ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি

দুই সপ্তাহে ৬ জন নিহত : আহত ২২

  • গুজবের জেরে চলছে এসব অঘট
  • ‘গণপিটুনি ফৌজদারি অপরাধ’
  • বাড়ছে উদ্বেগ ও পুলিশের প্রতি আস্থাহীনতা

‘পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে শিশুদের মাথা লাগবে’ গুজবের পর থেকে দুই সপ্তাহ ধরে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনায় সারাদেশে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অপরিচিত কাউকে দেখলেই বিচার-বিশ্লেষণ না করেই ‘ছেলেধরা’ অভিযোগ তুলে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। গত শনিবার ঢাকাসহ কয়েকটি এলাকায় একদিনেই নারীসহ ৪ জনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে সারাদেশে ২১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ জন ও আহত হয়েছেন ২২ জন। এমন পরিস্থিতিতে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে গণপিটুনিকে ‘ফৌজদারি অপরাধ’ উল্লেখ করে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি বার্তা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। এই বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে কাজ করা হচ্ছে। তবে গতকাল পর্যন্ত জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি পুলিশ। এ পর্যন্ত গণপিটুনিতে হত্যা ও আহত করার ঘটনায় মামলাগুলো তদন্ত করে দায়ীদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ।

অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধ করছে কী, করছে নাÑ তা বলার সুযোগ না দিয়ে এ নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এতে নির্মম মৃত্যুর ঘটনা যেমন বাড়ছে, তেমনি উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। মানুষের ধারণা- ‘অপরাধীদের’ ধরে যদি পুলিশের কাছে দেয়া হয়, তাহলে অপরাধীর শাস্তি হবে না। এই ধরনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠায় মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে একের পর এক বর্বরোচিত হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে। আর পুলিশের প্রতি আস্থাহীনতার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় এমন ঘটনা ঘটছে।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে একটি গুজব ছড়ানো কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ। তিনি বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত যত নিহতের ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ প্রতিটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বলা হচ্ছে। কারণ কোনভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না।

বিশিষ্ট আইনজীবী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আহমেদ গাজী বলেন, যত জঘন্য অপরাধ করে থাকুক না কেন, কারও নিজ হাতে আইন তুলে নেয়া উচিত নয়। এ ধরনের ঘটনা ন্যক্কারজনক অপরাধ। এ অপরাধ থেকে সবাইকে সাবধান ও সতর্ক থাকা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

গতকাল সকালে ছেলেধরা সন্দেহে নওগাঁর মান্দা উপজেলায় ৬ জেলেকে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। একই দিন কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলায় একদিনে ১৩ জনকে গণপিটুনিতে আহত করা হয়েছে। আগের দিন শনিবার রাজশাহীর তানোরে ছেলেধরা সন্দেহে পৃথক স্থানে দুই যুবককে, রাতে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় এক যুবককে, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় রাসেল মিয়াকে (৪৫) গণপিটুনির পর পুলিশে দিয়েছে এলাকাবাসী। ওইদিন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে দু’জনকে গণপিটুনি দেয়া হয়। এতে এক যুবক নিহত ও আরেক নারী আহত হন। রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করাতে গিয়ে অভিভাবকদের গণপিটুনির শিকার হন রেনু। তার চার বছর বয়সী মেয়েকে স্কুলে দিতে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাড়ি ফিরেছেন লাশ হয়ে। এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন নিহতের এক স্বজন। সাভারের ফল ব্যবসায়ী রাসেল মিয়া, পাবনায় এক যুবক, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে পঞ্চাশ-ঊর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। এদিন সাভারের তেঁতুলঝোড়া এলাকায় এক শিশুকে বিস্কুট খাওয়ানোর সময় এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় অপরিচিত হওয়ায় তিন ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে আহত ও ১১ জুলাই চাঁদপুরে মনু মিয়াকে (৪০) ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয়া হয়। পরে তদন্তে পুলিশ জানতে পারে মনু মিয়া মানসিক ভারসাম্যহীন। চালচলনে সন্দেহ হওয়ায় তাকে গণপিটুনি দেয়া হয়। এর আগে ৯ জুলাই চা দোকানের কর্মচারী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী যুবক মো. রবিউল্লাহকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক (সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক) তৌহিদুল হক বলেন, ‘যে কোনো উন্নয়ন কেন্দ্র করে মানুষের রক্ত লাগে, শিশুদের মাথা লাগে’Ñ এ ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মনে যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। এগুলো যখন গুজব আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তখন যে কাউকে দেখলেই সন্দেহ করে সাধারণ মানুষ তাদের সঙ্গে হিংস্র আচরণ করে। মানুষের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বিশ্বাস না থাকাও গণপিটুনির মাধ্যমে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার একটি অন্যতম কারণ। এ পরিস্থিতির উত্তরণ করতে হলে পুলিশ সদস্যদের সব সময় সতর্ক আচরণ করতে হবে এবং এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, এ জন্য তৎপর থাকতে হবে। এছাড়া এলাকার নির্বাচিত ও অনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে একটি কমিটি হতে পারে। এলাকায় সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে তাকে ধরে কমিটির কাছে এনে যাচাই-বাছাই করা যেতে পারে। স্কুল ও মসজিদভিত্তিক শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে। শিশুদের জানাতে হবেÑ যাতে তারা অভিভাবককে না বলে কারও সঙ্গে কোথাও না যায়। টিভিতে, বিজ্ঞাপন, লিফলেট বিতরণ ও সমাবেশের মতো সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

প্রতিনিধি, নওগাঁ জানান, নওগাঁর মান্দায় পুকুর থেকে মাছ চুরি করায় ৬ জেলেকে ছেলেধরা বলে অপপ্রচার চালিয়ে মারপিট ও আত্রাইয়ে একজনকে গণপিটুনি দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনাটি জানতে পেরে ওই ৬ জেলেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে ৯টার দিকে উপজেলার বুড়িদহ গ্রামে রঞ্জিত কুমারের পুকুরে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ওই ছয় জেলের বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলায়। অপর ঘটনাটি আত্রাইয়ে উপজেলার সোনাইডাঙ্গা গ্রামে রোববার বিকেলে ঘটনাটি ঘটেছে। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, বুড়িদহ গ্রামে রঞ্জিত কুমারের বাড়ির মহিলার সঙ্গে ওই জেলেদের চুক্তি হয় ১০ কেজি ছোট মাছ ধরে তারা ৭ কেজি মাছ নেবেন আর জেলেদের ৩ কেজি মাছ দেবেন। এই চুক্তিতে মাছ গতকাল সকালে ৯টার দিকে জেলেরা মাছ ধরতে পুকুরে নেমে ছোট মাছের সঙ্গে গোপনে বড় কিছু মাছ ধরে নেন জেলেরা। এরপর মহিলার মাছ চুরির বিষয়টি জানতে পেরে মাছ চোর, মাছ চোর বলে চিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন ছুটে পুকুরে চলে আসে। এ সময় জেলেরা পালাতে গেলে মাছ চোর বাক্যটি ছেলেধরার স্লোগান অপপ্রচার শুরু হয়। ওই সময় স্থানীয়রা জেলেদের কিছুটা মারপিট করে থানায় সংবাদ দেয় হয়।

ওসি মোজাফ্ফর হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, সংবাদ পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে ওই জেলেদের উদ্ধার করে থানায় নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, মাছ চুরির সময় মাছ চোরের চিৎকারটি ছেলেধরার স্লোগান অপপ্রচার হওয়ায় এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। জেলেরা সবাই সুস্থ রয়েছেন। তাদের পরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বিকেলে আত্রাই-পতিসর সড়কের সোনাইডাঙ্গা নামক স্থানে পূর্বদিক থেকে এক ব্যক্তি বস্তা কাঁধে করে আসতে থাকেন। এ সময় কয়েকজন তার বস্তা তল্লাশি করে কিছু চাল, কিছু টাকা ও খেলনা প্লাস্টিকের একটি পিস্তল পান। তার বাড়ি বরিশাল জেলায় বলায় স্থানীয়দের সন্দেহ দেখা দেয়। এরপর তাকে গণপিটুনি দিতে শুরু করে। সংবাদ পেয়ে আত্রাই থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে।

আত্রাই থানার ওসি মোসলেম উদ্দিন বলেন, প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে লোকটি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী।

প্রতিনিধি, বগুড়া জানান, বগুড়ার আদমদীঘির সান্তাহারে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয়রা গণপিটুনি দিতে শুরু করলে পুলিশের উপস্থিতিতে প্রাণে বেঁচে যান। গতকাল সকাল ১০টায় পৌর শহরের লকু কলোনি এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। মানসিক ভারসাম্যহীন ওই ব্যক্তি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সাজাপুর গ্রামের আবদুল খালেকের ছেলে আফজাল হোসেন (৪২)। সাজাপুর গ্রামের মেম্বার শফিক উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জানান, আফজালের মাথায় গন্ডগোল রয়েছে। তিনি ১০ দিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।

সান্তাহার পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আনিছুর রহমান জানান, ছেলেধরা সন্দেহে এক ব্যক্তিকে স্থানীয়রা গণপিটুনি দিচ্ছে খবর পেয়ে দ্রুত সেখানে গিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে আসি। এরপর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। তিনি জানান, সন্দেহজনক কাউকে দেখলে গণপিটুনি না দিয়ে তাকে পুলিশে দেয়ার অনুরোধ রইলো।

প্রতিনিধি, কুমিল্লা জানান, ছেলেধরা সন্দেহে কুমিল্লায় এক নারীসহ ৪ জনকে গণপিটুনি দিয়ে আহত করা হয়েছেন। রোববার দুপুরে জেলার আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলী ইউনিয়নের দুতিয়াদীঘিরপাড় এলাকা ও মাঝিগাছা এলাকায় পৃথক এ ঘটনা ঘটে। পরে স্থানীয়রা তাদের পুলিশে সোপর্দ করে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দুপুর ১২টার দিকে এক নারীসহ ৩ জন আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে যায়। এ সময় তারা ওই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী চৈতীকে ডাক দেন। এতে ওই শিশু ভয় পেয়ে ছেলেধরা সন্দেহে চিৎকার শুরু করলে এলাকাবাসী তাদের আটক করে গণপিটুনি দেয়। এতে তারা গুরুতর আহত হন। খবর পেয়ে কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। তারা হচ্ছেন জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বেজুরা গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে আনোয়ার হোসেন (২৮), আবদুস সালামের স্ত্রী রত্না বেগম (৪৫) ও রত্নার স্বামী জেলার বরুড়া উপজেলার হরিপুর গ্রামের ফজর আলীর ছেলে আবদুস সালাম (৭৫)। অপরদিকে একই উপজেলার মাঝিগাছা এলাকা থেকে ফেরিওয়ালা আরিফ হোসেনকে (৩০) ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে এলাকাবাসী। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার কোনাকাটা নয়নপুর গ্রামের আবদুন নূর স্বর্ণকারের ছেলে।

এ বিষয়ে কুমিল্লার পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, আটককৃতদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে একটি মহল তৎপরতা চালাচ্ছে। তিনি গুজবে কান না দেয়ার জন্য সাধারণ জনগণকে আহ্বান জানান। এছাড়া কারও গতিবিধি সন্দেহজনক হলে তাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করতে তিনি জনগণের সহযোগিতা কামনা করেন।

জেলা বার্তা পরিবেশক, টাঙ্গাইল জানান, টাঙ্গাইলে ছেলে ধরা সন্দেহে এক যুবককে মারধর করেছে জনতা। খবর পেয়ে পুলিশ ওই যুবককে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেলারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রোববার সকালে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের কান্দিলা বাজারে এ ঘটনা ঘটে। তবে ওই যুবকের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মজনু মিয়া বলেন, জানতে পারি কান্দিলা বাজারে ছেলেধরা সন্দেহে একজনকে মারধর করা হয়েছে। বাজারে গিয়ে দেখি তাকে ঘিরে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। আসলে তিনি ছেলেধরা কি না, তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেননি।

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল সদর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোশারফ হোসেন জানান, ছেলে ধরা সন্দেহে কান্দিলা বাজারে একজনকে মারধর করার খবর পেয়ে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। আসলে সে ছেলে ধরা কি না, এখনও তা বলা যাবে না। তদন্ত করে তা বুঝা যাবে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল সদর মডেল থানার (ওসি) মীর মোশারফ হোসেন বলেন, বর্তমানে ওই ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিসাধীনে রয়েছে। তদন্ত করে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যাবে। টাঙ্গাইল শহরে মাইকিং করা হবে। কাউকে সন্দেহ হলে আইন নিজের হাতে তুলে মারধর না করে পুলিশকে খবর দেয়ার জন্য বলা হচ্ছে।

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক,পাবনা জানান, পাবনার চাটমোহরে ছেলে ধরা সন্দেহে রাসেল রানা (৩২) নামে এক যুবককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার দুপুরে বনগ্রাম দীঘিপাড়া গ্রামের নায়েব আলীর ছেলে আবদুল্লাহ (৪) বাড়ির সামনে রাস্তায় পাশে বসে খেলছিল। এ সময় রাসেল রানা নামের ওই যুবক শিশুটিকে ডেকে চুইংগাম দেয়ার চেষ্টা করে। তবে চুইংগাম না নিয়ে আবদুল্লাহ দৌড়ে পালাতে গেলে, তার হাত ধরে হাতে থাকা ব্যাগ থেকে একটি বাটালি বের করে শিশুটির পিঠে আঘাত করে রাসেল। পরে শিশুটির চিৎকারে স্থানীয়রা এসে রাসেলকে আটক করে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে খবর দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে অভিযুক্ত রাসেলকে আটক করে থানায় নিয়ে যান।

সাভারের ঘটনায় ৮শ জনের বিরুদ্ধে মামলা

প্রতিনিধি সাভার জানান, সাভারের তেঁতুলঝোড়া এলাকায় ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাত (৩৫) এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এর আগে শনিবার সকালে গণপিটুনিতে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসলে রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তবে ওই নারীর তৎক্ষণিক নাম-পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ৮শ জনের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল সকালে সাভার মডেল থানার ট্যানারি ফাঁড়ির ইনচার্জ এমারত হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। পুলিশ জানায়, ওই নারী সাভারের হেমায়েতপুর এলাকার তেঁতুলঝড়া ইউনিয়নে বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য রুম খোজাখুঁজি করছিলেন । এ সময় প্রথমে জজ মিয়ার বাড়িতে বাসা ভাড়ার জন্য আসেন। সেখানে পছন্দমতো বাসা ভাড়া না পেয়ে পাশের ফারুকের মালিকানাধীন বাসা ভাড়ার জন্য যান। পরে ফারুকের বাসা থেকে বের হলে স্থানীয়রা ছেলেধরা সন্দেহে ওই নারীকে ধাওয়া করে। একপর্যায়ে ওই নারীকে স্থানীয়রা আটক করে বেধড়ক মারধর করে। ওই নারী নিজেকে বাঁচানোর জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে হেমায়েতপুর-সিংগাইর রোডে এলে ট্যানারি পুলিশ ফাঁড়ি সদস্যরা তাকে উদ্ধার করেন। পরে তাকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীনে রাত ৯টার দিকে তার মৃত্যু হয়। তবে তিনি বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য এসেছিলেন বলে অস্বীকার করেন বাড়ির মালিক জজ মিয়া ও ফারুক।

এ বিষয়ে সাভার মডেল থানার ট্যানারি ফাঁড়ির ইনচার্জ এমারৎ হোসেন জানান, বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য ওই নারী এসেছিলেন। তবে কে বা কারা মিথ্যা গুজবে ওই নারীকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তা তদন্ত করা হচ্ছে। গণপিটুনিতে নারী মৃত্যুও ঘটনায় অজ্ঞাত ৮০০ জনকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।

image

বগুড়া : গতকাল সান্তাহারে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি আফজাল হোসেনকে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয়রা গণপিটুনি দিতে শুরু করলে পুলিশ খবর পেয়ে উদ্ধার করে ফাঁড়িতে নিয়ে আসে -সংবাদ

আরও খবর
গণপিটুনিতে নিহত গৃহবধূ তাসলিমার পরিবারের মামলা
শিক্ষাভবনে ফের টেন্ডারবাজদের দৌরাত্ম্য
প্রিয়া সাহার ব্যাখ্যা না শুনে তার বিরুদ্ধে মামলা না করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
বড়পুকুরিয়ার সাত সাবেক এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র
মিন্নির জামিন নামঞ্জুর
ডিআইজি মিজানকে গ্রেফতার দেখানোর নির্দেশ
জড়িতদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে
‘ঘোষণা দিয়ে ঋণ আমানতে সুদহার নয়-ছয় সম্ভব নয়’
পানি বাড়ছে মধ্যাঞ্চলে
অটোরিকশা থেকে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে বাঁচাল স্কুলছাত্রী
বন্যার কারণে সদস্য সংগ্রহ অভিযান পেছাল আ’লীগ

সোমবার, ২২ জুলাই ২০১৯ , ৭ শ্রাবন ১৪২৫, ১৮ জিলকদ ১৪৪০

ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি

দুই সপ্তাহে ৬ জন নিহত : আহত ২২

বাকী বিল্লাহ ও সাইফ বাবলু

image

বগুড়া : গতকাল সান্তাহারে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি আফজাল হোসেনকে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয়রা গণপিটুনি দিতে শুরু করলে পুলিশ খবর পেয়ে উদ্ধার করে ফাঁড়িতে নিয়ে আসে -সংবাদ

  • গুজবের জেরে চলছে এসব অঘট
  • ‘গণপিটুনি ফৌজদারি অপরাধ’
  • বাড়ছে উদ্বেগ ও পুলিশের প্রতি আস্থাহীনতা

‘পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে শিশুদের মাথা লাগবে’ গুজবের পর থেকে দুই সপ্তাহ ধরে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনায় সারাদেশে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অপরিচিত কাউকে দেখলেই বিচার-বিশ্লেষণ না করেই ‘ছেলেধরা’ অভিযোগ তুলে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। গত শনিবার ঢাকাসহ কয়েকটি এলাকায় একদিনেই নারীসহ ৪ জনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে সারাদেশে ২১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ জন ও আহত হয়েছেন ২২ জন। এমন পরিস্থিতিতে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে গণপিটুনিকে ‘ফৌজদারি অপরাধ’ উল্লেখ করে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি বার্তা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। এই বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে কাজ করা হচ্ছে। তবে গতকাল পর্যন্ত জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি পুলিশ। এ পর্যন্ত গণপিটুনিতে হত্যা ও আহত করার ঘটনায় মামলাগুলো তদন্ত করে দায়ীদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ।

অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধ করছে কী, করছে নাÑ তা বলার সুযোগ না দিয়ে এ নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এতে নির্মম মৃত্যুর ঘটনা যেমন বাড়ছে, তেমনি উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। মানুষের ধারণা- ‘অপরাধীদের’ ধরে যদি পুলিশের কাছে দেয়া হয়, তাহলে অপরাধীর শাস্তি হবে না। এই ধরনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠায় মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে একের পর এক বর্বরোচিত হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে। আর পুলিশের প্রতি আস্থাহীনতার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় এমন ঘটনা ঘটছে।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে একটি গুজব ছড়ানো কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ। তিনি বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত যত নিহতের ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ প্রতিটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বলা হচ্ছে। কারণ কোনভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না।

বিশিষ্ট আইনজীবী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আহমেদ গাজী বলেন, যত জঘন্য অপরাধ করে থাকুক না কেন, কারও নিজ হাতে আইন তুলে নেয়া উচিত নয়। এ ধরনের ঘটনা ন্যক্কারজনক অপরাধ। এ অপরাধ থেকে সবাইকে সাবধান ও সতর্ক থাকা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

গতকাল সকালে ছেলেধরা সন্দেহে নওগাঁর মান্দা উপজেলায় ৬ জেলেকে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। একই দিন কুমিল্লাসহ কয়েকটি জেলায় একদিনে ১৩ জনকে গণপিটুনিতে আহত করা হয়েছে। আগের দিন শনিবার রাজশাহীর তানোরে ছেলেধরা সন্দেহে পৃথক স্থানে দুই যুবককে, রাতে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় এক যুবককে, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় রাসেল মিয়াকে (৪৫) গণপিটুনির পর পুলিশে দিয়েছে এলাকাবাসী। ওইদিন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে দু’জনকে গণপিটুনি দেয়া হয়। এতে এক যুবক নিহত ও আরেক নারী আহত হন। রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করাতে গিয়ে অভিভাবকদের গণপিটুনির শিকার হন রেনু। তার চার বছর বয়সী মেয়েকে স্কুলে দিতে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাড়ি ফিরেছেন লাশ হয়ে। এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন নিহতের এক স্বজন। সাভারের ফল ব্যবসায়ী রাসেল মিয়া, পাবনায় এক যুবক, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে পঞ্চাশ-ঊর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। এদিন সাভারের তেঁতুলঝোড়া এলাকায় এক শিশুকে বিস্কুট খাওয়ানোর সময় এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় অপরিচিত হওয়ায় তিন ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে আহত ও ১১ জুলাই চাঁদপুরে মনু মিয়াকে (৪০) ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয়া হয়। পরে তদন্তে পুলিশ জানতে পারে মনু মিয়া মানসিক ভারসাম্যহীন। চালচলনে সন্দেহ হওয়ায় তাকে গণপিটুনি দেয়া হয়। এর আগে ৯ জুলাই চা দোকানের কর্মচারী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী যুবক মো. রবিউল্লাহকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক (সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক) তৌহিদুল হক বলেন, ‘যে কোনো উন্নয়ন কেন্দ্র করে মানুষের রক্ত লাগে, শিশুদের মাথা লাগে’Ñ এ ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মনে যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। এগুলো যখন গুজব আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তখন যে কাউকে দেখলেই সন্দেহ করে সাধারণ মানুষ তাদের সঙ্গে হিংস্র আচরণ করে। মানুষের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বিশ্বাস না থাকাও গণপিটুনির মাধ্যমে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার একটি অন্যতম কারণ। এ পরিস্থিতির উত্তরণ করতে হলে পুলিশ সদস্যদের সব সময় সতর্ক আচরণ করতে হবে এবং এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, এ জন্য তৎপর থাকতে হবে। এছাড়া এলাকার নির্বাচিত ও অনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে একটি কমিটি হতে পারে। এলাকায় সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে তাকে ধরে কমিটির কাছে এনে যাচাই-বাছাই করা যেতে পারে। স্কুল ও মসজিদভিত্তিক শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে। শিশুদের জানাতে হবেÑ যাতে তারা অভিভাবককে না বলে কারও সঙ্গে কোথাও না যায়। টিভিতে, বিজ্ঞাপন, লিফলেট বিতরণ ও সমাবেশের মতো সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

প্রতিনিধি, নওগাঁ জানান, নওগাঁর মান্দায় পুকুর থেকে মাছ চুরি করায় ৬ জেলেকে ছেলেধরা বলে অপপ্রচার চালিয়ে মারপিট ও আত্রাইয়ে একজনকে গণপিটুনি দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনাটি জানতে পেরে ওই ৬ জেলেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে ৯টার দিকে উপজেলার বুড়িদহ গ্রামে রঞ্জিত কুমারের পুকুরে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ওই ছয় জেলের বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলায়। অপর ঘটনাটি আত্রাইয়ে উপজেলার সোনাইডাঙ্গা গ্রামে রোববার বিকেলে ঘটনাটি ঘটেছে। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, বুড়িদহ গ্রামে রঞ্জিত কুমারের বাড়ির মহিলার সঙ্গে ওই জেলেদের চুক্তি হয় ১০ কেজি ছোট মাছ ধরে তারা ৭ কেজি মাছ নেবেন আর জেলেদের ৩ কেজি মাছ দেবেন। এই চুক্তিতে মাছ গতকাল সকালে ৯টার দিকে জেলেরা মাছ ধরতে পুকুরে নেমে ছোট মাছের সঙ্গে গোপনে বড় কিছু মাছ ধরে নেন জেলেরা। এরপর মহিলার মাছ চুরির বিষয়টি জানতে পেরে মাছ চোর, মাছ চোর বলে চিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন ছুটে পুকুরে চলে আসে। এ সময় জেলেরা পালাতে গেলে মাছ চোর বাক্যটি ছেলেধরার স্লোগান অপপ্রচার শুরু হয়। ওই সময় স্থানীয়রা জেলেদের কিছুটা মারপিট করে থানায় সংবাদ দেয় হয়।

ওসি মোজাফ্ফর হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, সংবাদ পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে ওই জেলেদের উদ্ধার করে থানায় নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, মাছ চুরির সময় মাছ চোরের চিৎকারটি ছেলেধরার স্লোগান অপপ্রচার হওয়ায় এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। জেলেরা সবাই সুস্থ রয়েছেন। তাদের পরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বিকেলে আত্রাই-পতিসর সড়কের সোনাইডাঙ্গা নামক স্থানে পূর্বদিক থেকে এক ব্যক্তি বস্তা কাঁধে করে আসতে থাকেন। এ সময় কয়েকজন তার বস্তা তল্লাশি করে কিছু চাল, কিছু টাকা ও খেলনা প্লাস্টিকের একটি পিস্তল পান। তার বাড়ি বরিশাল জেলায় বলায় স্থানীয়দের সন্দেহ দেখা দেয়। এরপর তাকে গণপিটুনি দিতে শুরু করে। সংবাদ পেয়ে আত্রাই থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে।

আত্রাই থানার ওসি মোসলেম উদ্দিন বলেন, প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে লোকটি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী।

প্রতিনিধি, বগুড়া জানান, বগুড়ার আদমদীঘির সান্তাহারে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয়রা গণপিটুনি দিতে শুরু করলে পুলিশের উপস্থিতিতে প্রাণে বেঁচে যান। গতকাল সকাল ১০টায় পৌর শহরের লকু কলোনি এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। মানসিক ভারসাম্যহীন ওই ব্যক্তি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সাজাপুর গ্রামের আবদুল খালেকের ছেলে আফজাল হোসেন (৪২)। সাজাপুর গ্রামের মেম্বার শফিক উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জানান, আফজালের মাথায় গন্ডগোল রয়েছে। তিনি ১০ দিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।

সান্তাহার পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আনিছুর রহমান জানান, ছেলেধরা সন্দেহে এক ব্যক্তিকে স্থানীয়রা গণপিটুনি দিচ্ছে খবর পেয়ে দ্রুত সেখানে গিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে আসি। এরপর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। তিনি জানান, সন্দেহজনক কাউকে দেখলে গণপিটুনি না দিয়ে তাকে পুলিশে দেয়ার অনুরোধ রইলো।

প্রতিনিধি, কুমিল্লা জানান, ছেলেধরা সন্দেহে কুমিল্লায় এক নারীসহ ৪ জনকে গণপিটুনি দিয়ে আহত করা হয়েছেন। রোববার দুপুরে জেলার আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলী ইউনিয়নের দুতিয়াদীঘিরপাড় এলাকা ও মাঝিগাছা এলাকায় পৃথক এ ঘটনা ঘটে। পরে স্থানীয়রা তাদের পুলিশে সোপর্দ করে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দুপুর ১২টার দিকে এক নারীসহ ৩ জন আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে যায়। এ সময় তারা ওই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী চৈতীকে ডাক দেন। এতে ওই শিশু ভয় পেয়ে ছেলেধরা সন্দেহে চিৎকার শুরু করলে এলাকাবাসী তাদের আটক করে গণপিটুনি দেয়। এতে তারা গুরুতর আহত হন। খবর পেয়ে কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। তারা হচ্ছেন জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বেজুরা গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে আনোয়ার হোসেন (২৮), আবদুস সালামের স্ত্রী রত্না বেগম (৪৫) ও রত্নার স্বামী জেলার বরুড়া উপজেলার হরিপুর গ্রামের ফজর আলীর ছেলে আবদুস সালাম (৭৫)। অপরদিকে একই উপজেলার মাঝিগাছা এলাকা থেকে ফেরিওয়ালা আরিফ হোসেনকে (৩০) ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে এলাকাবাসী। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার কোনাকাটা নয়নপুর গ্রামের আবদুন নূর স্বর্ণকারের ছেলে।

এ বিষয়ে কুমিল্লার পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, আটককৃতদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে একটি মহল তৎপরতা চালাচ্ছে। তিনি গুজবে কান না দেয়ার জন্য সাধারণ জনগণকে আহ্বান জানান। এছাড়া কারও গতিবিধি সন্দেহজনক হলে তাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করতে তিনি জনগণের সহযোগিতা কামনা করেন।

জেলা বার্তা পরিবেশক, টাঙ্গাইল জানান, টাঙ্গাইলে ছেলে ধরা সন্দেহে এক যুবককে মারধর করেছে জনতা। খবর পেয়ে পুলিশ ওই যুবককে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেলারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রোববার সকালে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের কান্দিলা বাজারে এ ঘটনা ঘটে। তবে ওই যুবকের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মজনু মিয়া বলেন, জানতে পারি কান্দিলা বাজারে ছেলেধরা সন্দেহে একজনকে মারধর করা হয়েছে। বাজারে গিয়ে দেখি তাকে ঘিরে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। আসলে তিনি ছেলেধরা কি না, তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেননি।

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল সদর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোশারফ হোসেন জানান, ছেলে ধরা সন্দেহে কান্দিলা বাজারে একজনকে মারধর করার খবর পেয়ে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। আসলে সে ছেলে ধরা কি না, এখনও তা বলা যাবে না। তদন্ত করে তা বুঝা যাবে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল সদর মডেল থানার (ওসি) মীর মোশারফ হোসেন বলেন, বর্তমানে ওই ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিসাধীনে রয়েছে। তদন্ত করে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যাবে। টাঙ্গাইল শহরে মাইকিং করা হবে। কাউকে সন্দেহ হলে আইন নিজের হাতে তুলে মারধর না করে পুলিশকে খবর দেয়ার জন্য বলা হচ্ছে।

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক,পাবনা জানান, পাবনার চাটমোহরে ছেলে ধরা সন্দেহে রাসেল রানা (৩২) নামে এক যুবককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার দুপুরে বনগ্রাম দীঘিপাড়া গ্রামের নায়েব আলীর ছেলে আবদুল্লাহ (৪) বাড়ির সামনে রাস্তায় পাশে বসে খেলছিল। এ সময় রাসেল রানা নামের ওই যুবক শিশুটিকে ডেকে চুইংগাম দেয়ার চেষ্টা করে। তবে চুইংগাম না নিয়ে আবদুল্লাহ দৌড়ে পালাতে গেলে, তার হাত ধরে হাতে থাকা ব্যাগ থেকে একটি বাটালি বের করে শিশুটির পিঠে আঘাত করে রাসেল। পরে শিশুটির চিৎকারে স্থানীয়রা এসে রাসেলকে আটক করে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে খবর দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে অভিযুক্ত রাসেলকে আটক করে থানায় নিয়ে যান।

সাভারের ঘটনায় ৮শ জনের বিরুদ্ধে মামলা

প্রতিনিধি সাভার জানান, সাভারের তেঁতুলঝোড়া এলাকায় ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাত (৩৫) এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এর আগে শনিবার সকালে গণপিটুনিতে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসলে রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তবে ওই নারীর তৎক্ষণিক নাম-পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ৮শ জনের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল সকালে সাভার মডেল থানার ট্যানারি ফাঁড়ির ইনচার্জ এমারত হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। পুলিশ জানায়, ওই নারী সাভারের হেমায়েতপুর এলাকার তেঁতুলঝড়া ইউনিয়নে বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য রুম খোজাখুঁজি করছিলেন । এ সময় প্রথমে জজ মিয়ার বাড়িতে বাসা ভাড়ার জন্য আসেন। সেখানে পছন্দমতো বাসা ভাড়া না পেয়ে পাশের ফারুকের মালিকানাধীন বাসা ভাড়ার জন্য যান। পরে ফারুকের বাসা থেকে বের হলে স্থানীয়রা ছেলেধরা সন্দেহে ওই নারীকে ধাওয়া করে। একপর্যায়ে ওই নারীকে স্থানীয়রা আটক করে বেধড়ক মারধর করে। ওই নারী নিজেকে বাঁচানোর জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে হেমায়েতপুর-সিংগাইর রোডে এলে ট্যানারি পুলিশ ফাঁড়ি সদস্যরা তাকে উদ্ধার করেন। পরে তাকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীনে রাত ৯টার দিকে তার মৃত্যু হয়। তবে তিনি বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য এসেছিলেন বলে অস্বীকার করেন বাড়ির মালিক জজ মিয়া ও ফারুক।

এ বিষয়ে সাভার মডেল থানার ট্যানারি ফাঁড়ির ইনচার্জ এমারৎ হোসেন জানান, বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য ওই নারী এসেছিলেন। তবে কে বা কারা মিথ্যা গুজবে ওই নারীকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তা তদন্ত করা হচ্ছে। গণপিটুনিতে নারী মৃত্যুও ঘটনায় অজ্ঞাত ৮০০ জনকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।