ধানে লোকসান খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি

নিতাই চন্দ্র রায়

ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য। ধান উৎপাদন করে কৃষককে যদি প্রতি বছরই লোকসান গুনতে হয়, ঋণের দায়ে জর্জরিত হতে হয়, জমি বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়- তাহলে কৃষক কেন ধান উৎপাদন করে দেশের ১৭ কোটি মানুষের অন্ন জোগাবেন? কৃষকের ঘরে যখন ধান থাকে, তখন বাজারে ধানের দাম থাকে না। ব্যবসায়ীদের গুদামে ধান মজুদ হলেই পণ্যটির মূল্য হু হু করে বেড়ে যায়। এতে মিল মালিক, ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরাই লাভবান হন। সরকার উৎপাদিত ধানের মাত্র তিন শতাংশ ক্রয় করে। বাকি ৯৭ শতাংশ ধান ক্রয় করে বেসরকারি চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। এ বছর আমন মৌসুমে প্রায় সোয়া দুই কোটি টন ধান উৎপাদিত হয়েছে, তা থেকে সরকার কিনবে মাত্র ৬ লাখ টন। আর প্রায় ২ কোটি টন ধান কিনবে বেসরকারি ধান ব্যবসায়ী ও চালকল মালিক। সরকার এবার আমন মৌসুমে প্রতিমণ ধানের দাম ১০৪০ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে তার কোনো প্রতিফলন দৃশ্যমান হচ্ছে না। ব্যবসায়ী ও মিলমালিকদের মর্জির ওপরই নির্ভর করছে কৃষকের কষ্টে উৎপাদিত ধানের দাম। মৌসুমের শুরুতে প্রতি মণ ধান ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা দামে বিক্রি হলেও এখন আর সেই দামে ধান বিক্রি হচ্ছে না। রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ময়মনসিংহসহ সারা দেশের হাট-বাজারে প্রতি মণ আমন ধান বিক্রি হচ্ছে এখন ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা মণ দরে। এ বছর আমন মৌসুমে প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে ৮৫০ টাকা। ফলে প্রতি মণ ধানে কৃষককে লোকসান গুনতে হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এ পরিস্থিতিতে ৬ লাখ টন সরকারি ধান ক্রয় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কৃষকের কাছ থেকে মাত্র ৪১ হাজার ৫৩১ টন ধান সংগ্রহ করার বিষয়টি মোটেও বোধগম্য নয়।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, নদী ভাঙন ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে প্রতি বছরই কমছে কৃষিজমির পরিমাণ। উপকরণের সীমাবদ্ধতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ- খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে কৃষক দেশের চাহিদা মোতাবেক ধান উৎপাদন করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এখন খাদ্যের জন্য বাংলাদেশকে বিদেশের ওপর আর নির্ভর করতে হয় না। তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকতে হয় না ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের দিকে। বাংলাদেশ থেকে এখন সুগন্ধি চালসহ নানা রকমের কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। সবজি ও ফল উৎপাদনে বাংলাদেশে ঘটেছে এক নীরব বিপ্লব। কৃষি ক্ষেত্রে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই সফলতা, এই অর্জন তারা যদি উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পান। তাদের মুখে যদি হাসি না থাকে, তাহলে এর চেয়ে বেদনার বিষয় আর কিছু হতে পারে না। এটা জাতির জন্য যেমন দুর্ভাগ্যের বিষয়, তেমনি কৃষির জন্য এক অশনিসংকেত।

বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ এখনও কৃষির সঙ্গে জড়িত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ধান উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে শীর্ষে। ২০১৮ সালে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ, যা ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে বলে আশা করা যায়। কৃষির এই অভাবনীয় সাফল্যের অংশীদার কৃষক, সরকার, কৃষি গবেষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ হলেও, তার সুবিধা থেকে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের কৃষকরা। তাদের উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হচ্ছে ধান। মিল মালিক, শ্রমিক-কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের সংগঠন আছে। তারা মিছিল মিটিং করে সরকারের কাছ থেকে দাবি-দাওয়া আদায় করে নেন। বাংলাদেশে কৃষকদের তেমন শক্তিশালী সংগঠন নেই। বাম রাজনৈতিক দলগুলো কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে মাঝে-মধ্যে আন্দোলন করলেও বড় রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কৃষক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় না। যদিও তারা ভোটের সময় কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের ব্যাপারে নানা প্রতিশ্রুতি দেন।

সম্প্রতি (২৬ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ (বারসিক) আয়োজিত ‘ধানের ন্যায্যমূল্য : সংকট ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক সেমিনারে কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে এমনকি ক্ষেত্রভেদে কৃষক ও স্থানীয় পর্যায়ে ধানসহ কৃষিপণ্য মজুদকরণের শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সরকারের ধান মজুদ ক্ষমতা ১ কোটি টনে উন্নীত করণ এবং মোট উৎপাদন খরচের ২৫% লাভে ধানের বাজার মূল্য নিশ্চিত করণসহ ১০ দফা দাবি জানানো হয়। সেমিনারের মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের কৃষকদের শ্রমে ঘামে উৎপাদিত ধানের বাজার মূল্য কম থাকায় কৃষকরা বর্তমানে দিশেহারা। প্রতি বছর লোকসান গুনে গুনে কৃষির ওপর থেকে দিনদিন আস্থা হারিয়ে ফেলছেন এ দেশের কৃষককুল। সেমিনারে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কৃষকদের অবদান, উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কথাও উল্লেখ করা হয়। বক্তরা বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা শুধুমাত্র কৃষকের জীবনজীবিকার প্রশ্ন নয়; এটি বাংলাদেশের আপাময় জনগণের জন্য প্রয়োজন। প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় ২০ থেকে ২২ টাকা। আর কৃষক তা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন ১২ থেকে ১৩ টাকা কেজিতে। এটি শুধু অন্যায়ই নয়; একই সঙ্গে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য তৈরির অপপ্রয়াস। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে। ব্যাহত করবে হাওর ও চরাঞ্চলের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকেও।

হাওর অঞ্চলে বোরো ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল উৎপাদন হয় না বললেই চলে। বোরো ধানই হাওরবাসীদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের এক ভাগ হাওর এলাকা। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে দেশের সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এ ৭টি জেলার ৬০টি উপজেলার ৫৩৯টি ইউনিয়নে মোট ৪২৩টি ছোট-বড় হাওর রয়েছে। যেখানে প্রায় ২ কোটি লোকের বসবাস। হাওরাঞ্চলের বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান বাংলাদেশকে তার নিজের আত্মমর্যাদা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে। আমেরিকার হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে। সেই হাওর জনপদের মানুষের জীবনযাত্রা আজ ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে বিপন্ন। একক কৃষি অঞ্চল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদিত হয় হাওরে। শুধু বোরো মৌসুমেই দেশের উৎপাদিত মোট ধানের ১০ শতাংশ উৎপন্ন হয় হাওরাঞ্চলে। অব্যাহত লোকসানের কারণে হাওরে ধানের উৎপাদন কমে গেলে তা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হবে এক বিরাট হুমকি। তাই এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো কৃষিপণ্যের জাতীয় মূল্য কমিশন গঠন করতে হবে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদিত ধানের কম পক্ষে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্যগুদামের ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। সরকারি ধান ক্রয়ে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের অগ্রাধিকার দিয়ে প্রথমে তাদের নিকট থেকে ধান কিনতে হবে। ধান ক্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষককে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। ধান ক্রয়ে সব ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতি দূর করতে হবে। ধানের উৎপাদন খরচ কমাতে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে বিএডিসির মাধ্যমে স্বল্প ভাড়ায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে রাইস ট্রান্সপ্লাটার ও কম্বাইন হারভেস্টার সরবরাহ করতে হবে। কারণ প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান রোপণ করলে বিঘাপ্রতি ১৭০০ থেকে ২০০০ টাকা খরচ হয়। আর রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের সাহায্যে ধান রোপণ করলে বিঘাপ্রতি খরচ হয় ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা এবং প্রতি একরে ধান রোপণে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। কোম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারের মাধ্যমে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাভর্তি কাজে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ খরচ বাঁচে এবং ধানও বেশি পাওয়া যায় শতকরা ২ ভাগ। সেচের ভর্তুকির অর্থ নলকূপের মালিকদের প্রদান না করে ধান উৎপাদনকারী কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট প্রদান করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কৃষকদের রক্ষায় কৃষি বিমা চালু করতে হবে এবং বিমার কিস্তির টাকা সরকারকেই বহন করতে হবে। কৃষি উপকরণ ক্রয়ের সময় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক যাতে সময় মতো কৃষিঋণ পান, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের কৃষক ভাইদেরও ধানের পাশাপাশি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে সুগন্ধি ধানের চাষ করতে হবে। কারণ সুগন্ধি ধানের উৎপাদন খরচ কম এবং দাম সাধারণ ধানের দ্বিগুণ। যেহেতু উৎপাদিত ধানের সিংহভাগের ক্রেতা চালকল মালিক। তাই প্রতি মৌসুমে ধানের একটি ন্যূনতম বেসরকারি মূল্যও নির্ধারণ করা উচিত, যাতে কোন ব্যবসায়ী ও চালকল মালিক ওই দামের চেয়ে কম দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে না পারেন। ধানে লোকসানের কারণে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে আগের মতো উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। পরিচর্যা, পোকামাকড়, রোগ-বালাই দমনের মতো কাজেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষক। ২০১৭ সাল থেকে বোরো মৌসুমে চাষকৃত দু’টি মেগা ভ্যারাইটি- ব্রিধান-২৮ ও ব্রিধান-২৯’-এ ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে কৃষক ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এ জাত দুটির বিকল্প উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ এখন কৃষকের কাছে সহজলভ্য নয়। তাই এ ব্যাপারে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বর্তমানে জমি বন্ধক ও বর্গা নেয়ার মতো লোকও পাওয়া যাচ্ছে না গ্রামে। কৃষির জন্য এগুলো কোন শুভ লক্ষণ নয়। কৃষি বিশেষজ্ঞগণের আশঙ্কা- ধানের ক্রমাগত লোকসান ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং কৃষি উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে করতে পারে দারুণভাবে ব্যাহত।

[লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি.]

netairoy18@yahoo.com

শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২০ , ২৭ পৌষ ১৪২৬, ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

ধানে লোকসান খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি

নিতাই চন্দ্র রায়

ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য। ধান উৎপাদন করে কৃষককে যদি প্রতি বছরই লোকসান গুনতে হয়, ঋণের দায়ে জর্জরিত হতে হয়, জমি বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়- তাহলে কৃষক কেন ধান উৎপাদন করে দেশের ১৭ কোটি মানুষের অন্ন জোগাবেন? কৃষকের ঘরে যখন ধান থাকে, তখন বাজারে ধানের দাম থাকে না। ব্যবসায়ীদের গুদামে ধান মজুদ হলেই পণ্যটির মূল্য হু হু করে বেড়ে যায়। এতে মিল মালিক, ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরাই লাভবান হন। সরকার উৎপাদিত ধানের মাত্র তিন শতাংশ ক্রয় করে। বাকি ৯৭ শতাংশ ধান ক্রয় করে বেসরকারি চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। এ বছর আমন মৌসুমে প্রায় সোয়া দুই কোটি টন ধান উৎপাদিত হয়েছে, তা থেকে সরকার কিনবে মাত্র ৬ লাখ টন। আর প্রায় ২ কোটি টন ধান কিনবে বেসরকারি ধান ব্যবসায়ী ও চালকল মালিক। সরকার এবার আমন মৌসুমে প্রতিমণ ধানের দাম ১০৪০ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে তার কোনো প্রতিফলন দৃশ্যমান হচ্ছে না। ব্যবসায়ী ও মিলমালিকদের মর্জির ওপরই নির্ভর করছে কৃষকের কষ্টে উৎপাদিত ধানের দাম। মৌসুমের শুরুতে প্রতি মণ ধান ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা দামে বিক্রি হলেও এখন আর সেই দামে ধান বিক্রি হচ্ছে না। রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ময়মনসিংহসহ সারা দেশের হাট-বাজারে প্রতি মণ আমন ধান বিক্রি হচ্ছে এখন ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা মণ দরে। এ বছর আমন মৌসুমে প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে ৮৫০ টাকা। ফলে প্রতি মণ ধানে কৃষককে লোকসান গুনতে হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এ পরিস্থিতিতে ৬ লাখ টন সরকারি ধান ক্রয় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কৃষকের কাছ থেকে মাত্র ৪১ হাজার ৫৩১ টন ধান সংগ্রহ করার বিষয়টি মোটেও বোধগম্য নয়।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, নদী ভাঙন ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে প্রতি বছরই কমছে কৃষিজমির পরিমাণ। উপকরণের সীমাবদ্ধতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ- খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে কৃষক দেশের চাহিদা মোতাবেক ধান উৎপাদন করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এখন খাদ্যের জন্য বাংলাদেশকে বিদেশের ওপর আর নির্ভর করতে হয় না। তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকতে হয় না ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের দিকে। বাংলাদেশ থেকে এখন সুগন্ধি চালসহ নানা রকমের কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। সবজি ও ফল উৎপাদনে বাংলাদেশে ঘটেছে এক নীরব বিপ্লব। কৃষি ক্ষেত্রে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই সফলতা, এই অর্জন তারা যদি উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পান। তাদের মুখে যদি হাসি না থাকে, তাহলে এর চেয়ে বেদনার বিষয় আর কিছু হতে পারে না। এটা জাতির জন্য যেমন দুর্ভাগ্যের বিষয়, তেমনি কৃষির জন্য এক অশনিসংকেত।

বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ এখনও কৃষির সঙ্গে জড়িত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ধান উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে শীর্ষে। ২০১৮ সালে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ, যা ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে বলে আশা করা যায়। কৃষির এই অভাবনীয় সাফল্যের অংশীদার কৃষক, সরকার, কৃষি গবেষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ হলেও, তার সুবিধা থেকে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের কৃষকরা। তাদের উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হচ্ছে ধান। মিল মালিক, শ্রমিক-কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের সংগঠন আছে। তারা মিছিল মিটিং করে সরকারের কাছ থেকে দাবি-দাওয়া আদায় করে নেন। বাংলাদেশে কৃষকদের তেমন শক্তিশালী সংগঠন নেই। বাম রাজনৈতিক দলগুলো কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে মাঝে-মধ্যে আন্দোলন করলেও বড় রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কৃষক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় না। যদিও তারা ভোটের সময় কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের ব্যাপারে নানা প্রতিশ্রুতি দেন।

সম্প্রতি (২৬ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ (বারসিক) আয়োজিত ‘ধানের ন্যায্যমূল্য : সংকট ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক সেমিনারে কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে এমনকি ক্ষেত্রভেদে কৃষক ও স্থানীয় পর্যায়ে ধানসহ কৃষিপণ্য মজুদকরণের শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সরকারের ধান মজুদ ক্ষমতা ১ কোটি টনে উন্নীত করণ এবং মোট উৎপাদন খরচের ২৫% লাভে ধানের বাজার মূল্য নিশ্চিত করণসহ ১০ দফা দাবি জানানো হয়। সেমিনারের মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের কৃষকদের শ্রমে ঘামে উৎপাদিত ধানের বাজার মূল্য কম থাকায় কৃষকরা বর্তমানে দিশেহারা। প্রতি বছর লোকসান গুনে গুনে কৃষির ওপর থেকে দিনদিন আস্থা হারিয়ে ফেলছেন এ দেশের কৃষককুল। সেমিনারে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কৃষকদের অবদান, উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কথাও উল্লেখ করা হয়। বক্তরা বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা শুধুমাত্র কৃষকের জীবনজীবিকার প্রশ্ন নয়; এটি বাংলাদেশের আপাময় জনগণের জন্য প্রয়োজন। প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় ২০ থেকে ২২ টাকা। আর কৃষক তা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন ১২ থেকে ১৩ টাকা কেজিতে। এটি শুধু অন্যায়ই নয়; একই সঙ্গে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য তৈরির অপপ্রয়াস। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে। ব্যাহত করবে হাওর ও চরাঞ্চলের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকেও।

হাওর অঞ্চলে বোরো ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল উৎপাদন হয় না বললেই চলে। বোরো ধানই হাওরবাসীদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের এক ভাগ হাওর এলাকা। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে দেশের সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এ ৭টি জেলার ৬০টি উপজেলার ৫৩৯টি ইউনিয়নে মোট ৪২৩টি ছোট-বড় হাওর রয়েছে। যেখানে প্রায় ২ কোটি লোকের বসবাস। হাওরাঞ্চলের বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান বাংলাদেশকে তার নিজের আত্মমর্যাদা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে। আমেরিকার হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে। সেই হাওর জনপদের মানুষের জীবনযাত্রা আজ ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে বিপন্ন। একক কৃষি অঞ্চল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদিত হয় হাওরে। শুধু বোরো মৌসুমেই দেশের উৎপাদিত মোট ধানের ১০ শতাংশ উৎপন্ন হয় হাওরাঞ্চলে। অব্যাহত লোকসানের কারণে হাওরে ধানের উৎপাদন কমে গেলে তা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হবে এক বিরাট হুমকি। তাই এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো কৃষিপণ্যের জাতীয় মূল্য কমিশন গঠন করতে হবে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদিত ধানের কম পক্ষে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্যগুদামের ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। সরকারি ধান ক্রয়ে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের অগ্রাধিকার দিয়ে প্রথমে তাদের নিকট থেকে ধান কিনতে হবে। ধান ক্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষককে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। ধান ক্রয়ে সব ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতি দূর করতে হবে। ধানের উৎপাদন খরচ কমাতে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে বিএডিসির মাধ্যমে স্বল্প ভাড়ায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে রাইস ট্রান্সপ্লাটার ও কম্বাইন হারভেস্টার সরবরাহ করতে হবে। কারণ প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান রোপণ করলে বিঘাপ্রতি ১৭০০ থেকে ২০০০ টাকা খরচ হয়। আর রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের সাহায্যে ধান রোপণ করলে বিঘাপ্রতি খরচ হয় ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা এবং প্রতি একরে ধান রোপণে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। কোম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারের মাধ্যমে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাভর্তি কাজে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ খরচ বাঁচে এবং ধানও বেশি পাওয়া যায় শতকরা ২ ভাগ। সেচের ভর্তুকির অর্থ নলকূপের মালিকদের প্রদান না করে ধান উৎপাদনকারী কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট প্রদান করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কৃষকদের রক্ষায় কৃষি বিমা চালু করতে হবে এবং বিমার কিস্তির টাকা সরকারকেই বহন করতে হবে। কৃষি উপকরণ ক্রয়ের সময় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক যাতে সময় মতো কৃষিঋণ পান, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের কৃষক ভাইদেরও ধানের পাশাপাশি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে সুগন্ধি ধানের চাষ করতে হবে। কারণ সুগন্ধি ধানের উৎপাদন খরচ কম এবং দাম সাধারণ ধানের দ্বিগুণ। যেহেতু উৎপাদিত ধানের সিংহভাগের ক্রেতা চালকল মালিক। তাই প্রতি মৌসুমে ধানের একটি ন্যূনতম বেসরকারি মূল্যও নির্ধারণ করা উচিত, যাতে কোন ব্যবসায়ী ও চালকল মালিক ওই দামের চেয়ে কম দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে না পারেন। ধানে লোকসানের কারণে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে আগের মতো উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। পরিচর্যা, পোকামাকড়, রোগ-বালাই দমনের মতো কাজেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষক। ২০১৭ সাল থেকে বোরো মৌসুমে চাষকৃত দু’টি মেগা ভ্যারাইটি- ব্রিধান-২৮ ও ব্রিধান-২৯’-এ ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে কৃষক ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এ জাত দুটির বিকল্প উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ এখন কৃষকের কাছে সহজলভ্য নয়। তাই এ ব্যাপারে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া উচিত। বর্তমানে জমি বন্ধক ও বর্গা নেয়ার মতো লোকও পাওয়া যাচ্ছে না গ্রামে। কৃষির জন্য এগুলো কোন শুভ লক্ষণ নয়। কৃষি বিশেষজ্ঞগণের আশঙ্কা- ধানের ক্রমাগত লোকসান ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং কৃষি উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে করতে পারে দারুণভাবে ব্যাহত।

[লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি.]

netairoy18@yahoo.com