দার্শনিক সক্রেটিস

হাবিবুর রহমান স্বপন

সক্রেটিসের জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা খুবই কঠিন। কারণ তিনি তার জীবদ্দশায় নিজের সম্পর্কে কিংবা তার দর্শন নিয়ে কিছু লিখে যাননি। তাকে জানতে হয় অন্যের দেয়া তথ্য উপাত্ত থেকে।

বার্টন্ড রাসেল বলেছেন, ‘সক্রেটিস সম্পর্কে আমাদের কম জানা আছে, না বেশি জানা আছে, সেটা স্থির করাই মুশকিল।’

খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ অব্দে সক্রেটিস জন্মেছিলেন, গ্রিসের এথেন্সে। বাবা সক্রোনিকাস তৎকালীন গ্রিসের এ্যটিকার আ্যলোপেকি গোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন। এথেন্সে যে প্রধান দশটি গ্রুপ ছিল আ্যলোপেকি তাদের অন্যতম। বাবা সক্রোনিকাস পেশায় ছিলেন ভাস্কর। সক্রেটিসও প্রথম জীবনে বাবার পেশা বেছে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীর ভারী অস্ত্র বিভাগে যোগ দেন। সেনাবাহিনীতে সক্রেটিস সুনামের পাশাপাশি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর চাকরির পর তৎকালীন এথেন্সের আইনসভার সদস্য এবং বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সেই সময় এথেন্সের আইন, বিচারব্যবস্থা ও রাজনীতি সম্পর্কে সক্রেটিসের ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। কর্মজীবনে তিনি কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেননি। নিজস্ব বিচক্ষণতা ও সততার দ্বারা স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছেন।

সক্রেটিসের পরিবার ডিইডলাস থেকে নিজেদের বংশক্রম গণনা করতো। সক্রোনিকাসের পুত্র সক্রেটিসের মাতার নাম ফেনারিটি। তিনি পেশায় ছিলেন একজন ধাত্রী। প্যাট্রেক্লিস নামে তার অন্য স্বামীর ঔরসজাত এক পুত্র ছিল বলে কথিত আছে। পরবর্তী জীবনে সক্রেটিস তার মায়ের পেশার তুলনা দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন এবং সবাইকে বলতেন যে, তিনিও ধাত্রী পেশার মতো কাজই করে থাকেন। তার মা ফেনারিটি মনুষ্য-শিশু প্রসবে সাহায্য করতেন আর সক্রেটিসের চিন্তা-ভাবনা প্রসারে সহায়তা করতেন।

সক্রেটিসকে জানতে আমাদের প্লেটো ও জেনোফেনের কাছেই নিবিষ্ট হতে হয়। এই দুই জনই ছিলেন সক্রেটিসের প্রিয় শিষ্য। প্লেটো ও জেনোফেনের অঙ্কিত সক্রেটিস ছিল দু’রকম। অনেক ক্ষেত্রেই অনুভূত হয় যে, সংলাপ সৃষ্টির প্রয়োজনে প্লেটো তার আবেগ ও কল্পনা দিয়ে সক্রেটিস নামের চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। একজনের সক্রেটিস তাত্ত্বিক ও দার্শনিক এবং অন্যজনের সক্রেটিস লোকজীবন ও রক্ত-মাংসের উত্তাপে জীবন্ত।

সক্রেটিসের শৈশব সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও ধারণা করা যায় যে, আর দশটা সাধারণ এথেনীয় বালকের মতোই সক্রেটিস সাধারণ শিক্ষা লাভ করেছেন। তার বাবা মা দুজনই উপার্জন করলেও সংসারে সচ্ছলতা ছিল না। ফলে সক্রেটিসকে লেখা পড়ার পরিবর্তে পাথর কাটার কাজ করতে হতো। কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে তিনি জ্ঞান দ্বারা তাড়িত হয়েছেন। যেটুক সময় তিনি পেয়েছেন তার সবটাই জ্ঞান অন্বেষণের কাজে লাগিয়েছেন। এভাবে কয়েক বছর কাটাবার পর এক ধনাঢ্য ব্যক্তির সাথে ঘটনাক্রমে তার পরিচয় হয়। এই ব্যক্তি সক্রেটিসের আচার-আচরণ ও বুদ্ধিদীপ্ততার প্রখরতায় অভিভূত হয়ে তার পড়াশুনার দায়িত্ব নেন। এরপর সক্রেটিস পাথর কাটার কাজ ছেড়ে দিয়ে পুনরায় এনাক্সোগোরাস নামের এক ব্যক্তির কাছে পড়াশুনা শুরু করেন।

ধারণা করা হয় যে, সক্রেটিসকে শৈশবের শুরুতে ভাষা, সাহিত্য ও সংগীতের উপর বিশেষ শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন এথেন্সের অভিজাত পরিবারের বিশ্বস্ত দাসদের পেইডাগোগস অর্থাৎ বালকদের অভিভাবক বলা হতো। এরা সম্পদশালী নাগরিকদের সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যেতো। সেই সময় স্কুলেই ছয় থেকে সাত বছর বয়সের বালকদের কলা বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হতো, বিশেষ করে ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পাঠদান করানো হতো। সাহিত্যের বিষয় ছিল হোমারের কাব্যের নির্দিষ্ট কিছু অংশ এবং সংগীতকলা। বালকদের পিতা-মাতা ও পেইডাগোসরা ছেলেদের তাদের ধর্ম, সদাচারণ ও নীতিশাস্ত্রের শিক্ষা দিত। বিদ্যালয়ে সেই সময় শারীরিক শিক্ষাও দেয়া হতো। অনেক শিক্ষকের বাড়িতেও স্কুল ছিল। সেখানে শিক্ষকরা অনেক কম বেতনে ছাত্রদের পড়াতেন। ছাত্রদের বুদ্ধিদীপ্ত করে গড়ে তোলার জন্য মুক্তবুদ্ধির চর্চা, খেলাধূলা শিক্ষা সহায়ক বিষয় হিসবে অন্তর্ভূক্ত ছিল। ধর্ম ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীলতা সৃষ্টির জন্য ছাত্রদের উল্লেখ্য বিষয়ে শিক্ষাদানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। তাদের উচ্চতর শিক্ষার জন্য অলঙ্কারশাস্ত্র, গণিত ও জ্যেতির্বিজ্ঞান শিক্ষালাভ করেছিলেন। তিনি পাথরের শিল্পী হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার তৈরি কয়েকটি ভাস্কর্য সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি এই পেশা পরিত্যাগ করে শিক্ষা-সেবায় ব্রত হয়েছিলেন।

বহু লেখকের বরাত দিয়ে যতটুকু জানা যায় সক্রেটিস যৌবনকালে সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। তবে এর সন-তারিখের হিসাব করা যায় না। সক্রেটিসের যৌবনকালে গ্রিস ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং এই রাজ্যগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকতো। ক্ষমতার লড়াইয়ে যোগ দেবার জন্য দেশের সামর্থবান তরুণ, যুবক ও শক্তিমান পুরুষদের উপর বাধ্যবাধকতা ছিল। সামরিক অভিযানে যোগ দেবার জন্য সক্রেটিসকেও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলা হলো। এই যুদ্ধে তিনি প্রচণ্ড সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পরপর তিনটি যুদ্ধে সক্রেটিস অংশ নিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে বিরূপ হয়ে দেশে ফিরে আসেন। সক্রেটিস তিন থেকে চারবার দেশের বাইরে গিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এরপর আর জন্মভূমি এথেন্সের বাইরে সক্রেটিস মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যাননি।

নিজ দেশ এথেন্সে ফিরে এসে সক্রেটিস দেখলেন শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-গরিমা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শৌর্য-বীর্যে এথেন্সে তখন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। এই পরিবেশে ফিরে এসে সক্রেটিস জ্ঞান-সাধনায় ধাতস্ত হলেন। তিনি স্থির করলেন, জ্ঞানের চর্চায় এবং বিশ্বপ্রকৃতিকে জানার সাধনায় সারাজীবন কাটিয়ে দেবেন।

আট-দশটা সাধারণ এথেনীয় নাগরিকদের মতোই সক্রেটিস সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তিনি সম্পূর্ণই একজন সামাজিক মানুষ ছিলেন। একজন মানুষের নিতান্তই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবন বলতে যা বোঝায়, সক্রেটিসের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। প্লেটা বা জেনোফেনের বরাত দিয়ে আমরা যে সক্রেটিসকে জানতে পারি তিনি কখনো ঘরে থাকেন না, গৃহকর্মে তার মনোযোগ নেই বা পার্থিব ধনসম্পদ ও ভোগস্পৃহার প্রতিও তার কোন আকর্ষণ নেই। তাকে পাওয়া যায় পথে-ঘাটে, বাজারে, সাধারণ মানুষের মাঝে কিংবা কোন সামাজিক উৎসবে। তাকে পরিবারের লোকজনের সাথে সহসা খুঁজে পাওয়া যায় না।

সক্রেটিসের বাবা-মা’র পরে তার পরিবার সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো- তার স্ত্রী জেনথিপ ও তিন পুত্র ল্যাক্সোক্লিস, সক্রোনিসকস ও মিনিক্সিনস। এমন একটি কথা এথেন্সে প্রচলিত ছিল যে, দাম্পত্য জীবনে জেনথিপ ভীষণ বদমেজাজি ছিলেন। কিন্তু প্লেটো চিত্রিত সক্রেটিসে এমন কোন তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। প্লেটোর সক্রেটিসকে আমার যখন কারারুদ্ধ অবস্থায় দেখি, তখন তার বয়স সত্তর বছর। তিন সন্তানসহ (প্রথমজন বালক আর অপর দু’জন শিশু) স্ত্রী জেনথিপ জেল গেটে সক্রেটিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতেন। এ থেকে প্রমাণ মেলে সক্রেটিস বেশি বয়সে বিয়ে করেছিলেন। সক্রেটিসের বিয়ে সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে যে, তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন, তারই গোত্রভুক্ত সম্পদশালী এরিস্টাইডের কন্যা মায়তোয়াকে। তবে দ্বিতীয় বিয়ের কোন তথ্য প্লেটোর সক্রেটিসে নেই।

অস্বচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ এথেনীয়দের মতো সক্রেটিসের ভাত-কাপড়ের কথা চিন্তা করতে হয়নি। সারাজীবন তাকে দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে জীবন চালাতে হয়েছে। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য তার জীবনে অর্জন হয়নি এবং তিনি তা কখনো কামনাও করেননি। জীবন বাঁচানোর বাইরে বিন্দুমাত্র অর্থ তিনি চাননি। জাগতিক বিলাসপ্রবণতামুক্ত মানুষ সক্রেটিস ব্যতিরেকে বিশ্ব ইতিহাসে বিরল।

সক্রেটিস দেখতে মোটেই সুদর্শন ব্যক্তি ছিলেন না। তার চেহারাকে অনেকেই অদ্ভুত বলতেন। তৎকালীন এথেনীয়দের তুলনায় তিনি লম্বায় বেশ বেঁটে ছিলেন, প্রশস্ত নাকবিশিষ্ট কুৎসিৎ চেহারার অধিকারী ছিলেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথেই মাথায় টাক পড়তে থাকে। তিনি প্রায়শই জীর্ণ-শীর্ণ ও ময়লা কাপড় পরিধান করতেন। একজন দার্শনিক বলতে আমরা যা বুঝি অর্থাৎ যারা সমাজের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত নন, সমাজের আট-দশটা মানুষ থেকে তারা ভিন্ন। তারা লোকালয় থেকে আলাদা থেকে ভাবলোকে নিমগ্ন থাকেন, তত্ত্বের পর তত্ত্ব নিয়ে বিশ্লেষণ করেন, সাধারণ মানুষ্য শ্রেণির কাছে তারা অধরা, নিভৃতচারী, চিন্তালোকে পরিগমণকারী ও বাস্তবে উদাসীন। কিন্তু সক্রেটিস সেইসব দার্শনিকদের মতো ছিলেন না। সক্রেটিস ছিলেন এইসব বৈশিষ্ট থেকে অনেকাংশেই ভিন্ন চরিত্রের অধিকারী।

সক্রেটিসের পারিবারিক জীবনের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য অপ্রতুল হওয়া সত্ত্বেও যেটুকু প্লেটোর বরাতে জানা যায় তাতে সক্রেটিস যে তার পরিবার নিয়ে ভবছেন বা তার স্ত্রী-পুত্রদের জন্য বিচলিত হয়েছেন তার কোন চিত্র পাওয়া যায় না। সক্রেটিসের পরিবারের বিস্তারিত কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও তিনি যে অসামাজিক মানুষ ছিলেন না তা জানা যায়। সক্রেটিস ছিলেন সামাজিক মানুষ এবং সমাজের মানুষের মানোন্নয়নে সর্বদাই চিন্তিত থাকতেন, তৎকালীন এথেনীয় সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে ভাবিত থাকতেন তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

জাগতিক মোহমুক্ত মানুষের তুলনায় সক্রেটিসের মতো দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির উদাহরণ ইতিহাসে বিরল। তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। কাজেই সংসারে অভাব নামক শব্দটা আষ্টেপৃষ্ঠে থাকতো। এজন্য স্ত্রীর সাথে সামান্য বচসা লেগেই থাকতো। কারণ গার্হস্থ্য জীবন থেকে তিনি বিমুক্ত ছিলেন। এথেনীয় সমাজের উন্নয়ন ছাড়া তার চিন্তনে আর কিছু ছিল না। তিনি নগ্ন পায়ে চলাফেরা করতেন। তার কষ্ট সহিষ্ণুতা ছিল প্রবাদ কাহিনীর মতো এবং সাহস ছিল প্রচণ্ড। শীত-গ্রীষ্মে, এমনকি বরফের ওপর দিয়েও তিনি অবলীলায় খালি পায়ে চলাফেরা করতেন। পেলোপনোশীয় যুদ্ধে তিনি অতুলনীয় বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। তার ন্যায়পরায়ণতা, সাহস ও কর্তব্যপরায়ণতার জন্য সেকালে গ্রিসের শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে একদল যুবক তার কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন।

এথেন্সের হাট-বাজারে, পথের মোড়ে, ভোজসভায় এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে সকেটিস আটপৌরে আচরণ করতেন। শীত-গ্রীষ্ম, ক্ষুধা-তৃষ্ণার প্রতি তার উদাসীনতা ছিল অসীম। প্লেটোর ডায়লগ সিম্পোজিয়ামে তৎকালীন এথেন্সের সেনাপতি ও আর্কন (রাষ্ট্রপতি) আলকিয়াবিয়াডিস (এথেন্সের বিরুদ্ধচারণ করে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত) এক সামরিক অভিযানে সক্রেটিসের দীপ্ত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে-

ক. তার সহনশক্তি ছিল এক কথায় বিষ্ময়কর। সরবরাহ থেকে বিযুক্ত হয়ে যখন আমাদের উপোস করতে বাধ্য হতে হচ্ছিল-যুদ্ধকালে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে-তখন সক্রেটিস শুধু আমাকে কেন, যে কাউকে সহিষ্ণুতার পরীক্ষায় অতিক্রম করে যেতেন। বস্তুত এ ব্যাপারে তার সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। ...ঠাণ্ডা সইবার ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। একবার প্রচণ্ড বরফপাত হলো। এ অঞ্চলটায় সত্যিই শীত খুবই বেশি প্রত্যেকে গৃহবন্দী থাকতেন, না হয় বিপুল পরিমাণ কাপড়চোপড় পরে বের হতেন এবং অবশ্যই প্রত্যেকের পায়ে মজবুত জুতা, ফেল্ট বা পশম দিয়ে পা-জোড়া পুরোপুরি ঢাকা। এইরকম অবস্থায় বরফের ওপর সৈনিকদের চেয়ে ভালো কুচকাওয়াজ করতেন তিনি। এজন্য অন্যেরা তাকে বিষদৃষ্টিতে দেখতো, কারণ মনে হতো সক্রেটিস তাদের অবজ্ঞা দেখাচ্ছেন।

খ. সৈনিক হিসেবে তার আর একটি কীর্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। একদিন প্রত্যুষে তার মনে প্রশ্নের উদয় হওয়াতে তিনি তৎক্ষণাৎ সেইখানে দাঁড়িয়েই ভাবতে শুরু করলেন। কোনো সমাধান পাওয়া গেল না, তবু চেষ্টা ত্যাগ না করে ওইখানে দাঁড়িয়েই আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলেন। দুপুর হলো লোকজন দেখলো সক্রেটিস দাঁড়িয়ে- তারা অবাক হয়ে পরস্পর বলাবলি করতে লাগল সক্রেটিস সেই কোন সকাল থেকে এইভাবে চিন্তামগ্ন রয়েছে। অবশেষে রাত্রির আহারের পর (তখন গ্রীষ্মকাল) আইওনিয়ার কয়েকজন অধিবাসী সক্রেটিসের অদ্ভুত কাণ্ডের শেষ দেখবার জন্য নিজেদের খাটিয়া বাইরে নিয়ে এসে তার উপর বসে রইল, তারা দেখতে চাচ্ছিল সক্রেটিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই রাতটা কাবার করে দেয় কিনা। দেখা গেল, সক্রেটিস প্রত্যুষকাল দাঁড়িয়েই ছিল, তার পর সূর্য উঠলে-সূর্যদেবের প্রার্থনা করে চলে গেলেন।

আলকিয়াবিয়াডিসের দ্বিতীয় উদ্ধৃতি থেকে সক্রেটিসের অধ্যাত্ম চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তিনি যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ধ্যান করতেন তা সকলেই স্বীকার করতো। শারীরিক বা মানসিক কোনো ক্লেশই সক্রেটিসকে সামান্যতম কাতর করতে পারত না। তান্ত্রিক বা সাধু-সন্ন্যাসীদের এমন নির্বিকারচিত্র কাউকে দেখা যায়নি।

(আগামীকাল সমাপ্য)

শনিবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২০ , ২১ পৌষ ১৪২৬, ৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

দার্শনিক সক্রেটিস

হাবিবুর রহমান স্বপন

সক্রেটিসের জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা খুবই কঠিন। কারণ তিনি তার জীবদ্দশায় নিজের সম্পর্কে কিংবা তার দর্শন নিয়ে কিছু লিখে যাননি। তাকে জানতে হয় অন্যের দেয়া তথ্য উপাত্ত থেকে।

বার্টন্ড রাসেল বলেছেন, ‘সক্রেটিস সম্পর্কে আমাদের কম জানা আছে, না বেশি জানা আছে, সেটা স্থির করাই মুশকিল।’

খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ অব্দে সক্রেটিস জন্মেছিলেন, গ্রিসের এথেন্সে। বাবা সক্রোনিকাস তৎকালীন গ্রিসের এ্যটিকার আ্যলোপেকি গোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন। এথেন্সে যে প্রধান দশটি গ্রুপ ছিল আ্যলোপেকি তাদের অন্যতম। বাবা সক্রোনিকাস পেশায় ছিলেন ভাস্কর। সক্রেটিসও প্রথম জীবনে বাবার পেশা বেছে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীর ভারী অস্ত্র বিভাগে যোগ দেন। সেনাবাহিনীতে সক্রেটিস সুনামের পাশাপাশি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর চাকরির পর তৎকালীন এথেন্সের আইনসভার সদস্য এবং বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সেই সময় এথেন্সের আইন, বিচারব্যবস্থা ও রাজনীতি সম্পর্কে সক্রেটিসের ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। কর্মজীবনে তিনি কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেননি। নিজস্ব বিচক্ষণতা ও সততার দ্বারা স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছেন।

সক্রেটিসের পরিবার ডিইডলাস থেকে নিজেদের বংশক্রম গণনা করতো। সক্রোনিকাসের পুত্র সক্রেটিসের মাতার নাম ফেনারিটি। তিনি পেশায় ছিলেন একজন ধাত্রী। প্যাট্রেক্লিস নামে তার অন্য স্বামীর ঔরসজাত এক পুত্র ছিল বলে কথিত আছে। পরবর্তী জীবনে সক্রেটিস তার মায়ের পেশার তুলনা দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন এবং সবাইকে বলতেন যে, তিনিও ধাত্রী পেশার মতো কাজই করে থাকেন। তার মা ফেনারিটি মনুষ্য-শিশু প্রসবে সাহায্য করতেন আর সক্রেটিসের চিন্তা-ভাবনা প্রসারে সহায়তা করতেন।

সক্রেটিসকে জানতে আমাদের প্লেটো ও জেনোফেনের কাছেই নিবিষ্ট হতে হয়। এই দুই জনই ছিলেন সক্রেটিসের প্রিয় শিষ্য। প্লেটো ও জেনোফেনের অঙ্কিত সক্রেটিস ছিল দু’রকম। অনেক ক্ষেত্রেই অনুভূত হয় যে, সংলাপ সৃষ্টির প্রয়োজনে প্লেটো তার আবেগ ও কল্পনা দিয়ে সক্রেটিস নামের চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। একজনের সক্রেটিস তাত্ত্বিক ও দার্শনিক এবং অন্যজনের সক্রেটিস লোকজীবন ও রক্ত-মাংসের উত্তাপে জীবন্ত।

সক্রেটিসের শৈশব সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও ধারণা করা যায় যে, আর দশটা সাধারণ এথেনীয় বালকের মতোই সক্রেটিস সাধারণ শিক্ষা লাভ করেছেন। তার বাবা মা দুজনই উপার্জন করলেও সংসারে সচ্ছলতা ছিল না। ফলে সক্রেটিসকে লেখা পড়ার পরিবর্তে পাথর কাটার কাজ করতে হতো। কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে তিনি জ্ঞান দ্বারা তাড়িত হয়েছেন। যেটুক সময় তিনি পেয়েছেন তার সবটাই জ্ঞান অন্বেষণের কাজে লাগিয়েছেন। এভাবে কয়েক বছর কাটাবার পর এক ধনাঢ্য ব্যক্তির সাথে ঘটনাক্রমে তার পরিচয় হয়। এই ব্যক্তি সক্রেটিসের আচার-আচরণ ও বুদ্ধিদীপ্ততার প্রখরতায় অভিভূত হয়ে তার পড়াশুনার দায়িত্ব নেন। এরপর সক্রেটিস পাথর কাটার কাজ ছেড়ে দিয়ে পুনরায় এনাক্সোগোরাস নামের এক ব্যক্তির কাছে পড়াশুনা শুরু করেন।

ধারণা করা হয় যে, সক্রেটিসকে শৈশবের শুরুতে ভাষা, সাহিত্য ও সংগীতের উপর বিশেষ শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন এথেন্সের অভিজাত পরিবারের বিশ্বস্ত দাসদের পেইডাগোগস অর্থাৎ বালকদের অভিভাবক বলা হতো। এরা সম্পদশালী নাগরিকদের সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যেতো। সেই সময় স্কুলেই ছয় থেকে সাত বছর বয়সের বালকদের কলা বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হতো, বিশেষ করে ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পাঠদান করানো হতো। সাহিত্যের বিষয় ছিল হোমারের কাব্যের নির্দিষ্ট কিছু অংশ এবং সংগীতকলা। বালকদের পিতা-মাতা ও পেইডাগোসরা ছেলেদের তাদের ধর্ম, সদাচারণ ও নীতিশাস্ত্রের শিক্ষা দিত। বিদ্যালয়ে সেই সময় শারীরিক শিক্ষাও দেয়া হতো। অনেক শিক্ষকের বাড়িতেও স্কুল ছিল। সেখানে শিক্ষকরা অনেক কম বেতনে ছাত্রদের পড়াতেন। ছাত্রদের বুদ্ধিদীপ্ত করে গড়ে তোলার জন্য মুক্তবুদ্ধির চর্চা, খেলাধূলা শিক্ষা সহায়ক বিষয় হিসবে অন্তর্ভূক্ত ছিল। ধর্ম ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীলতা সৃষ্টির জন্য ছাত্রদের উল্লেখ্য বিষয়ে শিক্ষাদানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। তাদের উচ্চতর শিক্ষার জন্য অলঙ্কারশাস্ত্র, গণিত ও জ্যেতির্বিজ্ঞান শিক্ষালাভ করেছিলেন। তিনি পাথরের শিল্পী হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার তৈরি কয়েকটি ভাস্কর্য সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি এই পেশা পরিত্যাগ করে শিক্ষা-সেবায় ব্রত হয়েছিলেন।

বহু লেখকের বরাত দিয়ে যতটুকু জানা যায় সক্রেটিস যৌবনকালে সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। তবে এর সন-তারিখের হিসাব করা যায় না। সক্রেটিসের যৌবনকালে গ্রিস ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং এই রাজ্যগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকতো। ক্ষমতার লড়াইয়ে যোগ দেবার জন্য দেশের সামর্থবান তরুণ, যুবক ও শক্তিমান পুরুষদের উপর বাধ্যবাধকতা ছিল। সামরিক অভিযানে যোগ দেবার জন্য সক্রেটিসকেও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলা হলো। এই যুদ্ধে তিনি প্রচণ্ড সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পরপর তিনটি যুদ্ধে সক্রেটিস অংশ নিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে বিরূপ হয়ে দেশে ফিরে আসেন। সক্রেটিস তিন থেকে চারবার দেশের বাইরে গিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এরপর আর জন্মভূমি এথেন্সের বাইরে সক্রেটিস মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যাননি।

নিজ দেশ এথেন্সে ফিরে এসে সক্রেটিস দেখলেন শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-গরিমা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শৌর্য-বীর্যে এথেন্সে তখন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। এই পরিবেশে ফিরে এসে সক্রেটিস জ্ঞান-সাধনায় ধাতস্ত হলেন। তিনি স্থির করলেন, জ্ঞানের চর্চায় এবং বিশ্বপ্রকৃতিকে জানার সাধনায় সারাজীবন কাটিয়ে দেবেন।

আট-দশটা সাধারণ এথেনীয় নাগরিকদের মতোই সক্রেটিস সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তিনি সম্পূর্ণই একজন সামাজিক মানুষ ছিলেন। একজন মানুষের নিতান্তই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবন বলতে যা বোঝায়, সক্রেটিসের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। প্লেটা বা জেনোফেনের বরাত দিয়ে আমরা যে সক্রেটিসকে জানতে পারি তিনি কখনো ঘরে থাকেন না, গৃহকর্মে তার মনোযোগ নেই বা পার্থিব ধনসম্পদ ও ভোগস্পৃহার প্রতিও তার কোন আকর্ষণ নেই। তাকে পাওয়া যায় পথে-ঘাটে, বাজারে, সাধারণ মানুষের মাঝে কিংবা কোন সামাজিক উৎসবে। তাকে পরিবারের লোকজনের সাথে সহসা খুঁজে পাওয়া যায় না।

সক্রেটিসের বাবা-মা’র পরে তার পরিবার সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো- তার স্ত্রী জেনথিপ ও তিন পুত্র ল্যাক্সোক্লিস, সক্রোনিসকস ও মিনিক্সিনস। এমন একটি কথা এথেন্সে প্রচলিত ছিল যে, দাম্পত্য জীবনে জেনথিপ ভীষণ বদমেজাজি ছিলেন। কিন্তু প্লেটো চিত্রিত সক্রেটিসে এমন কোন তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। প্লেটোর সক্রেটিসকে আমার যখন কারারুদ্ধ অবস্থায় দেখি, তখন তার বয়স সত্তর বছর। তিন সন্তানসহ (প্রথমজন বালক আর অপর দু’জন শিশু) স্ত্রী জেনথিপ জেল গেটে সক্রেটিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতেন। এ থেকে প্রমাণ মেলে সক্রেটিস বেশি বয়সে বিয়ে করেছিলেন। সক্রেটিসের বিয়ে সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে যে, তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন, তারই গোত্রভুক্ত সম্পদশালী এরিস্টাইডের কন্যা মায়তোয়াকে। তবে দ্বিতীয় বিয়ের কোন তথ্য প্লেটোর সক্রেটিসে নেই।

অস্বচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ এথেনীয়দের মতো সক্রেটিসের ভাত-কাপড়ের কথা চিন্তা করতে হয়নি। সারাজীবন তাকে দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে জীবন চালাতে হয়েছে। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য তার জীবনে অর্জন হয়নি এবং তিনি তা কখনো কামনাও করেননি। জীবন বাঁচানোর বাইরে বিন্দুমাত্র অর্থ তিনি চাননি। জাগতিক বিলাসপ্রবণতামুক্ত মানুষ সক্রেটিস ব্যতিরেকে বিশ্ব ইতিহাসে বিরল।

সক্রেটিস দেখতে মোটেই সুদর্শন ব্যক্তি ছিলেন না। তার চেহারাকে অনেকেই অদ্ভুত বলতেন। তৎকালীন এথেনীয়দের তুলনায় তিনি লম্বায় বেশ বেঁটে ছিলেন, প্রশস্ত নাকবিশিষ্ট কুৎসিৎ চেহারার অধিকারী ছিলেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথেই মাথায় টাক পড়তে থাকে। তিনি প্রায়শই জীর্ণ-শীর্ণ ও ময়লা কাপড় পরিধান করতেন। একজন দার্শনিক বলতে আমরা যা বুঝি অর্থাৎ যারা সমাজের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত নন, সমাজের আট-দশটা মানুষ থেকে তারা ভিন্ন। তারা লোকালয় থেকে আলাদা থেকে ভাবলোকে নিমগ্ন থাকেন, তত্ত্বের পর তত্ত্ব নিয়ে বিশ্লেষণ করেন, সাধারণ মানুষ্য শ্রেণির কাছে তারা অধরা, নিভৃতচারী, চিন্তালোকে পরিগমণকারী ও বাস্তবে উদাসীন। কিন্তু সক্রেটিস সেইসব দার্শনিকদের মতো ছিলেন না। সক্রেটিস ছিলেন এইসব বৈশিষ্ট থেকে অনেকাংশেই ভিন্ন চরিত্রের অধিকারী।

সক্রেটিসের পারিবারিক জীবনের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য অপ্রতুল হওয়া সত্ত্বেও যেটুকু প্লেটোর বরাতে জানা যায় তাতে সক্রেটিস যে তার পরিবার নিয়ে ভবছেন বা তার স্ত্রী-পুত্রদের জন্য বিচলিত হয়েছেন তার কোন চিত্র পাওয়া যায় না। সক্রেটিসের পরিবারের বিস্তারিত কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও তিনি যে অসামাজিক মানুষ ছিলেন না তা জানা যায়। সক্রেটিস ছিলেন সামাজিক মানুষ এবং সমাজের মানুষের মানোন্নয়নে সর্বদাই চিন্তিত থাকতেন, তৎকালীন এথেনীয় সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে ভাবিত থাকতেন তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

জাগতিক মোহমুক্ত মানুষের তুলনায় সক্রেটিসের মতো দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির উদাহরণ ইতিহাসে বিরল। তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। কাজেই সংসারে অভাব নামক শব্দটা আষ্টেপৃষ্ঠে থাকতো। এজন্য স্ত্রীর সাথে সামান্য বচসা লেগেই থাকতো। কারণ গার্হস্থ্য জীবন থেকে তিনি বিমুক্ত ছিলেন। এথেনীয় সমাজের উন্নয়ন ছাড়া তার চিন্তনে আর কিছু ছিল না। তিনি নগ্ন পায়ে চলাফেরা করতেন। তার কষ্ট সহিষ্ণুতা ছিল প্রবাদ কাহিনীর মতো এবং সাহস ছিল প্রচণ্ড। শীত-গ্রীষ্মে, এমনকি বরফের ওপর দিয়েও তিনি অবলীলায় খালি পায়ে চলাফেরা করতেন। পেলোপনোশীয় যুদ্ধে তিনি অতুলনীয় বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। তার ন্যায়পরায়ণতা, সাহস ও কর্তব্যপরায়ণতার জন্য সেকালে গ্রিসের শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে একদল যুবক তার কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন।

এথেন্সের হাট-বাজারে, পথের মোড়ে, ভোজসভায় এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে সকেটিস আটপৌরে আচরণ করতেন। শীত-গ্রীষ্ম, ক্ষুধা-তৃষ্ণার প্রতি তার উদাসীনতা ছিল অসীম। প্লেটোর ডায়লগ সিম্পোজিয়ামে তৎকালীন এথেন্সের সেনাপতি ও আর্কন (রাষ্ট্রপতি) আলকিয়াবিয়াডিস (এথেন্সের বিরুদ্ধচারণ করে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত) এক সামরিক অভিযানে সক্রেটিসের দীপ্ত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে-

ক. তার সহনশক্তি ছিল এক কথায় বিষ্ময়কর। সরবরাহ থেকে বিযুক্ত হয়ে যখন আমাদের উপোস করতে বাধ্য হতে হচ্ছিল-যুদ্ধকালে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে-তখন সক্রেটিস শুধু আমাকে কেন, যে কাউকে সহিষ্ণুতার পরীক্ষায় অতিক্রম করে যেতেন। বস্তুত এ ব্যাপারে তার সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। ...ঠাণ্ডা সইবার ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। একবার প্রচণ্ড বরফপাত হলো। এ অঞ্চলটায় সত্যিই শীত খুবই বেশি প্রত্যেকে গৃহবন্দী থাকতেন, না হয় বিপুল পরিমাণ কাপড়চোপড় পরে বের হতেন এবং অবশ্যই প্রত্যেকের পায়ে মজবুত জুতা, ফেল্ট বা পশম দিয়ে পা-জোড়া পুরোপুরি ঢাকা। এইরকম অবস্থায় বরফের ওপর সৈনিকদের চেয়ে ভালো কুচকাওয়াজ করতেন তিনি। এজন্য অন্যেরা তাকে বিষদৃষ্টিতে দেখতো, কারণ মনে হতো সক্রেটিস তাদের অবজ্ঞা দেখাচ্ছেন।

খ. সৈনিক হিসেবে তার আর একটি কীর্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। একদিন প্রত্যুষে তার মনে প্রশ্নের উদয় হওয়াতে তিনি তৎক্ষণাৎ সেইখানে দাঁড়িয়েই ভাবতে শুরু করলেন। কোনো সমাধান পাওয়া গেল না, তবু চেষ্টা ত্যাগ না করে ওইখানে দাঁড়িয়েই আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলেন। দুপুর হলো লোকজন দেখলো সক্রেটিস দাঁড়িয়ে- তারা অবাক হয়ে পরস্পর বলাবলি করতে লাগল সক্রেটিস সেই কোন সকাল থেকে এইভাবে চিন্তামগ্ন রয়েছে। অবশেষে রাত্রির আহারের পর (তখন গ্রীষ্মকাল) আইওনিয়ার কয়েকজন অধিবাসী সক্রেটিসের অদ্ভুত কাণ্ডের শেষ দেখবার জন্য নিজেদের খাটিয়া বাইরে নিয়ে এসে তার উপর বসে রইল, তারা দেখতে চাচ্ছিল সক্রেটিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই রাতটা কাবার করে দেয় কিনা। দেখা গেল, সক্রেটিস প্রত্যুষকাল দাঁড়িয়েই ছিল, তার পর সূর্য উঠলে-সূর্যদেবের প্রার্থনা করে চলে গেলেন।

আলকিয়াবিয়াডিসের দ্বিতীয় উদ্ধৃতি থেকে সক্রেটিসের অধ্যাত্ম চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তিনি যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ধ্যান করতেন তা সকলেই স্বীকার করতো। শারীরিক বা মানসিক কোনো ক্লেশই সক্রেটিসকে সামান্যতম কাতর করতে পারত না। তান্ত্রিক বা সাধু-সন্ন্যাসীদের এমন নির্বিকারচিত্র কাউকে দেখা যায়নি।

(আগামীকাল সমাপ্য)