গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার নেপথ্যে কারা?

ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম

গত কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয় যে, ‘পদ্মা সেতুর জন্য মাথা লাগবে’। এ গুজবে জনগণের মধ্যে একটা আতঙ্ক ও ভয় দেখা দেয়। এরই মধ্যে আবার ছেলেধরার গুজব। এই গুজব ছড়িয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে, আহত হয়েছেন অনেকেই। গত বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখলাম- ছেলেধরা সন্দেহে রাজশাহীর বিনোদপুরে গণপিটুনির শিকার হন একটি চিপস কোম্পানির তিন কর্মী; তাদের গাড়িও ভাংচুর করা হয়। ছেলেধরা গুজবে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেই চলছে। ঢাকার সাভার ও কেরানীগঞ্জে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন দুজন। লালমনিরহাটে মানসিক প্রতিবন্ধী তিনজন হয়েছেন গণপিটুনির শিকার। পাবনায় আহত হয়েছেন তিনজন। কুমিল্লায় এক নারীসহ চারজন হয়েছেন গণপিটুনির শিকার। হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে আহত হয়েছেন ছয়জন। নওগাঁর মান্দায় ছেলেধরা সন্দেহে ছয় জেলেকে পিটিয়েছে স্থানীয়রা। রাজশাহী নগরীতে একটি স্কুলের সামনে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন একটি চিপস কোম্পানির তিন কর্মী। দেশব্যাপী এখন এ গুজব আর আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভিক্ষুকরা ঘর থেকে বের হচ্ছে না গণপিটুনির ভয়ে। কেউ কেউ বের হলেও জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে রাখছে। অপরদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে। যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের কেউ কেউ ধরাও পড়ছে। আতঙ্কিত না হয়ে যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের পুলিশে দেয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

কারা এ গুজব ছড়িয়ে নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা বা আহত করছে? কেনই বা এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে? এসব প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক। দেশব্যাপী যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা কার স্বার্থে? তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত এসব করছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘দেশের মধ্য যারা গুজবের মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তাদের বিষয়ে দলের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিরাজমান অন্য সামাজিক অস্থিরতা নিয়ে দলের পক্ষ থেকে সাংগঠনিকভাবে কোনো কর্মসূচি দেয়া যায় কিনা, সে বিষয়েও ভাবছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দেশে বিরাজমান সামাজিক অস্থিরতা, নৈতিকতার অবক্ষয় রোধ ও সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে কাজ করবে দল। দেশের সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য দলের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে প্রচার বাড়ানো হবে। সমাজ থেকে অস্থিরতা দূর করতে প্রশাসনকে সহায়তা করে যাবে দল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চলতি মাসে বলেন, এ বিষয়গুলো আমাদের গত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের সভায় বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সামাজিক অস্থিরতা এ বিষয়গুলোর অবনত রূপ। এটাকে ট্যাকল করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, সাংগঠনিকভাবে আমাদের নিজেদের অবস্থানকে তুলে ধরা এবং প্রশাসনিকভাবে কঠোর হস্তে দমনের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিরো টলারেন্সের বিষয়টি জানিয়েছেন। সে সময় ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, যা সত্য সেটাকে স্বীকৃতি দিয়েই মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রশাসনের সামাজিক অস্থিরতা প্রতিরোধে ও গুজবের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও সংসদ সদস্যরা। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দেশের বর্তমান সামাজিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে দলের পক্ষ থেকে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে প্রচার আরও বাড়ানো হবে। এছাড়া দলীয়ভাবে সকল স্তরের নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হবে। তবে গুজব ছড়ানোর বিষয়টি কেউ অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করছে বলেই সন্দেহ করছেন তারা। প্রশ্ন হচ্ছে যে, সরকারবিরোধীরা যদি এসব করেন বা করে থাকেন তবে সত্যিই এটা দুঃখজনক। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এসব করা কখনই ইতিবাচক নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সামাজিক অস্থিরতা বা নিরীহ মানুষের জীবন নিয়ে খেলা চলতে পারে না। মানুষের মঙ্গলের জন্যই রাজনীতি, মানুষ হত্যা করা বা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা ঠিক নয়। রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হয় বা করতে হবে। মানুষের জীবন নিয়ে নয়। আগেও দেশে গুজব ছড়িয়ে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য তৈরি করা হয়েছিল। ২০১৩ সালের মার্চে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ‘চাঁদে দেখা গেছে’ বলে গুজব ছড়িয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক নৈরাজ্য তৈরি করা হয়েছিল। ‘নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন’ চলার সময়ও বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হয়েছিল। ২০১১ সালে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ছয় ছাত্রকে। এভাবে স্বার্থান্বেষী মহল একেক সময় একেক রূপে গুজব ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে ফায়দা লুটছে। আর বলি হচ্ছেন সাধারণ অসহায় মানুষ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে সারা দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৯ জন। আর চলতি বছর চলমান গুজবে গণপিটুনিতে নিহত ১০ জন ছাড়াও গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসেই নিহত হয়েছেন ৩৬ জন। এটি কোনো সুস্থ সমাজব্যবস্থার লক্ষণ নয়।

আইনকানুন ও বিচারব্যবস্থার উপস্থিতি সম্পন্ন সভ্যসমাজে কোনো অবস্থাতেই গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা চলতে পারে না। আমরা মনে করি, একটি গোষ্ঠী অসৎ উদ্দেশ্যে দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে বানচালের লক্ষ্যে এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে উসকানি দিচ্ছে। এসব ঘটনার তদন্ত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বিচারের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। সমাজে নৈতিকতার মানদন্ড উচ্চমুখী করতেও নিতে হবে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ। গুজব শুনে কেউ যাতে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যাপক তৎপর হওয়া উচিত। গুজবের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়াতে বলিষ্ঠ কর্মসূচি থাকাও জরুরি। জনগণকে বোঝাতে হবে, এসব গুজবের কোনো ভিত্তি নেই। তাছাড়া গুজবে বিশ্বাসী হয়ে অপরাধী সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যা করে আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কারও নেই। এটি চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কাউকে অপরাধী মনে হলে তাকে ধরে পুলিশে দেয়া যেতে পারে। ৯৯৯ নম্বরে কল করে দ্রুত পুলিশের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি এ ব্যাপারে মসজিদের ইমামসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। গুজবকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের ব্যক্তিগত শত্রুদের টার্গেট করতে পারে। সুপরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে ও সেটিকে ব্যবহার করে এবং মানুষের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে কাজে লাগিয়ে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার অপচেষ্টা থাকাও অস্বাভাবিক নয়। অতীতেও গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে অশুভ চক্রগুলোর স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টায় লিপ্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন জাগে যে, গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার নেপথ্যে কি কোন চক্র কাজ করছে?

[লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন]

সোমবার, ২৯ জুলাই ২০১৯ , ১৪ শ্রাবন ১৪২৫, ২৫ জিলকদ ১৪৪০

গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার নেপথ্যে কারা?

ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম

image

গত কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয় যে, ‘পদ্মা সেতুর জন্য মাথা লাগবে’। এ গুজবে জনগণের মধ্যে একটা আতঙ্ক ও ভয় দেখা দেয়। এরই মধ্যে আবার ছেলেধরার গুজব। এই গুজব ছড়িয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে, আহত হয়েছেন অনেকেই। গত বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখলাম- ছেলেধরা সন্দেহে রাজশাহীর বিনোদপুরে গণপিটুনির শিকার হন একটি চিপস কোম্পানির তিন কর্মী; তাদের গাড়িও ভাংচুর করা হয়। ছেলেধরা গুজবে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেই চলছে। ঢাকার সাভার ও কেরানীগঞ্জে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন দুজন। লালমনিরহাটে মানসিক প্রতিবন্ধী তিনজন হয়েছেন গণপিটুনির শিকার। পাবনায় আহত হয়েছেন তিনজন। কুমিল্লায় এক নারীসহ চারজন হয়েছেন গণপিটুনির শিকার। হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে আহত হয়েছেন ছয়জন। নওগাঁর মান্দায় ছেলেধরা সন্দেহে ছয় জেলেকে পিটিয়েছে স্থানীয়রা। রাজশাহী নগরীতে একটি স্কুলের সামনে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন একটি চিপস কোম্পানির তিন কর্মী। দেশব্যাপী এখন এ গুজব আর আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভিক্ষুকরা ঘর থেকে বের হচ্ছে না গণপিটুনির ভয়ে। কেউ কেউ বের হলেও জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে রাখছে। অপরদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে। যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের কেউ কেউ ধরাও পড়ছে। আতঙ্কিত না হয়ে যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের পুলিশে দেয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

কারা এ গুজব ছড়িয়ে নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা বা আহত করছে? কেনই বা এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে? এসব প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক। দেশব্যাপী যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা কার স্বার্থে? তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত এসব করছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘দেশের মধ্য যারা গুজবের মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তাদের বিষয়ে দলের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিরাজমান অন্য সামাজিক অস্থিরতা নিয়ে দলের পক্ষ থেকে সাংগঠনিকভাবে কোনো কর্মসূচি দেয়া যায় কিনা, সে বিষয়েও ভাবছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দেশে বিরাজমান সামাজিক অস্থিরতা, নৈতিকতার অবক্ষয় রোধ ও সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে কাজ করবে দল। দেশের সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য দলের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে প্রচার বাড়ানো হবে। সমাজ থেকে অস্থিরতা দূর করতে প্রশাসনকে সহায়তা করে যাবে দল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চলতি মাসে বলেন, এ বিষয়গুলো আমাদের গত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের সভায় বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সামাজিক অস্থিরতা এ বিষয়গুলোর অবনত রূপ। এটাকে ট্যাকল করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, সাংগঠনিকভাবে আমাদের নিজেদের অবস্থানকে তুলে ধরা এবং প্রশাসনিকভাবে কঠোর হস্তে দমনের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিরো টলারেন্সের বিষয়টি জানিয়েছেন। সে সময় ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, যা সত্য সেটাকে স্বীকৃতি দিয়েই মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রশাসনের সামাজিক অস্থিরতা প্রতিরোধে ও গুজবের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও সংসদ সদস্যরা। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দেশের বর্তমান সামাজিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে দলের পক্ষ থেকে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে প্রচার আরও বাড়ানো হবে। এছাড়া দলীয়ভাবে সকল স্তরের নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হবে। তবে গুজব ছড়ানোর বিষয়টি কেউ অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করছে বলেই সন্দেহ করছেন তারা। প্রশ্ন হচ্ছে যে, সরকারবিরোধীরা যদি এসব করেন বা করে থাকেন তবে সত্যিই এটা দুঃখজনক। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এসব করা কখনই ইতিবাচক নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সামাজিক অস্থিরতা বা নিরীহ মানুষের জীবন নিয়ে খেলা চলতে পারে না। মানুষের মঙ্গলের জন্যই রাজনীতি, মানুষ হত্যা করা বা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা ঠিক নয়। রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হয় বা করতে হবে। মানুষের জীবন নিয়ে নয়। আগেও দেশে গুজব ছড়িয়ে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য তৈরি করা হয়েছিল। ২০১৩ সালের মার্চে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ‘চাঁদে দেখা গেছে’ বলে গুজব ছড়িয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক নৈরাজ্য তৈরি করা হয়েছিল। ‘নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন’ চলার সময়ও বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হয়েছিল। ২০১১ সালে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ছয় ছাত্রকে। এভাবে স্বার্থান্বেষী মহল একেক সময় একেক রূপে গুজব ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে ফায়দা লুটছে। আর বলি হচ্ছেন সাধারণ অসহায় মানুষ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে সারা দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৯ জন। আর চলতি বছর চলমান গুজবে গণপিটুনিতে নিহত ১০ জন ছাড়াও গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসেই নিহত হয়েছেন ৩৬ জন। এটি কোনো সুস্থ সমাজব্যবস্থার লক্ষণ নয়।

আইনকানুন ও বিচারব্যবস্থার উপস্থিতি সম্পন্ন সভ্যসমাজে কোনো অবস্থাতেই গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা চলতে পারে না। আমরা মনে করি, একটি গোষ্ঠী অসৎ উদ্দেশ্যে দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে বানচালের লক্ষ্যে এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে উসকানি দিচ্ছে। এসব ঘটনার তদন্ত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বিচারের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। সমাজে নৈতিকতার মানদন্ড উচ্চমুখী করতেও নিতে হবে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ। গুজব শুনে কেউ যাতে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যাপক তৎপর হওয়া উচিত। গুজবের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়াতে বলিষ্ঠ কর্মসূচি থাকাও জরুরি। জনগণকে বোঝাতে হবে, এসব গুজবের কোনো ভিত্তি নেই। তাছাড়া গুজবে বিশ্বাসী হয়ে অপরাধী সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যা করে আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কারও নেই। এটি চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কাউকে অপরাধী মনে হলে তাকে ধরে পুলিশে দেয়া যেতে পারে। ৯৯৯ নম্বরে কল করে দ্রুত পুলিশের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি এ ব্যাপারে মসজিদের ইমামসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। গুজবকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের ব্যক্তিগত শত্রুদের টার্গেট করতে পারে। সুপরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে ও সেটিকে ব্যবহার করে এবং মানুষের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে কাজে লাগিয়ে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার অপচেষ্টা থাকাও অস্বাভাবিক নয়। অতীতেও গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে অশুভ চক্রগুলোর স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টায় লিপ্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন জাগে যে, গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার নেপথ্যে কি কোন চক্র কাজ করছে?

[লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন]