নদী রক্ষায় শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ

সাহাদাৎ রানা

ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে। বলো কোথায় তোমার দেশ, তোমার নেই কি চলার শেষ, ও নদীরে...। শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নদী নিয়ে বিখ্যাত গান। নদী নিয়ে রয়েছে আরও অসংখ্য বিখ্যাত গান। নদী বিষয়বস্তু শুধু গানের মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকেনি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে নদী নিয়ে রচিত হয়েছে গল্প-কবিতা। সাহিত্যের একটা অংশজুড়ে নদীর বিচরণ। নদী মন ভালো করে দেয়ার উপকরণও। মন খারাপ হলে নদীর কাছে গেলে অনেকটা ভালো হয়ে যায়। তাই আমাদের জীবন ব্যবস্থা নয়, মন ভালো করার ক্ষেত্রেও নদীর আবেদন অপরিসীম। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি কতটুকু সত্য তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।

অবশ্য নদী শুধু মন ভালো করার বিষয় নয়, নদী হচ্ছে সভ্যতার এমন একটি কেন্দ্র যাকে ঘিরে গড়ে উঠে শহর। গড়ে উঠে নাগরিক সভ্যতা। পৃথিবীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে যা স্পষ্ট। অর্থাৎ প্রাচীনকাল থেকে সভ্যতাগুলো গড়ে ওঠার পেছনে নদীর অবদান অনেক বেশি। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কারণ বাংলাদেশ হচ্ছে নদীমাতৃক দেশ। তাই নদী আমাদের জীবন ব্যবস্থায় মিশে আছে অন্যরকমভাবে। সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে নদীর তুলনা অতুলনীয়। কারণ নদী ভালো থাকলে ভালো থাকে মানুষ। কেননা, নদী যেমন একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে অন্যদিকে, জীবন-জীবিকায়ও নদীর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবশ্য নদী বিষয়ে এই কথাটি সেভাবে সত্য নয়। অবশ্য এর জন্য দায়ী আমরা। দীর্ঘদিনের অবহেলা ও অনাদরে বাংলাদেশের নদীগুলো এখন দখল ও দূষণের কবলে নিমজ্জিত। তবে এতো হতাশার মধ্যেও আশার খবর হলো নদী বাঁচাতে সরকার সম্প্রতি বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে প্রধান লক্ষ্য হলো, নদ-নদীগুলো অবৈধ দখল ও ভরাটমুক্ত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। পাশাপাশি আগের মতো নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। কারণ এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেশের অর্থনীতি। যদি নদ-নদীগুলো অবৈধ দখল ও ভরাটমুক্ত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় তবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আরও বেশি সম্প্রসারণ হবে। পাশাপাশি সৃষ্টি হবে অনেক কর্মসংস্থানেরও।

একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। স্বাধীনতার পর দেশে ছোট বড় নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাতশ’র বেশি। কিন্তু বর্তমানে নদী টিকে আছে প্রায় অর্ধেক। তবে বেসরকারি হিসেবে যা আরও কম। বর্তমানে সারা দেশে টিকে থাকা ছোট বড় নদীর সংখ্যা ২৪০টির মতো। প্রায় ৪৮ বছরের পথ চলায় নদীর সংখ্যা কমে যাওয়ার আনুপাতিক হার বছরে প্রায় ১০টি করে নদীর অপমৃত্যু। যে কয়েকটি নদী টিকে আছে এর মধ্যে আবার অনেকগুলো রয়েছে দখল ও দূষণের তালিকায়। বিপন্ন নদীর হিসেবের খাতায় রয়েছে প্রায় ২০০টির মতো। দুঃখের বিষয় হলো দূষণ আর দখলের শিকার বাংলাদেশের প্রায় সব নদী। বিশেষ করে রাজধানী বা বড় শহরগুলোর নদীগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়। নদী রক্ষায় আইন আছে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নেই বাস্তবায়ন। তাই অনেকগুলো নদী আজ মৃতপ্রায়। তবে এত কিছুর পরও কিছু আশার খবর আছে নদী বিষয়ে। ইতোমধ্যে নদী বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে মহাপরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার তালিকায় রয়েছে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। সরকার নদীগুলো বাঁচাতে শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সামনে রেখে কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে সরকার ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নে প্রায় ২ হাজার ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ধরা হয়েছে। যেখানে ৬৪ জেলায় ৮৮টি নদী, ৩৫২টি খাল ৮টি জলাশয় খনন প্রকল্পের কাজ করা হবে। দীর্ঘ সময় পর হলেও সরকারের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ যেখানে নদীমাতৃক আমাদের দেশের নদীগুলো প্রায় হারাতে বসেছে। তাই এগুলো উদ্ধার করা না হলে আগামীর জন্য তা হতো ভয়াবহ। দেরিতে হলেও সরকারের এমন সিদ্ধান্ত সবাইকে আশান্বিত করছে।

নদী রক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য সরকার পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্তও নিয়েছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, নদীদখল ও দূষণ রোধ, নদী তীরের অবৈধ অবকাঠামো অপসারণ, নদী ভরাট রোধ, নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ রক্ষায় সহায়তা, নৌ চলাচলের উপযোগী করে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং নদীকে স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তিকে ‘বঙ্গবন্ধু নদী পদক’ দেয়ার সিদ্ধান্ত নি?য়ে?ছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। সরকারের এমন সিদ্ধান্তও সাধুবাদ পাওয়ার মতো। কারণ পুরস্কার মানুষকে ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই প্রতি বছরই এমন পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

কারণ নদীর সঙ্গে আমাদের অনেক কিছু জড়িত। প্রথমত নদী বাংলাদেশের প্রাণ প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে নদীকে কেন্দ্র করে দেশের একটি বড় অংশ জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বিশেষ করে ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে মৎস সম্পদ, ও জলজ প্রাণীর অস্বিত্ব টিকে থাকায় নদী অবদানের বিকল্প নেই। একটা শ্রেণী যারা মৎসজীবী, তারা প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল নদীকে কেন্দ্র করে। মাছ শিকার তাদের প্রধান ও একমাত্র পেশা। তাই নদী মরে গেলে মরে যায় তাদের বেঁচে থাকার স্বপ্নও। এছাড়া নৌ পথে চলাচল করে হাজার হাজার নৌযান। যাদের সবার উপার্যনের উৎসও নদীকে ঘিরে। এমন একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশে যাতায়াতের প্রধান পথ ছিল নদীপথ। এখনও দেশের নৌপথ অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছে যাতায়াত ব্যবস্থায়। বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে এখনো শিল্প কারখানা স্থাপনেও গুরুত্ব দেয়া হয় নদীপথে যোগাযোগের বিষয়টি মাথায় রেখে। যাতে খুব সহজে মালামাল পরিবহনে নদীকে ব্যবহার করা যায়। এতে যেমন দুর্ঘটনার ভয় থাকে কম তেমনি পরিবহন খরচও কম।

নদীকে কেন্দ্র করে আরও একটি সম্ভাবনাময় খাত আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে। নদীগুলোকে যদি তার স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয় তবে পর্যটন খাতের বিকাশ সম্ভব। যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে পর্যটন খাতকে বিকশিত করার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ। এছাড়া সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে এক্ষেত্রে। পাশাপাশি সবার মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করার কাজও করতে হবে।

সরকার যে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে নদী রক্ষায় সেখানে কয়েকটি কাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষ করে দূষণ রোধ করা। অবৈধ দখল আর অপরিকল্পিত নদী শাসনের ফলে ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে নদী, হারাচ্ছে নাব্যতা। আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা হলো অপরিকল্পিত ড্রেজিং। অপরিকল্পিত ড্রেজিং না করে পরিকল্পনা অনুযায়ী ড্রেজিং করতে হবে। আর ইচ্ছে মতো যেখানে-সেখানে বাঁধ নির্মাণ করা যাবে না। পাশাপাশি রাজধানীর ঢাকার আশে পাশের জেলার নদী তীরে এখন অসংখ্য সিমেন্ট কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব সিমেন্ট কারখানার ধুলা নদীতে মিশে নদীর পানি হচ্ছে দূষিত। জলজ প্রাণীর ক্ষতি হচ্ছে এতে। অপমৃত্যুর মুখে পড়ছে নদীগুলো। পরিবেশেরও ক্ষতি করছে সিমেন্ট কারখানাগুলো। তাই এসব সিমেন্ট কারাখানাগুলো নদী ও জনবহুল এলাকার বাহিরে হস্থান্তর করতে হবে।

নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে আরও একটি কাজ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে। যা নদী মৃত্যুর অন্যতম কারণ। কিন্তু এই কারণটা সবসময়ই আড়ালে থেকে যায়। বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত ঢাকা শহরের পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকার কারণে প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ ঘনমিটারেরও বেশি পয়োবর্জ্যরে প্রায় সবটাই উন্মুক্ত খাল, নদী, নর্দমা বেয়ে অপরিশোধিত অবস্থায় ঢাকার আশপাশের নদীতে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে দ্রুত মৃত্যু হচ্ছে নদীর। তাই আরও বর্জ্য শোধণাগার নির্মাণ করে নদী বাঁচাতে হবে। এতে রক্ষা পাবে পরিবেশ। কারণ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদীর গুরুত্ব ব্যাপক। যা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই আর সময় নষ্ট না করে নদী রক্ষায় সবার এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সরকারের শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের দিকে সবসময় মনোযোগী হতে হবে। যদিও নদী রক্ষায় শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান; বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলেও ভূমিকা রাখতে হবে সব নাগরিকদের। সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালনই পারে নদীকে বাঁচাতে। কারণ এতে বাঁচবে নাগরিকদের প্রাণই।

[ লেখক : সাংবাদিক ]

বুধবার, ৩১ জুলাই ২০১৯ , ১৬ শ্রাবন ১৪২৫, ২৭ জিলকদ ১৪৪০

নদী রক্ষায় শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ

সাহাদাৎ রানা

ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে। বলো কোথায় তোমার দেশ, তোমার নেই কি চলার শেষ, ও নদীরে...। শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নদী নিয়ে বিখ্যাত গান। নদী নিয়ে রয়েছে আরও অসংখ্য বিখ্যাত গান। নদী বিষয়বস্তু শুধু গানের মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকেনি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে নদী নিয়ে রচিত হয়েছে গল্প-কবিতা। সাহিত্যের একটা অংশজুড়ে নদীর বিচরণ। নদী মন ভালো করে দেয়ার উপকরণও। মন খারাপ হলে নদীর কাছে গেলে অনেকটা ভালো হয়ে যায়। তাই আমাদের জীবন ব্যবস্থা নয়, মন ভালো করার ক্ষেত্রেও নদীর আবেদন অপরিসীম। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি কতটুকু সত্য তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।

অবশ্য নদী শুধু মন ভালো করার বিষয় নয়, নদী হচ্ছে সভ্যতার এমন একটি কেন্দ্র যাকে ঘিরে গড়ে উঠে শহর। গড়ে উঠে নাগরিক সভ্যতা। পৃথিবীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে যা স্পষ্ট। অর্থাৎ প্রাচীনকাল থেকে সভ্যতাগুলো গড়ে ওঠার পেছনে নদীর অবদান অনেক বেশি। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কারণ বাংলাদেশ হচ্ছে নদীমাতৃক দেশ। তাই নদী আমাদের জীবন ব্যবস্থায় মিশে আছে অন্যরকমভাবে। সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে নদীর তুলনা অতুলনীয়। কারণ নদী ভালো থাকলে ভালো থাকে মানুষ। কেননা, নদী যেমন একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে অন্যদিকে, জীবন-জীবিকায়ও নদীর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবশ্য নদী বিষয়ে এই কথাটি সেভাবে সত্য নয়। অবশ্য এর জন্য দায়ী আমরা। দীর্ঘদিনের অবহেলা ও অনাদরে বাংলাদেশের নদীগুলো এখন দখল ও দূষণের কবলে নিমজ্জিত। তবে এতো হতাশার মধ্যেও আশার খবর হলো নদী বাঁচাতে সরকার সম্প্রতি বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে প্রধান লক্ষ্য হলো, নদ-নদীগুলো অবৈধ দখল ও ভরাটমুক্ত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। পাশাপাশি আগের মতো নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। কারণ এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেশের অর্থনীতি। যদি নদ-নদীগুলো অবৈধ দখল ও ভরাটমুক্ত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় তবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আরও বেশি সম্প্রসারণ হবে। পাশাপাশি সৃষ্টি হবে অনেক কর্মসংস্থানেরও।

একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। স্বাধীনতার পর দেশে ছোট বড় নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাতশ’র বেশি। কিন্তু বর্তমানে নদী টিকে আছে প্রায় অর্ধেক। তবে বেসরকারি হিসেবে যা আরও কম। বর্তমানে সারা দেশে টিকে থাকা ছোট বড় নদীর সংখ্যা ২৪০টির মতো। প্রায় ৪৮ বছরের পথ চলায় নদীর সংখ্যা কমে যাওয়ার আনুপাতিক হার বছরে প্রায় ১০টি করে নদীর অপমৃত্যু। যে কয়েকটি নদী টিকে আছে এর মধ্যে আবার অনেকগুলো রয়েছে দখল ও দূষণের তালিকায়। বিপন্ন নদীর হিসেবের খাতায় রয়েছে প্রায় ২০০টির মতো। দুঃখের বিষয় হলো দূষণ আর দখলের শিকার বাংলাদেশের প্রায় সব নদী। বিশেষ করে রাজধানী বা বড় শহরগুলোর নদীগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়। নদী রক্ষায় আইন আছে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নেই বাস্তবায়ন। তাই অনেকগুলো নদী আজ মৃতপ্রায়। তবে এত কিছুর পরও কিছু আশার খবর আছে নদী বিষয়ে। ইতোমধ্যে নদী বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে মহাপরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার তালিকায় রয়েছে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। সরকার নদীগুলো বাঁচাতে শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সামনে রেখে কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে সরকার ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নে প্রায় ২ হাজার ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ধরা হয়েছে। যেখানে ৬৪ জেলায় ৮৮টি নদী, ৩৫২টি খাল ৮টি জলাশয় খনন প্রকল্পের কাজ করা হবে। দীর্ঘ সময় পর হলেও সরকারের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ যেখানে নদীমাতৃক আমাদের দেশের নদীগুলো প্রায় হারাতে বসেছে। তাই এগুলো উদ্ধার করা না হলে আগামীর জন্য তা হতো ভয়াবহ। দেরিতে হলেও সরকারের এমন সিদ্ধান্ত সবাইকে আশান্বিত করছে।

নদী রক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য সরকার পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্তও নিয়েছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, নদীদখল ও দূষণ রোধ, নদী তীরের অবৈধ অবকাঠামো অপসারণ, নদী ভরাট রোধ, নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ রক্ষায় সহায়তা, নৌ চলাচলের উপযোগী করে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং নদীকে স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তিকে ‘বঙ্গবন্ধু নদী পদক’ দেয়ার সিদ্ধান্ত নি?য়ে?ছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। সরকারের এমন সিদ্ধান্তও সাধুবাদ পাওয়ার মতো। কারণ পুরস্কার মানুষকে ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই প্রতি বছরই এমন পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

কারণ নদীর সঙ্গে আমাদের অনেক কিছু জড়িত। প্রথমত নদী বাংলাদেশের প্রাণ প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে নদীকে কেন্দ্র করে দেশের একটি বড় অংশ জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বিশেষ করে ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে মৎস সম্পদ, ও জলজ প্রাণীর অস্বিত্ব টিকে থাকায় নদী অবদানের বিকল্প নেই। একটা শ্রেণী যারা মৎসজীবী, তারা প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল নদীকে কেন্দ্র করে। মাছ শিকার তাদের প্রধান ও একমাত্র পেশা। তাই নদী মরে গেলে মরে যায় তাদের বেঁচে থাকার স্বপ্নও। এছাড়া নৌ পথে চলাচল করে হাজার হাজার নৌযান। যাদের সবার উপার্যনের উৎসও নদীকে ঘিরে। এমন একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশে যাতায়াতের প্রধান পথ ছিল নদীপথ। এখনও দেশের নৌপথ অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছে যাতায়াত ব্যবস্থায়। বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে এখনো শিল্প কারখানা স্থাপনেও গুরুত্ব দেয়া হয় নদীপথে যোগাযোগের বিষয়টি মাথায় রেখে। যাতে খুব সহজে মালামাল পরিবহনে নদীকে ব্যবহার করা যায়। এতে যেমন দুর্ঘটনার ভয় থাকে কম তেমনি পরিবহন খরচও কম।

নদীকে কেন্দ্র করে আরও একটি সম্ভাবনাময় খাত আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে। নদীগুলোকে যদি তার স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয় তবে পর্যটন খাতের বিকাশ সম্ভব। যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে পর্যটন খাতকে বিকশিত করার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ। এছাড়া সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে এক্ষেত্রে। পাশাপাশি সবার মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করার কাজও করতে হবে।

সরকার যে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে নদী রক্ষায় সেখানে কয়েকটি কাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষ করে দূষণ রোধ করা। অবৈধ দখল আর অপরিকল্পিত নদী শাসনের ফলে ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে নদী, হারাচ্ছে নাব্যতা। আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা হলো অপরিকল্পিত ড্রেজিং। অপরিকল্পিত ড্রেজিং না করে পরিকল্পনা অনুযায়ী ড্রেজিং করতে হবে। আর ইচ্ছে মতো যেখানে-সেখানে বাঁধ নির্মাণ করা যাবে না। পাশাপাশি রাজধানীর ঢাকার আশে পাশের জেলার নদী তীরে এখন অসংখ্য সিমেন্ট কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব সিমেন্ট কারখানার ধুলা নদীতে মিশে নদীর পানি হচ্ছে দূষিত। জলজ প্রাণীর ক্ষতি হচ্ছে এতে। অপমৃত্যুর মুখে পড়ছে নদীগুলো। পরিবেশেরও ক্ষতি করছে সিমেন্ট কারখানাগুলো। তাই এসব সিমেন্ট কারাখানাগুলো নদী ও জনবহুল এলাকার বাহিরে হস্থান্তর করতে হবে।

নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে আরও একটি কাজ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে। যা নদী মৃত্যুর অন্যতম কারণ। কিন্তু এই কারণটা সবসময়ই আড়ালে থেকে যায়। বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত ঢাকা শহরের পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকার কারণে প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ ঘনমিটারেরও বেশি পয়োবর্জ্যরে প্রায় সবটাই উন্মুক্ত খাল, নদী, নর্দমা বেয়ে অপরিশোধিত অবস্থায় ঢাকার আশপাশের নদীতে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে দ্রুত মৃত্যু হচ্ছে নদীর। তাই আরও বর্জ্য শোধণাগার নির্মাণ করে নদী বাঁচাতে হবে। এতে রক্ষা পাবে পরিবেশ। কারণ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদীর গুরুত্ব ব্যাপক। যা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই আর সময় নষ্ট না করে নদী রক্ষায় সবার এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সরকারের শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের দিকে সবসময় মনোযোগী হতে হবে। যদিও নদী রক্ষায় শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান; বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলেও ভূমিকা রাখতে হবে সব নাগরিকদের। সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালনই পারে নদীকে বাঁচাতে। কারণ এতে বাঁচবে নাগরিকদের প্রাণই।

[ লেখক : সাংবাদিক ]