অ্যাডিশ মশার উপদ্রব ভয়াবহ

ডেঙ্গুজরের প্রকোপ

মশকনিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম জোরদার করার আহ্বান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

ডেঙ্গুজ্বর ও চিকুনগুনিয়ার বাহক অ্যাডিশ মশার উপদ্রব ভয়াবহ আকারে বেড়েই চলছে। রাজধানীর বেইলী রোড ও মন্ত্রিপাড়া থেকে শুরু করে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বাড়ছে অ্যাডিশ মশার প্রজনন। শিশু থেকে বয়স্ক কেউই রেহাই পাচ্ছে না। প্রতি ঘণ্টায় ৪ থেকে ৫ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু সরকারি হিসাবে আক্রান্ত হয়েছে ১১৬ জন। চলতি মাসের গতকাল পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ ১৭৬ থেকে নিচে ১১৬ জন পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। চলতি বছরের গতকাল পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৩ হাজার ২৫৬ জন। এরমধ্যে একজন ডাক্তারসহ ৩ জন মারা গেছে। অনেকেই এখনও চিকিৎসাধীন আছেন। আবার কেউ কেউ প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা তুলে ধরে ঢাকার দুই সিটিতে মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

এ দিকে মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদফতরের কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুজ্বরের বাহক অ্যাডিশ মশা বংশ বিস্তার করছে। মশা ডিম পাড়ে। প্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তার ঘটছে। এরপর পূর্ণাঙ্গ মশা হয়ে আক্রান্ত কাউকে কামড় দিয়ে আবার সুস্থ মানুষকে কামড় দিলে তিনি আক্রান্ত হন। এভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে ১০৫টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুজ্বরের বাহক অ্যাডিশ মশার বিস্তার ঘটছে। যেখানে পরিষ্কার স্বচ্ছ পনি সেখানে মশা ডিম পাড়ে। জানা গেছে, নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে বা ঘরের মধ্যে জমে থাকা পানিতেও অ্যাডিশ মশার বিস্তার ঘটছে। মশা নিধনে প্রতি বছর সিটি করপোরেশন নানাভাবে প্রচারণা চালালেও বাস্তবে তার উল্টো চিত্র বলে নগরবাসী অভিযোগ করেন। অনেক স্থানে ওষুধ দেয়ার পরও তা রহস্যজনক কারণে কার্যকর হচ্ছে না। ফলে মশার উপদ্রব বেড়েই চলেছে। ২০১৮ সালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে ১০ হাজার ১৪৮ জন। তার মধ্যে মারা গেছে ২৬ জন। এখনও অনেকেই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তরা হাত-পায়ের ব্যথা নিয়ে কষ্টে আছেন। নতুন করে আবার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় তারা টেনশনে দিন কাটাচ্ছেন। গত ৯ দিনে যথাক্রমে ১১৬, ১৫৬, ১২৭, ১৭৬, ১০১, ১৪৩, ১২২, ১২৩ ও ১২১ জন আক্রান্ত হয়েছে। এইভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

এদিকে অ্যাডিশ মশার উপদ্রব ও ভয়াবহতা তুলে ধরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি) মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। একই সঙ্গে ডেঙ্গু মশার বিষয়ে জনগণকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী।

গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আগামী ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস পালনের কর্মসূচির প্রস্তুতি সভায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। সভায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ উপস্থিত ছিলেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে দুই সিটি করপোরেশন যাতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাদের নিয়েও মিটিং করেছি। তাদের আহ্বান জানিয়েছি বেশি করে স্প্রে করুন, যাতে মশার উৎপত্তিস্থল ধংস করা যায়। তাতে ডেঙ্গু কন্ট্রোল করা যাবে, মশা কন্ট্রোল করা যাবে। তিনি বলেন, আমি মনে করি আরও জোরেশোরে কাজ হওয়া প্রয়োজন, যাতে মশার সংখ্যা কমে যায়, তাতে ডেঙ্গু আক্রান্ত লোকের সংখ্যাও কমে যাবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর উপদ্রব একটু বেশি। তাই দেশের জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা মশার কামড় থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তিনি বলেন, এটাও বলছি- জ্বর হলে কেউ যাতে দেরি না করেন, তাড়াতাড়ি যাতে স্বাস্থ্য সেবাটা গ্রহণ করেন। সময়মতো স্বাস্থ্য সেবা নিলে ডেঙ্গুতে ঝুঁকি নেই, দেরি করলেই সমস্যা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাটা বেশি থাকে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, এখন বর্ষার দিন, বর্ষার কারণে মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। মশার উপদ্রবের কারণে ডেঙ্গু হচ্ছে। হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমাদের ডাক্তার-নার্সদের অবহিত করা হয়েছে, তারা যাতে চিকিৎসাটা ভালোভাবে দিতে পারেন সেই প্রশিক্ষণও তাদের দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রন্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও আমাদের চেষ্টা অনুযায়ী চিকিৎসা আমরা দিচ্ছি। আমাদের চেষ্টা থাকবে, হাসপাতালে যাতে কোন মৃত্যু না ঘটে, কোন অবহেলার কারণ নেই। আমরা হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত বেডের ব্যবস্থা করেছি।

জ্বর হলেই অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানোর আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, এ বছর দুই হাজার ৬২৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং তারা রিলিজ পেয়েছেন। এই মুহূর্তে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৫৫১ জন। গত ৫ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি ছিল ৯৮ জন, ৬ জুলাই ১৬৪ জন, ৭ জুলাই ১২৪ জন, ৮ জুলাই ১৩০ জন এবং ৯ জুলাই দুপুর পর্যন্ত ১০৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানান তিনি। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে জানিয়ে আবুল কালাম আজাদ বলেন, জ্বর হলে অনেক সময় সাধারণ জ্বর মনে করি। ডেঙ্গু জ্বরও রোগীর কাছে সাধারণ জ্বর মনে হবে। যে কোন জ্বর হলে আপনারা সাধারণ জ্বর মনে না করে, অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেন এবং পরীক্ষা করেন।

এদিকে, অন্য বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি বলে স্বীকার করেছেন রাজধানীর ঢাকার এক মেয়র। তবে তিনি শহরের ডেঙ্গুর ব্যাপকতার বিষয়টি মানতে নারাজ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকনের মতে, ডেঙ্গু রোগী আসছেন সারাদেশ থেকে।

চলতি বছর ডেঙ্গুর মাত্রা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সাঈদ খোকন আরও বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সারা বাংলাদেশ থেকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসছেন এমন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ১০০ প্লাস। এসব রোগী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৮৭৫ জনের বেশি রোগী ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। আরেকটি মৃত্যুর কথা শোনা যায় তিনি একজন ডাক্তার, যিনি তিনবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই রকম একটা পরিসংখ্যান কোনভাবেই প্রমাণ করে না ডেঙ্গু অনেক ব্যাপকতা ছড়িয়েছে এই কথা আমরা বলতে পারি না।

তিনি বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে ২৮ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া সিঙ্গাপুরে এ বছর ৬ হাজার ২২১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। যা ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দিল্লি শহরেও ঢাকা শহর থেকে অনেক বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগামী ১৫ জুলাই থেকে ৪৫০টি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম প্রতিটি ওয়ার্ডে থাকবে। বিনামূল্য চিকিৎসা দেয়া হবে, ওষুধ দেয়া হবে। একটি হটলাইন চালু করা হবে। ওই নাম্বারে ফোন করা হলে মেডিকেল টিম বাসায় চলে যাবে। কোন নাগরিক ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে সঙ্কটাপন্ন হলে প্রয়োজনে ডিএনসিসির উদ্যোগে তাকে বিদেশে পাঠানো হবে।

নগরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দাবি করে দক্ষিণের মেয়রের মতো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামও বলে আসছেন, নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করছেন। উত্তর সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতাসহ নানা কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন সংবাদকে বলেন, নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি ডেঙ্গুর বিষয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম, ক্রাশ প্রোগ্রাম চলমান রয়েছে।

তবে ডেঙ্গু আতঙ্কে থাকা নগরবাসীদের অভিযোগ, শহরের মশার উপদ্রবে অতিষ্ট তারা। সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম তাদের চোখে পড়ছেন না বলে বিভিন্ন এলাকার অধিবাসীরা অভিযোগ করেছেন। মালিবাগ শান্তিবাগ এসি মসজিদ এলাকার বাসিন্দা হাসান রহমান জানান, এখন পর্যন্ত তার এলাকায় কোন কার্যক্রম চোখে পড়েনি। মশককর্মীদেরও দেখতে পাননি তিনি। মশার ওষুধের মান নিয়েও সন্দেহ করছেন বিভিন্ন এলাকার অধিবাসীরা।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছেই। বর্ষার বৃষ্টিতে এই জ্বরে আরও অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যানেসথেসিয়া, এ্যানাপজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিক সংবাদকে বলেন, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ডেঙ্গুজ্বর ও চিকুনগুনিয়ার বাহক অ্যাডিশ মশা বেশি হয়। গরম ও বৃষ্টিতে অ্যাডিশ মশার প্রজনন বাড়ার উত্তম সময় এটি। তবে ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কের কোন কারণ নেই। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু রোগীদের প্যারাসিটামল ও ফলমুল এবং পানীয় জাতীয় খাবার বেশি খেলে ডেঙ্গু জ্বর দ্রুতই ভালো হয়ে যায়।

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

অ্যাডিশ মশার উপদ্রব ভয়াবহ

ডেঙ্গুজরের প্রকোপ

মশকনিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম জোরদার করার আহ্বান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

বাকী বিল্লাহ ও মোস্তাফিজুর রহমান

image

ডেঙ্গুজ্বর ও চিকুনগুনিয়ার বাহক অ্যাডিশ মশার উপদ্রব ভয়াবহ আকারে বেড়েই চলছে। রাজধানীর বেইলী রোড ও মন্ত্রিপাড়া থেকে শুরু করে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বাড়ছে অ্যাডিশ মশার প্রজনন। শিশু থেকে বয়স্ক কেউই রেহাই পাচ্ছে না। প্রতি ঘণ্টায় ৪ থেকে ৫ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু সরকারি হিসাবে আক্রান্ত হয়েছে ১১৬ জন। চলতি মাসের গতকাল পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ ১৭৬ থেকে নিচে ১১৬ জন পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। চলতি বছরের গতকাল পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৩ হাজার ২৫৬ জন। এরমধ্যে একজন ডাক্তারসহ ৩ জন মারা গেছে। অনেকেই এখনও চিকিৎসাধীন আছেন। আবার কেউ কেউ প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা তুলে ধরে ঢাকার দুই সিটিতে মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

এ দিকে মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদফতরের কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুজ্বরের বাহক অ্যাডিশ মশা বংশ বিস্তার করছে। মশা ডিম পাড়ে। প্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তার ঘটছে। এরপর পূর্ণাঙ্গ মশা হয়ে আক্রান্ত কাউকে কামড় দিয়ে আবার সুস্থ মানুষকে কামড় দিলে তিনি আক্রান্ত হন। এভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে ১০৫টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুজ্বরের বাহক অ্যাডিশ মশার বিস্তার ঘটছে। যেখানে পরিষ্কার স্বচ্ছ পনি সেখানে মশা ডিম পাড়ে। জানা গেছে, নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে বা ঘরের মধ্যে জমে থাকা পানিতেও অ্যাডিশ মশার বিস্তার ঘটছে। মশা নিধনে প্রতি বছর সিটি করপোরেশন নানাভাবে প্রচারণা চালালেও বাস্তবে তার উল্টো চিত্র বলে নগরবাসী অভিযোগ করেন। অনেক স্থানে ওষুধ দেয়ার পরও তা রহস্যজনক কারণে কার্যকর হচ্ছে না। ফলে মশার উপদ্রব বেড়েই চলেছে। ২০১৮ সালে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে ১০ হাজার ১৪৮ জন। তার মধ্যে মারা গেছে ২৬ জন। এখনও অনেকেই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তরা হাত-পায়ের ব্যথা নিয়ে কষ্টে আছেন। নতুন করে আবার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় তারা টেনশনে দিন কাটাচ্ছেন। গত ৯ দিনে যথাক্রমে ১১৬, ১৫৬, ১২৭, ১৭৬, ১০১, ১৪৩, ১২২, ১২৩ ও ১২১ জন আক্রান্ত হয়েছে। এইভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

এদিকে অ্যাডিশ মশার উপদ্রব ও ভয়াবহতা তুলে ধরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি) মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। একই সঙ্গে ডেঙ্গু মশার বিষয়ে জনগণকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী।

গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আগামী ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস পালনের কর্মসূচির প্রস্তুতি সভায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। সভায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ উপস্থিত ছিলেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে দুই সিটি করপোরেশন যাতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাদের নিয়েও মিটিং করেছি। তাদের আহ্বান জানিয়েছি বেশি করে স্প্রে করুন, যাতে মশার উৎপত্তিস্থল ধংস করা যায়। তাতে ডেঙ্গু কন্ট্রোল করা যাবে, মশা কন্ট্রোল করা যাবে। তিনি বলেন, আমি মনে করি আরও জোরেশোরে কাজ হওয়া প্রয়োজন, যাতে মশার সংখ্যা কমে যায়, তাতে ডেঙ্গু আক্রান্ত লোকের সংখ্যাও কমে যাবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর উপদ্রব একটু বেশি। তাই দেশের জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা মশার কামড় থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তিনি বলেন, এটাও বলছি- জ্বর হলে কেউ যাতে দেরি না করেন, তাড়াতাড়ি যাতে স্বাস্থ্য সেবাটা গ্রহণ করেন। সময়মতো স্বাস্থ্য সেবা নিলে ডেঙ্গুতে ঝুঁকি নেই, দেরি করলেই সমস্যা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাটা বেশি থাকে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, এখন বর্ষার দিন, বর্ষার কারণে মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। মশার উপদ্রবের কারণে ডেঙ্গু হচ্ছে। হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমাদের ডাক্তার-নার্সদের অবহিত করা হয়েছে, তারা যাতে চিকিৎসাটা ভালোভাবে দিতে পারেন সেই প্রশিক্ষণও তাদের দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রন্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও আমাদের চেষ্টা অনুযায়ী চিকিৎসা আমরা দিচ্ছি। আমাদের চেষ্টা থাকবে, হাসপাতালে যাতে কোন মৃত্যু না ঘটে, কোন অবহেলার কারণ নেই। আমরা হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত বেডের ব্যবস্থা করেছি।

জ্বর হলেই অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানোর আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, এ বছর দুই হাজার ৬২৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং তারা রিলিজ পেয়েছেন। এই মুহূর্তে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৫৫১ জন। গত ৫ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি ছিল ৯৮ জন, ৬ জুলাই ১৬৪ জন, ৭ জুলাই ১২৪ জন, ৮ জুলাই ১৩০ জন এবং ৯ জুলাই দুপুর পর্যন্ত ১০৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানান তিনি। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে জানিয়ে আবুল কালাম আজাদ বলেন, জ্বর হলে অনেক সময় সাধারণ জ্বর মনে করি। ডেঙ্গু জ্বরও রোগীর কাছে সাধারণ জ্বর মনে হবে। যে কোন জ্বর হলে আপনারা সাধারণ জ্বর মনে না করে, অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেন এবং পরীক্ষা করেন।

এদিকে, অন্য বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি বলে স্বীকার করেছেন রাজধানীর ঢাকার এক মেয়র। তবে তিনি শহরের ডেঙ্গুর ব্যাপকতার বিষয়টি মানতে নারাজ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকনের মতে, ডেঙ্গু রোগী আসছেন সারাদেশ থেকে।

চলতি বছর ডেঙ্গুর মাত্রা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সাঈদ খোকন আরও বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সারা বাংলাদেশ থেকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসছেন এমন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ১০০ প্লাস। এসব রোগী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৮৭৫ জনের বেশি রোগী ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। আরেকটি মৃত্যুর কথা শোনা যায় তিনি একজন ডাক্তার, যিনি তিনবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই রকম একটা পরিসংখ্যান কোনভাবেই প্রমাণ করে না ডেঙ্গু অনেক ব্যাপকতা ছড়িয়েছে এই কথা আমরা বলতে পারি না।

তিনি বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে ২৮ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া সিঙ্গাপুরে এ বছর ৬ হাজার ২২১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। যা ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দিল্লি শহরেও ঢাকা শহর থেকে অনেক বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগামী ১৫ জুলাই থেকে ৪৫০টি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম প্রতিটি ওয়ার্ডে থাকবে। বিনামূল্য চিকিৎসা দেয়া হবে, ওষুধ দেয়া হবে। একটি হটলাইন চালু করা হবে। ওই নাম্বারে ফোন করা হলে মেডিকেল টিম বাসায় চলে যাবে। কোন নাগরিক ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে সঙ্কটাপন্ন হলে প্রয়োজনে ডিএনসিসির উদ্যোগে তাকে বিদেশে পাঠানো হবে।

নগরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দাবি করে দক্ষিণের মেয়রের মতো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামও বলে আসছেন, নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করছেন। উত্তর সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতাসহ নানা কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন সংবাদকে বলেন, নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি ডেঙ্গুর বিষয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম, ক্রাশ প্রোগ্রাম চলমান রয়েছে।

তবে ডেঙ্গু আতঙ্কে থাকা নগরবাসীদের অভিযোগ, শহরের মশার উপদ্রবে অতিষ্ট তারা। সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম তাদের চোখে পড়ছেন না বলে বিভিন্ন এলাকার অধিবাসীরা অভিযোগ করেছেন। মালিবাগ শান্তিবাগ এসি মসজিদ এলাকার বাসিন্দা হাসান রহমান জানান, এখন পর্যন্ত তার এলাকায় কোন কার্যক্রম চোখে পড়েনি। মশককর্মীদেরও দেখতে পাননি তিনি। মশার ওষুধের মান নিয়েও সন্দেহ করছেন বিভিন্ন এলাকার অধিবাসীরা।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছেই। বর্ষার বৃষ্টিতে এই জ্বরে আরও অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যানেসথেসিয়া, এ্যানাপজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিক সংবাদকে বলেন, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ডেঙ্গুজ্বর ও চিকুনগুনিয়ার বাহক অ্যাডিশ মশা বেশি হয়। গরম ও বৃষ্টিতে অ্যাডিশ মশার প্রজনন বাড়ার উত্তম সময় এটি। তবে ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কের কোন কারণ নেই। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু রোগীদের প্যারাসিটামল ও ফলমুল এবং পানীয় জাতীয় খাবার বেশি খেলে ডেঙ্গু জ্বর দ্রুতই ভালো হয়ে যায়।