বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি

বাড়ছে পানিবন্দী মানুষ
ত্রাণ অপ্রতুল

নদীভাঙনে জমি হারাচ্ছে মানুষ

বন্যাক্রান্ত জেলাগুলোতে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কোন কোন জেলায় পানি কমলেও নদী ভাঙনের ফলে যোগাযোগব্যবস্থা চরম আকার ধারণ করছে। বন্যাক্রান্ত এলাকায় নদী ভাঙন আতঙ্ক বিরাজ করছে। কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর ভাঙনে নতুন করে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ জেলায় গতকাল ৪ শিশুসহ আরও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় দু’দিনে পানিতে ডুবে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে। বন্যায় এ জেলায় ৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দী মানুষের জন্য ত্রাণ সংকট দেখা দিয়েছে। সেই পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বানভাসি মানুষ। গাইবান্ধার জেলায় বন্যার্তরা ত্রাণ সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জামালপুর জেলার বন্যাক্রান্ত মানুষ ত্রাণ সংকটে দিশেহারা। টাঙ্গাইল মাদারীপুর, মৌলভীবাজার, রাউজানে বন্যার পানিতে বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। শেরপুরের ঝিনাইগাতিতে বন্যার পানিতে ডুবে এক বৃদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন। প্রতিনিধিদের পাঠানো এ চিত্র তুলে ধরা হলো :

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপূত্র ও ধরলা নদীর পানি হু-হু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় ৪ লাখ মানুষ বন্যা ও ভাঙনের সম্মুখীন হয়েছে। রৌমারীতে বাঁধ ভেঙে নতুন করে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে রৌমারীর কর্ত্তিমারীতে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে পানিতে পরে সাইফুল ইসলাম (২৫) নামে এক যুবক নিখোঁজ হয়ে যায়। অন্যদিকে উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নে নৌকাডুবিতে রুনা বেগম (২৮), রুপা মনি (৮), হাসিবুল ইসলাম (৭), সুমন (৮) ও রুকুমনি (৮) নামে এক মহিলা ৪ শিশুসহ ৫ জন মারা গেছে। এরা ডিঙি নৌকায় করে বন্যা দেখতে গিয়ে নৌকাডুবিতে মারা যায়। এ নিয়ে দু’দিনে জেলায় এক প্রতিবন্ধীসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

কুড়িগ্রাম ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক মনজিল হক জানান, উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নের নতুন অনন্তপুর এলাকায় নৌকা ডুবে একই এলাকার ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে রেজাউল ইসলামের স্ত্রী রুনা বেগম, মহসিন আলীর কন্যা রুপা মনি ও আয়নাল হকের পূত্র হাসিবুল ইসলামকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে ডুবুরিদল মনসুর আলীর পূত্র সুমন ও রাশেদ আলীর কন্যা রুকু মনিকে তল্লাশি করে উদ্ধার করে।

কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার শাহিনুর রহমান সরদার জানান, রুপা মনি ও হাসিবুল ইসলাম নামে দু’শিশুকে দুপুরে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসে। পরে তাদের পরিবারের লোকজন শিশু দুটিকে বাড়িতে নিয়ে গেছে।

জেলা কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার পর্যন্ত কুড়িগ্রামে প্রায় ৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ভাঙনে ৪ হাজার ৫৩৬জন এবং পানিবন্দী ৩ লাখ ৯২ হাজার ২৭২ জন।

বন্যার ফলে পানিবন্দী মানুষ চরম ভোগান্তিতে পরেছে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও আশ্রয়ের সংকটে ভুগছেন তারা। চরাঞ্চলে গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সারাদিন পানিতে চলাফেরা করায় বানভাসিরা পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। মঙ্গলবার পর্যন্ত ব্রহ্মপূত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে বেড়ে গিয়ে ১২৫ সে. মিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৯৫ সে.মি এবং ধরলা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে ১১৭ সে. মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার পানি কমে গিয়ে ১০ সে.মি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বগুড়া : বগুড়ার সারিয়াকান্দির নিকট যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদ সীমার ১০৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুর্গম চরাঞ্চলে ওষুধ, মোমবাতি, কেরোসিন, গো খাদ্যের তীব্র সংকট বিরাজ করছে। ডাকাত ও বিষাক্ত সাপের আতঙ্কে ভুগছে মানুষ । বন্যার্তরা বাড়িঘর সরিয়ে নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন। যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের ৯৮টি গ্রামের ৬৬ হাজার ৮শ’ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন উঁচুস্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যায় তিনটি উপজেলায় ৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে। বন্যায় তিনটি উপজেলায় পাট, আউশ ধান, সবজি, মরিচ, বীজতলা ও আখ সহ ৮ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এছাড়া ১ হাজার ৯শ’ ল্যাট্রিন ও ২ হাজার ৪৫৭টি টিউবয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতিমধ্যেই ১৪টি টিউবয়েল মেরামত করা হয়েছে।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সবগুলো নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে গাইবান্ধার নদ-নদীগুলোতে পানি বাড়ছেই। ফলে জেলার বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। ইতোমধ্যে গাইবান্ধার বন্যাকবলিত চার উপজেলার ৩০০টি গ্রামের প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে গাইবান্ধা শহরের মানুষ। এদিকে সোমবার (১৫ জুলাই) রাত থেকে গাইবান্ধা শহরের বেশ কিছু এলাকায় বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করেছে।

জামালপুর : জামালপুরে বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। গতকাল দুপুরে যমুনার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বন্যার পানি বিপদসীমার ১৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৭ উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৭টি ইউনিয়ন ও ৩টি পৌরসভা বন্যা কবলিত হয়ে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেকেই বিভিন্ন অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যাকবলিত ইসলামপুর উপজেলার গোয়ালের চরের মালমারা গ্রামে পানিতে ডুবে আব্দুল্লাহ নামে চার বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ। রেল লাইনের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ লাইনে রেলপথ বন্ধ ঘোষণা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। ২৭৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।

বন্যা দুর্গত এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ত্রানের জন্য বন্যার্তরা দ্বিগবিদিগ ছুটাছুটি করছে। বন্যা আক্রান্ত মানুষেরা বলছেন তাদের কাছে এখনো ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছায়নি। অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা বলছেন বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যার চেয়ে ত্রানের বরাদ্দ কম হওয়ায় সবাইকে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী।

টাঙ্গাইল : গত কয়েকদিনের ভারি বর্ষণের ফলে টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে এই দুটি নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার সকালে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১৬ সে.মি. উপরে এবং ধলেশ্বরী নদীর পানি ২৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে নদী তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েকদিনে যমুনা নদীর তীরবর্তী নাগরপুর উপজেলার আগদিঘুলিয়া, নিশ্চিন্তপুর ও পাইকশা মাঝাইল গ্রামে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। অন্যদিকে ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার কাজীবাড়ি ও কেদারপুরে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। আর এতে গৃহহীন হচ্ছে বহু পরিবার। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্র্তৃপক্ষ বলছে আগামী দুই/তিন দিন নদীর পানি বৃদ্ধি পাবে।

জানা যায়, উপজেলার পাইকশা মাঝাইল, নিশ্চিন্তপুর গ্রামের শত শত পরিবার যমুনা নদীর ভাঙ্গনে গৃহহীন হয়ে তাদের ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষ পানি ও খাদ্যের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমরা ইতিমধ্যে দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছি।

রাজিবপুর (কুড়িগ্রাম): কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বানের পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলা শহরের সকল অফিস আদালত, রাজিবপুর হাট-বাজার ও আবাসিক এলাকায় পানি প্রবেশ করে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। অধিকাংশ ভবনের নিচের তলায় পানি উঠেছে। ফলে উপজেলা পরিষদ ভবনসহ পুরো এলাকা ৩/৫ ফুট পানির নিচে ভাসছে। এছাড়া উপজেলা খাদ্য গুদামে পানি প্রবেশ করে ভবনের মেঝেতে পানি ছুঁই ছুঁই করছে। এছাড়া জাউনিয়ার চর উচ্চবিদ্যালয়ের ফ্লাড সেন্টারটির ভিতরে ১ ফিট পানি উঠেছে, রাজিবপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোমড় পানি থেকে গলা পানিতে ভাসছে। প্রধান প্রধান সড়ক ছাড়া সকল পাকা-আধা-পাকা ও কাঁচা সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ার এলাকাবাসী শহরে যেতে পারছে না। উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা আজিজুর রহমান জানিয়েছেন, উপজেলার ৩ ইউনিয়নের জন্য ১৮ মেট্রিক টন জিআরের চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন। তা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ চলছে এবং মঙ্গলবার আরও ২০ মেট্রিকটন জিআরের চাল ও নগদ ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। রাজিবপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আকবর হোসেন হিরো জানান, তার উপজেলার ৯০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গত কয়েক দিনে প্রায় ৫০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে হারে সরকার বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বরদ্দ দিয়েছেন তা অতি নগণ্ন। তাই সরকারের পাশাপাশি বিত্তবান ও বেসরকারি সংস্থাকে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।

সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) : গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে করে ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

গত ১০ দিন থেকে অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এলাকাগুলো হচ্ছে হরিপুর, কাপাশিয়া, শ্রীপুর, চন্ডিপুর, তারাপুর, শান্তিরাম, কঞ্চিবাড়ী ইউনিয়নের ছয়ঘরিয়া, কাজিয়ারচর, বাদামেরচর, রাজারচর, নবাবগঞ্জসহ লোকালয়গুলোতে পানি প্রবেশ করায় বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। সরকারিভাবে পানিবন্দী মানুষদের উদ্ধারের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই পরিবার পরিজন, গবাদিপশু নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেরিবাঁধ ও উঁচু স্থানসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রীতদের মাঝে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও খাদ্য সংকট। সরকারি হিসাবমতে ৫১টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে করে ৮ হাজার ৭শ’ পরিবারের ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

(কুড়িগ্রাম) : থেমে থেমে বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চিলমারীর ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আরও নতুন করে ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এপর্যন্ত পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। সেই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের তোড়ের মুখে চিলমারী রক্ষা বাঁধটিও রয়েছে হুমকির মুখে। তা রক্ষায় এলাকার মানুষের সহায়তায় চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। মানুষজনের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম আতঙ্ক। বাঁধে আশ্রয় নেয়া প্রায় ২ হাজার পরিবারের মাঝে দেখা দিয়েছে হতাশা, বাড়ছে আতঙ্ক।

মৌলভীবাজার : গতকাল মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ধলই নদীর পানি কমলেও মনু নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। কমলগঞ্জে ধলই নদীর ও মৌলভীবাজারে কুশিয়ারা নদীর ৭টি ভাঙ্গনের মধ্যে ৬টি এখনো উন্মুক্ত। কুশিয়ারা নদীর হামরকোনা মসজিদের পাশের একটি ভাঙন মেরামত করেছে স্থানীয় লোকজন। কুশিয়ারা নদীর হামরকোনা এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ না থাকায় এস্থানের ভাঙন মেরামতের দায় নিচ্ছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড।

উজানের পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের সব কটি নদীর পানি গত কয়েক দিন ধরে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। গতকাল মৌলভীবাজার-কমলগঞ্জ সড়কে বন্যার পানি উঠে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বিঘিœত হয়েছে। তবে গতকাল দুপুর থেকে নদীগুলোর মধ্যে ধলই নদীর পানি কমতে শুরু করে। উজানে মনু নদীর পানি কমলেও ভাটিতে বেড়েছে। তবে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নিবাহী প্রকৌশলী।

কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) : মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ৫ দিন পর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আদমপুর, কমলগঞ্জ পৌর এলাকা, রহিমপুর থেকে পানি নামলেও নিম্নাঞ্চল শমশেরনগর, পতনউষার ও মুন্সীবাজার এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। পতনউষার, আদমপুর ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নে পানিবন্দী শত শত পরিবার পায়নি কোন ত্রাণ।

শিবচর (মাদারীপুর) : পদ্মা নদীতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধিতে শিবচরের চরাঞ্চলের ৩টি ইউনিয়নে নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। বেশি আক্রান্ত হয়েছে বন্দরখোলা ইউনিয়ন। এরইমাঝে ভাঙনে ক্ষতিগস্ত হয়েছে ইউনিয়নটির একটি মাদ্রাসা, কালভার্ট, ১৫টি ঘরবাড়িসহ ফসলের মাঠ। ভয়াবহ ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে একই ইউনিয়নের ৩তলাবিশিষ্ট একটি মাধ্যমিক স্কুল, ১টি প্রাথমিক স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন, হাটবাজারসহ ৩ ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হাজারো বসতবাড়ি। ভাঙন এলাকায় চরম আতংক বিরাজ করছে। নদী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ রায় প্রমুখ।

সরেজমিন একাধিক সূত্রে জানা যায়, গত ৪৮ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর শিবচর উপজেলার চরাঞ্চল বন্দরখোলা, চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়ন সংলগ্ন অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গনে আক্রান্ত হওয়ায় বন্দরখোলার কাজীরসুরা তাহফীজুল কুরআন গোরস্থান মাদরাসার একাধিক ঘর অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। মাদ্রাসাটিতে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। একই ইউনিয়নসহ সংলগ্ন ৩টি ইউনিয়নের ১৫-২০টি বসত বাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। চরজানাজাত ইউনিয়নের একটি কালভার্ট নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙ্গনের মুখে পড়ায় বন্দরখোলার নুরুউদ্দিন মাদবরেরকান্দি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩লা ভবন থেকেও মালামাল সরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে।

রাউজান : এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টি ও রাউজানের সর্তা ও ডাবুয়া খালের বাঁধ ভাঙা পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোতে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বহু রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়েছে। বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার পর পানি নামতে শুরু করলে রাস্তাগুলো ছিন্নভিন্ন চেহারা এখন মানুষের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চিকদাইর, রাউজান সদর ইউনিয়ন, নোয়াজিশপুর, ডাবুয়া, হলদিয়া,উরকিরচর, বিনাজুরী, পশ্চিম গুজরা, নোয়াপাড়ার রাস্তাঘাট।

ঝিনাইগাতী (শেরপুর) : শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে বন্যার পানিতে ডুবে আসিমা বেওয়া (১০৫) নামে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার সারিকালিনগর এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি ওই গ্রামের মৃত ফয়েজ উদ্দিন মন্ডলের স্ত্রী। থানার ওসি আবু বক্কর সিদ্দিক ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে গত রোববার উপজেলার ঘাগড়া সরকারপাড়া গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে মাহিন (১) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়।

সাঘাটা (গাইবান্ধা) : গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলায় বন্যার পানির বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল পর্যন্ত ৬টি ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রাম বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দী রয়েছে।

উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ভরতখালী গো-হাট কোমর পানির নিচে নিমজ্জিত। হাটের আশপাশে কোন উঁচু জায়গা না থাকায় মঙ্গলবার সাপ্তাহিক হাট বার হওয়ায় শত শত গরু-ছাগল ক্রেতা-বিক্রেতাকে হাটে এসে ফিরে যেতে দেখা যায়।

হাট ইজারাদার আলহাজ মোহাম্মদ আলী জানান, ৩ কোটি টাকার উপরে হাট ইজারা নিয়েছি। বন্যার ফলে গরু-ছাগল ক্রয়-বিক্রয় না হওয়ায় আমরা আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে পড়েছি।

বুধবার, ১৭ জুলাই ২০১৯ , ৩ শ্রাবন ১৪২৫, ১৩ জিলকদ ১৪৪০

বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি

বাড়ছে পানিবন্দী মানুষ
ত্রাণ অপ্রতুল

নদীভাঙনে জমি হারাচ্ছে মানুষ

সংবাদ ডেস্ক

image

গাইবান্ধা : নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বন্যাকবলিত মানুষ -সংবাদ

বন্যাক্রান্ত জেলাগুলোতে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কোন কোন জেলায় পানি কমলেও নদী ভাঙনের ফলে যোগাযোগব্যবস্থা চরম আকার ধারণ করছে। বন্যাক্রান্ত এলাকায় নদী ভাঙন আতঙ্ক বিরাজ করছে। কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর ভাঙনে নতুন করে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ জেলায় গতকাল ৪ শিশুসহ আরও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় দু’দিনে পানিতে ডুবে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে। বন্যায় এ জেলায় ৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দী মানুষের জন্য ত্রাণ সংকট দেখা দিয়েছে। সেই পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বানভাসি মানুষ। গাইবান্ধার জেলায় বন্যার্তরা ত্রাণ সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জামালপুর জেলার বন্যাক্রান্ত মানুষ ত্রাণ সংকটে দিশেহারা। টাঙ্গাইল মাদারীপুর, মৌলভীবাজার, রাউজানে বন্যার পানিতে বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। শেরপুরের ঝিনাইগাতিতে বন্যার পানিতে ডুবে এক বৃদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন। প্রতিনিধিদের পাঠানো এ চিত্র তুলে ধরা হলো :

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপূত্র ও ধরলা নদীর পানি হু-হু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় ৪ লাখ মানুষ বন্যা ও ভাঙনের সম্মুখীন হয়েছে। রৌমারীতে বাঁধ ভেঙে নতুন করে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে রৌমারীর কর্ত্তিমারীতে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে পানিতে পরে সাইফুল ইসলাম (২৫) নামে এক যুবক নিখোঁজ হয়ে যায়। অন্যদিকে উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নে নৌকাডুবিতে রুনা বেগম (২৮), রুপা মনি (৮), হাসিবুল ইসলাম (৭), সুমন (৮) ও রুকুমনি (৮) নামে এক মহিলা ৪ শিশুসহ ৫ জন মারা গেছে। এরা ডিঙি নৌকায় করে বন্যা দেখতে গিয়ে নৌকাডুবিতে মারা যায়। এ নিয়ে দু’দিনে জেলায় এক প্রতিবন্ধীসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

কুড়িগ্রাম ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক মনজিল হক জানান, উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নের নতুন অনন্তপুর এলাকায় নৌকা ডুবে একই এলাকার ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে রেজাউল ইসলামের স্ত্রী রুনা বেগম, মহসিন আলীর কন্যা রুপা মনি ও আয়নাল হকের পূত্র হাসিবুল ইসলামকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে ডুবুরিদল মনসুর আলীর পূত্র সুমন ও রাশেদ আলীর কন্যা রুকু মনিকে তল্লাশি করে উদ্ধার করে।

কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার শাহিনুর রহমান সরদার জানান, রুপা মনি ও হাসিবুল ইসলাম নামে দু’শিশুকে দুপুরে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসে। পরে তাদের পরিবারের লোকজন শিশু দুটিকে বাড়িতে নিয়ে গেছে।

জেলা কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার পর্যন্ত কুড়িগ্রামে প্রায় ৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ভাঙনে ৪ হাজার ৫৩৬জন এবং পানিবন্দী ৩ লাখ ৯২ হাজার ২৭২ জন।

বন্যার ফলে পানিবন্দী মানুষ চরম ভোগান্তিতে পরেছে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও আশ্রয়ের সংকটে ভুগছেন তারা। চরাঞ্চলে গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সারাদিন পানিতে চলাফেরা করায় বানভাসিরা পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। মঙ্গলবার পর্যন্ত ব্রহ্মপূত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে বেড়ে গিয়ে ১২৫ সে. মিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৯৫ সে.মি এবং ধরলা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে ১১৭ সে. মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার পানি কমে গিয়ে ১০ সে.মি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বগুড়া : বগুড়ার সারিয়াকান্দির নিকট যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদ সীমার ১০৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুর্গম চরাঞ্চলে ওষুধ, মোমবাতি, কেরোসিন, গো খাদ্যের তীব্র সংকট বিরাজ করছে। ডাকাত ও বিষাক্ত সাপের আতঙ্কে ভুগছে মানুষ । বন্যার্তরা বাড়িঘর সরিয়ে নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন। যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের ৯৮টি গ্রামের ৬৬ হাজার ৮শ’ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন উঁচুস্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যায় তিনটি উপজেলায় ৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে। বন্যায় তিনটি উপজেলায় পাট, আউশ ধান, সবজি, মরিচ, বীজতলা ও আখ সহ ৮ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এছাড়া ১ হাজার ৯শ’ ল্যাট্রিন ও ২ হাজার ৪৫৭টি টিউবয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতিমধ্যেই ১৪টি টিউবয়েল মেরামত করা হয়েছে।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সবগুলো নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে গাইবান্ধার নদ-নদীগুলোতে পানি বাড়ছেই। ফলে জেলার বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। ইতোমধ্যে গাইবান্ধার বন্যাকবলিত চার উপজেলার ৩০০টি গ্রামের প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে গাইবান্ধা শহরের মানুষ। এদিকে সোমবার (১৫ জুলাই) রাত থেকে গাইবান্ধা শহরের বেশ কিছু এলাকায় বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করেছে।

জামালপুর : জামালপুরে বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। গতকাল দুপুরে যমুনার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বন্যার পানি বিপদসীমার ১৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৭ উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৭টি ইউনিয়ন ও ৩টি পৌরসভা বন্যা কবলিত হয়ে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেকেই বিভিন্ন অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যাকবলিত ইসলামপুর উপজেলার গোয়ালের চরের মালমারা গ্রামে পানিতে ডুবে আব্দুল্লাহ নামে চার বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ। রেল লাইনের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ লাইনে রেলপথ বন্ধ ঘোষণা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। ২৭৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।

বন্যা দুর্গত এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ত্রানের জন্য বন্যার্তরা দ্বিগবিদিগ ছুটাছুটি করছে। বন্যা আক্রান্ত মানুষেরা বলছেন তাদের কাছে এখনো ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছায়নি। অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা বলছেন বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যার চেয়ে ত্রানের বরাদ্দ কম হওয়ায় সবাইকে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী।

টাঙ্গাইল : গত কয়েকদিনের ভারি বর্ষণের ফলে টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে এই দুটি নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার সকালে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১৬ সে.মি. উপরে এবং ধলেশ্বরী নদীর পানি ২৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে নদী তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েকদিনে যমুনা নদীর তীরবর্তী নাগরপুর উপজেলার আগদিঘুলিয়া, নিশ্চিন্তপুর ও পাইকশা মাঝাইল গ্রামে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। অন্যদিকে ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার কাজীবাড়ি ও কেদারপুরে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। আর এতে গৃহহীন হচ্ছে বহু পরিবার। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্র্তৃপক্ষ বলছে আগামী দুই/তিন দিন নদীর পানি বৃদ্ধি পাবে।

জানা যায়, উপজেলার পাইকশা মাঝাইল, নিশ্চিন্তপুর গ্রামের শত শত পরিবার যমুনা নদীর ভাঙ্গনে গৃহহীন হয়ে তাদের ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষ পানি ও খাদ্যের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমরা ইতিমধ্যে দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছি।

রাজিবপুর (কুড়িগ্রাম): কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বানের পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলা শহরের সকল অফিস আদালত, রাজিবপুর হাট-বাজার ও আবাসিক এলাকায় পানি প্রবেশ করে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। অধিকাংশ ভবনের নিচের তলায় পানি উঠেছে। ফলে উপজেলা পরিষদ ভবনসহ পুরো এলাকা ৩/৫ ফুট পানির নিচে ভাসছে। এছাড়া উপজেলা খাদ্য গুদামে পানি প্রবেশ করে ভবনের মেঝেতে পানি ছুঁই ছুঁই করছে। এছাড়া জাউনিয়ার চর উচ্চবিদ্যালয়ের ফ্লাড সেন্টারটির ভিতরে ১ ফিট পানি উঠেছে, রাজিবপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোমড় পানি থেকে গলা পানিতে ভাসছে। প্রধান প্রধান সড়ক ছাড়া সকল পাকা-আধা-পাকা ও কাঁচা সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ার এলাকাবাসী শহরে যেতে পারছে না। উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা আজিজুর রহমান জানিয়েছেন, উপজেলার ৩ ইউনিয়নের জন্য ১৮ মেট্রিক টন জিআরের চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন। তা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ চলছে এবং মঙ্গলবার আরও ২০ মেট্রিকটন জিআরের চাল ও নগদ ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। রাজিবপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আকবর হোসেন হিরো জানান, তার উপজেলার ৯০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গত কয়েক দিনে প্রায় ৫০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে হারে সরকার বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বরদ্দ দিয়েছেন তা অতি নগণ্ন। তাই সরকারের পাশাপাশি বিত্তবান ও বেসরকারি সংস্থাকে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।

সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) : গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে করে ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

গত ১০ দিন থেকে অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এলাকাগুলো হচ্ছে হরিপুর, কাপাশিয়া, শ্রীপুর, চন্ডিপুর, তারাপুর, শান্তিরাম, কঞ্চিবাড়ী ইউনিয়নের ছয়ঘরিয়া, কাজিয়ারচর, বাদামেরচর, রাজারচর, নবাবগঞ্জসহ লোকালয়গুলোতে পানি প্রবেশ করায় বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। সরকারিভাবে পানিবন্দী মানুষদের উদ্ধারের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই পরিবার পরিজন, গবাদিপশু নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেরিবাঁধ ও উঁচু স্থানসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রীতদের মাঝে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও খাদ্য সংকট। সরকারি হিসাবমতে ৫১টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে করে ৮ হাজার ৭শ’ পরিবারের ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

(কুড়িগ্রাম) : থেমে থেমে বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চিলমারীর ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আরও নতুন করে ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এপর্যন্ত পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। সেই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের তোড়ের মুখে চিলমারী রক্ষা বাঁধটিও রয়েছে হুমকির মুখে। তা রক্ষায় এলাকার মানুষের সহায়তায় চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। মানুষজনের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম আতঙ্ক। বাঁধে আশ্রয় নেয়া প্রায় ২ হাজার পরিবারের মাঝে দেখা দিয়েছে হতাশা, বাড়ছে আতঙ্ক।

মৌলভীবাজার : গতকাল মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ধলই নদীর পানি কমলেও মনু নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। কমলগঞ্জে ধলই নদীর ও মৌলভীবাজারে কুশিয়ারা নদীর ৭টি ভাঙ্গনের মধ্যে ৬টি এখনো উন্মুক্ত। কুশিয়ারা নদীর হামরকোনা মসজিদের পাশের একটি ভাঙন মেরামত করেছে স্থানীয় লোকজন। কুশিয়ারা নদীর হামরকোনা এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ না থাকায় এস্থানের ভাঙন মেরামতের দায় নিচ্ছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড।

উজানের পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের সব কটি নদীর পানি গত কয়েক দিন ধরে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। গতকাল মৌলভীবাজার-কমলগঞ্জ সড়কে বন্যার পানি উঠে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বিঘিœত হয়েছে। তবে গতকাল দুপুর থেকে নদীগুলোর মধ্যে ধলই নদীর পানি কমতে শুরু করে। উজানে মনু নদীর পানি কমলেও ভাটিতে বেড়েছে। তবে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নিবাহী প্রকৌশলী।

কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) : মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ৫ দিন পর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আদমপুর, কমলগঞ্জ পৌর এলাকা, রহিমপুর থেকে পানি নামলেও নিম্নাঞ্চল শমশেরনগর, পতনউষার ও মুন্সীবাজার এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। পতনউষার, আদমপুর ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নে পানিবন্দী শত শত পরিবার পায়নি কোন ত্রাণ।

শিবচর (মাদারীপুর) : পদ্মা নদীতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধিতে শিবচরের চরাঞ্চলের ৩টি ইউনিয়নে নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। বেশি আক্রান্ত হয়েছে বন্দরখোলা ইউনিয়ন। এরইমাঝে ভাঙনে ক্ষতিগস্ত হয়েছে ইউনিয়নটির একটি মাদ্রাসা, কালভার্ট, ১৫টি ঘরবাড়িসহ ফসলের মাঠ। ভয়াবহ ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে একই ইউনিয়নের ৩তলাবিশিষ্ট একটি মাধ্যমিক স্কুল, ১টি প্রাথমিক স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন, হাটবাজারসহ ৩ ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হাজারো বসতবাড়ি। ভাঙন এলাকায় চরম আতংক বিরাজ করছে। নদী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ রায় প্রমুখ।

সরেজমিন একাধিক সূত্রে জানা যায়, গত ৪৮ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর শিবচর উপজেলার চরাঞ্চল বন্দরখোলা, চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়ন সংলগ্ন অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গনে আক্রান্ত হওয়ায় বন্দরখোলার কাজীরসুরা তাহফীজুল কুরআন গোরস্থান মাদরাসার একাধিক ঘর অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। মাদ্রাসাটিতে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। একই ইউনিয়নসহ সংলগ্ন ৩টি ইউনিয়নের ১৫-২০টি বসত বাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। চরজানাজাত ইউনিয়নের একটি কালভার্ট নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙ্গনের মুখে পড়ায় বন্দরখোলার নুরুউদ্দিন মাদবরেরকান্দি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩লা ভবন থেকেও মালামাল সরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে।

রাউজান : এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টি ও রাউজানের সর্তা ও ডাবুয়া খালের বাঁধ ভাঙা পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোতে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বহু রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়েছে। বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার পর পানি নামতে শুরু করলে রাস্তাগুলো ছিন্নভিন্ন চেহারা এখন মানুষের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চিকদাইর, রাউজান সদর ইউনিয়ন, নোয়াজিশপুর, ডাবুয়া, হলদিয়া,উরকিরচর, বিনাজুরী, পশ্চিম গুজরা, নোয়াপাড়ার রাস্তাঘাট।

ঝিনাইগাতী (শেরপুর) : শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে বন্যার পানিতে ডুবে আসিমা বেওয়া (১০৫) নামে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার সারিকালিনগর এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি ওই গ্রামের মৃত ফয়েজ উদ্দিন মন্ডলের স্ত্রী। থানার ওসি আবু বক্কর সিদ্দিক ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে গত রোববার উপজেলার ঘাগড়া সরকারপাড়া গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে মাহিন (১) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়।

সাঘাটা (গাইবান্ধা) : গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলায় বন্যার পানির বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল পর্যন্ত ৬টি ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রাম বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দী রয়েছে।

উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ভরতখালী গো-হাট কোমর পানির নিচে নিমজ্জিত। হাটের আশপাশে কোন উঁচু জায়গা না থাকায় মঙ্গলবার সাপ্তাহিক হাট বার হওয়ায় শত শত গরু-ছাগল ক্রেতা-বিক্রেতাকে হাটে এসে ফিরে যেতে দেখা যায়।

হাট ইজারাদার আলহাজ মোহাম্মদ আলী জানান, ৩ কোটি টাকার উপরে হাট ইজারা নিয়েছি। বন্যার ফলে গরু-ছাগল ক্রয়-বিক্রয় না হওয়ায় আমরা আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে পড়েছি।