বিভ্রান্ত হওয়া না হওয়া

১.

যতই আমার বয়স বাড়ছে আমি ততই নিজের ভিতর একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। যখন বয়স কম ছিল তখন দুনিয়ার সব বিষয়েই আমার নিজস্ব মত ছিল। কোনটা ভুল আর কোনটা শুদ্ধ আমি সেটা একেবারে নিশ্চিতভাবে জানতাম এবং নিজের ধারণাটাকে একেবারে গলার বড়া ফুলিয়ে ঘোষণা করে অন্যদের জানিয়ে দিতাম। এখন যখন বয়স হয়েছে তখন আবিষ্কার করছি কোনো বিষয়েই আর পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি না। কোনো কিছুর পক্ষে যখন কেউ কিছু বলে তখন মনে হয় এটাই ঠিক, আবার যখন বিপক্ষে কেউ যুক্তি দেয় তখন নিজের মাথা চুলকাই এবং মনে হয়, নাহ্ এটাই মনে হচ্ছে ঠিক। কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক সেটা নিয়ে নিজের ভেতরেই তালগোল পাকিয়ে যায়। কয়েকটা উদাহরণ দিলে মনে হয় ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার হবে।

যেমন ধরা যাক, গণতন্ত্র নামের বিষয়টা। সারা জীবন শুনে এসেছি, জেনে এসেছি এবং বিশ্বাস করে এসেছি যে, দেশ চালাতে হয় গণতন্ত্র দিয়ে। আমাদের পাশেই বিশাল ভারত, কী চমৎকার গণতান্ত্রিকভাবে বছরের পর বছর চলে আসছে। সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। তার পাশেই আমরা, বাংলাদেশ হওয়ার পরও জোড়াতালি দিয়ে চলছে। মাঝখানে বড় একটা সময় মিলিটারি শাসন করে দেশের বারোটা বাজিয়ে দিল। শেষপর্যন্ত যখন গণতন্ত্র এসেছে তখন একটা নড়বড়ে গণতন্ত্র। এখনও নির্বাচন নিয়ে কত রকম অভিযোগ। যখন ভারতবর্ষের গণতন্ত্র নিয়ে তাদের হিংসা করে এসেছি তখন হঠাৎ করে নরেন্দ্র মোদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন। সন্ত্রাসী হিসেবে আমেরিকায় যে মানুষটি নিষিদ্ধ ছিলেন, হঠাৎ করে আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা সেই নিষিদ্ধ মানুষের সাথে গলাগলি করার জন্য ছোটাছুটি করতে শুরু করে ছিলেন। ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতবর্ষে এখন গরুর সম্মান রক্ষা করার জন্য নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা প্রায় নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমি ভাবলাম, ঠিক আছে ভুলে ভালে একবার এই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, পরের নির্বাচনে ভারতবর্ষের মানুষ নিজেদের ভুল শুধরে নেবে, ঠিক মানুষকে দেশের প্রধানমন্ত্রী বানাবে। কিসের কী? আমি অবাক হয়ে দেখলাম এবারে নরেন্দ্র মোদি আগের থেকে বেশি ভোট পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এবারে নির্বাচনের আসল শক্তিই হল ধর্মীয় উন্মাদনা। শুধু তাই নয়, এবারে নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ প্রশাসনকে পুরোপুরি ব্যবহার এবং টাকার খেলা। গণতান্ত্রিক একটা পদ্ধতিতে একটা দেশ চোখের সামনে এভাবে পাল্টে যাচ্ছে দেখতে কেমন লাগে? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে কি জার্মানি এভাবে আস্তে আস্তে নাৎসি জার্মানি হয়ে গিয়েছিল? এতদিন বলে এসেছি, গণতন্ত্র খুবই ভালো। আজকাল বলি, গণতন্ত্র খুবই ভালো, কিন্তু তারপর থেমে গিয়ে মাথা চুলকাই বাক্যটা কীভাবে শেষ করব বুঝতে পারি না।

সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রের মোড়ল হচ্ছে আমেরিকা। মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র সাপ্লাই করতে গিয়ে সেখানে কী অবস্থা করেছে সেটা আমরা চোখের সামনে দেখছি। খবরে দেখলাম বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বিশুদ্ধ এবং পরিশীলিত করার জন্য তারা একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এই দেশের মার্কিন কূটনীতিকদের সাথে আমার কোনোদিন দেখা হয় না, দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম সৌদি আরবের রাজা-বাদশাহদের সরিয়ে সেখানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে তাদের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা। পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা সমাধান নিয়ে তাদের নিজস্ব প্রস্তাব থাকে। আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে তাদের একজন কংগ্রেসম্যানের প্রস্তাব সবচেয়ে চমকপ্রদÑ মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশটি দখল করে বাংলাদেশকে দিয়ে দেয়া। গুরুতর বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করা ঠিক না কিন্তু এই প্রস্তাবটি শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গিয়েছিল। এই আমেরিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারণে আমার জীবনে কোনো উনিশ-বিশ হয়নি, কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশের অধিক মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ণবিদ্বেষ কিংবা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের জন্য অপরিসীম অবজ্ঞার সাথে একমত এটা চিন্তা করে আমার হাত-পা ঠা-া হয়ে যায়। যাই হোক, ধরে নিই গণতন্ত্র অনেক বড় ব্যাপার। আমার মতো আদার ব্যাপারী এই বিশাল জাহাজের খবর বুঝবে না। কিন্তু আমাদের সমাজের চারপাশের দৈনন্দিন ঘটনাগুলো নিশ্চয়ই বুঝতে পারব।

আজকাল খবরের কাগজ মানেই হচ্ছে খুনখারাবির খবর। কত রকম খুন দেখে আতঙ্ক হই। কিছুদিন হলো খুনের খবরের সাথে শুরু হয়েছে ধর্ষণের খবর। শুধু ধর্ষণ নয়, অনেক সময় গণধর্ষণ (ইস! কী ভয়ংকর একটা শব্দ!) সেখানেই শেষ নয়, ধর্ষণ-গণধর্ষণের পর হত্যাকা-। খবরের কাগজ পড়তে হলে নয় মাসের বাচ্চা থেকে শতবর্ষ বৃদ্ধাকে ধর্ষণের খবর পড়তে হয়। আজকাল ধর্ষক হিসেবে শিক্ষকেরাও এগিয়ে এসেছেন, বিশেষ করে মাদ্রাসার শিক্ষক। মাঝে মধ্যে মনে হয় একটা ভয়ংকর রোগে সবাই আক্রান্ত হয়ে গেছে। এই খবরগুলো পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে একবার মনে হলো পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষেরা এই সমস্যাকে কীভাবে সমাধান করে সেটা একটু দেখি। আমাদের দেশে স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েদের ঠিক করে বড় করি না, পরিবার ছেলেমেয়েদের ঠিক করে মানুষ করতে পারে না, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক কিছু গোলমাল করে, বিচার করা যায় না। শুধু তাই না বড় বড় মস্তান এবং গডফাদারেরা নয়ন বন্ডদের পুষে পুষে বড় করে। রাজনীতির মানুষেরা এদের ব্যবহার করে, কাজেই আমাদের সমস্যার শেষ নেই। খুন, ধর্ষণ যদি ভয়ংকর রোগ হয়ে থাকে, তাহলে আমরা শুধু রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা করার চেষ্টা করছি কিন্তু দক্ষ দেশগুলো নিশ্চয়ই এই রোগটি ছড়িয়ে পড়তেই দিচ্ছে না। পৃথিবীর পরিসংখ্যানে চোখ বুলাতে গিয়ে আমি পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেছি। যে দেশগুলোর সবকিছু ঠিক করে করত, ক্ষমতা আছে এবং আমার জানামতে সবকিছু ঠিকভাবে করে তাদের অনেকের পরিসংখ্যান আমাদের থেকে ভালো নয়, অনেকের পরিসংখ্যান আমাদের থেকেও খারাপ। হতে পারে সব দেশের পরিসংখ্যান ঠিকভাবে আসেনি। কোনো কোনো দেশের ধর্ষণ রিপোর্ট করা সহজ, কোনো কোনো দেশে কঠিন। স্ক্যান্ডিলিভিয়ান দেশগুলোর সামাজিক অবস্থা নিয়ে আমার সব সময়ই একটা উচ্চ ধারণা ছিল, পরিসংখ্যান দেখতে গিয়ে আমার সেই ধারণায় চোট খেয়ে গেল, সুইডেনে ধর্ষণের হার আমাদের দেশের ধর্ষণের হার থেকে ছয়-সাতগুণ বেশি। না তথ্যটা দেখে আমি স্বস্তি পাইনি বরং হতবুদ্ধি হয়ে আছি, অপেক্ষা করে আছি সমাজবিজ্ঞানীরা বিষয়টা বিশ্লেষণ করে আমাকে বোঝাবেন। আমার পক্ষে এটা বোঝার কিংবা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নেই। বিভ্রান্ত হয়ে আছি।

আমাদের দেশ এ দেশের স্টাইলে সমস্যাটা সমাধানের চেষ্টা করছে। সেই সমাধানের চেষ্টা করার প্রক্রিয়াটার নাম ‘ক্রসফায়ার’। ক্রসফায়ার একটা ইংরেজি শব্দ এবং ডিকশনারিতে নিশ্চয়ই তার আসল অর্থ দেয়া আছে। আমাদের দেশে ক্রসফায়ারের অর্থ হচ্ছে অপরাধী সন্দেহে বিনাবিচারে মেরে ফেলা। এ পদ্ধতি কাজ করে কিনা আমি জানি না। শুনেছি কোনো কোনো দেশে এটা কাজ করেছে এবং সেসব দেশ এখন খুবই আইন মেনে চলা শান্তিপূর্ণ দেশ। কিন্তু আমি অনেক খুঁজেও সে সম্পর্কে কোনো তথ্য কোথাও পাইনি। বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি ফিলিপাইনে এটা কাজ করছে না, সেখানে সাত হাজার থেকে বেশি মানুষকে মেরে ফেলেছে কিন্তু তাদের মাদকের সমস্যা মিটেছে সেরকম নিশানা নেই। আমাদের দেশে ক্রসফায়ার যথেষ্ট জনপ্রিয় পদ্ধতি বলে মনে হয়, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোও আজকাল বেশি উচ্চবাচ্চ্য করে না। মনে আছে, বেশ কয়েক বছর আগে একবার কক্সবাজার গিয়েছি, বীচে বসে আছি। তখন একজন কমবয়সী আর্মি অফিসারের সাথে দেখা হলো। (আমি কক্সবাজার এসেছি খবর পেয়ে সে আমাকে খুঁজে বের করেছে!) সেই কমবয়সী আর্মি অফিসার নিজে থেকেই বলল, উত্তরবঙ্গে তার পোস্টিং থাকার সময় সে একজন ভয়ংকর খারাপ মানুষকে ‘ক্রসফায়ার’ করেছে (তখন এই প্রজেক্টের নাম ছিল অপারেশন ক্লিন হার্ট)। বোঝাই যাচ্ছিল ঘটনাটি তাকে বিচলিত করেছিল এবং আমার কাছ থেকে সে কোনো এক ধরনের নৈতিক সমর্থন কিংবা সান্ত¡না পেতে চাইছিল। আমি তাকে কোনোটাই দিতে পারিনি, তাকে বলেছিলামÑ একজন কখনই বিনাবিচারে অন্যজনের প্রাণ নিতে পারে না। আমরা সমাজে থাকার জন্য নিয়ম করে নিয়েছি, যত খারাপই লাগুক আমরা কখনই বিনাবিচারে হত্যা করার দায়িত্ব নেব না। আমি এখনও এটা বিশ্বাস করি (ক্যাম্পাসে যখন একজন আমাকে খুন করে ফেলতে চেয়েছিল, তাকে ধরে সবাই যখন পিটিয়ে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়েছিল আমি তখন তাদের থামাতে চেষ্টা করেছিলাম)। তারপরও মনে হয় আজকাল যখন ভয়ংকর অপরাধীকে ক্রসফায়ার করে ফেলে তখন সেটা শুনে আগের মতো বিচলিত হই না। ক্রসফায়ারের কথা শুনতে শনতে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে, নাকি অপরাধের মাত্রা আমার যুক্তিতর্ককে আবেগ দিয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলছেÑ বুঝতে পারি না। বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

যতগুলো উদাহরণ দিয়েছি সবগুলো এক ধরনের জটিল উদাহরণ। আরও মাটির কাছাকাছি উদাহরণ দেয়া যাক। প্রথম যখন শুনেছি গ্যাসের দাম শতকরা তিরিশ ভাগ বেড়ে গেছে, আমি রীতিমতো আঁতকে উঠেছে। এক ধাক্কায় ত্রিশ শতাংশ? সর্বনাশ। বিষয়টা নিয়ে অনেক দিন পর দেশে হরতাল হলো মোটামুটি উত্তপ্ত পরিবেশ। তখন হঠাৎ একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ জানালেন, দেশের মাত্র বিশ শতাংশ মানুষ সরাসরি রান্নাঘরে গ্যাস ব্যবহার করার সুযোগ পায়। আশি ভাগ মানুষের কাছে গ্যাস পৌঁছায়নি। তথ্যটুকু কতটুকু সঠিক আমি জানি না কিন্তু যদি এটা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে হঠাৎ করে পুরো বিষয়টাকে আমি আর জাতীয় ব্যাপার ভাবতে পারছি না। দেশের শতকরা বিশ ভাগ সুবিধাভোগী মানুষের জীবনযাত্রার জন্য আমার কী দুর্ভাবনা করার প্রয়োজন আছে? (আমি নিজে সেই সৌভাগ্যবান বিশ ভাগের একজন) বাম রাজনৈতিক দল আর সরকার মিলে দেন-দরবার করে কোনো একটা সমাধানে পৌঁছে যাক, আমি দর্শক হয়ে ব্যাপারটা দেখি, বোঝার চেষ্টা করি। (সরাসরি গ্যাস ব্যবহার না করলেও গ্যাস ব্যবহার করে যেসব কাজ-কর্ম করা হয় সেই সুবিধা নিশ্চয়ই দেশের সব মানুষই ভোগ করে। সেটা কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কেউ একজন নিশ্চয়ই সেই হিসাব করে বলবে। তখন বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করব এখন এটি আমার বোঝার ক্ষমতার বাইরে!)।

আরও মাটির কাছাকাছি উদাহরণ দিই। যখন ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়া হলো তখন আমার মনে হলো কাজটা ঠিকই হয়েছে। ঢাকা এত বড় একটা মেট্রোপলিটান শহর, তাকে একটা আধুনিক শহর হিসেবে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে হলে আসলেই তো বড় বড় রাস্তা থেকে রিকশা তুলে দিতে হবে। তারপর যখন দেখলাম রিকশাওয়ালারা সব পথে নেমে এসেছেন তাদের রুটি-রুজি বন্ধ হওয়ার প্রতিবাদ করার জন্য, তখন আমার মনে হলোÑ সত্যিই তো রিকশা চালানোর মতো কঠিন আর অমানবিক ব্যাপার কী হতে পারে? সেই কষ্ট করে বেঁচে থাকা মানুষের আয়-উপার্জন কেন আমরা বন্ধ করতে চাইছি? তাদের জন্য সত্যিকার আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা না করে হঠাৎ করে রিকশা বন্ধ করে দেয়ার আমাদের কী অধিকার আছে? তাদের কি ঘর-সংসার নেই? স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নেই? তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যায় না? মেটা কথা, আমি বিভ্রান্তিতে ভুগতে শুরু করেছি।

আমার বিভ্রান্তি নিয়ে এবারে হালকা কয়েকটা উদাহরণ দিই। আমার যেসব সহকর্মী বা ছাত্র-ছাত্রী জাপান বা কোরিয়াতে মাস্টার্স পিএইচডি করতে গিয়েছে, তারা সবাই দেশে ফিরে এসে বলেছে, ওই সব দেশে সবাইকে শুধু কাজ এবং কাজ করতে হয়, নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আমি শুনেছি এবং ভেবেছি বাহ্? কী চমৎকার কাজের পরিবেশ। এত কাজ করে বলেই তো জাতি হিসেবে তারা এত সফল। বেঁচে থাকতে হলে তো কাজ করতেই হবে। তখন হঠাৎ একদিন দেখলাম ইউরোপের কোনো কোনো দেশ ভাবছে সপ্তাহে দুই দিন ছুটি কাটিয়ে টানা পাঁচ দিন কাজ অনেক বেশি হয়ে যায়। সপ্তাহে চার দিন কাজ করে তিন দিন ছুটি কাটালে কেমন হয়? খবরটা পড়ে আমার মনে হলো, সত্যিই তো এ চমৎকার আইডিয়াটা আমার মাথায় কেন আসেনি। আসলেই তো, একটা মাত্র জীবন, সেটা কী শুধু কাজ করে করে কাটিয়ে দিলে হবে? যত কম কাজ করে যত বেশি ছুটি উপভোগ করা যায়Ñ সেটাই তো ভালো!

এই হচ্ছে আমার অবস্থা। যেটাই শুনি সেটাই বিশ্বাস করে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে যাই। গত রাতে একটা খবর পড়ে আবার বিভ্রান্ত হয়ে গেছি। সারা জীবন শুনে এসেছি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়, ধোয়া কাপড় পরতে হয়। গত রাতে দেখলাম, খবর বের হয়েছে জামা-কাপড় ধুতে নাই। জামা কাপড় ধুলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। যত কম ধোয়া যায় তত ভালো। কথাগুলো হেজিপেঁজি পাগল-ছাগলের মুখ থেকে আসতো তাহলে সেটা হেসে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু এগুলো গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কথাÑ জিন্সের প্যান্ট নির্মাতা লিভাইয়ের সিইও বলেছেন, জিন্স কখনও ধুতে হয় না। তিনি যে জিনসটা পরে আছেন সেটা তিনি দশ বছর থেকে পরে আসছেন, একবারও ধুয়ে পরিষ্কার করেননি। খবরটা পড়ে আমার মনে হলো আসলেই তো, এতদিন শুধু শুধু কাপড় ধোয়ার পিছনে এত সময় নষ্ট করে এসেছি। কাপড় ধুতে না হলে জীবন কত সহজ। (আমার একশ’ হাতের ভেতর হয়তো কেউ আসবে না, কিন্তু একটা বড় অর্জনের জন্য ছোটখাটো ত্যাগ তো স্বীকার করতেই হবে!)।

আমি নিশ্চয়ই বোঝাতে পেরেছি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোক আর হালকা বিষয়ই হোক, আমি আজকাল খুব সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

২.

সেদিন খবরের কাগজে একটা খবর পড়ে আমি মেরুদ- সোজা করে বসেছি। জামায়াত সম্পর্কে বলতে গিয়ে অন্য অনেক কিছুর সাথে কর্নেল অলি আহমদ বলেছেন, ‘তারা দেশপ্রেমিক লোক’। না, এবারে আমি এতটুকু বিভ্রান্ত হইনি। আমি খুব ভালো করে জানি দেশটির নাম যদি হয় বাংলাদেশ তাহলে তারা দেশপ্রেমিক না। লন্ডন টাইমস লিখেছিলÑ রক্ত যদি স্বাধীনতার মূল্য হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশ অনেক মূল্যে স্বাধীনতা কিনেছে। সেই রক্তের দাগ জামায়াতে ইসলামীর হাতে লেগে আছে এবং সেটা তারা কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবে না। তারা বাংলাদেশ চায়নি। একাত্তরে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। বদর বাহিনী তৈরি করে দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, লেখকের হাত কেটেছে, চোখের চিকিৎসকের চোখ তুলে নিয়েছে, হৃদরোগ চিকিৎসকের বুক চিরে হৃৎপি- বের করে নিয়েছে। প্রায় অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেছে কিন্তু তারা একবারও নিজেদের দোষ স্বীকার করেনি। দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চায়নি। একাত্তর আমাদের কাছে পুরনো ইতিহাস নয়, একাত্তরের ইতিহাস আমাদের বুকের রক্তক্ষরণ।

আমি অনেক সহজে বিভ্রান্ত হয়ে যাই, কিন্তু এই একটি ব্যাপারে আমার কোনো বিভ্রান্তি নেই। কখনও ছিল না, কখনও থাকবে না।

শুক্রবার, ১২ জুলাই ২০১৯ , ২৮ আষাঢ় ১৪২৫, ৮ জিলকদ ১৪৪০

বিভ্রান্ত হওয়া না হওয়া

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১.

যতই আমার বয়স বাড়ছে আমি ততই নিজের ভিতর একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। যখন বয়স কম ছিল তখন দুনিয়ার সব বিষয়েই আমার নিজস্ব মত ছিল। কোনটা ভুল আর কোনটা শুদ্ধ আমি সেটা একেবারে নিশ্চিতভাবে জানতাম এবং নিজের ধারণাটাকে একেবারে গলার বড়া ফুলিয়ে ঘোষণা করে অন্যদের জানিয়ে দিতাম। এখন যখন বয়স হয়েছে তখন আবিষ্কার করছি কোনো বিষয়েই আর পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি না। কোনো কিছুর পক্ষে যখন কেউ কিছু বলে তখন মনে হয় এটাই ঠিক, আবার যখন বিপক্ষে কেউ যুক্তি দেয় তখন নিজের মাথা চুলকাই এবং মনে হয়, নাহ্ এটাই মনে হচ্ছে ঠিক। কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক সেটা নিয়ে নিজের ভেতরেই তালগোল পাকিয়ে যায়। কয়েকটা উদাহরণ দিলে মনে হয় ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার হবে।

যেমন ধরা যাক, গণতন্ত্র নামের বিষয়টা। সারা জীবন শুনে এসেছি, জেনে এসেছি এবং বিশ্বাস করে এসেছি যে, দেশ চালাতে হয় গণতন্ত্র দিয়ে। আমাদের পাশেই বিশাল ভারত, কী চমৎকার গণতান্ত্রিকভাবে বছরের পর বছর চলে আসছে। সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। তার পাশেই আমরা, বাংলাদেশ হওয়ার পরও জোড়াতালি দিয়ে চলছে। মাঝখানে বড় একটা সময় মিলিটারি শাসন করে দেশের বারোটা বাজিয়ে দিল। শেষপর্যন্ত যখন গণতন্ত্র এসেছে তখন একটা নড়বড়ে গণতন্ত্র। এখনও নির্বাচন নিয়ে কত রকম অভিযোগ। যখন ভারতবর্ষের গণতন্ত্র নিয়ে তাদের হিংসা করে এসেছি তখন হঠাৎ করে নরেন্দ্র মোদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন। সন্ত্রাসী হিসেবে আমেরিকায় যে মানুষটি নিষিদ্ধ ছিলেন, হঠাৎ করে আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা সেই নিষিদ্ধ মানুষের সাথে গলাগলি করার জন্য ছোটাছুটি করতে শুরু করে ছিলেন। ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতবর্ষে এখন গরুর সম্মান রক্ষা করার জন্য নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা প্রায় নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমি ভাবলাম, ঠিক আছে ভুলে ভালে একবার এই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, পরের নির্বাচনে ভারতবর্ষের মানুষ নিজেদের ভুল শুধরে নেবে, ঠিক মানুষকে দেশের প্রধানমন্ত্রী বানাবে। কিসের কী? আমি অবাক হয়ে দেখলাম এবারে নরেন্দ্র মোদি আগের থেকে বেশি ভোট পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এবারে নির্বাচনের আসল শক্তিই হল ধর্মীয় উন্মাদনা। শুধু তাই নয়, এবারে নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ প্রশাসনকে পুরোপুরি ব্যবহার এবং টাকার খেলা। গণতান্ত্রিক একটা পদ্ধতিতে একটা দেশ চোখের সামনে এভাবে পাল্টে যাচ্ছে দেখতে কেমন লাগে? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে কি জার্মানি এভাবে আস্তে আস্তে নাৎসি জার্মানি হয়ে গিয়েছিল? এতদিন বলে এসেছি, গণতন্ত্র খুবই ভালো। আজকাল বলি, গণতন্ত্র খুবই ভালো, কিন্তু তারপর থেমে গিয়ে মাথা চুলকাই বাক্যটা কীভাবে শেষ করব বুঝতে পারি না।

সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রের মোড়ল হচ্ছে আমেরিকা। মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র সাপ্লাই করতে গিয়ে সেখানে কী অবস্থা করেছে সেটা আমরা চোখের সামনে দেখছি। খবরে দেখলাম বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বিশুদ্ধ এবং পরিশীলিত করার জন্য তারা একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এই দেশের মার্কিন কূটনীতিকদের সাথে আমার কোনোদিন দেখা হয় না, দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম সৌদি আরবের রাজা-বাদশাহদের সরিয়ে সেখানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে তাদের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা। পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা সমাধান নিয়ে তাদের নিজস্ব প্রস্তাব থাকে। আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে তাদের একজন কংগ্রেসম্যানের প্রস্তাব সবচেয়ে চমকপ্রদÑ মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশটি দখল করে বাংলাদেশকে দিয়ে দেয়া। গুরুতর বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করা ঠিক না কিন্তু এই প্রস্তাবটি শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গিয়েছিল। এই আমেরিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারণে আমার জীবনে কোনো উনিশ-বিশ হয়নি, কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশের অধিক মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ণবিদ্বেষ কিংবা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের জন্য অপরিসীম অবজ্ঞার সাথে একমত এটা চিন্তা করে আমার হাত-পা ঠা-া হয়ে যায়। যাই হোক, ধরে নিই গণতন্ত্র অনেক বড় ব্যাপার। আমার মতো আদার ব্যাপারী এই বিশাল জাহাজের খবর বুঝবে না। কিন্তু আমাদের সমাজের চারপাশের দৈনন্দিন ঘটনাগুলো নিশ্চয়ই বুঝতে পারব।

আজকাল খবরের কাগজ মানেই হচ্ছে খুনখারাবির খবর। কত রকম খুন দেখে আতঙ্ক হই। কিছুদিন হলো খুনের খবরের সাথে শুরু হয়েছে ধর্ষণের খবর। শুধু ধর্ষণ নয়, অনেক সময় গণধর্ষণ (ইস! কী ভয়ংকর একটা শব্দ!) সেখানেই শেষ নয়, ধর্ষণ-গণধর্ষণের পর হত্যাকা-। খবরের কাগজ পড়তে হলে নয় মাসের বাচ্চা থেকে শতবর্ষ বৃদ্ধাকে ধর্ষণের খবর পড়তে হয়। আজকাল ধর্ষক হিসেবে শিক্ষকেরাও এগিয়ে এসেছেন, বিশেষ করে মাদ্রাসার শিক্ষক। মাঝে মধ্যে মনে হয় একটা ভয়ংকর রোগে সবাই আক্রান্ত হয়ে গেছে। এই খবরগুলো পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে একবার মনে হলো পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষেরা এই সমস্যাকে কীভাবে সমাধান করে সেটা একটু দেখি। আমাদের দেশে স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েদের ঠিক করে বড় করি না, পরিবার ছেলেমেয়েদের ঠিক করে মানুষ করতে পারে না, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক কিছু গোলমাল করে, বিচার করা যায় না। শুধু তাই না বড় বড় মস্তান এবং গডফাদারেরা নয়ন বন্ডদের পুষে পুষে বড় করে। রাজনীতির মানুষেরা এদের ব্যবহার করে, কাজেই আমাদের সমস্যার শেষ নেই। খুন, ধর্ষণ যদি ভয়ংকর রোগ হয়ে থাকে, তাহলে আমরা শুধু রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা করার চেষ্টা করছি কিন্তু দক্ষ দেশগুলো নিশ্চয়ই এই রোগটি ছড়িয়ে পড়তেই দিচ্ছে না। পৃথিবীর পরিসংখ্যানে চোখ বুলাতে গিয়ে আমি পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেছি। যে দেশগুলোর সবকিছু ঠিক করে করত, ক্ষমতা আছে এবং আমার জানামতে সবকিছু ঠিকভাবে করে তাদের অনেকের পরিসংখ্যান আমাদের থেকে ভালো নয়, অনেকের পরিসংখ্যান আমাদের থেকেও খারাপ। হতে পারে সব দেশের পরিসংখ্যান ঠিকভাবে আসেনি। কোনো কোনো দেশের ধর্ষণ রিপোর্ট করা সহজ, কোনো কোনো দেশে কঠিন। স্ক্যান্ডিলিভিয়ান দেশগুলোর সামাজিক অবস্থা নিয়ে আমার সব সময়ই একটা উচ্চ ধারণা ছিল, পরিসংখ্যান দেখতে গিয়ে আমার সেই ধারণায় চোট খেয়ে গেল, সুইডেনে ধর্ষণের হার আমাদের দেশের ধর্ষণের হার থেকে ছয়-সাতগুণ বেশি। না তথ্যটা দেখে আমি স্বস্তি পাইনি বরং হতবুদ্ধি হয়ে আছি, অপেক্ষা করে আছি সমাজবিজ্ঞানীরা বিষয়টা বিশ্লেষণ করে আমাকে বোঝাবেন। আমার পক্ষে এটা বোঝার কিংবা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নেই। বিভ্রান্ত হয়ে আছি।

আমাদের দেশ এ দেশের স্টাইলে সমস্যাটা সমাধানের চেষ্টা করছে। সেই সমাধানের চেষ্টা করার প্রক্রিয়াটার নাম ‘ক্রসফায়ার’। ক্রসফায়ার একটা ইংরেজি শব্দ এবং ডিকশনারিতে নিশ্চয়ই তার আসল অর্থ দেয়া আছে। আমাদের দেশে ক্রসফায়ারের অর্থ হচ্ছে অপরাধী সন্দেহে বিনাবিচারে মেরে ফেলা। এ পদ্ধতি কাজ করে কিনা আমি জানি না। শুনেছি কোনো কোনো দেশে এটা কাজ করেছে এবং সেসব দেশ এখন খুবই আইন মেনে চলা শান্তিপূর্ণ দেশ। কিন্তু আমি অনেক খুঁজেও সে সম্পর্কে কোনো তথ্য কোথাও পাইনি। বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি ফিলিপাইনে এটা কাজ করছে না, সেখানে সাত হাজার থেকে বেশি মানুষকে মেরে ফেলেছে কিন্তু তাদের মাদকের সমস্যা মিটেছে সেরকম নিশানা নেই। আমাদের দেশে ক্রসফায়ার যথেষ্ট জনপ্রিয় পদ্ধতি বলে মনে হয়, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোও আজকাল বেশি উচ্চবাচ্চ্য করে না। মনে আছে, বেশ কয়েক বছর আগে একবার কক্সবাজার গিয়েছি, বীচে বসে আছি। তখন একজন কমবয়সী আর্মি অফিসারের সাথে দেখা হলো। (আমি কক্সবাজার এসেছি খবর পেয়ে সে আমাকে খুঁজে বের করেছে!) সেই কমবয়সী আর্মি অফিসার নিজে থেকেই বলল, উত্তরবঙ্গে তার পোস্টিং থাকার সময় সে একজন ভয়ংকর খারাপ মানুষকে ‘ক্রসফায়ার’ করেছে (তখন এই প্রজেক্টের নাম ছিল অপারেশন ক্লিন হার্ট)। বোঝাই যাচ্ছিল ঘটনাটি তাকে বিচলিত করেছিল এবং আমার কাছ থেকে সে কোনো এক ধরনের নৈতিক সমর্থন কিংবা সান্ত¡না পেতে চাইছিল। আমি তাকে কোনোটাই দিতে পারিনি, তাকে বলেছিলামÑ একজন কখনই বিনাবিচারে অন্যজনের প্রাণ নিতে পারে না। আমরা সমাজে থাকার জন্য নিয়ম করে নিয়েছি, যত খারাপই লাগুক আমরা কখনই বিনাবিচারে হত্যা করার দায়িত্ব নেব না। আমি এখনও এটা বিশ্বাস করি (ক্যাম্পাসে যখন একজন আমাকে খুন করে ফেলতে চেয়েছিল, তাকে ধরে সবাই যখন পিটিয়ে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়েছিল আমি তখন তাদের থামাতে চেষ্টা করেছিলাম)। তারপরও মনে হয় আজকাল যখন ভয়ংকর অপরাধীকে ক্রসফায়ার করে ফেলে তখন সেটা শুনে আগের মতো বিচলিত হই না। ক্রসফায়ারের কথা শুনতে শনতে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে, নাকি অপরাধের মাত্রা আমার যুক্তিতর্ককে আবেগ দিয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলছেÑ বুঝতে পারি না। বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

যতগুলো উদাহরণ দিয়েছি সবগুলো এক ধরনের জটিল উদাহরণ। আরও মাটির কাছাকাছি উদাহরণ দেয়া যাক। প্রথম যখন শুনেছি গ্যাসের দাম শতকরা তিরিশ ভাগ বেড়ে গেছে, আমি রীতিমতো আঁতকে উঠেছে। এক ধাক্কায় ত্রিশ শতাংশ? সর্বনাশ। বিষয়টা নিয়ে অনেক দিন পর দেশে হরতাল হলো মোটামুটি উত্তপ্ত পরিবেশ। তখন হঠাৎ একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ জানালেন, দেশের মাত্র বিশ শতাংশ মানুষ সরাসরি রান্নাঘরে গ্যাস ব্যবহার করার সুযোগ পায়। আশি ভাগ মানুষের কাছে গ্যাস পৌঁছায়নি। তথ্যটুকু কতটুকু সঠিক আমি জানি না কিন্তু যদি এটা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে হঠাৎ করে পুরো বিষয়টাকে আমি আর জাতীয় ব্যাপার ভাবতে পারছি না। দেশের শতকরা বিশ ভাগ সুবিধাভোগী মানুষের জীবনযাত্রার জন্য আমার কী দুর্ভাবনা করার প্রয়োজন আছে? (আমি নিজে সেই সৌভাগ্যবান বিশ ভাগের একজন) বাম রাজনৈতিক দল আর সরকার মিলে দেন-দরবার করে কোনো একটা সমাধানে পৌঁছে যাক, আমি দর্শক হয়ে ব্যাপারটা দেখি, বোঝার চেষ্টা করি। (সরাসরি গ্যাস ব্যবহার না করলেও গ্যাস ব্যবহার করে যেসব কাজ-কর্ম করা হয় সেই সুবিধা নিশ্চয়ই দেশের সব মানুষই ভোগ করে। সেটা কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কেউ একজন নিশ্চয়ই সেই হিসাব করে বলবে। তখন বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করব এখন এটি আমার বোঝার ক্ষমতার বাইরে!)।

আরও মাটির কাছাকাছি উদাহরণ দিই। যখন ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়া হলো তখন আমার মনে হলো কাজটা ঠিকই হয়েছে। ঢাকা এত বড় একটা মেট্রোপলিটান শহর, তাকে একটা আধুনিক শহর হিসেবে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে হলে আসলেই তো বড় বড় রাস্তা থেকে রিকশা তুলে দিতে হবে। তারপর যখন দেখলাম রিকশাওয়ালারা সব পথে নেমে এসেছেন তাদের রুটি-রুজি বন্ধ হওয়ার প্রতিবাদ করার জন্য, তখন আমার মনে হলোÑ সত্যিই তো রিকশা চালানোর মতো কঠিন আর অমানবিক ব্যাপার কী হতে পারে? সেই কষ্ট করে বেঁচে থাকা মানুষের আয়-উপার্জন কেন আমরা বন্ধ করতে চাইছি? তাদের জন্য সত্যিকার আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা না করে হঠাৎ করে রিকশা বন্ধ করে দেয়ার আমাদের কী অধিকার আছে? তাদের কি ঘর-সংসার নেই? স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নেই? তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যায় না? মেটা কথা, আমি বিভ্রান্তিতে ভুগতে শুরু করেছি।

আমার বিভ্রান্তি নিয়ে এবারে হালকা কয়েকটা উদাহরণ দিই। আমার যেসব সহকর্মী বা ছাত্র-ছাত্রী জাপান বা কোরিয়াতে মাস্টার্স পিএইচডি করতে গিয়েছে, তারা সবাই দেশে ফিরে এসে বলেছে, ওই সব দেশে সবাইকে শুধু কাজ এবং কাজ করতে হয়, নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আমি শুনেছি এবং ভেবেছি বাহ্? কী চমৎকার কাজের পরিবেশ। এত কাজ করে বলেই তো জাতি হিসেবে তারা এত সফল। বেঁচে থাকতে হলে তো কাজ করতেই হবে। তখন হঠাৎ একদিন দেখলাম ইউরোপের কোনো কোনো দেশ ভাবছে সপ্তাহে দুই দিন ছুটি কাটিয়ে টানা পাঁচ দিন কাজ অনেক বেশি হয়ে যায়। সপ্তাহে চার দিন কাজ করে তিন দিন ছুটি কাটালে কেমন হয়? খবরটা পড়ে আমার মনে হলো, সত্যিই তো এ চমৎকার আইডিয়াটা আমার মাথায় কেন আসেনি। আসলেই তো, একটা মাত্র জীবন, সেটা কী শুধু কাজ করে করে কাটিয়ে দিলে হবে? যত কম কাজ করে যত বেশি ছুটি উপভোগ করা যায়Ñ সেটাই তো ভালো!

এই হচ্ছে আমার অবস্থা। যেটাই শুনি সেটাই বিশ্বাস করে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে যাই। গত রাতে একটা খবর পড়ে আবার বিভ্রান্ত হয়ে গেছি। সারা জীবন শুনে এসেছি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়, ধোয়া কাপড় পরতে হয়। গত রাতে দেখলাম, খবর বের হয়েছে জামা-কাপড় ধুতে নাই। জামা কাপড় ধুলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। যত কম ধোয়া যায় তত ভালো। কথাগুলো হেজিপেঁজি পাগল-ছাগলের মুখ থেকে আসতো তাহলে সেটা হেসে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু এগুলো গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কথাÑ জিন্সের প্যান্ট নির্মাতা লিভাইয়ের সিইও বলেছেন, জিন্স কখনও ধুতে হয় না। তিনি যে জিনসটা পরে আছেন সেটা তিনি দশ বছর থেকে পরে আসছেন, একবারও ধুয়ে পরিষ্কার করেননি। খবরটা পড়ে আমার মনে হলো আসলেই তো, এতদিন শুধু শুধু কাপড় ধোয়ার পিছনে এত সময় নষ্ট করে এসেছি। কাপড় ধুতে না হলে জীবন কত সহজ। (আমার একশ’ হাতের ভেতর হয়তো কেউ আসবে না, কিন্তু একটা বড় অর্জনের জন্য ছোটখাটো ত্যাগ তো স্বীকার করতেই হবে!)।

আমি নিশ্চয়ই বোঝাতে পেরেছি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোক আর হালকা বিষয়ই হোক, আমি আজকাল খুব সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

২.

সেদিন খবরের কাগজে একটা খবর পড়ে আমি মেরুদ- সোজা করে বসেছি। জামায়াত সম্পর্কে বলতে গিয়ে অন্য অনেক কিছুর সাথে কর্নেল অলি আহমদ বলেছেন, ‘তারা দেশপ্রেমিক লোক’। না, এবারে আমি এতটুকু বিভ্রান্ত হইনি। আমি খুব ভালো করে জানি দেশটির নাম যদি হয় বাংলাদেশ তাহলে তারা দেশপ্রেমিক না। লন্ডন টাইমস লিখেছিলÑ রক্ত যদি স্বাধীনতার মূল্য হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশ অনেক মূল্যে স্বাধীনতা কিনেছে। সেই রক্তের দাগ জামায়াতে ইসলামীর হাতে লেগে আছে এবং সেটা তারা কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবে না। তারা বাংলাদেশ চায়নি। একাত্তরে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। বদর বাহিনী তৈরি করে দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, লেখকের হাত কেটেছে, চোখের চিকিৎসকের চোখ তুলে নিয়েছে, হৃদরোগ চিকিৎসকের বুক চিরে হৃৎপি- বের করে নিয়েছে। প্রায় অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেছে কিন্তু তারা একবারও নিজেদের দোষ স্বীকার করেনি। দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চায়নি। একাত্তর আমাদের কাছে পুরনো ইতিহাস নয়, একাত্তরের ইতিহাস আমাদের বুকের রক্তক্ষরণ।

আমি অনেক সহজে বিভ্রান্ত হয়ে যাই, কিন্তু এই একটি ব্যাপারে আমার কোনো বিভ্রান্তি নেই। কখনও ছিল না, কখনও থাকবে না।