বিনা অপরাধে ২৩ বছরের কারাজীবন

২৩ বছর আগে যখন গ্রেফতার হন, তখন মোহাম্মদ আলি ভাটের বয়স ছিল ২৫ বছর। ১৯৯৬ সালে দিল্লি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এরপর কারাগারে কেটে যায় দুই দশকের বেশি। এই সময়ের মধ্যে হারিয়েছেন বাবা-মাকে। এখন কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে ফিরে এলেও সবকিছুই অচেনা তার। কাউকেই চিনতে পারছেন না। একই রকমের ঘটনা ঘটেছে আরও দুই কাশ্মীরির ক্ষেত্রেও। দুই দশকেরও বেশি সময় বিনা অপরাধে কারাগারে বন্দী থাকার পর আদালত তাদের বেকসুর খালাস দিয়েছেন।

১৯৯৬ সালে ভারতের লাজপাঁ নগর মার্কেটে একটি বোমা হামলায় ১৪ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও ৩৯ জন। এছাড়া রাজস্থান ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন আরএসটিসির একটি বাসে হামলার ঘটনায় প্রাণ হারান ১৪ জন। ওই দুই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ভাটকে গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ ২২ জুলাই রাজস্থান হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান ভাট। তার সঙ্গে আরও মুক্তি পায় আবদুল গনি, মির্জা নিসার হুসেন, লতিফ আহবেদ রাজা ও জাভেদ খান। তবে মুক্তির পর ভাট, হুসেন ও ওয়াজার জীবন একদম পাল্টে গেছে। পৃথিবীর স্বাভাবিক আলো থেকে যে তারা দূরে ছিলেন ২৩টি বছর। আলি ভাট বলেন, নির্দোষ হলেও তার কাছে কোনও প্রমাণ ছিল না। তারপরও ২০ বছরের বেশি সময় তাকে কারাগারে থাকতে হলো। যখন মুক্তি পেয়েছেন, তখন বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। বাবা মারা গিয়েছেন ২০১৬ সালে। মা আরও আগে, ২০০২। মুক্তি পেয়েই তাদের কবরের কাছে চলে যান ভাট। এরপর বাড়ি ফেরেন আলি। সেখানে অনেক মানুষ তাকে দেখতে জড়ো হন। সবাই জিজ্ঞাসা করতে থাকেন যে তাকে চিনতে পেরেছেন কিনা। কিন্তু আগে দেখা হওয়া সত্ত্বেও অনেককে চিনতে পারেননি আলি। ওই ব্যক্তি বলেন, আমি তোমার সঙ্গে কয়েক বছর তিহারে ছিলাম। আমাকেও অপরাধী ভাবা হয়েছিল। পরে মুক্তি পেয়েছি। ভাট বলেন, তিনি কারাগারে বসে একবারই একটি ঘুড়ির কাগজ ও ভাঙা পেন্সিল দিয়ে চিঠি পাঠাতে পেরেছিলেন।

এরপর কারও সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ হয়নি তার। কারা কর্তৃপক্ষে জানায়, তারা বন্দীদের চিঠি নিজেদের কাছেই রেখে দিত। এক সময় যোগাযোগ থেকে দূরে থাকা আলি ভাট বলেন, এখন তার ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা তাকে মোবাইল ফোন দিতে চায়। বলেই হেসে ওঠনে তিনি। ভারতের ধীরগতির বিচারিক ব্যবস্থা নিয়ে আলি ভাট বলেন, যদি ঠিকমতো কার্যক্রম পরিচালনা হতো তাহলে হয়তো বছরখানেকের মধ্যেই মুক্তি পেতেন তিনি। কিন্তু কেউই এ মামলা শেষ করতে চাইছিল না। ভাটের বাড়ি থেকে লতিফ আহমেদ ওয়াজার বাড়ির দূরত্ব ১০ মিনিটের পথ। সেখানেও একই দৃশ্য। তাকে ঘিরে তার আত্মীয়স্বজনরা ঘিরে বসে আছেন। যখনই কেউ দেখা করতে আসেন, ওয়াজা আগে মা’র দিকে তাকান। তিনি যেন পরিচয় করিয়ে দেন। দিল্লি পুলিশের কাছে গ্রেফতার হওয়ার সময় ওয়াজার বয়স ছিলো ১৯ বছর। ওয়াজা বলেন, ‘আমি ভাগ্যের কাছে হার মেনে নিয়েছিলাম। আমি কারাগারে রাজেশকে চিনতাম, রাকেশকে চিনতাম। মুনা বজরঙ্গীকে চিনতাম, তার বোন আমাকে রাখি বাঁধত। কিন্তু আমি আমার আত্মীয়দেরই চিনি না। সামলেতি ও লাজপাত নগরের বিস্ফোরণ ছাড়াও তাকে আহমেদাবাদ ও রাজস্থানের বোমা হামলাতেও অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি জানান, গ্রেফতারের পর গুজরাট পুলিশ তাকে এমনভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল যে তিনি কোনও উত্তর দেননি। তিনি বলেন, আমি পুলিশকে বলেছিলাম যে আমি এসবের কিছুই জানি না। তখন তারা রেগে যায়। তবে তারা আমাকে আশা দিয়েছিল যে তারা প্রমাণ করবেন যে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। ওয়াজা বলেন, তাকে যখন তিহার থেকে রাজস্থানে নেয়া হয় তখন আগে ১২১ ও ১২২ ধারায় ফাঁসানো হয়। তিনি বলেন, এর এক বছর পর তাকে ওই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ওয়াজা জানান, তিনি ভালো ক্রিকেট খেলতেন এবং নেপাল ক্রিকেট দলে সুযোগও পেয়েছিলেন। কিন্তু তার শেষ পর্যন্ত তিহারে কারাবন্দীদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে হয়েছে। ২০০৫ সালে ওয়াজাকে কারাগারে দেখতে গিয়েছিলেন তার বাবা। কিন্তু সেই কষ্ট সহ্য করতে পারেননি। বাড়ি ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর সেই অসুস্থতাতেই তার মৃত্যু হয়। ওয়াজা বলেন, আমি বাবার মৃত্যুর এক মাস পরে এই সংবাদ শুনতে পাই। ওয়াজা বলেন, কারাগারেও কাশ্মীরিরা বিদ্বেষের শিকার হন।

পুলওয়ামায় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার পর ওয়াজাসহ ১৪ জন কাশ্মীরিকে অন্যান্য বন্দীরা পেটাতে শুরু করেন। ওয়াজার বাড়ি অনেক কাছেই মির্জা নিসারের বাড়ি। গ্রেফতারের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। তিনি জানান, এ মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া তার কাছে স্বপ্নের মতো। তিনি বলেন, ‘আমি এখনও ওই কারাগার নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে। আমি নিজের বিছানায় ঘুমাতেই পারি না।’ আলি ভাট, ওয়াজা ও নিসার তিনজনই বলেন, আইনজীবী, বিচার কিংবা তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারাও জানতেন তারা নির্দোষ। কিন্তু তারপরও তারা এ মামলা টেনে গেছেন। ওয়াজা বলেন, আমার মনে আছে একজন সিনিয়র অফিসার বলেছিলেন যে এই মামলার সঙ্গে কাশ্মীরিদের কোন সংযোগ নেই। এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণও নেই।

বুধবার, ৩১ জুলাই ২০১৯ , ১৬ শ্রাবন ১৪২৫, ২৭ জিলকদ ১৪৪০

বিনা অপরাধে ২৩ বছরের কারাজীবন

সংবাদ ডেস্ক

২৩ বছর আগে যখন গ্রেফতার হন, তখন মোহাম্মদ আলি ভাটের বয়স ছিল ২৫ বছর। ১৯৯৬ সালে দিল্লি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এরপর কারাগারে কেটে যায় দুই দশকের বেশি। এই সময়ের মধ্যে হারিয়েছেন বাবা-মাকে। এখন কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে ফিরে এলেও সবকিছুই অচেনা তার। কাউকেই চিনতে পারছেন না। একই রকমের ঘটনা ঘটেছে আরও দুই কাশ্মীরির ক্ষেত্রেও। দুই দশকেরও বেশি সময় বিনা অপরাধে কারাগারে বন্দী থাকার পর আদালত তাদের বেকসুর খালাস দিয়েছেন।

১৯৯৬ সালে ভারতের লাজপাঁ নগর মার্কেটে একটি বোমা হামলায় ১৪ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও ৩৯ জন। এছাড়া রাজস্থান ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন আরএসটিসির একটি বাসে হামলার ঘটনায় প্রাণ হারান ১৪ জন। ওই দুই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ভাটকে গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ ২২ জুলাই রাজস্থান হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান ভাট। তার সঙ্গে আরও মুক্তি পায় আবদুল গনি, মির্জা নিসার হুসেন, লতিফ আহবেদ রাজা ও জাভেদ খান। তবে মুক্তির পর ভাট, হুসেন ও ওয়াজার জীবন একদম পাল্টে গেছে। পৃথিবীর স্বাভাবিক আলো থেকে যে তারা দূরে ছিলেন ২৩টি বছর। আলি ভাট বলেন, নির্দোষ হলেও তার কাছে কোনও প্রমাণ ছিল না। তারপরও ২০ বছরের বেশি সময় তাকে কারাগারে থাকতে হলো। যখন মুক্তি পেয়েছেন, তখন বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। বাবা মারা গিয়েছেন ২০১৬ সালে। মা আরও আগে, ২০০২। মুক্তি পেয়েই তাদের কবরের কাছে চলে যান ভাট। এরপর বাড়ি ফেরেন আলি। সেখানে অনেক মানুষ তাকে দেখতে জড়ো হন। সবাই জিজ্ঞাসা করতে থাকেন যে তাকে চিনতে পেরেছেন কিনা। কিন্তু আগে দেখা হওয়া সত্ত্বেও অনেককে চিনতে পারেননি আলি। ওই ব্যক্তি বলেন, আমি তোমার সঙ্গে কয়েক বছর তিহারে ছিলাম। আমাকেও অপরাধী ভাবা হয়েছিল। পরে মুক্তি পেয়েছি। ভাট বলেন, তিনি কারাগারে বসে একবারই একটি ঘুড়ির কাগজ ও ভাঙা পেন্সিল দিয়ে চিঠি পাঠাতে পেরেছিলেন।

এরপর কারও সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ হয়নি তার। কারা কর্তৃপক্ষে জানায়, তারা বন্দীদের চিঠি নিজেদের কাছেই রেখে দিত। এক সময় যোগাযোগ থেকে দূরে থাকা আলি ভাট বলেন, এখন তার ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা তাকে মোবাইল ফোন দিতে চায়। বলেই হেসে ওঠনে তিনি। ভারতের ধীরগতির বিচারিক ব্যবস্থা নিয়ে আলি ভাট বলেন, যদি ঠিকমতো কার্যক্রম পরিচালনা হতো তাহলে হয়তো বছরখানেকের মধ্যেই মুক্তি পেতেন তিনি। কিন্তু কেউই এ মামলা শেষ করতে চাইছিল না। ভাটের বাড়ি থেকে লতিফ আহমেদ ওয়াজার বাড়ির দূরত্ব ১০ মিনিটের পথ। সেখানেও একই দৃশ্য। তাকে ঘিরে তার আত্মীয়স্বজনরা ঘিরে বসে আছেন। যখনই কেউ দেখা করতে আসেন, ওয়াজা আগে মা’র দিকে তাকান। তিনি যেন পরিচয় করিয়ে দেন। দিল্লি পুলিশের কাছে গ্রেফতার হওয়ার সময় ওয়াজার বয়স ছিলো ১৯ বছর। ওয়াজা বলেন, ‘আমি ভাগ্যের কাছে হার মেনে নিয়েছিলাম। আমি কারাগারে রাজেশকে চিনতাম, রাকেশকে চিনতাম। মুনা বজরঙ্গীকে চিনতাম, তার বোন আমাকে রাখি বাঁধত। কিন্তু আমি আমার আত্মীয়দেরই চিনি না। সামলেতি ও লাজপাত নগরের বিস্ফোরণ ছাড়াও তাকে আহমেদাবাদ ও রাজস্থানের বোমা হামলাতেও অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি জানান, গ্রেফতারের পর গুজরাট পুলিশ তাকে এমনভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল যে তিনি কোনও উত্তর দেননি। তিনি বলেন, আমি পুলিশকে বলেছিলাম যে আমি এসবের কিছুই জানি না। তখন তারা রেগে যায়। তবে তারা আমাকে আশা দিয়েছিল যে তারা প্রমাণ করবেন যে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। ওয়াজা বলেন, তাকে যখন তিহার থেকে রাজস্থানে নেয়া হয় তখন আগে ১২১ ও ১২২ ধারায় ফাঁসানো হয়। তিনি বলেন, এর এক বছর পর তাকে ওই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ওয়াজা জানান, তিনি ভালো ক্রিকেট খেলতেন এবং নেপাল ক্রিকেট দলে সুযোগও পেয়েছিলেন। কিন্তু তার শেষ পর্যন্ত তিহারে কারাবন্দীদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে হয়েছে। ২০০৫ সালে ওয়াজাকে কারাগারে দেখতে গিয়েছিলেন তার বাবা। কিন্তু সেই কষ্ট সহ্য করতে পারেননি। বাড়ি ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর সেই অসুস্থতাতেই তার মৃত্যু হয়। ওয়াজা বলেন, আমি বাবার মৃত্যুর এক মাস পরে এই সংবাদ শুনতে পাই। ওয়াজা বলেন, কারাগারেও কাশ্মীরিরা বিদ্বেষের শিকার হন।

পুলওয়ামায় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার পর ওয়াজাসহ ১৪ জন কাশ্মীরিকে অন্যান্য বন্দীরা পেটাতে শুরু করেন। ওয়াজার বাড়ি অনেক কাছেই মির্জা নিসারের বাড়ি। গ্রেফতারের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। তিনি জানান, এ মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া তার কাছে স্বপ্নের মতো। তিনি বলেন, ‘আমি এখনও ওই কারাগার নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে। আমি নিজের বিছানায় ঘুমাতেই পারি না।’ আলি ভাট, ওয়াজা ও নিসার তিনজনই বলেন, আইনজীবী, বিচার কিংবা তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারাও জানতেন তারা নির্দোষ। কিন্তু তারপরও তারা এ মামলা টেনে গেছেন। ওয়াজা বলেন, আমার মনে আছে একজন সিনিয়র অফিসার বলেছিলেন যে এই মামলার সঙ্গে কাশ্মীরিদের কোন সংযোগ নেই। এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণও নেই।