১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ

আজকের এ শুভলগ্নে আমি সর্বপ্রথম আমার দেশের সংগ্রামী কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সেই বীর শহীদদের স্মরণ করছি, যারা গত ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আমার জীবনের স্বাদ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার সোনার বাংলা আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযাদ্ধো ও জনতার উদ্দেশে আমি সালাম জানাই। তোমরা আমার সালাম নাও।

আমার বাংলায় আজ এক বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। আপনারা জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন, ইয়াহিয়ার কারাগারে আমি প্রতিমুহূর্তে প্রতীক্ষা করেছি, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতও ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যে মুক্ত হবে এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তবে এই মুক্তির জন্য যে মূল্য দিতে হলো তা কল্পনারও অতীত। আমার বিশ্বাস পৃথিবীর ইতিহাসে কোন দেশের মুক্তি সংগ্রামে এত লোকের প্রাণহানির নজির নাই। আমার দেশের নিরীহ মানুষদের হত্যা করে তারা কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছে, আমার মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করে তারা জঘন্য বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে। সোনার বাংলায় অসংখ্য গ্রাম পুড়িয়ে তারা ছাড়খার করে দিয়েছে।

‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’ কিন্তু আজ আর কবিগুরুর সে কথা বাংলার মানুষের বেলায় খাটে না। বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন কাজ তারা করেছে যার নজির ইতিহাসে নাই। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে তারা বীরের জাতি, তারা নিজেদের অধিকার অর্জন করে মানুষের মতো বাঁচতে জানে।

আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি, যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, আমাদের সাধারণ মানুষ আশ্রয় না পায়, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে-পূর্ণ হবে না। আমাদের তাই এখন অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। সেগুলো মেরামত করতে হবে। আপনারা নিজেরাই সেইসব রাস্ত-ঘাট মেরামত করতে শুরু করে দিন। যার যা কাজ ঠিকমতো করে যান। কর্মচারীদের বলছি আপনারা ঘুষ খাবেন না। এদেশে আর কোন দুর্নীতি চলতে দেয়া যাবে না। প্রায় চার লাখ বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানে আছে। আমাদের তাদের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। তোমরা বাংলায় যারা কথা বল না, তারা এখন থেকে বাংলার মানুষ হও, বাঙালিদের হাত দিও না, তারাও আমার ভাই, বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে চাই; বাঙালি শুধু স্বাধীনতার জন্যই আত্মত্যাগ করতে পারে না, তারা শান্তিতেও বসবাস করতে পারে। কিন্তু ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যারা সহায়তা করেছে, যেসব লোক পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্থন করেছে, আমাদের হত্যা করতে সাহায্য করেছে তাদের ক্ষমা করা হবে না। যথা সময়ে সঠিক বিচারের মাধ্যমে তাদের শাস্তি দেয়া হবে।

আপনারা জানেন, আমার বিরুদ্ধে একটি মামলা দাঁড় করানো হয়েছিল এবং অনেকেই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে, আমি তাদের জানি। আপনারা আরও জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার জেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান, আমি বাঙালি, বাঙালিরা একবার মাত্রই মরে। তাই বলেছি ক্ষমা চাই না। তোমরা আমাকে মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। আমি ঠিক করেছিলাম ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় বলব, ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।’

মার্চের সেই রাতে আমাকে ছেড়ে যাবার সময় আমার সহকর্মীরা আমাকে চলে যেতে অনুরোধ করেন। আমি তখন তাদের বলেছিলাম, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিপদের মুখে রেখে আমি যাব না। মরতে হলে আমি এখানেই মরব। তবু মাথানত করব না। সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনসহ অন্যরা তা শুনে কান্না করেছিলেন। আমি তাদের শুধু বলেছিলাম তোমরা নির্দেশমতো সংগ্রাম চালিও। তারা সে ওয়াদা পালন করেছে।

বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন, কিন্তু আজ আমাদের সামনে অসংখ্য সমস্যা আছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। বিধ্বস্ত বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলুন। নিজেরা সবাই রাস্তা তৈরি করতে শুরু করে দিন। যার যার কাজ করে যান। বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে হবে। একটি মানুষকেও আর না খেয়ে মরতে দেয়া যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা আপনারা অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করেছেন। অসংখ্য বাঙালি মা-বোনদের অসম্মান করেছেন। তবুও আমি চাই আপনারা ভালো থাকুন।

আমি আজ বক্তৃতা দিতে পারব না। ওরা আমার লাখো লাখো মানুষকে হত্যা করেছে। এমন কোনো গ্রাম নাই যেখানে ওরা আগুন দেয় নাই, যেখানে মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করে নাই। আজ বহু ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবীকে ও সহকর্মীকে আমি দেখছি না। এত বেসামরিক লোককে হত্যার নজির নাই বিশ্বে। প্রথম মহাযুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এত লোক মরে নাই। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্র আর পাকিস্তান চতুর্থ। প্রথম ইন্দোনেশিয়া ও তৃতীয় ভারত। অথচ সেই রাষ্ট্রের মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী। তবে দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশ হবে একটি আদর্শ রাষ্ট্র। আর তার ভিত্তি কোন ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাকে জানাই আমার শ্রদ্ধা। তিনি প-িত জহুরলাল নেহরুর কন্যা, প-িত মতিলাল নেহরুর নাতনী। তার রক্তে মিশে রয়েছে রাজনীতি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সব রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। আমার সঙ্গে দিল্লিতে শ্রীমতি গান্ধীর আলাপ হয়েছে। তার সঙ্গে কথাও হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে।

আমি ফিরে আসার আগে ভুট্টো সাহেব অনুরোধ করেছেন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের শিথিলতা রাখা যায় কিনা। আমি তখন বলেছিলাম, আমি মানুষের কাছে না ফিরে যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারব না। আজ আমি বলতে চাই, ভুট্টো সাহেব আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সঙ্গে আর না। মরে যাবে তবু বাঙালি আর স্বাধীনতা হারাতে পারবে না। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে।

গত ২৫ মার্চ থেকে দীর্ঘ ৯ মাস বর্বর হানাদারবাহিনী এদেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তারা আমার লাখো লাখো মানুষকে হত্যা করেছে। মা-বোনের সম্মানহানি ঘটিয়েছে। বিশ্ব এসব ঘটনার সামান্য কিছু জানে মাত্র। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এই তদন্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে আমি বিশ্বের সব মুক্ত দেশকে অনুরোধ জানাই, আপনারা অবিলম্বে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন এবং সত্বর বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য করে নেয়ার জন্য সহায্য করুন। ‘জয় বাংলা’।

শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২০ , ২৬ পৌষ ১৪২৬, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ

image

আজকের এ শুভলগ্নে আমি সর্বপ্রথম আমার দেশের সংগ্রামী কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সেই বীর শহীদদের স্মরণ করছি, যারা গত ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আমার জীবনের স্বাদ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার সোনার বাংলা আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযাদ্ধো ও জনতার উদ্দেশে আমি সালাম জানাই। তোমরা আমার সালাম নাও।

আমার বাংলায় আজ এক বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। আপনারা জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন, ইয়াহিয়ার কারাগারে আমি প্রতিমুহূর্তে প্রতীক্ষা করেছি, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতও ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যে মুক্ত হবে এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তবে এই মুক্তির জন্য যে মূল্য দিতে হলো তা কল্পনারও অতীত। আমার বিশ্বাস পৃথিবীর ইতিহাসে কোন দেশের মুক্তি সংগ্রামে এত লোকের প্রাণহানির নজির নাই। আমার দেশের নিরীহ মানুষদের হত্যা করে তারা কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছে, আমার মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করে তারা জঘন্য বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে। সোনার বাংলায় অসংখ্য গ্রাম পুড়িয়ে তারা ছাড়খার করে দিয়েছে।

‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’ কিন্তু আজ আর কবিগুরুর সে কথা বাংলার মানুষের বেলায় খাটে না। বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন কাজ তারা করেছে যার নজির ইতিহাসে নাই। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে তারা বীরের জাতি, তারা নিজেদের অধিকার অর্জন করে মানুষের মতো বাঁচতে জানে।

আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি, যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, আমাদের সাধারণ মানুষ আশ্রয় না পায়, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে-পূর্ণ হবে না। আমাদের তাই এখন অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। সেগুলো মেরামত করতে হবে। আপনারা নিজেরাই সেইসব রাস্ত-ঘাট মেরামত করতে শুরু করে দিন। যার যা কাজ ঠিকমতো করে যান। কর্মচারীদের বলছি আপনারা ঘুষ খাবেন না। এদেশে আর কোন দুর্নীতি চলতে দেয়া যাবে না। প্রায় চার লাখ বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানে আছে। আমাদের তাদের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। তোমরা বাংলায় যারা কথা বল না, তারা এখন থেকে বাংলার মানুষ হও, বাঙালিদের হাত দিও না, তারাও আমার ভাই, বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে চাই; বাঙালি শুধু স্বাধীনতার জন্যই আত্মত্যাগ করতে পারে না, তারা শান্তিতেও বসবাস করতে পারে। কিন্তু ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যারা সহায়তা করেছে, যেসব লোক পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্থন করেছে, আমাদের হত্যা করতে সাহায্য করেছে তাদের ক্ষমা করা হবে না। যথা সময়ে সঠিক বিচারের মাধ্যমে তাদের শাস্তি দেয়া হবে।

আপনারা জানেন, আমার বিরুদ্ধে একটি মামলা দাঁড় করানো হয়েছিল এবং অনেকেই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে, আমি তাদের জানি। আপনারা আরও জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার জেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান, আমি বাঙালি, বাঙালিরা একবার মাত্রই মরে। তাই বলেছি ক্ষমা চাই না। তোমরা আমাকে মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। আমি ঠিক করেছিলাম ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় বলব, ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।’

মার্চের সেই রাতে আমাকে ছেড়ে যাবার সময় আমার সহকর্মীরা আমাকে চলে যেতে অনুরোধ করেন। আমি তখন তাদের বলেছিলাম, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিপদের মুখে রেখে আমি যাব না। মরতে হলে আমি এখানেই মরব। তবু মাথানত করব না। সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনসহ অন্যরা তা শুনে কান্না করেছিলেন। আমি তাদের শুধু বলেছিলাম তোমরা নির্দেশমতো সংগ্রাম চালিও। তারা সে ওয়াদা পালন করেছে।

বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন, কিন্তু আজ আমাদের সামনে অসংখ্য সমস্যা আছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। বিধ্বস্ত বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলুন। নিজেরা সবাই রাস্তা তৈরি করতে শুরু করে দিন। যার যার কাজ করে যান। বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে হবে। একটি মানুষকেও আর না খেয়ে মরতে দেয়া যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা আপনারা অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করেছেন। অসংখ্য বাঙালি মা-বোনদের অসম্মান করেছেন। তবুও আমি চাই আপনারা ভালো থাকুন।

আমি আজ বক্তৃতা দিতে পারব না। ওরা আমার লাখো লাখো মানুষকে হত্যা করেছে। এমন কোনো গ্রাম নাই যেখানে ওরা আগুন দেয় নাই, যেখানে মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করে নাই। আজ বহু ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবীকে ও সহকর্মীকে আমি দেখছি না। এত বেসামরিক লোককে হত্যার নজির নাই বিশ্বে। প্রথম মহাযুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এত লোক মরে নাই। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্র আর পাকিস্তান চতুর্থ। প্রথম ইন্দোনেশিয়া ও তৃতীয় ভারত। অথচ সেই রাষ্ট্রের মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী। তবে দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশ হবে একটি আদর্শ রাষ্ট্র। আর তার ভিত্তি কোন ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাকে জানাই আমার শ্রদ্ধা। তিনি প-িত জহুরলাল নেহরুর কন্যা, প-িত মতিলাল নেহরুর নাতনী। তার রক্তে মিশে রয়েছে রাজনীতি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সব রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। আমার সঙ্গে দিল্লিতে শ্রীমতি গান্ধীর আলাপ হয়েছে। তার সঙ্গে কথাও হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে।

আমি ফিরে আসার আগে ভুট্টো সাহেব অনুরোধ করেছেন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের শিথিলতা রাখা যায় কিনা। আমি তখন বলেছিলাম, আমি মানুষের কাছে না ফিরে যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারব না। আজ আমি বলতে চাই, ভুট্টো সাহেব আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সঙ্গে আর না। মরে যাবে তবু বাঙালি আর স্বাধীনতা হারাতে পারবে না। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে।

গত ২৫ মার্চ থেকে দীর্ঘ ৯ মাস বর্বর হানাদারবাহিনী এদেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তারা আমার লাখো লাখো মানুষকে হত্যা করেছে। মা-বোনের সম্মানহানি ঘটিয়েছে। বিশ্ব এসব ঘটনার সামান্য কিছু জানে মাত্র। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এই তদন্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে আমি বিশ্বের সব মুক্ত দেশকে অনুরোধ জানাই, আপনারা অবিলম্বে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন এবং সত্বর বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য করে নেয়ার জন্য সহায্য করুন। ‘জয় বাংলা’।