অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবা ক্ষুদ্রঋণের উত্তরণ

ক্ষুদ্রঋণ সমাজে বহুকাল আগে থেকে প্রচলিত একটি আর্থিক সেবা। প্রায় সব দেশেই এর প্রচলন ছিল ও আছে। তবে আগে এটি যেভাবে প্রচলিত ছিল তা ব্যক্তিগতভাবে ঋণ দেয়ার পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয় নজরদারির বাইরে। আর তার বৃহদংশটা ছিল মূলত ‘শোষণ’, সেবা নয়। সাম্প্রতিককালে ক্ষুদ্রঋণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদ্রঋণের সুদকে সার্ভিস চার্জ হিসেবে নির্দিষ্ট ও সীমায়িত করা এবং গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উপায় হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে একে জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভের শুরুর দিনগুলোয় ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তাগণ অনেক উচ্চাকাক্সক্ষার কথা বলতেন যার অনেক কিছুই বাস্তবসম্মত ছিল না। তবে এসব উচ্চাকাক্সক্ষা অনেক সমাজচিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকের মন গলাতে সক্ষম হয়। ক্ষুদ্রঋণকে তখন অনেকেই পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নতির জন্য এক সর্বরোগহর ওষুধ হিসেবে বলতে শুরু করেন। এর বিপরিত প্রক্রিয়াও শুরু হয়, সমালোচনার মাধ্যমে। অল্পদিনেই ক্ষুদ্রঋণ চলে আসে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। একইসঙ্গে আবার চলে এর বিশ্বব্যাপী বিস্তার।

রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের আশীর্বাদপুষ্ট এ ক্ষুদ্রঋণ সেবা তার যাত্রাপথে বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। অনেক লোভী, নীতিহীন, মুনাফামুখী ব্যক্তি এর মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং মহাজনী মনোবৃত্তিতে গরিব মানুষকে ঋণ দিয়ে একে দ্রুত টাকা কামাইয়ের একটা ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। এর কারণ, দেখা যায় যে গরিব মানুষ ঋণের টাকা ফেরত দিতে খুবই নীতিনিষ্ঠ যা আনুষ্ঠানিক আর্থিকসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তাদের কাছে খুবই আশ্চর্যের হলেও সত্যি। নীতিবর্জিত ব্যক্তি ও সংস্থার নির্মম লোভের শিকার হতে দরিদ্র মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নজরদারির ও আইনি কাঠামো তৈরির প্রয়োজন পড়ে। এর ফলে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে একটি শৃঙ্খলা ও দায়বদ্ধতার পরিবেশ তৈরি হয়।

‘ক্ষুদ্রঋণ’ (মাইক্রোক্রেডিট) শব্দও ‘ক্ষুদ্র-অর্থসংস্থানে’ (মাইক্রোফাইন্যান্স) পরিবর্তিত হয়ে একটি বিবর্তনের পথ ধরে আগাচ্ছে। বিবর্তনের এ প্রথম ধাপে দুটি শব্দের ব্যবহারে অবশ্য কোন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিল না। তবে পরিবর্তনটি এসেছিল প্রয়োজনের তাগিদে। এ পরিবর্তনের কারণ বোঝা যায় বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার UNE Business School এ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ের সিনিয়র লেকচারার আশফাক আহমদ খানের Paradigm Shift in the Microfinance Sector and its Implications for Theory Development: Empirical Evidence from Pakistan (Australasian Accounting Business and Finance Journal, সংখ্যা ৪, ভলিউম ২, ডিসেম্বর ২০০৮) শীর্ষক একটি লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৯০র দশকে অনেক এনজিও তাদের সেবা-গ্রহীতাদেরকে বৈচিত্র্যমূলক আর্থিক ও অনার্থিক সেবা দিতে শুরু করে, শুধু ক্ষুদ্রঋণ নয়।’ একটি পাদটীকায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান ছাড়াও যখন বিভিন্নরকম আর্থিকসেবা প্রদান শুরু হয়, সাহিত্যে মাইক্রোফাইন্যান্স শব্দটি মাইক্রোক্রেডিটকে প্রতিস্থাপন করে।’

তবে মাইক্রোক্রেডিট থেকে মাইক্রোফাইন্যান্সে পরিবর্তন কাজের চেয়ে কাগজে-কলমেই বেশি প্রতিফলিত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাহিত্যেও দুটি শব্দের পার্থক্য গুরুত্ব দিয়ে মানা হয়নি- একটার বদলে আরেকটা ইচ্ছে মতো বসানো হতো। কখনও কখনও একই বাক্যে দুটো শব্দই ব্যবহার হতো একটা আরেকটার পরিপূরক হিসেবে। তবে ক্ষুদ্রঋণ জন্মলগ্ন থেকেই এমনসব সমালোচনার শিকার হয় যে, এই ক্ষেত্রের অনেকেই বিকল্প শব্দের সন্ধান করেন যা তাদের ক্ষমতা-বলয়ের আশপাশে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাসমূহের শীর্ষ সমন্বয়ক প্রতিষ্ঠান পিকেএসএফের (পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের তেমনই একটি উদ্ভাবন ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েট ক্রেডিট’ (Appropriate credit বা ‘জুতসই ঋণ’) শব্দটি। এ বিকল্প শব্দের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির জন্য জুতসই ধরনের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও তিনি হাজির করেছেন।

ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বোঝাতে শব্দের এ ধীর পরিবর্তন আরও স্পষ্ট হয় পিকেএসএফের ওয়েবসাইটে, যেখানে নিজ সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘১৯৯০এ কার্যক্রমের শুরুতে পিকেএসএফ গ্রামীণ অকৃষি খাতে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্য নির্ধারণ করে ও সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঋণ কর্মসূচি বিস্তারের কৌশল গ্রহণ করে। গ্রামীণ মাঝারি দরিদ্রদের জন্য চালু করা এ ঋণ কর্মসূচি কালপরিক্রমায় সমাজের বিসদৃশ দারিদ্র্যক্লিস্ট অংশের পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৈচিত্র্য অর্জন করেছে এবং ধীরে ধীরে একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিকসেবা কর্মসূচি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। পিকেএসএফের বর্তমান আর্থিকসেবা কর্মসূচি শহর ও গ্রামের মাঝারি দরিদ্র, হতদরিদ্র, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের অন্তর্ভুক্ত করে। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যদের তাদের চাহিদা-উপযোগী সেবা দেয়া হয়। দরিদ্র মানুষকে স্বল্প-উৎপাদনের বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য সক্ষম করে পিকেএসএফ সক্ষমতা সৃষ্টি, প্রযুক্তি হস্তান্তর, ভ্যালু চেইন উন্নয়ন ও অন্যান্য কৌশলগত সেবা প্রদানকে এর উন্নয়ন কর্মসূচির অংশ করেছে।”

এ পরিবর্তন আরও স্পষ্ট পিকেএসএফের ঘোষিত ৫টি উদ্দেশের প্রথমটিতে, যা হলো: “মাঝারি ও হতদরিদ্র, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য উৎপাদনমূলক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক কমসূচি বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ সংস্থাসমূহকে প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান।” (উপরোক্ত দুটি অংশ পিকেএসএফের ওয়েবসাইটে পাওয়া ইংরেজি থেকে পাঠক-পাঠিকার জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হলো, যার দায়দায়িত্ব বর্তমান লেখকের।) ‘টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ সংস্থাসমূহকে’ (appropriate organisations for implementing sustainable inclusive financial programmes) এই শব্দগুচ্ছ উপরোল্লিখিত পরিবর্তনকে আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে।

প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের বড় ধাক্কাটি এসেছে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে বৈশ্বিক পর্যায় থেকে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন ২০০৫ সালকে ‘আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্রঋণ বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল এবং ‘বিশেষ করে দরিদ্রদের জন্য আর্থিক সেবা পাওয়ার প্রয়োজন’কে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এরপর ২০০৬ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘উন্নয়নের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক ক্ষেত্র তৈরি’ (Building Inclusive Financial Sectors for Development) শীর্ষক বইটি। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান বইটির ‘প্রারম্ভিক কথা’ শুরু করেছেন এভাবে: “বিশেষ করে দরিদ্রদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক ক্ষেত্র তৈরি মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটায়। ক্ষুদ্র ঋণ, একটি সঞ্চয় হিসাব ও বীমা নিম্ন আয়ের পরিবারে বিরাট পরিবর্তন ঘটাতে পারে।” তিনি আহ্বান করেছিলেন ‘দরিদ্রদের ক্ষমতায়িত করতে ও বিচিত্র রকম আর্থিক সেবায় বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের অভিগম্যতা সৃষ্টিতে’ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার।

এসব ছোটবড় পরিবর্তন ঘটেছে ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য’ (MDG) অর্জনের আমলে। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক ২০২০ সালের মধ্যে ১০০ কোটি মানুষকে বৈশ্বিক আর্থিকসেবায় অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেয়। এরপর বিশ্বনেতারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (ঝউএ) নির্ধারণ করেন যার অনেক অর্জনে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে সহায়ক বলে মনে করা হয়। বাজারে প্রাপ্য আর্থিক সেবাসমূহ বিশ্বব্যাপী দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক মানুষের কাছে সহজলভ্য করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিকসেবায় ক্ষুদ্রঋণের এ বিবর্তন স্পষ্টতই একটা বড় পরিবর্তন। অবশ্য এসব পরিবর্তন যত বড়ই হোক সমাজের সবার কল্যাণ নিশ্চিত করতে আর্থিক সেবার পূর্ণ গণতন্ত্রায়ন বা সামাজিকীকরণ এখনও বহু দূরের পদক্ষেপ।

[লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক]

শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ , ১৩ পৌষ ১৪২৬, ৩০ রবিউস সানি ১৪৪১

অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবা ক্ষুদ্রঋণের উত্তরণ

আলমগীর খান

ক্ষুদ্রঋণ সমাজে বহুকাল আগে থেকে প্রচলিত একটি আর্থিক সেবা। প্রায় সব দেশেই এর প্রচলন ছিল ও আছে। তবে আগে এটি যেভাবে প্রচলিত ছিল তা ব্যক্তিগতভাবে ঋণ দেয়ার পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয় নজরদারির বাইরে। আর তার বৃহদংশটা ছিল মূলত ‘শোষণ’, সেবা নয়। সাম্প্রতিককালে ক্ষুদ্রঋণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদ্রঋণের সুদকে সার্ভিস চার্জ হিসেবে নির্দিষ্ট ও সীমায়িত করা এবং গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উপায় হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে একে জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভের শুরুর দিনগুলোয় ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তাগণ অনেক উচ্চাকাক্সক্ষার কথা বলতেন যার অনেক কিছুই বাস্তবসম্মত ছিল না। তবে এসব উচ্চাকাক্সক্ষা অনেক সমাজচিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকের মন গলাতে সক্ষম হয়। ক্ষুদ্রঋণকে তখন অনেকেই পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নতির জন্য এক সর্বরোগহর ওষুধ হিসেবে বলতে শুরু করেন। এর বিপরিত প্রক্রিয়াও শুরু হয়, সমালোচনার মাধ্যমে। অল্পদিনেই ক্ষুদ্রঋণ চলে আসে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। একইসঙ্গে আবার চলে এর বিশ্বব্যাপী বিস্তার।

রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের আশীর্বাদপুষ্ট এ ক্ষুদ্রঋণ সেবা তার যাত্রাপথে বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। অনেক লোভী, নীতিহীন, মুনাফামুখী ব্যক্তি এর মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং মহাজনী মনোবৃত্তিতে গরিব মানুষকে ঋণ দিয়ে একে দ্রুত টাকা কামাইয়ের একটা ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। এর কারণ, দেখা যায় যে গরিব মানুষ ঋণের টাকা ফেরত দিতে খুবই নীতিনিষ্ঠ যা আনুষ্ঠানিক আর্থিকসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তাদের কাছে খুবই আশ্চর্যের হলেও সত্যি। নীতিবর্জিত ব্যক্তি ও সংস্থার নির্মম লোভের শিকার হতে দরিদ্র মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নজরদারির ও আইনি কাঠামো তৈরির প্রয়োজন পড়ে। এর ফলে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে একটি শৃঙ্খলা ও দায়বদ্ধতার পরিবেশ তৈরি হয়।

‘ক্ষুদ্রঋণ’ (মাইক্রোক্রেডিট) শব্দও ‘ক্ষুদ্র-অর্থসংস্থানে’ (মাইক্রোফাইন্যান্স) পরিবর্তিত হয়ে একটি বিবর্তনের পথ ধরে আগাচ্ছে। বিবর্তনের এ প্রথম ধাপে দুটি শব্দের ব্যবহারে অবশ্য কোন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিল না। তবে পরিবর্তনটি এসেছিল প্রয়োজনের তাগিদে। এ পরিবর্তনের কারণ বোঝা যায় বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার UNE Business School এ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ের সিনিয়র লেকচারার আশফাক আহমদ খানের Paradigm Shift in the Microfinance Sector and its Implications for Theory Development: Empirical Evidence from Pakistan (Australasian Accounting Business and Finance Journal, সংখ্যা ৪, ভলিউম ২, ডিসেম্বর ২০০৮) শীর্ষক একটি লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৯০র দশকে অনেক এনজিও তাদের সেবা-গ্রহীতাদেরকে বৈচিত্র্যমূলক আর্থিক ও অনার্থিক সেবা দিতে শুরু করে, শুধু ক্ষুদ্রঋণ নয়।’ একটি পাদটীকায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান ছাড়াও যখন বিভিন্নরকম আর্থিকসেবা প্রদান শুরু হয়, সাহিত্যে মাইক্রোফাইন্যান্স শব্দটি মাইক্রোক্রেডিটকে প্রতিস্থাপন করে।’

তবে মাইক্রোক্রেডিট থেকে মাইক্রোফাইন্যান্সে পরিবর্তন কাজের চেয়ে কাগজে-কলমেই বেশি প্রতিফলিত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাহিত্যেও দুটি শব্দের পার্থক্য গুরুত্ব দিয়ে মানা হয়নি- একটার বদলে আরেকটা ইচ্ছে মতো বসানো হতো। কখনও কখনও একই বাক্যে দুটো শব্দই ব্যবহার হতো একটা আরেকটার পরিপূরক হিসেবে। তবে ক্ষুদ্রঋণ জন্মলগ্ন থেকেই এমনসব সমালোচনার শিকার হয় যে, এই ক্ষেত্রের অনেকেই বিকল্প শব্দের সন্ধান করেন যা তাদের ক্ষমতা-বলয়ের আশপাশে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাসমূহের শীর্ষ সমন্বয়ক প্রতিষ্ঠান পিকেএসএফের (পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের তেমনই একটি উদ্ভাবন ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েট ক্রেডিট’ (Appropriate credit বা ‘জুতসই ঋণ’) শব্দটি। এ বিকল্প শব্দের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির জন্য জুতসই ধরনের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও তিনি হাজির করেছেন।

ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বোঝাতে শব্দের এ ধীর পরিবর্তন আরও স্পষ্ট হয় পিকেএসএফের ওয়েবসাইটে, যেখানে নিজ সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘১৯৯০এ কার্যক্রমের শুরুতে পিকেএসএফ গ্রামীণ অকৃষি খাতে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্য নির্ধারণ করে ও সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঋণ কর্মসূচি বিস্তারের কৌশল গ্রহণ করে। গ্রামীণ মাঝারি দরিদ্রদের জন্য চালু করা এ ঋণ কর্মসূচি কালপরিক্রমায় সমাজের বিসদৃশ দারিদ্র্যক্লিস্ট অংশের পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৈচিত্র্য অর্জন করেছে এবং ধীরে ধীরে একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিকসেবা কর্মসূচি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। পিকেএসএফের বর্তমান আর্থিকসেবা কর্মসূচি শহর ও গ্রামের মাঝারি দরিদ্র, হতদরিদ্র, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের অন্তর্ভুক্ত করে। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যদের তাদের চাহিদা-উপযোগী সেবা দেয়া হয়। দরিদ্র মানুষকে স্বল্প-উৎপাদনের বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য সক্ষম করে পিকেএসএফ সক্ষমতা সৃষ্টি, প্রযুক্তি হস্তান্তর, ভ্যালু চেইন উন্নয়ন ও অন্যান্য কৌশলগত সেবা প্রদানকে এর উন্নয়ন কর্মসূচির অংশ করেছে।”

এ পরিবর্তন আরও স্পষ্ট পিকেএসএফের ঘোষিত ৫টি উদ্দেশের প্রথমটিতে, যা হলো: “মাঝারি ও হতদরিদ্র, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য উৎপাদনমূলক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক কমসূচি বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ সংস্থাসমূহকে প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান।” (উপরোক্ত দুটি অংশ পিকেএসএফের ওয়েবসাইটে পাওয়া ইংরেজি থেকে পাঠক-পাঠিকার জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হলো, যার দায়দায়িত্ব বর্তমান লেখকের।) ‘টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ সংস্থাসমূহকে’ (appropriate organisations for implementing sustainable inclusive financial programmes) এই শব্দগুচ্ছ উপরোল্লিখিত পরিবর্তনকে আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে।

প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের বড় ধাক্কাটি এসেছে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে বৈশ্বিক পর্যায় থেকে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন ২০০৫ সালকে ‘আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্রঋণ বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল এবং ‘বিশেষ করে দরিদ্রদের জন্য আর্থিক সেবা পাওয়ার প্রয়োজন’কে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এরপর ২০০৬ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘উন্নয়নের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক ক্ষেত্র তৈরি’ (Building Inclusive Financial Sectors for Development) শীর্ষক বইটি। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান বইটির ‘প্রারম্ভিক কথা’ শুরু করেছেন এভাবে: “বিশেষ করে দরিদ্রদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক ক্ষেত্র তৈরি মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটায়। ক্ষুদ্র ঋণ, একটি সঞ্চয় হিসাব ও বীমা নিম্ন আয়ের পরিবারে বিরাট পরিবর্তন ঘটাতে পারে।” তিনি আহ্বান করেছিলেন ‘দরিদ্রদের ক্ষমতায়িত করতে ও বিচিত্র রকম আর্থিক সেবায় বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের অভিগম্যতা সৃষ্টিতে’ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার।

এসব ছোটবড় পরিবর্তন ঘটেছে ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য’ (MDG) অর্জনের আমলে। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক ২০২০ সালের মধ্যে ১০০ কোটি মানুষকে বৈশ্বিক আর্থিকসেবায় অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেয়। এরপর বিশ্বনেতারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (ঝউএ) নির্ধারণ করেন যার অনেক অর্জনে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে সহায়ক বলে মনে করা হয়। বাজারে প্রাপ্য আর্থিক সেবাসমূহ বিশ্বব্যাপী দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক মানুষের কাছে সহজলভ্য করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিকসেবায় ক্ষুদ্রঋণের এ বিবর্তন স্পষ্টতই একটা বড় পরিবর্তন। অবশ্য এসব পরিবর্তন যত বড়ই হোক সমাজের সবার কল্যাণ নিশ্চিত করতে আর্থিক সেবার পূর্ণ গণতন্ত্রায়ন বা সামাজিকীকরণ এখনও বহু দূরের পদক্ষেপ।

[লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক]