আব্দুল মান্নান খান
বলতে চাচ্ছি, যে পরীক্ষায় অপরাধ করলেও একজন শিশুর মানসিক জগতে প্রভাব ফেলতে পারে দেখে বহিষ্কার করা যাবে না সেই পিইসি পরীক্ষায় শিশুদের বসাতে যাওয়া কেন। এ পিইসি নিয়ে কথা চলছে এর শুরু থেকেই। পরীক্ষাটি থাকবে কি থাকবে না এ সিদ্ধান্তটি এক রকম ঝুলে আছে বলা যায়। এর আগের সরকারে মোস্তাফিজুর রহমান যখন প্রাথমিক শিক্ষার মন্ত্রী তখন তো তিনি বলেই ফেলেছিলেন, এবার থেকেই আর পিইসি থাকছে না। তারপর মন্ত্রিসভায় গিয়ে আর হলো না। এতে হতাশই হতে হলো একটু।
২৫ ডিসেম্বর ২০১৯ পত্রিকায় এসেছে, পিইসি থাকবে কি থাকবে না তা ঠিক করতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ নির্দেশকে আমরা সাধুবাদ জানাই। শিশুরা যে পরীক্ষার ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে প্রধানমন্ত্রীর তা জানা আছে এজন্য আমরা আশাবাদী। পরীক্ষাটা তুলে দেয়ার পক্ষে অনেক সুধীজন লিখেছেন, মতামত ব্যক্ত করেছেন। মানববন্ধন হয়েছে। দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদরাও অনেকে বক্তব্য দিয়েছেন। দেখা গেছে তার মধ্যে কেউ এটা রাখার পক্ষে বলেননি। বরং ১২ ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করতে আমাদের শিশুদের চারবার পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে এটা ‘টু মাচ’ বলেছেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকবে না সিদ্ধান্ত এসেছে। আমরা স্বাগত জানিয়েছি। তখন এ কলামে লিখেছিলাম, আরও ভালো হবে পঞ্চম শ্রেণী থেকে পাবলিক পরীক্ষাটা তুলে দিলে। বলেছিলাম, পঞ্চম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা রেখে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দিলে শিশুদের নতুন করে আবার পরীক্ষাভীতির মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। কারণ চতুর্থ শ্রেণীতে গিয়ে তারা প্রথম প্রশ্নপত্র হাতে পাবে এবং খাতা-কলমে পরীক্ষা দিয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠবে। তারপর পঞ্চম শ্রেণীতেই সমাপনী পরীক্ষা। তার মানে স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে একবার শুধু পরীক্ষায় বসেই তারা পঞ্চম শ্রেণীতে গিয়ে পাবলিক পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। অভিভাবক-শিক্ষক কারও জন্য সেটা স্বস্তিকর হবে না। উল্টা শিশুরা আরও চাপের মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
জীবনের প্রথম সার্টিফিকেটের জন্য পরীক্ষা বলে কথা। জিপিএ ৫, গোল্ডেন না পেলে জীবন বরবাদ- এমন প্রচার তো আছেই বাজারে। এবং সেটা এমনই যে মনে হয় যেন ওদের ঘুম দরকার নেই, খেলাধুলা দরকার নেই, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দরকার নেই, পারিবারিক মেলামেশা হৈচৈর দরকার নেই- জিপিএ ৫, গোল্ডেন হলেই চলবে। অভিভাবকরা নিরুপায়। চাপে পড়ে বেশির ভাগ অভিভাবক খেয়ে না খেয়ে জোগাচ্ছেন টাকা, সন্তানেরা একদিন মানুষ হবে এ আশায়। আবার অনেকেই ভাবছেন টাকাপয়সা গেলেও ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার মধ্যে আছে সারা দিন- এই তো ভালো। আর এ মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে চলে আসছে শিশুদের শিক্ষা নিয়ে রমরমা বাণিজ্য। এর থেকে বেরিয়ে আসতেই আজ তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা উঠে যাচ্ছে। তাই বলতে চাচ্ছি এর সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণী থেকে পিইসি পরীক্ষাও তুলে দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এতে পুরো ব্যাপারটা টেকসই হবে এবং লেখাপড়া শ্রেণীকক্ষমুখী হবে। ছাত্রছাত্রীদের ভেতর নিজে পড়ার মনোভাবও গড়ে ওঠবে। শুধু পরীক্ষা পরীক্ষা করে ছুটতে হবে না।
পরীক্ষায় অপরাধ তো ওই ১০-১১ বছরের শিশুরা করে না। ওরা বোঝে না জিপিএ কি জিনিস বোঝে না তার স্কুল ছেড়ে অন্য স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা কেন দিতে হবে। তাকে নিয়ে কেন এত টানাটানি করা হচ্ছে বোঝে না। তারা পাঠ্যবই আর গাইড বইয়ের পার্থক্য বোঝে না। সব বইয়ের দোকানে গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি কিন্তু পাঠ্যবইটা কেন পাওয়া যায় না তা বোঝে না। একই ভাবে নকল করে বা অন্য কোন অসদুপায় অবলম্বন করে এ পরীক্ষায় ভালো করতে হবে এ তারা বোঝে না। এসব কথা বোঝেন, তাদের শিক্ষক এবং তাদের অভিভাবকরা।
সে বেশ আগের কথা। ঢাকার একটা নামকরা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে। দেখা গেল লোকজন এদিক-ওদিক ভিড় জমাচ্ছে জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। এ অবস্থায় ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক বেরিয়ে এলেন, সবার উদ্দেশে বললেন, আপনারা এটা কী করছেন! ওরা আপনাদের যা করতে দেখবে তাই তো শিখবে। ভাববে এই বুঝি নিয়ম, এমনই করতে হয়। ওদের এমন ক্ষতি আপনারা করছেন কেন। দয়া করে সরে যান সবাই। এতে দেখা গেল সবাই ঠিকই সরে গেলেন। উনাকে পুলিশ ডাকতে হলো না।
এখন একটা ১০-১২ বছরের শিশু যদি এ পরীক্ষায় কোন রকম অসদুপায় অবলম্বন করে বা কোন রকম শৃঙ্খলা ভঙ করে তার জন্য তো তাকে দায়ী করা যায় না। হাইকোর্ট এজন্যই তো পিইসি পরীক্ষায় শিশুদের বহিষ্কার করা কেন অবৈধ হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। গত পিইসি পরীক্ষায় যেসব শিশুদের বহিষ্কার করা হয় তাদের পুনরায় কেন পরীক্ষা নিতে নির্দেশ দেয়া হবে না তাও ওই রুলে জানতে চান মহামান্য হাইকোর্ট। এরপর দেখা গেল বহিষ্কৃতদের আবার পরীক্ষা নেয়া হলো।
এর আগের বছর ঘটেছিল আরেক ঘটনা। পিইসি (প্রাইমারি এডুকেশন সার্টিফিকেট) পরীক্ষার প্রথম দিনই দেড় লাখ ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত ছিল। এর কোন কারণ খটু জে দেখা হয়েছে কিনা জানা যায়নি। পঞ্চম শ্রেণীর এ দেড় লাখ শিক্ষার্থী কি শুধু কাগজে-কলমেই ছিল, না সশরীরেও ছিল। সংখ্যাটা কি প্রথম শ্রেণী থেকে বয়ে এসেছে না পঞ্চম শ্রেণীতে এসেই হয়েছে। এই দেড় লাখের পেছনে কত লাখ বই বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে তার মূল্য কত। এর মধ্যে কতজনকে উপবৃত্তির টাকা দেয়া হয়েছে তার পরিমাণ কত। এসবের জবাবদিহিতার প্রয়োজন রয়েছে। শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে হেলাফেলা করা চলে না। এতে প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের বিরাট অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে। সব শিশু এখন স্কুলে যায় এ অর্জনকে মানসম্মত করে তুলতে হবে।
এসব শিশুদের সামনে এখন শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা। প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা বলে এক পরীক্ষা চালু হয়েছে এর যন্ত্রণায় সবাই অস্থির। গাইডওয়ালাদের পোয়াবারো। মোটা অংকের টাকা ব্যয় করে তারা বিশেষজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে কাজ করিয়ে নেন। এ সুযোগটা সৃষ্টি হয়েছে অনেকে বলেন পাবলিক পরীক্ষা বেশি হওয়ার কারণে। যেমন পঞ্চম শ্রেণীতে পিইসি অষ্টম শ্রেণীতে জেএসসি তার দুই ক্লাস পরে দশম শ্রেণীতে এসএসসি পরীক্ষা তার দুই ক্লাস পরে এইচএসসি পরীক্ষা। অর্থাৎ ১২ ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করতে একজনকে দিতে হচ্ছে চারটা পাবলিক পরীক্ষা। আর এই চার পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে বয়ে যাচ্ছে পরীক্ষার বন্যা চারদিকে। এর থেকে ওদের উদ্ধারের রাস্তা হলো অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি এবং দ্বাদশ শ্রেণীর এইসএসসির সমাপনী পরীক্ষা রেখে বাকি দুটো পরীক্ষা অর্থাৎ পিইসি এবং এসএসসি দুটোই তুলে দেয়া যেতে পারে। ওদের হাড়ে একটু বাতাস লাগতে পারবে এতে। পরীক্ষা যত বেশি হচ্ছে লেখাপড়ার মান তত পড়ে যাচ্ছে। এই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখার মান কতখানি পড়ে গেছে তা গত বছর বিশ্বব্যাংক তার এক প্রতিবেদনে দেখিয়ে দিয়েছে। তারা বলেছে, মানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা চার বছর পিছিয়ে আছে। এর মানে আমাদের শিশুরা প্রথম শ্রেণীতে যা শেখার কথা তা শিখছে পঞ্চম শ্রেণীতে গিয়ে। ১১ বছরের স্কুলজীবনে ৪ বছরই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাদের। এর কারণ আমি মনে করি আমাদের এ শিশুদের সামনে লেখাপড়া কঠিন করে তুলে ধরা হয়েছে। অবস্থা এমন করে ফেলা হয়েছে যে, গাইড আর কোচিং ছাড়া কেউ পাসই করতে পারবে না- একথা অনেক সচেতন অভিভাবকেরা বলছেন। একবার এ কলামে সরকারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ইংরেজি বিষয়ের একসেট প্রশ্নপত্র তুলে ধরে বলেছিলাম, তৃতীয় শ্রেণীর ৮-৯ বছর বয়সের একটা শিশুর পক্ষে ইংরেজির এই সুদীর্ঘ প্রশ্নপত্র পড়ে-বুঝে দুই-আড়াই ঘণ্টায় উত্তর করা কীভাবে সম্ভব! আর যদি সম্ভব হয়ও তাহলে সেটা কত পার্সেন্ট শিক্ষার্থীর পক্ষে সম্ভব। এমন লেখাপড়া করার মতো সুযোগ-সুবিধাই বা আমাদের কতজন ছেলেমেয়েরা পেয়ে থাকে।’
আরেকটা কারণ মনে করি এমন যে, আমাদের রয়েছে অনেক রকম শিক্ষা পদ্ধতি যেমন কোন শিশু পড়ছে ইংরেজি মিডিয়ামে কোন শিশু পড়ছে ইংরেজি ভার্সানে কোন শিশু পড়ছে সরকারি স্কুলে কেউ পড়ছে এবতেদায়ি মাদ্রাসায় আবার কেউ পড়ছে হাফেজি-নূরানি বা কওমি মাদ্রাসায়। জগাখিচুড়ি মার্কা হলেও রয়েছে ব্যাপক আকারে কিন্ডারগার্টেন নামের স্কুল- শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। ফলে শিক্ষার মধ্যে যেমন তারতম্য রয়েছে মানের মধ্যেও তেমন রয়েছে ব্যাপক তারতম্য। সত্যি কথা বলতে কি এগুলোকে সমন্বয় করে অভিন্ন একটা কারিকুলামে ফেলে কিছু একটা করা যায কিনা সেটা নিয়ে কেউ এগিয়ে আসছেন এমন দেখা যাচ্ছে না।
আরও একটা কারণ হতে পারে, ওই যে বললাম, লেখাপড়াকে কঠিন করে ওদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে লেখাপড়া করতে ওরা ঠিক সেই জগৎটা পাচ্ছে না যে জগতে হাসি আনন্দের সঙ্গে পড়বে জানবে কোন চাপের মধ্যে পড়বে না।
যাহোক, পিইসি পরীক্ষা তুলে দেয়ার পক্ষে কিছু কথা বলে শেষ করতে চাই। ঝরে পড়ার বিষয়টা নিয়েই আগে বলি। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত উঠতে যেসব শিশুরা ঝরে পড়ে বা আরও দু-এক ক্লাস উঠে যারা ঝরে পড়ে তারা কারা? হতদরিদ্র দিনমজুর মেহনতি খেটে খাওয়া শ্রমিক শ্রেণীর ঘরের ছেলেমেয়েরাই তো। আর যারা একটু সচ্ছল তাদের ছেলেমেয়েরা ঝরে না পড়ে ক্লাস পাড়ি দিতে থাকে। কারণ তারা কোচিং-প্রাইভেট ইত্যাদিতে টাকা-পয়সা খরচ করে টিকে থাকে বা টিকিয়ে রাখেন তাদের অভিভাবক এবং শিক্ষক মহোদয়রা কিছু শিখুক আর না শিখুক। ধরে নিলাম যারা প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল তারা সবাই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত গেল। পিইসি পরীক্ষা দিল এবং একখানা করে সার্টিফিকেট হাতে পেল। তারপর আরও দু-এক বছর স্কুলে গেল-এলো বা ওখানেই ঝরে গেল। তখন ওই পিইসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট তাদের কী কাজে লাগবে। কোন কাজেই লাগবে না। সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে কি ওই সার্টিফিকেট বিবেচিত হবে? হবে না। সমাজের কাছে সে কি লেখাপড়া জানা মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে? হবে না। সরকারের সর্বনিম্ন পদে চাকরির জন্য সে কি আবেদন করতে পারবে? পারবে না। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া যদি হয় সরকারের সর্বনিম্ন পদে চাকরির জন্য আবেদন করার শিক্ষাগত যোগ্যতা তাহলে প্রথম সমাপনী পরীক্ষাটা সেখানেই হোক না কেন। জেএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত টিকে থেকে ঝরে গেলে যেটুকু শিখবে তা একেবারে ভুলে যাবে না। কিছু তার কাজে লাগবে। এখন যেটা করা হচ্ছে পঞ্চম শ্রেণীর ১০-১১ বছরের শিশুদের দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত এক পাবলিক পরীক্ষায় হাজির করা হচ্ছে যেটা অমানবিকও মনে হয়। এর অবসান হওয়া দরকার। বলতে চাচ্ছি, অপ্রয়োজনীয় এরকম একটা সনদের জন্য কেন ওদের শৈশবে নানা রকম অনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়া হবে। কেন নোট-গাইড-কোচিংয়ের মধ্যে ওরা আটকে যাবে।
সোমবার, ০৬ জানুয়ারী ২০২০ , ২৩ পৌষ ১৪২৬, ৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১
আব্দুল মান্নান খান
বলতে চাচ্ছি, যে পরীক্ষায় অপরাধ করলেও একজন শিশুর মানসিক জগতে প্রভাব ফেলতে পারে দেখে বহিষ্কার করা যাবে না সেই পিইসি পরীক্ষায় শিশুদের বসাতে যাওয়া কেন। এ পিইসি নিয়ে কথা চলছে এর শুরু থেকেই। পরীক্ষাটি থাকবে কি থাকবে না এ সিদ্ধান্তটি এক রকম ঝুলে আছে বলা যায়। এর আগের সরকারে মোস্তাফিজুর রহমান যখন প্রাথমিক শিক্ষার মন্ত্রী তখন তো তিনি বলেই ফেলেছিলেন, এবার থেকেই আর পিইসি থাকছে না। তারপর মন্ত্রিসভায় গিয়ে আর হলো না। এতে হতাশই হতে হলো একটু।
২৫ ডিসেম্বর ২০১৯ পত্রিকায় এসেছে, পিইসি থাকবে কি থাকবে না তা ঠিক করতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ নির্দেশকে আমরা সাধুবাদ জানাই। শিশুরা যে পরীক্ষার ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে প্রধানমন্ত্রীর তা জানা আছে এজন্য আমরা আশাবাদী। পরীক্ষাটা তুলে দেয়ার পক্ষে অনেক সুধীজন লিখেছেন, মতামত ব্যক্ত করেছেন। মানববন্ধন হয়েছে। দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদরাও অনেকে বক্তব্য দিয়েছেন। দেখা গেছে তার মধ্যে কেউ এটা রাখার পক্ষে বলেননি। বরং ১২ ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করতে আমাদের শিশুদের চারবার পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে এটা ‘টু মাচ’ বলেছেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকবে না সিদ্ধান্ত এসেছে। আমরা স্বাগত জানিয়েছি। তখন এ কলামে লিখেছিলাম, আরও ভালো হবে পঞ্চম শ্রেণী থেকে পাবলিক পরীক্ষাটা তুলে দিলে। বলেছিলাম, পঞ্চম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা রেখে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দিলে শিশুদের নতুন করে আবার পরীক্ষাভীতির মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। কারণ চতুর্থ শ্রেণীতে গিয়ে তারা প্রথম প্রশ্নপত্র হাতে পাবে এবং খাতা-কলমে পরীক্ষা দিয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠবে। তারপর পঞ্চম শ্রেণীতেই সমাপনী পরীক্ষা। তার মানে স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে একবার শুধু পরীক্ষায় বসেই তারা পঞ্চম শ্রেণীতে গিয়ে পাবলিক পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। অভিভাবক-শিক্ষক কারও জন্য সেটা স্বস্তিকর হবে না। উল্টা শিশুরা আরও চাপের মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
জীবনের প্রথম সার্টিফিকেটের জন্য পরীক্ষা বলে কথা। জিপিএ ৫, গোল্ডেন না পেলে জীবন বরবাদ- এমন প্রচার তো আছেই বাজারে। এবং সেটা এমনই যে মনে হয় যেন ওদের ঘুম দরকার নেই, খেলাধুলা দরকার নেই, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দরকার নেই, পারিবারিক মেলামেশা হৈচৈর দরকার নেই- জিপিএ ৫, গোল্ডেন হলেই চলবে। অভিভাবকরা নিরুপায়। চাপে পড়ে বেশির ভাগ অভিভাবক খেয়ে না খেয়ে জোগাচ্ছেন টাকা, সন্তানেরা একদিন মানুষ হবে এ আশায়। আবার অনেকেই ভাবছেন টাকাপয়সা গেলেও ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার মধ্যে আছে সারা দিন- এই তো ভালো। আর এ মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে চলে আসছে শিশুদের শিক্ষা নিয়ে রমরমা বাণিজ্য। এর থেকে বেরিয়ে আসতেই আজ তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা উঠে যাচ্ছে। তাই বলতে চাচ্ছি এর সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণী থেকে পিইসি পরীক্ষাও তুলে দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এতে পুরো ব্যাপারটা টেকসই হবে এবং লেখাপড়া শ্রেণীকক্ষমুখী হবে। ছাত্রছাত্রীদের ভেতর নিজে পড়ার মনোভাবও গড়ে ওঠবে। শুধু পরীক্ষা পরীক্ষা করে ছুটতে হবে না।
পরীক্ষায় অপরাধ তো ওই ১০-১১ বছরের শিশুরা করে না। ওরা বোঝে না জিপিএ কি জিনিস বোঝে না তার স্কুল ছেড়ে অন্য স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা কেন দিতে হবে। তাকে নিয়ে কেন এত টানাটানি করা হচ্ছে বোঝে না। তারা পাঠ্যবই আর গাইড বইয়ের পার্থক্য বোঝে না। সব বইয়ের দোকানে গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি কিন্তু পাঠ্যবইটা কেন পাওয়া যায় না তা বোঝে না। একই ভাবে নকল করে বা অন্য কোন অসদুপায় অবলম্বন করে এ পরীক্ষায় ভালো করতে হবে এ তারা বোঝে না। এসব কথা বোঝেন, তাদের শিক্ষক এবং তাদের অভিভাবকরা।
সে বেশ আগের কথা। ঢাকার একটা নামকরা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে। দেখা গেল লোকজন এদিক-ওদিক ভিড় জমাচ্ছে জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। এ অবস্থায় ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক বেরিয়ে এলেন, সবার উদ্দেশে বললেন, আপনারা এটা কী করছেন! ওরা আপনাদের যা করতে দেখবে তাই তো শিখবে। ভাববে এই বুঝি নিয়ম, এমনই করতে হয়। ওদের এমন ক্ষতি আপনারা করছেন কেন। দয়া করে সরে যান সবাই। এতে দেখা গেল সবাই ঠিকই সরে গেলেন। উনাকে পুলিশ ডাকতে হলো না।
এখন একটা ১০-১২ বছরের শিশু যদি এ পরীক্ষায় কোন রকম অসদুপায় অবলম্বন করে বা কোন রকম শৃঙ্খলা ভঙ করে তার জন্য তো তাকে দায়ী করা যায় না। হাইকোর্ট এজন্যই তো পিইসি পরীক্ষায় শিশুদের বহিষ্কার করা কেন অবৈধ হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। গত পিইসি পরীক্ষায় যেসব শিশুদের বহিষ্কার করা হয় তাদের পুনরায় কেন পরীক্ষা নিতে নির্দেশ দেয়া হবে না তাও ওই রুলে জানতে চান মহামান্য হাইকোর্ট। এরপর দেখা গেল বহিষ্কৃতদের আবার পরীক্ষা নেয়া হলো।
এর আগের বছর ঘটেছিল আরেক ঘটনা। পিইসি (প্রাইমারি এডুকেশন সার্টিফিকেট) পরীক্ষার প্রথম দিনই দেড় লাখ ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত ছিল। এর কোন কারণ খটু জে দেখা হয়েছে কিনা জানা যায়নি। পঞ্চম শ্রেণীর এ দেড় লাখ শিক্ষার্থী কি শুধু কাগজে-কলমেই ছিল, না সশরীরেও ছিল। সংখ্যাটা কি প্রথম শ্রেণী থেকে বয়ে এসেছে না পঞ্চম শ্রেণীতে এসেই হয়েছে। এই দেড় লাখের পেছনে কত লাখ বই বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে তার মূল্য কত। এর মধ্যে কতজনকে উপবৃত্তির টাকা দেয়া হয়েছে তার পরিমাণ কত। এসবের জবাবদিহিতার প্রয়োজন রয়েছে। শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে হেলাফেলা করা চলে না। এতে প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের বিরাট অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে। সব শিশু এখন স্কুলে যায় এ অর্জনকে মানসম্মত করে তুলতে হবে।
এসব শিশুদের সামনে এখন শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা। প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা বলে এক পরীক্ষা চালু হয়েছে এর যন্ত্রণায় সবাই অস্থির। গাইডওয়ালাদের পোয়াবারো। মোটা অংকের টাকা ব্যয় করে তারা বিশেষজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে কাজ করিয়ে নেন। এ সুযোগটা সৃষ্টি হয়েছে অনেকে বলেন পাবলিক পরীক্ষা বেশি হওয়ার কারণে। যেমন পঞ্চম শ্রেণীতে পিইসি অষ্টম শ্রেণীতে জেএসসি তার দুই ক্লাস পরে দশম শ্রেণীতে এসএসসি পরীক্ষা তার দুই ক্লাস পরে এইচএসসি পরীক্ষা। অর্থাৎ ১২ ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করতে একজনকে দিতে হচ্ছে চারটা পাবলিক পরীক্ষা। আর এই চার পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে বয়ে যাচ্ছে পরীক্ষার বন্যা চারদিকে। এর থেকে ওদের উদ্ধারের রাস্তা হলো অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি এবং দ্বাদশ শ্রেণীর এইসএসসির সমাপনী পরীক্ষা রেখে বাকি দুটো পরীক্ষা অর্থাৎ পিইসি এবং এসএসসি দুটোই তুলে দেয়া যেতে পারে। ওদের হাড়ে একটু বাতাস লাগতে পারবে এতে। পরীক্ষা যত বেশি হচ্ছে লেখাপড়ার মান তত পড়ে যাচ্ছে। এই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখার মান কতখানি পড়ে গেছে তা গত বছর বিশ্বব্যাংক তার এক প্রতিবেদনে দেখিয়ে দিয়েছে। তারা বলেছে, মানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা চার বছর পিছিয়ে আছে। এর মানে আমাদের শিশুরা প্রথম শ্রেণীতে যা শেখার কথা তা শিখছে পঞ্চম শ্রেণীতে গিয়ে। ১১ বছরের স্কুলজীবনে ৪ বছরই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাদের। এর কারণ আমি মনে করি আমাদের এ শিশুদের সামনে লেখাপড়া কঠিন করে তুলে ধরা হয়েছে। অবস্থা এমন করে ফেলা হয়েছে যে, গাইড আর কোচিং ছাড়া কেউ পাসই করতে পারবে না- একথা অনেক সচেতন অভিভাবকেরা বলছেন। একবার এ কলামে সরকারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ইংরেজি বিষয়ের একসেট প্রশ্নপত্র তুলে ধরে বলেছিলাম, তৃতীয় শ্রেণীর ৮-৯ বছর বয়সের একটা শিশুর পক্ষে ইংরেজির এই সুদীর্ঘ প্রশ্নপত্র পড়ে-বুঝে দুই-আড়াই ঘণ্টায় উত্তর করা কীভাবে সম্ভব! আর যদি সম্ভব হয়ও তাহলে সেটা কত পার্সেন্ট শিক্ষার্থীর পক্ষে সম্ভব। এমন লেখাপড়া করার মতো সুযোগ-সুবিধাই বা আমাদের কতজন ছেলেমেয়েরা পেয়ে থাকে।’
আরেকটা কারণ মনে করি এমন যে, আমাদের রয়েছে অনেক রকম শিক্ষা পদ্ধতি যেমন কোন শিশু পড়ছে ইংরেজি মিডিয়ামে কোন শিশু পড়ছে ইংরেজি ভার্সানে কোন শিশু পড়ছে সরকারি স্কুলে কেউ পড়ছে এবতেদায়ি মাদ্রাসায় আবার কেউ পড়ছে হাফেজি-নূরানি বা কওমি মাদ্রাসায়। জগাখিচুড়ি মার্কা হলেও রয়েছে ব্যাপক আকারে কিন্ডারগার্টেন নামের স্কুল- শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। ফলে শিক্ষার মধ্যে যেমন তারতম্য রয়েছে মানের মধ্যেও তেমন রয়েছে ব্যাপক তারতম্য। সত্যি কথা বলতে কি এগুলোকে সমন্বয় করে অভিন্ন একটা কারিকুলামে ফেলে কিছু একটা করা যায কিনা সেটা নিয়ে কেউ এগিয়ে আসছেন এমন দেখা যাচ্ছে না।
আরও একটা কারণ হতে পারে, ওই যে বললাম, লেখাপড়াকে কঠিন করে ওদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে লেখাপড়া করতে ওরা ঠিক সেই জগৎটা পাচ্ছে না যে জগতে হাসি আনন্দের সঙ্গে পড়বে জানবে কোন চাপের মধ্যে পড়বে না।
যাহোক, পিইসি পরীক্ষা তুলে দেয়ার পক্ষে কিছু কথা বলে শেষ করতে চাই। ঝরে পড়ার বিষয়টা নিয়েই আগে বলি। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত উঠতে যেসব শিশুরা ঝরে পড়ে বা আরও দু-এক ক্লাস উঠে যারা ঝরে পড়ে তারা কারা? হতদরিদ্র দিনমজুর মেহনতি খেটে খাওয়া শ্রমিক শ্রেণীর ঘরের ছেলেমেয়েরাই তো। আর যারা একটু সচ্ছল তাদের ছেলেমেয়েরা ঝরে না পড়ে ক্লাস পাড়ি দিতে থাকে। কারণ তারা কোচিং-প্রাইভেট ইত্যাদিতে টাকা-পয়সা খরচ করে টিকে থাকে বা টিকিয়ে রাখেন তাদের অভিভাবক এবং শিক্ষক মহোদয়রা কিছু শিখুক আর না শিখুক। ধরে নিলাম যারা প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল তারা সবাই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত গেল। পিইসি পরীক্ষা দিল এবং একখানা করে সার্টিফিকেট হাতে পেল। তারপর আরও দু-এক বছর স্কুলে গেল-এলো বা ওখানেই ঝরে গেল। তখন ওই পিইসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট তাদের কী কাজে লাগবে। কোন কাজেই লাগবে না। সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে কি ওই সার্টিফিকেট বিবেচিত হবে? হবে না। সমাজের কাছে সে কি লেখাপড়া জানা মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে? হবে না। সরকারের সর্বনিম্ন পদে চাকরির জন্য সে কি আবেদন করতে পারবে? পারবে না। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া যদি হয় সরকারের সর্বনিম্ন পদে চাকরির জন্য আবেদন করার শিক্ষাগত যোগ্যতা তাহলে প্রথম সমাপনী পরীক্ষাটা সেখানেই হোক না কেন। জেএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত টিকে থেকে ঝরে গেলে যেটুকু শিখবে তা একেবারে ভুলে যাবে না। কিছু তার কাজে লাগবে। এখন যেটা করা হচ্ছে পঞ্চম শ্রেণীর ১০-১১ বছরের শিশুদের দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত এক পাবলিক পরীক্ষায় হাজির করা হচ্ছে যেটা অমানবিকও মনে হয়। এর অবসান হওয়া দরকার। বলতে চাচ্ছি, অপ্রয়োজনীয় এরকম একটা সনদের জন্য কেন ওদের শৈশবে নানা রকম অনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়া হবে। কেন নোট-গাইড-কোচিংয়ের মধ্যে ওরা আটকে যাবে।