আসছে নতুন মুদ্রানীতি

ড. মিহির কুমার রায়

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাঙ্ক্ষিত জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বাজারে মুদ্রা ও ঋণ সরবরাহ সম্পর্কে একটি আগাম ধারণা দিতে প্রতি ছয় মাস অন্তর মুদ্রানীতি ঘোষণা করে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যুরোর তথ্য মতে সদ্য শেষ হওয়া (২০১৮-১৯) অর্থবছরে প্রথমবার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অর্জিত হয়েছে ৮.৩ শতাংশ এবং চলতি বছর (২০১৯-২০) সদ্য ঘোষিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮.৫ শতাংশ। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৮-১৯) মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫.৬ শতাংশ যদিও বছর শেষে মূল্যস্ফীতির সার্বিক গড় দাঁড়ায় টার্গেটের ছেয়ে ও কম অর্থাৎ ৫.৪৭ শতাংশ। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি ছিল মে মাসে (৫.৬৩ শতাংশ)। বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয় বাজেটে ঘোষিত দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাজারে মুদ্রা সরবরাহ করে থাকে যা একটি চলমান প্রক্রয়া এবং তারই অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরে দু’বার (জানুয়ারি-জুন ও জুলাই-জিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথমার্ধের জুলাই-ডিসেম্বরের মুদ্রানীতির প্রণয়নের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে এবং আজই ঘোষণা করা হবে। এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৮ জুলাই সোমবার প্রধান কার্যালয়ে ব্যাংক নির্বাহীদের নিয়ে অন্যান্য বারের মতো এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে মুদ্রানীতির দৃষ্টি ভঙ্গি নির্ধারণের জন্য। ব্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত তারল্য না থাকায় ঋণ প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মখুীন এবং পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত ঋণ সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা রয়েই যাবে। এর কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে ব্যাংকগুলোতে ঋণ ও আমানত (এসডিআর) অনুপাত অনুকূলে না থাকায় মূলধন ঘাটতি বিদ্যমান এবং খেলাপি ঋণ যার পরিমাণ বিগত মার্চ মাস পর্যন্ত ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা যা দেশে মোট বিনিয়োগের প্রায় ১২ শতাংশ যা এ পরিস্থিতিকে আরও উৎসাহিত করে চলছে। সরকার এ ব্যাপারে পরিস্থিতির উন্নতির চেষ্টা চালাচ্ছে এবং এর মধ্যে ঘোষণাও আসছে যে শতকরা ২ ভাগ টাকা পরিশোধ করে ১০ বছরের মতো ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাবে ঋণ খেলাপিরা ৯ শতাংশ সুদে। যদিও এই সময়ে তারা কোন নতুন ঋণ নিতে পারবে না।

এসব কারণে নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি যা গত মে মাস পর্যন্ত ছিল ১২.১৬ শতাংশ এবং আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ওপর ঋণ সঞ্চয় (এডিআর) অনুপাত সমন্বয়ের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর একটি চাপ অব্যাহত থাকবে বিধায় আগামী ছয় মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ খুব একটা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করে না এ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা। এ অবস্থার বিবেচনায় চলতি মাসের শেষে ঘোষিতব্য মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা প্রয়োজন বাস্তবতার নিরিখে যা বাস্তবায়নযোগ্য হবে। এ ব্যাপারে প্রতিবারের মতো এইবারেও রাজধানীর খ্যাতনামা হোটেলে দেশের অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, সাংবাদিক ও গবেষকদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন চলছে। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বেসরকারি ঋণ প্রবাহ কমিয়ে ধরলে সরকারের প্রক্ষেপিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে কিনা যে বিষয়ে তক বির্তক রয়েছে। কারণ চলতি মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা গড়ে ১৬ শতাংশ কিন্তু প্রকৃত অর্জন ১৩ শতাংশ কম হতে পারে যার জোগান দিয়ে এবার ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে। তাই নতুন মুদ্রানীতিতে (জুলাই-ডিসেম্বর) বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে রাখলেও ৮ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। কারণ বেসরকারি বিনিয়োগ কমলেও সরকারি বিনিয়োগ রাড়বে বিশেষত পদ্মা সেতু মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পের কারণে। কিন্তু বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা কম যা দিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি।

বর্তমানে দেশে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৮৮৮ মার্কিন ডলার হলেও দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের উপরে রয়েছে যা দিনে দিনে বৃদ্ধির প্রবণতা বিদ্যমান। বাংলাদেশ আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল/ মধ্যআয়ের দেশে যাওয়ার পথে রয়েছে যেখানে জিডিপিতে বিনিয়োগের হার হতে হবে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বাধ্যতামূলক যা বর্তমানে রয়েছে ৩২ শতাংশ। এ বিষয়টি অবশ্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিবেচনায় রেখে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করবে যা বাস্তবায়নযোগ্য। প্রতি বছরই যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয় তার বৈশিষ্ট্যগুলো অভিন্ন ও গতানুগতিক বলে মনে হয় যেমন বেসরকারি-সরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতির হার, সুদের হার, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাজার শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি। এসব বৈশিষ্ট্যগুলোর বাস্তবায়ন কতটুকু কিভাবে সংগঠিত হচ্ছে বা হবে তার কোন বিশ্লেষন বিগত মুদ্রানীতির ঘোষণাপত্রগুলোতে উল্লিখিত হয়নি। যার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার গতানুগতিক ছক থেকে বেড়িয়ে আসার যে প্রচেষ্টা তা পরিলক্ষিত হওয়ার সময় এসেছে। মুদ্রানীতির বিশ্লেষকরা তাত্ত্বিক (theoretical) ভাবে বলছেন মুদ্রানীতি হলো কতগুলো আইন (rules and regulations) যা দিয়ে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় কতগুলো পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যা বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২-এর দলিলে উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে মুদ্রা চালু, টাকার মূল্যমান নির্ধারণ, অন্য মুদ্রার বিপরীতে আর্থিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধি ইত্যাদি। তিনটি চলক মুদ্রানীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে যা হলো : (১) হাতিয়ার (২) লক্ষ্যমাত্রা ও উদ্দেশ্য এবং (৩) মাধ্যমিক চলক (intermediate variables) যেমন সুদের হার, ব্যাংকের স্তিতি (reserve)ও মুদ্রা সরবরাহ (money supply) ইত্যাদি। এইসব হাতিয়ার বা উদ্দেশ্য কতটুকু তুলনামূলক নিপুণতার সঙ্গে কাজ করবে যার সঙ্গে মুদ্রানীতির সফলতা-বিফলতা নির্ভর করছে তা হলো : ক) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার (independence) ব্যাপ্তি (gravity) কতটুকু (খ) রাজস্ব নীতিরব্যাপ্তি অথনীতিতে কতটুকু গভীরে (গ) দেশের অথনৈতিক কাঠামো (আর্থিক ও অআথিক খাত), সনাতনী খাত বনাব আধুনিক খাত (ঘ) ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নের স্থর (জিডিপিতে ঋণও সঞ্চয়ের হার (ঙ) অথনীতি কতটুকু উদার (ট্রেড জিডিপির অনুপাত) (চ) সার্বিক ভাবে ব্যাংকিং খাতের জন্য খেলার ক্ষেত্র সমতল (level playing field) কিনা এবং (ছ) আইন ও বিধিবিধান কার্যকরী ভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের গতানুগতিক ছক থেকে বেরিয়ে এসে এসব হাতিয়ারের ভিত্তিতে মুদ্রানীতিকে সাজাতে অসুবিধে কোথায় ? এ বাজেটে (২০১৯-২০) দুটি বিষয় বিশেষ ভাবে উল্লেখিত হয়েছে যেমন খেলাপি ঋণ এবং কালো টাকা সাদাকরণ যা এর আগে সেভাবে আসেনি । তাই এই মেয়াদের ঘোষিতব্য মুদ্রানীতিতে যে সব বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে তা হলো: এক, ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণে ব্যাংকের মুনাফা কমবে, তারল্য সংকট বাড়বে এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় স্থবিরতাকে উৎসাহিত করবে। এ সমস্যাটি সরকারি ব্যাংকেই প্রধ্যান্য বিস্তার করছে যার কারণে সরকারকে মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বাজেট কঠামো থেকে কোটি কোটি টাকা সহায়ক বাজেট সাপোর্ট দিতে হচ্ছে। এ বিষয়টি একান্তই ব্যাংকিং খাতের বিষয় যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অভিভাবক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু বাস্তাবে দেখা যাচ্ছে এই কাজটি করছে অর্থ মন্ত্রণালয় বিশেষত: নীতি প্রণয়ন সুপারিশ, সংসদে প্রশ্নোত্তোর ও ঋণ খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ। এখন প্রশ্নটি হলো ব্যাংকের আমানতের অর্থ জনগণের, লালন করছে ব্যাংকে ও সুদ মওকুফ কিংবা রিসিডিউইলিং করছে সরকার। আবার ২ শতাংশ ঋণ পরিশোধ করে শতকরা ৯ ভাগ হারে সুদ দিয়ে আগমী দশ বছরের মধ্যে ঋণ ফেরত কিংবা খেলাপির অপবাদ থেকে মুক্তি ইত্যাদি সব করছে সরকার যদিও কাজটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখতিয়ার। এটি একটি সংবিধিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান যার চাকরি নীতিমালা (service rules) ভিন্ন, কর্ম পরিধি কিংবা কাজের কৃষ্টি (work culture) ভিন্ন, বেতন ভাতা হলেও আনুষঙ্গিক সুবিধা ভিন্ন এবং সমাজে একটি বিশেষ আমেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বস্ব মহিমায়। তাহলে কি ক্ষমতার অনুশীলনে ঘাটতি রয়েছে? নেপাল রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সে দেশের কু-ঋণ মোট ঋণের মাত্র ৩ শতাংশ যেখানে সিআরআর ও এসএলআর অনেক বেশি। সেই দেশাটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ খেলাপিদের সামাজিক ভাবে হেয়প্রতিপন্নসহ এমনকি দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত করে আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে যা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে যা মুদ্রানীতিতে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা বাঞ্ছনীয় ; দ্বিতীয়ত, দেশের তফসিলভুক্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের আধিপত্য থাকায় সুদের হার কমানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। যদিও সরকার এক ডিজিট সুদের হার (ঋণের সুদ ৯% এবং আমনতের সুদ ৩%) নামিয়ে আনার ব্যাপারে একটি ঘোষণা দিয়েছিল গত বছরে (২০১৮) কিন্তু সকর ব্যাংক বিষেশত ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করে চলছে এ যুক্তিতে যে ৩% ব্যবধানে (spread) ব্যাংকের মুনাফা করা কোন ভাবেই সম্ভব নয় যার জন্য ন্যূনতম হার বিস্তার ৫% হওয়া উচিত। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি নির্দেশনা আসে সিআরআর ১ শতাংশ কমিয়ে আনর জন্য বিষেশত: বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের দাবির পরি প্রেক্ষিতে। এতে করে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ব্যাংকারদের কাছে চলে আসে। এর পরপর মিডিয়াতে প্রশ্ন রাখা হলো নির্বাচনের আগে এ বাড়াতি অর্থ সরবারহ অর্থনীতিতে কি প্রভাব ফেলবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেনই বা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল এ সিদ্ধান্ত পালনে। এ ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ ও সুশাসন আগমী মুদ্রনীতিতে বিশ্লেষণের দাবি রাখে : তৃতীয়ত, বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মতে বিনিয়োগ বান্ধব ব্যবসার পরিবেশের র‌্যাংকিং এ ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৪। এতে করে বিনিয়োগের দিক থেকে আমরা আনেক পিছিয়ে আছি খেলাপি ঋণের কারণে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী বিধায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল ব্যাংক হার (bank rate) কমানো। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এটি ৫% এর মধ্যে অপরিবর্তিত রয়েছে। আগামী মুদ্রানীতিতে ব্যাংক হার অর্থাৎ রেপো ও রিভার্স রেপো সুদের হার কমিয়ে আনার প্রস্তাব থাকবে। কারণ নীতি সুদের হার কমলে ব্যাংকের লেনদেনের খরচ কমবে এবং আরও কম সুদে ব্যাংকগুলো ঋণের জোগান দিতে পারবে। ব্যবসায়ীসহ সমাজের অন্যান্য উদ্যোক্তারা আরও বিনিয়োগের প্রতি উৎসাহিত হতে পারবে এবং কোন কোন ব্যাংকের অধিক তারল্যের সমস্যা দূর হতে পারবে; চতুর্থত, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়নের হার শতকরা ৯৪ ভাগ যা খুবই আশাপ্রদ যার ভিতর দিয়ে সরকারি খাতের বিনিয়োগের একটি চিত্র পাওয়া যায় যদিও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক ভাবে কম হলেও এটা বলা যায় যে দেশে বিনিয়োগ থেমে নেই। স্থির বাজার মূল্যে বিগত তিন বছরে সরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে প্রতি বছরে গড় ১৪ শতাংশ হারে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে ৬.৯৩ শতাংশ হারে যা অবশ্য বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ভালো করছে তার সূচকের মানদন্ডে বিধায় এখনই প্রকৃত সময় প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, সঞ্চয়, মাথাপিছু আয়, কর আদায় ইত্যাদির লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির অনুপাত বাড়িয়ে নির্ধারিত করা যার নির্দেশনা আগামী মুদ্রানীতিতে আসা উচিত : পঞ্চমত, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নীতিনির্ধারণী বিষয় যেমন খেলাপি ঋণ, ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা, পুঁজি বাজার ও বন্ড মার্কেট উন্নয়ন, পুঁজি বাজার থেকে মূলধন সংগ্রহে উদ্যোক্তাদের উৎসাহ প্রদান, শেয়ার বাজারে মাল্টিন্যাশনালের কোম্পানিগুলোর অন্তর্ভুক্তিকরণ, প্রযুক্তি নির্ভর গ্রীন হাউজ ভিত্তিক বাণিজ্যিক কৃষি খামার প্রতিষ্ঠায় ঋণ কর্মসূচি প্রচলন, কৃষি ও পল্লী অর্থনীতিতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো ইত্যাদি বিষয়গুলো আগামী মুদ্রানীতিতে ঘোষণা সংযোজন হতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার তার নিকটবর্তী প্রতিবেশীগুলোর তুলনায় একটি স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতি ধরে রাখতে পেরেছে যা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ থেকে জানা গেছে। সেই প্রেক্ষিতে বলা যায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রথমার্ধের ঘোষিতব্য মুদ্রানীতিতে এ সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পূর্বে ঘোষিত বিয়ষগুলোর প্রতি নির্দেশনা থাকা উচিত।

[লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি ও সাবেক জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা]

mihir.city@gmail.com

বুধবার, ৩১ জুলাই ২০১৯ , ১৬ শ্রাবন ১৪২৫, ২৭ জিলকদ ১৪৪০

আসছে নতুন মুদ্রানীতি

ড. মিহির কুমার রায়

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাঙ্ক্ষিত জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বাজারে মুদ্রা ও ঋণ সরবরাহ সম্পর্কে একটি আগাম ধারণা দিতে প্রতি ছয় মাস অন্তর মুদ্রানীতি ঘোষণা করে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যুরোর তথ্য মতে সদ্য শেষ হওয়া (২০১৮-১৯) অর্থবছরে প্রথমবার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অর্জিত হয়েছে ৮.৩ শতাংশ এবং চলতি বছর (২০১৯-২০) সদ্য ঘোষিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮.৫ শতাংশ। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৮-১৯) মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫.৬ শতাংশ যদিও বছর শেষে মূল্যস্ফীতির সার্বিক গড় দাঁড়ায় টার্গেটের ছেয়ে ও কম অর্থাৎ ৫.৪৭ শতাংশ। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি ছিল মে মাসে (৫.৬৩ শতাংশ)। বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয় বাজেটে ঘোষিত দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাজারে মুদ্রা সরবরাহ করে থাকে যা একটি চলমান প্রক্রয়া এবং তারই অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরে দু’বার (জানুয়ারি-জুন ও জুলাই-জিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথমার্ধের জুলাই-ডিসেম্বরের মুদ্রানীতির প্রণয়নের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে এবং আজই ঘোষণা করা হবে। এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৮ জুলাই সোমবার প্রধান কার্যালয়ে ব্যাংক নির্বাহীদের নিয়ে অন্যান্য বারের মতো এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে মুদ্রানীতির দৃষ্টি ভঙ্গি নির্ধারণের জন্য। ব্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত তারল্য না থাকায় ঋণ প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মখুীন এবং পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত ঋণ সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা রয়েই যাবে। এর কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে ব্যাংকগুলোতে ঋণ ও আমানত (এসডিআর) অনুপাত অনুকূলে না থাকায় মূলধন ঘাটতি বিদ্যমান এবং খেলাপি ঋণ যার পরিমাণ বিগত মার্চ মাস পর্যন্ত ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা যা দেশে মোট বিনিয়োগের প্রায় ১২ শতাংশ যা এ পরিস্থিতিকে আরও উৎসাহিত করে চলছে। সরকার এ ব্যাপারে পরিস্থিতির উন্নতির চেষ্টা চালাচ্ছে এবং এর মধ্যে ঘোষণাও আসছে যে শতকরা ২ ভাগ টাকা পরিশোধ করে ১০ বছরের মতো ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাবে ঋণ খেলাপিরা ৯ শতাংশ সুদে। যদিও এই সময়ে তারা কোন নতুন ঋণ নিতে পারবে না।

এসব কারণে নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি যা গত মে মাস পর্যন্ত ছিল ১২.১৬ শতাংশ এবং আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ওপর ঋণ সঞ্চয় (এডিআর) অনুপাত সমন্বয়ের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর একটি চাপ অব্যাহত থাকবে বিধায় আগামী ছয় মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ খুব একটা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করে না এ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা। এ অবস্থার বিবেচনায় চলতি মাসের শেষে ঘোষিতব্য মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা প্রয়োজন বাস্তবতার নিরিখে যা বাস্তবায়নযোগ্য হবে। এ ব্যাপারে প্রতিবারের মতো এইবারেও রাজধানীর খ্যাতনামা হোটেলে দেশের অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, সাংবাদিক ও গবেষকদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন চলছে। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বেসরকারি ঋণ প্রবাহ কমিয়ে ধরলে সরকারের প্রক্ষেপিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে কিনা যে বিষয়ে তক বির্তক রয়েছে। কারণ চলতি মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা গড়ে ১৬ শতাংশ কিন্তু প্রকৃত অর্জন ১৩ শতাংশ কম হতে পারে যার জোগান দিয়ে এবার ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে। তাই নতুন মুদ্রানীতিতে (জুলাই-ডিসেম্বর) বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে রাখলেও ৮ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। কারণ বেসরকারি বিনিয়োগ কমলেও সরকারি বিনিয়োগ রাড়বে বিশেষত পদ্মা সেতু মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পের কারণে। কিন্তু বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা কম যা দিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি।

বর্তমানে দেশে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৮৮৮ মার্কিন ডলার হলেও দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের উপরে রয়েছে যা দিনে দিনে বৃদ্ধির প্রবণতা বিদ্যমান। বাংলাদেশ আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল/ মধ্যআয়ের দেশে যাওয়ার পথে রয়েছে যেখানে জিডিপিতে বিনিয়োগের হার হতে হবে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বাধ্যতামূলক যা বর্তমানে রয়েছে ৩২ শতাংশ। এ বিষয়টি অবশ্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিবেচনায় রেখে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করবে যা বাস্তবায়নযোগ্য। প্রতি বছরই যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয় তার বৈশিষ্ট্যগুলো অভিন্ন ও গতানুগতিক বলে মনে হয় যেমন বেসরকারি-সরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতির হার, সুদের হার, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাজার শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি। এসব বৈশিষ্ট্যগুলোর বাস্তবায়ন কতটুকু কিভাবে সংগঠিত হচ্ছে বা হবে তার কোন বিশ্লেষন বিগত মুদ্রানীতির ঘোষণাপত্রগুলোতে উল্লিখিত হয়নি। যার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার গতানুগতিক ছক থেকে বেড়িয়ে আসার যে প্রচেষ্টা তা পরিলক্ষিত হওয়ার সময় এসেছে। মুদ্রানীতির বিশ্লেষকরা তাত্ত্বিক (theoretical) ভাবে বলছেন মুদ্রানীতি হলো কতগুলো আইন (rules and regulations) যা দিয়ে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় কতগুলো পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যা বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২-এর দলিলে উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে মুদ্রা চালু, টাকার মূল্যমান নির্ধারণ, অন্য মুদ্রার বিপরীতে আর্থিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধি ইত্যাদি। তিনটি চলক মুদ্রানীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে যা হলো : (১) হাতিয়ার (২) লক্ষ্যমাত্রা ও উদ্দেশ্য এবং (৩) মাধ্যমিক চলক (intermediate variables) যেমন সুদের হার, ব্যাংকের স্তিতি (reserve)ও মুদ্রা সরবরাহ (money supply) ইত্যাদি। এইসব হাতিয়ার বা উদ্দেশ্য কতটুকু তুলনামূলক নিপুণতার সঙ্গে কাজ করবে যার সঙ্গে মুদ্রানীতির সফলতা-বিফলতা নির্ভর করছে তা হলো : ক) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার (independence) ব্যাপ্তি (gravity) কতটুকু (খ) রাজস্ব নীতিরব্যাপ্তি অথনীতিতে কতটুকু গভীরে (গ) দেশের অথনৈতিক কাঠামো (আর্থিক ও অআথিক খাত), সনাতনী খাত বনাব আধুনিক খাত (ঘ) ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নের স্থর (জিডিপিতে ঋণও সঞ্চয়ের হার (ঙ) অথনীতি কতটুকু উদার (ট্রেড জিডিপির অনুপাত) (চ) সার্বিক ভাবে ব্যাংকিং খাতের জন্য খেলার ক্ষেত্র সমতল (level playing field) কিনা এবং (ছ) আইন ও বিধিবিধান কার্যকরী ভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের গতানুগতিক ছক থেকে বেরিয়ে এসে এসব হাতিয়ারের ভিত্তিতে মুদ্রানীতিকে সাজাতে অসুবিধে কোথায় ? এ বাজেটে (২০১৯-২০) দুটি বিষয় বিশেষ ভাবে উল্লেখিত হয়েছে যেমন খেলাপি ঋণ এবং কালো টাকা সাদাকরণ যা এর আগে সেভাবে আসেনি । তাই এই মেয়াদের ঘোষিতব্য মুদ্রানীতিতে যে সব বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে তা হলো: এক, ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণে ব্যাংকের মুনাফা কমবে, তারল্য সংকট বাড়বে এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় স্থবিরতাকে উৎসাহিত করবে। এ সমস্যাটি সরকারি ব্যাংকেই প্রধ্যান্য বিস্তার করছে যার কারণে সরকারকে মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বাজেট কঠামো থেকে কোটি কোটি টাকা সহায়ক বাজেট সাপোর্ট দিতে হচ্ছে। এ বিষয়টি একান্তই ব্যাংকিং খাতের বিষয় যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অভিভাবক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু বাস্তাবে দেখা যাচ্ছে এই কাজটি করছে অর্থ মন্ত্রণালয় বিশেষত: নীতি প্রণয়ন সুপারিশ, সংসদে প্রশ্নোত্তোর ও ঋণ খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ। এখন প্রশ্নটি হলো ব্যাংকের আমানতের অর্থ জনগণের, লালন করছে ব্যাংকে ও সুদ মওকুফ কিংবা রিসিডিউইলিং করছে সরকার। আবার ২ শতাংশ ঋণ পরিশোধ করে শতকরা ৯ ভাগ হারে সুদ দিয়ে আগমী দশ বছরের মধ্যে ঋণ ফেরত কিংবা খেলাপির অপবাদ থেকে মুক্তি ইত্যাদি সব করছে সরকার যদিও কাজটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখতিয়ার। এটি একটি সংবিধিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান যার চাকরি নীতিমালা (service rules) ভিন্ন, কর্ম পরিধি কিংবা কাজের কৃষ্টি (work culture) ভিন্ন, বেতন ভাতা হলেও আনুষঙ্গিক সুবিধা ভিন্ন এবং সমাজে একটি বিশেষ আমেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বস্ব মহিমায়। তাহলে কি ক্ষমতার অনুশীলনে ঘাটতি রয়েছে? নেপাল রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সে দেশের কু-ঋণ মোট ঋণের মাত্র ৩ শতাংশ যেখানে সিআরআর ও এসএলআর অনেক বেশি। সেই দেশাটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ খেলাপিদের সামাজিক ভাবে হেয়প্রতিপন্নসহ এমনকি দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত করে আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে যা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে যা মুদ্রানীতিতে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা বাঞ্ছনীয় ; দ্বিতীয়ত, দেশের তফসিলভুক্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের আধিপত্য থাকায় সুদের হার কমানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। যদিও সরকার এক ডিজিট সুদের হার (ঋণের সুদ ৯% এবং আমনতের সুদ ৩%) নামিয়ে আনার ব্যাপারে একটি ঘোষণা দিয়েছিল গত বছরে (২০১৮) কিন্তু সকর ব্যাংক বিষেশত ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করে চলছে এ যুক্তিতে যে ৩% ব্যবধানে (spread) ব্যাংকের মুনাফা করা কোন ভাবেই সম্ভব নয় যার জন্য ন্যূনতম হার বিস্তার ৫% হওয়া উচিত। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি নির্দেশনা আসে সিআরআর ১ শতাংশ কমিয়ে আনর জন্য বিষেশত: বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের দাবির পরি প্রেক্ষিতে। এতে করে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ব্যাংকারদের কাছে চলে আসে। এর পরপর মিডিয়াতে প্রশ্ন রাখা হলো নির্বাচনের আগে এ বাড়াতি অর্থ সরবারহ অর্থনীতিতে কি প্রভাব ফেলবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেনই বা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল এ সিদ্ধান্ত পালনে। এ ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ ও সুশাসন আগমী মুদ্রনীতিতে বিশ্লেষণের দাবি রাখে : তৃতীয়ত, বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মতে বিনিয়োগ বান্ধব ব্যবসার পরিবেশের র‌্যাংকিং এ ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৪। এতে করে বিনিয়োগের দিক থেকে আমরা আনেক পিছিয়ে আছি খেলাপি ঋণের কারণে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী বিধায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল ব্যাংক হার (bank rate) কমানো। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এটি ৫% এর মধ্যে অপরিবর্তিত রয়েছে। আগামী মুদ্রানীতিতে ব্যাংক হার অর্থাৎ রেপো ও রিভার্স রেপো সুদের হার কমিয়ে আনার প্রস্তাব থাকবে। কারণ নীতি সুদের হার কমলে ব্যাংকের লেনদেনের খরচ কমবে এবং আরও কম সুদে ব্যাংকগুলো ঋণের জোগান দিতে পারবে। ব্যবসায়ীসহ সমাজের অন্যান্য উদ্যোক্তারা আরও বিনিয়োগের প্রতি উৎসাহিত হতে পারবে এবং কোন কোন ব্যাংকের অধিক তারল্যের সমস্যা দূর হতে পারবে; চতুর্থত, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়নের হার শতকরা ৯৪ ভাগ যা খুবই আশাপ্রদ যার ভিতর দিয়ে সরকারি খাতের বিনিয়োগের একটি চিত্র পাওয়া যায় যদিও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক ভাবে কম হলেও এটা বলা যায় যে দেশে বিনিয়োগ থেমে নেই। স্থির বাজার মূল্যে বিগত তিন বছরে সরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে প্রতি বছরে গড় ১৪ শতাংশ হারে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে ৬.৯৩ শতাংশ হারে যা অবশ্য বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ভালো করছে তার সূচকের মানদন্ডে বিধায় এখনই প্রকৃত সময় প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, সঞ্চয়, মাথাপিছু আয়, কর আদায় ইত্যাদির লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির অনুপাত বাড়িয়ে নির্ধারিত করা যার নির্দেশনা আগামী মুদ্রানীতিতে আসা উচিত : পঞ্চমত, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নীতিনির্ধারণী বিষয় যেমন খেলাপি ঋণ, ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা, পুঁজি বাজার ও বন্ড মার্কেট উন্নয়ন, পুঁজি বাজার থেকে মূলধন সংগ্রহে উদ্যোক্তাদের উৎসাহ প্রদান, শেয়ার বাজারে মাল্টিন্যাশনালের কোম্পানিগুলোর অন্তর্ভুক্তিকরণ, প্রযুক্তি নির্ভর গ্রীন হাউজ ভিত্তিক বাণিজ্যিক কৃষি খামার প্রতিষ্ঠায় ঋণ কর্মসূচি প্রচলন, কৃষি ও পল্লী অর্থনীতিতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো ইত্যাদি বিষয়গুলো আগামী মুদ্রানীতিতে ঘোষণা সংযোজন হতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার তার নিকটবর্তী প্রতিবেশীগুলোর তুলনায় একটি স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতি ধরে রাখতে পেরেছে যা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ থেকে জানা গেছে। সেই প্রেক্ষিতে বলা যায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রথমার্ধের ঘোষিতব্য মুদ্রানীতিতে এ সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পূর্বে ঘোষিত বিয়ষগুলোর প্রতি নির্দেশনা থাকা উচিত।

[লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি ও সাবেক জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা]

mihir.city@gmail.com