দুর্গম বোবারথল জনপদের বাসিন্দাদের বোবা কান্না

ইসমাইল মাহমুদ

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী একটি পাহাড়ি জনপদ ‘বোবারথল’। ১০টি পাহাড়ি গ্রাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত দুর্গম বোবারথল জনপদের বাসিন্দাদের মনে যুগ যুগ ধরে শান্তির কোন সুবাতাস নেই। নেই আধুনিক জীবনযাত্রার লেশমাত্র। বর্তমান আধুনিক জীবন ব্যবস্থা থেকে শত বছর পিছিয়ে রয়েছে পাহাড়ি এ জনপদের বাসিন্দারা। মাত্র পাঁচ বছর পূর্বেও এ জনপদের চিকিৎসা বলতে ছিল শুধু গ্রাম্য কবিরাজের তাবিজ ও পানিপড়া। বোবারথল জনপদের ১০ গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তির শিক্ষা দৌড় ছিল এইচএসসি পর্যন্ত। পরিবার পরিকল্পনা কি তা এখনও জানেন না ওই ১০ গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষ। প্রতিটি পরিবারে তাই শিশুদের ছড়াছড়ি। গ্রামের বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অথৈবচ। বর্তমান বাজারে একটি আনারসের মূল্য যেখানে ২৫ থেকে ৩০ টাকা সেখানে অত্যন্ত নাজুক যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে বোবারথল গ্রামের বাসিন্দাদের উৎপাদিত আনারস ওই গ্রামে বিক্রি হয় ২ টাকা থেকে ৩ টাকা। একটি কমলা বিক্রি হয় ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা। একটি কাঁঠাল পাওয়া যায় ৩ টাকা থেকে ৫ টাকায়। শাকসবজি পাওয়া যায় প্রায় পানির দামে, যা বর্তমান সময়ে দেশের কোন স্থানেই কল্পনাও করা যায় না। চরম অবহেলিত ‘বোবারথল’ পাহাড়ি জনপদ যেন একটি অভিশপ্ত জনপদের নাম।

বড়লেখা উপজেলা সদর থেকে বোবারথল গ্রামে যেতে হলে ৮ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়। আর এ পথে পেরোতে হবে ১২টি সুউচ্চ টিলা। যার প্রত্যেকটির উচ্চতা সমতল ভূমি থেকে ৩শ’ থেকে ৪শ’ ফিট। কোন কোন টিলা আবার একেবারে খাড়া। টিলার চুড়ায় ওঠতে একটু বেখেয়াল হলে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। মাঝে-মধ্যে রয়েছে ঘন ঝোপ। এর ওপর রয়েছে বিষধর সাপ, বন বিড়াল, পাহাড়ি কুকুর, ভাল্কুক-উল্লুকসহ নানা জাতের হিংস্র বন্যপ্রাণীর উৎপাত। এতসব ঝক্কি-ঝামেলা নিয়ে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে বোবারথল গ্রামের বাসিন্দারা পারতপক্ষে শহরের পথ মাড়ান না।

বোবারথল জনপদের প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ১৯৬৪ সালের পূর্বে বোবারথল দুর্গম পাহাড়ে মানুষের বসবাস সম্ভব তা ছিল কল্পনারও অতীত। ঘন জঙ্গলে পা পড়েনি কোন জনমানুষের। বোবারথল ও এর আশপাশের এলাকা ছিল বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এ পাহাড়ে যাতায়াতের কোন পথ ছিল না। সেটি ছিল সমতল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বিপ। তবে অনেকে দাবি করেন ওই সময়ে বোবারথল পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু টিলার ওপরে পাকিস্তান ইপিআর ক্যাম্প ছিল। ক্যাম্পটির ইপিআর সদস্যদের খাবারসহ সবকিছু আনা-নেয়া হতো হেলিকপ্টারের সাহায্যে। ইপিআর সদস্যদের শাস্তিমূলক বদলি করা হতো সড়ক যোগাযোগবিহীন বোবারথলে। আর হেলিকপ্টারের সাহায্যে তাদের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ রক্ষা করা হতো।

দুর্গম ও সড়ক যোগাযোগবিহীন বোবারথলে বসতি স্থাপন সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৬৪ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে সংঘটিত হয় ভয়াবহ দাঙ্গা। সে দাঙ্গায় সর্বস্ব হারিয়ে কিছু ভারতীয় নাগরিক (মোহাজের) সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য বোবারথলে এসে আশ্রয় নেন। প্রথম বছরেই হিংস্র বন্যপ্রাণীর হামলায় বেশকিছু আশ্রয়গ্রহণকারী মারা যান। ওপাড়ে ভয়াবহ দাঙ্গা, এপাড়ে বন্যপ্রাণীর হামলা। তারপরও ভারতীয় নাগরিকরা শত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে জীবনকে হাতে নিয়ে নিজ দেশে না ফিরে থেকে যান দুর্গম বোবারথলে। শুরু হয় তাদের আরেক সংগ্রামী জীবন। এখনও সভ্যতার আলো ও আধুনিক জীবন ব্যবস্থা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা বোবারথলে ইতোমধ্যে তাদের কেটে গেছে প্রায় ৬৫ বছর। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিহীন বোবাথলের অনেক বাসিন্দা কোন দিনই শহরের আলো ঝলমলে জীবন সচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারেননি। গ্রামটির বাসিন্দাদের অসুখ-বিসুখে গ্রাম্য কবিরাজ ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। আধুনিক ও প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা ভাগ্যে ঝুটেনি অনেক বাসিন্দার। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে তারা প্রায় অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছেন।

মাত্র পাঁচ থেকে সাত বছর পূর্বেও গ্রামটির অধিকাংশ বাসিন্দাই জানতেন না পরিবার-পরিকল্পনা কি। বছর বছর শিশু জন্মায় এমন পরিবার অসংখ্য। এমনও অনেক পরিবার আছে যে পরিবারে সদস্য সংখ্যা দশের অধিক। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বোবারথল গ্রামের কৃষক অলি মিয়ার পরিবার গ্রামের সবচেয়ে বড় পরিবার। অলি মিয়া-নুরজাহান দম্পত্তির বিয়ে প্রথম ১৬ বছরে জন্ম নিয়েছে ১১ শিশু। এ ব্যাপারে অলি মিয়ার ভাষ্য ‘আল্লায় বাচ্চা দিলে আমরা কিতা (কি) করতাম (করব)’। বাচ্চা প্রসবকালে এক সময় ওই গ্রামের অনেক মহিলা মারা যেতেন প্রতি বছর। হৃদরোগ, যক্ষ্মা, শ্বাসকষ্টসহ সব রোগের চিকিৎসক ছিলেন মাত্র ১ জন। সর্বরোগের চিকিৎসক সিরাজ আলী কবিরাজ। তার তাবিজ আর পানি পড়াই ছিল গ্রামটির বাসিন্দাদের একমাত্র ভরসাস্থল। সিরাজ আলী কবিরাজের বাবাও ছিলেন বোবারথল জনপদের সর্বরোগের চিকিৎসক। তিনি মারা যাবার পর সিরাজ আলী কবিরাজ বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এ পেশায় আসেন। কিন্তু গত পাঁচ বছর যাবত এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বোবারথল জনপদের ১০টি গ্রামের জন্য সরকার ৪টি ইপিআই সেন্টার স্থাপন করেছে। গ্রামের ‘ডাক্তার আপা’ ইপিআই কর্মী নাজমা বেগম গ্রামের মানুষকে তাবিজ-পানি পড়ার বিকল্প হিসেবে আধুনিক এলোপ্যাথ ওষুধের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। স্বাস্থ্য সচেতনার সব বিষয়ে ‘ডাক্তার আপা’ গ্রামের বাসিন্দাদের সম্যক ধারণা দিয়েছেন। ‘ডাক্তার আপা’ নাজমা বেগমের কার্যক্রমে প্রথমে গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে মৃদু আপত্তি ওঠে। অনেকেই প্রকাশ্যে ‘ডাক্তার আপা’ নাজমা বেগমের বিরোধিতা করে বলেন ‘হারা (সারা) জীবন হামরা (আমরা) কবিরাজর (কবিরাজের) পানি পড়াত (পড়ায়) ভালা অইছি (হইছি)। অহন (এখন) ইতা (এসব) কিতা (কি) হুনি (শুনি)’। কিন্তু আস্তে আস্তে তাদের ভুল ভাঙতে শুরু করেছে। গ্রামের বাসিন্দাদের প্রাথমিক চিকিৎসা, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা চলছে দ্রুতগতিতে। সেই সঙ্গে চলছে শিশুদের ঠিকাদানসহ নানা কার্যক্রম।

১০টি পাহাড়ি গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বোবারথল জনপদে চিত্ত বিনোদন ও খেলাধুলার কোন ব্যবস্থা নেই। পুরো ১০ গ্রামজুড়ে টেলিভিশন রয়েছে মাত্র ৫টি। কয়েক বছর আগে ২টি সাদা-কালো টেলিভিশন চলতো ব্যাটারির সাহায্যে। এগুলোও ছিল দুটি দোকানে। সে সময়ে প্রতিদিন বোবারথল বাজারে অবস্থিত আছিরদ্দিন মিয়ার চায়ের দোকান এবং ষাটঘরি গ্রামে আবদুর রহমানের মনোহারী দোকানে টেলিভিশন দেখার জন্য ভিড় জমে ওঠতো। সে দুটো দোকানে বিটিভি’র বাংলা সিনেমা জনপ্রতি ৩ টাকা, সাপ্তাহিক নাটক জনপ্রতি ২ টাকা, সিরিজ নাটক জনপ্রতি ১ টাকা ইত্যাদি হারে টিকিটের মাধ্যমে দেখতেন ১০ গ্রামের বাসিন্দারা। এখন কয়েকটি বাড়িতে এসেছে টেলিভিশন। সমগ্র বোবারথল জনপদের শিশুদের কাছে লাঠিম, দৌড়, মার্বেল, ডাংগুটি, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, কানামাছি ইত্যাদি খেলাই তাদের অবসরের উপকরণ। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর বোবারথল জনপদের বাসিন্দারা আড্ডা মেরেই সময় অতিক্রান্ত করেন। বোবারথল জনপদের ১০ গ্রামের মধ্যে সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি মো. আবদুস শহীদ। উত্তর ষাটঘড়ি গ্রামের মতলিব মিয়ার পুত্র মো. আবদুস শহীদ গ্রামের বাইরে গিয়ে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। বোবারথল জনপদে একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও সেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। ১০ গ্রামের বাসিন্দাদের শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার কোন পদক্ষেপ ছিল না। তখনকার সময়ে অনেক অভিভাবক মনে করতেন শিক্ষিত হয়ে কি হবে? গ্রামের কেউতো আর জজ ব্যারিস্টার হবে না। কাজ করেই খেতে হবে। তাই শিক্ষার দরকার নেই। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টেছে। শিশুরা বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে। তবে এর হার এখনও আশাপ্রদ নয়।

বোবারথণ জনপদে একটি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। এটিরও প্রাশাসনিক কার্যক্রম চলছে ঢিমেতালে। কয়েকবার এ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা হলেও দুর্গম এ পাহাড়ি জনপদে কোন শিক্ষক পাঠদানে যেতে রাজি হননি। শুধু শিক্ষকের অভাবে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবন পড়ে রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়।

বোবারথল জনপদের বাসিন্দাদের স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফসল শহরে নিয়ে বিক্রি করা হয়। ফসল শহরে নেয়ার জন্য এ জনপদে কিছু বারুয়া (ভার বহনকারী) রয়েছেন। যারা অর্থের বিনিময়ে মালামাল এবং এলাকার কোন রোগীকে গুরুতর অবস্থায় শহরের হাসপাতালে নিতে হলে বাঁশের মাচান বেঁধে কাঁধে করে শহরে নিয়ে যায়। এ জন্য তাদের দিতে হয় জনপ্রতি প্রতিদিন ২ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। ফল মৌসুমে সপ্তাহের প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার বোবারথল বাজারে আনারস-কমলা-কাঁঠালের হাট বসে। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ দুর্গম হওয়ায় এসব হাটে বিক্রেতার তুলনায় ক্রেতা থাকেন কম। ফলে বিক্রেতাদের অনেকের পক্ষে তাদের উৎপাদিত ফল বিক্রি করা সম্ভব হয় না। বারুয়াদের দিয়ে শহরে পাঠিয়েও অনেক সময় লাভের মুখ দেখেন না তারা। বারুয়াদের মজুরি, বাজারে ইজারার টাকা পরিশোধ করার টাকাও অনেক সময় উঠে আসে না।

স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বোবারথল জনপদের খাসিয়া পান পুঞ্জির পাশে একটি টিলায় বিরাট এলাকাজুড়ে মাটির নিচে কয়লার খনি রয়েছে। এলাকার মানুষ ওই টিলা থেকে মাটি খুঁড়ে কয়লা উত্তোলন করে জ্বালানির কাজে ব্যবহার করছেন। এ টিলা থেকে কয়লা উত্তোলনের কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এখান থেকে কয়লা উত্তোলনের পদক্ষেপ নেয়া হলে বোবারথলের রাস্তা-ঘাট নির্মাণ হবে। অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্ত হবেন তারা। অন্যদিকে সরকার কয়লা বিক্রি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে।

[লেখক : গণমাধ্যকর্মী ও কলামিস্ট]

ismail.press2019@gmail.com

বুধবার, ০১ জানুয়ারী ২০২০ , ১৮ পৌষ ১৪২৬, ৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

দুর্গম বোবারথল জনপদের বাসিন্দাদের বোবা কান্না

ইসমাইল মাহমুদ

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী একটি পাহাড়ি জনপদ ‘বোবারথল’। ১০টি পাহাড়ি গ্রাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত দুর্গম বোবারথল জনপদের বাসিন্দাদের মনে যুগ যুগ ধরে শান্তির কোন সুবাতাস নেই। নেই আধুনিক জীবনযাত্রার লেশমাত্র। বর্তমান আধুনিক জীবন ব্যবস্থা থেকে শত বছর পিছিয়ে রয়েছে পাহাড়ি এ জনপদের বাসিন্দারা। মাত্র পাঁচ বছর পূর্বেও এ জনপদের চিকিৎসা বলতে ছিল শুধু গ্রাম্য কবিরাজের তাবিজ ও পানিপড়া। বোবারথল জনপদের ১০ গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তির শিক্ষা দৌড় ছিল এইচএসসি পর্যন্ত। পরিবার পরিকল্পনা কি তা এখনও জানেন না ওই ১০ গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষ। প্রতিটি পরিবারে তাই শিশুদের ছড়াছড়ি। গ্রামের বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অথৈবচ। বর্তমান বাজারে একটি আনারসের মূল্য যেখানে ২৫ থেকে ৩০ টাকা সেখানে অত্যন্ত নাজুক যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে বোবারথল গ্রামের বাসিন্দাদের উৎপাদিত আনারস ওই গ্রামে বিক্রি হয় ২ টাকা থেকে ৩ টাকা। একটি কমলা বিক্রি হয় ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা। একটি কাঁঠাল পাওয়া যায় ৩ টাকা থেকে ৫ টাকায়। শাকসবজি পাওয়া যায় প্রায় পানির দামে, যা বর্তমান সময়ে দেশের কোন স্থানেই কল্পনাও করা যায় না। চরম অবহেলিত ‘বোবারথল’ পাহাড়ি জনপদ যেন একটি অভিশপ্ত জনপদের নাম।

বড়লেখা উপজেলা সদর থেকে বোবারথল গ্রামে যেতে হলে ৮ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়। আর এ পথে পেরোতে হবে ১২টি সুউচ্চ টিলা। যার প্রত্যেকটির উচ্চতা সমতল ভূমি থেকে ৩শ’ থেকে ৪শ’ ফিট। কোন কোন টিলা আবার একেবারে খাড়া। টিলার চুড়ায় ওঠতে একটু বেখেয়াল হলে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। মাঝে-মধ্যে রয়েছে ঘন ঝোপ। এর ওপর রয়েছে বিষধর সাপ, বন বিড়াল, পাহাড়ি কুকুর, ভাল্কুক-উল্লুকসহ নানা জাতের হিংস্র বন্যপ্রাণীর উৎপাত। এতসব ঝক্কি-ঝামেলা নিয়ে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে বোবারথল গ্রামের বাসিন্দারা পারতপক্ষে শহরের পথ মাড়ান না।

বোবারথল জনপদের প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, ১৯৬৪ সালের পূর্বে বোবারথল দুর্গম পাহাড়ে মানুষের বসবাস সম্ভব তা ছিল কল্পনারও অতীত। ঘন জঙ্গলে পা পড়েনি কোন জনমানুষের। বোবারথল ও এর আশপাশের এলাকা ছিল বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এ পাহাড়ে যাতায়াতের কোন পথ ছিল না। সেটি ছিল সমতল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বিপ। তবে অনেকে দাবি করেন ওই সময়ে বোবারথল পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু টিলার ওপরে পাকিস্তান ইপিআর ক্যাম্প ছিল। ক্যাম্পটির ইপিআর সদস্যদের খাবারসহ সবকিছু আনা-নেয়া হতো হেলিকপ্টারের সাহায্যে। ইপিআর সদস্যদের শাস্তিমূলক বদলি করা হতো সড়ক যোগাযোগবিহীন বোবারথলে। আর হেলিকপ্টারের সাহায্যে তাদের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ রক্ষা করা হতো।

দুর্গম ও সড়ক যোগাযোগবিহীন বোবারথলে বসতি স্থাপন সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৬৪ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে সংঘটিত হয় ভয়াবহ দাঙ্গা। সে দাঙ্গায় সর্বস্ব হারিয়ে কিছু ভারতীয় নাগরিক (মোহাজের) সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য বোবারথলে এসে আশ্রয় নেন। প্রথম বছরেই হিংস্র বন্যপ্রাণীর হামলায় বেশকিছু আশ্রয়গ্রহণকারী মারা যান। ওপাড়ে ভয়াবহ দাঙ্গা, এপাড়ে বন্যপ্রাণীর হামলা। তারপরও ভারতীয় নাগরিকরা শত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে জীবনকে হাতে নিয়ে নিজ দেশে না ফিরে থেকে যান দুর্গম বোবারথলে। শুরু হয় তাদের আরেক সংগ্রামী জীবন। এখনও সভ্যতার আলো ও আধুনিক জীবন ব্যবস্থা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা বোবারথলে ইতোমধ্যে তাদের কেটে গেছে প্রায় ৬৫ বছর। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিহীন বোবাথলের অনেক বাসিন্দা কোন দিনই শহরের আলো ঝলমলে জীবন সচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারেননি। গ্রামটির বাসিন্দাদের অসুখ-বিসুখে গ্রাম্য কবিরাজ ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। আধুনিক ও প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা ভাগ্যে ঝুটেনি অনেক বাসিন্দার। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে তারা প্রায় অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছেন।

মাত্র পাঁচ থেকে সাত বছর পূর্বেও গ্রামটির অধিকাংশ বাসিন্দাই জানতেন না পরিবার-পরিকল্পনা কি। বছর বছর শিশু জন্মায় এমন পরিবার অসংখ্য। এমনও অনেক পরিবার আছে যে পরিবারে সদস্য সংখ্যা দশের অধিক। গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বোবারথল গ্রামের কৃষক অলি মিয়ার পরিবার গ্রামের সবচেয়ে বড় পরিবার। অলি মিয়া-নুরজাহান দম্পত্তির বিয়ে প্রথম ১৬ বছরে জন্ম নিয়েছে ১১ শিশু। এ ব্যাপারে অলি মিয়ার ভাষ্য ‘আল্লায় বাচ্চা দিলে আমরা কিতা (কি) করতাম (করব)’। বাচ্চা প্রসবকালে এক সময় ওই গ্রামের অনেক মহিলা মারা যেতেন প্রতি বছর। হৃদরোগ, যক্ষ্মা, শ্বাসকষ্টসহ সব রোগের চিকিৎসক ছিলেন মাত্র ১ জন। সর্বরোগের চিকিৎসক সিরাজ আলী কবিরাজ। তার তাবিজ আর পানি পড়াই ছিল গ্রামটির বাসিন্দাদের একমাত্র ভরসাস্থল। সিরাজ আলী কবিরাজের বাবাও ছিলেন বোবারথল জনপদের সর্বরোগের চিকিৎসক। তিনি মারা যাবার পর সিরাজ আলী কবিরাজ বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এ পেশায় আসেন। কিন্তু গত পাঁচ বছর যাবত এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বোবারথল জনপদের ১০টি গ্রামের জন্য সরকার ৪টি ইপিআই সেন্টার স্থাপন করেছে। গ্রামের ‘ডাক্তার আপা’ ইপিআই কর্মী নাজমা বেগম গ্রামের মানুষকে তাবিজ-পানি পড়ার বিকল্প হিসেবে আধুনিক এলোপ্যাথ ওষুধের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। স্বাস্থ্য সচেতনার সব বিষয়ে ‘ডাক্তার আপা’ গ্রামের বাসিন্দাদের সম্যক ধারণা দিয়েছেন। ‘ডাক্তার আপা’ নাজমা বেগমের কার্যক্রমে প্রথমে গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে মৃদু আপত্তি ওঠে। অনেকেই প্রকাশ্যে ‘ডাক্তার আপা’ নাজমা বেগমের বিরোধিতা করে বলেন ‘হারা (সারা) জীবন হামরা (আমরা) কবিরাজর (কবিরাজের) পানি পড়াত (পড়ায়) ভালা অইছি (হইছি)। অহন (এখন) ইতা (এসব) কিতা (কি) হুনি (শুনি)’। কিন্তু আস্তে আস্তে তাদের ভুল ভাঙতে শুরু করেছে। গ্রামের বাসিন্দাদের প্রাথমিক চিকিৎসা, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা চলছে দ্রুতগতিতে। সেই সঙ্গে চলছে শিশুদের ঠিকাদানসহ নানা কার্যক্রম।

১০টি পাহাড়ি গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বোবারথল জনপদে চিত্ত বিনোদন ও খেলাধুলার কোন ব্যবস্থা নেই। পুরো ১০ গ্রামজুড়ে টেলিভিশন রয়েছে মাত্র ৫টি। কয়েক বছর আগে ২টি সাদা-কালো টেলিভিশন চলতো ব্যাটারির সাহায্যে। এগুলোও ছিল দুটি দোকানে। সে সময়ে প্রতিদিন বোবারথল বাজারে অবস্থিত আছিরদ্দিন মিয়ার চায়ের দোকান এবং ষাটঘরি গ্রামে আবদুর রহমানের মনোহারী দোকানে টেলিভিশন দেখার জন্য ভিড় জমে ওঠতো। সে দুটো দোকানে বিটিভি’র বাংলা সিনেমা জনপ্রতি ৩ টাকা, সাপ্তাহিক নাটক জনপ্রতি ২ টাকা, সিরিজ নাটক জনপ্রতি ১ টাকা ইত্যাদি হারে টিকিটের মাধ্যমে দেখতেন ১০ গ্রামের বাসিন্দারা। এখন কয়েকটি বাড়িতে এসেছে টেলিভিশন। সমগ্র বোবারথল জনপদের শিশুদের কাছে লাঠিম, দৌড়, মার্বেল, ডাংগুটি, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, কানামাছি ইত্যাদি খেলাই তাদের অবসরের উপকরণ। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর বোবারথল জনপদের বাসিন্দারা আড্ডা মেরেই সময় অতিক্রান্ত করেন। বোবারথল জনপদের ১০ গ্রামের মধ্যে সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি মো. আবদুস শহীদ। উত্তর ষাটঘড়ি গ্রামের মতলিব মিয়ার পুত্র মো. আবদুস শহীদ গ্রামের বাইরে গিয়ে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। বোবারথল জনপদে একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও সেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। ১০ গ্রামের বাসিন্দাদের শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার কোন পদক্ষেপ ছিল না। তখনকার সময়ে অনেক অভিভাবক মনে করতেন শিক্ষিত হয়ে কি হবে? গ্রামের কেউতো আর জজ ব্যারিস্টার হবে না। কাজ করেই খেতে হবে। তাই শিক্ষার দরকার নেই। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টেছে। শিশুরা বিদ্যালয়মুখী হচ্ছে। তবে এর হার এখনও আশাপ্রদ নয়।

বোবারথণ জনপদে একটি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। এটিরও প্রাশাসনিক কার্যক্রম চলছে ঢিমেতালে। কয়েকবার এ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা হলেও দুর্গম এ পাহাড়ি জনপদে কোন শিক্ষক পাঠদানে যেতে রাজি হননি। শুধু শিক্ষকের অভাবে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবন পড়ে রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়।

বোবারথল জনপদের বাসিন্দাদের স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফসল শহরে নিয়ে বিক্রি করা হয়। ফসল শহরে নেয়ার জন্য এ জনপদে কিছু বারুয়া (ভার বহনকারী) রয়েছেন। যারা অর্থের বিনিময়ে মালামাল এবং এলাকার কোন রোগীকে গুরুতর অবস্থায় শহরের হাসপাতালে নিতে হলে বাঁশের মাচান বেঁধে কাঁধে করে শহরে নিয়ে যায়। এ জন্য তাদের দিতে হয় জনপ্রতি প্রতিদিন ২ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। ফল মৌসুমে সপ্তাহের প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার বোবারথল বাজারে আনারস-কমলা-কাঁঠালের হাট বসে। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ দুর্গম হওয়ায় এসব হাটে বিক্রেতার তুলনায় ক্রেতা থাকেন কম। ফলে বিক্রেতাদের অনেকের পক্ষে তাদের উৎপাদিত ফল বিক্রি করা সম্ভব হয় না। বারুয়াদের দিয়ে শহরে পাঠিয়েও অনেক সময় লাভের মুখ দেখেন না তারা। বারুয়াদের মজুরি, বাজারে ইজারার টাকা পরিশোধ করার টাকাও অনেক সময় উঠে আসে না।

স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বোবারথল জনপদের খাসিয়া পান পুঞ্জির পাশে একটি টিলায় বিরাট এলাকাজুড়ে মাটির নিচে কয়লার খনি রয়েছে। এলাকার মানুষ ওই টিলা থেকে মাটি খুঁড়ে কয়লা উত্তোলন করে জ্বালানির কাজে ব্যবহার করছেন। এ টিলা থেকে কয়লা উত্তোলনের কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এখান থেকে কয়লা উত্তোলনের পদক্ষেপ নেয়া হলে বোবারথলের রাস্তা-ঘাট নির্মাণ হবে। অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্ত হবেন তারা। অন্যদিকে সরকার কয়লা বিক্রি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে।

[লেখক : গণমাধ্যকর্মী ও কলামিস্ট]

ismail.press2019@gmail.com