ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯

সুপার ওভারে ‘সুপার’ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড

অবিশ্বাস্য, অবিস্মরণীয় ফাইনাল। কোন বিশেষণই যথেষ্ট নয় লর্ডসের ফাইনালের বর্ণনার জন্য। নির্ধারিত ৫০ ওভার টাই। সুপার ওভারও টাই। স্বাগতিক ইংল্যান্ড প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপা জিতলো অধিক সংখ্যক বাউন্ডারি হাঁকানোর জন্য। সুপার ওভারে ইংলিশরা ১৫ রান করলে জয়ের জন্য নিউজিল্যান্ড টপকাতে পারেনি সেই রান। শেষ বলে কিউইদের প্রয়োজন ছিল ২ রান। নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মার্টিন গাপটিল ছিলেন স্ট্রাইকে। দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে রান আউট হলে পুরো ইংল্যান্ড আনন্দের জোয়ারে ভাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফি স্পর্শ করার মুহূর্ত তৈরি হওয়ায়।

১৯৭৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ১৯৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়া আর ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের কাছে ফাইনালের ব্যর্থতা ভুলিয়ে দিলো ইংল্যান্ড। মাইক ব্রিয়ারলি, মাইক গ্যাটিং ও গ্রাহাম গুচদের আক্ষেপ ঘুচালেন এউইন মরগান। গত বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বে বিদায় নেয়ার পর থেকে যে উত্থান, তারই পুরস্কার তারা পেলো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে। দলকে শীর্ষ র‌্যাংকিংয়ে নেয়া অধিনায়কের হাতেই উঠলো বিশ্বকাপ ট্রফি।

লর্ডসের ফাইনালে মুখোমুখি হওয়া দুই দল ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ড উভয় দলের জন্যই ছিল প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের ম্যাচ। ম্যাচের রং পাল্টেছে প্রতি মুহূর্তে। কখনো ইংল্যান্ড আবার কখনো নিউজিল্যান্ডের দিকে হেলে পড়েছে ম্যাচ। নানা নাটকীয়তায় নির্ধারিত ৫০ ওভারে অমীমাংসিত থেকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল গড়ায় সুপার ওভারে। প্রথম সুপার ওভারের ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে পরাজিত করে ঘরের মাঠ তথা ক্রিকেটের তীর্থভূমি লর্ডসে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতল ইংল্যান্ড। এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশদের ৪৪ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। অন্যদিকে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও শিরোপা অধরা থাকল নিউজিল্যান্ডের। এবারের বিশ্বকাপে শিরোপা নিশ্চিত হলো বাউন্ডারি দিয়ে। বিশ্বকাপের আর দশটা ম্যাচের মতো ফাইনালের লড়াই হাই স্কোরিং হয়নি। ফাইনালের চাপে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং ডিপার্টমেন্ট নির্ধারিত ৫০ ওভারে আট উইকেটে তুলতে পেরেছিল ২৪১ রান। এবারের বিশ্বকাপে তিন শতাধিক রান তাড়া করে জয়ের বিষয়টাকে ডাল-ভাতে পরিণত করা ইংলিশরা ব্যাটিংয়ে নেমে ফাইনালের চাপে শুরুতে মাত্র ৮৬ রানে টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে চলে গিয়েছিল ব্যাকফুটে। তবে বেন স্টোকস ও জস বাটলারের ব্যাটে ঘুরে দাঁড়িয়ে শেষ ওভারের নাটকীয়তায় নির্ধারিত ৫০ ওভারে ২৪১ রানে অল আউট হলে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল গড়ায় সুপার ওভারে। বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ইনিংসে প্রায় প্রতিটা ম্যাচে দারুণ শুরুর ভিত গড়ে দেয়া জেসন রয় ফাইনালে পেরোতে পারেননি ২০ রানের কোটাও। কিউই পেসার ম্যাট হেনরির আউটসুংগারে পরাস্ত হয়ে জেসন রয় (১৭) ধরা পড়েন উইকেটরক্ষক টম লাথামের গ্লাভসে।

কিউই পেসারদের চমৎকার বোলিংয়ে মোটেও সুবিধা করতে পারছিলেন না জো রুট (৩০ বলে মাত্র ৭ রান)। সম্ভবত ফাইনালের চাপ নিতে পারছিলেন না তিনি। কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমের করা অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল তার ব্যাটে লেগে উইকেটরক্ষক টম লাথামের গ্লাভসে জমা হলে ইংলিশরা ৫৯ রানে হারায় দ্বিতীয় উইকেট।

দুইবার জীবন পেয়েও ইনিংস বড় করতে পারেননি জনি বেয়ারস্টো। লুকি ফার্গুসনের বলে তার স্ট্যাম্পে আঘাত করার আগে ৫৫ বলে ৭ বাউন্ডারিতে ৩৬ রান জমা দেন তিনি।

দলীয় ৭১ রানে তিন ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে ব্যাকফুটে চলে যাওয়া ইংলিশদের বিপদে ফেলে দলীয় ৮৬ রানে জিমি নিশামের বলে অধিনায়ক এউইন মরগান (৯) ধরা পড়েন লুতি ফার্গুসনের হাতে।

বেন স্টোকস ও জস বাটলারের ব্যাটে এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো ইংল্যান্ড। দুজনে ১১০ রানের জুটি গড়ে বিচ্ছিন্ন হন। লুকি ফার্গুসনের বল বদলি ফিল্ডার টিম সাউদির হাতে জমা দিয়ে বাটলার (৫৯) ফিরলে ভাঙে পঞ্চম উইকেটের পার্টনারশিপ।

ফার্গুসনের বল উইকেটকিপারের গ্লাভসে জমা দিয়ে ফেরেন ক্রিস ওকস (২)। দলীয় ২০৩ রানে ষষ্ঠ উইকেট হারানো ইংলিশরা ২২৬ রানে পৌঁছার পথে জিমি নিশামের বলে সাজঘরে পাঠায় লিয়াম প্লাংকেট ও জোফরা আর্চারকে (০)। ইনিংসের ৪৮তম ওভারে দলীয় ২২৬ রানে আট ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকা ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যান বেন স্টোকস শেষ ওভারে জমিয়ে দেন খেলা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিলো ১৫ রান। প্রথম দুটো বল ডট হয়। তৃতীয় বলে ঝক্কা হাঁকান স্টোকস। চতুর্থ বল মিডউইকেট সীমানার দিকে ঠেলে দ্রুত দুটো রান নিয়ে স্ট্রাইকিং প্রান্তে ফিরছিলেন স্টোকস। রান আউট করতে গিয়ে কিউই ফিল্ডার ট্রেন্ট বোল্ট এলোমেলো থ্রো করলে বল সীমানা পেরিয়ে যোগ হয় আরো চারটি রান। শেষ দুই বলে তিন রানের প্রয়োজন পড়ে। গ্যালারিতে ঘরের মাঠে প্রথম শিরোপা জয়ের জন্য তখন প্রস্তুতি প্রায় শুরু করে দিয়েছিলেন ইংলিশ সমর্থকরা। কিন্তু ক্রিকেট ঈশ্বরের মনে ছিলো ভিন্ন কিছু। পঞ্চম বলে দুই রান নিয়ে স্টোকস আবারও স্ট্রাইকিং প্রান্তে ফেরার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু আদিল রশীদ রান আউট হলে যোগ হয় এক রান। এক বলে দুই রানের প্রয়োজনে লং অনে বল ঠেলে দ্রুত দৌড়েও দুটো রান নিতে পারেননি স্টোকস। এক রান পূর্ণ হতেই বোলারস প্রান্তে ফেরার চেষ্টায় থাকা মার্ক উড হয়ে যান রান আউট। টাই হওয়া ম্যাচ গড়ায় সুপার ওভারে।

এর আগে দেড় মাসের বেশি সময় ধরে চলা আইসিসি ওডিআই বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে গতকাল ক্রিকেটের তীর্থভূমি লর্ডসের ফাইনালে মুখোমুখি হয় শিরোপাপ্রত্যাশী দুই দল নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। এই লড়াইয়ে ইংলিশ বোলাররা কিউইদের আটকে দিয়েছে মাত্র ২৪১ রানে। রানবন্যার এই বিশ্বকাপের ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের ইনিংসে বলার মতো স্কোর কেবল হেনরি নিকলসের ৫৫ এবং টম লাথামের ৪৭ রান। কিউই ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার ফলে ক্রিকেটের সূতিকাগার নামে পরিচিত বৃটিশরা জয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের জন্য পেয়েছে ২৪২ রানের টার্গেট।

সেই ১৯৭৫ সালে শুরু হওয়া আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের এবারের আসরে ঘরের মাটিতে ফেভারিট হিসেবেই শুরু করেছিা এউইন মরগানের নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ড। লর্ডসের ফাইনালেও টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং ডিপার্টমেন্টের ওপর গতকাল ইংলিশ বোলাররা হামলে পড়েছিল ফেভারিটের মতোই।টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরু থেকেই ইংলিশ পেসারদের তোপের মুখে পড়ে নিউজিল্যান্ড। পুরো টুর্নামেন্টে নিজের ছায়া হয়ে থাকা কিউই ওপেনার মার্টিন গাপটিল ফাইনালেও ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সপ্তম ওভারে ক্রিস ওকসের বলে লেগ বিফোর উইকেট হয়ে ফেরেন ১৯ রান করে। রিভিউ নিয়েও ক্রিজে থাকা হয়নি তার।

তবে গাপটিল আউট হওয়ার আগে ক্রিস ওকসের করা তৃতীয় ওভারে ফিল্ড আম্পায়ারের লেগ বিফোর উইকেটের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে বেঁচে গিয়েছিলেন আরেক ওপেনার হেনরি নিকোলস। শুরুর ধাক্কা সামলে নিকোলাসের সঙ্গে জুটি গড়ে দলকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন কেন উইলিয়ামসন। দলের স্কোর শতরানের কোটা পার হতেই ভাঙে এইে জুটি। ৫৩ বলে ৩০ রান করা কিউই অধিনায়ককে ফেরান লিয়াম প্লাংকেট। উইকেটকিপার জস বাটলারের গ্লাভসবন্দী হয়ে কেন উইলয়ামসন ফিরলে ৭৪ রানের জুটিটা আর ইংলিশদের আর চোখ রাঙাতে পারেনি।

কিউই ওপেনার হেনরি নিকোলস ৭১ বলে ৪ বাউন্ডারিতে হাফ সেঞ্চুরি পূরণ করে বেশিদূর যেতে পারেননি। ৫৫ রানে তাকেও ফেরান প্লাংকেট। বোল্ড হন নিকোলস। অভিজ্ঞ রস টেলরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিল কিউইরা। তাকে ১৫ রানে ইংলিশ পেসার মার্ক উড লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে জড়ালে দলীয় ১৪১ রানে টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে পায় নিউজিল্যান্ড। আশার আলো হয়ে থাকা জিমি নিশামকে (১৯) ফিরিয়ে তৃতীয় শিকার ধরেন প্লাংকেট।

ধুকতে থাকা কিউই ব্যাটিং লাইনআপ তারপরও ৪৪তম ওভারে দলের স্কোর দুশ’র কোটা পার করে। দলীয় ২১৯ রানে কলিন গ্র্যান্ডহোমকে (১৬) বদলি ফিল্ডার জেমস ভিন্সের তালুবন্দী করেন ক্রিস ওকস। হাফসেঞ্চুরির কাছে গিয়ে ব্যর্থ হন লাথাম। ৪৭ রান করে তৃতীয় শিকার হন ওকসের। শেষ ওভারে ম্যাট হেনরিকে (৪) বোল্ড করে দেন জোফরা আর্চার। ৩টি করে উইকেট নিয়েছেন ক্রিস ওকস এবং লিয়াম প্লাংকেট। ১টি করে উইকেট নিয়েছেন মার্ক উড এবং জোফরা আর্চার।

লর্ডসে এবারের বিশ্বকাপে আগের চারটি ম্যাচেই জিতেছে আগে ব্যাট করা দল। সেই ধারা ধরে রাখতে কিউই বোলারদের আরেকবার করতে হবে অসাধারণ কিছু। নইলে স্বাগতিকদের অপেক্ষায় বিশ্বসেরা হওয়ার উৎসব।

স্কোরকার্ড

নিউজিল্যান্ড

গাপটিল এলবিডব্লিউ ব ওবস ১৯

নিকোলস বোল্ড প্লাংকেট ৫৫

উইলিয়ামসন ক বাটলার ব প্লাংকেট ৩০

টেলর এলবিডব্লিউ ব উড ১৫

লাথাম ক (ভিন্স) ব ওকস ৪৭

নিশাম ক রুট ব প্লাংকেট ১৯

গ্র্যান্ডহোম ক (ভিন্স) ব ওকস ১৬

স্যান্টনার অপরাজিত ৫

হেনরি বোল্ড আর্চার ৪

বোল্ট অপরাজিত ১

অতিরিক্ত (লে-১২, নো-১, ও-১৭) ৩০

মোট (৫০ ওভারে ৮ উই.) ২৪১

উইকেট পতন : ১/২৯ (গাপটিল, ৬.২ ওভার), ২/১০৩ (উইলিয়ামসন, ২২.৪) (৩/১১৮ (নিকোলস, ২৬.৫) ৪/১৪১ (টেলর, ৩৩.১), ৫/১৭৩ (নিশাম, ৩৮.৬), ৬/২১৯ (গ্র্যান্ডহোম, ৪৬.৫), ৭/২৩২ (লাথাম, ৪৮.৩), ৮/২৪০ (হেনরি, ৪৯.৩)।

বোলিং : ওকস ৯-০-৩৭-৩, আর্চার ১০-০-৪২-১, প্লাংকেট ১০-০-৪২-৩, উড ১০-১-৪৯-১, রশিদ ৮-০-৩৯-০, স্টোকস ৩-০-২০-০।

ইংল্যান্ড

জেসন রয় ক লাথাম ব হেনরি ১৭

বেয়ারস্ট্রো বোল্ড ফার্গুসন ৩৬

জো রুটস ক লাথাম ব গ্র্যান্ডহোম ৭

মরগান ক ফার্গুসন ব নিশাম ৯

স্টোকস অপরাজিত ৮৪

বাটলার ক (সাউদি) ব ফার্গুসন ৫৯

ওকস ক লাথাম ব ফার্গুসন ২

প্লাংকেট ক বোল্ট ব নিশাম ১০

আর্চার বোল্ড নিশাম ০

রশিদ রান আউট ০

উড রান আউট ০

অতিরিক্ত (বা-২, লে-৩, ও-১২) ১৭

মোট (৫০ ওভারে অল আউট) ২৪১

উইকেট পতন : ১/২৮ (রয়, ৫.৪ ওভার), ২/৫৯ (রুট, ১৬.৩), ৩/৭১ (বেয়ারস্ট্রো, ১৯.৩), ৪/৮৬, মরগান, ২৩.১), ৫/১৯৬ (বাটলার, ৪৪.৫), ৬/২০৩ (ওকস, ৪৬.১), ৭/২২০ (প্লাংকেট, ৪৮.৩), ৮/২২৭ (আর্চার, ৪৮.৬), ৯/২৪০ (রশিদ, ৪৯.৫), ১০/২৪১ (উড, ৪৯.৬)।

বোলিং : বাটলার ১০-০-৬৭-০, হেনরি ১০-২-৪০-১, গ্র্যান্ডহোম ১০-২-২৫-১, ফার্গুসন ১০-০-৫০-৩, নিশাম ৭-০-৪৩-৩, স্যান্টনার ৩-০-১১-০।

ম্যান অব দ্য ফাইনাল : বেন স্টোকস।

প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট : কেন উইলিয়ামসন।

লর্ডসের গ্যালারি থেকে নিহাদ কবির

ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের লর্ডসে বসে দেখছি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল। ছোট্ট দেশ নিউজিল্যান্ড জিতবে, নাকি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভগ্নাবশেষের বহু দশকের স্বপ্ন পূর্ণ হবে?

এই যে লর্ডসে বসে ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড ফাইনাল খেলা দেখছি প্রেস গ্যালারির ঠিক পাশে বসে। এখানে বসে এই রিপোর্ট লেখার কথা ছিল অজয়দার। কিন্তু লন্ডনের কোন এক হাসপাতালে হিমশীতল কক্ষে শুয়ে তিনি। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, বৃষ্টিভেজা বাতাস যেন তার অকাল প্রয়াণে শোকাচ্ছন্ন। ঢিমেতেতালা ছন্দে রান তুলছেন কিউইরা। আমরা তৃতীয় পক্ষের নিউট্রাল দর্শক চাচ্ছি আরও কিছু রানÑ যাতে খেলাটি জমে। লিখতে লিখতে পর পর দুটি চারের মার। ৩৫ ওভারে ১৫০ রান। পুরনো দিনের ঢঙে খেলার স্কোর। পিচে তেমন কোন বাঘ-সিংহ নেই। কিন্তু ইংল্যান্ডের বোলাররা দারুণ লাইন লেন্থে বল করছেন। ব্যাটসম্যানরা হাত খোলার চেষ্টা করেও পারছেন না। গাপটিল আর টেইলরের খারাপ ফর্ম কিউইদের ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছেন। শেষ ১০ ওভারে ধ্বংসাত্মক ব্যাটিং না করতে পারলে ডিফেন্ড করার মতো রান হবে না। শেষ পর্যন্ত উঠিয়ে একটি মারলেন বটে ল্যাথাম, অল্পের জন্য ছক্কাটি হলো না। আমার ইংল্যান্ডকেই সাপোর্ট করার কথা। এখানে লেখাপড়া করেছি, অনেক বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন রয়েছেন। কিন্তু মন টানছে নিউজিল্যান্ডের প্রতি। চার বছর আগে ওয়ার্ল্ড কাপ দেখার জন্য সেখানে গিয়ে অকুণ্ঠ আতিথেয়তা পেয়েছি। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দেখলেই হাসিমুখ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, সম্মানের চোখে তাকিয়েছেন তারা। কী আর করা! অগত্যা নিরপেক্ষ দর্শক। একটি চার, পরের বলে ক্যাচ আউট নিশাম, প্লাংকেটের বলে রুটের হাতে ধরা। ব্যাট-বলের সংযোগটি ভালো হয়নি। টিকে গেলে শেষ ১০ ওভারে মারার একটি সুযোগ থাকত। নতুন ব্যাটসম্যান ডি গ্র্যান্ডহমকে শুরু থেকেই হাত খুলে খেলতে হবে। ইংল্যান্ডের ফিল্ডিং দুর্দান্ত। মাঠে প্রচ- উত্তেজনা। এত বছরের স্বপ্ন পূর্ণ হয়েই যাবে বোধহয়। হাতে গোনা কয়েকশ’ কিউই সমর্থক তাও জানান দিচ্ছেন মাঝে মধ্যেইÑ যা তারও আছে, ‘খেল আভি বাকি হ্যায়’। ইন্ডিয়ার মতো দলকে কত কম রানে আটকে দিয়েছেন তারা। লিয়াম প্লান্কেটের ১০ ওভার শেষ, ৪২ রানে তিনটি বডি বডি উইকেট। আমার ভালো লাগার কথা বটে, সিলেট সিক্সারস দলে খেলে গেছেন তিনি। ইংল্যান্ডের জেসন রয়ও। ৪৬ ওভারে ২১৪-৫। কত হবে শেষ চার ওভারে। সামনে বসা ব্রিটিশ-বাঙালি ছেলেটি বলছে, ২৩৮ করবেন কালো টুপিরা। আমার পাশে বসে বয়োজ্যেষ্ঠ বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, সম্পর্কে আমার খালুও বটেÑ আশা করছেন আরও ৪০ রানের। অমনি উডের বলে বাজে ক্যাচ তুলে আউট হয়ে গেলেন ডি গ্র্যান্ডহম। ছেলেটির কথাই ঠিক হবে বোধহয়।

৪৮তম ওভারে ৪ রান মাত্র দিল আর্চার। ২৪০ও হবে না। আশপাশে বসা যারা ইংল্যান্ডের সমর্থক নন, তারা উঠি উঠি করছেনÑ বাড়ি গিয়ে টিভিতে উইম্বলডন ফাইনাল দেখার চিন্তায়। ল্যাথাম ৫০ না করেই আউট। শেষ পর্যন্ত ২৪১ রানে ইনিংস শেষ। শেষ তিন ওভারে ২১ রান। না হলে তো কিউইরা বল করার মতো সংগ্রহই পেতেন না। আমার আশপাশে ঘটনাচক্রে অনেক বাঙালি, পরিচিত অনেকেই এসে গল্প করে যাচ্ছেন। খুব ভালো লাগছে।

দ্বিতীয় ইংনিসের প্রথম ওভারেই দারুণ শুরুÑ আম্পায়ারের বদান্যতায় ব্যাটসম্যানের জীবন লাভ। প্রতিটি বলে আউট হওয়ার সম্ভাবনা। প্রতি ওভারেই মাঠজুড়ে উউউ আআআ শব্দ। কিন্তু উইকেট পড়ি পড়ি করে পড়ছে না। দুটো চারের মার হয়ে গেল এর মধ্যে। কিন্তু এতো কাছে এসে তরী ডুবতে বোধহয় দেবে না বিশ্বের একদা নৌ-পরাশক্তি ইংল্যান্ড।

চারে চারে রান বাড়ছে। গলার জোর বাড়ছে ইংল্যান্ড সমর্থকদের। রোদ উঠছে ধীরে ধীরে। আমরা খেলা দেখার ফাঁকে ফাঁকে রাজা উজির মারছি। ইনিংসের শুরুতে নিউজিল্যান্ড উইকেট নিতে পারছে না। অতএব মোটামুটি খেলার রেজাল্ট আউট - কিন্তু না! হেনরির দুর্দান্ত বলে ক্যাচ দিলেন জেসন রয়। প্রথম আপিলটা কার্যকর হলে জমত খেলা। কিন্তু বেয়ারস্টো যেন পণ করে নেমেছেন একাই জেতাবেন ইংল্যান্ডকে।

বিহাইনন্ড দ্য বোলার্স আর্ম বসে দেখছি কি মারাত্মক সুইং করছে হেনরির বল। কিন্তু উইকেট যে আসে না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন মাঠের নব্বই শতাংশ দর্শক। কিন্তু এ কি করলেন ডি গ্র্যান্ডহোম! মেডেন ওভারের শেষ বলে বেয়ারস্টোর ক্যাচ, সহজ কট অ্যান্ড বোল্ডÑ ফেলে দিলেন? লাকি উইকেট ইংল্যান্ড টুডে।

টাইট বোলিংয়ের ফল পেলেন ডি গ্র্যান্ডহোম। রুট ৭ রানে আউট। এবার কোন দিকে বাঁধ ভাঙবে!? মাঠ ঢোলের বাদ্যে উদ্দাম। কয়েক ওভার ধরে চেপে ধরেছে কিউইরা, বায়ারস্টো হাঁকিয়ে চার মারলেন; কিন্ত তার পরেই আউট। ফারগিউসনের আগুনে বলে প্লে’ড অন। মর্গান কি হাল ধরতে পারবেন? নাকি চাপের মুখে দ্রুত উইকেট যাবে? শক্ত আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজিয়েছেন উইলিয়ামসন। মাত্র দুজন ডিপ ফিল্ডার, বাকি সবাই ব্যাটসম্যানদের ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছেন। আমার পিছনে বসে আছেন অকল্যান্ড প্রবাসী বাঙালি জনাব আফতাব। আসতে আসতে তার মুখে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি; আবার স্টোক্স সজোরে ব্যাটে বলে চার পিটাতেই ইংরেজরা সরব। বলে বলে দোলাচল, উত্তেজনা! হোয়াট এ ক্যাচ! হোয়াট এ ক্যাচ! মাঠে শুধু এই চিৎকার। অসম্ভব এক ক্যাচে মর্গানকে ফেরালেন ফারগুসন। এই ক্যাচটাই কি ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট? মাঠে টানটান টেনশন। টু বি অর নট টু বি!?

মাঠের চারদিক ঘুরে আসতে আসতে স্টোক্স আর বাটলার ইনিংস মেরামত করে বেশ জেঁকে বসেছে। চারের পর চার, আর মাঠজুড়েই আনন্দ উল্লাস। আজ তবে ইংল্যান্ডেরই দিন। তবু একদিকে রানের চাকা আটকে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা, ইয়র্কারের পর ইয়র্কার, অন্যদিকে বাঁধন ছেড়া ব্যাটিংয়ের দুরন্ত প্রয়াস। কেহ কারে নাহি পারে সমানে সমান। স্টেডিয়াম জুড়ে রব- কাম অন ইংল্যান্ড। বাটলারের ৫০, এর একটু আগেই স্টোক্সের ৫০; তবুও মাঠ ছাড়ার লক্ষণ নেই কিউইদের। এই না হলে ফাইনাল! ছক্কা - কিন্তু না - আরেকটা মারাত্মক ক্যাচে ফিরে গেল বাটলার। একটু চুপচাপ, তারপরেই এক চারের মারে মাঠ উচ্চকিত। পরের বলেই ওকসের ক্যাচ- এমনি মাঠে আশঙ্কা। হাতে গোলাম কিউইদের উত্তাল উল্লাস। খেলা একবার এদিক, একবার ওদিকে মোড় নিচ্ছে। মনে হচ্ছে উইলিয়ামসনদের ধরে খেলাটার বেনিফিট পেতে পারে দল। পরের বলেই সিলেট সিক্সারের প্লাঙ্কেটের সজোরে হাঁকানো চারে হোমটিমের স্বস্তি। ১৬ বলে ২৯ রান। টি-২০’র যুগে কিছুই না। বলে বলে এই খেলার উত্তেজনায় পয়সা উসুল! কে বলবে এই নিউজিল্যান্ড গত বিশ্বকাপ ফাইনালে অজিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারে নাই।

১০ বল বাকি। প্লাংকেট উড়িয়ে মারতে গিয়ে লং অফে আউট। তার আগের বলেই নিশানের ইয়র্কারে ভূতলশায়ী হয়েছিলেন। পরের বলে আরও উত্তেজনা - ক্যাচ পরিণত হলো ছক্কায়; ফিল্ডারের পা ছুলো বাউন্ডারি। স্টোর্স আউট হলেই ইংল্যান্ডের ভরসা শেষ হতে যেত। কিন্তু আর্চার প্রথম বলেই আউট। শেষ ওভারে স্টোক্স স্ট্রাইকে ৬ বলে দরকার ১৫ রান। প্রথম বল ডট। দ্বিতীয় বলও তাই। তৃতীয় বলে ছক্কা; ৩ বলে ৯ রান। পরের বলে ওভার থ্রো হয়ে ছয় রান। ইংল্যান্ডের ভাগ্য বটে!

শেষ বলে ২ রান দরকার। স্টোক্স কি ইতিহাসে তার নাম লিখাতে যাচ্ছেন! নাকি নিশাম? শেষ পর্যন্ত সুপার ওভার। শেষ পর্যন্ত সুপার ওভারের শেষ বলে জিতে গেল ইংল্যান্ড! দ্য এমপায়ার স্ট্রাইক্স ব্যাক!! আইরিশ ক্যাপটেন, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলার, কত কিছু মিলে ইংল্যান্ড দল। জিতে নিল ওয়ার্ল্ড কাপ। এর চেয়ে ভালো ম্যাচ আর হয় না!

সোমবার, ১৫ জুলাই ২০১৯ , ১ শ্রাবন ১৪২৫, ১১ জিলকদ ১৪৪০

ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯

সুপার ওভারে ‘সুপার’ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড

বিশেষ প্রতিনিধি

image

প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ট্রফি নিয়ে ইংলিশদের উল্লাস

অবিশ্বাস্য, অবিস্মরণীয় ফাইনাল। কোন বিশেষণই যথেষ্ট নয় লর্ডসের ফাইনালের বর্ণনার জন্য। নির্ধারিত ৫০ ওভার টাই। সুপার ওভারও টাই। স্বাগতিক ইংল্যান্ড প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপা জিতলো অধিক সংখ্যক বাউন্ডারি হাঁকানোর জন্য। সুপার ওভারে ইংলিশরা ১৫ রান করলে জয়ের জন্য নিউজিল্যান্ড টপকাতে পারেনি সেই রান। শেষ বলে কিউইদের প্রয়োজন ছিল ২ রান। নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মার্টিন গাপটিল ছিলেন স্ট্রাইকে। দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে রান আউট হলে পুরো ইংল্যান্ড আনন্দের জোয়ারে ভাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফি স্পর্শ করার মুহূর্ত তৈরি হওয়ায়।

১৯৭৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ১৯৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়া আর ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের কাছে ফাইনালের ব্যর্থতা ভুলিয়ে দিলো ইংল্যান্ড। মাইক ব্রিয়ারলি, মাইক গ্যাটিং ও গ্রাহাম গুচদের আক্ষেপ ঘুচালেন এউইন মরগান। গত বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বে বিদায় নেয়ার পর থেকে যে উত্থান, তারই পুরস্কার তারা পেলো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে। দলকে শীর্ষ র‌্যাংকিংয়ে নেয়া অধিনায়কের হাতেই উঠলো বিশ্বকাপ ট্রফি।

লর্ডসের ফাইনালে মুখোমুখি হওয়া দুই দল ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ড উভয় দলের জন্যই ছিল প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের ম্যাচ। ম্যাচের রং পাল্টেছে প্রতি মুহূর্তে। কখনো ইংল্যান্ড আবার কখনো নিউজিল্যান্ডের দিকে হেলে পড়েছে ম্যাচ। নানা নাটকীয়তায় নির্ধারিত ৫০ ওভারে অমীমাংসিত থেকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল গড়ায় সুপার ওভারে। প্রথম সুপার ওভারের ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে পরাজিত করে ঘরের মাঠ তথা ক্রিকেটের তীর্থভূমি লর্ডসে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতল ইংল্যান্ড। এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশদের ৪৪ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। অন্যদিকে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও শিরোপা অধরা থাকল নিউজিল্যান্ডের। এবারের বিশ্বকাপে শিরোপা নিশ্চিত হলো বাউন্ডারি দিয়ে। বিশ্বকাপের আর দশটা ম্যাচের মতো ফাইনালের লড়াই হাই স্কোরিং হয়নি। ফাইনালের চাপে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং ডিপার্টমেন্ট নির্ধারিত ৫০ ওভারে আট উইকেটে তুলতে পেরেছিল ২৪১ রান। এবারের বিশ্বকাপে তিন শতাধিক রান তাড়া করে জয়ের বিষয়টাকে ডাল-ভাতে পরিণত করা ইংলিশরা ব্যাটিংয়ে নেমে ফাইনালের চাপে শুরুতে মাত্র ৮৬ রানে টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে চলে গিয়েছিল ব্যাকফুটে। তবে বেন স্টোকস ও জস বাটলারের ব্যাটে ঘুরে দাঁড়িয়ে শেষ ওভারের নাটকীয়তায় নির্ধারিত ৫০ ওভারে ২৪১ রানে অল আউট হলে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল গড়ায় সুপার ওভারে। বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ইনিংসে প্রায় প্রতিটা ম্যাচে দারুণ শুরুর ভিত গড়ে দেয়া জেসন রয় ফাইনালে পেরোতে পারেননি ২০ রানের কোটাও। কিউই পেসার ম্যাট হেনরির আউটসুংগারে পরাস্ত হয়ে জেসন রয় (১৭) ধরা পড়েন উইকেটরক্ষক টম লাথামের গ্লাভসে।

কিউই পেসারদের চমৎকার বোলিংয়ে মোটেও সুবিধা করতে পারছিলেন না জো রুট (৩০ বলে মাত্র ৭ রান)। সম্ভবত ফাইনালের চাপ নিতে পারছিলেন না তিনি। কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমের করা অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল তার ব্যাটে লেগে উইকেটরক্ষক টম লাথামের গ্লাভসে জমা হলে ইংলিশরা ৫৯ রানে হারায় দ্বিতীয় উইকেট।

দুইবার জীবন পেয়েও ইনিংস বড় করতে পারেননি জনি বেয়ারস্টো। লুকি ফার্গুসনের বলে তার স্ট্যাম্পে আঘাত করার আগে ৫৫ বলে ৭ বাউন্ডারিতে ৩৬ রান জমা দেন তিনি।

দলীয় ৭১ রানে তিন ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে ব্যাকফুটে চলে যাওয়া ইংলিশদের বিপদে ফেলে দলীয় ৮৬ রানে জিমি নিশামের বলে অধিনায়ক এউইন মরগান (৯) ধরা পড়েন লুতি ফার্গুসনের হাতে।

বেন স্টোকস ও জস বাটলারের ব্যাটে এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো ইংল্যান্ড। দুজনে ১১০ রানের জুটি গড়ে বিচ্ছিন্ন হন। লুকি ফার্গুসনের বল বদলি ফিল্ডার টিম সাউদির হাতে জমা দিয়ে বাটলার (৫৯) ফিরলে ভাঙে পঞ্চম উইকেটের পার্টনারশিপ।

ফার্গুসনের বল উইকেটকিপারের গ্লাভসে জমা দিয়ে ফেরেন ক্রিস ওকস (২)। দলীয় ২০৩ রানে ষষ্ঠ উইকেট হারানো ইংলিশরা ২২৬ রানে পৌঁছার পথে জিমি নিশামের বলে সাজঘরে পাঠায় লিয়াম প্লাংকেট ও জোফরা আর্চারকে (০)। ইনিংসের ৪৮তম ওভারে দলীয় ২২৬ রানে আট ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকা ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যান বেন স্টোকস শেষ ওভারে জমিয়ে দেন খেলা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিলো ১৫ রান। প্রথম দুটো বল ডট হয়। তৃতীয় বলে ঝক্কা হাঁকান স্টোকস। চতুর্থ বল মিডউইকেট সীমানার দিকে ঠেলে দ্রুত দুটো রান নিয়ে স্ট্রাইকিং প্রান্তে ফিরছিলেন স্টোকস। রান আউট করতে গিয়ে কিউই ফিল্ডার ট্রেন্ট বোল্ট এলোমেলো থ্রো করলে বল সীমানা পেরিয়ে যোগ হয় আরো চারটি রান। শেষ দুই বলে তিন রানের প্রয়োজন পড়ে। গ্যালারিতে ঘরের মাঠে প্রথম শিরোপা জয়ের জন্য তখন প্রস্তুতি প্রায় শুরু করে দিয়েছিলেন ইংলিশ সমর্থকরা। কিন্তু ক্রিকেট ঈশ্বরের মনে ছিলো ভিন্ন কিছু। পঞ্চম বলে দুই রান নিয়ে স্টোকস আবারও স্ট্রাইকিং প্রান্তে ফেরার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু আদিল রশীদ রান আউট হলে যোগ হয় এক রান। এক বলে দুই রানের প্রয়োজনে লং অনে বল ঠেলে দ্রুত দৌড়েও দুটো রান নিতে পারেননি স্টোকস। এক রান পূর্ণ হতেই বোলারস প্রান্তে ফেরার চেষ্টায় থাকা মার্ক উড হয়ে যান রান আউট। টাই হওয়া ম্যাচ গড়ায় সুপার ওভারে।

এর আগে দেড় মাসের বেশি সময় ধরে চলা আইসিসি ওডিআই বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে গতকাল ক্রিকেটের তীর্থভূমি লর্ডসের ফাইনালে মুখোমুখি হয় শিরোপাপ্রত্যাশী দুই দল নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। এই লড়াইয়ে ইংলিশ বোলাররা কিউইদের আটকে দিয়েছে মাত্র ২৪১ রানে। রানবন্যার এই বিশ্বকাপের ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের ইনিংসে বলার মতো স্কোর কেবল হেনরি নিকলসের ৫৫ এবং টম লাথামের ৪৭ রান। কিউই ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার ফলে ক্রিকেটের সূতিকাগার নামে পরিচিত বৃটিশরা জয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের জন্য পেয়েছে ২৪২ রানের টার্গেট।

সেই ১৯৭৫ সালে শুরু হওয়া আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের এবারের আসরে ঘরের মাটিতে ফেভারিট হিসেবেই শুরু করেছিা এউইন মরগানের নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ড। লর্ডসের ফাইনালেও টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং ডিপার্টমেন্টের ওপর গতকাল ইংলিশ বোলাররা হামলে পড়েছিল ফেভারিটের মতোই।টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরু থেকেই ইংলিশ পেসারদের তোপের মুখে পড়ে নিউজিল্যান্ড। পুরো টুর্নামেন্টে নিজের ছায়া হয়ে থাকা কিউই ওপেনার মার্টিন গাপটিল ফাইনালেও ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সপ্তম ওভারে ক্রিস ওকসের বলে লেগ বিফোর উইকেট হয়ে ফেরেন ১৯ রান করে। রিভিউ নিয়েও ক্রিজে থাকা হয়নি তার।

তবে গাপটিল আউট হওয়ার আগে ক্রিস ওকসের করা তৃতীয় ওভারে ফিল্ড আম্পায়ারের লেগ বিফোর উইকেটের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে বেঁচে গিয়েছিলেন আরেক ওপেনার হেনরি নিকোলস। শুরুর ধাক্কা সামলে নিকোলাসের সঙ্গে জুটি গড়ে দলকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন কেন উইলিয়ামসন। দলের স্কোর শতরানের কোটা পার হতেই ভাঙে এইে জুটি। ৫৩ বলে ৩০ রান করা কিউই অধিনায়ককে ফেরান লিয়াম প্লাংকেট। উইকেটকিপার জস বাটলারের গ্লাভসবন্দী হয়ে কেন উইলয়ামসন ফিরলে ৭৪ রানের জুটিটা আর ইংলিশদের আর চোখ রাঙাতে পারেনি।

কিউই ওপেনার হেনরি নিকোলস ৭১ বলে ৪ বাউন্ডারিতে হাফ সেঞ্চুরি পূরণ করে বেশিদূর যেতে পারেননি। ৫৫ রানে তাকেও ফেরান প্লাংকেট। বোল্ড হন নিকোলস। অভিজ্ঞ রস টেলরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিল কিউইরা। তাকে ১৫ রানে ইংলিশ পেসার মার্ক উড লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে জড়ালে দলীয় ১৪১ রানে টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে পায় নিউজিল্যান্ড। আশার আলো হয়ে থাকা জিমি নিশামকে (১৯) ফিরিয়ে তৃতীয় শিকার ধরেন প্লাংকেট।

ধুকতে থাকা কিউই ব্যাটিং লাইনআপ তারপরও ৪৪তম ওভারে দলের স্কোর দুশ’র কোটা পার করে। দলীয় ২১৯ রানে কলিন গ্র্যান্ডহোমকে (১৬) বদলি ফিল্ডার জেমস ভিন্সের তালুবন্দী করেন ক্রিস ওকস। হাফসেঞ্চুরির কাছে গিয়ে ব্যর্থ হন লাথাম। ৪৭ রান করে তৃতীয় শিকার হন ওকসের। শেষ ওভারে ম্যাট হেনরিকে (৪) বোল্ড করে দেন জোফরা আর্চার। ৩টি করে উইকেট নিয়েছেন ক্রিস ওকস এবং লিয়াম প্লাংকেট। ১টি করে উইকেট নিয়েছেন মার্ক উড এবং জোফরা আর্চার।

লর্ডসে এবারের বিশ্বকাপে আগের চারটি ম্যাচেই জিতেছে আগে ব্যাট করা দল। সেই ধারা ধরে রাখতে কিউই বোলারদের আরেকবার করতে হবে অসাধারণ কিছু। নইলে স্বাগতিকদের অপেক্ষায় বিশ্বসেরা হওয়ার উৎসব।

স্কোরকার্ড

নিউজিল্যান্ড

গাপটিল এলবিডব্লিউ ব ওবস ১৯

নিকোলস বোল্ড প্লাংকেট ৫৫

উইলিয়ামসন ক বাটলার ব প্লাংকেট ৩০

টেলর এলবিডব্লিউ ব উড ১৫

লাথাম ক (ভিন্স) ব ওকস ৪৭

নিশাম ক রুট ব প্লাংকেট ১৯

গ্র্যান্ডহোম ক (ভিন্স) ব ওকস ১৬

স্যান্টনার অপরাজিত ৫

হেনরি বোল্ড আর্চার ৪

বোল্ট অপরাজিত ১

অতিরিক্ত (লে-১২, নো-১, ও-১৭) ৩০

মোট (৫০ ওভারে ৮ উই.) ২৪১

উইকেট পতন : ১/২৯ (গাপটিল, ৬.২ ওভার), ২/১০৩ (উইলিয়ামসন, ২২.৪) (৩/১১৮ (নিকোলস, ২৬.৫) ৪/১৪১ (টেলর, ৩৩.১), ৫/১৭৩ (নিশাম, ৩৮.৬), ৬/২১৯ (গ্র্যান্ডহোম, ৪৬.৫), ৭/২৩২ (লাথাম, ৪৮.৩), ৮/২৪০ (হেনরি, ৪৯.৩)।

বোলিং : ওকস ৯-০-৩৭-৩, আর্চার ১০-০-৪২-১, প্লাংকেট ১০-০-৪২-৩, উড ১০-১-৪৯-১, রশিদ ৮-০-৩৯-০, স্টোকস ৩-০-২০-০।

ইংল্যান্ড

জেসন রয় ক লাথাম ব হেনরি ১৭

বেয়ারস্ট্রো বোল্ড ফার্গুসন ৩৬

জো রুটস ক লাথাম ব গ্র্যান্ডহোম ৭

মরগান ক ফার্গুসন ব নিশাম ৯

স্টোকস অপরাজিত ৮৪

বাটলার ক (সাউদি) ব ফার্গুসন ৫৯

ওকস ক লাথাম ব ফার্গুসন ২

প্লাংকেট ক বোল্ট ব নিশাম ১০

আর্চার বোল্ড নিশাম ০

রশিদ রান আউট ০

উড রান আউট ০

অতিরিক্ত (বা-২, লে-৩, ও-১২) ১৭

মোট (৫০ ওভারে অল আউট) ২৪১

উইকেট পতন : ১/২৮ (রয়, ৫.৪ ওভার), ২/৫৯ (রুট, ১৬.৩), ৩/৭১ (বেয়ারস্ট্রো, ১৯.৩), ৪/৮৬, মরগান, ২৩.১), ৫/১৯৬ (বাটলার, ৪৪.৫), ৬/২০৩ (ওকস, ৪৬.১), ৭/২২০ (প্লাংকেট, ৪৮.৩), ৮/২২৭ (আর্চার, ৪৮.৬), ৯/২৪০ (রশিদ, ৪৯.৫), ১০/২৪১ (উড, ৪৯.৬)।

বোলিং : বাটলার ১০-০-৬৭-০, হেনরি ১০-২-৪০-১, গ্র্যান্ডহোম ১০-২-২৫-১, ফার্গুসন ১০-০-৫০-৩, নিশাম ৭-০-৪৩-৩, স্যান্টনার ৩-০-১১-০।

ম্যান অব দ্য ফাইনাল : বেন স্টোকস।

প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট : কেন উইলিয়ামসন।

লর্ডসের গ্যালারি থেকে নিহাদ কবির

ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের লর্ডসে বসে দেখছি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল। ছোট্ট দেশ নিউজিল্যান্ড জিতবে, নাকি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভগ্নাবশেষের বহু দশকের স্বপ্ন পূর্ণ হবে?

এই যে লর্ডসে বসে ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড ফাইনাল খেলা দেখছি প্রেস গ্যালারির ঠিক পাশে বসে। এখানে বসে এই রিপোর্ট লেখার কথা ছিল অজয়দার। কিন্তু লন্ডনের কোন এক হাসপাতালে হিমশীতল কক্ষে শুয়ে তিনি। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, বৃষ্টিভেজা বাতাস যেন তার অকাল প্রয়াণে শোকাচ্ছন্ন। ঢিমেতেতালা ছন্দে রান তুলছেন কিউইরা। আমরা তৃতীয় পক্ষের নিউট্রাল দর্শক চাচ্ছি আরও কিছু রানÑ যাতে খেলাটি জমে। লিখতে লিখতে পর পর দুটি চারের মার। ৩৫ ওভারে ১৫০ রান। পুরনো দিনের ঢঙে খেলার স্কোর। পিচে তেমন কোন বাঘ-সিংহ নেই। কিন্তু ইংল্যান্ডের বোলাররা দারুণ লাইন লেন্থে বল করছেন। ব্যাটসম্যানরা হাত খোলার চেষ্টা করেও পারছেন না। গাপটিল আর টেইলরের খারাপ ফর্ম কিউইদের ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছেন। শেষ ১০ ওভারে ধ্বংসাত্মক ব্যাটিং না করতে পারলে ডিফেন্ড করার মতো রান হবে না। শেষ পর্যন্ত উঠিয়ে একটি মারলেন বটে ল্যাথাম, অল্পের জন্য ছক্কাটি হলো না। আমার ইংল্যান্ডকেই সাপোর্ট করার কথা। এখানে লেখাপড়া করেছি, অনেক বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন রয়েছেন। কিন্তু মন টানছে নিউজিল্যান্ডের প্রতি। চার বছর আগে ওয়ার্ল্ড কাপ দেখার জন্য সেখানে গিয়ে অকুণ্ঠ আতিথেয়তা পেয়েছি। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দেখলেই হাসিমুখ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, সম্মানের চোখে তাকিয়েছেন তারা। কী আর করা! অগত্যা নিরপেক্ষ দর্শক। একটি চার, পরের বলে ক্যাচ আউট নিশাম, প্লাংকেটের বলে রুটের হাতে ধরা। ব্যাট-বলের সংযোগটি ভালো হয়নি। টিকে গেলে শেষ ১০ ওভারে মারার একটি সুযোগ থাকত। নতুন ব্যাটসম্যান ডি গ্র্যান্ডহমকে শুরু থেকেই হাত খুলে খেলতে হবে। ইংল্যান্ডের ফিল্ডিং দুর্দান্ত। মাঠে প্রচ- উত্তেজনা। এত বছরের স্বপ্ন পূর্ণ হয়েই যাবে বোধহয়। হাতে গোনা কয়েকশ’ কিউই সমর্থক তাও জানান দিচ্ছেন মাঝে মধ্যেইÑ যা তারও আছে, ‘খেল আভি বাকি হ্যায়’। ইন্ডিয়ার মতো দলকে কত কম রানে আটকে দিয়েছেন তারা। লিয়াম প্লান্কেটের ১০ ওভার শেষ, ৪২ রানে তিনটি বডি বডি উইকেট। আমার ভালো লাগার কথা বটে, সিলেট সিক্সারস দলে খেলে গেছেন তিনি। ইংল্যান্ডের জেসন রয়ও। ৪৬ ওভারে ২১৪-৫। কত হবে শেষ চার ওভারে। সামনে বসা ব্রিটিশ-বাঙালি ছেলেটি বলছে, ২৩৮ করবেন কালো টুপিরা। আমার পাশে বসে বয়োজ্যেষ্ঠ বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, সম্পর্কে আমার খালুও বটেÑ আশা করছেন আরও ৪০ রানের। অমনি উডের বলে বাজে ক্যাচ তুলে আউট হয়ে গেলেন ডি গ্র্যান্ডহম। ছেলেটির কথাই ঠিক হবে বোধহয়।

৪৮তম ওভারে ৪ রান মাত্র দিল আর্চার। ২৪০ও হবে না। আশপাশে বসা যারা ইংল্যান্ডের সমর্থক নন, তারা উঠি উঠি করছেনÑ বাড়ি গিয়ে টিভিতে উইম্বলডন ফাইনাল দেখার চিন্তায়। ল্যাথাম ৫০ না করেই আউট। শেষ পর্যন্ত ২৪১ রানে ইনিংস শেষ। শেষ তিন ওভারে ২১ রান। না হলে তো কিউইরা বল করার মতো সংগ্রহই পেতেন না। আমার আশপাশে ঘটনাচক্রে অনেক বাঙালি, পরিচিত অনেকেই এসে গল্প করে যাচ্ছেন। খুব ভালো লাগছে।

দ্বিতীয় ইংনিসের প্রথম ওভারেই দারুণ শুরুÑ আম্পায়ারের বদান্যতায় ব্যাটসম্যানের জীবন লাভ। প্রতিটি বলে আউট হওয়ার সম্ভাবনা। প্রতি ওভারেই মাঠজুড়ে উউউ আআআ শব্দ। কিন্তু উইকেট পড়ি পড়ি করে পড়ছে না। দুটো চারের মার হয়ে গেল এর মধ্যে। কিন্তু এতো কাছে এসে তরী ডুবতে বোধহয় দেবে না বিশ্বের একদা নৌ-পরাশক্তি ইংল্যান্ড।

চারে চারে রান বাড়ছে। গলার জোর বাড়ছে ইংল্যান্ড সমর্থকদের। রোদ উঠছে ধীরে ধীরে। আমরা খেলা দেখার ফাঁকে ফাঁকে রাজা উজির মারছি। ইনিংসের শুরুতে নিউজিল্যান্ড উইকেট নিতে পারছে না। অতএব মোটামুটি খেলার রেজাল্ট আউট - কিন্তু না! হেনরির দুর্দান্ত বলে ক্যাচ দিলেন জেসন রয়। প্রথম আপিলটা কার্যকর হলে জমত খেলা। কিন্তু বেয়ারস্টো যেন পণ করে নেমেছেন একাই জেতাবেন ইংল্যান্ডকে।

বিহাইনন্ড দ্য বোলার্স আর্ম বসে দেখছি কি মারাত্মক সুইং করছে হেনরির বল। কিন্তু উইকেট যে আসে না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন মাঠের নব্বই শতাংশ দর্শক। কিন্তু এ কি করলেন ডি গ্র্যান্ডহোম! মেডেন ওভারের শেষ বলে বেয়ারস্টোর ক্যাচ, সহজ কট অ্যান্ড বোল্ডÑ ফেলে দিলেন? লাকি উইকেট ইংল্যান্ড টুডে।

টাইট বোলিংয়ের ফল পেলেন ডি গ্র্যান্ডহোম। রুট ৭ রানে আউট। এবার কোন দিকে বাঁধ ভাঙবে!? মাঠ ঢোলের বাদ্যে উদ্দাম। কয়েক ওভার ধরে চেপে ধরেছে কিউইরা, বায়ারস্টো হাঁকিয়ে চার মারলেন; কিন্ত তার পরেই আউট। ফারগিউসনের আগুনে বলে প্লে’ড অন। মর্গান কি হাল ধরতে পারবেন? নাকি চাপের মুখে দ্রুত উইকেট যাবে? শক্ত আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজিয়েছেন উইলিয়ামসন। মাত্র দুজন ডিপ ফিল্ডার, বাকি সবাই ব্যাটসম্যানদের ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছেন। আমার পিছনে বসে আছেন অকল্যান্ড প্রবাসী বাঙালি জনাব আফতাব। আসতে আসতে তার মুখে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি; আবার স্টোক্স সজোরে ব্যাটে বলে চার পিটাতেই ইংরেজরা সরব। বলে বলে দোলাচল, উত্তেজনা! হোয়াট এ ক্যাচ! হোয়াট এ ক্যাচ! মাঠে শুধু এই চিৎকার। অসম্ভব এক ক্যাচে মর্গানকে ফেরালেন ফারগুসন। এই ক্যাচটাই কি ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট? মাঠে টানটান টেনশন। টু বি অর নট টু বি!?

মাঠের চারদিক ঘুরে আসতে আসতে স্টোক্স আর বাটলার ইনিংস মেরামত করে বেশ জেঁকে বসেছে। চারের পর চার, আর মাঠজুড়েই আনন্দ উল্লাস। আজ তবে ইংল্যান্ডেরই দিন। তবু একদিকে রানের চাকা আটকে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা, ইয়র্কারের পর ইয়র্কার, অন্যদিকে বাঁধন ছেড়া ব্যাটিংয়ের দুরন্ত প্রয়াস। কেহ কারে নাহি পারে সমানে সমান। স্টেডিয়াম জুড়ে রব- কাম অন ইংল্যান্ড। বাটলারের ৫০, এর একটু আগেই স্টোক্সের ৫০; তবুও মাঠ ছাড়ার লক্ষণ নেই কিউইদের। এই না হলে ফাইনাল! ছক্কা - কিন্তু না - আরেকটা মারাত্মক ক্যাচে ফিরে গেল বাটলার। একটু চুপচাপ, তারপরেই এক চারের মারে মাঠ উচ্চকিত। পরের বলেই ওকসের ক্যাচ- এমনি মাঠে আশঙ্কা। হাতে গোলাম কিউইদের উত্তাল উল্লাস। খেলা একবার এদিক, একবার ওদিকে মোড় নিচ্ছে। মনে হচ্ছে উইলিয়ামসনদের ধরে খেলাটার বেনিফিট পেতে পারে দল। পরের বলেই সিলেট সিক্সারের প্লাঙ্কেটের সজোরে হাঁকানো চারে হোমটিমের স্বস্তি। ১৬ বলে ২৯ রান। টি-২০’র যুগে কিছুই না। বলে বলে এই খেলার উত্তেজনায় পয়সা উসুল! কে বলবে এই নিউজিল্যান্ড গত বিশ্বকাপ ফাইনালে অজিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারে নাই।

১০ বল বাকি। প্লাংকেট উড়িয়ে মারতে গিয়ে লং অফে আউট। তার আগের বলেই নিশানের ইয়র্কারে ভূতলশায়ী হয়েছিলেন। পরের বলে আরও উত্তেজনা - ক্যাচ পরিণত হলো ছক্কায়; ফিল্ডারের পা ছুলো বাউন্ডারি। স্টোর্স আউট হলেই ইংল্যান্ডের ভরসা শেষ হতে যেত। কিন্তু আর্চার প্রথম বলেই আউট। শেষ ওভারে স্টোক্স স্ট্রাইকে ৬ বলে দরকার ১৫ রান। প্রথম বল ডট। দ্বিতীয় বলও তাই। তৃতীয় বলে ছক্কা; ৩ বলে ৯ রান। পরের বলে ওভার থ্রো হয়ে ছয় রান। ইংল্যান্ডের ভাগ্য বটে!

শেষ বলে ২ রান দরকার। স্টোক্স কি ইতিহাসে তার নাম লিখাতে যাচ্ছেন! নাকি নিশাম? শেষ পর্যন্ত সুপার ওভার। শেষ পর্যন্ত সুপার ওভারের শেষ বলে জিতে গেল ইংল্যান্ড! দ্য এমপায়ার স্ট্রাইক্স ব্যাক!! আইরিশ ক্যাপটেন, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলার, কত কিছু মিলে ইংল্যান্ড দল। জিতে নিল ওয়ার্ল্ড কাপ। এর চেয়ে ভালো ম্যাচ আর হয় না!