১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অবদান

সাদেকুর রহমান

(গতকালের পর)

নিউইয়র্ক টাইমসের ২৮ মার্চের সংবাদের শিরোনামে ৩৫ জন সাংবাদিকের দেশ ত্যাগের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকদের সঠিক সংখ্যা ছিল ৩৭। সেখানে আরও দুজন সাংবাদিকের কথা আলাদা করে উঠে আসে, তখন যাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রতিবেদনে বলা হয়, যখন সাংবাদিকদের একসঙ্গে আটকে রাখা হয় তখন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ও রয়টার্সের দুজন সাংবাদিক হোটেলে ছিলেন না। অফিসে তাদের সন্ধান করা হলে অফিস জানায় এখন পর্যন্ত ঢাকা থেকে তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

পাকিস্তানি হায়েনাদের ধর্ষণকাণ্ডের খবর : একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল পরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের পক্ষে দেশটির তৎকালীন সরকার বেশ তৎপরও ছিল। তবে দেশটির স্বাধীন গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের লড়াই, বিজয়, গৌরব আর ধর্ষণের শিকার নারীর দুঃখগাঁথা প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে, ব্যাপক পরিসরে। একাধিক মার্কিন সাংবাদিক যুদ্ধের সময় ও আগে-পরে চষে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশ।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের আর্কাইভ থেকে পাওয়া এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণের শিকার নারী চোখে আগুন আর কণ্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে ওই সময় বলেছিলেন, ‘একদিন বিচার হবেই। ’ এক বৃদ্ধার হাহাকারের বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই সময় নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক তার প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, “আমার হয়তো বলা উচিত ছিল, একদিন তিনি ন্যায়বিচারের আদালতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতে পারবেন এবং ওই লোকগুলো তাদের কৃতকর্মের সাজা পাবে। আমি নিজের কথাতেই বিশ্বাস রাখতে পারিনি। ”

অপর এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য নিয়ে উদ্বেগের কথা প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশ সফরে এসে ইয়াহিয়া খান ও সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর দায় চাপিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ক্ষমা চাওয়া ও জনবিক্ষোভের খবরও রয়েছে আর্কাইভে।

মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে বাংলাদেশ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের একাধিক প্রতিবেদন এর আর্কাইভে প্রিন্ট সংস্করণে সংরক্ষিত আছে। এই আর্কাইভকে ‘টাইম মেশিন’ বলে থাকে নিউইয়র্ক টাইমস।

১৯৭১-এ মুজিবনগর থেকে অনেকগুলো পত্রিকা বের হতো। এই পত্রিকাগুলোতেও মেলে ধর্ষণের খবর। সিলেটের শালুটিকরে নারী ধর্ষণের ব্যাপকতার সাক্ষ্য ‘সাপ্তাহিক বাংলা’। পত্রিকাটির ১৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ‘আম্বরখানা কলোনী ও মডেল স্কুলে ৫ শতাধিক বাঙালি মেয়ে বন্দিনী’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে স্পষ্ট পাওয়া যায় নারী নির্যাতনের দলিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “পাঁচ শতাধিক বাঙালি মেয়ে আজও সিলেট শহরের আম্বরখানা কলোনী ও শালুটিকর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে বন্দিনী হয়ে আছে। পাক সেনাদের সীমাহীন অত্যাচারে দুঃসহ তাদের জীবন। কিন্তু মরার কোন উপায় নেই। পরনের শাড়িগুলি পর্যন্ত পশুরা ছিনিয়ে নিয়েছে। গলায় দড়ি দেবার পর্যন্ত উপায় নেই। পরণে সামান্য একটা জাইঙ্গা আর ব্রেসিয়ার।

অর্ধনগ্ন এই সব মেয়েদের উপর রোজই চলে পাশবিক বলাৎকার। দানবের পৌনঃপুনিক ধর্ষণে ওরা বিধ্বস্ত। দস্যুরা বস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে নিয়তই লুঠে নিচ্ছে ওদের মান সম্ভ্রম-কুমারীত্ব আর সতীত্বকে। বুকফাটা কান্না চার দেয়ালে বাধা পেয়ে ওদের কাছেই আবার ফিরে আসে।

কে জানে তাদের মুক্তিকামী ভাই আর সন্তানেরা কবে তাদেরকে নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবে।”

গণমাধ্যমগুলো তুলে ধরে পঁচিশে মার্চের গণহত্যার কথা :

‘পদ্মা অববাহিকার আকাশ ছেয়ে গেছে শকুনে শকুনে। ইতোমধ্যেই আড়াই লাখ বাঙালির লাশ তারা পেয়েছে খাদ্য হিসেবে। কুয়োর পানিতে, খানা খন্দে, কচুরিপানার নিচে শিশু সন্তানের চোখের সামনে পচছে পিতা-মাতার লাশ। ’ ঢাকা থেকে এভাবেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচালিত ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালরাতের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছিলেন ‘এসোসিয়েট প্রেস (এপি)’ এর সংবাদদাতা।

শুধু এপিই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গণহত্যার খবর প্রথম ছড়িয়ে দিয়েছিল বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম। তারাই বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিল সেই সময়ের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী মানুষ হত্যার চিত্র। তবে ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ প্রথম চোটে ঢাকাসহ সারাদেশের কত লোককে হত্যা করা হয়েছে তার সংখ্যা কোনো দিনই জানা যাবে না।

পরিকল্পিত গণহত্যার নৃশংসতা ঢেকে রাখার অপকৌশল হিসেবে পরিকল্পিতভাবেই ইয়াহিয়ার জারি করা ৭৭ নম্বর সামরিক বিধির মাধ্যমে প্রথম রাশ টেনে ধরা হয় গণমাধ্যমের। এরপরই সেই সময়ে শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকচক্রের একের পর এক আইন প্রণয়ন। যেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে সঠিক তথ্যসংগ্রহ ও প্রকাশ প্রক্রিয়া। বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেই দেশের ভেতরের অবস্থা তুলে ধরে বেশ কিছু গণমাধ্যম।

তাছাড়া ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের চেহারা আজকের মতো ছিল না। বিদেশের খবর সংগ্রহ করে তা প্রকাশে দু’-তিন দিন লেগে যেত। সেই সময়ে ২৫ মার্চের কালরাতের খবর ২৭ মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল, মে ও জুন মাস পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে।

বিশ্লেষকরা সেই সময়ের পত্রপত্রিকাকে তুলনা করেন বিষ্ফোরকের সঙ্গে। বিস্ফোরক নিয়ে চললে যেমন আইনি বাধার মুখে পড়তে হয়, তেমন পড়তে হতো সেই সময়ে পত্রপত্রিকা নিয়ে চললেও।

সেই সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কথা আসলেই সবার আগে যে নামটি সামনে আসে সেটি সায়মন ড্রিং। ২৫ মার্চের গণহত্যার চিত্র যাতে বিশ্ববাসী জানতে না পারে, সে জন্য পাক হানাদার বাহিনী বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিংয়ের জন্য তাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি।

সায়মন ড্রিং-ই সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে জানান, পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা হয়েছে। তিনি ৩০ মার্চ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে লিখেন, ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’।

২৫ মার্চে ঢাকায় অবস্থানকারী বিদেশি সাংবাদিকদের বাইরে বের হতে নিষেধ করে পাকিস্তান সরকার। তখন হোটেল কন্টিনেন্টালে আরও কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে ছিলেন দ্য টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। নিষেধ উপেক্ষা করে হোটেলের ছাদে উঠে পেছনের দেয়াল টপকে বেরিয়ে পড়েন তিনি।

রাত ১১টা নাগাদ রাস্তায় নামে অস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী। ট্যাংক ও কামানের গর্জনে প্রকম্পিত হতে থাকে ঢাকা। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি সাংবাদিকরা বুঝতে পেরেছিলেন- ভয়াবহ কিছু ঘটতে চলেছে। তাদের আশঙ্কা সত্যি হলো। সেই কালরাতে রক্তে রঞ্জিত হলো ঢাকা। আহত-মৃত্যুমুখী মানুষের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছিল ঢাকার আকাশ।

সেই কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সারা রাত পাকিস্তানের নারকীয় তাণ্ডবে ঝরে যায় প্রায় ৭ হাজার প্রাণ। পুড়িয়ে দেওয়া হয় অসংখ্য ঘরবাড়ি। ২৬ মার্চ সকালে এক মৃত্যুপুরী ঢাকা দেখা যায়। সেই দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং।

সায়মন ড্রিং তার প্রতিবেদন শুরু করেন এভাবে- “ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত ও ভয়ার্ত শহরের নাম। পাকিস্তানি বাহিনীর ঠান্ডা মাথায় চব্বিশ ঘণ্টার নির্মম গুলিবর্ষণে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে বিশাল এলাকা এবং স্বাধীনতার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামের নির্মম পরিণতি ঘটেছে।”

একাত্তরের ২৮ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস তিনটি সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদগুলোর শিরোনাম ছিল- ‘আর্মি এক্সপেলস থার্টি ফাইভ ফরেন নিউজম্যান ফ্রম পাকিস্তান’, ‘আর্টিলারি ইউজ্ড’ ও ‘টোল কল্ড হাই’।

বাংলাদেশের তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ দ্য টেলিগ্রাফ সম্পাদীয়সহ চারটি সংবাদ প্রকাশ করে। এ দিন ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ এ বিষয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ একটি ও ‘দ্য এজ’ চারটি সংবাদ প্রকাশ করে।

বুধবার, ০১ জানুয়ারী ২০২০ , ১৮ পৌষ ১৪২৬, ৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের অবদান

সাদেকুর রহমান

(গতকালের পর)

নিউইয়র্ক টাইমসের ২৮ মার্চের সংবাদের শিরোনামে ৩৫ জন সাংবাদিকের দেশ ত্যাগের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকদের সঠিক সংখ্যা ছিল ৩৭। সেখানে আরও দুজন সাংবাদিকের কথা আলাদা করে উঠে আসে, তখন যাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রতিবেদনে বলা হয়, যখন সাংবাদিকদের একসঙ্গে আটকে রাখা হয় তখন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ও রয়টার্সের দুজন সাংবাদিক হোটেলে ছিলেন না। অফিসে তাদের সন্ধান করা হলে অফিস জানায় এখন পর্যন্ত ঢাকা থেকে তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

পাকিস্তানি হায়েনাদের ধর্ষণকাণ্ডের খবর : একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল পরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের পক্ষে দেশটির তৎকালীন সরকার বেশ তৎপরও ছিল। তবে দেশটির স্বাধীন গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের লড়াই, বিজয়, গৌরব আর ধর্ষণের শিকার নারীর দুঃখগাঁথা প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে, ব্যাপক পরিসরে। একাধিক মার্কিন সাংবাদিক যুদ্ধের সময় ও আগে-পরে চষে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশ।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের আর্কাইভ থেকে পাওয়া এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণের শিকার নারী চোখে আগুন আর কণ্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে ওই সময় বলেছিলেন, ‘একদিন বিচার হবেই। ’ এক বৃদ্ধার হাহাকারের বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই সময় নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক তার প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, “আমার হয়তো বলা উচিত ছিল, একদিন তিনি ন্যায়বিচারের আদালতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতে পারবেন এবং ওই লোকগুলো তাদের কৃতকর্মের সাজা পাবে। আমি নিজের কথাতেই বিশ্বাস রাখতে পারিনি। ”

অপর এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য নিয়ে উদ্বেগের কথা প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশ সফরে এসে ইয়াহিয়া খান ও সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর দায় চাপিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ক্ষমা চাওয়া ও জনবিক্ষোভের খবরও রয়েছে আর্কাইভে।

মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে বাংলাদেশ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের একাধিক প্রতিবেদন এর আর্কাইভে প্রিন্ট সংস্করণে সংরক্ষিত আছে। এই আর্কাইভকে ‘টাইম মেশিন’ বলে থাকে নিউইয়র্ক টাইমস।

১৯৭১-এ মুজিবনগর থেকে অনেকগুলো পত্রিকা বের হতো। এই পত্রিকাগুলোতেও মেলে ধর্ষণের খবর। সিলেটের শালুটিকরে নারী ধর্ষণের ব্যাপকতার সাক্ষ্য ‘সাপ্তাহিক বাংলা’। পত্রিকাটির ১৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ‘আম্বরখানা কলোনী ও মডেল স্কুলে ৫ শতাধিক বাঙালি মেয়ে বন্দিনী’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে স্পষ্ট পাওয়া যায় নারী নির্যাতনের দলিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “পাঁচ শতাধিক বাঙালি মেয়ে আজও সিলেট শহরের আম্বরখানা কলোনী ও শালুটিকর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে বন্দিনী হয়ে আছে। পাক সেনাদের সীমাহীন অত্যাচারে দুঃসহ তাদের জীবন। কিন্তু মরার কোন উপায় নেই। পরনের শাড়িগুলি পর্যন্ত পশুরা ছিনিয়ে নিয়েছে। গলায় দড়ি দেবার পর্যন্ত উপায় নেই। পরণে সামান্য একটা জাইঙ্গা আর ব্রেসিয়ার।

অর্ধনগ্ন এই সব মেয়েদের উপর রোজই চলে পাশবিক বলাৎকার। দানবের পৌনঃপুনিক ধর্ষণে ওরা বিধ্বস্ত। দস্যুরা বস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে নিয়তই লুঠে নিচ্ছে ওদের মান সম্ভ্রম-কুমারীত্ব আর সতীত্বকে। বুকফাটা কান্না চার দেয়ালে বাধা পেয়ে ওদের কাছেই আবার ফিরে আসে।

কে জানে তাদের মুক্তিকামী ভাই আর সন্তানেরা কবে তাদেরকে নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবে।”

গণমাধ্যমগুলো তুলে ধরে পঁচিশে মার্চের গণহত্যার কথা :

‘পদ্মা অববাহিকার আকাশ ছেয়ে গেছে শকুনে শকুনে। ইতোমধ্যেই আড়াই লাখ বাঙালির লাশ তারা পেয়েছে খাদ্য হিসেবে। কুয়োর পানিতে, খানা খন্দে, কচুরিপানার নিচে শিশু সন্তানের চোখের সামনে পচছে পিতা-মাতার লাশ। ’ ঢাকা থেকে এভাবেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচালিত ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালরাতের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছিলেন ‘এসোসিয়েট প্রেস (এপি)’ এর সংবাদদাতা।

শুধু এপিই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গণহত্যার খবর প্রথম ছড়িয়ে দিয়েছিল বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম। তারাই বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিল সেই সময়ের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী মানুষ হত্যার চিত্র। তবে ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ প্রথম চোটে ঢাকাসহ সারাদেশের কত লোককে হত্যা করা হয়েছে তার সংখ্যা কোনো দিনই জানা যাবে না।

পরিকল্পিত গণহত্যার নৃশংসতা ঢেকে রাখার অপকৌশল হিসেবে পরিকল্পিতভাবেই ইয়াহিয়ার জারি করা ৭৭ নম্বর সামরিক বিধির মাধ্যমে প্রথম রাশ টেনে ধরা হয় গণমাধ্যমের। এরপরই সেই সময়ে শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকচক্রের একের পর এক আইন প্রণয়ন। যেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে সঠিক তথ্যসংগ্রহ ও প্রকাশ প্রক্রিয়া। বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেই দেশের ভেতরের অবস্থা তুলে ধরে বেশ কিছু গণমাধ্যম।

তাছাড়া ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের চেহারা আজকের মতো ছিল না। বিদেশের খবর সংগ্রহ করে তা প্রকাশে দু’-তিন দিন লেগে যেত। সেই সময়ে ২৫ মার্চের কালরাতের খবর ২৭ মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল, মে ও জুন মাস পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে।

বিশ্লেষকরা সেই সময়ের পত্রপত্রিকাকে তুলনা করেন বিষ্ফোরকের সঙ্গে। বিস্ফোরক নিয়ে চললে যেমন আইনি বাধার মুখে পড়তে হয়, তেমন পড়তে হতো সেই সময়ে পত্রপত্রিকা নিয়ে চললেও।

সেই সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কথা আসলেই সবার আগে যে নামটি সামনে আসে সেটি সায়মন ড্রিং। ২৫ মার্চের গণহত্যার চিত্র যাতে বিশ্ববাসী জানতে না পারে, সে জন্য পাক হানাদার বাহিনী বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিংয়ের জন্য তাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি।

সায়মন ড্রিং-ই সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীকে জানান, পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা হয়েছে। তিনি ৩০ মার্চ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে লিখেন, ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’।

২৫ মার্চে ঢাকায় অবস্থানকারী বিদেশি সাংবাদিকদের বাইরে বের হতে নিষেধ করে পাকিস্তান সরকার। তখন হোটেল কন্টিনেন্টালে আরও কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে ছিলেন দ্য টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। নিষেধ উপেক্ষা করে হোটেলের ছাদে উঠে পেছনের দেয়াল টপকে বেরিয়ে পড়েন তিনি।

রাত ১১টা নাগাদ রাস্তায় নামে অস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী। ট্যাংক ও কামানের গর্জনে প্রকম্পিত হতে থাকে ঢাকা। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি সাংবাদিকরা বুঝতে পেরেছিলেন- ভয়াবহ কিছু ঘটতে চলেছে। তাদের আশঙ্কা সত্যি হলো। সেই কালরাতে রক্তে রঞ্জিত হলো ঢাকা। আহত-মৃত্যুমুখী মানুষের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছিল ঢাকার আকাশ।

সেই কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সারা রাত পাকিস্তানের নারকীয় তাণ্ডবে ঝরে যায় প্রায় ৭ হাজার প্রাণ। পুড়িয়ে দেওয়া হয় অসংখ্য ঘরবাড়ি। ২৬ মার্চ সকালে এক মৃত্যুপুরী ঢাকা দেখা যায়। সেই দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং।

সায়মন ড্রিং তার প্রতিবেদন শুরু করেন এভাবে- “ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত ও ভয়ার্ত শহরের নাম। পাকিস্তানি বাহিনীর ঠান্ডা মাথায় চব্বিশ ঘণ্টার নির্মম গুলিবর্ষণে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে বিশাল এলাকা এবং স্বাধীনতার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামের নির্মম পরিণতি ঘটেছে।”

একাত্তরের ২৮ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস তিনটি সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদগুলোর শিরোনাম ছিল- ‘আর্মি এক্সপেলস থার্টি ফাইভ ফরেন নিউজম্যান ফ্রম পাকিস্তান’, ‘আর্টিলারি ইউজ্ড’ ও ‘টোল কল্ড হাই’।

বাংলাদেশের তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ দ্য টেলিগ্রাফ সম্পাদীয়সহ চারটি সংবাদ প্রকাশ করে। এ দিন ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ এ বিষয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ একটি ও ‘দ্য এজ’ চারটি সংবাদ প্রকাশ করে।