংবাদিকতাকে খ-ন করার জন্য অপরিহার্য হাতিয়ার হয়ে ওঠে। সামরিক শাসনবিরোধী লড়াই সংগ্রামে দৈনিক সংবাদ বরাবরই ছিল লড়াকু মানুষদের পক্ষে অকুতোভয়। সকল বিভ্রান্তিকর একপেশে ও ক্ষমতাতুষ্ট সংবাদের বিরুদ্ধে সংবাদ-এর নিরপেক্ষ এবং যৌক্তিক সংবাদ পরিবেশন ছিল প্রতিবাদস্বরূপ। তাছাড়া প্রান্তিক মানুষদের লড়াই সংগ্রামের সচিত্র প্রতিবেদন ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। মোনাজাতউদ্দিনের অনন্য সাধারণ সরেজমিন সংবাদ পরিবেশনা বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়া জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং সংবাদ মাধ্যমের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করে। মাটি ও মানুষের সাংবাদিকতায় মোনাজাতউদ্দিন অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

দৈনিক সংবাদ-এর উপসম্পাদকীয়সমূহ ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বিশেষত গাছপাথরের ‘সময় বহিয়া যায়’। আমরা সবাই গোল হয়ে বসে গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়তাম আর তুমুল তর্ক-বিতর্কের ভেতর দিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করতাম। গাছপাথরের বলার ভঙ্গি এমন ছিল যে, গল্পচ্ছলে পাঠককে সুকৌশলে বর্ণিত সমস্যার ভেতর টেনে নিয়ে গিয়ে পুরো সমস্যার পোস্টমর্টেম দেখিয়ে দেয়া হতো যাতে পাঠক নিজেই নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বিষয়টির বিচার করতে পারে। এই পদ্ধতিতে পাঠকসমাজকে যুক্তিনির্ভরতা ও প্রয়োগে উৎসাহিত করার বিষয়টি ছিল অনবদ্য।

দৈনিক সংবাদ এমন একটি সংবাদ মাধ্যম যা শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অদ্যাবধি তার গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনা জারিত চরিত্র ধারণ করে চলেছে। আমরা দেখেছি, প্রগতিবাদী মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের ওপর নেমে আসা চরম নিপীড়ন নির্যাতনের সময় সংবাদ তার মৌলিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেনি বরং সাহসিকতার সঙ্গে নির্যাতিতদের পক্ষাবলম্বন করেছে।

দৈনিক সংবাদের ‘সংবাদ সাময়িকী’ ছিল আমার জ্ঞানপিপাসার এক প্রকা- আধার। অপরাপর দৈনিকসমূহের সাহ্যিপাতার তুলনায় সংবাদ সাময়িকী ছিল (এখনও আছে) অনন্য সাধারণ এবং প্রাগ্রসর চিন্তা জগতের অবারিত দুয়ার। বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, গবেষকদের অনেকেই সংবাদ সাময়িকী বিলানো আলোয় আলোকিত হয়েছেন তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রতি বৃহস্পতিবার আমি বরাদ্দ রাখতাম সংবাদ সাময়িকীর জন্য এবং শুক্রবার পর্যন্ত সময় নিয়ে পুরো সাময়িকী শেষ করতাম। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্য, বই পরিচিতিসমৃদ্ধ সাহিত্যপাতা বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছিল স্বতন্ত্র বাতিঘর। একমাত্র সংবাদ সাময়িকীই ছিল দুই বাংলার চিন্তা জগতের সেতুবন্ধন। ভাষার কোন দেশ নেই এবং ভাষাই সংস্কৃতির মৌলিক বন্ধন। আমার আজকের যে নিজস্ব লেখনী ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার আকাশ তার অনেক কিছুই সমৃদ্ধ হয়েছে সাময়িকীর বৈচিত্র্যময় পরিবেশনায়। আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, বর্তমান সংবাদ সাময়িকীও দীপ্তমান কবি ওবায়েদ আকাশের সৃষ্টিশীল প্রয়াসে স্বাতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলেছে এবং নতুন প্রজন্মের অনেকের মনোজাগতিক কাঠামো গঠনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখে চলেছে।

দৈনিক সংবাদ-এর জনজীবন ঘনিষ্ঠতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চায় একনিষ্ঠতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমুন্নত ও একটি মানবতাবাদী রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার ভূমিকা অব্যাহত থাকুক আটষট্টি বছরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এটাই প্রত্যাশা।