ওয়াসার ১১ খাতে দুর্নীতি চিহ্নিত করেছে দুদক

সীমাহীন দুর্নীতির কারণে ঢাকা ওয়াসা থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। সুপেয় পানি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয়া এ সংস্থার প্রতিটি প্রকল্পে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। সীমাহীন দুর্নীতি আর প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের জবাবদিহি না থাকায় সেবাদানকারী এ প্রতিষ্ঠান এখন দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। সুপেয় পানির পরিবর্তে সরবরাহ করা হচ্ছে দুর্গন্ধ ও ময়লাযুক্ত পানি। মডস জোনগুলোয় মিলছে না নিময়িত পানি। বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি হওয়ার কারণে কোন সুফল পাননি ওয়াসার গ্রাহকরা। মিটার রিডিং, নলকূপ স্থাপন, ভৌতিক বিল, ঠিকাদার নিয়োগসহ ১১টি খাতে দুর্নীতির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে দুদক। একই সঙ্গে তা প্রতিরোধে ১২টি সুপারিশ করে গতকাল স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন দুদক কমিশনার ড. মো. মোজ্জাম্মেল হক। সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম দুদকের এ জাতীয় কার্যক্রমের প্রশংসা করে বলেন, দুর্নীতি দেশের অর্থনীতিসহ সব অগ্রযাত্রার প্রতিবন্ধক। তাই মন্ত্রণালয়ের কোন স্তরেই দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবে না। কমিশনের এই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে কর্মকর্তাদের কোন গাফলতি কিংবা শৈথিল্য আছে কি না, তা চিহ্নিত করা এবং ওই মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল বলেন, দুদক ২০১৭ সালে দেশের ২৫টি মন্ত্রণালয়, অধিদফতর বা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন, বিধি-বিধানের পদ্ধতিগত ত্রুটি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবসহ বিবিধ কারণে যেসব দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি হয়, এর উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধে বা প্রতিরোধে পৃথক ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে। এ পর্যন্ত কমিশন ১৩টি প্রতিবেদন ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করেছে। ঢাকা ওয়াসার প্রতিবেদনটি ১৪তম প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনে দুর্নীতির ১১টি সম্ভাব্য উৎস চিহ্নিত করে তা নিরসনে ১২টি সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন কমিশনের এ প্রতিবেদন কোন বিশেষজ্ঞ মতামত সংবলিত প্রতিবেদন নয়। তবে এটি কমিশনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিমের প্রতিবেদন। টিম বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি অ্যানালাইসিস করে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। সরকারের প্রতিটি সংস্থাকেই সমন্বিতভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। এ জাতীয় প্রতিবেদন মূলত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি প্রতিরোধে আরও সংবেদনশীল করে তুলবে।

দুদক সূত্র জানায়, ঢাকা ওয়াসার আইন, বিধি, পরিচালন পদ্ধতি, সরকারি অর্থ অপচয়ের দিকসমূহ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা, প্রতিবন্ধকতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধের নিমিত্ত সুপারিশমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে কমিশনের এক পরিচালকের নেতৃত্বে এক উপ-পরিচালক ও এক সহকারী পরিচালকের সমন্বয়ে ওয়াসার দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করা হয়। এই প্রাতিষ্ঠানিক টিম তাদের অনুসন্ধানকালে ওয়াসার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তা ও এ বিষয়ে যারা সম্যক ধারণা রাখেন, তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহপূর্বক তা পর্যালোচনা করে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক টিম তাদের অনুসন্ধানকালে ওয়াসার বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যসহ ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতাদের বক্তব্য, প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক বিবৃতি, নিরীক্ষা ও অডিট প্রতিবেদনও পর্যালোচনা করে। সার্বিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক টিম ওয়াসার দুর্নীতির উৎস ও ক্ষেত্র চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে প্রণীত সুপারিশমালা প্রতিবেদন আকারে কমিশনে দাখিল করে। দাখিলকৃত প্রতিবেদনে নিম্নবর্ণিত দুর্নীতির উৎস ও সুপারিশমালার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে।

দুর্নীতির উৎস : নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে বিভিন্ন অজুহাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়। এক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন হয় না মর্মে জনশ্রুতি রয়েছে। যেমনÑ ঢাকাসহ বৃহত্তর মিরপুর এলাকার পানির চাহিদা পূরণকল্পে মিরপুরের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা হ্রাসকরণ প্রকল্পটি ২০১২ সালের ২২ অক্টোবর অনুমোদিত হয়। অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী জিওবি ১৪২ কোটি, ওয়াসার ১০ কোটি, প্রকল্প সাহায্য (এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব কোরিয়া সরকারি এজেন্সি ইডিসিএফ) ৩৬৯ কোটিসহ মোট ৫২১ কোটি টাকার প্রকল্প ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় ৫৭৩ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এর মধ্যে জিওবি ২০০.০৫ কোটি, ওয়াসার ১০ কোটি, প্রকল্প সাহায্য ৩৬২.৯৫ কোটি টাকা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকল্পটি ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে অযৌক্তিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ৫২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পের কাজের অঙ্গসমূহের মধ্যে ৪৬টি উৎপাদনযোগ্য কূপ (প্রডাকশন ওয়েলস), ২টি আয়রন অপসারন প্লান্ট, ১টি ভূউপরিস্থ জলাধার ৭.৮১ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ, ৪৮.৭৮ কি.মি. পানি সরবরাহ লাইন (২০০-১২০০ মি.মি. ব্যাস) নির্মাণ কাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হলেও বাস্তব কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৬.৭২%। এ কাজে ঠিকাদারকে ৩১৩.৭১ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, যা সংশোধিত ডিপিপি মূল্যের ৫৪.৭৫%। এক্ষেত্রে কাজের অগ্রগতির সঙ্গে ঠিকাদারের পরিশোধিত বিলের অনেক পার্থক্য রয়েছে।

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা অটুট রাখার স্বার্থে প্রতিদিন ৪০ কোটি লিটার অতিরিক্ত পানি সরবরাহ করার জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন, প্রতিস্থাপন, রিজেনারেশন ও পানির লাইন নির্মাণ-পুনর্বাসনের জন্য ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ৩ বছরমেয়াদি জিওবি ২৪২.০০ কোটি ও ওয়াসার ১০ কোটি টাকাসহ মোট ২৫২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পটি গৃহীত হয়। আলোচ্য প্রকল্পে মোট ১৬২টি গভীর নলকূপ স্থাপন-প্রতিস্থাপন, ৩০টি গভীর নলকূপ রিজেনারেশন-রিহেবিলিটেশন ও ৭০ কিলোমিটার পানির লাইন নির্মাণ-পুনর্বাসনসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আলোচ্য প্রকল্পে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮০ কোটি ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫০ কোটিসহ মোট ১৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ ও ব্যয় হয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬২টি গভীর নলকূপের কাজ শেষ হয়েছে মর্মে খাতাপত্রে দেখানো হয়েছে। রিভাইজড ডিপিপিতে ৩৭৫টি গভীর নলকূপ স্থাপন-প্রতিস্থাপন, ১২০টি গভীর নলকূপ রিজেনারেশন-রিহেবিলিটেশন ও ১০০ কিলোমিটার পানির লাইন নির্মাণ, পুনর্বাসনসহ আনুষঙ্গিক কাজ অন্তর্ভুক্ত করে ৬১২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পটির রিভাইজড ডিপিপি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় প্রথম অনুমোদিত ডিপিপির মাত্র ৫১% হলেও পুনরায় ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। প্রকল্পটি ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ জুনের মধ্যে সমাপ্ত করার কথা থাকলেও প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কয়েকটি গভীর নলকূপ স্থাপন ও কিছু পানির লাইন স্থাপন করা হলেও অধিকাংশ কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। যে কাজ হয়েছে, ওই কাজের অগ্রগতির সঙ্গে ঠিকাদারের পরিশোধিত বিলের অনেক পার্থক্য রয়েছে। দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট থাকে মর্মে জানা যায়। এই প্রকল্পের ক্ষেত্রেও ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন হয়নি মর্মে অভিযোগ রয়েছে।

সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার (ফেজ-৩) প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়মগুলো : হলো পানি শোধনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরীর পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ৪ হাজার ৫৯৭ কোটি ব্যয়ে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পের কাজের তেমন কোন অগ্রগতি নেই। পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার নির্মাণ (ফেজ-১) প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়মগুলো : মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার পদ্মা নদীর তীরে যশলদিয়া নামক স্থানে পানি শোধনাগার নির্মাণের মাধ্যমে পুরন ঢাকার মিটফোর্ড, নবাবপুর, লালবাগ, হাজারীবাগ ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ৪৫০ এমএলডি সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য ৩ হাজার ৫০৮.৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করার কথা থাকলেও তা সমাপ্ত হয়নি। ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়মগুলো : ভূউপরিস্থ পানি শোধনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরীর পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। এ প্রকল্পে ২৩৮ কোটি টাকা ইতোমধ্যে পরিশোধ করা হলেও কাজের অগ্রগতি মাত্র ৮%। দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পে দুর্নীতি : ঢাকা শহরের গুলশান, বনানীসহ অন্যান্য এলাকায় পয়ঃবর্জ্য পরিশোধ প্রকল্পের জন্য ৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সমাপ্ত করার কথা। এ যাবৎ প্রায় ১০১ কোটি টাকা জিওবি থেকে পরিশোধ করা হয়েছে। কাজের অগ্রগতি একেবারেই নগন্য। ঢাকা মহানগরীর আগারগাঁও এলাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়মগুলো : জিওবি থেকে প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পের তেমন কোন অগ্রগতি নেই। ঢাকা পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়মগুলো : প্রায় ৩ হাজার ১৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ৩০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। অদ্যাবধি প্রকল্পের কোন অগ্রগতি নেই। এ প্রকল্পের কাজের কাক্সিক্ষত অগ্রগতি না থাকলেও কার্যাদেশ প্রাপ্ত ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা হচ্ছে মর্মে অভিযোগ রয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ওয়াসা এখনও ম্যানুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করায় প্রকৌশল ও রাজস্ব শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্ত-কর্মচারীরা মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এর মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে।

সুপারিশমালা : সুপারিশে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার চলমান প্রকল্পগুলোর বিভিন্ন অনিয়মম-দুর্নীতি ও অর্থ অপচয় রোধে বিভিন্ন প্রকৌশল সংস্থা কর্তৃক অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর সমন্বয়ে যৌথ পরিমাপ টিম ও মনিটরিং টিম গঠন করা যেতে পারে। এসব টিম গঠন করা হলে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদাররা প্রকল্প কাজ যথাসময়ে যথাযথভাবে সম্পাদনের বিষয়ে মনোযোগী হবেন এবং এতে সময়, অর্থ অপচয় ও দুর্নীতি অনেকাংশে হ্্রাস পাবে মর্মে প্রতীয়মান হয়। প্রকল্পের প্রাক্কলন তৈরির সময় কাজের যথার্থতা ও উপযোগিতা আছে কি না, তা ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত হতে হবে এবং বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যাতে অহেতুক না বাড়ানো হয়, এদিকে বিশেষ দৃষ্টি আরও প্রয়োজন। দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটিতে দাতা সংস্থার প্রতিনিধিসহ টেন্ডার ও ক্রয়কার্য যথাযথ হচ্ছে কি না, তা মনিটর করার জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক শক্তিশালী টিম গঠন করা যেতে পারে। প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের সময় ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ একাধিকবার প্রকল্প পরিদর্শনসহ জনশ্রুত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারে। ঠিকাদারকে বিল পরিশোধের আগে এ মর্মে সুনিশ্চিত হতে হবে, দরপত্রের শর্তানুযায়ী ঠিকাদার প্রকল্প কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া ঠিকাদার যতটুকু কাজ করেছেন, এর গুণগতমান যাচাইয়ের ওপরই তার বিল পরিশোধ করা যেতে পারে। ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ওয়াসা কর্তৃক ম্যানুয়াল পদ্ধতির ব্যবহার পরিহার করে সহজতর ডিজিটাল পদ্ধতিতে মিটার রিডিংয়ের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। অবৈধ ওভারটাইম বিল রোধকল্পে ঢাকা ওয়াসার কর্মচারীদের জনবল কাঠামো সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন এবং বেতনের সঙ্গে ওভারটাইম বিলের সমন্বয় সাধনসহ সুর্নিদিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। প্রকল্প কাজ বাস্তবায়নের জন্য ঢাকা ওয়াসার কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য প্রতিষ্ঠানÑ ঢাকা সিটি করপোরেশন, সওজ, বিদ্যুৎ বিভাগ ইত্যাদির সঙ্গে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন। ঢাকা ওয়াসার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনয়নের লক্ষ্যে গণমাধ্যম, দুদক, অডিট ডিপার্টমেন্টসহ নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে সেবাগ্রহীতাদের নিয়ে ঢাকা ওয়াসায় মাঝে মধ্যে গণশুনানির আয়োজন করা যেতে পারে। ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নাধীন অবস্থায় বিভিন্ন প্রকৌশলী সংস্থার বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত সার্ভিলেন্স টিম কর্তৃক আকস্মিক অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন প্রকার ক্রয়ে প্রতিযোগিতামূলক প্রকাশ্য বা ই-টেন্ডারিং দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে কার্যাদেশ প্রদান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞ সিনিয়র কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বুয়েটসহ অন্যান্য পেশাদার সংস্থাকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

শুক্রবার, ১৯ জুলাই ২০১৯ , ৪ শ্রাবন ১৪২৫, ১৫ জিলকদ ১৪৪০

ওয়াসার ১১ খাতে দুর্নীতি চিহ্নিত করেছে দুদক

image

সীমাহীন দুর্নীতির কারণে ঢাকা ওয়াসা থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। সুপেয় পানি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয়া এ সংস্থার প্রতিটি প্রকল্পে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। সীমাহীন দুর্নীতি আর প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের জবাবদিহি না থাকায় সেবাদানকারী এ প্রতিষ্ঠান এখন দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। সুপেয় পানির পরিবর্তে সরবরাহ করা হচ্ছে দুর্গন্ধ ও ময়লাযুক্ত পানি। মডস জোনগুলোয় মিলছে না নিময়িত পানি। বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি হওয়ার কারণে কোন সুফল পাননি ওয়াসার গ্রাহকরা। মিটার রিডিং, নলকূপ স্থাপন, ভৌতিক বিল, ঠিকাদার নিয়োগসহ ১১টি খাতে দুর্নীতির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে দুদক। একই সঙ্গে তা প্রতিরোধে ১২টি সুপারিশ করে গতকাল স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন দুদক কমিশনার ড. মো. মোজ্জাম্মেল হক। সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম দুদকের এ জাতীয় কার্যক্রমের প্রশংসা করে বলেন, দুর্নীতি দেশের অর্থনীতিসহ সব অগ্রযাত্রার প্রতিবন্ধক। তাই মন্ত্রণালয়ের কোন স্তরেই দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবে না। কমিশনের এই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে কর্মকর্তাদের কোন গাফলতি কিংবা শৈথিল্য আছে কি না, তা চিহ্নিত করা এবং ওই মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল বলেন, দুদক ২০১৭ সালে দেশের ২৫টি মন্ত্রণালয়, অধিদফতর বা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন, বিধি-বিধানের পদ্ধতিগত ত্রুটি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবসহ বিবিধ কারণে যেসব দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি হয়, এর উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধে বা প্রতিরোধে পৃথক ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে। এ পর্যন্ত কমিশন ১৩টি প্রতিবেদন ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করেছে। ঢাকা ওয়াসার প্রতিবেদনটি ১৪তম প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনে দুর্নীতির ১১টি সম্ভাব্য উৎস চিহ্নিত করে তা নিরসনে ১২টি সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন কমিশনের এ প্রতিবেদন কোন বিশেষজ্ঞ মতামত সংবলিত প্রতিবেদন নয়। তবে এটি কমিশনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিমের প্রতিবেদন। টিম বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি অ্যানালাইসিস করে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। সরকারের প্রতিটি সংস্থাকেই সমন্বিতভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। এ জাতীয় প্রতিবেদন মূলত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি প্রতিরোধে আরও সংবেদনশীল করে তুলবে।

দুদক সূত্র জানায়, ঢাকা ওয়াসার আইন, বিধি, পরিচালন পদ্ধতি, সরকারি অর্থ অপচয়ের দিকসমূহ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা, প্রতিবন্ধকতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধের নিমিত্ত সুপারিশমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে কমিশনের এক পরিচালকের নেতৃত্বে এক উপ-পরিচালক ও এক সহকারী পরিচালকের সমন্বয়ে ওয়াসার দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করা হয়। এই প্রাতিষ্ঠানিক টিম তাদের অনুসন্ধানকালে ওয়াসার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তা ও এ বিষয়ে যারা সম্যক ধারণা রাখেন, তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহপূর্বক তা পর্যালোচনা করে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক টিম তাদের অনুসন্ধানকালে ওয়াসার বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যসহ ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতাদের বক্তব্য, প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক বিবৃতি, নিরীক্ষা ও অডিট প্রতিবেদনও পর্যালোচনা করে। সার্বিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক টিম ওয়াসার দুর্নীতির উৎস ও ক্ষেত্র চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে প্রণীত সুপারিশমালা প্রতিবেদন আকারে কমিশনে দাখিল করে। দাখিলকৃত প্রতিবেদনে নিম্নবর্ণিত দুর্নীতির উৎস ও সুপারিশমালার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে।

দুর্নীতির উৎস : নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে বিভিন্ন অজুহাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়। এক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন হয় না মর্মে জনশ্রুতি রয়েছে। যেমনÑ ঢাকাসহ বৃহত্তর মিরপুর এলাকার পানির চাহিদা পূরণকল্পে মিরপুরের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা হ্রাসকরণ প্রকল্পটি ২০১২ সালের ২২ অক্টোবর অনুমোদিত হয়। অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী জিওবি ১৪২ কোটি, ওয়াসার ১০ কোটি, প্রকল্প সাহায্য (এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব কোরিয়া সরকারি এজেন্সি ইডিসিএফ) ৩৬৯ কোটিসহ মোট ৫২১ কোটি টাকার প্রকল্প ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় ৫৭৩ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এর মধ্যে জিওবি ২০০.০৫ কোটি, ওয়াসার ১০ কোটি, প্রকল্প সাহায্য ৩৬২.৯৫ কোটি টাকা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকল্পটি ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে অযৌক্তিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ৫২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পের কাজের অঙ্গসমূহের মধ্যে ৪৬টি উৎপাদনযোগ্য কূপ (প্রডাকশন ওয়েলস), ২টি আয়রন অপসারন প্লান্ট, ১টি ভূউপরিস্থ জলাধার ৭.৮১ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ, ৪৮.৭৮ কি.মি. পানি সরবরাহ লাইন (২০০-১২০০ মি.মি. ব্যাস) নির্মাণ কাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হলেও বাস্তব কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৬.৭২%। এ কাজে ঠিকাদারকে ৩১৩.৭১ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, যা সংশোধিত ডিপিপি মূল্যের ৫৪.৭৫%। এক্ষেত্রে কাজের অগ্রগতির সঙ্গে ঠিকাদারের পরিশোধিত বিলের অনেক পার্থক্য রয়েছে।

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা অটুট রাখার স্বার্থে প্রতিদিন ৪০ কোটি লিটার অতিরিক্ত পানি সরবরাহ করার জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন, প্রতিস্থাপন, রিজেনারেশন ও পানির লাইন নির্মাণ-পুনর্বাসনের জন্য ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ৩ বছরমেয়াদি জিওবি ২৪২.০০ কোটি ও ওয়াসার ১০ কোটি টাকাসহ মোট ২৫২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পটি গৃহীত হয়। আলোচ্য প্রকল্পে মোট ১৬২টি গভীর নলকূপ স্থাপন-প্রতিস্থাপন, ৩০টি গভীর নলকূপ রিজেনারেশন-রিহেবিলিটেশন ও ৭০ কিলোমিটার পানির লাইন নির্মাণ-পুনর্বাসনসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আলোচ্য প্রকল্পে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮০ কোটি ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫০ কোটিসহ মোট ১৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ ও ব্যয় হয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬২টি গভীর নলকূপের কাজ শেষ হয়েছে মর্মে খাতাপত্রে দেখানো হয়েছে। রিভাইজড ডিপিপিতে ৩৭৫টি গভীর নলকূপ স্থাপন-প্রতিস্থাপন, ১২০টি গভীর নলকূপ রিজেনারেশন-রিহেবিলিটেশন ও ১০০ কিলোমিটার পানির লাইন নির্মাণ, পুনর্বাসনসহ আনুষঙ্গিক কাজ অন্তর্ভুক্ত করে ৬১২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পটির রিভাইজড ডিপিপি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় প্রথম অনুমোদিত ডিপিপির মাত্র ৫১% হলেও পুনরায় ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। প্রকল্পটি ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ জুনের মধ্যে সমাপ্ত করার কথা থাকলেও প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কয়েকটি গভীর নলকূপ স্থাপন ও কিছু পানির লাইন স্থাপন করা হলেও অধিকাংশ কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। যে কাজ হয়েছে, ওই কাজের অগ্রগতির সঙ্গে ঠিকাদারের পরিশোধিত বিলের অনেক পার্থক্য রয়েছে। দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট থাকে মর্মে জানা যায়। এই প্রকল্পের ক্ষেত্রেও ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন হয়নি মর্মে অভিযোগ রয়েছে।

সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার (ফেজ-৩) প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়মগুলো : হলো পানি শোধনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরীর পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ৪ হাজার ৫৯৭ কোটি ব্যয়ে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পের কাজের তেমন কোন অগ্রগতি নেই। পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার নির্মাণ (ফেজ-১) প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়মগুলো : মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার পদ্মা নদীর তীরে যশলদিয়া নামক স্থানে পানি শোধনাগার নির্মাণের মাধ্যমে পুরন ঢাকার মিটফোর্ড, নবাবপুর, লালবাগ, হাজারীবাগ ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ৪৫০ এমএলডি সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য ৩ হাজার ৫০৮.৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করার কথা থাকলেও তা সমাপ্ত হয়নি। ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়মগুলো : ভূউপরিস্থ পানি শোধনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরীর পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। এ প্রকল্পে ২৩৮ কোটি টাকা ইতোমধ্যে পরিশোধ করা হলেও কাজের অগ্রগতি মাত্র ৮%। দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পে দুর্নীতি : ঢাকা শহরের গুলশান, বনানীসহ অন্যান্য এলাকায় পয়ঃবর্জ্য পরিশোধ প্রকল্পের জন্য ৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সমাপ্ত করার কথা। এ যাবৎ প্রায় ১০১ কোটি টাকা জিওবি থেকে পরিশোধ করা হয়েছে। কাজের অগ্রগতি একেবারেই নগন্য। ঢাকা মহানগরীর আগারগাঁও এলাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়মগুলো : জিওবি থেকে প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্পের তেমন কোন অগ্রগতি নেই। ঢাকা পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়মগুলো : প্রায় ৩ হাজার ১৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ৩০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। অদ্যাবধি প্রকল্পের কোন অগ্রগতি নেই। এ প্রকল্পের কাজের কাক্সিক্ষত অগ্রগতি না থাকলেও কার্যাদেশ প্রাপ্ত ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা হচ্ছে মর্মে অভিযোগ রয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ওয়াসা এখনও ম্যানুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করায় প্রকৌশল ও রাজস্ব শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্ত-কর্মচারীরা মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এর মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে।

সুপারিশমালা : সুপারিশে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার চলমান প্রকল্পগুলোর বিভিন্ন অনিয়মম-দুর্নীতি ও অর্থ অপচয় রোধে বিভিন্ন প্রকৌশল সংস্থা কর্তৃক অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর সমন্বয়ে যৌথ পরিমাপ টিম ও মনিটরিং টিম গঠন করা যেতে পারে। এসব টিম গঠন করা হলে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদাররা প্রকল্প কাজ যথাসময়ে যথাযথভাবে সম্পাদনের বিষয়ে মনোযোগী হবেন এবং এতে সময়, অর্থ অপচয় ও দুর্নীতি অনেকাংশে হ্্রাস পাবে মর্মে প্রতীয়মান হয়। প্রকল্পের প্রাক্কলন তৈরির সময় কাজের যথার্থতা ও উপযোগিতা আছে কি না, তা ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত হতে হবে এবং বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যাতে অহেতুক না বাড়ানো হয়, এদিকে বিশেষ দৃষ্টি আরও প্রয়োজন। দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটিতে দাতা সংস্থার প্রতিনিধিসহ টেন্ডার ও ক্রয়কার্য যথাযথ হচ্ছে কি না, তা মনিটর করার জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক শক্তিশালী টিম গঠন করা যেতে পারে। প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের সময় ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ একাধিকবার প্রকল্প পরিদর্শনসহ জনশ্রুত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে পারে। ঠিকাদারকে বিল পরিশোধের আগে এ মর্মে সুনিশ্চিত হতে হবে, দরপত্রের শর্তানুযায়ী ঠিকাদার প্রকল্প কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া ঠিকাদার যতটুকু কাজ করেছেন, এর গুণগতমান যাচাইয়ের ওপরই তার বিল পরিশোধ করা যেতে পারে। ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ওয়াসা কর্তৃক ম্যানুয়াল পদ্ধতির ব্যবহার পরিহার করে সহজতর ডিজিটাল পদ্ধতিতে মিটার রিডিংয়ের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। অবৈধ ওভারটাইম বিল রোধকল্পে ঢাকা ওয়াসার কর্মচারীদের জনবল কাঠামো সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন এবং বেতনের সঙ্গে ওভারটাইম বিলের সমন্বয় সাধনসহ সুর্নিদিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। প্রকল্প কাজ বাস্তবায়নের জন্য ঢাকা ওয়াসার কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য প্রতিষ্ঠানÑ ঢাকা সিটি করপোরেশন, সওজ, বিদ্যুৎ বিভাগ ইত্যাদির সঙ্গে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন। ঢাকা ওয়াসার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনয়নের লক্ষ্যে গণমাধ্যম, দুদক, অডিট ডিপার্টমেন্টসহ নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে সেবাগ্রহীতাদের নিয়ে ঢাকা ওয়াসায় মাঝে মধ্যে গণশুনানির আয়োজন করা যেতে পারে। ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নাধীন অবস্থায় বিভিন্ন প্রকৌশলী সংস্থার বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত সার্ভিলেন্স টিম কর্তৃক আকস্মিক অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন প্রকার ক্রয়ে প্রতিযোগিতামূলক প্রকাশ্য বা ই-টেন্ডারিং দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে কার্যাদেশ প্রদান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞ সিনিয়র কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বুয়েটসহ অন্যান্য পেশাদার সংস্থাকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।