মুক্তিযুদ্ধোত্তর দিনাজপুর ট্র্যাজেডি

১৬ ডিসেম্বর একাত্তর। বাঙালির দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ জয়ের দিন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই দিন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল বীর বাঙালি জাতির কাছে। পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল এই দিনে। নতুন পতাকা, নতুন দেশ নিয়ে বীরোচিত অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের।

যুদ্ধ জয় শেষে ঘরে ফেরার পালা। ঘরে ফিরতে থাকে বাঙালি শরণার্থীরা। ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিতে থাকে বাংলার বীর সেনা মুক্তিযোদ্ধারা। ঘরে ফেরার প্রস্তুতি হিসেবে তারা সমবেত হতে থাকেন বিভিন্ন ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানেও অনেক কাজ। ঘরে ফিরতে চাইলেও সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফেরা যাচ্ছিল না।

বিশেষ করে যুদ্ধ জয়ের সঙ্গে সঙ্গেই সেদিন সকল মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে ঘরে ফেরা সম্ভব হয়নি। কারণ শত্রু বাহিনীর ফেলে যাওয়া, পুঁতে রাখা অস্ত্র, গোলা, বোমা, বারুদ তখনো অনেকের প্রাণ সংহারের কারণ হয়ে উঠছিল। বিভিন্ন স্থানে, যেখানে-সেখানে ফেলে যাওয়া, পুঁতে রাখা সেসব বিপজ্জনক মারণাস্ত্র যতক্ষণ নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়া না যায়, ততক্ষণ মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে ফেরা সম্ভব নয়। সে কারণে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা হয় ট্রানজিট ক্যাম্প।

মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত ৬ ও ৭নং সেক্টরের আওতায় দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়ের যে সব মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাদের নিয়ে ট্রানজিট ক্যাম্প করা হয় দিনাজপুর শহরের পূর্বপ্রান্তের মহারাজা গীরিজানাথ হাই স্কুল প্রাঙ্গণে। বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় যুদ্ধ করেছেন এমন প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এই ট্রানজিট ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। ক্যাম্পের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন লে. কর্নেল শাহরিয়ার।

ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বৃহত্তর দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদারদের পুঁতে রাখা, ফেলে রাখা, ছেড়ে যাওয়া মাইন, বোমা, অন্যান্য অস্ত্র উদ্ধার করা হতো। প্রতিদিনের উদ্ধারকৃত অস্ত্র ট্রানজিট ক্যাম্পের বিরাট বাংকারে রেখে দেয়া হতো। মহারাজা স্কুলের বিরাট মাঠের দক্ষিণ দিকে (বর্তমানে যেখানে মসজিদ রয়েছে তার পাশেই) উদ্ধারকৃত এইসব অস্ত্রের বাংকার ছিলো। সেখানে থাকত উদ্ধার করা এন্টি ট্যাংক মাইন, এন্টি পারসোনাল মাইন, জ্যাম্পিং মাইন, মর্টারের ২ ও ৩ ইঞ্চি শেল, গ্রেনেড ইত্যাদি। স্বাধীন দেশের মাটি নিরাপদ করতে মুক্তিযোদ্ধারা উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রতিদিনের উদ্ধার কাজ চালাতে থাকেন। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয় কয়েক দিনে। কিন্তু বিজয়ের মাত্র ২০ দিন পর ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সব আনন্দ উদ্দীপনা নিঃশেষ হয়ে যায় এক অকল্পনীয় দুর্ঘটনায়।

৬ জানুয়ারি ১৯৭২, সন্ধ্যা। সূর্য তখন অস্তগামী। আকাশে লাল আভা। ঠিক এ সময় অকস্মাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো মহারাজা স্কুল। স্কুলের দ্বিতল ভবন গুঁড়িয়ে গেলো। মাঠের যে স্থানটিতে অস্ত্রভাণ্ডার ছিলো, সেটি বিরাট খালে পরিণত হলো। সেই খালে উঠে এলো পানি। আর গোটা আকাশ, গোটা মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গণ অন্ধকারে ঢেকে গেলো। স্কুলের বিশাল এলাকা এবং এর চারপাশে নিহত আর আহত মানুষের পোড়া গন্ধে ভয়ঙ্করে পরিণত হলো ট্রানজিট ক্যাম্প। এই অকস্মাৎ বিস্ফোরণ শুধু মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গণ নয়, গোটা দিনাজপুর শহরকে ভূমিকম্পের মতো কাঁপিয়ে দিল। এখান থেকে ৪০-৫০ মাইল দূরের লোকও বিকট একটি শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড দেখতে পেলেন।

কেমন করে এই বিরাট দুর্ঘটনা সেদিন ঘটেছিলো, তার সঠিক ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রে এবং অনেকের লেখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, অন্যান্য দিনের মতো ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারিতেও বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছিল এবং সেই সব অস্ত্র দুইটি ট্রাকে করে (কারো কারো মতো তিনটি ট্রাকে) মহারাজা স্কুলে আনা হয়েছিল। ট্রাক থেকে অস্ত্র খালাসের কাজ শুরু হয় বিকেল ৪টায়। বাংকার বা অস্ত্রভাণ্ডার থেকে ট্রাকের দূরত্ব ছিলো ১০০ গজ। এই ১০০ গজের মধ্যে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা লাইনে দাঁড়ানো ছিলেন। ট্রাক থেকে অস্ত্র নামিয়ে হাত বদলের মাধ্যমে বাংকারে অস্ত্রগুলো রাখছিলেন। কিন্তু সেদিন হাত বদলের সময় একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে একটি মাইন ফসকে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই বাংকারে মজুত রাখা পুরো অস্ত্রভাণ্ডারও বিস্ফোরিত হয়ে ব্যাপক ধ্বংসলীলা সাধন করে। সেই ভায়াবহ বিস্ফোরণে ক্যাম্পে উপস্থিত কয়েকশ’ বীর মুক্তিযোদ্ধার অকাল মৃত্যু ঘটে।

দুর্ঘটনার সময় সঠিক কতজন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে উপস্থিত ছিলেন তার সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য নেই। বিভিন্ন জনের থেকে জানা গেছে, সকালে রোল কলের সময় ৭৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে উপস্থিত ছিলেন। তারপর অনেকেই ২/১ দিনের ছুটি নিয়ে বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দেখা করত্যে ক্যাম্প ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায় কতজন? তাও জানেন না কেউ। তাই দুর্ঘটনার সময় ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বলা কঠিন।

দুর্ঘটনার পরপরই স্থানীয় জনগণ উদ্ধার কাজে নেমে পড়েন। কিন্তু সে সময় বিদ্যুৎ না থাকায় ঘন অন্ধকারের ভেতর উদ্ধারকাজ চালানো কষ্টকর ছিলো। পরে ভারতীয় মিত্রবাহিনী উদ্ধারকাজে যোগ দেন। গাড়ির লাইট জ্বালিয়ে এবং টর্চ, হ্যাজাক ও লণ্ঠনের আলোয় রাতভর উদ্ধার কাজে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। পরদিন প্রথমে ৮৬ জনের, পরে আরও ২১ জনের লাশ চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে দাফন করা হয় এক সঙ্গে। লাশগুলোর অধিকাংশ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ছিলো। কারো হাত, কারো মাথা জোড়া লাগিয়ে একেকটি লাশের আদল দেয়া হয়েছিল। সবগুলো লাশ মুক্তিযোদ্ধাদের।

উদ্ধারকারীরা দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৪ মণ গলিত, পোড়া, অর্ধ পোড়া, ছিন্ন-বিচ্ছিন, ঝলসানো মাংসের টুকরো উদ্ধার করেছিলেন। এই গলিত, অর্ধ গলিত, পোড়া মাংসও দাফন করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাগণের লাশের সঙ্গে।

স্বাধীন বাংলাদেশে এতবড় ট্র্যাজেডি আর কোথাও হয়নি। একসঙ্গে কয়েকশ’ বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ ঝরে যাওয়ার মতো এতবড় মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ঘটনা অকল্পনীয়। যে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, বাংলার স্বাধীন মাটিকে নিরাপদ করতে সক্রিয় ছিলেন, তাদের এ প্রাণ বিসর্জন বেদনার চেয়েও বেদনাদায়ক।

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারির দুর্ঘটনায় আহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ (পিতা-মাহাতাব উদ্দিন, গ্রাম-বলঞ্চা, থানা-রাণীশংকৈল, জেলা-ঠাকুরগাঁও) স্মৃতিচারণ করে এক পত্রে লিখেছিলেন- ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালন করি রাণীশংকৈল থানার নেকমরদে। এখান থেকে দিনাজপুরে একত্র হওয়ার নির্দেশ পেয়ে আমরা ১৫ সদস্যের একটি গ্রুপ ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি দিনাজপুর মহারাজা স্কুলে গিয়ে হাজির হই এবং ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের কাছে আমাদের হাতিয়ার জমা দিয়ে অবস্থান গ্রহণ করি। স্কুলের মাঝ কক্ষটিতে আমরা মেঝেতে বিছানা করে নেই। আমাদের গ্রুপের কারো থালা, বাটি, গ্লাস ছিলো না। অন্যের থালা, বাটি, গ্লাসে খানা খেয়ে যার যার বিছানায় কুয়ে পড়ি। কয়েক দিন আগের থেকেই আমার জ্বর ও মাথা ব্যথা ছিল। সুতরাং খাওয়ার পর বাইরে যাওয়ার কোন ইচ্ছা হলো না। ৬ জানুয়ারি আমি ও শ্রী সিরেন চন্দ্র মধ্যাহ্নভোজনের পর বিছানায় বসে নিজেদের বাড়ির গল্প করছিলাম। কারণ ৫ জানুয়ারি বুধবার আমার সাথী ও প্রতিবেশী মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল, বিরেন্দ্রনাথ ও আমার এক চাচা ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। আমিও ছুটি চেয়েছিলাম, কিন্তু দিলো না। তাই অসুস্থ শরীরে, দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে সিরেন চন্দ্রের সঙ্গে এক বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। গল্প চলাকালে বিকেল ৫টার দিকে সৈয়দপুর থেকে মাইন ও বিস্ফোরক দ্রব্যবোঝাই দুইটি ট্রাক আসে। এ সময় মাঠে সবাইকে ফলইন হওয়ার জন্য হুইসেল দেয়া হয়। আমি অসুস্থতার কারণে বের না হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। আমার পাশে সিরেন চন্দ্রও শুয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ট্রাক থেকে মাইন নামানো শুরু হলো। ছোট-খাটো বিস্ফোরকগুলো আমাদের পাশের রুমে এবং বড় ধরনের মাইনগুলো একটি গর্তে রাখা হচ্ছিল্। পাশেই একটি মসজিদে তখন আজান শুরু হলো। আজান শেষ হতে না হতেই হঠাৎ একটা বিদ্যুতের চমক এবং প্রকম্পিত বিকট আওয়াজ শুনতে পেলাম। তারপরে কি হলো আমি আর কিছুই বলতে পারি না। পরের দিন সকাল ৯টায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম সদর হাসপাতালের বিছানায়। জানতে পারলাম যে, আমার সাথী সিরেন বেঁচে নেই।

৬ জানুয়ারির দুর্ঘটনায় আহত আরেক মুক্তিযোদ্ধা নবাবগঞ্জ থানার পুঁঠিমারা ইউনিয়নাধীন আঁন্দল গ্রাম নিবাসী আব্দুর রশিদ। তিনি লিখেছেন, আমি ৭নং সেক্টরের খানপুর, মোহনপুর, পার্বতীপুর, ডাঙ্গাপাড়া, হিলি ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধ করি। পরে ফ্রিডম ফাইটার হিসেবে যুদ্ধ করি। আমরা চড়ারহাট আঁন্দল গ্রাম (নবাবগঞ্জ) থেকে ৫/১/৭২ তারিখে হাতিয়ার জমা দেয়ার জন্য দিনাজপুর মহারাজা স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পরদিন ৬/১/৭২ তারিখে বেলা ১১টায় মহারাজা স্কুলে উপস্থিত হই। বেলা ১২টায় হাতিয়ার জমা করি। দুপুরে খাবার খেয়ে বিশ্রাম করি। বিকেলে ভলিবল প্রতিযোগিতা দেখি। খেলা দেখতে দেখতে দেখি, মাইন ভর্তি একটি ট্রাক স্কুল মাঠে প্রবেশ করলো। ঠিক মাগরিবের আজান হলো, এ সময় সুবেদার সাহেব বাঁশিতে ফুঁ দিলেন। আমরা তিন লাইনে ফলইন হলাম। সুবেদার লাইন থেকে কিছু ছেলেকে মাইন নামানোর আদেশ দিলেন। ৫-৬ জন ছেলে মাইন নামাচ্ছিলো। ট্রাকের ওপর থেকে নিচে যে ছেলেকে ধরতে হয়, সে সাবধান না থাকায় একটি মাইন হাত ফসকে মাটিতে পড়ে যায়। আর তখুনি বিদ্যুতের চমকে একসঙ্গে সব অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটে। আমরা লাইন থেকে কে কোন দিকে বিচ্ছিন্ন হলাম, কিছুই বলতে পারি না। কতোদিন পর আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিলো জানি না। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর দেখি, একখানা কম্বল দিয়ে আমার পা থেকে গলা পর্যন্ত ঢাকা। আমার হাতে স্যালাইন চলছে। জ্ঞান ফেরার ৩-৪ দিন পর নার্স যখন আমার কম্বলখানা বদল করতে লাগলো, তখনই আমি জানলাম যে আমার বাঁ পা চিরতরে উড়ে গেছে। নিজের পা না দেখে আবার জ্ঞান হারালাম।

দিনাজপুরের এ ট্র্যাজেডিতে অনেকেই অনুমান করেন যে, সেদিন প্রায় ৪শ’ থেকে ৫শ’ মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছিলো। অধিকাংশই ছিলেন দিনাজপুর শহরের বাইরের। আহতদের তুলনায় মৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি ছিলো। এত বড় ট্র্যাজেডির ঘটনা সাধারণ মানুষ প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। এ দিবসটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের কোথাও, এমন কি দিনাজপুরেও কোন ধরনের কর্মসূচি নেয়া হতো না। এমনকি মহারাজা স্কুলেও কর্মসূচি থাকতো না শোকাবহ দিবসটিকে কেন্দ্র করে।

ট্র্যাজেডির প্রায় ১৬ বছর পর ১৯৮৮ সালে দিনাজপুরের ৩টি ক্ষুদ্র সংগঠন অমৃত সাহিত্য গোষ্ঠী, হোমিও মেডিকেল ছাত্র ঐক্য পরিষদ-দিনাজপুর শাখা এবং পাটুয়াপাড়া জাগরণী ক্লাব প্রথমবারের মতো ৬ জানুয়ারিতে ‘ট্র্যাজেডি দিবস’ পালন করে। ওই বছর পত্র-পত্রিকায়ও ৬ জানুয়ারির ওপর প্রবন্ধ-নিবন্ধ বের হয়। ফলে দিনাজপুরের এ ট্র্যাজেডি সম্পর্কে দিনাজপুরবাসী নতুন করে জানতে পারেন। দেশবাসীও জানতে পারেন। এরপর থেকে প্রতি বছরই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে।

চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের গণসমাধি হওয়ার পর স্থানীয় জনগণ সমাধির সামনে একটি ছোট্ট শহীদ মিনার তৈরি করেন। সামান্য কিছু মানুষ প্রতি বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ও ৬ জানুয়ারিতে সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে থাকেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের গণসমাধি সৌধে বেঙ্গল রেজিমেন্ট একটি স্মৃতিফলক দিয়েছে। কিন্তু ১৯৭২ সালের এতবড় ট্র্যাজেডির ঘটনায় জাতীয় পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ না থাকা হতাশাজনক ও পীড়াদায়ক!

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার আগে দিনাজপুরে আয়োজিত এক জনসভায় মহারাজা স্কুলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদের বর্তমান হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি উদ্যোগী হয়ে সম্প্রতি স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এ কাজ এগিয়ে চলছে।

[লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক]

a.azadjewel@gmail.com

সোমবার, ০৬ জানুয়ারী ২০২০ , ২৩ পৌষ ১৪২৬, ৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

মুক্তিযুদ্ধোত্তর দিনাজপুর ট্র্যাজেডি

আজহারুল আজাদ জুয়েল

১৬ ডিসেম্বর একাত্তর। বাঙালির দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ জয়ের দিন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই দিন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল বীর বাঙালি জাতির কাছে। পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল এই দিনে। নতুন পতাকা, নতুন দেশ নিয়ে বীরোচিত অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের।

যুদ্ধ জয় শেষে ঘরে ফেরার পালা। ঘরে ফিরতে থাকে বাঙালি শরণার্থীরা। ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিতে থাকে বাংলার বীর সেনা মুক্তিযোদ্ধারা। ঘরে ফেরার প্রস্তুতি হিসেবে তারা সমবেত হতে থাকেন বিভিন্ন ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানেও অনেক কাজ। ঘরে ফিরতে চাইলেও সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফেরা যাচ্ছিল না।

বিশেষ করে যুদ্ধ জয়ের সঙ্গে সঙ্গেই সেদিন সকল মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে ঘরে ফেরা সম্ভব হয়নি। কারণ শত্রু বাহিনীর ফেলে যাওয়া, পুঁতে রাখা অস্ত্র, গোলা, বোমা, বারুদ তখনো অনেকের প্রাণ সংহারের কারণ হয়ে উঠছিল। বিভিন্ন স্থানে, যেখানে-সেখানে ফেলে যাওয়া, পুঁতে রাখা সেসব বিপজ্জনক মারণাস্ত্র যতক্ষণ নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়া না যায়, ততক্ষণ মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে ফেরা সম্ভব নয়। সে কারণে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা হয় ট্রানজিট ক্যাম্প।

মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত ৬ ও ৭নং সেক্টরের আওতায় দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়ের যে সব মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাদের নিয়ে ট্রানজিট ক্যাম্প করা হয় দিনাজপুর শহরের পূর্বপ্রান্তের মহারাজা গীরিজানাথ হাই স্কুল প্রাঙ্গণে। বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় যুদ্ধ করেছেন এমন প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এই ট্রানজিট ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। ক্যাম্পের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন লে. কর্নেল শাহরিয়ার।

ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বৃহত্তর দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদারদের পুঁতে রাখা, ফেলে রাখা, ছেড়ে যাওয়া মাইন, বোমা, অন্যান্য অস্ত্র উদ্ধার করা হতো। প্রতিদিনের উদ্ধারকৃত অস্ত্র ট্রানজিট ক্যাম্পের বিরাট বাংকারে রেখে দেয়া হতো। মহারাজা স্কুলের বিরাট মাঠের দক্ষিণ দিকে (বর্তমানে যেখানে মসজিদ রয়েছে তার পাশেই) উদ্ধারকৃত এইসব অস্ত্রের বাংকার ছিলো। সেখানে থাকত উদ্ধার করা এন্টি ট্যাংক মাইন, এন্টি পারসোনাল মাইন, জ্যাম্পিং মাইন, মর্টারের ২ ও ৩ ইঞ্চি শেল, গ্রেনেড ইত্যাদি। স্বাধীন দেশের মাটি নিরাপদ করতে মুক্তিযোদ্ধারা উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রতিদিনের উদ্ধার কাজ চালাতে থাকেন। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয় কয়েক দিনে। কিন্তু বিজয়ের মাত্র ২০ দিন পর ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সব আনন্দ উদ্দীপনা নিঃশেষ হয়ে যায় এক অকল্পনীয় দুর্ঘটনায়।

৬ জানুয়ারি ১৯৭২, সন্ধ্যা। সূর্য তখন অস্তগামী। আকাশে লাল আভা। ঠিক এ সময় অকস্মাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো মহারাজা স্কুল। স্কুলের দ্বিতল ভবন গুঁড়িয়ে গেলো। মাঠের যে স্থানটিতে অস্ত্রভাণ্ডার ছিলো, সেটি বিরাট খালে পরিণত হলো। সেই খালে উঠে এলো পানি। আর গোটা আকাশ, গোটা মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গণ অন্ধকারে ঢেকে গেলো। স্কুলের বিশাল এলাকা এবং এর চারপাশে নিহত আর আহত মানুষের পোড়া গন্ধে ভয়ঙ্করে পরিণত হলো ট্রানজিট ক্যাম্প। এই অকস্মাৎ বিস্ফোরণ শুধু মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গণ নয়, গোটা দিনাজপুর শহরকে ভূমিকম্পের মতো কাঁপিয়ে দিল। এখান থেকে ৪০-৫০ মাইল দূরের লোকও বিকট একটি শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড দেখতে পেলেন।

কেমন করে এই বিরাট দুর্ঘটনা সেদিন ঘটেছিলো, তার সঠিক ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রে এবং অনেকের লেখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, অন্যান্য দিনের মতো ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারিতেও বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছিল এবং সেই সব অস্ত্র দুইটি ট্রাকে করে (কারো কারো মতো তিনটি ট্রাকে) মহারাজা স্কুলে আনা হয়েছিল। ট্রাক থেকে অস্ত্র খালাসের কাজ শুরু হয় বিকেল ৪টায়। বাংকার বা অস্ত্রভাণ্ডার থেকে ট্রাকের দূরত্ব ছিলো ১০০ গজ। এই ১০০ গজের মধ্যে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা লাইনে দাঁড়ানো ছিলেন। ট্রাক থেকে অস্ত্র নামিয়ে হাত বদলের মাধ্যমে বাংকারে অস্ত্রগুলো রাখছিলেন। কিন্তু সেদিন হাত বদলের সময় একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে একটি মাইন ফসকে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই বাংকারে মজুত রাখা পুরো অস্ত্রভাণ্ডারও বিস্ফোরিত হয়ে ব্যাপক ধ্বংসলীলা সাধন করে। সেই ভায়াবহ বিস্ফোরণে ক্যাম্পে উপস্থিত কয়েকশ’ বীর মুক্তিযোদ্ধার অকাল মৃত্যু ঘটে।

দুর্ঘটনার সময় সঠিক কতজন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে উপস্থিত ছিলেন তার সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য নেই। বিভিন্ন জনের থেকে জানা গেছে, সকালে রোল কলের সময় ৭৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে উপস্থিত ছিলেন। তারপর অনেকেই ২/১ দিনের ছুটি নিয়ে বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দেখা করত্যে ক্যাম্প ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায় কতজন? তাও জানেন না কেউ। তাই দুর্ঘটনার সময় ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বলা কঠিন।

দুর্ঘটনার পরপরই স্থানীয় জনগণ উদ্ধার কাজে নেমে পড়েন। কিন্তু সে সময় বিদ্যুৎ না থাকায় ঘন অন্ধকারের ভেতর উদ্ধারকাজ চালানো কষ্টকর ছিলো। পরে ভারতীয় মিত্রবাহিনী উদ্ধারকাজে যোগ দেন। গাড়ির লাইট জ্বালিয়ে এবং টর্চ, হ্যাজাক ও লণ্ঠনের আলোয় রাতভর উদ্ধার কাজে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। পরদিন প্রথমে ৮৬ জনের, পরে আরও ২১ জনের লাশ চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে দাফন করা হয় এক সঙ্গে। লাশগুলোর অধিকাংশ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ছিলো। কারো হাত, কারো মাথা জোড়া লাগিয়ে একেকটি লাশের আদল দেয়া হয়েছিল। সবগুলো লাশ মুক্তিযোদ্ধাদের।

উদ্ধারকারীরা দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৪ মণ গলিত, পোড়া, অর্ধ পোড়া, ছিন্ন-বিচ্ছিন, ঝলসানো মাংসের টুকরো উদ্ধার করেছিলেন। এই গলিত, অর্ধ গলিত, পোড়া মাংসও দাফন করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাগণের লাশের সঙ্গে।

স্বাধীন বাংলাদেশে এতবড় ট্র্যাজেডি আর কোথাও হয়নি। একসঙ্গে কয়েকশ’ বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ ঝরে যাওয়ার মতো এতবড় মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ঘটনা অকল্পনীয়। যে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, বাংলার স্বাধীন মাটিকে নিরাপদ করতে সক্রিয় ছিলেন, তাদের এ প্রাণ বিসর্জন বেদনার চেয়েও বেদনাদায়ক।

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারির দুর্ঘটনায় আহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ (পিতা-মাহাতাব উদ্দিন, গ্রাম-বলঞ্চা, থানা-রাণীশংকৈল, জেলা-ঠাকুরগাঁও) স্মৃতিচারণ করে এক পত্রে লিখেছিলেন- ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালন করি রাণীশংকৈল থানার নেকমরদে। এখান থেকে দিনাজপুরে একত্র হওয়ার নির্দেশ পেয়ে আমরা ১৫ সদস্যের একটি গ্রুপ ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি দিনাজপুর মহারাজা স্কুলে গিয়ে হাজির হই এবং ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের কাছে আমাদের হাতিয়ার জমা দিয়ে অবস্থান গ্রহণ করি। স্কুলের মাঝ কক্ষটিতে আমরা মেঝেতে বিছানা করে নেই। আমাদের গ্রুপের কারো থালা, বাটি, গ্লাস ছিলো না। অন্যের থালা, বাটি, গ্লাসে খানা খেয়ে যার যার বিছানায় কুয়ে পড়ি। কয়েক দিন আগের থেকেই আমার জ্বর ও মাথা ব্যথা ছিল। সুতরাং খাওয়ার পর বাইরে যাওয়ার কোন ইচ্ছা হলো না। ৬ জানুয়ারি আমি ও শ্রী সিরেন চন্দ্র মধ্যাহ্নভোজনের পর বিছানায় বসে নিজেদের বাড়ির গল্প করছিলাম। কারণ ৫ জানুয়ারি বুধবার আমার সাথী ও প্রতিবেশী মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল, বিরেন্দ্রনাথ ও আমার এক চাচা ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। আমিও ছুটি চেয়েছিলাম, কিন্তু দিলো না। তাই অসুস্থ শরীরে, দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে সিরেন চন্দ্রের সঙ্গে এক বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। গল্প চলাকালে বিকেল ৫টার দিকে সৈয়দপুর থেকে মাইন ও বিস্ফোরক দ্রব্যবোঝাই দুইটি ট্রাক আসে। এ সময় মাঠে সবাইকে ফলইন হওয়ার জন্য হুইসেল দেয়া হয়। আমি অসুস্থতার কারণে বের না হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। আমার পাশে সিরেন চন্দ্রও শুয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা ট্রাক থেকে মাইন নামানো শুরু হলো। ছোট-খাটো বিস্ফোরকগুলো আমাদের পাশের রুমে এবং বড় ধরনের মাইনগুলো একটি গর্তে রাখা হচ্ছিল্। পাশেই একটি মসজিদে তখন আজান শুরু হলো। আজান শেষ হতে না হতেই হঠাৎ একটা বিদ্যুতের চমক এবং প্রকম্পিত বিকট আওয়াজ শুনতে পেলাম। তারপরে কি হলো আমি আর কিছুই বলতে পারি না। পরের দিন সকাল ৯টায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম সদর হাসপাতালের বিছানায়। জানতে পারলাম যে, আমার সাথী সিরেন বেঁচে নেই।

৬ জানুয়ারির দুর্ঘটনায় আহত আরেক মুক্তিযোদ্ধা নবাবগঞ্জ থানার পুঁঠিমারা ইউনিয়নাধীন আঁন্দল গ্রাম নিবাসী আব্দুর রশিদ। তিনি লিখেছেন, আমি ৭নং সেক্টরের খানপুর, মোহনপুর, পার্বতীপুর, ডাঙ্গাপাড়া, হিলি ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধ করি। পরে ফ্রিডম ফাইটার হিসেবে যুদ্ধ করি। আমরা চড়ারহাট আঁন্দল গ্রাম (নবাবগঞ্জ) থেকে ৫/১/৭২ তারিখে হাতিয়ার জমা দেয়ার জন্য দিনাজপুর মহারাজা স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পরদিন ৬/১/৭২ তারিখে বেলা ১১টায় মহারাজা স্কুলে উপস্থিত হই। বেলা ১২টায় হাতিয়ার জমা করি। দুপুরে খাবার খেয়ে বিশ্রাম করি। বিকেলে ভলিবল প্রতিযোগিতা দেখি। খেলা দেখতে দেখতে দেখি, মাইন ভর্তি একটি ট্রাক স্কুল মাঠে প্রবেশ করলো। ঠিক মাগরিবের আজান হলো, এ সময় সুবেদার সাহেব বাঁশিতে ফুঁ দিলেন। আমরা তিন লাইনে ফলইন হলাম। সুবেদার লাইন থেকে কিছু ছেলেকে মাইন নামানোর আদেশ দিলেন। ৫-৬ জন ছেলে মাইন নামাচ্ছিলো। ট্রাকের ওপর থেকে নিচে যে ছেলেকে ধরতে হয়, সে সাবধান না থাকায় একটি মাইন হাত ফসকে মাটিতে পড়ে যায়। আর তখুনি বিদ্যুতের চমকে একসঙ্গে সব অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটে। আমরা লাইন থেকে কে কোন দিকে বিচ্ছিন্ন হলাম, কিছুই বলতে পারি না। কতোদিন পর আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিলো জানি না। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর দেখি, একখানা কম্বল দিয়ে আমার পা থেকে গলা পর্যন্ত ঢাকা। আমার হাতে স্যালাইন চলছে। জ্ঞান ফেরার ৩-৪ দিন পর নার্স যখন আমার কম্বলখানা বদল করতে লাগলো, তখনই আমি জানলাম যে আমার বাঁ পা চিরতরে উড়ে গেছে। নিজের পা না দেখে আবার জ্ঞান হারালাম।

দিনাজপুরের এ ট্র্যাজেডিতে অনেকেই অনুমান করেন যে, সেদিন প্রায় ৪শ’ থেকে ৫শ’ মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছিলো। অধিকাংশই ছিলেন দিনাজপুর শহরের বাইরের। আহতদের তুলনায় মৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি ছিলো। এত বড় ট্র্যাজেডির ঘটনা সাধারণ মানুষ প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। এ দিবসটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের কোথাও, এমন কি দিনাজপুরেও কোন ধরনের কর্মসূচি নেয়া হতো না। এমনকি মহারাজা স্কুলেও কর্মসূচি থাকতো না শোকাবহ দিবসটিকে কেন্দ্র করে।

ট্র্যাজেডির প্রায় ১৬ বছর পর ১৯৮৮ সালে দিনাজপুরের ৩টি ক্ষুদ্র সংগঠন অমৃত সাহিত্য গোষ্ঠী, হোমিও মেডিকেল ছাত্র ঐক্য পরিষদ-দিনাজপুর শাখা এবং পাটুয়াপাড়া জাগরণী ক্লাব প্রথমবারের মতো ৬ জানুয়ারিতে ‘ট্র্যাজেডি দিবস’ পালন করে। ওই বছর পত্র-পত্রিকায়ও ৬ জানুয়ারির ওপর প্রবন্ধ-নিবন্ধ বের হয়। ফলে দিনাজপুরের এ ট্র্যাজেডি সম্পর্কে দিনাজপুরবাসী নতুন করে জানতে পারেন। দেশবাসীও জানতে পারেন। এরপর থেকে প্রতি বছরই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে।

চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের গণসমাধি হওয়ার পর স্থানীয় জনগণ সমাধির সামনে একটি ছোট্ট শহীদ মিনার তৈরি করেন। সামান্য কিছু মানুষ প্রতি বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ও ৬ জানুয়ারিতে সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে থাকেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের গণসমাধি সৌধে বেঙ্গল রেজিমেন্ট একটি স্মৃতিফলক দিয়েছে। কিন্তু ১৯৭২ সালের এতবড় ট্র্যাজেডির ঘটনায় জাতীয় পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ না থাকা হতাশাজনক ও পীড়াদায়ক!

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার আগে দিনাজপুরে আয়োজিত এক জনসভায় মহারাজা স্কুলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদের বর্তমান হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি উদ্যোগী হয়ে সম্প্রতি স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এ কাজ এগিয়ে চলছে।

[লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক]

a.azadjewel@gmail.com