গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু

রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের গণমাধ্যমের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। ৬ দফা আন্দোলন এবং তার রেশ ধরে হওয়া আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় তাকে নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখি তুঙ্গে ওঠে। তৎকালীন সংবাদপত্রের রিপোর্ট, প্রবন্ধ, নিবন্ধ থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে অনেক তথ্য মেলে সেসব তথ্যের সন্নিবেশে সহজেই তার রাজনৈতিক জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংবাদ-এ অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে সেসব প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে পুনঃপ্রকাশ করা হচ্ছে।

আওয়ামী এমপিদের

প্রতি মুজিবুরের অনুরোধ

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি শেখ মুজিবর রহমান প্রাদেশিক পরিষদে পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্যগণকে পার্টির নেতার সহিত পরামর্শ ব্যতিরেকে ঢাকা ত্যাগ না করার অনুরোধ জানাইয়াছেন।

১৬ আগস্ট, ১৯৫৬।

৫ জন সদস্যবিশিষ্ট আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ সম্পন্ন

আতাউর রহমানের নেতৃত্বে গতকল্য (বৃহস্পতিবার) আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করিয়াছে। প্রাদেশিক গভর্নর ফজলুল হক লাট ভবনের দরবার কক্ষে অপরাহ্ণ পাঁচ ঘটিকায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীকে লইয়া পাঁচজন মন্ত্রী রহিয়াছেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করিয়া সম্ভবত এগারোজন করা হইবে। নয়া মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন আতাউর রহমান (প্রধানমন্ত্রী আ,লীগ), আবুল মনসুর আহমেদ (আ,লীগ), শেখ মুজিবর রহমান (আ,লীগ), কফিল উদ্দীন চৌধুরী (স্বতন্ত্র) ও মাহমুদ আলী (গণতন্ত্রী দল)।

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জা নয়া প্রধানমন্ত্রী ও তাহার সহকর্মীদের সাক্ষাৎ দেন। সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীদের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দেন। অনুষ্ঠানে জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলের নেতা সোহরাওয়ার্দী, হাইকোর্টের বিচারপতিগণ, কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিবৃন্দ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীবৃন্দ জিওসি এবং বিশিষ্ট নাগরিকগণ উপস্থিত ছিলেন। শপথ গ্রহণের পর আতাউর রহমান ও অন্যান্য মন্ত্রী লাট ভবন হইতে বাহির হইলে গেটে অপেক্ষমাণ উৎফুল্ল জনতা তাহাদের বিপুলভাবে অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রীকে জনসাধারণের পক্ষ হইতে মাল্যভূষিত করিয়া এক প্রকার জোরপূর্বক একটি ভালো গাড়িতে উঠাইয়া লন। জনতা ‘গভর্নরের অপসারণ চাই’ ‘ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা কর’ ইত্যাদি স্লোগান তুলিতে থাকেন। লাট ভবনের গেটের উল্লসিত জনতা এক বিরাট মিছিল করিয়া প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীকে নবাবপুর রোড দিয়া আওয়ামী লীগ অফিস পর্যন্ত লইয়া যায়। নয়ামন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর প্রবল চাপে পড়িয়াই আমি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পক্ষপাতি ছিলাম না।

৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬।

নয়া মন্ত্রীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী

আতাউর রহমান খান

পূর্ব পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী ৪১ বৎসর বয়স্ক আতাউর রহমান খান ১৯৫৪ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার বেসামরিক সরবরাহ দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। আবু হাসেন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হইতেই তিনি বিরোধী দলের নেতৃত্ব করিতে ছিলেন।

১৯০৭ সালের ১ জুলাই আতাউর রহমান ঢাকা হইতে ৩০ মাইল দূরবর্তী বালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ১৯৩০ সালে অর্থনীতিতে অনার্সসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বিএ পাস করেন। ১৯৩০ সালে তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করিয়া আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৭ সালে তিনি বারে যোগদান করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সালে তিনি বিচার বিভাগে কার্য গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৪৪ সালে তিনি পদত্যাগ করিয়া পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। অচিরেই জেলা বারের আইনজীবীদের মধ্যে খ্যাতনামা আইনজ্ঞ বলিয়া তিনি প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। জনাব আতাউর রহমান খানের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৩৪-৩৫ সালে ছাত্রাবস্থায়। ঐ বৎসর তিনি ঢাকা জেলা প্রজা সমিতির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ সালে তিনি জেলা মুসলিম লীগের কার্যনির্বাহক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ঐ বৎসরই তিনি মহকুমা মুসলিম লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪২-৪৬ সালে ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি শান্তি কমিটির সদস্য তালিকাভূক্ত হন এবং স্থানীয় শান্তিরক্ষা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান পাট চাষী সমিতির এবং পাকিস্তান জুট ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হইয়া কায়েদে আজমের নিকট প্রেরিত এক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করেন। তিনি কায়েদে আজমের নিকট পাট সমস্যা সমাধান সম্পর্কে একটি খসড়া প্রস্তাব প্রদান করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি মুসলিম লীগ কর্মীদের এক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। উক্ত সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী উক্ত প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মওলানা ভাসানী কারারুদ্ধ থাকাকালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হন। গণতন্ত্রের অগ্রদূত আতাউর রহমান খান দেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি গঠনতন্ত্রের মূলনীতি কমিটির বিরুদ্ধে এক আন্দোলন পরিচালনা করেন এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কনভেনশনে সভাপতিত্ব করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ব্যক্তি স্বাধীনতা লীগ ও পূর্ববঙ্গ শান্তি কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কর্মপরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ব্যাপারে তিনি বিশেষ আগ্রহশীল। ১৯৫৪ সালে ওই পদে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি দক্ষিণ পূর্ব এশীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে যোগদানকারী পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের সরকারি নেতা হিসেবে চীন সফর করেন। ১৯৫৪ সালে মওলানা ভাসানী ও জনাব সোহরাওয়ার্দীর সহিত সাক্ষাৎ করার জন্য তিনি যথাক্রমে ইংল্যান্ডে ও সুইজারল্যান্ডে গমন করেন। বিগত ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বৎসরই তিনি প্রথম যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার বেসামরিক সরবরাহ দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালে জুন মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং নয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২১ সালে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজ হইতে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪০ সালে তাহার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। এই সময় তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন এবং নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিলর ও গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪১ সালে কলিকাতার হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলন এবং ১৯৪৩ সালে রশীদ আলী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি নিখিল ভারত ও নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগের কাউন্সিলর ছিলেন। মুজিবুর রহমান দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরেই মুসলিম লীগের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠাতা। পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগ আমলে তাহাকে চারবার কারাবরণ করিতে হয়। ইহার মধ্যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকিবার অপরাধে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে প্রথমবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটের ব্যাপারে ১৯৪৯ সালে তাহাকে আইন ক্লাস হইতে বহিষ্কৃত ও একই অপরাধে দ্বিতীয়বার গ্রেফতার করা হয়। ইহার পর ১৯৪৯ সালে তাহাকে পুনরায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিবার অপরাধে কারাবরণ করিতে হয়। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সমীপে এক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করিবার অপরাধে তাহাকে কারারুদ্ধ করা হয়। গোপালগঞ্জ কারাগারে বন্দী অবস্থায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। জেল হইতে মুক্তিলাভের পর তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে তিনি যোগদান করিয়াছিলেন। বিগত সাধারণ নির্বাচনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হইবার কিছুদিন পরেই ফজলুল হক মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন। গত জুন মাসে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬।

শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২০ , ২৭ পৌষ ১৪২৬, ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু

image

রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের গণমাধ্যমের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। ৬ দফা আন্দোলন এবং তার রেশ ধরে হওয়া আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় তাকে নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখি তুঙ্গে ওঠে। তৎকালীন সংবাদপত্রের রিপোর্ট, প্রবন্ধ, নিবন্ধ থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে অনেক তথ্য মেলে সেসব তথ্যের সন্নিবেশে সহজেই তার রাজনৈতিক জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংবাদ-এ অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে সেসব প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে পুনঃপ্রকাশ করা হচ্ছে।

আওয়ামী এমপিদের

প্রতি মুজিবুরের অনুরোধ

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি শেখ মুজিবর রহমান প্রাদেশিক পরিষদে পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্যগণকে পার্টির নেতার সহিত পরামর্শ ব্যতিরেকে ঢাকা ত্যাগ না করার অনুরোধ জানাইয়াছেন।

১৬ আগস্ট, ১৯৫৬।

৫ জন সদস্যবিশিষ্ট আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ সম্পন্ন

আতাউর রহমানের নেতৃত্বে গতকল্য (বৃহস্পতিবার) আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করিয়াছে। প্রাদেশিক গভর্নর ফজলুল হক লাট ভবনের দরবার কক্ষে অপরাহ্ণ পাঁচ ঘটিকায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীকে লইয়া পাঁচজন মন্ত্রী রহিয়াছেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করিয়া সম্ভবত এগারোজন করা হইবে। নয়া মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন আতাউর রহমান (প্রধানমন্ত্রী আ,লীগ), আবুল মনসুর আহমেদ (আ,লীগ), শেখ মুজিবর রহমান (আ,লীগ), কফিল উদ্দীন চৌধুরী (স্বতন্ত্র) ও মাহমুদ আলী (গণতন্ত্রী দল)।

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জা নয়া প্রধানমন্ত্রী ও তাহার সহকর্মীদের সাক্ষাৎ দেন। সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীদের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দেন। অনুষ্ঠানে জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলের নেতা সোহরাওয়ার্দী, হাইকোর্টের বিচারপতিগণ, কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিবৃন্দ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীবৃন্দ জিওসি এবং বিশিষ্ট নাগরিকগণ উপস্থিত ছিলেন। শপথ গ্রহণের পর আতাউর রহমান ও অন্যান্য মন্ত্রী লাট ভবন হইতে বাহির হইলে গেটে অপেক্ষমাণ উৎফুল্ল জনতা তাহাদের বিপুলভাবে অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রীকে জনসাধারণের পক্ষ হইতে মাল্যভূষিত করিয়া এক প্রকার জোরপূর্বক একটি ভালো গাড়িতে উঠাইয়া লন। জনতা ‘গভর্নরের অপসারণ চাই’ ‘ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা কর’ ইত্যাদি স্লোগান তুলিতে থাকেন। লাট ভবনের গেটের উল্লসিত জনতা এক বিরাট মিছিল করিয়া প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীকে নবাবপুর রোড দিয়া আওয়ামী লীগ অফিস পর্যন্ত লইয়া যায়। নয়ামন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর প্রবল চাপে পড়িয়াই আমি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পক্ষপাতি ছিলাম না।

৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬।

নয়া মন্ত্রীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী

আতাউর রহমান খান

পূর্ব পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী ৪১ বৎসর বয়স্ক আতাউর রহমান খান ১৯৫৪ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার বেসামরিক সরবরাহ দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। আবু হাসেন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হইতেই তিনি বিরোধী দলের নেতৃত্ব করিতে ছিলেন।

১৯০৭ সালের ১ জুলাই আতাউর রহমান ঢাকা হইতে ৩০ মাইল দূরবর্তী বালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ১৯৩০ সালে অর্থনীতিতে অনার্সসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বিএ পাস করেন। ১৯৩০ সালে তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করিয়া আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৭ সালে তিনি বারে যোগদান করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সালে তিনি বিচার বিভাগে কার্য গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৪৪ সালে তিনি পদত্যাগ করিয়া পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। অচিরেই জেলা বারের আইনজীবীদের মধ্যে খ্যাতনামা আইনজ্ঞ বলিয়া তিনি প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। জনাব আতাউর রহমান খানের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৩৪-৩৫ সালে ছাত্রাবস্থায়। ঐ বৎসর তিনি ঢাকা জেলা প্রজা সমিতির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯৪৪ সালে তিনি জেলা মুসলিম লীগের কার্যনির্বাহক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ঐ বৎসরই তিনি মহকুমা মুসলিম লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪২-৪৬ সালে ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি শান্তি কমিটির সদস্য তালিকাভূক্ত হন এবং স্থানীয় শান্তিরক্ষা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান পাট চাষী সমিতির এবং পাকিস্তান জুট ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হইয়া কায়েদে আজমের নিকট প্রেরিত এক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করেন। তিনি কায়েদে আজমের নিকট পাট সমস্যা সমাধান সম্পর্কে একটি খসড়া প্রস্তাব প্রদান করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি মুসলিম লীগ কর্মীদের এক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। উক্ত সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী উক্ত প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মওলানা ভাসানী কারারুদ্ধ থাকাকালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সভাপতি নির্বাচিত হন। গণতন্ত্রের অগ্রদূত আতাউর রহমান খান দেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি গঠনতন্ত্রের মূলনীতি কমিটির বিরুদ্ধে এক আন্দোলন পরিচালনা করেন এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কনভেনশনে সভাপতিত্ব করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ব্যক্তি স্বাধীনতা লীগ ও পূর্ববঙ্গ শান্তি কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কর্মপরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ব্যাপারে তিনি বিশেষ আগ্রহশীল। ১৯৫৪ সালে ওই পদে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি দক্ষিণ পূর্ব এশীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে যোগদানকারী পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের সরকারি নেতা হিসেবে চীন সফর করেন। ১৯৫৪ সালে মওলানা ভাসানী ও জনাব সোহরাওয়ার্দীর সহিত সাক্ষাৎ করার জন্য তিনি যথাক্রমে ইংল্যান্ডে ও সুইজারল্যান্ডে গমন করেন। বিগত ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বৎসরই তিনি প্রথম যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার বেসামরিক সরবরাহ দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালে জুন মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং নয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২১ সালে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজ হইতে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪০ সালে তাহার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। এই সময় তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন এবং নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিলর ও গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪১ সালে কলিকাতার হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলন এবং ১৯৪৩ সালে রশীদ আলী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি নিখিল ভারত ও নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগের কাউন্সিলর ছিলেন। মুজিবুর রহমান দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরেই মুসলিম লীগের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠাতা। পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগ আমলে তাহাকে চারবার কারাবরণ করিতে হয়। ইহার মধ্যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকিবার অপরাধে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে প্রথমবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটের ব্যাপারে ১৯৪৯ সালে তাহাকে আইন ক্লাস হইতে বহিষ্কৃত ও একই অপরাধে দ্বিতীয়বার গ্রেফতার করা হয়। ইহার পর ১৯৪৯ সালে তাহাকে পুনরায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিবার অপরাধে কারাবরণ করিতে হয়। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সমীপে এক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করিবার অপরাধে তাহাকে কারারুদ্ধ করা হয়। গোপালগঞ্জ কারাগারে বন্দী অবস্থায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। জেল হইতে মুক্তিলাভের পর তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে তিনি যোগদান করিয়াছিলেন। বিগত সাধারণ নির্বাচনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হইবার কিছুদিন পরেই ফজলুল হক মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন। গত জুন মাসে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬।