নিজেকে বাঁচাতে ৫ জনকে দায়ী করেন বাছির

এবার নিজেকে বাঁচাতে আরও ৫ জনকে জড়িয়ে অভিযোগ করেছেন বরখাস্ত দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির। এতে তিনি দাবি করেছেন ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নথিভুক্ত করতে তাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছিলেন দুদকের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। তাকে (খন্দকার বাছির) দিয়ে ডিআইজি মিজানের পক্ষে অনুসন্ধান প্রতিবেদন চাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন ওই কর্মকর্তারা। এরপরই তাকে এ অভিযোগে জড়ানো হয়। খন্দকার বাছির গত ১০ জুলাই ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রধান দুদকের উপ-পরিচালক ফানাফিল্লার কাছে লিখিতভাবে এ বক্তব্য দেন। প্রসঙ্গত, ডিআইজি মিজানের সঙ্গে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে তাকে গত ১০ জুন দুদক পরিচালক পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

লিখিত বক্তব্যে বাছির নিজেকে নির্দোষ দাবি করে পাঁচ জনকে দায়ী করেছেন। তারা হলেন, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক দুদক চেয়ারম্যানে বন্ধু আবদুল দয়াছ, দুদক পরিচালক কাজী সফিক ও নাসিম আনোয়ার এবং অবসরে যাওয়া পরিচালক আবদুল আজিজ ভূঁইয়া ও জায়েদ হোসেন খান।

বক্তব্যের শুরুতে গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে তিনি দুদকে হাজির হয়ে এ বিষয়ে বক্তব্য দেননি বলে উল্লেখ করেন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিতে ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে দু’দফায় ৪০ লাখ টাকা ঘুষগ্রহণ এবং ছেলের স্কুলের জন্য গাড়ি দাবি করার অভিযোগ ওঠে বাছিরের বিরুদ্ধে। এরপর পরিচালকদের পদ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে দুদক। পরে এ ঘটনায় অনুসন্ধানে দুদকের উপ-পরিচালক ফানাফিল্লা ও সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান এবং সালাউদ্দিনের সমন্বয়ে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই টিম ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে খন্দকার এনামুল বাছিরের ঘুষ নেয়া, ঘুষের বিষয়ে টেলিফোনে কথোপকথনের অডিও রেকর্ডের সত্যতা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিআইজি মিজান (বর্তমানে গ্রেফতার হয়ে জেলে) ও খন্দকার বাছিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে। তবে এ দুজনের একজনও সময়মতো দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য দেননি। এরমধ্যে ডিআইজি মিজানের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী এবং গাড়িচালককে তলব করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খন্দকার বাছিরকে দু’দফা তলব করে দুদক। প্রথম দফায় গত ২৪ জুন নোটিস পাঠিয়ে ১ জুলাই দুদকে হাজির হতে বলা হয়েছিল। ওই দিন অসুস্থতার অজুহাতে তিনি হাজির হননি। ওই দিনই দ্বিতীয় দফায় নোটিস পাঠানো হয়। নোটিসে ১০ জুলাই দুদকে হাজির হওয়ার কথা বলা হয়। এদিনও গ্রেফতার হওয়ার ভয় দেখিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য পাঠান বাছির। তার লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করে দুদকের টিম।

লিখিত বক্তব্যে বাছির ঘুষ লেনদেনের অডিও প্রকাশের ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে খন্দকার এনামুল বাছির বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মামলা হবে। মামলার পর গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়া হবে বলে জানতে পেরেছি। দুদকের উচ্চপর্যায় থেকেও বলা হচ্ছে ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ সত্য। এ অবস্থায় সশরীরে দুদকে হাজির হওয়া নিরাপদ মনে করছি না। দুদক বিধিমালা, ২০০৭-এর বিধি ৭ (৮) অনুযায়ী লিখিত বক্তব্য আইনজীবীর মাধ্যমে পাঠানো হলো।’

লিখিত বক্তব্যে বাছির বলেন, ‘কথোপকথনের একসেট অডিও সত্য ধরে দুদক আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করেছে। ঘুষ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান চলছে। সম্পদের খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, কথোপকথনের আরেক সেট অডিও আমলে নিচ্ছে না দুদক। ওই অডিওতে লন্ডন প্রবাসী আবদুল দয়াছ, দুদক পরিচালক কাজী সফিক ও নাসিম আনোয়ার এবং অবসরে যাওয়া পরিচালক আবদুল আজিজ ভূঁইয়া ও জায়েদ হোসেন খানকে নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু তাদের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।’ বাছির আরও বলেন, ‘ঘুষ লেনদেনের অডিও প্রকাশের পর দুদকের শীর্ষপর্যায় থেকে আমার সম্পর্কে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। ডিআইজি মিজানের সম্পদ অনুসন্ধানের বিষয়ে বলা হচ্ছে দেড় বছরেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারিনি। সঠিক তথ্য হলো, গত বছরের ২৯ অক্টোবর ডিআইজি মিজানের সম্পদ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাই। এর আগে অনুসন্ধানের দায়িত্বে ছিলেন উপ-পরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী। তিনিও মিজানের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। আর মিজানও তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ এনেছিলেন। এ কারণে পাটোয়ারীকে বরখাস্ত হতে হয়েছে। মিজান নিজে বাঁচার জন্য আমাকেও ফাঁসিয়েছেন। ঘুষ কেলেঙ্কারির অডিও প্রকাশের নাটক সাজিয়েছেন।’

বাছির দাবি করেছেন, ‘চলতি বছরের পুরো মার্চ মাস ও মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ডিআইজি মিজানের সম্পদ যাচাই করি। ২৩ মে মামলার সুপারিশসহ প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেই, যা ২৬ মে গৃহীত হয়।’ ‘ডিআইজি মিজানের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপ-পরিচালক পাটোয়ারীকে শাস্তি দিয়েছিল কমিশন। আর এ ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন মিজান। আমার বিরুদ্ধেও অভিযোগ করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। মিজান তার ড্রাইভারের নামে ফোন কিনে কথা চালাচালি, মেসেজ চালাচালি করেছেন এবং তা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আর এর ভিত্তিতেই দুদক আমার বিরুদ্ধে ওঠা ঘুষ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান করছে। আমি মিজানের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে চেয়েছিলাম। ১ জুলাই আবেদনও করেছি। কিন্তু কমিশন থেকে অনুমতি মেলেনি।’ গত বছরের ২৯ অক্টোবর দায়িত্ব পাওয়ার ১ থেকে দেড়ঘণ্টার মধ্যেই মিজান আমার দফতরে হাজির হন। তার স্ত্রীর সম্পদ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাওয়ার আগেই মিজান জানতে পারেন আমিই অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করব। অথচ দায়িত্ব পাওয়ার আগে এ বিষয়ে কিছুই জানা ছিল না আমার। এ থেকে বোঝা যায়, কমিশনের অভ্যন্তরীণ তথ্য পাওয়ার মতো যোগাযোগ মিজানের আছে।’

অডিও অনুযায়ী আবদুল দয়াছ, ডিআইজি মিজানসহ আরও কয়েকজন পরিচালক কীভাবে আমাকে ম্যানেজ করবে সেটা নিয়ে খুব চিন্তিত। ওই অডিও অনুযায়ী আমি ফোন ধরি না। কথা বলি না। আমাকে জোর করা যাচ্ছে না। ওই অডিওতে আরও শোনা যায়, ডিআইজি মিজান বলছেন, দুদকের নিম্নপর্যায় থেকে তিনি জানতে পেরেছেন আমি অনেক কাজ করছি। কিন্তু কী কাজ করছি সেটি তিনি জানতে পারছেন না। এ থেকেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয় যে, ডিআইজি মিজান দুদকের ভেতরের অন্য কোন সূত্র থেকে তথ্য পাচ্ছিলেন।’ লিখিত বক্তব্যে বাছির দাবি করেন, ‘আমার বিরুদ্ধে তথ্য ফাঁসের অভিযোগ আনা হলেও কী তথ্য ফাঁস করেছি তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি। বাস্তবে আমি কোন তথ্য ফাঁস করিনি।’

ঘুষ লেনদেনের অডিওকে ‘কথিত অডিও’ মন্তব্য করে বাছির দাবি করেন, যে প্রক্রিয়ায় তার কণ্ঠ পরীক্ষা করা হয়েছে তা সঠিক হয়নি। তার দাবি, এনটিএমসি কণ্ঠ পরীক্ষার উপযুক্ত স্থান নয়। ‘এনটিএমসিতে আদালত স্বীকৃত ফরেনসিক বিভাগ নেই। ফরেনসিক পরীক্ষা সম্পাদনের জন্য আদালত স্বীকৃত পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়, যা এনটিএমসি’র নেই। টেলিফোনিক রেকর্ড ব্যতীত অন্য কোন রেকর্ড বা রেকর্ডিং এনটিএমসি সরবরাহ করতে পারে না। মামলা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুরোধ ছাড়া কোন ফোন কল রেকর্ড করা এবং সেটা সংরক্ষণ করা বেআইনি এবং এনটিএমসি’র এখতিয়ারের বাইরে। ডিআইজি মিজানের ফোন এবং তার ড্রাইভার হৃদয়ের নামে রেজিস্টার করা সিম ও ফোনের কথোপকথন, মেসেজ, মোবাইল টাওয়ারের রেকর্ড আমার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা অযৌক্তিক।’

নির্দোষ দাবির পাশাপাশি সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করে বাছির দাবি করেছেন, ‘১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে জেলা দুর্নীতি দমন কর্মকর্তা হিসেবে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন তিনি। ২০১২ সালে ১২ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনে পরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। পরিচালক পদে দায়িত্ব পালনকালে সাক্ষী হাজির করার হার শতকরা ২৭ ভাগ থেকে শতকরা ৫৪ ভাগে উন্নীত হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি মামলার বিচার নিষ্পত্তির হার বাড়ে। সাজার হার শতকরা ২৬ ভাগ থেকে শতকরা ৪৭ ভাগে উন্নীত হয়।’ ‘আমাকে নিয়ে দুদকের উচ্চপর্যায়ের কিছু লোকের ষড়যন্ত্র আছে। পদোন্নতি নিয়ে দুদকের সঙ্গে আমার অভ্যন্তরীণ বিরোধ চলছিল। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি মেলেনি। এ পরিস্থিতিতে দুদকের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগে রিট দাখিল করেছি। হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চ গত ২০ জানুয়ারি রুল ইস্যু করেন এবং ২৯ জানুয়ারি দুদকের বিরুদ্ধে প্রেষণ ও চুক্তিভিত্তিক মহাপরিচালক নিয়োগের বিরুদ্ধে অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। সেইসঙ্গে আমার পদোন্নতির জন্য একটি পদ সংরক্ষণ করার আদেশ দেন। রিটের শুনানি হলেই আমার জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। তাই সেই রিটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে দুদক শুনানি এতদিন আটকে রেখেছে। এখন সেই সাময়িক বরখাস্তের অ্যাকশন নিলে রিট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য ঘুষ লেনদেনের কথোপকথন (অডিও) পরীক্ষার আগেই দোষী সাব্যস্ত করে বিভাগীয় মামলা করেছে দুদক। আমাকে নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে।’

আরও খবর
শপথ নিলেন মন্ত্রী ইমরান প্রতিমন্ত্রী ইন্দিরা
দেখবেন, দুর্নীতির কারণে যেন অর্জনগুলো নষ্ট না হয়
ঢাকায় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী লি
বারোভূতে লুটেপুটে খাচ্ছে খুলনা রেলওয়ের কোটি কোটি টাকার সম্পদ
হিন্দু পারিবারিক আইন বাতিল দাবি
বেনাপোল-ঢাকা ১৭ জুলাই চালু হচ্ছে বিরতিহীন ট্রেন
তৃতীয় বর্ষে ফেল করে চতুর্থ বর্ষে পরীক্ষা দিচ্ছেন ঢাবি ছাত্রলীগ সা. সম্পাদক
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দাবি
পূর্ববিরোধের জেরে হত্যাকান্ড ঘটে
জিয়া হত্যায় বেশি লাভবান খালেদা
নভোথিয়েটারে মাসব্যাপী আলোকচিত্র প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত
মির্জাপুরে রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী পালিত

রবিবার, ১৪ জুলাই ২০১৯ , ৩০ আষাঢ় ১৪২৫, ১০ জিলকদ ১৪৪০

নিজেকে বাঁচাতে ৫ জনকে দায়ী করেন বাছির

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

এবার নিজেকে বাঁচাতে আরও ৫ জনকে জড়িয়ে অভিযোগ করেছেন বরখাস্ত দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির। এতে তিনি দাবি করেছেন ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নথিভুক্ত করতে তাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছিলেন দুদকের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। তাকে (খন্দকার বাছির) দিয়ে ডিআইজি মিজানের পক্ষে অনুসন্ধান প্রতিবেদন চাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন ওই কর্মকর্তারা। এরপরই তাকে এ অভিযোগে জড়ানো হয়। খন্দকার বাছির গত ১০ জুলাই ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রধান দুদকের উপ-পরিচালক ফানাফিল্লার কাছে লিখিতভাবে এ বক্তব্য দেন। প্রসঙ্গত, ডিআইজি মিজানের সঙ্গে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে তাকে গত ১০ জুন দুদক পরিচালক পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

লিখিত বক্তব্যে বাছির নিজেকে নির্দোষ দাবি করে পাঁচ জনকে দায়ী করেছেন। তারা হলেন, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক দুদক চেয়ারম্যানে বন্ধু আবদুল দয়াছ, দুদক পরিচালক কাজী সফিক ও নাসিম আনোয়ার এবং অবসরে যাওয়া পরিচালক আবদুল আজিজ ভূঁইয়া ও জায়েদ হোসেন খান।

বক্তব্যের শুরুতে গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে তিনি দুদকে হাজির হয়ে এ বিষয়ে বক্তব্য দেননি বলে উল্লেখ করেন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিতে ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে দু’দফায় ৪০ লাখ টাকা ঘুষগ্রহণ এবং ছেলের স্কুলের জন্য গাড়ি দাবি করার অভিযোগ ওঠে বাছিরের বিরুদ্ধে। এরপর পরিচালকদের পদ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে দুদক। পরে এ ঘটনায় অনুসন্ধানে দুদকের উপ-পরিচালক ফানাফিল্লা ও সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান এবং সালাউদ্দিনের সমন্বয়ে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই টিম ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে খন্দকার এনামুল বাছিরের ঘুষ নেয়া, ঘুষের বিষয়ে টেলিফোনে কথোপকথনের অডিও রেকর্ডের সত্যতা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিআইজি মিজান (বর্তমানে গ্রেফতার হয়ে জেলে) ও খন্দকার বাছিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে। তবে এ দুজনের একজনও সময়মতো দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য দেননি। এরমধ্যে ডিআইজি মিজানের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী এবং গাড়িচালককে তলব করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খন্দকার বাছিরকে দু’দফা তলব করে দুদক। প্রথম দফায় গত ২৪ জুন নোটিস পাঠিয়ে ১ জুলাই দুদকে হাজির হতে বলা হয়েছিল। ওই দিন অসুস্থতার অজুহাতে তিনি হাজির হননি। ওই দিনই দ্বিতীয় দফায় নোটিস পাঠানো হয়। নোটিসে ১০ জুলাই দুদকে হাজির হওয়ার কথা বলা হয়। এদিনও গ্রেফতার হওয়ার ভয় দেখিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য পাঠান বাছির। তার লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করে দুদকের টিম।

লিখিত বক্তব্যে বাছির ঘুষ লেনদেনের অডিও প্রকাশের ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে খন্দকার এনামুল বাছির বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মামলা হবে। মামলার পর গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়া হবে বলে জানতে পেরেছি। দুদকের উচ্চপর্যায় থেকেও বলা হচ্ছে ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ সত্য। এ অবস্থায় সশরীরে দুদকে হাজির হওয়া নিরাপদ মনে করছি না। দুদক বিধিমালা, ২০০৭-এর বিধি ৭ (৮) অনুযায়ী লিখিত বক্তব্য আইনজীবীর মাধ্যমে পাঠানো হলো।’

লিখিত বক্তব্যে বাছির বলেন, ‘কথোপকথনের একসেট অডিও সত্য ধরে দুদক আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করেছে। ঘুষ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান চলছে। সম্পদের খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, কথোপকথনের আরেক সেট অডিও আমলে নিচ্ছে না দুদক। ওই অডিওতে লন্ডন প্রবাসী আবদুল দয়াছ, দুদক পরিচালক কাজী সফিক ও নাসিম আনোয়ার এবং অবসরে যাওয়া পরিচালক আবদুল আজিজ ভূঁইয়া ও জায়েদ হোসেন খানকে নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু তাদের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।’ বাছির আরও বলেন, ‘ঘুষ লেনদেনের অডিও প্রকাশের পর দুদকের শীর্ষপর্যায় থেকে আমার সম্পর্কে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। ডিআইজি মিজানের সম্পদ অনুসন্ধানের বিষয়ে বলা হচ্ছে দেড় বছরেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারিনি। সঠিক তথ্য হলো, গত বছরের ২৯ অক্টোবর ডিআইজি মিজানের সম্পদ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাই। এর আগে অনুসন্ধানের দায়িত্বে ছিলেন উপ-পরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী। তিনিও মিজানের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। আর মিজানও তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ এনেছিলেন। এ কারণে পাটোয়ারীকে বরখাস্ত হতে হয়েছে। মিজান নিজে বাঁচার জন্য আমাকেও ফাঁসিয়েছেন। ঘুষ কেলেঙ্কারির অডিও প্রকাশের নাটক সাজিয়েছেন।’

বাছির দাবি করেছেন, ‘চলতি বছরের পুরো মার্চ মাস ও মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ডিআইজি মিজানের সম্পদ যাচাই করি। ২৩ মে মামলার সুপারিশসহ প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেই, যা ২৬ মে গৃহীত হয়।’ ‘ডিআইজি মিজানের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপ-পরিচালক পাটোয়ারীকে শাস্তি দিয়েছিল কমিশন। আর এ ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন মিজান। আমার বিরুদ্ধেও অভিযোগ করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। মিজান তার ড্রাইভারের নামে ফোন কিনে কথা চালাচালি, মেসেজ চালাচালি করেছেন এবং তা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আর এর ভিত্তিতেই দুদক আমার বিরুদ্ধে ওঠা ঘুষ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান করছে। আমি মিজানের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে চেয়েছিলাম। ১ জুলাই আবেদনও করেছি। কিন্তু কমিশন থেকে অনুমতি মেলেনি।’ গত বছরের ২৯ অক্টোবর দায়িত্ব পাওয়ার ১ থেকে দেড়ঘণ্টার মধ্যেই মিজান আমার দফতরে হাজির হন। তার স্ত্রীর সম্পদ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাওয়ার আগেই মিজান জানতে পারেন আমিই অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করব। অথচ দায়িত্ব পাওয়ার আগে এ বিষয়ে কিছুই জানা ছিল না আমার। এ থেকে বোঝা যায়, কমিশনের অভ্যন্তরীণ তথ্য পাওয়ার মতো যোগাযোগ মিজানের আছে।’

অডিও অনুযায়ী আবদুল দয়াছ, ডিআইজি মিজানসহ আরও কয়েকজন পরিচালক কীভাবে আমাকে ম্যানেজ করবে সেটা নিয়ে খুব চিন্তিত। ওই অডিও অনুযায়ী আমি ফোন ধরি না। কথা বলি না। আমাকে জোর করা যাচ্ছে না। ওই অডিওতে আরও শোনা যায়, ডিআইজি মিজান বলছেন, দুদকের নিম্নপর্যায় থেকে তিনি জানতে পেরেছেন আমি অনেক কাজ করছি। কিন্তু কী কাজ করছি সেটি তিনি জানতে পারছেন না। এ থেকেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয় যে, ডিআইজি মিজান দুদকের ভেতরের অন্য কোন সূত্র থেকে তথ্য পাচ্ছিলেন।’ লিখিত বক্তব্যে বাছির দাবি করেন, ‘আমার বিরুদ্ধে তথ্য ফাঁসের অভিযোগ আনা হলেও কী তথ্য ফাঁস করেছি তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি। বাস্তবে আমি কোন তথ্য ফাঁস করিনি।’

ঘুষ লেনদেনের অডিওকে ‘কথিত অডিও’ মন্তব্য করে বাছির দাবি করেন, যে প্রক্রিয়ায় তার কণ্ঠ পরীক্ষা করা হয়েছে তা সঠিক হয়নি। তার দাবি, এনটিএমসি কণ্ঠ পরীক্ষার উপযুক্ত স্থান নয়। ‘এনটিএমসিতে আদালত স্বীকৃত ফরেনসিক বিভাগ নেই। ফরেনসিক পরীক্ষা সম্পাদনের জন্য আদালত স্বীকৃত পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়, যা এনটিএমসি’র নেই। টেলিফোনিক রেকর্ড ব্যতীত অন্য কোন রেকর্ড বা রেকর্ডিং এনটিএমসি সরবরাহ করতে পারে না। মামলা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুরোধ ছাড়া কোন ফোন কল রেকর্ড করা এবং সেটা সংরক্ষণ করা বেআইনি এবং এনটিএমসি’র এখতিয়ারের বাইরে। ডিআইজি মিজানের ফোন এবং তার ড্রাইভার হৃদয়ের নামে রেজিস্টার করা সিম ও ফোনের কথোপকথন, মেসেজ, মোবাইল টাওয়ারের রেকর্ড আমার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা অযৌক্তিক।’

নির্দোষ দাবির পাশাপাশি সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করে বাছির দাবি করেছেন, ‘১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে জেলা দুর্নীতি দমন কর্মকর্তা হিসেবে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন তিনি। ২০১২ সালে ১২ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনে পরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। পরিচালক পদে দায়িত্ব পালনকালে সাক্ষী হাজির করার হার শতকরা ২৭ ভাগ থেকে শতকরা ৫৪ ভাগে উন্নীত হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি মামলার বিচার নিষ্পত্তির হার বাড়ে। সাজার হার শতকরা ২৬ ভাগ থেকে শতকরা ৪৭ ভাগে উন্নীত হয়।’ ‘আমাকে নিয়ে দুদকের উচ্চপর্যায়ের কিছু লোকের ষড়যন্ত্র আছে। পদোন্নতি নিয়ে দুদকের সঙ্গে আমার অভ্যন্তরীণ বিরোধ চলছিল। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি মেলেনি। এ পরিস্থিতিতে দুদকের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগে রিট দাখিল করেছি। হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চ গত ২০ জানুয়ারি রুল ইস্যু করেন এবং ২৯ জানুয়ারি দুদকের বিরুদ্ধে প্রেষণ ও চুক্তিভিত্তিক মহাপরিচালক নিয়োগের বিরুদ্ধে অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। সেইসঙ্গে আমার পদোন্নতির জন্য একটি পদ সংরক্ষণ করার আদেশ দেন। রিটের শুনানি হলেই আমার জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। তাই সেই রিটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে দুদক শুনানি এতদিন আটকে রেখেছে। এখন সেই সাময়িক বরখাস্তের অ্যাকশন নিলে রিট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য ঘুষ লেনদেনের কথোপকথন (অডিও) পরীক্ষার আগেই দোষী সাব্যস্ত করে বিভাগীয় মামলা করেছে দুদক। আমাকে নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে।’