গণপূর্তের ক্রয়নীতিমালাই দুর্নীতির ফাঁদ

সরকারি কেনাকাটার জন্য গণপূর্ত অধিদফতর যে নীতিমালা তৈরি করে রেখেছে তার মধ্যেই দুর্নীতির ফাঁদ পাতা আছে। অধিদফতরের ‘মূল্য তালিকা (রেট সিডিউল) ২০১৮’-এ ইস্পাতের কাঠামো তৈরির জন্য তৈরি মূল্য তালিকায় ঠিকাদারের জন্য ১০ শতাংশ মুনাফা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আর ঠিকাদারের ওপর ৬ শতাংশ হরে মূসক ধরা হয়। সিডিউল বহির্ভূত কর কাটা হয় ৫ শতাংশ। একাধিক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তির মতে, এত অল্প (৫ শতাংশ) মুনাফায় প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ নেবে না। তাদের অভিযোগ, গণপূর্তের ‘রেট সিডিউল’-এর ফাঁদে ফেলেই নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের সঙ্গে নিয়ে তৈরি করা হয় দুর্নীতির ক্ষেত্র। এতে ঠিকাদাররাও সুযোগ পায় নিম্নমানের সামগ্রী সরবরাহ করে বেশি অর্থ হাতিয়ে নেয়ার।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক প্রকল্পে আসবাবপত্র ও বালিশসহ কতিপয় জিনিসপত্র কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘গণপূর্তের কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনার জন্য নতুন ক্রয়নীতি প্রয়োজন।’ গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের বিভিন্ন সূত্রমতে, অধিদফতরের ক্রয়নীতিমালায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও ব্যাখ্যার অতীত অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই নীতিমালা সংশোধন কিংবা বাতিল করে নতুন নীতিমালা না করা হলে দুর্নীতির লাগাম টানা সম্ভব হবে না। গণপূর্তের কাজের মানও ভালো হবে না।

গণপূর্ত অধিদফতরের সূত্রমতে, চলতি অর্থ বছরের বাজেটে এই কাজের ক্ষেত্রে মূসক ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। অর্থাৎ এখন থেকে ঠিকাদারের বিল থেকে কেটে নেয়া হবে মোট সাড়ে ১২ শতাংশ। এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক বলেন, গণপূর্তের রেট সিডিউল অনুযায়ী, কোন ঠিকাদার তার কাজের জন্য ১০০ টাকা বিল করলে তার মধ্যে ১০ টাকা তার মুনাফা, ৬ টাকা মূসক এবং অবশিষ্ট ৮৪ টাকা মূল কাজে ব্যয় ধরা হবে। কিন্তু বাস্তবে কোন ঠিকাদার যখন ১০০ টাকার একটি বিল উপস্থাপন করেন তখন সেখান থেকে ৬ শতাংশ মূসক এবং ৫ শতাংশ কর কেটে রাখা হয়। ৫ শতাংশ করের কথা সিডিউলে উল্লেখ না থাকলেও এই কর কাটা হয়। ফলে ঠিকাদার যদি মূল কাজে ৮৪ টাকা ব্যয় করেন তাহলে মূসক ও কর মিলিয়ে ১১ শতাংশ কেটে নেয়ার পর তার মুনাফা থাকে ৫ শতাংশ। কিন্তু ৫ শতাংশ মুনাফায় তো কোন ঠিকাদার কাজ করবেন না। তাই ঠিকাদার গণপূর্তের সঙ্গে যোগসাজশে মূল কাজে তিনি ব্যয় করেন অনেক কম। তাই কাজ হয় নিম্নমানের। উদ্বৃত্ত অর্থ ভাগাভাগি হয় কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের মধ্যে।

অপর এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে করপোরেট কর দেয় ৩৫ শতাংশ, সেখানে গণপূর্ত অধিদফতরে ৫ শতাংশ কর কেটে নেয়ার কোন যুক্তি নেই। তার মতে, একটি প্রতিষ্ঠান ১০০ টাকা আয় করলে ৩৫ শতাংশ কর দিতে হবে। সে হিসাবে গণপূর্তের সিডিউলে নির্ধারণ করে দেয়া ১০ শতাংশ মুনাফার জন্য সাড়ে ৩ শতাংশ কর অগ্রিম হিসেবে কেটে নেয়া যৌক্তিক হতে পরে। কোনভাবেই ৫ শতাংশ নয়।

সরকারি কেনাকাটার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো যে দামে কেনাকাটা করা হবে সেটি অবশ্যই প্রতিযোগিতামূলক ও সর্বনিম্ন হতে হবে। গণপূর্ত অধিদফতরের একটি সূত্র জানায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক প্রকল্পের আসবাবপত্র ও ঘরে ব্যবহারের জিনিসপত্র কেনা হয় ‘কোটেশন পদ্ধতি’তে। এই পদ্ধতির সুবিধা হচ্ছে গণপূর্ত অধিফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যোগসাজশের মাধ্যমে কোন একজন ঠিকাদারের কাছ থেকেই ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিক দরপ্রস্তাব (কোটেশন) নিয়ে তার মধ্যে তথাকথিত সর্বনিম্ন দর প্রস্তাবকারীকে কাজ দিতে পারেন। উপরোক্ত ‘রেট সিডিউলের’ মতো এই পদ্ধতিতেও জবাবদিহির কোন ব্যবস্থা নেই। সেই কারণেই রূপপুরের কেনাকাটার সঙ্গে সম্পৃক্ত কোন কোন কর্মকর্তা বলেছেন যে তারা নিয়ম অনুযায়ীই কেনাকাটা করেছেন। নিয়মের কোন ব্যত্যয় তারা ঘটাননি। এই প্রেক্ষাপটেই রূপপুরের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি এবং গণপূর্ত অধিদফতরের সূত্রগুলো নতুন ক্রয়নীতির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।

রবিবার, ২১ জুলাই ২০১৯ , ৬ শ্রাবন ১৪২৫, ১৭ জিলকদ ১৪৪০

গণপূর্তের ক্রয়নীতিমালাই দুর্নীতির ফাঁদ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

সরকারি কেনাকাটার জন্য গণপূর্ত অধিদফতর যে নীতিমালা তৈরি করে রেখেছে তার মধ্যেই দুর্নীতির ফাঁদ পাতা আছে। অধিদফতরের ‘মূল্য তালিকা (রেট সিডিউল) ২০১৮’-এ ইস্পাতের কাঠামো তৈরির জন্য তৈরি মূল্য তালিকায় ঠিকাদারের জন্য ১০ শতাংশ মুনাফা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আর ঠিকাদারের ওপর ৬ শতাংশ হরে মূসক ধরা হয়। সিডিউল বহির্ভূত কর কাটা হয় ৫ শতাংশ। একাধিক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তির মতে, এত অল্প (৫ শতাংশ) মুনাফায় প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ নেবে না। তাদের অভিযোগ, গণপূর্তের ‘রেট সিডিউল’-এর ফাঁদে ফেলেই নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের সঙ্গে নিয়ে তৈরি করা হয় দুর্নীতির ক্ষেত্র। এতে ঠিকাদাররাও সুযোগ পায় নিম্নমানের সামগ্রী সরবরাহ করে বেশি অর্থ হাতিয়ে নেয়ার।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক প্রকল্পে আসবাবপত্র ও বালিশসহ কতিপয় জিনিসপত্র কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘গণপূর্তের কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনার জন্য নতুন ক্রয়নীতি প্রয়োজন।’ গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের বিভিন্ন সূত্রমতে, অধিদফতরের ক্রয়নীতিমালায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও ব্যাখ্যার অতীত অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই নীতিমালা সংশোধন কিংবা বাতিল করে নতুন নীতিমালা না করা হলে দুর্নীতির লাগাম টানা সম্ভব হবে না। গণপূর্তের কাজের মানও ভালো হবে না।

গণপূর্ত অধিদফতরের সূত্রমতে, চলতি অর্থ বছরের বাজেটে এই কাজের ক্ষেত্রে মূসক ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। অর্থাৎ এখন থেকে ঠিকাদারের বিল থেকে কেটে নেয়া হবে মোট সাড়ে ১২ শতাংশ। এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক বলেন, গণপূর্তের রেট সিডিউল অনুযায়ী, কোন ঠিকাদার তার কাজের জন্য ১০০ টাকা বিল করলে তার মধ্যে ১০ টাকা তার মুনাফা, ৬ টাকা মূসক এবং অবশিষ্ট ৮৪ টাকা মূল কাজে ব্যয় ধরা হবে। কিন্তু বাস্তবে কোন ঠিকাদার যখন ১০০ টাকার একটি বিল উপস্থাপন করেন তখন সেখান থেকে ৬ শতাংশ মূসক এবং ৫ শতাংশ কর কেটে রাখা হয়। ৫ শতাংশ করের কথা সিডিউলে উল্লেখ না থাকলেও এই কর কাটা হয়। ফলে ঠিকাদার যদি মূল কাজে ৮৪ টাকা ব্যয় করেন তাহলে মূসক ও কর মিলিয়ে ১১ শতাংশ কেটে নেয়ার পর তার মুনাফা থাকে ৫ শতাংশ। কিন্তু ৫ শতাংশ মুনাফায় তো কোন ঠিকাদার কাজ করবেন না। তাই ঠিকাদার গণপূর্তের সঙ্গে যোগসাজশে মূল কাজে তিনি ব্যয় করেন অনেক কম। তাই কাজ হয় নিম্নমানের। উদ্বৃত্ত অর্থ ভাগাভাগি হয় কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের মধ্যে।

অপর এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে করপোরেট কর দেয় ৩৫ শতাংশ, সেখানে গণপূর্ত অধিদফতরে ৫ শতাংশ কর কেটে নেয়ার কোন যুক্তি নেই। তার মতে, একটি প্রতিষ্ঠান ১০০ টাকা আয় করলে ৩৫ শতাংশ কর দিতে হবে। সে হিসাবে গণপূর্তের সিডিউলে নির্ধারণ করে দেয়া ১০ শতাংশ মুনাফার জন্য সাড়ে ৩ শতাংশ কর অগ্রিম হিসেবে কেটে নেয়া যৌক্তিক হতে পরে। কোনভাবেই ৫ শতাংশ নয়।

সরকারি কেনাকাটার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো যে দামে কেনাকাটা করা হবে সেটি অবশ্যই প্রতিযোগিতামূলক ও সর্বনিম্ন হতে হবে। গণপূর্ত অধিদফতরের একটি সূত্র জানায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক প্রকল্পের আসবাবপত্র ও ঘরে ব্যবহারের জিনিসপত্র কেনা হয় ‘কোটেশন পদ্ধতি’তে। এই পদ্ধতির সুবিধা হচ্ছে গণপূর্ত অধিফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যোগসাজশের মাধ্যমে কোন একজন ঠিকাদারের কাছ থেকেই ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিক দরপ্রস্তাব (কোটেশন) নিয়ে তার মধ্যে তথাকথিত সর্বনিম্ন দর প্রস্তাবকারীকে কাজ দিতে পারেন। উপরোক্ত ‘রেট সিডিউলের’ মতো এই পদ্ধতিতেও জবাবদিহির কোন ব্যবস্থা নেই। সেই কারণেই রূপপুরের কেনাকাটার সঙ্গে সম্পৃক্ত কোন কোন কর্মকর্তা বলেছেন যে তারা নিয়ম অনুযায়ীই কেনাকাটা করেছেন। নিয়মের কোন ব্যত্যয় তারা ঘটাননি। এই প্রেক্ষাপটেই রূপপুরের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি এবং গণপূর্ত অধিদফতরের সূত্রগুলো নতুন ক্রয়নীতির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।