ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল পেতে উদ্যোক্তা উন্নয়ন জরুরি

এমএ খালেক

বংশীয় পরিবারে জন্ম নেয়া ফারখুন্দা জেবিন খান, যিনি ‘সংগীতা আপা’ নামেই বেশি পরিচিত। উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে একটি বিদেশি কোম্পানিতে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিলেন। সেখানে কর্ম পরিবেশ এবং আর্থিক সুবিধাদিও ছিল বেশ অনুকূল। কিন্তু তারপরও মন টিকছিল না। সব সময়ই নিজে কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। এভাবেই প্রায় ২০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। এক সময় চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। আত্মীয়-স্বজন এবং শুভাকাক্সিক্ষদের অনেকেই তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। কিন্তু সংগীতা নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। নিজ উদ্যোগে শুরু করেন বিউটি পারলার এবং রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়। প্রথমে কিছুটা অসুবিধা হলেও এখন তিনি নিজেকে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

নারী উদ্যোক্তার দেশের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন। বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। সামান্য সহযোগিতা পেলেই যে কোন কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারেন তারা। তিনি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করেন তারা নিজেরাই যাতে পরবর্তীতে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সে ব্যাপারে সহায়তা করা হয়। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। এ অবস্থার সুফল কাজে লাগাতে হলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি হাতকেই কর্মীর হাতিয়ারে পরিণত করতে হবে। অন্যথায় আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল ভোগ করতে পারব না। সরকার ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল কাজে লাগানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সবাই মিলে সরকারের এ উদ্যোগকে আরও বেগবান করতে হবে। নারীদের যদি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলে তারা আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে। আর নারীর অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভর এবং সাবলম্বী করে তোলা ব্যতীত তাদের আত্মস্থ অফুরন্ত শক্তির বিকাশ ও সামাজিক-পারিবারিক অবস্থার উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই নারীদের সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য তাদের আত্মনির্ভর করে তুলতে হবে।

আমাদের দেশে অনেকের কাছেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বিষয়টি এখনো পরিস্কার নয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশির বয়স যখন ১৫ বছর থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে হয় সেই অবস্থাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। এই অবস্থায় একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। কারণ এই অবস্থায় দেশের বেশিরভাগ মানুষই কর্মক্ষম থাকে এবং তারা কিছু না কিছু একটা করতে চায়। যে দেশ এ অবস্থাকে কাজে লাগানোর জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে তারাই সফলতা অর্জন করতে পারে। একটি দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা ৩০ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একটি জাতির জীবনে একবারই আসে। আবার কারো কারো মতে, হাজার বছরে একবার এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা অতিক্রান্ত হলে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও স্থিমিত হয়ে পড়ে। এর উদাহরণ হচ্ছে জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বস্থপ্রায় দেশ জাপান ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করে। কিন্তু কয়েক দশক আগে তারা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসে। ফলে জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গাতি স্তিমিত হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যেই জাপান চীনের নিকট বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের ৪৪ বছরের আধিপত্য হারিয়ে দ্বিতীয় স্থান থেকে তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে। জাপানে এখন বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা বেশি। চীনের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা সমাপ্ত হবার পথে। প্রতিবেশি দেশ ভারতের অবস্থাও চীনের মতোই। বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা ২০৩০/২০৩৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে চলমান অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করতে হবে।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য সরকারকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। আশার কথা এই যে, বর্তমান সরকার ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর ব্যাপারে সচেষ্ট রয়েছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ বা সম্ভাবনাকে পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগাতে হলে নারী পুরুষ প্রত্যেককেই যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশ জনসংখ্যা বহুল একটি দেশ। জনসংখ্যা অর্থনীতির এমন এক উপকরণ যা পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো গেলে জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদে পরিণত হতে পারে। আবার অপরিকল্পিত ব্যবহারের কারণে জনসংখ্যা একটি জাতির জন্য ‘আপদ’ হিসেবে গণ্য হতে পারে। কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে কর্মহীন রেখে কখনোই একটি জাতি অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করতে পারে না। এই সত্যটি উপলব্ধি করেই বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি সক্ষম নাগরিকের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, সরকারি চাকরির মাধ্যমে দেশের বেকার জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। এ জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হতে পারে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।

অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য উচ্চ আয়ের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উদ্যোক্তা উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। সরকার এই সত্যটি উপলব্ধি করেই উদ্যোক্তা উন্নয়নের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। চলতি অর্থ বছরের জন্য জাতীয় বাজেটে প্রথমবারের মতো উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ‘স্টার্ট আপ বিজনেস’ নামে একটি নতুন খাত সৃষ্টি করে তাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদের বাছাই করে বিশেষ প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) সারা দেশের সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদের বাছাই করে ট্রেডভিত্তিক নিবিড় প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে।

সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় এসএমই শিল্পোদ্যোক্তাদের বিনা জামানতে ব্যাংক ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। কুটির এবং মাইক্রো শিল্পকে (এসএমই) সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (সিএমএসএমই)। ইতিপূর্বে কুটির শিল্প এবং মাইক্রো শিল্পকে এসএমই শিল্প হিসেবে গণ্য করা হতো না। ফলে এই দুটি খাতের উদ্যোক্তারা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সহায়তা পেতেন না। এখন কুটির শিল্প ও মাইক্রো শিল্প মালিকগণও এসএমই খাতের জন্য দেয়া ঋণ সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এতে আগামীতে বাংলাদেশের শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় বিপ্লব সাধিত হবে। কুটির ও মাইক্রো শিল্পকে এসএমই শিল্পের মর্যাদা দেয়া এবং বিনা জামানতে এই খাতে ব্যাংক ঋণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করার ফলে দেশের শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার হবে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাগণ এতদিন জামানত প্রদান করতে না পারার কারণে প্রায়ই ব্যাংক ঋণ লাভে ব্যর্থ হতেন। এখন আর সেই সীমাবদ্ধতা থাকবে না। এখন আমাদের দায়িত্ব হবে সরকারের এই মহতী উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ ত্বরান্বিত করা। তবেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল আমরা ভোগ করতে পারব।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২০ , ২৬ পৌষ ১৪২৬, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল পেতে উদ্যোক্তা উন্নয়ন জরুরি

এমএ খালেক

বংশীয় পরিবারে জন্ম নেয়া ফারখুন্দা জেবিন খান, যিনি ‘সংগীতা আপা’ নামেই বেশি পরিচিত। উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে একটি বিদেশি কোম্পানিতে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিলেন। সেখানে কর্ম পরিবেশ এবং আর্থিক সুবিধাদিও ছিল বেশ অনুকূল। কিন্তু তারপরও মন টিকছিল না। সব সময়ই নিজে কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। এভাবেই প্রায় ২০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। এক সময় চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। আত্মীয়-স্বজন এবং শুভাকাক্সিক্ষদের অনেকেই তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। কিন্তু সংগীতা নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। নিজ উদ্যোগে শুরু করেন বিউটি পারলার এবং রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়। প্রথমে কিছুটা অসুবিধা হলেও এখন তিনি নিজেকে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

নারী উদ্যোক্তার দেশের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন। বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। সামান্য সহযোগিতা পেলেই যে কোন কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারেন তারা। তিনি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করেন তারা নিজেরাই যাতে পরবর্তীতে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সে ব্যাপারে সহায়তা করা হয়। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। এ অবস্থার সুফল কাজে লাগাতে হলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি হাতকেই কর্মীর হাতিয়ারে পরিণত করতে হবে। অন্যথায় আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল ভোগ করতে পারব না। সরকার ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল কাজে লাগানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সবাই মিলে সরকারের এ উদ্যোগকে আরও বেগবান করতে হবে। নারীদের যদি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলে তারা আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে। আর নারীর অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভর এবং সাবলম্বী করে তোলা ব্যতীত তাদের আত্মস্থ অফুরন্ত শক্তির বিকাশ ও সামাজিক-পারিবারিক অবস্থার উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই নারীদের সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য তাদের আত্মনির্ভর করে তুলতে হবে।

আমাদের দেশে অনেকের কাছেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বিষয়টি এখনো পরিস্কার নয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশির বয়স যখন ১৫ বছর থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে হয় সেই অবস্থাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। এই অবস্থায় একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। কারণ এই অবস্থায় দেশের বেশিরভাগ মানুষই কর্মক্ষম থাকে এবং তারা কিছু না কিছু একটা করতে চায়। যে দেশ এ অবস্থাকে কাজে লাগানোর জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে তারাই সফলতা অর্জন করতে পারে। একটি দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা ৩০ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একটি জাতির জীবনে একবারই আসে। আবার কারো কারো মতে, হাজার বছরে একবার এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা অতিক্রান্ত হলে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও স্থিমিত হয়ে পড়ে। এর উদাহরণ হচ্ছে জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বস্থপ্রায় দেশ জাপান ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করে। কিন্তু কয়েক দশক আগে তারা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসে। ফলে জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গাতি স্তিমিত হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যেই জাপান চীনের নিকট বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের ৪৪ বছরের আধিপত্য হারিয়ে দ্বিতীয় স্থান থেকে তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে। জাপানে এখন বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা বেশি। চীনের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা সমাপ্ত হবার পথে। প্রতিবেশি দেশ ভারতের অবস্থাও চীনের মতোই। বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা ২০৩০/২০৩৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে চলমান অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করতে হবে।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য সরকারকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। আশার কথা এই যে, বর্তমান সরকার ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর ব্যাপারে সচেষ্ট রয়েছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ বা সম্ভাবনাকে পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগাতে হলে নারী পুরুষ প্রত্যেককেই যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশ জনসংখ্যা বহুল একটি দেশ। জনসংখ্যা অর্থনীতির এমন এক উপকরণ যা পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো গেলে জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদে পরিণত হতে পারে। আবার অপরিকল্পিত ব্যবহারের কারণে জনসংখ্যা একটি জাতির জন্য ‘আপদ’ হিসেবে গণ্য হতে পারে। কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে কর্মহীন রেখে কখনোই একটি জাতি অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করতে পারে না। এই সত্যটি উপলব্ধি করেই বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি সক্ষম নাগরিকের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, সরকারি চাকরির মাধ্যমে দেশের বেকার জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। এ জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হতে পারে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।

অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য উচ্চ আয়ের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উদ্যোক্তা উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। সরকার এই সত্যটি উপলব্ধি করেই উদ্যোক্তা উন্নয়নের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। চলতি অর্থ বছরের জন্য জাতীয় বাজেটে প্রথমবারের মতো উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ‘স্টার্ট আপ বিজনেস’ নামে একটি নতুন খাত সৃষ্টি করে তাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদের বাছাই করে বিশেষ প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) সারা দেশের সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদের বাছাই করে ট্রেডভিত্তিক নিবিড় প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে।

সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় এসএমই শিল্পোদ্যোক্তাদের বিনা জামানতে ব্যাংক ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। কুটির এবং মাইক্রো শিল্পকে (এসএমই) সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (সিএমএসএমই)। ইতিপূর্বে কুটির শিল্প এবং মাইক্রো শিল্পকে এসএমই শিল্প হিসেবে গণ্য করা হতো না। ফলে এই দুটি খাতের উদ্যোক্তারা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সহায়তা পেতেন না। এখন কুটির শিল্প ও মাইক্রো শিল্প মালিকগণও এসএমই খাতের জন্য দেয়া ঋণ সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এতে আগামীতে বাংলাদেশের শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় বিপ্লব সাধিত হবে। কুটির ও মাইক্রো শিল্পকে এসএমই শিল্পের মর্যাদা দেয়া এবং বিনা জামানতে এই খাতে ব্যাংক ঋণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করার ফলে দেশের শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার হবে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাগণ এতদিন জামানত প্রদান করতে না পারার কারণে প্রায়ই ব্যাংক ঋণ লাভে ব্যর্থ হতেন। এখন আর সেই সীমাবদ্ধতা থাকবে না। এখন আমাদের দায়িত্ব হবে সরকারের এই মহতী উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ ত্বরান্বিত করা। তবেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল আমরা ভোগ করতে পারব।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)