প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন

আখনুর লাজু

জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াকে শিক্ষা বলে। শিক্ষা ব্যক্তির জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ প্রভৃতির বিকাশ সাধন করে থাকে। ব্যক্তির আচরণের কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে সামনে এগিয়ে চলার নামই শিক্ষা। জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণ ও উৎকর্ষ সাধন তথা বিশ্বোয়ন প্রক্রিয়ার ফলে বিশ্বেব্যাপী মানসম্মত শিক্ষার গুরুত্ব বাড়ছে। আন্তর্জাতিকভাবে মানসম্মত শিক্ষা হলো শিক্ষার লক্ষ্য পূরণের সফলতা। শিক্ষার ক্ষেত্রে গুণ বা মানকে চিহ্নিত করা যায় শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফল, আচরণ এবং দক্ষতা বিশ্লেষণ করে প্রাপ্ত ইতিবাচক ফলের মাধ্যমে। মানসম্মত শিক্ষা বলতে যেসব যোগ্যতাকে বোঝায়, যা একজন শিক্ষার্থী শিক্ষার নির্দিষ্ট স্তর থেকে অর্জন করলে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে ভূমিকা রাখতে পারবে এবং শিক্ষার্থী তার বাস্তব জীবনে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হবে। প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে সকল ধরনের শিক্ষার ভিত্তি। তাই ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন প্রয়োজন।

প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। ১৯৯০ সালের থাইল্যান্ডের জমতিয়েন ঘোষণার পর বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০০১ সালে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন বিশ্বে শিক্ষা ফোরাম থেকে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যার অনেক বিষয় ইতোমধ্যেই অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রকৃত ভর্তির হার ৯৭.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ছেলে ৯৬.৬ শতাংশ ও মেয়ে ৯৮.৮ শতাংশ। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির হার ১৯৯১ সালের ৪৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৪ সালে ৮১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বে শিক্ষা ফোরাম থেকে ২০৩০ সালের জন্য গৃহীত হয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। এর মূলমন্ত্র হচ্ছে Leave no one behind অর্থাৎ কাউকে পিছনে ফেলে নয়। যেখানে উন্নয়নের মূলমন্ত্রই হবে টেকসই উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা প্রচলন। এসডিজির-৪ নম্বরের অভীষ্ট হলো শিক্ষা ব্যবস্থায় সার্বিক গুণগত মানোন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের সকল প্রকার মানুষের জন্য টেকসই, কল্যাণকর জীবন ও জীবিকার সুযোগ এবং সম্ভাবনা সৃষ্টি করা। এসডিজির ৪.২ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে সকল ছেলে মেয়ে যাতে প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাসহ শৈশবের একেবারে গোড়া থেকে মানসম্মত বিকাশ ও পরিচর্যার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে তার নিশ্চয়তা বিধান করা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ এমডিজিতে সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ছয়টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রাথমিক শিক্ষার পরিমাণগত অর্জনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। এসডিজি অভীষ্ট অর্জনে পরিমাণের চেয়ে শিক্ষার গুণগত মানের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই এসডিজি অর্জনের সফলতার জন্য প্রয়োজন গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা।

শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় শিক্ষাক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক শিক্ষাক্রমের পরিধি অনেক ব্যপক। শিক্ষাক্রমকে কেবল পঠনীয় বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। বিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষার্থীর সকল অভিজ্ঞতার যোগফলই হলো প্রকৃত শিক্ষাক্রম। শ্রেণীকক্ষে, খেলার মাঠে, লাইব্রেরিতে, গবেষণাগারে, প্রদর্শনীতে শিশুরা পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান ও সংযোগের মাধ্যমে যে বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা অর্জন করে তার সবগুলোই শিক্ষাক্রমের উপাদান। শিক্ষাক্রম হলো কোন বিশেষ স্তরের শিক্ষা সম্পর্কিত কার্যক্রম ও অভিজ্ঞতার পূর্ণাঙ্গ দলিল, যা কোনো দায়িত¦শীল সংগঠন কর্তৃক গৃহীত ও পরিচালিত হয়। শিক্ষাক্রম শিক্ষার যেকোনো স্তর বা বিষয় বা কার্যক্রমের হতে পারে। যেমন প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের এ ধরনের পরিকল্পনার নাম প্রাথমিক শিক্ষাক্রম। কাদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষা কার্যক্রম থেকে শিক্ষার্থী কী কী যোগ্যতা অর্জন করবে, কতদিন এ কার্যক্রম চলবে, কোন কোন বিষয় কত সময় যাবত কীভাবে কারা শিখবে, কী কী শিখন সামগ্রী ব্যবহার করা হবে, শিক্ষা প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা কীভাবে অংশগ্রহণ করবে, শিক্ষার্থীদের অর্জনসমূহ কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে এ সবকিছুর বিবরণ প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে রয়েছে। শিক্ষাক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরে ১৯৯২ সালে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা হয়।

সাধারণভাবে যোগ্যতার অর্থ কিছু করতে পারার সামর্থ্য। শিক্ষাক্ষেত্রে শিখন শেখানোর মধ্য দিয়ে কোন জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিপূর্ণভাবে আয়ত্ত করার পর শিশু তার বাস্তব জীবনে প্রয়োজনের সময়ে তা কাজে লাগাতে পারলে সেই জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে তার একটি যোগ্যতা বলা হয়। যেমন বাংলা বিষয়ে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুদ্ধভাবে ও স্পষ্টস্বরে কথা বলতে পারার দক্ষতা আয়ত্ত করার পর শিশু যদি নিজ গৃহে এবং বন্ধুদের সঙ্গে শুদ্ধ ভাষায় ও স্পষ্ট স্বরে কথা বলতে পারে অর্থাৎ জীবনে সর্বক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে পারে তবে সেটি তার যোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য অর্জন উপযোগী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা বা পারদর্শিতাকে ভিত্তি করে যে শিক্ষাক্রম প্রণীত হয় তাকে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম বলা হয়। ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত কোন কোন শ্রেণীতে কোন কোন প্রান্তিক যোগ্যতার কতটুকু অর্জন করবে তার জন্য পরিকল্পিত শিক্ষাক্রমই যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম। শিক্ষার্থীদের বয়স, মেধা ও চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে অর্জন উপযোগী যোগ্যতা চিহ্নিত করে প্রথমিক স্তরে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণীত হয়। ১ম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা শেষে যে নির্ধারিত যোগ্যতাগুলো অর্জন করবে বলে আশা করা হয় সেগুলো প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের প্রান্তিক যোগ্যতা। যেমন বাংলাদেশ ও বিশ্বে পরিচয় বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রান্তিক যোগ্যতা জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা এবং এ বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।

এ শিক্ষাক্রমের উল্লেখযোগ্য দিক হলো বিভিন্ন বিষয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা শেষে ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে বিষয় সংশ্লিষ্ট প্রান্তিক যোগ্যতার সংখ্যা একরকম নয়। আবার শিক্ষার্র্থীরা একবারে বা একসঙ্গে প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করবে না। ধাপে ধাপে বিভিন্ন শ্রেণীতে প্রান্তিক যোগ্যতার অংশ বিশেষ অর্জনের মাধ্যমে একটি প্রান্তিক যোগ্যতা পুরোপুরি অর্জনে সক্ষম হবে। ২০০২ সালে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রথমবারের মতো পরিমার্জন করে ৫০টি প্রান্তিক যোগ্যতা এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে ২০১২ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষানীতি, গবেষণা, নীতি-নির্ধারকগণের দিক নির্দেশনায় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার দিনে দিনে পরিমানগত ও গুনগতমানের উন্নয়ন ঘটেছে। যেমন- শিশু ভর্তির হার বৃদ্ধি, ঝড়ে পড়ার হার হ্রাস, পাঁচ বছর মেয়াদি শিক্ষাচক্র সমাপ্তি হার বৃদ্ধি, শতভাগ উপবৃত্তির ব্যবস্থা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম পাঠদান পদ্ধতি, উপকরণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা ইত্যাদি।

যেকোনো শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে শিক্ষার্থী। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কার্যাবলীর লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর আচরণের সার্বিক বিকাশ ও ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন। আর শিক্ষার্থীর এই বিকাশ ও পরিবর্তন উদ্দেশ্য অনুযায়ী, কতটুকু কীভাবে সংগঠিত হচ্ছে তা জানার অন্যতম হাতিয়ার হলো মূল্যায়ন। মূল্যায়ন ছাড়া শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার সফলতার মাত্রা যাচাই করা যায় না। তাই মূল্যায়ন শিখন শেখানো প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে মূল্যায়ন পদ্ধতির সামঞ্জস্য থাকা দরকার। মূল্যায়ন হলো একটি উপকরণ বা কৌশল, যার দ্বারা শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য নির্ধারিত শিখনফল কতটা ভালোভাবে অর্জন করতে পেরেছে তা নিরুপণ করা বা মাপা যায়। মূল্যায়নকালের উপর ভিত্তি করে মূল্যায়নকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। গাঠনিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ন। প্রতিটি শিক্ষার্থীর নির্ধারিত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের জন্য তাকে সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে গাঠনিক মূল্যায়ন একটি অপরিহার্য কৌশল হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। এই ধরনের মূল্যায়ন শ্রেণিকক্ষ মূল্যায়নের অন্তর্গত। সামষ্টিক মূল্যায়ন কোনো টার্ম বা কোর্সের শেষে অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থী এ মূল্যায়নের পর কোন বিস্তারিত ফলাবর্তন প্রাপ্ত হয় না বরং গ্রেড বা নম্বর পেয়ে থাকে। মূল্যায়নের ফলাফল যাই হোক না কেন শিক্ষক পরবর্তী পাঠে চলে যান। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের একাধিক পর্যায়ে মূল্যায়ন করা হয়। যেমন-পাঠ চলাকালে শ্রেণী শিক্ষক দ্বারা, বছরের বিভিন্ন সময়ে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা দ্বারা এবং প্রাথমিক স্তর শেষে পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে (যেমন- প্রাথমিক স্তর সমাপনী পরীক্ষা) শিক্ষাথীদের মূল্যায়ন করা হয়। মূল্যায়ন ব্যবস্থায় মুখস্থ নির্ভরতা বেশি থাকায় শিক্ষার্থীরা কিছু বিষয় পড়ে পাশ করে পরবর্তী শ্রেণিতে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু অনুধাবন ও বাস্তবমুখী জ্ঞান বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

শিক্ষার্থীদের জ্ঞানকে প্রসারিত করার জন্য যোগ্যাতাভিত্তিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা উত্তরণ ঘটছে। ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি সারা দেশব্যাপী অভিন্ন প্রশ্নপত্রের আলোকে ৫ম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০১২ সালে প্রথম যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নের আলোকে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালে সমাপনী পরীক্ষায় ১০% যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্র, ২০১৩ সালে ২৫% যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্রের আলোকে মূল্যায়ন করা হয়। এভাবে ধাপে ধাপে উত্তরণ ঘটিয়ে ২০১৮ সাল থেকে শতভাগ প্রশ্নপত্রের আলোকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। মানের উৎকর্ষ সাধনের জন্য ৩য় শ্রেণী থেকেই যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্রের আলোকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক বেঞ্জামিন ব্লুম জীববিজ্ঞানে ব্যবহৃত Taxonomy শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছেন। ব্লুম তার ট্যাক্সোনমিতে আচরনিক ভাষার শিক্ষার উদ্দেশ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি শিখনের উদ্দেশ্যসমূহকে প্রথমত ৩ ক্ষেত্রে ভাগ করেছেন (ক) জ্ঞানমূলক মননশীলতার ক্ষেত্র (Congnitive Domain) (খ) অনুভূতি মূলক / আবেগিক (Affective Domain) ও (গ) মনোপেশীজ ক্ষেত্র (Psychomotor Domain) জ্ঞানমূল ক্ষেত্রকে ৬টি উপক্ষেত্রে ভাগ করা হয়েছে (১) জ্ঞান (Knowledge) (২) অনুধাবন (Understanding) (৩) প্রয়োগ (Application) (৪) বিশ্লেষণ (Analysis) (৫) সংশ্লেষণ (Synthesis) ও (৬) মূল্যায়ন (Evaluation) জ্ঞানমূলক ৬টি উপক্ষেত্রে জ্ঞান অনুধাবন ও প্রয়োগের আলোকে প্রাথমিক স্তরের প্রশ্ন করা হয়।

জ্ঞান (Knowledge) : এটি জ্ঞানমূলক ক্ষেত্রের সবচেয়ে নিচু স্তরের উদ্দেশ্য। জ্ঞান বলতে পূর্বে শেখা কোন সুনির্দিষ্ট/সর্বজনীন কোন কিছুর (সংজ্ঞা, ঘটনা, প্রক্রিয়া, তত্ত্ব ইত্রাদি) স্মরণ করার মানসিক প্রক্রিয়াকে বুঝায়। শিশু পরিচিত ফুল, ফল ও জীবজন্তুর নাম বলতে পারবে। ছড়া ও কবিতা আবৃত্তি করতে পারবে। জ্ঞানের উত্তর সরাসরি টেক্সট বইয়ে আছে।

অনুধাবন (understanding) : বিষয়বস্তু/তথ্যসমূহ কতখানি উপলব্ধি করতে পেরেছে শিশুর যে ক্ষমতাকে অনুধাবন বোঝায়। অর্থাৎ কোন ধারণা/তথ্যকে বুঝে সহজভাবে তা বর্ণনা করার ক্ষমতাকে অনুধাবন/বোধগম্যতা বলা হয়।

প্রয়োগ (Application) : জ্ঞানমূলক ক্ষেত্রের তৃতীয় ধাপ হলো প্রয়োগ। কোন ধারণা, পদ্ধতি, সূত্র বা কোন অর্জিত জ্ঞানকে বস্তবক্ষেত্রে নতুন পরিস্থিতিতে/সমস্যা সমাধানে কাজে লাগানোর ক্ষমতাকে প্রয়োগ বলে। যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়নে কাঠামোবদ্ধ অভীক্ষাপদ প্রণয়ন করা হয়। যে অভীক্ষাপদের জন্য পরীক্ষার্থীদের সংক্ষিপ্ত বা বিস্তারিত বর্ণনা লিখে উত্তর করতে হয় তাই কাঠামোবদ্ধ অভীক্ষাপদ। যোগ্যতাভিত্তিক কাঠামোবদ্ধ অভীক্ষাপদ অবশ্যই জ্ঞান, অনুধাবন ও প্রয়োগ ডোমেইনের উপর ভিত্তি করে করা হয়। প্রতিটি অভীক্ষাপদের জন্য নম্বরও সুনির্দিষ্ট থাকে। সংক্ষিপ্ত কাঠামোদ্ধ অভীক্ষাপদ (Brief constructed Response item-Bcr) যে কোন শিখনক্ষেত্র ভিত্তিক হতে পারে কিন্তু বর্ণনামূলক কাঠামোবদ্ধ অভীক্ষাপদ (Extended contructed Responseitem-ECR) অবশ্যই জ্ঞান, অনুধাবন ও উচ্চতর শিখনক্ষেত্র পরিমাপের জন্য প্রণীত হতে হবে। যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে বয়স ও সামর্থ্য অনুযায়ী পাঠের বিষয়বস্তু সর্ম্পকে ভালোভাবে জানতে হবে এবং মূলভাব সর্ম্পকে অবগত হয়ে বাস্তবধর্মী চিন্তাশীল হতে হবে। যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি, শিক্ষার্থীর সামর্থ্য ও যোগ্যতা, শিক্ষকের বিষয়জ্ঞান গভীরতা, পাঠদান পদ্ধতি, প্রশিক্ষণ, শ্রেণীকক্ষে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নে অভ্যস্থ করা ইত্যাদির উপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।

শিক্ষা মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধ বদলে দেয়। মানসম্মত শিক্ষা হচ্ছে সেই শিক্ষা যা একজন শিক্ষার্থীকে মানবিক ও পারিপাশির্্বেক পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে সহায়তা করে। এ শিক্ষা অর্জন করে শিক্ষার্থী ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রয়োগ করে উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। গুণগত শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা কেবল শিক্ষকের কাছ থেকেই শিক্ষা লাভ করে না বরং একে অন্যের কাছ থেকেও শেখে; কেবল শুনে নয় বরং দেখেও শেখে। এ ধরনের মিথস্ক্রিয়ার ফলে শিশুর সৃজনশীল শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের সুয়োগ পাওয়া যায়। ফলে তার অর্জিত যোগ্যতা টেকসই হয়। প্রত্যেক শিক্ষকের পেশাগত দায়িত্বের অংশ হলো শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাথী কী শিখতে পারছে, কী মাত্রায় এবং কতটা ভালোভাবে শিখতে পারছে সে সম্পর্কে অবহিত হয়ে সর্বোচ্চ শিখন নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা যাচাইয়ের পাশাপাশি শিক্ষকের আত্মমূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি করে। যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়নে শিক্ষার্থী জ্ঞানের পাশাপাশি দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বাস্তবধর্মী ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে। প্রগতিশীল বিশ্বে মেধাভিত্তিক, চিন্তাশীল, বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের জন্য বাস্তবভিত্তিক ও প্রয়োগমুখী শিক্ষা ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আর এ লক্ষ্যে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা।

[লেখক : সহকারী ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, নারায়ণগঞ্জ]

শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ , ১২ পৌষ ১৪২৬, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪১

প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন

আখনুর লাজু

জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াকে শিক্ষা বলে। শিক্ষা ব্যক্তির জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ প্রভৃতির বিকাশ সাধন করে থাকে। ব্যক্তির আচরণের কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে সামনে এগিয়ে চলার নামই শিক্ষা। জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণ ও উৎকর্ষ সাধন তথা বিশ্বোয়ন প্রক্রিয়ার ফলে বিশ্বেব্যাপী মানসম্মত শিক্ষার গুরুত্ব বাড়ছে। আন্তর্জাতিকভাবে মানসম্মত শিক্ষা হলো শিক্ষার লক্ষ্য পূরণের সফলতা। শিক্ষার ক্ষেত্রে গুণ বা মানকে চিহ্নিত করা যায় শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফল, আচরণ এবং দক্ষতা বিশ্লেষণ করে প্রাপ্ত ইতিবাচক ফলের মাধ্যমে। মানসম্মত শিক্ষা বলতে যেসব যোগ্যতাকে বোঝায়, যা একজন শিক্ষার্থী শিক্ষার নির্দিষ্ট স্তর থেকে অর্জন করলে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে ভূমিকা রাখতে পারবে এবং শিক্ষার্থী তার বাস্তব জীবনে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হবে। প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে সকল ধরনের শিক্ষার ভিত্তি। তাই ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন প্রয়োজন।

প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। ১৯৯০ সালের থাইল্যান্ডের জমতিয়েন ঘোষণার পর বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০০১ সালে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন বিশ্বে শিক্ষা ফোরাম থেকে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যার অনেক বিষয় ইতোমধ্যেই অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রকৃত ভর্তির হার ৯৭.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ছেলে ৯৬.৬ শতাংশ ও মেয়ে ৯৮.৮ শতাংশ। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির হার ১৯৯১ সালের ৪৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৪ সালে ৮১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বে শিক্ষা ফোরাম থেকে ২০৩০ সালের জন্য গৃহীত হয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। এর মূলমন্ত্র হচ্ছে Leave no one behind অর্থাৎ কাউকে পিছনে ফেলে নয়। যেখানে উন্নয়নের মূলমন্ত্রই হবে টেকসই উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা প্রচলন। এসডিজির-৪ নম্বরের অভীষ্ট হলো শিক্ষা ব্যবস্থায় সার্বিক গুণগত মানোন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের সকল প্রকার মানুষের জন্য টেকসই, কল্যাণকর জীবন ও জীবিকার সুযোগ এবং সম্ভাবনা সৃষ্টি করা। এসডিজির ৪.২ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে সকল ছেলে মেয়ে যাতে প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাসহ শৈশবের একেবারে গোড়া থেকে মানসম্মত বিকাশ ও পরিচর্যার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে তার নিশ্চয়তা বিধান করা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ এমডিজিতে সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ছয়টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রাথমিক শিক্ষার পরিমাণগত অর্জনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। এসডিজি অভীষ্ট অর্জনে পরিমাণের চেয়ে শিক্ষার গুণগত মানের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই এসডিজি অর্জনের সফলতার জন্য প্রয়োজন গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা।

শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় শিক্ষাক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক শিক্ষাক্রমের পরিধি অনেক ব্যপক। শিক্ষাক্রমকে কেবল পঠনীয় বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। বিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষার্থীর সকল অভিজ্ঞতার যোগফলই হলো প্রকৃত শিক্ষাক্রম। শ্রেণীকক্ষে, খেলার মাঠে, লাইব্রেরিতে, গবেষণাগারে, প্রদর্শনীতে শিশুরা পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান ও সংযোগের মাধ্যমে যে বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা অর্জন করে তার সবগুলোই শিক্ষাক্রমের উপাদান। শিক্ষাক্রম হলো কোন বিশেষ স্তরের শিক্ষা সম্পর্কিত কার্যক্রম ও অভিজ্ঞতার পূর্ণাঙ্গ দলিল, যা কোনো দায়িত¦শীল সংগঠন কর্তৃক গৃহীত ও পরিচালিত হয়। শিক্ষাক্রম শিক্ষার যেকোনো স্তর বা বিষয় বা কার্যক্রমের হতে পারে। যেমন প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের এ ধরনের পরিকল্পনার নাম প্রাথমিক শিক্ষাক্রম। কাদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষা কার্যক্রম থেকে শিক্ষার্থী কী কী যোগ্যতা অর্জন করবে, কতদিন এ কার্যক্রম চলবে, কোন কোন বিষয় কত সময় যাবত কীভাবে কারা শিখবে, কী কী শিখন সামগ্রী ব্যবহার করা হবে, শিক্ষা প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা কীভাবে অংশগ্রহণ করবে, শিক্ষার্থীদের অর্জনসমূহ কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে এ সবকিছুর বিবরণ প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে রয়েছে। শিক্ষাক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরে ১৯৯২ সালে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা হয়।

সাধারণভাবে যোগ্যতার অর্থ কিছু করতে পারার সামর্থ্য। শিক্ষাক্ষেত্রে শিখন শেখানোর মধ্য দিয়ে কোন জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিপূর্ণভাবে আয়ত্ত করার পর শিশু তার বাস্তব জীবনে প্রয়োজনের সময়ে তা কাজে লাগাতে পারলে সেই জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে তার একটি যোগ্যতা বলা হয়। যেমন বাংলা বিষয়ে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুদ্ধভাবে ও স্পষ্টস্বরে কথা বলতে পারার দক্ষতা আয়ত্ত করার পর শিশু যদি নিজ গৃহে এবং বন্ধুদের সঙ্গে শুদ্ধ ভাষায় ও স্পষ্ট স্বরে কথা বলতে পারে অর্থাৎ জীবনে সর্বক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে পারে তবে সেটি তার যোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য অর্জন উপযোগী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা বা পারদর্শিতাকে ভিত্তি করে যে শিক্ষাক্রম প্রণীত হয় তাকে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম বলা হয়। ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত কোন কোন শ্রেণীতে কোন কোন প্রান্তিক যোগ্যতার কতটুকু অর্জন করবে তার জন্য পরিকল্পিত শিক্ষাক্রমই যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম। শিক্ষার্থীদের বয়স, মেধা ও চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে অর্জন উপযোগী যোগ্যতা চিহ্নিত করে প্রথমিক স্তরে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণীত হয়। ১ম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা শেষে যে নির্ধারিত যোগ্যতাগুলো অর্জন করবে বলে আশা করা হয় সেগুলো প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের প্রান্তিক যোগ্যতা। যেমন বাংলাদেশ ও বিশ্বে পরিচয় বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রান্তিক যোগ্যতা জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা এবং এ বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।

এ শিক্ষাক্রমের উল্লেখযোগ্য দিক হলো বিভিন্ন বিষয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা শেষে ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে বিষয় সংশ্লিষ্ট প্রান্তিক যোগ্যতার সংখ্যা একরকম নয়। আবার শিক্ষার্র্থীরা একবারে বা একসঙ্গে প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করবে না। ধাপে ধাপে বিভিন্ন শ্রেণীতে প্রান্তিক যোগ্যতার অংশ বিশেষ অর্জনের মাধ্যমে একটি প্রান্তিক যোগ্যতা পুরোপুরি অর্জনে সক্ষম হবে। ২০০২ সালে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রথমবারের মতো পরিমার্জন করে ৫০টি প্রান্তিক যোগ্যতা এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে ২০১২ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষানীতি, গবেষণা, নীতি-নির্ধারকগণের দিক নির্দেশনায় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার দিনে দিনে পরিমানগত ও গুনগতমানের উন্নয়ন ঘটেছে। যেমন- শিশু ভর্তির হার বৃদ্ধি, ঝড়ে পড়ার হার হ্রাস, পাঁচ বছর মেয়াদি শিক্ষাচক্র সমাপ্তি হার বৃদ্ধি, শতভাগ উপবৃত্তির ব্যবস্থা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম পাঠদান পদ্ধতি, উপকরণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা ইত্যাদি।

যেকোনো শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে শিক্ষার্থী। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কার্যাবলীর লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর আচরণের সার্বিক বিকাশ ও ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন। আর শিক্ষার্থীর এই বিকাশ ও পরিবর্তন উদ্দেশ্য অনুযায়ী, কতটুকু কীভাবে সংগঠিত হচ্ছে তা জানার অন্যতম হাতিয়ার হলো মূল্যায়ন। মূল্যায়ন ছাড়া শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার সফলতার মাত্রা যাচাই করা যায় না। তাই মূল্যায়ন শিখন শেখানো প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে মূল্যায়ন পদ্ধতির সামঞ্জস্য থাকা দরকার। মূল্যায়ন হলো একটি উপকরণ বা কৌশল, যার দ্বারা শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য নির্ধারিত শিখনফল কতটা ভালোভাবে অর্জন করতে পেরেছে তা নিরুপণ করা বা মাপা যায়। মূল্যায়নকালের উপর ভিত্তি করে মূল্যায়নকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। গাঠনিক ও সামষ্টিক মূল্যায়ন। প্রতিটি শিক্ষার্থীর নির্ধারিত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের জন্য তাকে সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে গাঠনিক মূল্যায়ন একটি অপরিহার্য কৌশল হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। এই ধরনের মূল্যায়ন শ্রেণিকক্ষ মূল্যায়নের অন্তর্গত। সামষ্টিক মূল্যায়ন কোনো টার্ম বা কোর্সের শেষে অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থী এ মূল্যায়নের পর কোন বিস্তারিত ফলাবর্তন প্রাপ্ত হয় না বরং গ্রেড বা নম্বর পেয়ে থাকে। মূল্যায়নের ফলাফল যাই হোক না কেন শিক্ষক পরবর্তী পাঠে চলে যান। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের একাধিক পর্যায়ে মূল্যায়ন করা হয়। যেমন-পাঠ চলাকালে শ্রেণী শিক্ষক দ্বারা, বছরের বিভিন্ন সময়ে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা দ্বারা এবং প্রাথমিক স্তর শেষে পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে (যেমন- প্রাথমিক স্তর সমাপনী পরীক্ষা) শিক্ষাথীদের মূল্যায়ন করা হয়। মূল্যায়ন ব্যবস্থায় মুখস্থ নির্ভরতা বেশি থাকায় শিক্ষার্থীরা কিছু বিষয় পড়ে পাশ করে পরবর্তী শ্রেণিতে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু অনুধাবন ও বাস্তবমুখী জ্ঞান বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

শিক্ষার্থীদের জ্ঞানকে প্রসারিত করার জন্য যোগ্যাতাভিত্তিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা উত্তরণ ঘটছে। ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি সারা দেশব্যাপী অভিন্ন প্রশ্নপত্রের আলোকে ৫ম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০১২ সালে প্রথম যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নের আলোকে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালে সমাপনী পরীক্ষায় ১০% যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্র, ২০১৩ সালে ২৫% যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্রের আলোকে মূল্যায়ন করা হয়। এভাবে ধাপে ধাপে উত্তরণ ঘটিয়ে ২০১৮ সাল থেকে শতভাগ প্রশ্নপত্রের আলোকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। মানের উৎকর্ষ সাধনের জন্য ৩য় শ্রেণী থেকেই যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্রের আলোকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক বেঞ্জামিন ব্লুম জীববিজ্ঞানে ব্যবহৃত Taxonomy শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছেন। ব্লুম তার ট্যাক্সোনমিতে আচরনিক ভাষার শিক্ষার উদ্দেশ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি শিখনের উদ্দেশ্যসমূহকে প্রথমত ৩ ক্ষেত্রে ভাগ করেছেন (ক) জ্ঞানমূলক মননশীলতার ক্ষেত্র (Congnitive Domain) (খ) অনুভূতি মূলক / আবেগিক (Affective Domain) ও (গ) মনোপেশীজ ক্ষেত্র (Psychomotor Domain) জ্ঞানমূল ক্ষেত্রকে ৬টি উপক্ষেত্রে ভাগ করা হয়েছে (১) জ্ঞান (Knowledge) (২) অনুধাবন (Understanding) (৩) প্রয়োগ (Application) (৪) বিশ্লেষণ (Analysis) (৫) সংশ্লেষণ (Synthesis) ও (৬) মূল্যায়ন (Evaluation) জ্ঞানমূলক ৬টি উপক্ষেত্রে জ্ঞান অনুধাবন ও প্রয়োগের আলোকে প্রাথমিক স্তরের প্রশ্ন করা হয়।

জ্ঞান (Knowledge) : এটি জ্ঞানমূলক ক্ষেত্রের সবচেয়ে নিচু স্তরের উদ্দেশ্য। জ্ঞান বলতে পূর্বে শেখা কোন সুনির্দিষ্ট/সর্বজনীন কোন কিছুর (সংজ্ঞা, ঘটনা, প্রক্রিয়া, তত্ত্ব ইত্রাদি) স্মরণ করার মানসিক প্রক্রিয়াকে বুঝায়। শিশু পরিচিত ফুল, ফল ও জীবজন্তুর নাম বলতে পারবে। ছড়া ও কবিতা আবৃত্তি করতে পারবে। জ্ঞানের উত্তর সরাসরি টেক্সট বইয়ে আছে।

অনুধাবন (understanding) : বিষয়বস্তু/তথ্যসমূহ কতখানি উপলব্ধি করতে পেরেছে শিশুর যে ক্ষমতাকে অনুধাবন বোঝায়। অর্থাৎ কোন ধারণা/তথ্যকে বুঝে সহজভাবে তা বর্ণনা করার ক্ষমতাকে অনুধাবন/বোধগম্যতা বলা হয়।

প্রয়োগ (Application) : জ্ঞানমূলক ক্ষেত্রের তৃতীয় ধাপ হলো প্রয়োগ। কোন ধারণা, পদ্ধতি, সূত্র বা কোন অর্জিত জ্ঞানকে বস্তবক্ষেত্রে নতুন পরিস্থিতিতে/সমস্যা সমাধানে কাজে লাগানোর ক্ষমতাকে প্রয়োগ বলে। যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়নে কাঠামোবদ্ধ অভীক্ষাপদ প্রণয়ন করা হয়। যে অভীক্ষাপদের জন্য পরীক্ষার্থীদের সংক্ষিপ্ত বা বিস্তারিত বর্ণনা লিখে উত্তর করতে হয় তাই কাঠামোবদ্ধ অভীক্ষাপদ। যোগ্যতাভিত্তিক কাঠামোবদ্ধ অভীক্ষাপদ অবশ্যই জ্ঞান, অনুধাবন ও প্রয়োগ ডোমেইনের উপর ভিত্তি করে করা হয়। প্রতিটি অভীক্ষাপদের জন্য নম্বরও সুনির্দিষ্ট থাকে। সংক্ষিপ্ত কাঠামোদ্ধ অভীক্ষাপদ (Brief constructed Response item-Bcr) যে কোন শিখনক্ষেত্র ভিত্তিক হতে পারে কিন্তু বর্ণনামূলক কাঠামোবদ্ধ অভীক্ষাপদ (Extended contructed Responseitem-ECR) অবশ্যই জ্ঞান, অনুধাবন ও উচ্চতর শিখনক্ষেত্র পরিমাপের জন্য প্রণীত হতে হবে। যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে বয়স ও সামর্থ্য অনুযায়ী পাঠের বিষয়বস্তু সর্ম্পকে ভালোভাবে জানতে হবে এবং মূলভাব সর্ম্পকে অবগত হয়ে বাস্তবধর্মী চিন্তাশীল হতে হবে। যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি, শিক্ষার্থীর সামর্থ্য ও যোগ্যতা, শিক্ষকের বিষয়জ্ঞান গভীরতা, পাঠদান পদ্ধতি, প্রশিক্ষণ, শ্রেণীকক্ষে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নে অভ্যস্থ করা ইত্যাদির উপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।

শিক্ষা মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধ বদলে দেয়। মানসম্মত শিক্ষা হচ্ছে সেই শিক্ষা যা একজন শিক্ষার্থীকে মানবিক ও পারিপাশির্্বেক পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে সহায়তা করে। এ শিক্ষা অর্জন করে শিক্ষার্থী ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রয়োগ করে উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। গুণগত শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা কেবল শিক্ষকের কাছ থেকেই শিক্ষা লাভ করে না বরং একে অন্যের কাছ থেকেও শেখে; কেবল শুনে নয় বরং দেখেও শেখে। এ ধরনের মিথস্ক্রিয়ার ফলে শিশুর সৃজনশীল শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের সুয়োগ পাওয়া যায়। ফলে তার অর্জিত যোগ্যতা টেকসই হয়। প্রত্যেক শিক্ষকের পেশাগত দায়িত্বের অংশ হলো শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাথী কী শিখতে পারছে, কী মাত্রায় এবং কতটা ভালোভাবে শিখতে পারছে সে সম্পর্কে অবহিত হয়ে সর্বোচ্চ শিখন নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা যাচাইয়ের পাশাপাশি শিক্ষকের আত্মমূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি করে। যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়নে শিক্ষার্থী জ্ঞানের পাশাপাশি দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বাস্তবধর্মী ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে। প্রগতিশীল বিশ্বে মেধাভিত্তিক, চিন্তাশীল, বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের জন্য বাস্তবভিত্তিক ও প্রয়োগমুখী শিক্ষা ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আর এ লক্ষ্যে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা।

[লেখক : সহকারী ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, নারায়ণগঞ্জ]