গভীর খাদে পুঁজিবাজার

নেমে গেছে ভিত্তি পয়েন্টের নিচে ম কোথায় গিয়ে থামবে জানা নেই কারও, বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ

ভিত্তি পয়েন্ট ৪০৫৫- এর নিচে নেমে গেছে দেশের বড় পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক। গতকাল বড় পতনের মধ্য দিয়ে বাজারের এ অবস্থা দাঁড়ায়। এরপরও কি পতন থামবে কিনা তা জানা নেই কারও। গতকাল ডিএসইর সূচক ৮৭ দশমিক ২৪ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ১১ শতাংশ কমে ৪০৩৬.২৪ পয়েন্টে নেমে আসে। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। মামলার ভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসেন তারা। ডিএসইর সামনে বিক্ষোভ থেকে তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করেন। পুঁজিবাজারের এমন ভয়াবহ ধস ২০১০ সালের চেয়েও খারাপ বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। বাজারের এমন দুরবস্থার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণও খুঁজে পাচ্ছেন না বিশ্লেষকরা। পতনের প্রবণতা দেখে অনেকেই বিস্মিত। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা সরকারের পক্ষ থেকেও কোন আশ্বাস নেই। ফলে বিনিয়োগকারীরা আরও হতাশ হয়ে পড়ছেন। অব্যাহত পতনে যত দিন যাচ্ছে তাদের পুুঁজি ততই কমছে। কোন কোন বিশ্লেষক মনে করছেন, বিনিয়োগকারীদের এই হতাশা ও আস্থা সংকট, নিয়ন্ত্রক সংস্থার অদক্ষতা, বাজারে সুশাসনের অভাব ও ব্যাংক খাতের দুরবস্থা পুঁজিবাজারকে গভীর খাদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

বাজার বিশ্লেষণ : বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, মঙ্গলবার ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। এদিন ডিএসইতে মাত্র ৩২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে কমেছে ২৯৩টির। ৩০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৮৭ পয়েন্ট কমে চার হাজার ৩৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আগের দিন এ সূচকটি কমে ৮৯ পয়েন্ট। এর আগে গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক কমে ২৬১ পয়েন্ট। এতে শেষ ৮ কার্যদিবসে সূচকটি কমলো ৪১১ পয়েন্ট। এমন পতনের কবলে পড় ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচকটি ভিত্তি পয়েন্টের নিচে নেমে গেল। ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক হিসেবে ডিএসইএক্স চার হাজার ৫৫ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি। এ হিসাবে শুরুর অবস্থান থেকে সূচকটি এখন ১৯ পয়েন্ট কম রয়েছে। অবশ্য প্রধান মূল্য সূচকের থেকেও করুণ দশা বিরাজ করছে ডিএসইর অপর সূচকগুলোয়। বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ অনেক আগেই শুরুর নিচে নেমে গেছে। এক হাজার ৪৬০ পয়েন্ট নিয়ে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি চালু হওয়া সূচকটি এখন এক হাজার ৩৬১ পয়েন্টে অবস্থান করছে। মঙ্গলবার এ সূচকটি কমেছে ২৬ পয়েন্ট। ডিএসইর আরেক সূচক ‘ডিএসই শরিয়াহ্’। ইসলামী শরিয়াহ্ ভিত্তিক পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি এ সূচকটি যাত্রা শুরু করে। শুরুতে এ সূচকটি ছিল ৯৪১ পয়েন্টে। মঙ্গলবার লেনদেন শেষে সূচকটি ২২ পয়েন্ট কমে ৯০৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এদিকে বৃহৎ বা বড় মূলধনের কোম্পানির জন্য চলতি বছরে ‘সিএনআই-ডিএসই সিলেক্ট ইনডেক্স (সিডিএসইটি)’ নামে নতুন সূচক চালু করেছে ডিএসই। বছরের প্রথমদিন ১ জানুয়ারি থেকে অফিশিয়ালি ডিএসইর ওয়েবসাইটে সূচকটি উন্মুক্ত করা হয়। ৪০টি কোম্পানি নিয়ে শুরু হওয়া সূচকটির ভিত্তি ভ্যালু ধরা হয় ১০০০ পয়েন্ট। তবে এখন সূচকটি ৮১১ পয়েন্টে নেমে এসেছে।

মঙ্গলবার ডিএসইতে ২৯৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দরপতন হয়েছে, তার মধ্যে ১৪৫টিরই দাম কমেছে ৩ শতাংশের ওপরে। ৫ শতাংশের ওপরে দাম হারিয়েছে ৫৭টি প্রতিষ্ঠানের। আর ৬ শতাংশের ওপরে দাম কমেছে ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের। এমন দাম কমার পর অনেক বিনিয়োগকারী এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি।

এদিকে শেয়ারের ক্রেতা সংকটে বাজারে দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা। গত বছরের ৫ ডিসেম্বরের পর ডিএসইর লেনদেন আর ৪০০ কোটি টাকার ঘর স্পর্শ করতে পারেনি। বাজারে লেনদেনের পরিমাণ ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে আটকে রয়েছে। মঙ্গলবার লেনদেন হয়েছে ২৬২ কোটি ৮১ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ২৮৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) দুরবস্থায় রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বাজারটির সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৭৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ২৯৫ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে ৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৪৪ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম বেড়েছে ২১টির, কমেছে ২০৩টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২০টির।

বিশ্লেষকদের মতামত : বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারে যে বড় দরপতন হচ্ছে এর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। বিনিয়োগকারীরা হুজুগে শেয়ার বিক্রি করছেন। অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। শেয়ারবাজারের এ দুরবস্থার কারণ হিসেবে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা বলেন, যেটা ঘটার কথা না সেটাই ঘটছে। বিনিয়োগকারীরা বিমুখ হয়ে গেছেন। বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের কোন আস্থা নেই। আস্থা ফেরানোর জন্য কোন চেষ্টা চলছে কিনা, কে জানে। চললেও তা কাজে আসছে না। সার্বিক বাজারের আচরণ এখন অস্বাভাবিক। সরকার চাইলে বাজারে টাকার ব্যবস্থা করতে পারে, কিন্তু করে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, বাজারের ওপর অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা এত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন যে তারা আর কোন ভরসা পাচ্ছেন না। সর্বশেষ ডিএসইর এমডি নিয়োগ নিয়ে বোর্ড সভায় যে ঘটনা ঘটছে তাও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এটা অশনিসংকেত। কেন যেন বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, ডিএসই প্রতিযোগিতা করে দুঃশাসন নিয়ে আসছে বিনিয়োগকারীদের জন্য।

বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ : মামলার ভয় দূরে ঠেলে শেয়ারবাজারের ভয়াবহ দরপতনের প্রতিবাদে মতিঝিলে অবস্থিত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) আগের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন বিনিয়োগকারীরা। মঙ্গলবার দুপুরে ‘বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ’র ব্যানারে এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ থেকে বরাবরের মতো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানানো হয়।

এর আগে দরপতনের প্রতিবাদে দিনের পর দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করায় গত ২৭ আগস্ট ডিএসইর পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। সাধারণ ডায়রিতে বলা হয়েছিল, ২৭ আগস্ট আনুমানিক দুপুর ২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত বাংলাদেশ পুঁজিবাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে ৯-১০ জন লোক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের সামনে ব্যানার ও মাইকসহ বিক্ষোভ মিছিল করে। ফলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাতায়াত এবং অফিসের স্বাভাবিক কার্যক্রম সম্পাদনে বিঘœ ঘটে। এতে উল্লেখ করা হয়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বেশ কিছুদিন ধরে তারা এ ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছে এবং পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্পর্কে সম্মানহানিকর মন্তব্য করছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ মনে করে এ ধরনের কার্যকলাপ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ পুঁজিবাজারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে। ফলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে বলে সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ‘ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ দেশের প্রাচীন বৃহৎ পুঁজিবাজার। একটি জাতীয় ও জনস্বার্থমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার লোকের আগমন ঘটে। ডিএসইর পক্ষ থেকে এই সাধারণ ডায়েরি করা হলে বন্ধ হয়ে যায় বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভ। তবে শেয়ারবাজারে চলতে থাকে দরপতন। দরপতনের ধারা সম্প্রতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

শেষ ৮ কার্যদিবসের মধ্যে সাত দিনই বড় পতন হয়েছে। এই সাত দিনে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৪০০ পয়েন্টের বেশি। এরমধ্যে মঙ্গলবার কমেছে ৮৭ পয়েন্ট। সূচকের এই বড় পতনের প্রতিবাদে লেনদেন শেষ হওয়ার আগেই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন বিনিয়োগকারীরা। আধঘণ্টা চলে এ বিক্ষোভ। বিক্ষোভ থেকে বরাবরের মতো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনের পদত্যাগ দাবি করা হয়।

এসময় বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী বলেন, বিএসইসির এই চেয়ারম্যানকে দায়িত্বে রেখে শেয়ারবাজার ভালো করা যাবে না। আমরা বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চাই। সেই সঙ্গে পুরো কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।

ব্লক মার্কেট : ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মঙ্গলবার ব্লক মার্কেটে মোট ১২ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে। কোম্পানিগুলোর মোট ৪০ লাখ ৭৮ হাজার ২০০টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ১২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের। স্কয়ার ফার্মার ২ কোটি ৯৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন করে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তৃতীয় স্থানে থাকা রেনেটা ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এছাড়া ব্লকে লেনদেন করা অন্য কোম্পানিগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স, ব্র্যাক ব্যাংক, বিএসআরএম লিমিটেড, নাভানা সিএনজি, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ফনিক্স ফাইন্যান্স, এসইএমএল লেকচার ইক্যুয়িটি ম্যানেজমেন্ট, এসকে ট্রিমস ও স্কয়ার ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেড।

image

গতকাল পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ-সংবাদ

আরও খবর
ক্ষণগণনা : আর ৬১ দিন
মাধ্যমিক ও অন্য স্তরে পাঠ্যবই মুদ্রণে ‘ই-জিপি’ টেন্ডার
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা দুর্নীতি সহায়ক
ভোট ৩০ জানুয়ারি
বিএনপির নজর মেয়র পদে আ’লীগ কাউন্সিলর প্রার্থীরা ব্যস্ত বিদ্রোহী ঠেকাতে
খেলবেন ২টি টেস্ট, ১টি ওডিআই ও ৩টি টি-২০
পদ্মা সেতুতে বসল ২১তম স্প্যান
ঢাবির ৬৭ শিক্ষার্থী স্থায়ী বহিষ্কার
মন্ত্রীর এপিএস আরিফুরের বিরুদ্ধে লুটপাটের অভিযোগ
অনেক দিন সাজা খাটার পর সরকার বিবেচনা করতে পারে
প্রতিশ্রুতি পাচ্ছেন, হিসাব কষছেন ভোটাররা
সৈয়দ কায়সারের মৃত্যুদণ্ড বহাল
গৃহবধূকে আটকে রেখে এক মাস ধরে গণধর্ষণ

বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২০ , ১ মাঘ ১৪২৬, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

গভীর খাদে পুঁজিবাজার

নেমে গেছে ভিত্তি পয়েন্টের নিচে ম কোথায় গিয়ে থামবে জানা নেই কারও, বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ

রোকন মাহমুদ

image

গতকাল পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ-সংবাদ

ভিত্তি পয়েন্ট ৪০৫৫- এর নিচে নেমে গেছে দেশের বড় পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক। গতকাল বড় পতনের মধ্য দিয়ে বাজারের এ অবস্থা দাঁড়ায়। এরপরও কি পতন থামবে কিনা তা জানা নেই কারও। গতকাল ডিএসইর সূচক ৮৭ দশমিক ২৪ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ১১ শতাংশ কমে ৪০৩৬.২৪ পয়েন্টে নেমে আসে। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। মামলার ভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসেন তারা। ডিএসইর সামনে বিক্ষোভ থেকে তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করেন। পুঁজিবাজারের এমন ভয়াবহ ধস ২০১০ সালের চেয়েও খারাপ বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। বাজারের এমন দুরবস্থার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণও খুঁজে পাচ্ছেন না বিশ্লেষকরা। পতনের প্রবণতা দেখে অনেকেই বিস্মিত। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা সরকারের পক্ষ থেকেও কোন আশ্বাস নেই। ফলে বিনিয়োগকারীরা আরও হতাশ হয়ে পড়ছেন। অব্যাহত পতনে যত দিন যাচ্ছে তাদের পুুঁজি ততই কমছে। কোন কোন বিশ্লেষক মনে করছেন, বিনিয়োগকারীদের এই হতাশা ও আস্থা সংকট, নিয়ন্ত্রক সংস্থার অদক্ষতা, বাজারে সুশাসনের অভাব ও ব্যাংক খাতের দুরবস্থা পুঁজিবাজারকে গভীর খাদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

বাজার বিশ্লেষণ : বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, মঙ্গলবার ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। এদিন ডিএসইতে মাত্র ৩২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে কমেছে ২৯৩টির। ৩০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৮৭ পয়েন্ট কমে চার হাজার ৩৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আগের দিন এ সূচকটি কমে ৮৯ পয়েন্ট। এর আগে গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক কমে ২৬১ পয়েন্ট। এতে শেষ ৮ কার্যদিবসে সূচকটি কমলো ৪১১ পয়েন্ট। এমন পতনের কবলে পড় ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচকটি ভিত্তি পয়েন্টের নিচে নেমে গেল। ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক হিসেবে ডিএসইএক্স চার হাজার ৫৫ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি। এ হিসাবে শুরুর অবস্থান থেকে সূচকটি এখন ১৯ পয়েন্ট কম রয়েছে। অবশ্য প্রধান মূল্য সূচকের থেকেও করুণ দশা বিরাজ করছে ডিএসইর অপর সূচকগুলোয়। বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ অনেক আগেই শুরুর নিচে নেমে গেছে। এক হাজার ৪৬০ পয়েন্ট নিয়ে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি চালু হওয়া সূচকটি এখন এক হাজার ৩৬১ পয়েন্টে অবস্থান করছে। মঙ্গলবার এ সূচকটি কমেছে ২৬ পয়েন্ট। ডিএসইর আরেক সূচক ‘ডিএসই শরিয়াহ্’। ইসলামী শরিয়াহ্ ভিত্তিক পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি এ সূচকটি যাত্রা শুরু করে। শুরুতে এ সূচকটি ছিল ৯৪১ পয়েন্টে। মঙ্গলবার লেনদেন শেষে সূচকটি ২২ পয়েন্ট কমে ৯০৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এদিকে বৃহৎ বা বড় মূলধনের কোম্পানির জন্য চলতি বছরে ‘সিএনআই-ডিএসই সিলেক্ট ইনডেক্স (সিডিএসইটি)’ নামে নতুন সূচক চালু করেছে ডিএসই। বছরের প্রথমদিন ১ জানুয়ারি থেকে অফিশিয়ালি ডিএসইর ওয়েবসাইটে সূচকটি উন্মুক্ত করা হয়। ৪০টি কোম্পানি নিয়ে শুরু হওয়া সূচকটির ভিত্তি ভ্যালু ধরা হয় ১০০০ পয়েন্ট। তবে এখন সূচকটি ৮১১ পয়েন্টে নেমে এসেছে।

মঙ্গলবার ডিএসইতে ২৯৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দরপতন হয়েছে, তার মধ্যে ১৪৫টিরই দাম কমেছে ৩ শতাংশের ওপরে। ৫ শতাংশের ওপরে দাম হারিয়েছে ৫৭টি প্রতিষ্ঠানের। আর ৬ শতাংশের ওপরে দাম কমেছে ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের। এমন দাম কমার পর অনেক বিনিয়োগকারী এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি।

এদিকে শেয়ারের ক্রেতা সংকটে বাজারে দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা। গত বছরের ৫ ডিসেম্বরের পর ডিএসইর লেনদেন আর ৪০০ কোটি টাকার ঘর স্পর্শ করতে পারেনি। বাজারে লেনদেনের পরিমাণ ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে আটকে রয়েছে। মঙ্গলবার লেনদেন হয়েছে ২৬২ কোটি ৮১ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ২৮৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) দুরবস্থায় রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বাজারটির সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৭৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ২৯৫ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে ৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৪৪ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম বেড়েছে ২১টির, কমেছে ২০৩টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২০টির।

বিশ্লেষকদের মতামত : বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারে যে বড় দরপতন হচ্ছে এর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। বিনিয়োগকারীরা হুজুগে শেয়ার বিক্রি করছেন। অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। শেয়ারবাজারের এ দুরবস্থার কারণ হিসেবে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা বলেন, যেটা ঘটার কথা না সেটাই ঘটছে। বিনিয়োগকারীরা বিমুখ হয়ে গেছেন। বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের কোন আস্থা নেই। আস্থা ফেরানোর জন্য কোন চেষ্টা চলছে কিনা, কে জানে। চললেও তা কাজে আসছে না। সার্বিক বাজারের আচরণ এখন অস্বাভাবিক। সরকার চাইলে বাজারে টাকার ব্যবস্থা করতে পারে, কিন্তু করে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, বাজারের ওপর অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা এত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন যে তারা আর কোন ভরসা পাচ্ছেন না। সর্বশেষ ডিএসইর এমডি নিয়োগ নিয়ে বোর্ড সভায় যে ঘটনা ঘটছে তাও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এটা অশনিসংকেত। কেন যেন বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, ডিএসই প্রতিযোগিতা করে দুঃশাসন নিয়ে আসছে বিনিয়োগকারীদের জন্য।

বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ : মামলার ভয় দূরে ঠেলে শেয়ারবাজারের ভয়াবহ দরপতনের প্রতিবাদে মতিঝিলে অবস্থিত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) আগের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন বিনিয়োগকারীরা। মঙ্গলবার দুপুরে ‘বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ’র ব্যানারে এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ থেকে বরাবরের মতো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানানো হয়।

এর আগে দরপতনের প্রতিবাদে দিনের পর দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করায় গত ২৭ আগস্ট ডিএসইর পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। সাধারণ ডায়রিতে বলা হয়েছিল, ২৭ আগস্ট আনুমানিক দুপুর ২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত বাংলাদেশ পুঁজিবাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে ৯-১০ জন লোক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের সামনে ব্যানার ও মাইকসহ বিক্ষোভ মিছিল করে। ফলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাতায়াত এবং অফিসের স্বাভাবিক কার্যক্রম সম্পাদনে বিঘœ ঘটে। এতে উল্লেখ করা হয়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বেশ কিছুদিন ধরে তারা এ ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছে এবং পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্পর্কে সম্মানহানিকর মন্তব্য করছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ মনে করে এ ধরনের কার্যকলাপ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ পুঁজিবাজারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে। ফলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে বলে সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ‘ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ দেশের প্রাচীন বৃহৎ পুঁজিবাজার। একটি জাতীয় ও জনস্বার্থমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার লোকের আগমন ঘটে। ডিএসইর পক্ষ থেকে এই সাধারণ ডায়েরি করা হলে বন্ধ হয়ে যায় বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভ। তবে শেয়ারবাজারে চলতে থাকে দরপতন। দরপতনের ধারা সম্প্রতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

শেষ ৮ কার্যদিবসের মধ্যে সাত দিনই বড় পতন হয়েছে। এই সাত দিনে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৪০০ পয়েন্টের বেশি। এরমধ্যে মঙ্গলবার কমেছে ৮৭ পয়েন্ট। সূচকের এই বড় পতনের প্রতিবাদে লেনদেন শেষ হওয়ার আগেই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন বিনিয়োগকারীরা। আধঘণ্টা চলে এ বিক্ষোভ। বিক্ষোভ থেকে বরাবরের মতো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনের পদত্যাগ দাবি করা হয়।

এসময় বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী বলেন, বিএসইসির এই চেয়ারম্যানকে দায়িত্বে রেখে শেয়ারবাজার ভালো করা যাবে না। আমরা বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চাই। সেই সঙ্গে পুরো কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।

ব্লক মার্কেট : ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মঙ্গলবার ব্লক মার্কেটে মোট ১২ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে। কোম্পানিগুলোর মোট ৪০ লাখ ৭৮ হাজার ২০০টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ১২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের। স্কয়ার ফার্মার ২ কোটি ৯৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন করে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তৃতীয় স্থানে থাকা রেনেটা ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এছাড়া ব্লকে লেনদেন করা অন্য কোম্পানিগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স, ব্র্যাক ব্যাংক, বিএসআরএম লিমিটেড, নাভানা সিএনজি, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ফনিক্স ফাইন্যান্স, এসইএমএল লেকচার ইক্যুয়িটি ম্যানেজমেন্ট, এসকে ট্রিমস ও স্কয়ার ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেড।