গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু

নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহ্বান

মাদারীপুরে জনসভায় প্রাদেশিক মন্ত্রী শেখ মুজিবের বক্তৃতা

মাদারীপুর, ২ ফেব্রুয়ারি : গতকল্য পুলিশ ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রাদেশিক শিল্প বাণিজ্য ও দুর্নীতি দমন বিভাগের মন্ত্রী জনাব শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য সকলকে আহ্বান জানান। অপরাহ্ণে বিমানযোগে মন্ত্রী মহোদয় মাদারীপুরে আগমন করিলে এক বিরাট জনতা তাহাকে অভ্যর্থনা ও মাল্যভূষিত করে। অতঃপর তিনি লতিফ ভূঁয়ার কবর জেয়ারত ও আওয়ামী লীগ অফিস, মিউনিসিপ্যাল অফিস পরিদর্শন করেন। বিকালে পুলিশ ময়দানে এক বিরাট জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ মিউনিসিপ্যালিটি রিক্সা মজদুর ইউনিয়ন, ধাঙ্গর ইউনিয়ন প্রভৃতি বহু প্রতিষ্ঠান হইতে তাহাকে মানপত্র প্রদান করা হয়। মানপত্রে মাদারীপুরে যাতায়াত, বেকার সমস্যা, নদীনালা শুকাইয়া যাওয়ার চরমুগরিয়া বন্দরের দুরবস্থার কথা টাকা পয়সা ও পাকা বাড়ির অভাবে স্থানীয় নাজিমুদ্দিন কলেজের বালিকা বিদ্যালয়ের ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দূরবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়। মানপত্রের জবাবে মন্ত্রিসাহেব গত কয়েক বৎসরের সরকারগুলির শোষণ নীতির এক ফিরিস্তি দাখিল করিয়া বলেন, বর্তমান সরকারের হাত শূন্য, তবে জনসাধারণের অবস্থার উন্নতি করার জন্য সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করিয়া তিনি বলেন, ‘আজ হইতে আপনারা হাত তুলিয়া এই প্রতিজ্ঞা করেন, কেহ ঘুষ নিবেন না এবং দিবেন না। সভায় অগণিত জনতা হাত তুলিয়া প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। সন্ধ্যার পরে মন্ত্রি মহোদয় নাজিমুদ্দিন কলেজে আগমন করেন এবং কলেজের অভাব অভিযোগের কথা শ্রবণ করেন। ছাত্রদের পক্ষ হইতে তাহাকে একখানি মানপত্র প্রদান করা হয়। তিনি যথাসাধ্য কলেজকে সাহায্য করিবে বলিয়া জানান। মন্ত্রী সাহেবের আগমনে মাদারীপুরে এক অভূতপূর্ব কর্মচাঞ্চল্যের সাড়া পড়িয়া যায়। সমস্ত শহর সুসজ্জিত করা হয় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরফ হইতে কয়েকটি তোরণ নির্মাণ করা হয়। রাত ১১টায় তিনি গোপালগঞ্জের পথে লঞ্চে আরোহণ করেন।

দৈনিক সংবাদ : ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭

শেখ মুজিবুর কর্তৃক কাউন্সিল সমক্ষে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ঐতিহ্যের রিপোর্ট পেশ

গতকল্য (শুক্রবার) কাগমারীতে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে রিপোর্ট দান প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবুর রহমান দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জনসেবার কাছে আওয়ামী লীগ দলের ঐতিহাসিক ভূমিকা বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বিগত সাধারণ নির্বাচনের পর এটা কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশন। এর পূর্বে আমরা বিগত ১৯ ও ২০ মে (১৯৫৬) তারিখে ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে সমবেত হই। সে আজ নয় মাসের কথা, ইতিমধ্যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহু সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন হয়েছে। দীর্ঘ নয় বৎসর ধরে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে এককভাবে বিরোধী দলের কাজ করে আসছিল। বিরোধিতার জন্যই যে বিরোধিতা করে আসছিল, তা নয়। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে অনাচার, অত্যাচার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতির। কলুষ-কালিমা মুক্ত করে তদস্থলে ন্যায়নীতি, সত্য এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে আসছিল আওয়ামী লীগ। এ সংগ্রামের নেতৃত্ব করেছেন পরম শ্রদ্ধেয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও জনাব সোহরাওয়ার্দী।

ভাইসব, আমাদের এ সংগ্রাম সহজ সংগ্রাম ছিল না, আমাদের অগ্রগতিকে বাধা দেওয়ার জন্য তৎকালীন মুসলিম লীগ দল, এমন কোন উপায় নেই যা অবলম্বন করেনি, এমন কোন অপবাদ নেই যা আমাদের উপর আরোপ করেনি।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শ্রদ্ধেয় মওলানা ভাসানী কিছুদিন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের সভ্য ছিলেন। তিনি বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, মরহুম খাজা নাসেরল্লাহ, জনাব তোফাজ্জল আলী, ডা. মালেক, জনাব ফজলুল হক প্রভৃতিকে দিয়ে মুসলিম লীগকে জনসাধারণের প্রতিনিধি স্থানীয় করবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তদানীন্তন নাজেম মন্ত্রিসভায় তা সহ্য হলো না। তারা জনাব খুররম খান পন্নী দ্বারা শ্রদ্ধেয় মওলানা সাহেবের নির্বাচনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করালেন। মাওলানা সাহেব মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অস্বীকার করেন; ফলে নাজেম মন্ত্রিসভা জিতলেন। এসেম্বলিতে মওলানা ভাসানীর সমালোচনা থেকে তারা মুক্তি পেলেন। অন্য যাদের নাম করেছি তারা একে একে বিদেশ রাষ্ট্রদূত এবং বড় বড় পদ পেয়ে সন্তুষ্টচিত্তে বিদায় নিলেন। তারা বিরোধিতা করছিলেন সুবিধার জন্য, সুবিধা পেতেই তারা নিরস্ত হলেন। এতে পরিষ্কার প্রমাণিত হলো, ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রতি। বগুড়ার মােহাম্মদ আলী, জনাব ফজলুল হক, তোফাজ্জল আলী, প্রভৃতি যে দরদ দেখিয়েছিলেন, তা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, দেশের দশের কোন হিতের জন্য নয়। পশ্চিম বাংলা তথা সমগ্র ভারতের মুসলমানদের জন্য চরম দুর্দিন। জনাব। সোহরাওয়ার্দী তার পক্ষে যতদূর সম্ভব, ভারতীয় মুসলমানদের খেদমত ও সহায়তার জন্য তখনও কলকাতায়। তাদেরই রক্ষার্থ ১৯৪৯ সালে জনাব সোহরাওয়ার্দী শান্তি মিশন নিয়ে ঢাকায় আসলে, নাজেম মন্ত্রিসভা জনাব সোহরাওয়ার্দীর পূর্ববঙ্গ সফরের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তার এলাসিন যাত্রাকালে, বাদামতলী স্টিমার ঘাটে তার উপর নাজেম মন্ত্রিসভার নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।

জনাব সোহরাওয়ার্দী, মিয়া ইফতিখারদ্দীন, মওলানা ভাসানী প্রভৃতি নেতার এক বৈঠক হয় ঢাকায়। একটি বিরোধীদল গঠন সম্বন্ধে আলোচনা হয়। সে আলোচনায় স্থির হয় যে মুসলিম লীগকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানরূপে গঠন করার একটি শেষ চেষ্টা করা হউক। ... করা হয়। আমি অতি কষ্টে গ্রেফতার এড়িয়ে মওলানা সাহেবের নির্দেশে লাহোরে গমন করি। সেখানে আমি জনাব সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং এক সাংবাদিক বৈঠকে মিলিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে তখন যে চ-নীতি অনুসৃত হচ্ছিল, তা জানাই। পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত সংবাদপত্রে আমার সেই সাংবাদিক বৈঠকের বিবরণ ভালভাবে ছাপা হয়। সেখানে মুসলীম লীগের নীতিবিরোধী। নেতাদের এক বৈঠক হয় এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। প্রায় এক মাস পশ্চিম পাকিস্তানে অতিবাহিত করে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার পরে সঙ্গে সঙ্গে আমি গ্রেফতার হই। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক লীগ সরকার প্রবল দমন নীতি পরিচালনা করে আরও শত শত কর্মীকে গ্রেফতার করে।

জনাব সোহরাওয়ার্দী লীগ শাহী কর্তৃক অনুসৃত এই গণতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপের খবর পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেন এবং মওলানা ভাসানী এবং আমাদের মুক্তির জন্য প্রবল আন্দোলন আরম্ভ করেন। আমাদের সকলের গ্রেফতারের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে তখন বিশেষ ত্রাসের সঞ্চার হয়েছিল। তাদের মধ্যে হতাশার লক্ষণও সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। সকলেরই মনে এরূপ ধারণা জন্মে যে লীগ শাহীর বিরুদ্ধে বুঝিবা কিছু করা সম্ভব নয়। ঠিক এ সময়ে জনাব সোহরাওয়ার্দীর পূর্ববঙ্গে আগমন এবং রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য আন্দোলন জনসাধারণের মনে সাহস সঞ্চার করে। জনাব সোহরাওয়ার্দী ব্যাপকভাবে পূর্ববঙ্গ সফর করতে থাকেন। সর্বত্র তার এ আন্দোলনের প্রতি বিপুল সাড়া পরিলক্ষিত হয়।

অসমাপ্ত

বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২০ , ২ মাঘ ১৪২৬, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু

নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহ্বান

মাদারীপুরে জনসভায় প্রাদেশিক মন্ত্রী শেখ মুজিবের বক্তৃতা

মাদারীপুর, ২ ফেব্রুয়ারি : গতকল্য পুলিশ ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রাদেশিক শিল্প বাণিজ্য ও দুর্নীতি দমন বিভাগের মন্ত্রী জনাব শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য সকলকে আহ্বান জানান। অপরাহ্ণে বিমানযোগে মন্ত্রী মহোদয় মাদারীপুরে আগমন করিলে এক বিরাট জনতা তাহাকে অভ্যর্থনা ও মাল্যভূষিত করে। অতঃপর তিনি লতিফ ভূঁয়ার কবর জেয়ারত ও আওয়ামী লীগ অফিস, মিউনিসিপ্যাল অফিস পরিদর্শন করেন। বিকালে পুলিশ ময়দানে এক বিরাট জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ মিউনিসিপ্যালিটি রিক্সা মজদুর ইউনিয়ন, ধাঙ্গর ইউনিয়ন প্রভৃতি বহু প্রতিষ্ঠান হইতে তাহাকে মানপত্র প্রদান করা হয়। মানপত্রে মাদারীপুরে যাতায়াত, বেকার সমস্যা, নদীনালা শুকাইয়া যাওয়ার চরমুগরিয়া বন্দরের দুরবস্থার কথা টাকা পয়সা ও পাকা বাড়ির অভাবে স্থানীয় নাজিমুদ্দিন কলেজের বালিকা বিদ্যালয়ের ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দূরবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়। মানপত্রের জবাবে মন্ত্রিসাহেব গত কয়েক বৎসরের সরকারগুলির শোষণ নীতির এক ফিরিস্তি দাখিল করিয়া বলেন, বর্তমান সরকারের হাত শূন্য, তবে জনসাধারণের অবস্থার উন্নতি করার জন্য সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করিয়া তিনি বলেন, ‘আজ হইতে আপনারা হাত তুলিয়া এই প্রতিজ্ঞা করেন, কেহ ঘুষ নিবেন না এবং দিবেন না। সভায় অগণিত জনতা হাত তুলিয়া প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। সন্ধ্যার পরে মন্ত্রি মহোদয় নাজিমুদ্দিন কলেজে আগমন করেন এবং কলেজের অভাব অভিযোগের কথা শ্রবণ করেন। ছাত্রদের পক্ষ হইতে তাহাকে একখানি মানপত্র প্রদান করা হয়। তিনি যথাসাধ্য কলেজকে সাহায্য করিবে বলিয়া জানান। মন্ত্রী সাহেবের আগমনে মাদারীপুরে এক অভূতপূর্ব কর্মচাঞ্চল্যের সাড়া পড়িয়া যায়। সমস্ত শহর সুসজ্জিত করা হয় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরফ হইতে কয়েকটি তোরণ নির্মাণ করা হয়। রাত ১১টায় তিনি গোপালগঞ্জের পথে লঞ্চে আরোহণ করেন।

দৈনিক সংবাদ : ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭

শেখ মুজিবুর কর্তৃক কাউন্সিল সমক্ষে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ঐতিহ্যের রিপোর্ট পেশ

গতকল্য (শুক্রবার) কাগমারীতে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে রিপোর্ট দান প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবুর রহমান দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জনসেবার কাছে আওয়ামী লীগ দলের ঐতিহাসিক ভূমিকা বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বিগত সাধারণ নির্বাচনের পর এটা কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশন। এর পূর্বে আমরা বিগত ১৯ ও ২০ মে (১৯৫৬) তারিখে ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে সমবেত হই। সে আজ নয় মাসের কথা, ইতিমধ্যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহু সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন হয়েছে। দীর্ঘ নয় বৎসর ধরে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে এককভাবে বিরোধী দলের কাজ করে আসছিল। বিরোধিতার জন্যই যে বিরোধিতা করে আসছিল, তা নয়। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে অনাচার, অত্যাচার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতির। কলুষ-কালিমা মুক্ত করে তদস্থলে ন্যায়নীতি, সত্য এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে আসছিল আওয়ামী লীগ। এ সংগ্রামের নেতৃত্ব করেছেন পরম শ্রদ্ধেয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও জনাব সোহরাওয়ার্দী।

ভাইসব, আমাদের এ সংগ্রাম সহজ সংগ্রাম ছিল না, আমাদের অগ্রগতিকে বাধা দেওয়ার জন্য তৎকালীন মুসলিম লীগ দল, এমন কোন উপায় নেই যা অবলম্বন করেনি, এমন কোন অপবাদ নেই যা আমাদের উপর আরোপ করেনি।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শ্রদ্ধেয় মওলানা ভাসানী কিছুদিন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের সভ্য ছিলেন। তিনি বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, মরহুম খাজা নাসেরল্লাহ, জনাব তোফাজ্জল আলী, ডা. মালেক, জনাব ফজলুল হক প্রভৃতিকে দিয়ে মুসলিম লীগকে জনসাধারণের প্রতিনিধি স্থানীয় করবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তদানীন্তন নাজেম মন্ত্রিসভায় তা সহ্য হলো না। তারা জনাব খুররম খান পন্নী দ্বারা শ্রদ্ধেয় মওলানা সাহেবের নির্বাচনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করালেন। মাওলানা সাহেব মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অস্বীকার করেন; ফলে নাজেম মন্ত্রিসভা জিতলেন। এসেম্বলিতে মওলানা ভাসানীর সমালোচনা থেকে তারা মুক্তি পেলেন। অন্য যাদের নাম করেছি তারা একে একে বিদেশ রাষ্ট্রদূত এবং বড় বড় পদ পেয়ে সন্তুষ্টচিত্তে বিদায় নিলেন। তারা বিরোধিতা করছিলেন সুবিধার জন্য, সুবিধা পেতেই তারা নিরস্ত হলেন। এতে পরিষ্কার প্রমাণিত হলো, ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রতি। বগুড়ার মােহাম্মদ আলী, জনাব ফজলুল হক, তোফাজ্জল আলী, প্রভৃতি যে দরদ দেখিয়েছিলেন, তা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, দেশের দশের কোন হিতের জন্য নয়। পশ্চিম বাংলা তথা সমগ্র ভারতের মুসলমানদের জন্য চরম দুর্দিন। জনাব। সোহরাওয়ার্দী তার পক্ষে যতদূর সম্ভব, ভারতীয় মুসলমানদের খেদমত ও সহায়তার জন্য তখনও কলকাতায়। তাদেরই রক্ষার্থ ১৯৪৯ সালে জনাব সোহরাওয়ার্দী শান্তি মিশন নিয়ে ঢাকায় আসলে, নাজেম মন্ত্রিসভা জনাব সোহরাওয়ার্দীর পূর্ববঙ্গ সফরের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তার এলাসিন যাত্রাকালে, বাদামতলী স্টিমার ঘাটে তার উপর নাজেম মন্ত্রিসভার নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।

জনাব সোহরাওয়ার্দী, মিয়া ইফতিখারদ্দীন, মওলানা ভাসানী প্রভৃতি নেতার এক বৈঠক হয় ঢাকায়। একটি বিরোধীদল গঠন সম্বন্ধে আলোচনা হয়। সে আলোচনায় স্থির হয় যে মুসলিম লীগকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানরূপে গঠন করার একটি শেষ চেষ্টা করা হউক। ... করা হয়। আমি অতি কষ্টে গ্রেফতার এড়িয়ে মওলানা সাহেবের নির্দেশে লাহোরে গমন করি। সেখানে আমি জনাব সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং এক সাংবাদিক বৈঠকে মিলিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে তখন যে চ-নীতি অনুসৃত হচ্ছিল, তা জানাই। পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত সংবাদপত্রে আমার সেই সাংবাদিক বৈঠকের বিবরণ ভালভাবে ছাপা হয়। সেখানে মুসলীম লীগের নীতিবিরোধী। নেতাদের এক বৈঠক হয় এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। প্রায় এক মাস পশ্চিম পাকিস্তানে অতিবাহিত করে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার পরে সঙ্গে সঙ্গে আমি গ্রেফতার হই। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক লীগ সরকার প্রবল দমন নীতি পরিচালনা করে আরও শত শত কর্মীকে গ্রেফতার করে।

জনাব সোহরাওয়ার্দী লীগ শাহী কর্তৃক অনুসৃত এই গণতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপের খবর পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেন এবং মওলানা ভাসানী এবং আমাদের মুক্তির জন্য প্রবল আন্দোলন আরম্ভ করেন। আমাদের সকলের গ্রেফতারের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে তখন বিশেষ ত্রাসের সঞ্চার হয়েছিল। তাদের মধ্যে হতাশার লক্ষণও সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। সকলেরই মনে এরূপ ধারণা জন্মে যে লীগ শাহীর বিরুদ্ধে বুঝিবা কিছু করা সম্ভব নয়। ঠিক এ সময়ে জনাব সোহরাওয়ার্দীর পূর্ববঙ্গে আগমন এবং রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য আন্দোলন জনসাধারণের মনে সাহস সঞ্চার করে। জনাব সোহরাওয়ার্দী ব্যাপকভাবে পূর্ববঙ্গ সফর করতে থাকেন। সর্বত্র তার এ আন্দোলনের প্রতি বিপুল সাড়া পরিলক্ষিত হয়।

অসমাপ্ত