শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু

শঙ্কর প্রসাদ দে

শেখ মুজিবুর রহমান। ছোট বেলায় ডাকনাম ছিল খোকা। বাঙালি জাতির দেয়া নাম বঙ্গবন্ধু। এ উপাধি কোন রাজা বা সম্রাট, কোন রাজ্য বা প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত নয়। রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতা তাদের মুকুটহীন রাজাকে বললো, আজ থেকে তুমি আমাদের বন্ধু। মুকুটহীন রাজা হাত নেড়ে জনতার ভালোবাসার জবাব দিয়েছিল তর্জনী উচিয়ে। ওই তর্জনী পৃথিবী বিখ্যাত। একটি তর্জনীর ঔদ্ধত্য কত বিশাল হতে পারে তা বুঝা গেছে সাত মার্চ ১৯৭১। উদ্ধত ডান হাতের সঙ্গে সঙ্গে তর্জনী অঙ্গুস্টি যতই আকাশমুখী হয়েছে জনতা ততই দাঁড়িয়ে ছুতে ছেয়েছে আকাশ। তর্জনী আর জনতার আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা, ঔদ্ধত্যের চেয়ে বেশি। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার আকাক্সক্ষা। মুক্তির আকাক্সক্ষা।

বালক খোকার কৈশোর গেছে ছায়াঘেরা গ্রামীণ প্রকৃতির মাঝে। সকাল-সন্ধ্যা পাখির কলরব, কৃষকের ভূমি কর্ষণে ফসল ফলানো, হাট-বাজারে খেটে খাওয়া মানুষের সশব্দ কোলাহল। গ্রাম্য মেটো পথে কিশোর কিশোরীর নগ্ন পদে স্কুলে আসা যাওয়া, শস্য, রবিশস্য, পাট চাষে সবাই চাষি বা দিনমজুর। ধর্মের কোন সীমান্ত রেখা ফসলের মাঠে নেই। উৎসব পার্বণের হিন্দু মুসলিম বৈরীতাহীন। বাংলার সমাজ জীবন পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িকতার উপসর্গে বলীয়ান। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে, ঝি ঝি পোকার কলরব ক্রমশ নিস্তব্দ হয়ে আসে। জোনাকীরা গোটা গ্রামীণ প্রকৃতিতে নিয়ে আসে এক অপূর্ব মোহময় মায়াবী আবহ।

অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনাবোধ ও বাংলার প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, খোকার কৈশোরেই গড়ে উঠে। নদী, নৌকো, লঞ্চ, স্টিমার শান্ত নদীজলকে আন্দোলিত করে এগিয়ে চলে, গন্তব্যের পথে। নদীর যেমন জাত নেই, নদীর জেলেদেরও কোন জাত থাকতে নেই, নৌকার মাঝিমাল্লারও কোন জাত থাকে না। তবে ওদের পরিচয় একটাই, ওরা গরিব বা শোষিত মানুষ। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে খেটে খাওয়া মানুষ ছিল, বড়লোক আর ক্ষমতাসীনদের শোষণের উর্বর ভূমি। ইংরেজদের হাত থেকে শোষণের ক্ষমতা স্থানান্তরিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি শুরু থেকেই ছলনা আর প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। দ্বি-জাতিতত্ত্ব নামক এক অবৈজ্ঞানিক কনসেপ্ট দিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে সহজ সরল বাঙালি মুসলমানদের। বলা হয়েছিল, ইসলামী দেশ পাকিস্তান হলে মুসলমানের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। ৪৮ সালেই দেখা গেল, মৌলভীদের ফতোয়া দেয়া বন্ধ হলো না। মহাজনদের সুদ ব্যবসা বন্ধ হলো না। জোতদার জমিদারদের কাছে বর্গাচাষি হলো আগের মতোই অসহায়। ভূমির ওপর বড় লোকদের অন্যায় মালিকানা ও মালিকানা দিয়ে শোষণ বন্ধ হলো না। চাকরি ব্যবসা নিয়ে রাষ্ট্র আশ্রয় নিল ছলনার। ১০ জন পশ্চিম পাকিস্তানি চাকরি পেলে বাঙালি পেত মাত্র একজন। সেনাবাহিনীতে ওই একজনও নেয়া হতো না। ঊর্ধ্বতন সেনা ও আমলার ক্ষেত্রে এ অনুপাত আরও ন্যক্কারজনক আকার ধারণ করেছিল। শতকরা দু’একজন ব্যতীত ঊর্ধ্বতন সেনা বা সিভিল কর্মকর্তা ছিল নিতান্তই করুণার দান। দ্বন্দ্বটা দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে হয়ে উঠল, বাঙালি বনাম পশ্চিম পাকিস্তানি।

এ বৈষম্য এ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব একেবারে প্রথম থেকেই অনুধাবন করেছিলেন যুবক শেখ মুজিব। দীর্ঘকায় এই যুবকের ত্বরিত প্রতিবাদ প্রবীনদের উপলব্ধিকেও হার মানিয়েছিল। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় এ যুবকের ভূমিকা বাঙালির পুনর্জাগরণের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। অসাম্প্রদায়িক বাঙালির পতাকা নিয়ে সেই যে যুবকটি নৌকায় উঠলো, আর থামল না মৃত্যু অবধি। একাত্তরে ওই নৌকার কাছে রেসকোর্সে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ বাধ্য করেছে। এবার সেই নৌকা নিয়ে তিনি পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন বিশাল উপসাগর, সাগর, মহাসাগর। বাংলার এ অকুতোভয় মানুষটি বিশ্বজয় করতে চেয়েছিলেন।

বাঙালি জাতিসত্ত্বা বিকাশে বহু মানুষের, বহু মনীষির, বহুমুখী ভূমিকা ছিল। কিন্তু জাতি পরিচয়ের স্বীকৃতি আদায়ে একজন বিশাল মানুষের দরকার ছিল। হাজার বছর ধরে এই জনগোষ্ঠী বিকশিত হয়েছে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে। বিকাশের এ ধারা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বলাবাহুল্য বাংলার লোকগীতি, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, জারিসারি, হাসন ও লালনের মরমী সংগীত ধ্রুপদী কলার চেয়েও অসাম্প্রাদায়িক দর্শনের তীর্থক্ষেত্র। পৃথিবীর অন্য ভাষাভিত্তিক জাতির ভাণ্ডারে এমন অমূল্য রতœ দেখা পাওয়া নিতান্তই বিরল। ঊনবিংশ শতকের বঙ্গীয় রেঁনেসা ভাষাভিত্তিক এই জাতিসত্তাকে পরিপূর্ণতা এনে দেয়। মীর মোশাররফ হোসেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মধুসুদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ভাষার শব্দ, ছন্দ, রোমান্টিকতা, ট্র্যাজেডিকে সফলভাবে আত্মীকরণ করে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। বিদেশি ভাষা থেকে রূপ, রস, কল্পনা ও কৌশলকে এতো চমৎকারভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছে এমন ভাষা পৃথিবীতে হাতে গোনা। এই ভাষার মানুষ বাঙালি, স্বাধীনতার জন্য টগবগ করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। রাজনীতির দুরবিন দিয়ে মুজিব দেখেছিলেন, সঠিক পথে, সঠিক কৌশলে এগোতে পারলে জাতিসত্তার রাজনৈতিক স্বীকৃতি সম্ভব।

পৃথিবীর বহু ভাষাভিত্তিক, ভূ-খণ্ডভিত্তিক, বর্ণভিত্তিক, জাতির ভাগ্যে স্বাধীনতা আসেনি। জাতিসত্তার স্বীকৃতি আসেনি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া জাতিসত্তার স্বীকৃতি আসে না। তামিলদের আসেনি, কুর্দীদের আসেনি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি আসে না।

ব্রিটিশ পাকিস্তান বাংলাদেশ নিয়ে ত্রিকালদর্শী অথবা আমাদের মতো যারা পাকিস্তান বাংলাদেশ পর্বে দ্বিকালদর্শী, স্বীকার করতে বাধ্য যে- অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, অবকাঠামোতে এগিয়েছি বহুদূর। গত শতাব্দীর ছয় এবং সাতের দশকে স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বাধীনতার মধ্যে যে কোন একটিকে বেছে নেয়ার মুহূর্ত এসেছিল। মুজিব চাইলে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। তবে এর বিনিময়ে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো। ঊনসত্তরে গোটা জাতি এক বিন্দুতে এসে পৌঁছল। জনতার উদ্যত শিরের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয় আইয়ুব খান, পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী ও দ্বি-জাতিতত্ত্ব। মুজিব হয়ে উঠেছিলেন জাতির নয়নের মনি। ভূষিত হলেন বাংলার বন্ধু ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে। জনতার উপাধি, জাতির অলঙ্কারে রঞ্জিত হলেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ বিজয় আসার মুহূর্ত্বে হলেন জাতির পিতা।

বাঙালির পদার্পণ নেই এমন দেশ পৃথিবীতে নেই। শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথায় আছেন তা জানার উপায় নেই। পৃথিবীর কাছাকাছি অন্য কোন প্রাণ-সমৃদ্ধ গ্রহ থাকতেও পারে। মহাকাশ বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হেভিটেবল জোন। হেভিটেবল জোনের কোন গ্রহে প্রাণ থাকলেও মনুষ্য প্রজাতির মতো উন্নত প্রজাতি থাকার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। প্যারালাল ইউনিভার্স তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীর মতো আরও একটি গ্রহ, ওই গ্রহে মানুষের মতো প্রাণ বা প্রজাতি, অন্য কোন গ্যালাক্সিতে থাকার কল্পনা করা হচ্ছে। যেভাবেই হোক বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোন ঠিকানায় মনুষ্য প্রজাতির মতো প্রাণের অস্তিত্ব থাকলেও আমাদের বঙ্গবন্ধুর মতো অমন মহৎ একটি মানুষ হয়তো নেই। এ গ্রহে বঙ্গবন্ধুর মতো আরও মহান বহু মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। মানব মুক্তির স্বপ্ন এদের অনেকেই দেখেছেন। এ মুক্তির স্বপ্ন অঙ্কিত হয়েছে সার্বিক মুক্তির ক্যানভাসে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হয়েছেন ওই একজনই।

বাংলার ক্যানভাসে এখন নিরন্তর লড়াই চলছে অর্থনৈতিক মুক্তির, শোষণ মুক্তির। জীবনের সৌন্দর্য রূপায়ণে সার্বিক মুক্তির। বঙ্গবন্ধু প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় মুক্তির কথা ভেবেছিলেন। আবার প্রচলিত সমাজসম্পর্ক ভেঙে মালিকানায় পরিবর্তন এনে সাম্যের কথাও ভেবেছিলেন। স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শ্রেণীহীন সমাজতন্ত্রের প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। এমন স্বপ্ন দেখার মানুষ পৃথিবীর কম জাতির ভাগ্যেই জুটেছে। বাকশাল করেছিলেন বলে, তাকে সপরিবারে প্রাণ দিতে হয়েছে। এতেই বোঝা যায় তার স্বপ্ন সঠিক ছিল। কারণ তাঁকে যারা হত্যা করেছিল তারা পাকিস্তানের বন্ধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শত্রু। বাঙালির মুক্তির স্বপ্নের শত্রু। বাকশাল হলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হতো তারা ষড়যন্ত্রের জালে বন্দী করে তাকে হত্যা করেছে। হত্যার মধ্য দিয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে আমাদের বঙ্গবন্ধু, আমাদের জাতির পিতার স্বপ্নের মৃত্যু হয়নি। শতবর্ষে এ স্বপ্ন দেখছে দেশের লাখো কোটি বাঙালি।

[লেখক : আইনজীবী, কলাম লেখক]

spdey2011@gmail.com

শনিবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২০ , ২১ পৌষ ১৪২৬, ৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু

শঙ্কর প্রসাদ দে

শেখ মুজিবুর রহমান। ছোট বেলায় ডাকনাম ছিল খোকা। বাঙালি জাতির দেয়া নাম বঙ্গবন্ধু। এ উপাধি কোন রাজা বা সম্রাট, কোন রাজ্য বা প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত নয়। রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতা তাদের মুকুটহীন রাজাকে বললো, আজ থেকে তুমি আমাদের বন্ধু। মুকুটহীন রাজা হাত নেড়ে জনতার ভালোবাসার জবাব দিয়েছিল তর্জনী উচিয়ে। ওই তর্জনী পৃথিবী বিখ্যাত। একটি তর্জনীর ঔদ্ধত্য কত বিশাল হতে পারে তা বুঝা গেছে সাত মার্চ ১৯৭১। উদ্ধত ডান হাতের সঙ্গে সঙ্গে তর্জনী অঙ্গুস্টি যতই আকাশমুখী হয়েছে জনতা ততই দাঁড়িয়ে ছুতে ছেয়েছে আকাশ। তর্জনী আর জনতার আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা, ঔদ্ধত্যের চেয়ে বেশি। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার আকাক্সক্ষা। মুক্তির আকাক্সক্ষা।

বালক খোকার কৈশোর গেছে ছায়াঘেরা গ্রামীণ প্রকৃতির মাঝে। সকাল-সন্ধ্যা পাখির কলরব, কৃষকের ভূমি কর্ষণে ফসল ফলানো, হাট-বাজারে খেটে খাওয়া মানুষের সশব্দ কোলাহল। গ্রাম্য মেটো পথে কিশোর কিশোরীর নগ্ন পদে স্কুলে আসা যাওয়া, শস্য, রবিশস্য, পাট চাষে সবাই চাষি বা দিনমজুর। ধর্মের কোন সীমান্ত রেখা ফসলের মাঠে নেই। উৎসব পার্বণের হিন্দু মুসলিম বৈরীতাহীন। বাংলার সমাজ জীবন পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িকতার উপসর্গে বলীয়ান। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে, ঝি ঝি পোকার কলরব ক্রমশ নিস্তব্দ হয়ে আসে। জোনাকীরা গোটা গ্রামীণ প্রকৃতিতে নিয়ে আসে এক অপূর্ব মোহময় মায়াবী আবহ।

অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনাবোধ ও বাংলার প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, খোকার কৈশোরেই গড়ে উঠে। নদী, নৌকো, লঞ্চ, স্টিমার শান্ত নদীজলকে আন্দোলিত করে এগিয়ে চলে, গন্তব্যের পথে। নদীর যেমন জাত নেই, নদীর জেলেদেরও কোন জাত থাকতে নেই, নৌকার মাঝিমাল্লারও কোন জাত থাকে না। তবে ওদের পরিচয় একটাই, ওরা গরিব বা শোষিত মানুষ। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে খেটে খাওয়া মানুষ ছিল, বড়লোক আর ক্ষমতাসীনদের শোষণের উর্বর ভূমি। ইংরেজদের হাত থেকে শোষণের ক্ষমতা স্থানান্তরিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি শুরু থেকেই ছলনা আর প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। দ্বি-জাতিতত্ত্ব নামক এক অবৈজ্ঞানিক কনসেপ্ট দিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে সহজ সরল বাঙালি মুসলমানদের। বলা হয়েছিল, ইসলামী দেশ পাকিস্তান হলে মুসলমানের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। ৪৮ সালেই দেখা গেল, মৌলভীদের ফতোয়া দেয়া বন্ধ হলো না। মহাজনদের সুদ ব্যবসা বন্ধ হলো না। জোতদার জমিদারদের কাছে বর্গাচাষি হলো আগের মতোই অসহায়। ভূমির ওপর বড় লোকদের অন্যায় মালিকানা ও মালিকানা দিয়ে শোষণ বন্ধ হলো না। চাকরি ব্যবসা নিয়ে রাষ্ট্র আশ্রয় নিল ছলনার। ১০ জন পশ্চিম পাকিস্তানি চাকরি পেলে বাঙালি পেত মাত্র একজন। সেনাবাহিনীতে ওই একজনও নেয়া হতো না। ঊর্ধ্বতন সেনা ও আমলার ক্ষেত্রে এ অনুপাত আরও ন্যক্কারজনক আকার ধারণ করেছিল। শতকরা দু’একজন ব্যতীত ঊর্ধ্বতন সেনা বা সিভিল কর্মকর্তা ছিল নিতান্তই করুণার দান। দ্বন্দ্বটা দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে হয়ে উঠল, বাঙালি বনাম পশ্চিম পাকিস্তানি।

এ বৈষম্য এ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব একেবারে প্রথম থেকেই অনুধাবন করেছিলেন যুবক শেখ মুজিব। দীর্ঘকায় এই যুবকের ত্বরিত প্রতিবাদ প্রবীনদের উপলব্ধিকেও হার মানিয়েছিল। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় এ যুবকের ভূমিকা বাঙালির পুনর্জাগরণের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। অসাম্প্রদায়িক বাঙালির পতাকা নিয়ে সেই যে যুবকটি নৌকায় উঠলো, আর থামল না মৃত্যু অবধি। একাত্তরে ওই নৌকার কাছে রেসকোর্সে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ বাধ্য করেছে। এবার সেই নৌকা নিয়ে তিনি পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন বিশাল উপসাগর, সাগর, মহাসাগর। বাংলার এ অকুতোভয় মানুষটি বিশ্বজয় করতে চেয়েছিলেন।

বাঙালি জাতিসত্ত্বা বিকাশে বহু মানুষের, বহু মনীষির, বহুমুখী ভূমিকা ছিল। কিন্তু জাতি পরিচয়ের স্বীকৃতি আদায়ে একজন বিশাল মানুষের দরকার ছিল। হাজার বছর ধরে এই জনগোষ্ঠী বিকশিত হয়েছে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে। বিকাশের এ ধারা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বলাবাহুল্য বাংলার লোকগীতি, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, জারিসারি, হাসন ও লালনের মরমী সংগীত ধ্রুপদী কলার চেয়েও অসাম্প্রাদায়িক দর্শনের তীর্থক্ষেত্র। পৃথিবীর অন্য ভাষাভিত্তিক জাতির ভাণ্ডারে এমন অমূল্য রতœ দেখা পাওয়া নিতান্তই বিরল। ঊনবিংশ শতকের বঙ্গীয় রেঁনেসা ভাষাভিত্তিক এই জাতিসত্তাকে পরিপূর্ণতা এনে দেয়। মীর মোশাররফ হোসেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মধুসুদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ভাষার শব্দ, ছন্দ, রোমান্টিকতা, ট্র্যাজেডিকে সফলভাবে আত্মীকরণ করে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। বিদেশি ভাষা থেকে রূপ, রস, কল্পনা ও কৌশলকে এতো চমৎকারভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছে এমন ভাষা পৃথিবীতে হাতে গোনা। এই ভাষার মানুষ বাঙালি, স্বাধীনতার জন্য টগবগ করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। রাজনীতির দুরবিন দিয়ে মুজিব দেখেছিলেন, সঠিক পথে, সঠিক কৌশলে এগোতে পারলে জাতিসত্তার রাজনৈতিক স্বীকৃতি সম্ভব।

পৃথিবীর বহু ভাষাভিত্তিক, ভূ-খণ্ডভিত্তিক, বর্ণভিত্তিক, জাতির ভাগ্যে স্বাধীনতা আসেনি। জাতিসত্তার স্বীকৃতি আসেনি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া জাতিসত্তার স্বীকৃতি আসে না। তামিলদের আসেনি, কুর্দীদের আসেনি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া অর্থনৈতিক মুক্তি আসে না।

ব্রিটিশ পাকিস্তান বাংলাদেশ নিয়ে ত্রিকালদর্শী অথবা আমাদের মতো যারা পাকিস্তান বাংলাদেশ পর্বে দ্বিকালদর্শী, স্বীকার করতে বাধ্য যে- অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, অবকাঠামোতে এগিয়েছি বহুদূর। গত শতাব্দীর ছয় এবং সাতের দশকে স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বাধীনতার মধ্যে যে কোন একটিকে বেছে নেয়ার মুহূর্ত এসেছিল। মুজিব চাইলে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। তবে এর বিনিময়ে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো। ঊনসত্তরে গোটা জাতি এক বিন্দুতে এসে পৌঁছল। জনতার উদ্যত শিরের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয় আইয়ুব খান, পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী ও দ্বি-জাতিতত্ত্ব। মুজিব হয়ে উঠেছিলেন জাতির নয়নের মনি। ভূষিত হলেন বাংলার বন্ধু ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে। জনতার উপাধি, জাতির অলঙ্কারে রঞ্জিত হলেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ বিজয় আসার মুহূর্ত্বে হলেন জাতির পিতা।

বাঙালির পদার্পণ নেই এমন দেশ পৃথিবীতে নেই। শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথায় আছেন তা জানার উপায় নেই। পৃথিবীর কাছাকাছি অন্য কোন প্রাণ-সমৃদ্ধ গ্রহ থাকতেও পারে। মহাকাশ বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হেভিটেবল জোন। হেভিটেবল জোনের কোন গ্রহে প্রাণ থাকলেও মনুষ্য প্রজাতির মতো উন্নত প্রজাতি থাকার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। প্যারালাল ইউনিভার্স তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীর মতো আরও একটি গ্রহ, ওই গ্রহে মানুষের মতো প্রাণ বা প্রজাতি, অন্য কোন গ্যালাক্সিতে থাকার কল্পনা করা হচ্ছে। যেভাবেই হোক বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোন ঠিকানায় মনুষ্য প্রজাতির মতো প্রাণের অস্তিত্ব থাকলেও আমাদের বঙ্গবন্ধুর মতো অমন মহৎ একটি মানুষ হয়তো নেই। এ গ্রহে বঙ্গবন্ধুর মতো আরও মহান বহু মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। মানব মুক্তির স্বপ্ন এদের অনেকেই দেখেছেন। এ মুক্তির স্বপ্ন অঙ্কিত হয়েছে সার্বিক মুক্তির ক্যানভাসে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হয়েছেন ওই একজনই।

বাংলার ক্যানভাসে এখন নিরন্তর লড়াই চলছে অর্থনৈতিক মুক্তির, শোষণ মুক্তির। জীবনের সৌন্দর্য রূপায়ণে সার্বিক মুক্তির। বঙ্গবন্ধু প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় মুক্তির কথা ভেবেছিলেন। আবার প্রচলিত সমাজসম্পর্ক ভেঙে মালিকানায় পরিবর্তন এনে সাম্যের কথাও ভেবেছিলেন। স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শ্রেণীহীন সমাজতন্ত্রের প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। এমন স্বপ্ন দেখার মানুষ পৃথিবীর কম জাতির ভাগ্যেই জুটেছে। বাকশাল করেছিলেন বলে, তাকে সপরিবারে প্রাণ দিতে হয়েছে। এতেই বোঝা যায় তার স্বপ্ন সঠিক ছিল। কারণ তাঁকে যারা হত্যা করেছিল তারা পাকিস্তানের বন্ধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শত্রু। বাঙালির মুক্তির স্বপ্নের শত্রু। বাকশাল হলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হতো তারা ষড়যন্ত্রের জালে বন্দী করে তাকে হত্যা করেছে। হত্যার মধ্য দিয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে আমাদের বঙ্গবন্ধু, আমাদের জাতির পিতার স্বপ্নের মৃত্যু হয়নি। শতবর্ষে এ স্বপ্ন দেখছে দেশের লাখো কোটি বাঙালি।

[লেখক : আইনজীবী, কলাম লেখক]

spdey2011@gmail.com