স্মরণ : গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ কাঙাল হরিনাথ

ইসমাইল মাহমুদ

বাংলা সিনেমার অধিপতি সত্যজিৎ রায়ের পথের পাচালীসহ আরও কয়েকটি ছবির জনপ্রিয় গান হলো-

‘যেখানে দেখিবে ছাই/ উড়াইয়া দেখ তাই/ পাইলেও পাইতে পারো/ লুকানো রতন।’

অথবা

‘হরি দিনতো গেল,/ সন্ধ্যা হলো/ পার কর আমারে’

এসব কালজয়ী গান কার রচনা তা অনেকের কাছে অজানা। এসব গানের রচয়িতা কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। তিনি ছিলেন একাধারে বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের জনক, গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ, ঊনবিংশ শতাব্দীর কালজয়ী একজন সাধক, সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, সমাজসেবক ও নারী জাগরণের অন্যতম দিকপাল। কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্ত্তা’ বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র। প্রকাশনার প্রথমদিকে এটি হাতে লিখে প্রকাশ করা হতো। সাংবাদিকতায় কাঙাল হরিনাথের আদর্শ রূপকথার কাহিনীকেও হার মানায়। তিনি সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নির্ভীক সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তৎকালীন সময়ে ইংরেজ নীলকর, জমিদার, পুলিশ ও শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন হাতে লেখা পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র মাধ্যমে। অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আজীবন আপসহীন।

গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ১২৪০ বঙ্গাব্দের ৫ শ্রাবণ (১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুলাই) কুষ্টিয়ার কুমারখালী শহরের (তদানীন্তন পাবনা জেলার নদীয়া) নিভৃত গ্রাম কুণ্ডুপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হলধর মজুমদার এবং মাতা কমলিনী দেবী। হরিনাথ মজুমদার ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। শৈশবেই তিনি তার পিতা-মাতাকে হারান। এরপর চরম দরিদ্রতাকে সাথী করে বেড়ে ওঠেন তিনি।

১৮৫৭ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর একটি নিভৃত গ্রাম থেকে তিনি হাতে লিখে প্রথম প্রকাশ করেন মাসিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামের পত্রিকাটি। পত্রিকাটি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি হাজারো বাধা-বিপত্তিতে পড়েন। কিন্তু দৃঢ়চেতা কাঙাল হরিনাথ সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে পত্রিকাটি প্রায় এক যুগ প্রকাশ করেছিলেন হাতে লিখেই। একযুগ পর পত্রিকাটি মাসিক থেকে পত্রিকাটি পাক্ষিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ১৮৬৩ সালে কলকাতার ‘গিরিশচন্দ্র বিদ্যারতœ প্রেস’ থেকে পত্রিকাটি সাপ্তাহিক আকারে থেকে নিয়মিত প্রকাশ করেন কাঙাল হরিনাথ। পত্রিকাটি প্রকাশ করতে গিয়ে এক সময় তিনি চরম আর্থিক সংকটে নিপতিত হন তিনি। ১৮৭৩ সালে তিনি তার সুহৃদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়’র বাবা মথুরানাথ মৈত্রেয়’র আর্থিক সহায়তায় কুমারখালীতে এমএন প্রেস নামে একটি লেটারহেড প্রেস স্থাপন করে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র প্রকাশনা অব্যাহত রাখেন।

কাঙাল হরিনাথ পত্রিকাটির সম্পাদক হয়ে নিজেই ঘুরে বেড়াতেন গ্রাম থেকে গ্রামে। সংগ্রহ করতেন বঞ্চনা-অত্যাচর-শোষণ আর নির্যাতনের সংবাদ। রাতের পর রাত নিজের হাতে তা লিখে আবার তুলে দিতেন পাঠকদের হাতে। বস্তুনিষ্ঠ পত্রিকা হিসেবে সে সময়ে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৮৭২ সালে দুঃখী মানুষের পক্ষে কালাকানুনের বিরুদ্ধে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র মাধ্যমে প্রতিবাদ জানান সাহসী এ সাংবাদিক। নিভৃত গ্রামে বসবাস করেও ১৮৬৩ সালে উনিশ শতকের বুদ্ধিজীবী কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তার পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’য় শিলাইদহের জোড়াসাঁকোর ঠাকুর জমিদারের বিরুদ্ধে কৃষকদের পক্ষে প্রবন্ধ লিখে সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি করেন। এ প্রবন্ধের কারণে ঠাকুর জমিদার কাঙাল হরিনাথকে প্রাণে হত্যা করতে লাঠিয়াল বাহিনী পাঠান। এ অবস্থায় কাঙাল হরিনাথ উপায়ন্তর না দেখে বাউল সাধক লালন ফকির’র সহায়তা কামনা করেন। লালন ফকির তার দলবল নিয়ে কাঙাল হরিনাথকে রক্ষা করতে জমিদারের লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। এর ফলে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী কাঙাল হরিনাথকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। এরপরই অত্যাচার-জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার কাঙাল হরিনাথ ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র লেখক গোষ্ঠী তৈরি করেন। এ পত্রিকা-ই বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, সুসাহিত্যিক রায় বাহাদুর জলধর সেন, দীনেন্দ্র কুমার রায়, মীর মশাররফ হোসেন, শিবচন্দ্র বিদ্যানর্ব প্রমুখ সাহিত্যিক সৃষ্টি করে। তিনি সাহিত্য আড্ডা বসাতেন নিয়মিত। সে সময় ওই আড্ডায় নিয়মিত সময় দিতেন মীর মশাররফ হোসেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, বাউল সম্রাট লালন ফকির প্রমুখরা।

‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ছিল নিতান্তই নির্ভীক সাংবাদিকতার একটি আদর্শ পত্রিকা। পাবনার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. হামফ্রে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন-‘এডিটর, আমি তোমাকে ভয় করি না বটে, কিন্তু তোমার লেখনীর জন্য অনেক কুকর্ম পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি।’ এই উক্তির পেছনে যে কারণটি ছিল, তা হলো, এক দুখিনী মায়ের একটি গরু ছিল খুবই মোটাতাজা। পাবনার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. হামফ্রে’র ওই গরুটি দেখে পছন্দ হয়ে যায়। পরে তারই নির্দেশে ওই মহিলার গরুটি জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। এ ঘটনা লোকমুখে জানতে পারেন সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ। এ নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সত্যতাও পান। তিনি তার পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র পরবর্তী সংখ্যায় ‘গরুচোর ম্যাজিস্ট্রেট’ শিরোনামে তিনি একটি সংবাদ প্রকাশ করেন। সংবাদ দেখে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. হামফ্রে রাগান্বিত হয়ে ছুটে এলেন কাঙাল হরিনাথের প্রেসে। সে সময় হরিনাথ ছিলেন কুামারখালী শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে বাটিকামারা গ্রামের তৎকালীন ‘ঝরেপুল’ খ্যাত জঙ্গলের মাঝে কালিমন্দিরে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট ঘোড়ায় চড়ে হরিনাথকে শায়েস্তা করতে চাবুক নিয়ে ছুটলেন সেখানে। কাঙাল হরিনাথকে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কয়েকবার ডাকেন। এ নিয়ে কথিত আছে, অনেকবার ডাকার পরও কাঙাল হরিনাথের কোনো সাড়া না পাওয়ায় তিনি চাবুক মারতে থাকেন। অথচ একটিবারও কাঙালের পিঠে চাবুক ¯পর্শ না করায় ম্যাজিস্ট্রেট হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। ম্যাজিস্ট্রেট তার এ দুর্ব্যবহারের জন্য পরে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন বলেও কথিত আছে।

অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও কাঙাল হরিনাথ কিশোর বয়সেই তিনি জীবন জীবিকার জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি মাসিক মাত্র দু’পয়সা বেতনে কুষ্টিয়ার কুমারখালী বাজারের একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি নেন। তার কাজ ছিল দিনের বেলায় খরিদ্দারের তামাক-সাজা, কাপড়-গোছানো এবং সন্ধ্যায় তিনি দোকানের খাতা লেখা। এরপর কিছুদিন তিনি মহাজনের গদিতে খাতা লেখা, ৫১টি কুঠির হেড অফিস কুমারখালীর নীলকুঠিতে শিক্ষানবিস হিসেবে চাকরি এবং পরে শিক্ষকতার কাজ করেন। নানা অত্যাচার, অনাচার সইতে না পেরে তিনি কোনো চাকরিই কয়েক দিনের বেশি করতে পারেননি। এরপর ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে ইংরেজ জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনী লিখে পাঠাতে শুরু করেন। ১৮৫১ সালে হরিনাথ প্রথম উপন্যাস গ্রন্থ ‘বিজয় বসন্ত’ প্রকাশ করেন। ১৮৫৪ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি কুমারখালীতে একটি বাংলা স্কুল স্থাপন করেন। এখানে তিনি অবৈতনিক শিক্ষকতার চাকরি করতে থাকেন। বিদ্যালয়ের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ক্রমেই ছাত্রসংখ্যা বাড়তে থাকে। বিদ্যালয়টি সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত হয়। প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাঙাল হরিনাথের বেতন নির্ধারণ হয় মাসিক ২০ টাকা। তবে তিনি নিম্ন শ্রেণীর শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে নিজে ১৫ টাকা বেতন গ্রহণ করেন। পরে তিনি মেয়েদের শিক্ষাদানের জন্য ১৮৬০ সালে কুমারখালীতে নিজ বাড়িতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ তখন নারী-প্রগতি ও স্ত্রী শিক্ষার বিপক্ষে। এমনকি হরিনাথের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার গুরু কবি ঈশ্বর গুপ্তও স্ত্রী শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। সে সময়েই কুমারখালীতে হরিনাথ পল্লীতে তিনি স্ত্রী শিক্ষায় ব্র্রত হয়েছিলেন। সেই বিদ্যালয়টিই এখন কুমারখালীর সুনামধন্য বালিকা বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

কাঙাল হরিনাথ তার ৬৩ বছরের জীবনে অসংখ্য বাউল গান রচনা করেছেন। কাঙালের রচিত গান শুনে তৎকালীন বহু লোককে আবেগে অশ্রু ঝরাতে দেখা গেছে। এ সম্পর্কে সুকুমার সেন বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে কাঙাল হরিনাথই বাউল গান সৃষ্টি করেন। তার বহু বাউল গান আজো গ্রামে-গঞ্জে বাউল শিল্পীদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়। কাঙাল নিজে বাউল না হয়েও বাউল গান রচনা করেছিলেন।’ তবে লালন সাঁইয়ের প্রচন্ড প্রভাব মূলত কাঙালকে বাউল গান রচনা করতে সহায়তা করেছিল বলে জানা গেছে। লালন সাঁই জীবনে অসংখ্যবার কুমারখালীর কাঙাল কুটিরে গেছেন। কাঙালও লালন শাহের ছেউড়িয়া গ্রামের আখড়া বাড়িতে এসেছেন একাধিকবার। এর প্রমাণ পাওয়া যায় গবেষক ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী’র ‘কাঙাল হরিনাথের জীবনীমালা গ্রন্থ’ এবং ‘লালন সাঁইয়ের সন্ধানে’ গ্রন্থে। তিনি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘হরিনাথ বাউলগানের একটি ঘরানা সৃষ্টি করেছিলেন। কাঙাল হরিনাথের বাউলাঙ্গের গান রয়েছে প্রায় হাজারের কোটায়। তার গান শুনে অনেকে হরিনাথ দেবতাও বলেছে। বাঙলা ১২৮৭ সালে ফিকিরচাঁদ ফকিরের বাউল গানের দল গঠন করেন তিনি। এই দলের গান শুনতে এবং নিজে গান করতে কাঙাল কুটিরে আসতেন সাধক লালন ফকির। এতে ফিকিরচাঁদ দলের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এ বাউল গান শুনতে আসত।’

কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকাটি গ্রামীণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। কৃষক-প্রজা-রায়ত-শ্রমজীবী এবং মধ্যবৃত্তের মানুষের আনুকূল্য পেয়েছিল তার এ পত্রিকাটি। এর পাশাপাশি সমাজের চরম অসহায় মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। স্বদেশ শিল্প-বাণিজ্য বিকাশের এক পুরধা ব্যক্তিত্বও ছিলেন তিনি। সংগ্রামী কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ৫ বৈশাখ (১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল) কুমারখালী শহরের কুন্ডুপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি তিন পুত্র, এক কন্যা এবং স্ত্রী স্বর্ণময়ীকে রেখে গিয়েছিলেন।

রচনাবলী : কাঙাল হরিনাথ মজুমদার শুধু বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের জনক, গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সাধক ও সাহিত্যিক। জীবদ্দশায় তিনি কবিতা, উপন্যাস ও শিশুদের জন্য পাঠ্যপুস্তকও লিখেছেন। এছাড়া রচনা করেছেন নাট্যগ্রন্থ ও বিভিন্ন প্রবন্ধগ্রন্থ। বিভিন্ন গবেষক তদন্ত প্রণীত গ্রন্থ থেকে জানা যায়, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার মোট ৪০টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। অপ্রকাশিতই রয়েছে বেশিরভাগ। কোন কোন গবেষকদের মতে, তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘বিজয় বসন্ত’ উপন্যাসটিই বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস। তবে কেউ কেউ মনে করেন টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরে দুলাল’ উপন্যাসটিও বাংলায় প্রথম উপন্যাস। এ বিষয় নিয়ে গবেষক শিবনাথ শাস্ত্রী ও রামতনু লাহিড়ী ‘তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কুমারখালীর হরিনাথ মজুমদার প্রণীত বিজয় বসন্ত ও টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরে দুলাল’ বাংলার প্রথম উপন্যাস।’ কাঙাল হরিনাথ-ই প্রথম লালন ফকিরের গান নিয়ে বই লেখেন এবং গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় বাউল গান প্রকাশ করেছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৮৬১ সালে প্রকাশিত ‘বিজয় বসন্ত’, ১৮৬২ সালে প্রকাশিত ‘পদ্যপুন্ডরীক’, ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত ‘চারুচরিত্র’, ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত ‘কবিতাকৌমুদী’, ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত ‘বিজয়া’, ১৮৭০ সালে প্রকাশিত ‘কবিকল্প’, ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত ‘অক্রুরসংবাদ’ (গীতাভিনয়), ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত ‘সাবিত্রী’ (গীতাভিনয়), ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ‘চিত্তচপলা’, ‘একলব্যের অধ্যবসায়’ ও ‘ভাবোচ্ছ্বাস’ (নাটক), ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত ‘কাঙাল ফিকিরচাঁদ ফকিরের গীতাবলী’ ও ‘ব্র্রহ্মাবেদ’, ১৮৯২ সালে প্রকাশিত ‘কৃষ্ণকালী-লীলা’, ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত ‘আধত্মা-আগমনী’ (সংগীত), ‘আগমনী’ (ধর্মীয় সংগীত) ও ‘পরমার্থ-গাথা’ (ধর্মীয় সংগীত), ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত ‘মাতৃ-মহিমা’, ‘কাঙাল ফিকিরচাঁদ ফকিরের বাউলসংগীত’ এবং ‘হরিনাথ গ্রন্থাবলি’।

[লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট]

ismail.press2019@gmail.com

সোমবার, ২২ জুলাই ২০১৯ , ৭ শ্রাবন ১৪২৫, ১৮ জিলকদ ১৪৪০

স্মরণ : গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ কাঙাল হরিনাথ

ইসমাইল মাহমুদ

বাংলা সিনেমার অধিপতি সত্যজিৎ রায়ের পথের পাচালীসহ আরও কয়েকটি ছবির জনপ্রিয় গান হলো-

‘যেখানে দেখিবে ছাই/ উড়াইয়া দেখ তাই/ পাইলেও পাইতে পারো/ লুকানো রতন।’

অথবা

‘হরি দিনতো গেল,/ সন্ধ্যা হলো/ পার কর আমারে’

এসব কালজয়ী গান কার রচনা তা অনেকের কাছে অজানা। এসব গানের রচয়িতা কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। তিনি ছিলেন একাধারে বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের জনক, গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ, ঊনবিংশ শতাব্দীর কালজয়ী একজন সাধক, সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, সমাজসেবক ও নারী জাগরণের অন্যতম দিকপাল। কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্ত্তা’ বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র। প্রকাশনার প্রথমদিকে এটি হাতে লিখে প্রকাশ করা হতো। সাংবাদিকতায় কাঙাল হরিনাথের আদর্শ রূপকথার কাহিনীকেও হার মানায়। তিনি সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নির্ভীক সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তৎকালীন সময়ে ইংরেজ নীলকর, জমিদার, পুলিশ ও শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন হাতে লেখা পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র মাধ্যমে। অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আজীবন আপসহীন।

গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ১২৪০ বঙ্গাব্দের ৫ শ্রাবণ (১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুলাই) কুষ্টিয়ার কুমারখালী শহরের (তদানীন্তন পাবনা জেলার নদীয়া) নিভৃত গ্রাম কুণ্ডুপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হলধর মজুমদার এবং মাতা কমলিনী দেবী। হরিনাথ মজুমদার ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। শৈশবেই তিনি তার পিতা-মাতাকে হারান। এরপর চরম দরিদ্রতাকে সাথী করে বেড়ে ওঠেন তিনি।

১৮৫৭ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর একটি নিভৃত গ্রাম থেকে তিনি হাতে লিখে প্রথম প্রকাশ করেন মাসিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামের পত্রিকাটি। পত্রিকাটি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি হাজারো বাধা-বিপত্তিতে পড়েন। কিন্তু দৃঢ়চেতা কাঙাল হরিনাথ সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে পত্রিকাটি প্রায় এক যুগ প্রকাশ করেছিলেন হাতে লিখেই। একযুগ পর পত্রিকাটি মাসিক থেকে পত্রিকাটি পাক্ষিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ১৮৬৩ সালে কলকাতার ‘গিরিশচন্দ্র বিদ্যারতœ প্রেস’ থেকে পত্রিকাটি সাপ্তাহিক আকারে থেকে নিয়মিত প্রকাশ করেন কাঙাল হরিনাথ। পত্রিকাটি প্রকাশ করতে গিয়ে এক সময় তিনি চরম আর্থিক সংকটে নিপতিত হন তিনি। ১৮৭৩ সালে তিনি তার সুহৃদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়’র বাবা মথুরানাথ মৈত্রেয়’র আর্থিক সহায়তায় কুমারখালীতে এমএন প্রেস নামে একটি লেটারহেড প্রেস স্থাপন করে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র প্রকাশনা অব্যাহত রাখেন।

কাঙাল হরিনাথ পত্রিকাটির সম্পাদক হয়ে নিজেই ঘুরে বেড়াতেন গ্রাম থেকে গ্রামে। সংগ্রহ করতেন বঞ্চনা-অত্যাচর-শোষণ আর নির্যাতনের সংবাদ। রাতের পর রাত নিজের হাতে তা লিখে আবার তুলে দিতেন পাঠকদের হাতে। বস্তুনিষ্ঠ পত্রিকা হিসেবে সে সময়ে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৮৭২ সালে দুঃখী মানুষের পক্ষে কালাকানুনের বিরুদ্ধে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র মাধ্যমে প্রতিবাদ জানান সাহসী এ সাংবাদিক। নিভৃত গ্রামে বসবাস করেও ১৮৬৩ সালে উনিশ শতকের বুদ্ধিজীবী কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তার পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’য় শিলাইদহের জোড়াসাঁকোর ঠাকুর জমিদারের বিরুদ্ধে কৃষকদের পক্ষে প্রবন্ধ লিখে সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি করেন। এ প্রবন্ধের কারণে ঠাকুর জমিদার কাঙাল হরিনাথকে প্রাণে হত্যা করতে লাঠিয়াল বাহিনী পাঠান। এ অবস্থায় কাঙাল হরিনাথ উপায়ন্তর না দেখে বাউল সাধক লালন ফকির’র সহায়তা কামনা করেন। লালন ফকির তার দলবল নিয়ে কাঙাল হরিনাথকে রক্ষা করতে জমিদারের লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। এর ফলে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী কাঙাল হরিনাথকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। এরপরই অত্যাচার-জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার কাঙাল হরিনাথ ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র লেখক গোষ্ঠী তৈরি করেন। এ পত্রিকা-ই বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, সুসাহিত্যিক রায় বাহাদুর জলধর সেন, দীনেন্দ্র কুমার রায়, মীর মশাররফ হোসেন, শিবচন্দ্র বিদ্যানর্ব প্রমুখ সাহিত্যিক সৃষ্টি করে। তিনি সাহিত্য আড্ডা বসাতেন নিয়মিত। সে সময় ওই আড্ডায় নিয়মিত সময় দিতেন মীর মশাররফ হোসেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, বাউল সম্রাট লালন ফকির প্রমুখরা।

‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ছিল নিতান্তই নির্ভীক সাংবাদিকতার একটি আদর্শ পত্রিকা। পাবনার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. হামফ্রে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন-‘এডিটর, আমি তোমাকে ভয় করি না বটে, কিন্তু তোমার লেখনীর জন্য অনেক কুকর্ম পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি।’ এই উক্তির পেছনে যে কারণটি ছিল, তা হলো, এক দুখিনী মায়ের একটি গরু ছিল খুবই মোটাতাজা। পাবনার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. হামফ্রে’র ওই গরুটি দেখে পছন্দ হয়ে যায়। পরে তারই নির্দেশে ওই মহিলার গরুটি জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। এ ঘটনা লোকমুখে জানতে পারেন সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ। এ নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সত্যতাও পান। তিনি তার পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র পরবর্তী সংখ্যায় ‘গরুচোর ম্যাজিস্ট্রেট’ শিরোনামে তিনি একটি সংবাদ প্রকাশ করেন। সংবাদ দেখে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. হামফ্রে রাগান্বিত হয়ে ছুটে এলেন কাঙাল হরিনাথের প্রেসে। সে সময় হরিনাথ ছিলেন কুামারখালী শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে বাটিকামারা গ্রামের তৎকালীন ‘ঝরেপুল’ খ্যাত জঙ্গলের মাঝে কালিমন্দিরে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট ঘোড়ায় চড়ে হরিনাথকে শায়েস্তা করতে চাবুক নিয়ে ছুটলেন সেখানে। কাঙাল হরিনাথকে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কয়েকবার ডাকেন। এ নিয়ে কথিত আছে, অনেকবার ডাকার পরও কাঙাল হরিনাথের কোনো সাড়া না পাওয়ায় তিনি চাবুক মারতে থাকেন। অথচ একটিবারও কাঙালের পিঠে চাবুক ¯পর্শ না করায় ম্যাজিস্ট্রেট হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। ম্যাজিস্ট্রেট তার এ দুর্ব্যবহারের জন্য পরে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন বলেও কথিত আছে।

অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও কাঙাল হরিনাথ কিশোর বয়সেই তিনি জীবন জীবিকার জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি মাসিক মাত্র দু’পয়সা বেতনে কুষ্টিয়ার কুমারখালী বাজারের একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি নেন। তার কাজ ছিল দিনের বেলায় খরিদ্দারের তামাক-সাজা, কাপড়-গোছানো এবং সন্ধ্যায় তিনি দোকানের খাতা লেখা। এরপর কিছুদিন তিনি মহাজনের গদিতে খাতা লেখা, ৫১টি কুঠির হেড অফিস কুমারখালীর নীলকুঠিতে শিক্ষানবিস হিসেবে চাকরি এবং পরে শিক্ষকতার কাজ করেন। নানা অত্যাচার, অনাচার সইতে না পেরে তিনি কোনো চাকরিই কয়েক দিনের বেশি করতে পারেননি। এরপর ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে ইংরেজ জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনী লিখে পাঠাতে শুরু করেন। ১৮৫১ সালে হরিনাথ প্রথম উপন্যাস গ্রন্থ ‘বিজয় বসন্ত’ প্রকাশ করেন। ১৮৫৪ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি কুমারখালীতে একটি বাংলা স্কুল স্থাপন করেন। এখানে তিনি অবৈতনিক শিক্ষকতার চাকরি করতে থাকেন। বিদ্যালয়ের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ক্রমেই ছাত্রসংখ্যা বাড়তে থাকে। বিদ্যালয়টি সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত হয়। প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাঙাল হরিনাথের বেতন নির্ধারণ হয় মাসিক ২০ টাকা। তবে তিনি নিম্ন শ্রেণীর শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে নিজে ১৫ টাকা বেতন গ্রহণ করেন। পরে তিনি মেয়েদের শিক্ষাদানের জন্য ১৮৬০ সালে কুমারখালীতে নিজ বাড়িতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ তখন নারী-প্রগতি ও স্ত্রী শিক্ষার বিপক্ষে। এমনকি হরিনাথের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার গুরু কবি ঈশ্বর গুপ্তও স্ত্রী শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। সে সময়েই কুমারখালীতে হরিনাথ পল্লীতে তিনি স্ত্রী শিক্ষায় ব্র্রত হয়েছিলেন। সেই বিদ্যালয়টিই এখন কুমারখালীর সুনামধন্য বালিকা বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

কাঙাল হরিনাথ তার ৬৩ বছরের জীবনে অসংখ্য বাউল গান রচনা করেছেন। কাঙালের রচিত গান শুনে তৎকালীন বহু লোককে আবেগে অশ্রু ঝরাতে দেখা গেছে। এ সম্পর্কে সুকুমার সেন বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে কাঙাল হরিনাথই বাউল গান সৃষ্টি করেন। তার বহু বাউল গান আজো গ্রামে-গঞ্জে বাউল শিল্পীদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়। কাঙাল নিজে বাউল না হয়েও বাউল গান রচনা করেছিলেন।’ তবে লালন সাঁইয়ের প্রচন্ড প্রভাব মূলত কাঙালকে বাউল গান রচনা করতে সহায়তা করেছিল বলে জানা গেছে। লালন সাঁই জীবনে অসংখ্যবার কুমারখালীর কাঙাল কুটিরে গেছেন। কাঙালও লালন শাহের ছেউড়িয়া গ্রামের আখড়া বাড়িতে এসেছেন একাধিকবার। এর প্রমাণ পাওয়া যায় গবেষক ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী’র ‘কাঙাল হরিনাথের জীবনীমালা গ্রন্থ’ এবং ‘লালন সাঁইয়ের সন্ধানে’ গ্রন্থে। তিনি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘হরিনাথ বাউলগানের একটি ঘরানা সৃষ্টি করেছিলেন। কাঙাল হরিনাথের বাউলাঙ্গের গান রয়েছে প্রায় হাজারের কোটায়। তার গান শুনে অনেকে হরিনাথ দেবতাও বলেছে। বাঙলা ১২৮৭ সালে ফিকিরচাঁদ ফকিরের বাউল গানের দল গঠন করেন তিনি। এই দলের গান শুনতে এবং নিজে গান করতে কাঙাল কুটিরে আসতেন সাধক লালন ফকির। এতে ফিকিরচাঁদ দলের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এ বাউল গান শুনতে আসত।’

কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকাটি গ্রামীণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। কৃষক-প্রজা-রায়ত-শ্রমজীবী এবং মধ্যবৃত্তের মানুষের আনুকূল্য পেয়েছিল তার এ পত্রিকাটি। এর পাশাপাশি সমাজের চরম অসহায় মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। স্বদেশ শিল্প-বাণিজ্য বিকাশের এক পুরধা ব্যক্তিত্বও ছিলেন তিনি। সংগ্রামী কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ৫ বৈশাখ (১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল) কুমারখালী শহরের কুন্ডুপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি তিন পুত্র, এক কন্যা এবং স্ত্রী স্বর্ণময়ীকে রেখে গিয়েছিলেন।

রচনাবলী : কাঙাল হরিনাথ মজুমদার শুধু বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের জনক, গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সাধক ও সাহিত্যিক। জীবদ্দশায় তিনি কবিতা, উপন্যাস ও শিশুদের জন্য পাঠ্যপুস্তকও লিখেছেন। এছাড়া রচনা করেছেন নাট্যগ্রন্থ ও বিভিন্ন প্রবন্ধগ্রন্থ। বিভিন্ন গবেষক তদন্ত প্রণীত গ্রন্থ থেকে জানা যায়, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার মোট ৪০টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। অপ্রকাশিতই রয়েছে বেশিরভাগ। কোন কোন গবেষকদের মতে, তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘বিজয় বসন্ত’ উপন্যাসটিই বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস। তবে কেউ কেউ মনে করেন টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরে দুলাল’ উপন্যাসটিও বাংলায় প্রথম উপন্যাস। এ বিষয় নিয়ে গবেষক শিবনাথ শাস্ত্রী ও রামতনু লাহিড়ী ‘তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কুমারখালীর হরিনাথ মজুমদার প্রণীত বিজয় বসন্ত ও টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরে দুলাল’ বাংলার প্রথম উপন্যাস।’ কাঙাল হরিনাথ-ই প্রথম লালন ফকিরের গান নিয়ে বই লেখেন এবং গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় বাউল গান প্রকাশ করেছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৮৬১ সালে প্রকাশিত ‘বিজয় বসন্ত’, ১৮৬২ সালে প্রকাশিত ‘পদ্যপুন্ডরীক’, ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত ‘চারুচরিত্র’, ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত ‘কবিতাকৌমুদী’, ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত ‘বিজয়া’, ১৮৭০ সালে প্রকাশিত ‘কবিকল্প’, ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত ‘অক্রুরসংবাদ’ (গীতাভিনয়), ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত ‘সাবিত্রী’ (গীতাভিনয়), ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ‘চিত্তচপলা’, ‘একলব্যের অধ্যবসায়’ ও ‘ভাবোচ্ছ্বাস’ (নাটক), ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত ‘কাঙাল ফিকিরচাঁদ ফকিরের গীতাবলী’ ও ‘ব্র্রহ্মাবেদ’, ১৮৯২ সালে প্রকাশিত ‘কৃষ্ণকালী-লীলা’, ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত ‘আধত্মা-আগমনী’ (সংগীত), ‘আগমনী’ (ধর্মীয় সংগীত) ও ‘পরমার্থ-গাথা’ (ধর্মীয় সংগীত), ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত ‘মাতৃ-মহিমা’, ‘কাঙাল ফিকিরচাঁদ ফকিরের বাউলসংগীত’ এবং ‘হরিনাথ গ্রন্থাবলি’।

[লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট]

ismail.press2019@gmail.com