১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম : দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অবদান

সাদেকুর রহমান

(গতকালের পর)

বিদেশি গণমাধ্যমের ভূমিকা মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের মতোই সক্রিয় ও তেজোদীপ্ত। বিবিসির সাংবাদিক মার্ক টালির নিরপেক্ষ সংবাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসী প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত তথ্য তথা পাকিস্তানি বর্বরতা-নৃশংসতার খবর জানতে পেরেছে। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। মার্ক টালির মতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিডনি শ্যানবার্গ, অ্যান্থনী মাসকারেনহাস, ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ, সায়মন ড্রিং, অ্যালেন গিন্সবার্গ, নিকোলাস টোমালিন, মাটির্ন গুনাকাট, জন পিলজার, ডেভিড, পিটার হাজেন হার্স্ট প্রমুখ বিদেশি সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করেছেন। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ও অশ্রুর ছোঁয়া দিয়ে ১৯৭১ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ছবি তুলেছেন ভারতের ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার তরুণ আলোকচিত্রী রঘু রায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ফ্রেমবন্দী করার দুঃসাধ্য কাজটি করেছিলেন তিনি। ছবিগুলোকে এক অসামান্য মহাকাব্য করে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে কজন সফল ক্যামেরাযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চিত্র সেলুলয়েডবন্দী করেছিলেন তাদের একজন ভারতের কিশোর পারেখ। মাত্র আট দিনে তার তোলা ৬৭টি ছবি মুক্তিযুদ্ধের এক অসামান্য দলিল হয়ে আছে। এ ছবিগুলো অবলম্বন করে পরে তিনি ‘বাংলাদেশ : এ ব্রুটাল বার্থ’ নামে একটি ফটোগ্রাফি বই প্রকাশ করেন।

ভারতের নয়াদিল্লিসহ প্রায় সব প্রদেশ থেকে প্রকাশিত পত্রিকাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা তুলে ধরে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ‘আনন্দ বাজার পত্রিকা’, ‘দেশ’, ত্রিপুরার ‘সংবাদ’, ‘জাগরণ’, ‘গণরাজ’, ‘রুদ্রবীণা’, ‘নাগরিক জনপদ’, ‘সাপ্তাহিত্যিক সমাচার’, ‘দেশের কথা’, ‘সীমান্ত প্রকাশ’ ও ‘ত্রিপুরার কথা নামে’ পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করেছে।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা পালনকারী অন্যান্য দেশের সংবাদপত্রের মধ্যে লন্ডনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’; ‘সানডে টেলিগ্রাম’, ‘সানডে টাইমস্’, ‘পিস নিউজ’, ‘নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘ইভনিং স্টার’, যুগোসøাভিয়ার ‘দ্য কমিউনিস্ট’, টোকিওর ‘মইনিচি শিমবুন’, সিঙ্গাপুরের ‘নিউনেশন’, নেপালের ‘রাইজিং নেপাল’ ও রাশিয়ার ‘প্রাভদা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের খবর

রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপনামূলক ও স্বাধীনতার দিকনির্দেশনামূলক ভাষণের পরদিন (৮ মার্চ) ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল- ‘পরিষদে যাওয়ার প্রশ্ন বিবেচনা করিতে পারি যদি...’। ভেতরে আছে বঙ্গবন্ধুর শর্তগুলো ও ভাষণের বিবরণ। তবে এক্ষেত্রে ‘দৈনিক সংবাদ’ ছিল এগিয়ে। সরাসরি স্বাধীনতার স্লোগানই ঠাঁই পেয়েছিল শিরোনামে। দৈনিক সংবাদের ৮ মার্চের শিরোনাম ছিল ‘এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম : মুজিব’।

অবশ্য ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দিতে চলেছেন তা টের পেয়েছিলো বিশ্ব গণমাধ্যম মার্চের শুরু থেকেই। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ লন্ডনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’, ‘সানডে টাইমস, ‘দি অবজারভার’ এবং ৬ মার্চ ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ৭ মার্চে স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বাভাস দেয়া হয়। ৬ মার্চ লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ছাপা হয়- ‘শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল (৭ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন।’

নিউজ উইক পত্রিকার নিবন্ধ ‘দ্য পয়েট অব পলিটিক্স’ এ বলা হয়েছে- ‘৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি পান।’ ১৯৭১ সালে দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়- ‘শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।’ বিবিসি উল্লেখ করেছিল, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে জন আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনীয় এই ভাষণটি। যেখানে তিনি একাধারে বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়ক।’ এএফপি বলেছিল- ‘৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ঐ দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই বাঙালি জাতি সব রকমের আক্রমণের প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। সংবাদপত্রগুলো এ বিষয়গুলোর উপরও জোর দেয়। যেমন- ২১ মার্চ দৈনিক সংবাদের ভেতরের পাতায় সব জেলার আন্দোলন, বিক্ষোভের সংবাদগুলো একসঙ্গে প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল- ‘মোদের হাড় দিয়ে ভাই জ্বালবো এবার মুক্তির বজ্রানল’।

৭ মার্চের পর ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিকদের আনাগোনা

ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রায় ১৮ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই বাংলাদেশে বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের আনাগোনা শুরু হয়। বাঙালিদের নিজেদের স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলন নয়, বরং বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের পর অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছের দেশ পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কেমন হয় তার ওপরই যেন বেশি চোখ ছিল সাংবাদিকদের। পঁচিশে মার্চ তারা অবস্থান করছিলেন শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। এদের মধ্যে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান ও রাশিয়ার প্রায় ৩৭ জন সাংবাদিক।

২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সকল বিদেশি সাংবাদিককে জোরপূর্বক হোটেলে আটকে রাখে। কেউ ভাবতেও পারেনি কী ঘটতে যাচ্ছে সেই রাতে। নিউইয়র্ক টাইমস তাদের ২৯ তারিখের প্রতিবেদনে লিখে- ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হুমকি দিয়েছে, হোটেল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করা হলে সাংবাদিকদের গুলি করা হবে।’ একই প্রতিবেদনে আটকে পড়া সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে হোটেলে অবস্থানরত এক সৈনিকের জবাব এভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়- ‘উই ওয়ান্ট ইউ টু লিভ বিকজ ইট উইল বি ঠু ডেঞ্জারাস ফর ইউ। ইট উইল বি ঠু ব্লাডি।’ বিদেশি সাংবাদিকরা হোটেল থেকেই দেখতে পেয়েছেন, নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনের উপর সামরিক বাহিনীর বর্বর আক্রমণ। ট্যাঙ্ক, বন্দুক আর মেশিনগানের গুলির শব্দে আঁতকে উঠেছিলেন সবাই।

গণহত্যার ব্যাপারে সাংবাদিকরা যেন কোনো তথ্য বহির্বিশ্বে সরবরাহ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা ছিল পাকিস্তানের অন্যতম কাজ। এর প্রথম কারণ হলো, তারা নিজেরা সম্পূর্ণ অবগত ছিল কীভাবে নিরীহ বাঙালিদের উপর অন্যায়স্বরূপ বীভৎস অত্যাচার চালাচ্ছে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার অধিকারী ছিল এবং তারা ভয় পেয়েছিল যদি বহির্বিশ্বে এটা প্রকাশ পায় যে পাকিস্তানে সরবরাহকৃত মার্কিন অস্ত্র বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে। ফলস্বরূপ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যত দ্রুত সম্ভব সাংবাদিকদের দেশ থেকে বহিষ্কার করার প্রক্রিয়া শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকদের ২৮ মার্চের মধ্যেই ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়।

(চলবে)

(((এই পর্যন্ত পড়া হয়েছে)))

মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ , ১৬ পৌষ ১৪২৬, ৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম : দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অবদান

সাদেকুর রহমান

(গতকালের পর)

বিদেশি গণমাধ্যমের ভূমিকা মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের মতোই সক্রিয় ও তেজোদীপ্ত। বিবিসির সাংবাদিক মার্ক টালির নিরপেক্ষ সংবাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসী প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত তথ্য তথা পাকিস্তানি বর্বরতা-নৃশংসতার খবর জানতে পেরেছে। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। মার্ক টালির মতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিডনি শ্যানবার্গ, অ্যান্থনী মাসকারেনহাস, ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ, সায়মন ড্রিং, অ্যালেন গিন্সবার্গ, নিকোলাস টোমালিন, মাটির্ন গুনাকাট, জন পিলজার, ডেভিড, পিটার হাজেন হার্স্ট প্রমুখ বিদেশি সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করেছেন। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ও অশ্রুর ছোঁয়া দিয়ে ১৯৭১ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ছবি তুলেছেন ভারতের ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার তরুণ আলোকচিত্রী রঘু রায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ফ্রেমবন্দী করার দুঃসাধ্য কাজটি করেছিলেন তিনি। ছবিগুলোকে এক অসামান্য মহাকাব্য করে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে কজন সফল ক্যামেরাযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চিত্র সেলুলয়েডবন্দী করেছিলেন তাদের একজন ভারতের কিশোর পারেখ। মাত্র আট দিনে তার তোলা ৬৭টি ছবি মুক্তিযুদ্ধের এক অসামান্য দলিল হয়ে আছে। এ ছবিগুলো অবলম্বন করে পরে তিনি ‘বাংলাদেশ : এ ব্রুটাল বার্থ’ নামে একটি ফটোগ্রাফি বই প্রকাশ করেন।

ভারতের নয়াদিল্লিসহ প্রায় সব প্রদেশ থেকে প্রকাশিত পত্রিকাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা তুলে ধরে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ‘আনন্দ বাজার পত্রিকা’, ‘দেশ’, ত্রিপুরার ‘সংবাদ’, ‘জাগরণ’, ‘গণরাজ’, ‘রুদ্রবীণা’, ‘নাগরিক জনপদ’, ‘সাপ্তাহিত্যিক সমাচার’, ‘দেশের কথা’, ‘সীমান্ত প্রকাশ’ ও ‘ত্রিপুরার কথা নামে’ পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করেছে।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা পালনকারী অন্যান্য দেশের সংবাদপত্রের মধ্যে লন্ডনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’; ‘সানডে টেলিগ্রাম’, ‘সানডে টাইমস্’, ‘পিস নিউজ’, ‘নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘ইভনিং স্টার’, যুগোসøাভিয়ার ‘দ্য কমিউনিস্ট’, টোকিওর ‘মইনিচি শিমবুন’, সিঙ্গাপুরের ‘নিউনেশন’, নেপালের ‘রাইজিং নেপাল’ ও রাশিয়ার ‘প্রাভদা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের খবর

রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপনামূলক ও স্বাধীনতার দিকনির্দেশনামূলক ভাষণের পরদিন (৮ মার্চ) ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল- ‘পরিষদে যাওয়ার প্রশ্ন বিবেচনা করিতে পারি যদি...’। ভেতরে আছে বঙ্গবন্ধুর শর্তগুলো ও ভাষণের বিবরণ। তবে এক্ষেত্রে ‘দৈনিক সংবাদ’ ছিল এগিয়ে। সরাসরি স্বাধীনতার স্লোগানই ঠাঁই পেয়েছিল শিরোনামে। দৈনিক সংবাদের ৮ মার্চের শিরোনাম ছিল ‘এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম : মুজিব’।

অবশ্য ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দিতে চলেছেন তা টের পেয়েছিলো বিশ্ব গণমাধ্যম মার্চের শুরু থেকেই। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ লন্ডনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’, ‘সানডে টাইমস, ‘দি অবজারভার’ এবং ৬ মার্চ ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ৭ মার্চে স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বাভাস দেয়া হয়। ৬ মার্চ লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ছাপা হয়- ‘শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল (৭ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন।’

নিউজ উইক পত্রিকার নিবন্ধ ‘দ্য পয়েট অব পলিটিক্স’ এ বলা হয়েছে- ‘৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি পান।’ ১৯৭১ সালে দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়- ‘শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।’ বিবিসি উল্লেখ করেছিল, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে জন আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনীয় এই ভাষণটি। যেখানে তিনি একাধারে বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়ক।’ এএফপি বলেছিল- ‘৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ঐ দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই বাঙালি জাতি সব রকমের আক্রমণের প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। সংবাদপত্রগুলো এ বিষয়গুলোর উপরও জোর দেয়। যেমন- ২১ মার্চ দৈনিক সংবাদের ভেতরের পাতায় সব জেলার আন্দোলন, বিক্ষোভের সংবাদগুলো একসঙ্গে প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল- ‘মোদের হাড় দিয়ে ভাই জ্বালবো এবার মুক্তির বজ্রানল’।

৭ মার্চের পর ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিকদের আনাগোনা

ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রায় ১৮ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই বাংলাদেশে বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের আনাগোনা শুরু হয়। বাঙালিদের নিজেদের স্বাধীনতা আদায়ের আন্দোলন নয়, বরং বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের পর অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছের দেশ পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কেমন হয় তার ওপরই যেন বেশি চোখ ছিল সাংবাদিকদের। পঁচিশে মার্চ তারা অবস্থান করছিলেন শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। এদের মধ্যে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান ও রাশিয়ার প্রায় ৩৭ জন সাংবাদিক।

২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সকল বিদেশি সাংবাদিককে জোরপূর্বক হোটেলে আটকে রাখে। কেউ ভাবতেও পারেনি কী ঘটতে যাচ্ছে সেই রাতে। নিউইয়র্ক টাইমস তাদের ২৯ তারিখের প্রতিবেদনে লিখে- ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হুমকি দিয়েছে, হোটেল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করা হলে সাংবাদিকদের গুলি করা হবে।’ একই প্রতিবেদনে আটকে পড়া সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে হোটেলে অবস্থানরত এক সৈনিকের জবাব এভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়- ‘উই ওয়ান্ট ইউ টু লিভ বিকজ ইট উইল বি ঠু ডেঞ্জারাস ফর ইউ। ইট উইল বি ঠু ব্লাডি।’ বিদেশি সাংবাদিকরা হোটেল থেকেই দেখতে পেয়েছেন, নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনের উপর সামরিক বাহিনীর বর্বর আক্রমণ। ট্যাঙ্ক, বন্দুক আর মেশিনগানের গুলির শব্দে আঁতকে উঠেছিলেন সবাই।

গণহত্যার ব্যাপারে সাংবাদিকরা যেন কোনো তথ্য বহির্বিশ্বে সরবরাহ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা ছিল পাকিস্তানের অন্যতম কাজ। এর প্রথম কারণ হলো, তারা নিজেরা সম্পূর্ণ অবগত ছিল কীভাবে নিরীহ বাঙালিদের উপর অন্যায়স্বরূপ বীভৎস অত্যাচার চালাচ্ছে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার অধিকারী ছিল এবং তারা ভয় পেয়েছিল যদি বহির্বিশ্বে এটা প্রকাশ পায় যে পাকিস্তানে সরবরাহকৃত মার্কিন অস্ত্র বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে। ফলস্বরূপ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যত দ্রুত সম্ভব সাংবাদিকদের দেশ থেকে বহিষ্কার করার প্রক্রিয়া শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকদের ২৮ মার্চের মধ্যেই ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়।

(চলবে)

(((এই পর্যন্ত পড়া হয়েছে)))