মাধ্যমিক ও অন্য স্তরে পাঠ্যবই মুদ্রণে ‘ই-জিপি’ টেন্ডার

যে কোন মূল্যে সিদ্ধান্ত কার্যকরের নির্দেশ শিক্ষা সচিবের

অসাধু মুদ্রাকরদের (প্রিন্টার্স) সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে এবার মাধ্যমিক ও অন্যান্য শিক্ষা স্তরের পাঠ্যবই ছাপতে ‘ই-জিপি’ (ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) অর্থাৎ অনলাইনে দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০২১ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ কার্যক্রম ‘ই-জিপি’ প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হচ্ছে; খুব শীঘ্রই প্রথমবারের মতো এই দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

যদিও মুদ্রাকরদের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সরকারের এই সিদ্ধান্তকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি’র কর্মকর্তারা। তবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর নির্দেশনা অনুযায়ী ‘ই-জিপি’ টেন্ডার আহ্বানের বিষয়ে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে এনসিটিবি।

এদিকে শিক্ষা সচিব মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় ‘পাঠ্যপুস্তক’ মুদ্রণে ‘ই-জিপি’ টেন্ডার আহ্বানের বিষয়ে চূড়ান্ত নির্দেশনা দেয়া হয় এনসিটিবিকে। যেকোন মূল্যে ‘ই-জিপি’ টেন্ডার প্রক্রিয়া কার্যকরের নির্দেশনা দিয়েছেন শিক্ষা সচিব। সভা শেষে এনসিটিবি’র একাধিক কর্মকর্তা সংবাদকে সরকারের এ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

জানা গেছে, অসাধু মুদ্রাকরদের টেন্ডার বাণিজ্যের লাগাম টানতে ২০১১ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে আসছে সরকার। এতে সুফলও মিলছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠান খুব একটা কাজ না পেলেও দেশের অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট অনেকটাই দুর্বল হয়েছে। বই মুদ্রণকাজ প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়েছে। সরকারের মোটা অঙ্কের টাকাও সাশ্রয় হচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রণশিল্পের সম্প্রসারণও ঘটছে। এ অভিজ্ঞতা থেকেই মাধ্যমিক ও অন্যান্য স্তরের পাঠ্যবই ছাপতে ‘ই-জিপি’ দরপত্র প্রক্রিয়া চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

ই-জিপি প্রক্রিয়ায় দরপত্র হলে অসাধু সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে কিনা জানতে চাইলে এনসিটিবি’র সদস্য (টেক্সট) প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘এখন আর কেউ সিন্ডিকেট করতে পারবে না। এনসিটিবিকেও জিম্মি করা যাবে না। কারণ দরপত্র প্রক্রিয়ায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হচ্ছে। মূলত যাদের অনেকগুলো ওয়েব মেশিন আছে এবং যাদের একটিমাত্র ওয়েব মেশিন আছে উভয়ই সমান সুযোগ পাবে। অর্থাৎ সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে। কাজেও অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।’

এনসিটিবি সূত্র জানায়, ২০২০ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই মুদ্রণ করা হয়েছে ৩২০টি লটে। আর ই-জিপি দরপত্রে ওই লট কমিয়ে ২৫০টি নির্ধারণ করা হয়েছে। মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে লট কমানো হয়েছে। এতে যাদের ‘ওয়েব মেশিন’ রয়েছে-এমন প্রায় সব ব্যবসায়ীই কম-বেশি পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ পেতে পারেন।

এদিকে ই-জিপি টেন্ডারের বিষয়ে ইতোমধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ‘সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট’ (সিপিটিইউ) থেকে এনসিটিবি’র ৬০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে জানিয়ে এনসিটিবি বিতরণ নিয়ন্ত্রক প্রফেসর জিয়াউল হক সংবাদকে বলেন, ‘শুধুমাত্র বই ছাপা নয়, কাজ কেনা থেকে শুরু করে এনসিটিবি’র সব কাজেই এখন থেকে ই-জিপি দরপত্র আহ্বান করা হবে।

তিনি আরও জানান, ‘ই-জিপি টেন্ডারের বিষয়ে শতভাগ প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এনসিটিবি। এমনকি পেশাদার প্রিন্টারদেরও (মুদ্রাকর) এনসিটিবি’তে আমন্ত্রণ জানিয়ে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন এ বিষয়ে আর কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।’

গত ১ জানুয়ারি থেকে চলতি ২০২০ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় চার কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর কাছে মোট ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪ কপি বই বিতরণ করেছে এনসিটিবি।

সাধারণত প্রতিবছরের জানুয়ারিতে নতুন বই বিতরণের পর থেকেই পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার প্রক্রিয়া শুরু করতে হয় এনসিটিবিকে। আগস্ট থেকে বই ছাপার কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে নভেম্বর ও ডিসেম্বর নাগাদ বই ছাপা ও বিতরণ কাজ শেষ হয়। প্রায় প্রতিবছরই শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বইয়ের চাহিদাও বাড়ছে। এনসিটিবিকেও বিশাল এই চাপ সামলাতে হচ্ছে।

কিন্তু বই মুদ্রণে প্রচলিত দরপত্র পদ্ধতি অবলম্বন করায় অসাধু ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরেই এনসিটিবিকে জিম্মি করে কখনও প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বেশি কাজ বাগাচ্ছেন। কখনও সঙ্গবদ্ধভাবে উচ্চমূল্যে দরপত্র আহ্বান করছেন। পুরো কাজটিই নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে হওয়ায় এনসিটিবি’কেও কখনও কখনও সিন্ডিকেটের সঙ্গে আপোষ করতে হয়। এবার ই-জিপি দরপত্র আহ্বান করা হলে ওই সিন্ডিকেট ভেঙে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন এনসিটিবি কর্মকর্তারা।

বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২০ , ১ মাঘ ১৪২৬, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

মুদ্রণ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে

মাধ্যমিক ও অন্য স্তরে পাঠ্যবই মুদ্রণে ‘ই-জিপি’ টেন্ডার

যে কোন মূল্যে সিদ্ধান্ত কার্যকরের নির্দেশ শিক্ষা সচিবের

রাকিব উদ্দিন

অসাধু মুদ্রাকরদের (প্রিন্টার্স) সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে এবার মাধ্যমিক ও অন্যান্য শিক্ষা স্তরের পাঠ্যবই ছাপতে ‘ই-জিপি’ (ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) অর্থাৎ অনলাইনে দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০২১ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ কার্যক্রম ‘ই-জিপি’ প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হচ্ছে; খুব শীঘ্রই প্রথমবারের মতো এই দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

যদিও মুদ্রাকরদের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সরকারের এই সিদ্ধান্তকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি’র কর্মকর্তারা। তবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর নির্দেশনা অনুযায়ী ‘ই-জিপি’ টেন্ডার আহ্বানের বিষয়ে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে এনসিটিবি।

এদিকে শিক্ষা সচিব মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় ‘পাঠ্যপুস্তক’ মুদ্রণে ‘ই-জিপি’ টেন্ডার আহ্বানের বিষয়ে চূড়ান্ত নির্দেশনা দেয়া হয় এনসিটিবিকে। যেকোন মূল্যে ‘ই-জিপি’ টেন্ডার প্রক্রিয়া কার্যকরের নির্দেশনা দিয়েছেন শিক্ষা সচিব। সভা শেষে এনসিটিবি’র একাধিক কর্মকর্তা সংবাদকে সরকারের এ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

জানা গেছে, অসাধু মুদ্রাকরদের টেন্ডার বাণিজ্যের লাগাম টানতে ২০১১ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে আসছে সরকার। এতে সুফলও মিলছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠান খুব একটা কাজ না পেলেও দেশের অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট অনেকটাই দুর্বল হয়েছে। বই মুদ্রণকাজ প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়েছে। সরকারের মোটা অঙ্কের টাকাও সাশ্রয় হচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রণশিল্পের সম্প্রসারণও ঘটছে। এ অভিজ্ঞতা থেকেই মাধ্যমিক ও অন্যান্য স্তরের পাঠ্যবই ছাপতে ‘ই-জিপি’ দরপত্র প্রক্রিয়া চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

ই-জিপি প্রক্রিয়ায় দরপত্র হলে অসাধু সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে কিনা জানতে চাইলে এনসিটিবি’র সদস্য (টেক্সট) প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘এখন আর কেউ সিন্ডিকেট করতে পারবে না। এনসিটিবিকেও জিম্মি করা যাবে না। কারণ দরপত্র প্রক্রিয়ায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হচ্ছে। মূলত যাদের অনেকগুলো ওয়েব মেশিন আছে এবং যাদের একটিমাত্র ওয়েব মেশিন আছে উভয়ই সমান সুযোগ পাবে। অর্থাৎ সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে। কাজেও অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।’

এনসিটিবি সূত্র জানায়, ২০২০ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই মুদ্রণ করা হয়েছে ৩২০টি লটে। আর ই-জিপি দরপত্রে ওই লট কমিয়ে ২৫০টি নির্ধারণ করা হয়েছে। মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে লট কমানো হয়েছে। এতে যাদের ‘ওয়েব মেশিন’ রয়েছে-এমন প্রায় সব ব্যবসায়ীই কম-বেশি পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ পেতে পারেন।

এদিকে ই-জিপি টেন্ডারের বিষয়ে ইতোমধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ‘সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট’ (সিপিটিইউ) থেকে এনসিটিবি’র ৬০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে জানিয়ে এনসিটিবি বিতরণ নিয়ন্ত্রক প্রফেসর জিয়াউল হক সংবাদকে বলেন, ‘শুধুমাত্র বই ছাপা নয়, কাজ কেনা থেকে শুরু করে এনসিটিবি’র সব কাজেই এখন থেকে ই-জিপি দরপত্র আহ্বান করা হবে।

তিনি আরও জানান, ‘ই-জিপি টেন্ডারের বিষয়ে শতভাগ প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এনসিটিবি। এমনকি পেশাদার প্রিন্টারদেরও (মুদ্রাকর) এনসিটিবি’তে আমন্ত্রণ জানিয়ে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন এ বিষয়ে আর কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।’

গত ১ জানুয়ারি থেকে চলতি ২০২০ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় চার কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর কাছে মোট ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪ কপি বই বিতরণ করেছে এনসিটিবি।

সাধারণত প্রতিবছরের জানুয়ারিতে নতুন বই বিতরণের পর থেকেই পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার প্রক্রিয়া শুরু করতে হয় এনসিটিবিকে। আগস্ট থেকে বই ছাপার কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে নভেম্বর ও ডিসেম্বর নাগাদ বই ছাপা ও বিতরণ কাজ শেষ হয়। প্রায় প্রতিবছরই শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বইয়ের চাহিদাও বাড়ছে। এনসিটিবিকেও বিশাল এই চাপ সামলাতে হচ্ছে।

কিন্তু বই মুদ্রণে প্রচলিত দরপত্র পদ্ধতি অবলম্বন করায় অসাধু ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরেই এনসিটিবিকে জিম্মি করে কখনও প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বেশি কাজ বাগাচ্ছেন। কখনও সঙ্গবদ্ধভাবে উচ্চমূল্যে দরপত্র আহ্বান করছেন। পুরো কাজটিই নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে হওয়ায় এনসিটিবি’কেও কখনও কখনও সিন্ডিকেটের সঙ্গে আপোষ করতে হয়। এবার ই-জিপি দরপত্র আহ্বান করা হলে ওই সিন্ডিকেট ভেঙে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন এনসিটিবি কর্মকর্তারা।