রাজধানীতে জলাবদ্ধতা স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা

২ হাজার ৮শ কি.মি. ড্রেন ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি

  • জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের

    -প্রকৌশলী ইনামুল হক

  • আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের

প্রতি বছরই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রাজধানীবাসীকে। একটু বৃষ্টিতেই বড় বড় রাস্তার পাশাপাশি অলিগলিতেও দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। মূলত নগরীর পানি নিষ্কাশন পথগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে আছে। ড্রেনেজ লাইনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় সব রাস্তাঘাট। রাজধানীতে ২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি হওয়ায় পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হয়। ফলে বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এছাড়া রাজধানীতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য সাড়ে ৮ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট ও ৩৫০ কিলোমিটার স্টর্ম সুয়ারেজ লাইন রয়েছে। প্রতি বর্ষা মৌসুম শেষে ৮০ শতাংশ বক্স কালভার্ট ও স্টর্ম সুয়ারেজ লাইন ভরাট হয়ে যায়। নিয়মিত পরিষ্কারের অভাবে বক্স কালভার্ট ও সুয়ারেজ লাইন দিয়ে পানি নামতে পারে না। তাই প্রতি বছরের মতো এবারও রাজধানীতে জলবদ্ধতার আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর ৪টি স্থায়ী ও ১৫টি অস্থায়ী পাম্পের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি অপসারণ করা হয়। তাও খুব অপর্যাপ্ত। এছাড়া রাজধানীর চারপাশে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৫১টি সুইস গেট রয়েছে। নিয়মিত তদারকির অভাবে তাও অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েছে। তাই বর্ষায় দুর্ভোগ নিরসনে জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকায় অস্থায়ী পাম্প বসানোসহ একাধিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। রাজধানীতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। কিন্তু তাদের দায়িত্ব দেয়া হয় না বা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করার কারণে সামান্য বৃষ্টিতে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। শুধু প্রকল্প গ্রহণ করলে হবে না। যার যে দায়িত্ব, তা সঠিকভাবে পালন করার সুপারিশ বিশেষজ্ঞদের।

এ বিষয়ে পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক সংবাদকে বলেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব একা ওয়াসা নিয়ে বসে আছে। ওয়াসার এটা কাজ নয়। ওয়াসার কাজ বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ ও পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশন। কিন্তু তাদের দায়িত্ব তারা সঠিকভাবে পালন করেন না। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প নেয়া হয় আর টাকা অপচয় করা হয়। কাজের কাজ কিছুই হয় না। মূলত জলাবদ্ধতার নিরসনের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। অথচ তাদের এ বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া হয় না বা ডাকা হয় না। তাদের কেউ ডাকেন না। তারা আরামে বসে আছেন। যার যে দায়িত্ব, তাকে ওই দায়িত্ব দেয়া উচিত। ওয়াসা দায়িত্ব নিতে না চাইলে তা দেয়া হয় সিটি করপোরেশনের কাছে। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন- কারও নয়। এটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের আইনে স্পষ্ট লেখা আছে, ১ হাজার হেক্টরের বেশি এলাকায় পানি নিষ্কাশন করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ফলে যার ওই দায়িত্ব, তাকে তা দেয়া উচিত। তা না হলে ৫০ বছরেও এই সমস্যা সমাধান হবে না বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, প্রতি বছরই সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতায় দীর্ঘ ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। এবার ওই ভোগান্তি আরও বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতি বছরই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়েন ঢাকাবাসী। নগরীর বড়-ছোট সড়ক থেকে অলিগলিতে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নেয়। একই সঙ্গে ড্রেন থেকে আবর্জনা উঠে সয়লাব হয় পুরো সড়ক, অলিগলি। আষাঢ়ের শেষপ্রান্তে এসে গত শুক্রবার রাজধানীতে ৫০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। প্রায় দিনব্যাপী থেমে থেমে বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, আরামবাগ, মতিঝিল, ধানমন্ডি, কারওয়ান বাজার, বাংলামটর, শান্তিনগর, ইস্কাটন, মগবাজার, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের বেশিরভাগ এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকে বৃষ্টির পানি। কোথাও কোথাও হাঁটুপানি মাড়িয়ে আবার কোথাও রিকশায় পারাপার করতে হয় সাধারণ মানুষকে। ফলে এবার বর্ষায় ব্যাপকভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হবে রাজধানীবাসীকেÑ এমন ধারণা অনেকের। তবে এবারের বর্ষায় রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে নানা উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছে সেবা সংস্থাগুলো।

রাজধানীতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য সাড়ে ৮ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট ও ৩৫০ কিলোমিটার স্টর্ম সুয়ারেজ লাইন রয়েছে। এর মধ্যে বক্স কালভার্ট ও ড্রেন দেখাশোনার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। এছাড়া দুই সিটি করপোরেশনের আওতায় ড্রেন রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার এবং প্রায় ৪০০ কিলোমিটার ওয়াসার। বৃষ্টির পানি এ দুই মাধ্যমে বিভিন্ন জলাশয়, খাল বা নদীতে প্রবাহিত হয়। প্রতি বর্ষা মৌসুম শেষে ৮০ শতাংশ বক্স কালভার্ট ও স্টর্ম সুয়ারেজ লাইন ভরাট হয়ে যায়। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি হওয়ায় পানি নিষ্কাশন বিঘিœত হয়। ফলে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। ওই ধারণা থেকে এবারও রাজধানীতে জলবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

এ বিষয়ে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান সংবাদিকদের বলেন, ডিএসসিসি এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক নির্মাণ, নর্দমা, জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ নির্মাণ ও সংস্কার, ফুটপাত নির্মাণ এবং প্রশস্তকরণে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ কাজ শেষ হলে ডিএসসিসির বাসিন্দারা স্বচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারবেন। ড্রেনগুলো প্রশস্ত করা হলে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা কিছুটা হলেও নিরসন হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছরই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রাজধানীবাসীকে। ড্রেনেজ লাইনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় সব রাস্তা। ভারি বৃষ্টি হলে তাৎক্ষণিকভাবে পানিধারণের জন্য নগরীতে উপযুক্ত জলাধার নেই। একই সঙ্গে পাম্পগুলোর ভারি বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ক্ষমতাও সীমিত। ফলে এবারও ঢাকার অনেক স্থানে জলাবদ্ধতা থাকবে। রাজধানীতে বৃষ্টি হলেই প্রতি বছর বেশি জলাবদ্ধতা দেখা যায় মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, গ্রিন রোড, কাঁঠাল বাগান, কারওয়ান বাজার, তেজকুনিপাড়া, তেজতুরিবাজার, গার্ডেন রোড, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোড, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, মতিঝিল, আরামবাগ, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড, উমেশ দত্ত রোড, বংশাল রোড, টিকাটুলী, মুগদা, খিলক্ষেত ও বঙ্গভবন এলাকায়। গত বছর বর্ষা মৌসুমের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চলতি বছর ওয়াসার কাজে গতি বাড়াতে হবে। তা না হলে এ সমস্যার নিরসন হবে না। অন্যদিকে সিটি কনপোরেশন মূলত নতুন লাইন তৈরিতে ব্যস্ত। আগের ড্রেনগুলোর যেসব স্থান ভরাট হয়ে গেছে, তা পরিষ্কারের ব্যাপারে তাদের আরও মনোযোগী হতে হবে। এটা করা না হলে জলাবদ্ধাতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব্য নয় বলে জানান নগর বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা ওয়াসা সূত্র জানায়, রাজধানীর ১৫টি খালের ২০ কিলোমিটার ও ৩০০ কিলোমিটার স্টর্ম ওয়াটার ড্রেন পরিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া চারটি স্থায়ী ও ১৫টি অস্থায়ী পাম্পের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি অপসারণের পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির। এদিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ড্রেনগুলো পরিষ্কার করছে। তবে দুই সিটি করপোরেশন বলছে, ওয়াসাকে পানি নিষ্কাশনের জন্য পাম্পের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। তা না হলে এবারও নগরীতে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা থেকে যাবে। রাজধানীবাসীকে জলজট থেকে মুক্তি দিতে ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে একটি প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা ওয়াসা। ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং খাল উন্নয়ন নামের প্রকল্পের সময় এক বছর পার হলেও অর্ধেক কাজ শেষ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং ১৬টি খাল উন্নয়নের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, শেরেবাংলা নগর, দারুসসালাম, মিরপুর, পল্লবী, ক্যান্টনমেন্ট, উত্তরা, বিমানবন্দর এলাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, শঙ্কর, ঝিগাতলা, রায়েরবাজার এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করাই ওই প্রকল্পের প্রধান কাজ। এছাড়া প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত বিদ্যমান খালগুলো খনন ও প্রশস্ত করে তীর উন্নয়ন এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে খালের দুই তীরের পরিবেশ উন্নত করাও ছিল এ কাজের অংশ। ৩০০ কিলোমিটার স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনের পরিষ্কার কাজ চলছে। ২৪৯ কিলোমিটার পরিষ্কার হয়েছে। এছাড়া ভারি বৃষ্টিপাত হলে চারটি স্থায়ী ও ১৫টি অস্থায়ী পাম্পের মাধ্যমে পানি অপসারণ করা হবে। এবারের বর্ষায় রাজধানীতে যেন জলাবদ্ধতা না হয়, এ জন্য গত বছর ১৭টি খালের ৩০ কিলোমিটার পুনর্খনন করা হয়। পানি যেন দ্রুত ড্রেন দিয়ে চলে যেতে পারে, এ জন্য ৩০০ কিলোমিটার স্টর্ম ওয়াটার ড্রেন পরিষ্কার করা হয়েছে। রাস্তার পানি যেন দ্রুত ড্রেনে প্রবেশ করতে পারে, এ জন্য ৭০০টি ক্যাচপিট (নালার ওপরের ছিদ্রযুক্ত ঢাকনা) পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।

শনিবার, ২০ জুলাই ২০১৯ , ৫ শ্রাবন ১৪২৫, ১৬ জিলকদ ১৪৪০

রাজধানীতে জলাবদ্ধতা স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা

২ হাজার ৮শ কি.মি. ড্রেন ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি

মাহমুদ আকাশ

image

  • জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের

    -প্রকৌশলী ইনামুল হক

  • আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের

প্রতি বছরই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রাজধানীবাসীকে। একটু বৃষ্টিতেই বড় বড় রাস্তার পাশাপাশি অলিগলিতেও দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। মূলত নগরীর পানি নিষ্কাশন পথগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে আছে। ড্রেনেজ লাইনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় সব রাস্তাঘাট। রাজধানীতে ২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি হওয়ায় পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হয়। ফলে বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এছাড়া রাজধানীতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য সাড়ে ৮ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট ও ৩৫০ কিলোমিটার স্টর্ম সুয়ারেজ লাইন রয়েছে। প্রতি বর্ষা মৌসুম শেষে ৮০ শতাংশ বক্স কালভার্ট ও স্টর্ম সুয়ারেজ লাইন ভরাট হয়ে যায়। নিয়মিত পরিষ্কারের অভাবে বক্স কালভার্ট ও সুয়ারেজ লাইন দিয়ে পানি নামতে পারে না। তাই প্রতি বছরের মতো এবারও রাজধানীতে জলবদ্ধতার আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর ৪টি স্থায়ী ও ১৫টি অস্থায়ী পাম্পের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি অপসারণ করা হয়। তাও খুব অপর্যাপ্ত। এছাড়া রাজধানীর চারপাশে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৫১টি সুইস গেট রয়েছে। নিয়মিত তদারকির অভাবে তাও অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েছে। তাই বর্ষায় দুর্ভোগ নিরসনে জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকায় অস্থায়ী পাম্প বসানোসহ একাধিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। রাজধানীতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। কিন্তু তাদের দায়িত্ব দেয়া হয় না বা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করার কারণে সামান্য বৃষ্টিতে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। শুধু প্রকল্প গ্রহণ করলে হবে না। যার যে দায়িত্ব, তা সঠিকভাবে পালন করার সুপারিশ বিশেষজ্ঞদের।

এ বিষয়ে পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক সংবাদকে বলেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব একা ওয়াসা নিয়ে বসে আছে। ওয়াসার এটা কাজ নয়। ওয়াসার কাজ বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ ও পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশন। কিন্তু তাদের দায়িত্ব তারা সঠিকভাবে পালন করেন না। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প নেয়া হয় আর টাকা অপচয় করা হয়। কাজের কাজ কিছুই হয় না। মূলত জলাবদ্ধতার নিরসনের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। অথচ তাদের এ বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া হয় না বা ডাকা হয় না। তাদের কেউ ডাকেন না। তারা আরামে বসে আছেন। যার যে দায়িত্ব, তাকে ওই দায়িত্ব দেয়া উচিত। ওয়াসা দায়িত্ব নিতে না চাইলে তা দেয়া হয় সিটি করপোরেশনের কাছে। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন- কারও নয়। এটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের আইনে স্পষ্ট লেখা আছে, ১ হাজার হেক্টরের বেশি এলাকায় পানি নিষ্কাশন করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ফলে যার ওই দায়িত্ব, তাকে তা দেয়া উচিত। তা না হলে ৫০ বছরেও এই সমস্যা সমাধান হবে না বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, প্রতি বছরই সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতায় দীর্ঘ ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। এবার ওই ভোগান্তি আরও বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতি বছরই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়েন ঢাকাবাসী। নগরীর বড়-ছোট সড়ক থেকে অলিগলিতে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নেয়। একই সঙ্গে ড্রেন থেকে আবর্জনা উঠে সয়লাব হয় পুরো সড়ক, অলিগলি। আষাঢ়ের শেষপ্রান্তে এসে গত শুক্রবার রাজধানীতে ৫০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। প্রায় দিনব্যাপী থেমে থেমে বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, আরামবাগ, মতিঝিল, ধানমন্ডি, কারওয়ান বাজার, বাংলামটর, শান্তিনগর, ইস্কাটন, মগবাজার, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের বেশিরভাগ এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকে বৃষ্টির পানি। কোথাও কোথাও হাঁটুপানি মাড়িয়ে আবার কোথাও রিকশায় পারাপার করতে হয় সাধারণ মানুষকে। ফলে এবার বর্ষায় ব্যাপকভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হবে রাজধানীবাসীকেÑ এমন ধারণা অনেকের। তবে এবারের বর্ষায় রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে নানা উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছে সেবা সংস্থাগুলো।

রাজধানীতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য সাড়ে ৮ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট ও ৩৫০ কিলোমিটার স্টর্ম সুয়ারেজ লাইন রয়েছে। এর মধ্যে বক্স কালভার্ট ও ড্রেন দেখাশোনার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। এছাড়া দুই সিটি করপোরেশনের আওতায় ড্রেন রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার এবং প্রায় ৪০০ কিলোমিটার ওয়াসার। বৃষ্টির পানি এ দুই মাধ্যমে বিভিন্ন জলাশয়, খাল বা নদীতে প্রবাহিত হয়। প্রতি বর্ষা মৌসুম শেষে ৮০ শতাংশ বক্স কালভার্ট ও স্টর্ম সুয়ারেজ লাইন ভরাট হয়ে যায়। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি হওয়ায় পানি নিষ্কাশন বিঘিœত হয়। ফলে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। ওই ধারণা থেকে এবারও রাজধানীতে জলবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

এ বিষয়ে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান সংবাদিকদের বলেন, ডিএসসিসি এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক নির্মাণ, নর্দমা, জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ নির্মাণ ও সংস্কার, ফুটপাত নির্মাণ এবং প্রশস্তকরণে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ কাজ শেষ হলে ডিএসসিসির বাসিন্দারা স্বচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারবেন। ড্রেনগুলো প্রশস্ত করা হলে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা কিছুটা হলেও নিরসন হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছরই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রাজধানীবাসীকে। ড্রেনেজ লাইনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় সব রাস্তা। ভারি বৃষ্টি হলে তাৎক্ষণিকভাবে পানিধারণের জন্য নগরীতে উপযুক্ত জলাধার নেই। একই সঙ্গে পাম্পগুলোর ভারি বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ক্ষমতাও সীমিত। ফলে এবারও ঢাকার অনেক স্থানে জলাবদ্ধতা থাকবে। রাজধানীতে বৃষ্টি হলেই প্রতি বছর বেশি জলাবদ্ধতা দেখা যায় মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, গ্রিন রোড, কাঁঠাল বাগান, কারওয়ান বাজার, তেজকুনিপাড়া, তেজতুরিবাজার, গার্ডেন রোড, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোড, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, মতিঝিল, আরামবাগ, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড, উমেশ দত্ত রোড, বংশাল রোড, টিকাটুলী, মুগদা, খিলক্ষেত ও বঙ্গভবন এলাকায়। গত বছর বর্ষা মৌসুমের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চলতি বছর ওয়াসার কাজে গতি বাড়াতে হবে। তা না হলে এ সমস্যার নিরসন হবে না। অন্যদিকে সিটি কনপোরেশন মূলত নতুন লাইন তৈরিতে ব্যস্ত। আগের ড্রেনগুলোর যেসব স্থান ভরাট হয়ে গেছে, তা পরিষ্কারের ব্যাপারে তাদের আরও মনোযোগী হতে হবে। এটা করা না হলে জলাবদ্ধাতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব্য নয় বলে জানান নগর বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা ওয়াসা সূত্র জানায়, রাজধানীর ১৫টি খালের ২০ কিলোমিটার ও ৩০০ কিলোমিটার স্টর্ম ওয়াটার ড্রেন পরিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া চারটি স্থায়ী ও ১৫টি অস্থায়ী পাম্পের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি অপসারণের পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির। এদিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ড্রেনগুলো পরিষ্কার করছে। তবে দুই সিটি করপোরেশন বলছে, ওয়াসাকে পানি নিষ্কাশনের জন্য পাম্পের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। তা না হলে এবারও নগরীতে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা থেকে যাবে। রাজধানীবাসীকে জলজট থেকে মুক্তি দিতে ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে একটি প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা ওয়াসা। ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং খাল উন্নয়ন নামের প্রকল্পের সময় এক বছর পার হলেও অর্ধেক কাজ শেষ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং ১৬টি খাল উন্নয়নের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, শেরেবাংলা নগর, দারুসসালাম, মিরপুর, পল্লবী, ক্যান্টনমেন্ট, উত্তরা, বিমানবন্দর এলাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, শঙ্কর, ঝিগাতলা, রায়েরবাজার এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করাই ওই প্রকল্পের প্রধান কাজ। এছাড়া প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত বিদ্যমান খালগুলো খনন ও প্রশস্ত করে তীর উন্নয়ন এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে খালের দুই তীরের পরিবেশ উন্নত করাও ছিল এ কাজের অংশ। ৩০০ কিলোমিটার স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনের পরিষ্কার কাজ চলছে। ২৪৯ কিলোমিটার পরিষ্কার হয়েছে। এছাড়া ভারি বৃষ্টিপাত হলে চারটি স্থায়ী ও ১৫টি অস্থায়ী পাম্পের মাধ্যমে পানি অপসারণ করা হবে। এবারের বর্ষায় রাজধানীতে যেন জলাবদ্ধতা না হয়, এ জন্য গত বছর ১৭টি খালের ৩০ কিলোমিটার পুনর্খনন করা হয়। পানি যেন দ্রুত ড্রেন দিয়ে চলে যেতে পারে, এ জন্য ৩০০ কিলোমিটার স্টর্ম ওয়াটার ড্রেন পরিষ্কার করা হয়েছে। রাস্তার পানি যেন দ্রুত ড্রেনে প্রবেশ করতে পারে, এ জন্য ৭০০টি ক্যাচপিট (নালার ওপরের ছিদ্রযুক্ত ঢাকনা) পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।