কৃষক বাঁচলেই বাঁচবে দেশ

আনোয়ারুল হক নিজামী

কৃষি প্রধান দেশ বাংলাদেশ। একসময় এ দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর ছিলেন। বর্তমানেও গ্রাম বাংলায় শুধু নিরক্ষর মানুষ কৃষিনির্ভর নন। অনেক শিক্ষিত যুবক ডিগ্রি-মাস্টার্স শেষ করে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করছেন। এতে শুধু তার জীবনের পরিবর্তন নয় সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে দেশের জাতীয় উৎপাদন। কৃষিতে আসছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যেখানে ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের য্দ্ধুপরবর্তী সময়ে সাড়ে ৭ লাখ মানুষের জন্য খাদ্য ঘাটতি ছিল সেখানে আজ আবাদি জমি কমার পরে ও প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে খাদ্য রফতানির সুযোগ হচ্ছে। কিভাবে আমরা এ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পেলাম? নিশ্চয় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কৃষিতে আত্মনিয়োগ ও সম-সাময়িক বিশ্বকৃষির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদনই এ পরিবর্তন।

দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত কয়েক বছর বাংলাদেশের কৃষক অসহায়ের মতো নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। ব্যাংক লোন কিংবা এনজিও লোন বা ধারদেনা করে কৃষিতে বিনিয়োগ করে সঠিক দাম না পাওয়ায় বারবার হতাশ হচ্ছেন। যার ফলে কৃষি বিভাগ থেকে জানা যায় ২০২০ সালে উৎপাদিত বোরো ধান চাষে জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ধানের বীজ বিগত সময়ের তুলনায় কম বিক্রি হয়েছে।

ডিসেম্বর ২০১৯ চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার ১৩নং মায়ানী ইউনিয়নের কৃষক জসিম উদ্দিন জানান, তিনি এ বছর বর্গা জমিসহ প্রায় ৩ কানি জমি চাষ করতে প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু হতাশ কণ্ঠে জানান, ধানের দাম কম আড়ি প্রতি ১৫০ টাকা হওয়ায় তাকে প্রায় ৩০ হাজার টাকার মতো লোকসান গুনতে হবে।

মীরসরাই উপজেলার ১৬নং সাহেরখালী ইউনিয়নের কৃষক শামসুল হক জানান, তিনি নিজের ও বর্গা মিলে প্রায় ৫ কানি জমি চাষ করেছেন সব মিলে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার খরচ হয়েছে। কিন্তু ধানের দাম কেজি প্রতি ১৩ টাকা হারে আড়ি ১৫০ টাকা হওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়বেন বলে তিনি জানান।

সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫৫ শতাংশ বা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু এসব ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে অনেক দেরিতে। দরিদ্র কৃষকরা এরই মধ্যে তাদের ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। অন্যদিকে গত ১০ মাসে তিন লাখ টনের বেশি চাল আমদানি করা হয়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে ধান-চালের বাজারে।

প্রায় প্রতি বছরই উৎপাদন মৌসুমে একই ধরনের চিত্র দেখা যায়। সরকার ধান-চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে সরাসরি ধান ক্রয় করতে পারে খুবই কম। সেই সুযোগ নেয় চালকল মালিক, আড়তদার, ফড়িয়া তথা মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা নানা কৌশলে কৃষককে বাধ্য করে সবচেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করতে। অবস্থাপন্ন কৃষকরা এ সময় ধান বিক্রি না করেও থাকতে পারে কিন্তু সমস্যা হয় দরিদ্র কৃষকদের। ফলে সরকার বেশি দামে ধান-চাল কিনলেও দরিদ্র কৃষকরা তাতে লাভবান হন না।

আবার অনেকে মনে করেন, দরিদ্র কৃষকদের বিক্রিযোগ্য ধানের অনুপাতে ব্যাংকগুলো যদি দু-তিন মাসের জন্য সামান্য সুদে বা বিনা সুদে ঋণ দেয়, তাহলে দরিদ্র কৃষকরা এত কম দামে ধান বিক্রি না করে কিছুদিন ধরে রাখতে পারবেন। স্থানীয় সমবায় সৃষ্টির মাধ্যমেও এ কাজটি করা যেতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

বাংলাদেশে শিল্প বিপ্লব হওয়া আগ পর্যন্ত আধুনিক বিশ্বের কৃষি প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি কার্যক্রম চালিয়ে রাষ্ট্রকেই কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। আমরা আশা করি, প্রয়োজনে বিশেষ কমিটি গঠন করে কৃষিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো অতীব জরুরি।

anowar.up@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী ২০২০ , ১৯ পৌষ ১৪২৬, ৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

কৃষক বাঁচলেই বাঁচবে দেশ

আনোয়ারুল হক নিজামী

কৃষি প্রধান দেশ বাংলাদেশ। একসময় এ দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর ছিলেন। বর্তমানেও গ্রাম বাংলায় শুধু নিরক্ষর মানুষ কৃষিনির্ভর নন। অনেক শিক্ষিত যুবক ডিগ্রি-মাস্টার্স শেষ করে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করছেন। এতে শুধু তার জীবনের পরিবর্তন নয় সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে দেশের জাতীয় উৎপাদন। কৃষিতে আসছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যেখানে ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের য্দ্ধুপরবর্তী সময়ে সাড়ে ৭ লাখ মানুষের জন্য খাদ্য ঘাটতি ছিল সেখানে আজ আবাদি জমি কমার পরে ও প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে খাদ্য রফতানির সুযোগ হচ্ছে। কিভাবে আমরা এ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পেলাম? নিশ্চয় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কৃষিতে আত্মনিয়োগ ও সম-সাময়িক বিশ্বকৃষির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদনই এ পরিবর্তন।

দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত কয়েক বছর বাংলাদেশের কৃষক অসহায়ের মতো নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। ব্যাংক লোন কিংবা এনজিও লোন বা ধারদেনা করে কৃষিতে বিনিয়োগ করে সঠিক দাম না পাওয়ায় বারবার হতাশ হচ্ছেন। যার ফলে কৃষি বিভাগ থেকে জানা যায় ২০২০ সালে উৎপাদিত বোরো ধান চাষে জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ধানের বীজ বিগত সময়ের তুলনায় কম বিক্রি হয়েছে।

ডিসেম্বর ২০১৯ চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার ১৩নং মায়ানী ইউনিয়নের কৃষক জসিম উদ্দিন জানান, তিনি এ বছর বর্গা জমিসহ প্রায় ৩ কানি জমি চাষ করতে প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু হতাশ কণ্ঠে জানান, ধানের দাম কম আড়ি প্রতি ১৫০ টাকা হওয়ায় তাকে প্রায় ৩০ হাজার টাকার মতো লোকসান গুনতে হবে।

মীরসরাই উপজেলার ১৬নং সাহেরখালী ইউনিয়নের কৃষক শামসুল হক জানান, তিনি নিজের ও বর্গা মিলে প্রায় ৫ কানি জমি চাষ করেছেন সব মিলে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার খরচ হয়েছে। কিন্তু ধানের দাম কেজি প্রতি ১৩ টাকা হারে আড়ি ১৫০ টাকা হওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়বেন বলে তিনি জানান।

সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫৫ শতাংশ বা প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু এসব ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে অনেক দেরিতে। দরিদ্র কৃষকরা এরই মধ্যে তাদের ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। অন্যদিকে গত ১০ মাসে তিন লাখ টনের বেশি চাল আমদানি করা হয়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে ধান-চালের বাজারে।

প্রায় প্রতি বছরই উৎপাদন মৌসুমে একই ধরনের চিত্র দেখা যায়। সরকার ধান-চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে সরাসরি ধান ক্রয় করতে পারে খুবই কম। সেই সুযোগ নেয় চালকল মালিক, আড়তদার, ফড়িয়া তথা মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা নানা কৌশলে কৃষককে বাধ্য করে সবচেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করতে। অবস্থাপন্ন কৃষকরা এ সময় ধান বিক্রি না করেও থাকতে পারে কিন্তু সমস্যা হয় দরিদ্র কৃষকদের। ফলে সরকার বেশি দামে ধান-চাল কিনলেও দরিদ্র কৃষকরা তাতে লাভবান হন না।

আবার অনেকে মনে করেন, দরিদ্র কৃষকদের বিক্রিযোগ্য ধানের অনুপাতে ব্যাংকগুলো যদি দু-তিন মাসের জন্য সামান্য সুদে বা বিনা সুদে ঋণ দেয়, তাহলে দরিদ্র কৃষকরা এত কম দামে ধান বিক্রি না করে কিছুদিন ধরে রাখতে পারবেন। স্থানীয় সমবায় সৃষ্টির মাধ্যমেও এ কাজটি করা যেতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

বাংলাদেশে শিল্প বিপ্লব হওয়া আগ পর্যন্ত আধুনিক বিশ্বের কৃষি প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি কার্যক্রম চালিয়ে রাষ্ট্রকেই কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। আমরা আশা করি, প্রয়োজনে বিশেষ কমিটি গঠন করে কৃষিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো অতীব জরুরি।

anowar.up@gmail.com