সায়মার বাবার আকুতি

ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম

পত্রিকার পাতায় ছোট্ট একটি শিরোনাম ‘সায়মার বাবার আকুতি’। তিনি বলেছেন, ‘আপনাদের যাদের মেয়ে আছে, সন্তান আছে এরকম কুরুচিপূর্ণ, এরকম পশুত্বসুলভ আচরণকারীদের কাছ থেকে কিভাবে দূরে রাখবেন, আপনারা একটু ভেবে দেখবেন। এসব পশুর কাছ থেকে বাচ্চাদের রক্ষার চেষ্টা করুন। আমি হয়তো পারিনি আমার মেয়েকে রক্ষা করতে’। নিজেরে মেয়েকে হারিয়ে এভাবেই সব অভিভাবকদের কাছে আকুতি জানিয়েছেন নিহত শিশু সায়মার হতভাগ্য বাবা। রাজধানীর ওয়ারীতে ধর্ষণের পর হত্যাকা-ের শিকার ৭ বছরের ফুলেরমতো ফুটফুটে সুন্দর শিশু সায়মা। সায়মার মতো বহু শিশু এ নির্মমতার শিকার হচ্ছে হরহামেশায়। গত ৫ জানুয়ারি, শনিবার ঢাকার গে-ারিয়া এলাকার ঘটনা। আয়েশা নামের দুই বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শিশুটির পরিবারের অভিযোগ, নাহিদ (৪৫) নামের এক প্রতিবেশী শিশুটির বাসার পাশের একটি চার তলা ভবনের তিন তলায় থাকেন। নাহিদ দুই বছরের ওই শিশুকে খিচুড়ি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে নিজের বাসায় ডেকে নেয়। পরে শিশুটিকে ‘ধর্ষণের’ পর তিন তলার বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করে। ৬ জানুয়ারি, রোববার সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গাবতলা গ্রামে ৮ বছর বয়সী এক শিশু ‘ধর্ষণের’ শিকার হয়। ধর্ষণের পর শিশুটি অবচেতন হয়ে গেলে, মারা গেছে ভেবে তাকে পার্শ্ববর্তী একটি পুকুরে ফেলে দেয়া হয়। পরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ৭ জানুয়ারি, সোমবার ঢাকার ডেমরা এলাকার একটি ঘরের খাটের নিচ থেকে ফারিয়া আক্তার দোলা (৫) ও নুসরাত (সাড়ে ৪ বছর) নামের দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। যে ঘর থেকে শিশু দুটির লাশ উদ্ধার করা হয় ওই ঘরের মালিক মোস্তফা ও তার মামাতো ভাই আজিজুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে জবানবন্দিতে তারা স্বীকার করে, শিশু দুটিকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে তারা। শুধু সংবাদপত্রে শিরোনাম হওয়া গত ৫ বছরের শিশু নির্যাতনের চিত্রই খুব ভয়াবহ। শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, আর ধর্ষণের পর অপমানে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে অনেক। এমনকি ধর্ষণের হাত থেকে প্রতিবন্ধী শিশুরাও রেহাই পায়নি।

শিশুদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে সারা দেশে ২৩২২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে আরও ৬৩৯ জন শিশু। অন্যদিকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ গত চার বছরে সারা দেশে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৩১ জন শিশুকে। এ ছাড়া ধর্ষণের পর অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ১৯ জন শিশু। আর ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ গত তিন বছরে সারা দেশে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩১ শিশু। একই সঙ্গে এই তিন বছরে সারা দেশে ১১২ জন প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বিএসএএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৯৯ শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ২১ শিশু। কিন্ত পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালে এসে শিশু নির্যাতনের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। ২০১৫ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫২১ শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ১৪৩ শিশু। এ ছাড়াও ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ৩০ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে চার শিশু। ওই সংস্থার ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ওই বছরে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৪৬ জন শিশু। আর ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ১৩৪ জন শিশু। এ ছাড়াও ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ২১ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে দুই শিশু। ২০১৬ সালের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬৮ শিশু ওই বছর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। এ ছাড়া সে বছর ৪২ জন প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়। বিএসএএফের ২০১৭ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয় ৫৯৩ জন শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ১৬২ জন শিশু। এ ছাড়াও ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ২২ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে সাত শিশু। ২০১৭ সালের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৭০ জন শিশু ওই বছর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর ২০১৭ সালে সারা দেশে ৪৪ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া সংস্থাটির সর্বশেষ পরিসখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৬৩ জন শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয় ১৭৯ শিশু। এ ছাড়া ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫৮ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে ছয় শিশু। এই ১১ মাসে ৯৩ জন শিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। এ ছাড়া এই সময়ের মধ্যে ২৬ জন প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়। চলতি ২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাসে ৬৩০ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে। কেন এই নির্মম ও নিষ্ঠুরতা? ব্যক্তিগত লালসা, আচরণগত ও নানা কারণে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েছে।

আমাদের দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে, তারা (শিশুরা) ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচার মতো সক্ষমতা রাখে না। খুব সহজেই তাদের ওপর জোর-জবরদস্তি করা যায়। বয়সের কারণে তারা বড়দের মতো প্রতিবাদ করতে পারে না ও আত্মরক্ষাও করতে পারে না। ফলে যে সব মানুষের মধ্যে ধর্ষণ প্রবণতা আছে। তারা এই সুযোগকে কাজে লাগায়। তারা শিশু এবং বিকলাঙ্গ নারীদের টার্গেট করে।’ ‘আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়াটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ভয়ানক চিত্র ও সতর্কবাণী। ধর্ষণের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সব ধর্ষণের ঘটনার পেছনে দায়ী মূলত কয়েকটি বিষয়। প্রথমত হলো- প্রযুক্তির অপব্যবহার। কারণ ইন্টারনেটে অতি সহজে যৌন ছবি, উত্তেজক ভিডিও পাওয়া যায়। ফলে ধর্ষণের নৈরাজ্য বেড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে- পুঁজিবাদের ফলে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মানুষের মধ্যে দূরত্ব, পারস্পারিক সম্মানবোধ, সহনশীল আচরণ অনেকটাই কমে গেছে। আর একইসঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। আরও একটি কারণ আমি মনে করি যে, ধর্ষণের ঘটনায় বিচারের ক্ষেত্রে এক প্রকার শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়। এটা থেকে বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়। যখন কোন ধর্ষণের দ্রুত বিচার না হয়, তখন এটি আরও একটি ধর্ষণের ঘটনার জন্য দায়ী। এই সব বিষয়গুলো যদি সরকার বা রাষ্ট্র মাথায় রেখে কাজ করে, তবে ধর্ষণের ঘটনা অনেকাংশে কমে যেতে পারে।’ অপরদিকে পুলিশের মতে বিকৃত মানসিকতা ও মাদকাসক্তির কারণে সমাজের এমন অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে পুলিশ সব সময় এসব ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামিদের গ্রেফতারে তৎপর থাকে এবং তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতে বদ্ধ পরিকর। এই পৈচাশিক, নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা সচেতন নাগরিক সমাজকে রুখে দাঁড়াতে হবে। এবিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৮ জুলাই সোমবার গণভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ‘ধর্ষণের বিরুদ্ধে পুরুষ সমাজেরও আওয়াজ তোলা উচিত’। হ্যাঁ, সচেতন মহল তথা পুরুষ সমাজকে এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। রুখে দাড়াতে হবে ঐসব মানুষ নামের পশুদের বিরূদ্ধে।

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন ]

শুক্রবার, ১২ জুলাই ২০১৯ , ২৮ আষাঢ় ১৪২৫, ৮ জিলকদ ১৪৪০

সায়মার বাবার আকুতি

ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম

পত্রিকার পাতায় ছোট্ট একটি শিরোনাম ‘সায়মার বাবার আকুতি’। তিনি বলেছেন, ‘আপনাদের যাদের মেয়ে আছে, সন্তান আছে এরকম কুরুচিপূর্ণ, এরকম পশুত্বসুলভ আচরণকারীদের কাছ থেকে কিভাবে দূরে রাখবেন, আপনারা একটু ভেবে দেখবেন। এসব পশুর কাছ থেকে বাচ্চাদের রক্ষার চেষ্টা করুন। আমি হয়তো পারিনি আমার মেয়েকে রক্ষা করতে’। নিজেরে মেয়েকে হারিয়ে এভাবেই সব অভিভাবকদের কাছে আকুতি জানিয়েছেন নিহত শিশু সায়মার হতভাগ্য বাবা। রাজধানীর ওয়ারীতে ধর্ষণের পর হত্যাকা-ের শিকার ৭ বছরের ফুলেরমতো ফুটফুটে সুন্দর শিশু সায়মা। সায়মার মতো বহু শিশু এ নির্মমতার শিকার হচ্ছে হরহামেশায়। গত ৫ জানুয়ারি, শনিবার ঢাকার গে-ারিয়া এলাকার ঘটনা। আয়েশা নামের দুই বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শিশুটির পরিবারের অভিযোগ, নাহিদ (৪৫) নামের এক প্রতিবেশী শিশুটির বাসার পাশের একটি চার তলা ভবনের তিন তলায় থাকেন। নাহিদ দুই বছরের ওই শিশুকে খিচুড়ি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে নিজের বাসায় ডেকে নেয়। পরে শিশুটিকে ‘ধর্ষণের’ পর তিন তলার বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করে। ৬ জানুয়ারি, রোববার সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গাবতলা গ্রামে ৮ বছর বয়সী এক শিশু ‘ধর্ষণের’ শিকার হয়। ধর্ষণের পর শিশুটি অবচেতন হয়ে গেলে, মারা গেছে ভেবে তাকে পার্শ্ববর্তী একটি পুকুরে ফেলে দেয়া হয়। পরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ৭ জানুয়ারি, সোমবার ঢাকার ডেমরা এলাকার একটি ঘরের খাটের নিচ থেকে ফারিয়া আক্তার দোলা (৫) ও নুসরাত (সাড়ে ৪ বছর) নামের দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। যে ঘর থেকে শিশু দুটির লাশ উদ্ধার করা হয় ওই ঘরের মালিক মোস্তফা ও তার মামাতো ভাই আজিজুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে জবানবন্দিতে তারা স্বীকার করে, শিশু দুটিকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে তারা। শুধু সংবাদপত্রে শিরোনাম হওয়া গত ৫ বছরের শিশু নির্যাতনের চিত্রই খুব ভয়াবহ। শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, আর ধর্ষণের পর অপমানে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে অনেক। এমনকি ধর্ষণের হাত থেকে প্রতিবন্ধী শিশুরাও রেহাই পায়নি।

শিশুদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে সারা দেশে ২৩২২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে আরও ৬৩৯ জন শিশু। অন্যদিকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ গত চার বছরে সারা দেশে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৩১ জন শিশুকে। এ ছাড়া ধর্ষণের পর অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ১৯ জন শিশু। আর ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ গত তিন বছরে সারা দেশে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩১ শিশু। একই সঙ্গে এই তিন বছরে সারা দেশে ১১২ জন প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বিএসএএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৯৯ শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ২১ শিশু। কিন্ত পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালে এসে শিশু নির্যাতনের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। ২০১৫ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫২১ শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ১৪৩ শিশু। এ ছাড়াও ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ৩০ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে চার শিশু। ওই সংস্থার ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ওই বছরে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৪৬ জন শিশু। আর ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ১৩৪ জন শিশু। এ ছাড়াও ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ২১ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে দুই শিশু। ২০১৬ সালের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬৮ শিশু ওই বছর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। এ ছাড়া সে বছর ৪২ জন প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়। বিএসএএফের ২০১৭ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয় ৫৯৩ জন শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ১৬২ জন শিশু। এ ছাড়াও ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ২২ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে সাত শিশু। ২০১৭ সালের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৭০ জন শিশু ওই বছর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর ২০১৭ সালে সারা দেশে ৪৪ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া সংস্থাটির সর্বশেষ পরিসখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৬৩ জন শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয় ১৭৯ শিশু। এ ছাড়া ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫৮ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে ছয় শিশু। এই ১১ মাসে ৯৩ জন শিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। এ ছাড়া এই সময়ের মধ্যে ২৬ জন প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়। চলতি ২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাসে ৬৩০ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে। কেন এই নির্মম ও নিষ্ঠুরতা? ব্যক্তিগত লালসা, আচরণগত ও নানা কারণে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েছে।

আমাদের দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে, তারা (শিশুরা) ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচার মতো সক্ষমতা রাখে না। খুব সহজেই তাদের ওপর জোর-জবরদস্তি করা যায়। বয়সের কারণে তারা বড়দের মতো প্রতিবাদ করতে পারে না ও আত্মরক্ষাও করতে পারে না। ফলে যে সব মানুষের মধ্যে ধর্ষণ প্রবণতা আছে। তারা এই সুযোগকে কাজে লাগায়। তারা শিশু এবং বিকলাঙ্গ নারীদের টার্গেট করে।’ ‘আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়াটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ভয়ানক চিত্র ও সতর্কবাণী। ধর্ষণের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সব ধর্ষণের ঘটনার পেছনে দায়ী মূলত কয়েকটি বিষয়। প্রথমত হলো- প্রযুক্তির অপব্যবহার। কারণ ইন্টারনেটে অতি সহজে যৌন ছবি, উত্তেজক ভিডিও পাওয়া যায়। ফলে ধর্ষণের নৈরাজ্য বেড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে- পুঁজিবাদের ফলে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মানুষের মধ্যে দূরত্ব, পারস্পারিক সম্মানবোধ, সহনশীল আচরণ অনেকটাই কমে গেছে। আর একইসঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। আরও একটি কারণ আমি মনে করি যে, ধর্ষণের ঘটনায় বিচারের ক্ষেত্রে এক প্রকার শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়। এটা থেকে বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়। যখন কোন ধর্ষণের দ্রুত বিচার না হয়, তখন এটি আরও একটি ধর্ষণের ঘটনার জন্য দায়ী। এই সব বিষয়গুলো যদি সরকার বা রাষ্ট্র মাথায় রেখে কাজ করে, তবে ধর্ষণের ঘটনা অনেকাংশে কমে যেতে পারে।’ অপরদিকে পুলিশের মতে বিকৃত মানসিকতা ও মাদকাসক্তির কারণে সমাজের এমন অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে পুলিশ সব সময় এসব ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামিদের গ্রেফতারে তৎপর থাকে এবং তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতে বদ্ধ পরিকর। এই পৈচাশিক, নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা সচেতন নাগরিক সমাজকে রুখে দাঁড়াতে হবে। এবিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৮ জুলাই সোমবার গণভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ‘ধর্ষণের বিরুদ্ধে পুরুষ সমাজেরও আওয়াজ তোলা উচিত’। হ্যাঁ, সচেতন মহল তথা পুরুষ সমাজকে এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। রুখে দাড়াতে হবে ঐসব মানুষ নামের পশুদের বিরূদ্ধে।

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন ]