মুজিববর্ষ ও শিশুর সাবলীল পঠন

শরীফুল্লাহ মুক্তি

২০২০ সাল। মুজিববর্ষ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। মুজিববর্ষকে ঘিরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও মুজিববর্ষকে সামনে রেখে নানা ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো মুজিবর্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিশু তাদের বাংলা পাঠ্যবইটি সাবলীলভাবে পড়তে পারবে। এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। এ লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পরিবীক্ষণও করছে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এই মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্যও আমাদের রক্ত দিতে হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা বিরল। কিন্তু বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের একটা বড় অংশ বাংলা ঠিকমতো পড়তে ও লিখতে পারে না। আর নিজ মাতৃভাষায় দুর্বলতার কারণে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য পাঠ্য বিষয়েও কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। তাই মুজিববর্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিশুকে তাদের বাংলা পাঠ্যবইটি স্পষ্ট এবং শুদ্ধ উচ্চারণসহ সাবলীলভাবে পড়তে পারার যোগ্যতা অর্জন করানোর উদ্যোগ অবশ্যই প্রাসঙ্গিক।

ভাষার মাধ্যমে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করি। মানুষ ভাষাকে ব্যবহার করে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে। বাংলা কেবল একটি ভাষাই নয়, শেখার মাধ্যমও বটে। আমাদের দেশে মাতৃভাষা ছাড়াও অন্যান্য বিষয় শেখার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাই ব্যবহৃত হয়। তাই বাংলা ভাষা চর্চার সঙ্গে শিক্ষার পুরো বিষয়টিই অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই মাতৃভাষার ভিত্তিটা মজবুত হওয়া খুবই জরুরি। বিখ্যাত মনীষীদের বিভিন্ন উদ্ধৃতি থেকে মাতৃভাষার ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন’। রামনিধি গুপ্ত বলেছেন, ‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশি ভাষা পুরে কি আশা’।

মনের ভাব প্রকাশ ও যোগাযোগের জন্য আমরা শোনা, বলা, পড়া, লেখা- এই চারটি ভাষাদক্ষতা ব্যবহার করে থাকি। কোন ভাষা আয়ত্ত করার অর্থ হলো ভাষার এই চারটি মৌলিক দক্ষতায় পারদর্শিতা থাকা। ভাষার চারটি মৌলিক দক্ষতার মধ্যে শোনা এবং পড়া হচ্ছে গ্রহণমূলক দক্ষতা, পক্ষান্তরে বলা এবং লেখা হচ্ছে প্রকাশমূলক দক্ষতা। কোন বিষয়বস্তু সম্পর্কে সার্বিক ধারণা লাভের জন্য ভাষার দক্ষতাগুলোর মধ্যে পড়া অন্যমত। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাক্রম একটি যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম। প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে বাংলা বিষয়ে ১৪টি বিষয়ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার মধ্যে পড়ার দক্ষতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৩টি। পড়া সংশ্লিষ্ট বাংলা বিষয়ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতাগুলো হলো- (১) স্পষ্ট, শুদ্ধ ও প্রমিত উচ্চারণে সাবলীলভাবে পড়তে পারা, (২) ছড়া, কবিতা, রূপকথা, গল্প, কথোপকথন, বর্ণনা ইত্যাদি পড়ে মূলভাব বুঝতে পারা, (৩) হাতের লেখা ও মুদ্রিত লেখা পড়তে পারা। কিন্তু আমাদের কোমলমতি শিশুদের অনেকেই বাংলা ঠিকমতো পড়তে ও লিখতে পারে না। আর নিজ মাতৃভাষায় দুর্বলতার কারণে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য পাঠ্য বিষয়েও (যেমন- বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ধর্ম ও মৌলিক শিক্ষা, প্রাথমিক গণিত ইত্যাদি) কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। প্রাথমিক পর্যায়ের কোমলমতি শিশুদের মাতৃভাষায় পড়ার দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করার জন্য এ প্রবন্ধে কতিপয় কৌশল সন্নিবেশ করা হয়েছে। শিক্ষকগণ এ কৌশলগুলো শ্রেণীকক্ষে ব্যবহার করলে পড়ার দক্ষতা অর্জনে শিশুরা স্বাবলম্বী হবে বলে আশা করা যায়।

আমাদের দেশে বিদ্যালয়গুলোতে একই শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীর মেধা ও পাঠগত অবস্থান এক রকম নয়। কাজেই শ্রেণীতে সব শিশুকে একভাবে শেখানো যুক্তিসঙ্গত নয়। তাই বছরের শুরুতেই বেইজলাইন সার্ভের মাধ্যমে শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের শ্রেণীতে পাঠগত অবস্থান যাচাই করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে স্তরভিত্তিক/লেভেলভিত্তিক পাঠদানের ব্যবস্থা করবেন। যেমন- সাবলীলভাবে পড়তে পারা দল, শিক্ষকের আংশিক সহায়তায় পড়তে পারা দল, শিক্ষকের সম্পূর্ণ সহায়তায় পড়তে পারা দল, বর্ণ চিনতে অক্ষম দল।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রারম্ভে শিশুকে ভাষা শিক্ষাদানে যে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হোক না কেন, তাকে বর্ণের ধ্বনি, শব্দ, বাক্য ইত্যাদি প্রমিত উচ্চরণে পড়তে হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে তার পড়ার পরিসর বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে যোগ হয় নতুন নতুন মাত্রা। এক্ষেত্রে শিশুকে যতিচিহ্ন অনুসরণ করে এবং স্বরভঙ্গি ও স্বরাঘাত বজায় রেখে বিষয়বস্তুর অর্থ বা মূলভাব বুঝে পড়তে হয়। পড়ার দক্ষতার ভূমিকা অনেক। পড়ার দক্ষতা শিশুকে বর্ণ ও শব্দ সঠিক উচ্চারণে পড়তে সহায়তা করে, শব্দকে দৃশ্যমান করতে সহায়তা করে, যতিচিহ্ন বজায় রেখে সঠিকভাবে বাক্য ও অনুচ্ছেদ পড়তে আগ্রহী করে। জ্ঞান আহরণ ও তথ্য সংগ্রহে উৎসাহিত করে। ভাবের আদান-প্রদান/যোগাযোগ রক্ষা করতে সহায়তা করে। বিষয়বস্তুর মর্ম অনুধাবনে সহায়তা করে এবং গল্প, কবিতা, নাটক, প্রভৃতি পড়তে কৌতূহলি করে।

পড়ার দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষককে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হয়। কোমলমতি শিশুদের পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি ও ধরে রাখার জন্য শিক্ষকগণ পড়ানোর আগে. পড়ানোর সময়, পড়ানোর পরে কতিপয় কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন-

পড়ানোর আগে আমরা প্রস্ততিমূলক কিছু কাজ করতে পারি। কোনো পাঠাংশ পড়ার জন্য শিশুকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা দরকার। কেননা পাঠের প্রতি শিশুর আগ্রহ সৃষ্টি হলে পড়ার অন্তর্নিহিত সাফল্য অর্জিত হয়। এ জন্য পড়ার পূর্বে শিক্ষককে কতগুলো কাজ অনুসরণ করা দরকার। আনুষ্ঠানিকভাবে পড়া শুরু করার পূর্বে শিক্ষক পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি বা পাঠের শিরোনাম প্রদর্শনপূর্বক পাঠের বিষয়বস্তু কী হতে পারে সে সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করবেন। এতে পড়ার প্রতি শিশুর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। শিক্ষক পাঠ্যাংশটির পূর্বে প্রস্তুতকৃত সহজ পাঠ, মূলভাব বা সারমর্ম তুলে ধরবেন যা শিশুকে পড়ার প্রতি কৌতূহলি করে তুলবে। পাঠ্যাংশ থেকে বাছাইকৃত অজানা/নতুন শব্দের অর্থ, প্রতিশব্দ, যুক্তবর্ণ সম্বলিত শব্দ, সম-উচ্চরিত শব্দ, সমার্থক শব্দ, বিপরীত শব্দ ইত্যাদি শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধির কৌশলগুলো শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে উপস্থাপন করবেন। এতে শিশুর সহজেই বিষয়বস্তুর প্রাথমিক ধারণা লাভ করবে, পড়ার শিশুর আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য পাঠের কোনো মজার ঘটনা বা আনন্দদায়ক অংশের ইঙ্গিত প্রদান করা, পাঠ্যাংশের শেষ দিকের অংশ থেকে দু’একটি প্রশ্ন করা যার উত্তর সরাসরি পাঠে রয়েছে।

পড়ানোর সময় আমাদের কিছু বিশেষ দিকের প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন। শিক্ষক প্রমিত উচ্চরণে স্বরভঙ্গী ও স্বরাঘাত বজায় রেখে পাঠ্যাংশটি সরবে পড়বেন। শিশুরা মনোযোগ সহকারে শুনবে। পরে তাকে অনুসরণ করে শিশুরা পাঠ্যাংশের অন্তর্ভুক্ত বাক্যের প্রতিটি শব্দ আঙুল দ্বারা নির্দেশপূর্বক প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্ষেত্রে সমস্বরে এবং ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণীর ক্ষেত্রে কয়েকবার সরবে পড়বে। এ সময় শিশুরা শব্দগুলো টিকমতো নির্দেশ করে পড়ছে কিনা তা নিশ্চিত করা জরুরি। অতঃপর দল গঠন করে দলনেতা/পরাগ শিশুর সহযোগিতায় দলে একটি বই ব্যবহার করে পড়তে বলবেন। পরে শ্রবণযোগ্য স্বরে ও প্রমিত উচ্চারণে প্রায় সব শিশুকে এক এক করে পাঠ্যাংশটি পড়তে বলবেন অন্যরা শুনবে ও প্রতিটি শব্দ আঙুল দ্বারা নির্দেশ করে পড়া অনুসরণ করবে। বিষয়বস্তু সাধারণভাবে বোঝার জন্য শিশুর পড়ার ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষককে প্রশ্নোত্তরে আলোচনার সুযোগ রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন- বিষয়স্তুর সংগে সঙ্গতি রেখে এরপর কী হতে পারে? মাঝে মাঝে তা জিজ্ঞাসা করা, বিষয়বস্তুর সূত্র ধরে তুমি হলে কী করতে?-এ ধরনের প্রশ্ন করা, বিষয়স্তু সম্পর্কে সাধারণ ধারণা লাভ ও পাঠ্যাংশের ধারবাহিকতা রক্ষার জন্য কতগুলো প্রশ্ন করা। যেমন- এরপর কী হলো? কোন পাঠ্যাংশ শিক্ষার্থী পড়ে কতটুকু বুঝেছে তা যাচাইয়ের জন্য কতকগুলো প্রশ্ন করা দরকার। যেমন: কেন এসব হলো? বা কীভাবে হলো? ইত্যাদি।

পড়ানোর পরেও আরও কিছু কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। যেমন- বিষয়স্তুর মূলভাব গভীরভাবে বুঝার জন্য কয়েকবার (৩য়-৫ম শ্রেণীর ক্ষেত্রে) নীরব পাঠের ব্যবস্থা করা দরকার। এরপর পাঠের কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য বের করার জন্য কিছু প্রশ্ন করা যায় উত্তর সরাসরি পাঠ্যাংশে আছে। অতঃপর কয়েকটি উন্মুক্ত প্রশ্ন করা যার উত্তর সরাসরি পাঠ্যাংশে দেয়া নেই। যে ধরনের প্রশ্নের উত্তর শুধু পাঠ্যাংশের মূলভাব অনুধাবন করে দেয়া সম্ভব। এছাড়া পাঠ্যাংশটি গভীরভাবে বোঝার জন্য আলোচনার ব্যবস্থা করা যায় যা শিশুর নিজস্ব চিন্তাশক্তি বা মননের সমন্বয় সাধন করতে সহায়তা করে। পড়ার পর অনুসরণীয় কতিপয় দিক নি¤েœ দেয়া হলো-কোনো কিছু পড়ে তার সুনির্দিষ্ট বা বিশেষ তথ্য প্রশ্নের মাধ্যমে খুঁজে বের করা। যেমন: কত সালে, কোন রোগ, কোন কারণে ইত্যাদি। গল্পের মূল চরিত্র/ঘটনাগুলো শিশুর সহযোগিতায় বোর্ডে লেখা, গল্পের অনুভূতি বা মূলভাবকে ব্যক্ত করার জন্য শিশুদের দ্বারা চরিত্র রূপায়ণ করা। এক্ষেত্রে শিক্ষক ‘কেন’ দ্বারা প্রশ্ন করবেন, পঠিত পাঠ্যাংশটির সঙ্গে শিশুর দৈনন্দিন জীবনকে সম্পৃক্ত করে পাঠবহির্ভূত বিভিন্ন ধরনের বাক্য তৈরি। মূলভাব ঠিক রেখে নতুন গল্প, কবিতা বলা বা লেখার ব্যবস্থা করা।

শিশুরা সবাই মৌখিক ভাষার ব্যবহার জানে। তাদের আয়ত্তে একটি সমৃদ্ধ মৌখিক শব্দভা-ার ও বাক্য-কাঠামো থাকে। এ সব শব্দ দিয়ে সে বয়স ও সামর্থ্য অনুযায়ী শব্দ ব্যবহার করে ছোট ছোট বাক্য গঠন করতে পারে। প্রথমে শিশুর এ দক্ষতা শুধু বলা ও শোনার মধ্যেই সীমিত থাকে। শিক্ষকগণ ধীরে ধীরে মৌখিক ভাষার যে একটি লিখিত রূপ আছে তার সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করান। লিখিত কোন কিছু কারো কোনো রকম সাহায্য ছাড়া অর্থ বুঝে, বিরামচিহ্ন ঠিক রেখে সাবলীলভাবে পড়তে পারার ক্ষমতাকে পঠন-দক্ষতা বলা যেতে পারে। মানসম্মত পঠন-দক্ষতা হলো প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণী বয়সী শিশুদের প্রতি মিনিটে ৪৫-৬০টি শব্দ পড়ে তার অর্থ বুঝতে পারা।

শব্দ শেখানোর সময় শিক্ষককে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। যেমন- একসঙ্গে খুব বেশি শব্দ শেখানো উচিত নয়, প্রতিদিন একটি করে নতুন শব্দ শেখানো, শিক্ষার্থীর চাহিদা অনুযায়ী শব্দ শেখানো, ধারাবাহিক ও নিয়মিতভাবে নতুন শব্দ শেখানো। শব্দভা-ার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভাষার চারটি দক্ষতারই সমন্বয় করা আবশ্যক। শিক্ষার্থীর সরব পাঠের পূর্বেই পাঠ্যাংশে ব্যবহৃত নতুন শব্দগুলো শেখানো প্রয়োজন, পর্যায়ক্রমে শব্দের প্রমিত উচ্চারণ, বানান, অর্থ ও পাঠ্যাংশ বহির্ভূত বাক্যে প্রয়োগ শেখানো আবশ্যক। ধারণামূলক শব্দ (মমতা, আনন্দ, অসীম ইত্যাদি) সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা/বিশ্লেষণ/তুলনা করে বোঝানো প্রয়োজন। শিশুর শব্দভা-ার বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক অনুশীলনের সুযোগ থাকা প্রয়োজন।

শব্দ শেখানোর ক্ষেত্রে শিক্ষককে কিছু কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হয়। যেমন- অজানা বা নতুন শব্দগুলো বাছাই করে একটি একটি করে বোর্ডে লেখা, বস্তুবাচক শব্দ হলে প্রথমে ছবি, পরে শব্দকার্ড দেখানো বা শব্দ বোর্ডে লেখা, ভাবমূলক/ধারণামূলক শব্দ হলে সাধারণত: ব্যাখ্যা করা, তুলনা করা বা বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা (যেমন: ‘স্বচ্ছ’ শব্দটি বুঝানোর জন্য দুইটি কাঁচের গ্লাস ব্যবহার করা যেতে পারে যার একটিতে ঘোলা পানি এবং অন্যটিতে পরিস্কার পানি)। শব্দটি প্রমিত উচ্চরণে বরাবর অনুশীলন করানো। যুক্তবর্ণ থাকলে ভেঙে দেখানো, শব্দস্থিত প্রতিটি বর্ণের ধ্বনি সহযোগে বানান অনুশীলন করানো। প্রথম শ্রেণীর ক্ষেত্রে শব্দটি ভেঙে নির্দিষ্ট বর্ণটি শেখানো। শব্দটির অর্থ বলতে শিশুদের উৎসাহিত করা। শব্দটির প্রতিশব্দ, সম-উচ্চারিত শব্দ, বিপরীত শব্দ বলতে উৎসাহিত করা। শব্দ দিয়ে বাক্য রচনা করতে দেয়া। এটি কোন পদের অন্তর্গত তা নির্ণয় করতে সহায়তা করা। শব্দটি দিয়ে পাঠের বহির্ভূত বাক্য রচনা করতে দেয়া। শিক্ষকগণ শ্রেণী ও পাঠ-অনুযায়ী শব্দভা-ার বৃদ্ধির কৌশলগুলো শনাক্ত করে শ্রেণীকক্ষে প্রয়োগ করবেন।

যে সব শব্দ বর্ণ না চিনেও শিশু বার বার দেখে ও শুনে চিহ্নিত করতে পারে সেগুলোকে দৃশ্যমান শব্দ (Sight vocbulary) বলা যায়। সাধারণত দৃশ্যমান শব্দগুলোকে শিশুমনে জীবন্ত ছবির মত ভেসে ওঠে। এ ধরনের শব্দ শিশু কখনও বানান করে পড়ে না। শব্দটাই তার কাছে সমগ্ররূপে ধরা পড়ে। যেমন: শিশুরা ‘আমার’ শব্দটি দেখেই আমার বলতে পারে, কিন্তু সে বানান করতে পারে না। শিশুরা কোনো শব্দ আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে শব্দটি পড়ে শেখে না। অর্থাৎ শিশুরা কোন পরিচিত শব্দ, বর্ণ-বিন্যাসের ক্রম অনুযায়ী ভেঙে বানান করে পড়ে না। পুরো শব্দটিকেই ধারণ করে একত্রে পড়ে। যেমন- একটি হরিণের ছবি দেখেই ‘হরিণ’ বলতে পারে। তার হাত, পা, নখ, চোখ ইত্যাদি আলাদাভাবে বিবেচনা করে ছবিটিকে হরিণ বলে না। শিশুর শব্দ ভা-ার বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটি একটি কার্যকর কৌশল। দৃশ্যমান শব্দ পদ্ধতিতে বহুল ব্যবহৃত শব্দসমূহের প্রতি বেশি জোর দেয়া হয়। প্রতিটি ভাষায় ১০০ থেকে ১৫০টির মতো শব্দ আছে যেগুলো সাধারণ কথা-বার্তায় ব্যবহৃত শব্দের ৮০% হয়ে থাকে। সাধারণ বাক্যের মধ্যে ব্যবহার করে এই শব্দ দেখতে ও বলতে শেখানো হয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ বাক্য বারবার ব্যবহার করে শেখানো, যাতে নব্য পড়–য়ারা সহজেই শব্দগুলো শনাক্ত করতে পারে। বাক্যে শব্দগুলো বারবার ব্যবহারের ফলে এটা শিক্ষার্থীদের দৃশ্যমান শব্দভা-ারে পরিণত হয়। তবে এর জন্য যথেষ্ট অনুশীলনের প্রয়োজন। ১ম পাঠে প্রতিটি শব্দ ৫ বার থেকে ১৫ বার পুনরাবৃত্তি করা প্রয়োজন। এইভাবে শিক্ষার্থীর দৃশ্যমান শব্দভা-ার গড়ে উঠবে।

শিশুর পড়ার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য রিডিং-চার্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। পাঠ্য বইয়ের পড়ানো গল্পের সংক্ষিপ্তসার বড় কাগজে লিখে রিডিং-চার্ট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এই চার্ট বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া শ্রেণীতে পঠিত অংশের শব্দ নিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক গল্প, ছড়া, কবিতা তৈরি করতে পারেন এবং সেগুলো বড় বড় করে চার্ট ও কার্ডে লিখে রিডিং চার্ট ও রিডিং কার্ড তৈরি করবেন। শ্রেণীকক্ষে চার্ট টানিয়ে শিক্ষক নির্দেশক কাঠি ব্যবহার করে জোরে জোরে পড়বেন। সঙ্গে শিক্ষার্থীরাও পড়বে। প্রতি বেঞ্চে তিনজন শিক্ষার্থী বসিয়ে একটি করে কার্ড দিয়ে পড়ানো যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একজন পড়বে অন্যরা দেখবে। শিক্ষক পুরো শ্রেণীকক্ষ ঘুরে ঘুরে দেখবেন। প্রয়োজনে শিক্ষক যাচাই করে দেখতে পারেন শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে পড়ছে কি না। রিডিং-চার্ট থেকে একটি অনুচ্ছেদ বোর্ডে লেখা যেতে পারে যাতে মাঝে মাঝে শব্দ বাদ দিয়ে লেখা থাকবে। শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শব্দ দিয়ে শূন্যস্থান পুরণ করবে। এক্ষেত্রে বইয়ের শব্দ হুবহু না এসে নতুন শব্দ আসতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার পরিচয়ও পাওয়া যাবে।

শিশুদের পঠন-দক্ষতা বাড়ানার জন্য বেশি বেশি বই পড়তে দিতে হবে। তবে শিশুদের যে কোনো বই পড়তে দিলেই হবে না- এতে হিতে বিপরীতও হতে পারে। শিশুদের বই নির্বাচনের সময় কিছু বিশেষ দিকে লক্ষ রাখা দরকার। যেমন- বইটি বড় বড় অক্ষরে স্পষ্ট করে লেখা থাকবে, শিশুদের বইয়ে শিশুদের পরিচিত শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরি থাকবে, বাক্যগুলো অর্থপূর্ণ হবে, বাক্যের মধ্যে ধারাবাহিকতা থাকতে হবে, শিশুদের পরিচিত জগৎ সম্পর্কে কথা থাকতে হবে, বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল রেখে আকর্ষণীয় রঙ্গিন ছবি থাকতে হবে, শব্দের পুনরাবৃত্তি থাকতে হবে, বইয়ের লেখাগুলো পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ামূলক হতে হবে। শিশুদের জন্য বইয়ের লেখাগুলো যেন মুখের কথার মতো মনে হয়।

শিশুদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বিবেচনা করে বিভিন্ন শিশুতোষ গল্প ও কবিতার বই সংগ্রহ করে শিশুদের নিয়মিত পড়তে দিতে হবে। এ ব্যাপারে শিশু একাডেমি, ব্র্যাক, সংবাদপত্রের শিশু-কিশোর কলাম বা অন্য যে কোনো প্রকাশনার উপকরণ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি বইয়ে যতগুলো গল্প আছে তা কেটে নিয়ে শক্ত কাগছে পেস্ট করে অপর পৃষ্ঠায় ওই গল্পের উপর কিছু প্রশ্ন লিখে দিতে হবে। প্রতিটি গল্প লেমিনেটিং করে বা পলিথিনের স্বচ্ছ প্যাকেটে মুড়ে দিলে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যেতে পারে। সপ্তাহে এক বা দুইদিন এই উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে। দলগতভাবে পড়তে দিলে অল্প সংখ্যক বই দিয়ে অনেক শিক্ষার্থী পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে। কিছু কিছু উপকরণ সংশ্লিষ্ট শিক্ষক নিজে তৈরি করবেন। তখন লক্ষ রাখবেন যেন গল্পে ব্যবহৃত শব্দ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের উপযোগী শব্দ হয়। দলগতভাবে পড়তে দেয়ার ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে দলীয় সদস্যগণের মধ্যে যেন সবল ও দুর্বল শিক্ষার্থীর মিশ্রণ থাকে। শ্রেণীর সকল শিক্ষার্থীর পঠন-দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষক পালাক্রমে সকল শিক্ষার্থীর ১ মিনিট রিডিং এককভাবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবেন (ঙহব ঃড় ড়হব ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয) এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করবেন। অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দেবেন।

কোমলমতি শিশুদের পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। বইয়ের ছবি দেখিয়ে গল্প বলা, পাঠ্য বইয়ের ছবি নিয়ে আলোচনা করা, প্রতিদিন রিডিং পড়ানো, বেশি করে ছবির বই দেখতে দেয়া, পছন্দমতো বই দেখতে দেয়া, শিশুদের উপযোগী পত্র-পত্রিকা পড়তে দেয়া, কোনো লেখা পড়তে দেয়া, দেশ-বিদেশের খবর শোনানো ইত্যাদি উপায়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায়।

শিশুকে সাবলীল পাঠক তৈরিতে বিদ্যালয়ের পাশাপাশি পরিবারকেও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। প্রতিদিন পারিবারিকভাবেও একটি নির্দিষ্ট সময় পড়ার অভ্যাস করতে হবে। বড়দের পড়তে দেখলে শিশুরাও পড়তে উৎসাহিত বোধ করে এবং শিশুর আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। শিশুর বই রাখতে হবে হাতের কাছে- তার যখন ইচ্ছে তখন যেন পড়তে পারে। যেমন- বেডরুমে, ড্রয়িংরুমে, গাড়িতে, রিডিং-কর্নারে। পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য শিশুকে মাঝে মাঝে বইয়ের দোকানে বা পাঠাগারে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে এবং তার পছন্দ মতো বই কিনে দিতে হবে। নতুন বই পেলে শিশুর পড়ার আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। বাবা-মা/অভিভাবকদের উচিত শিশুকে পড়ার জন্য উৎসাহিত করা। আবার পড়তে না পারার জন্য কখনও তিরস্কার করা যাবে না।

শিশুর সার্বিক মঙ্গল ও উন্নতি সাধনের জন্য পড়ার দক্ষতা অর্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। শিশুর ব্যক্তিগত অর্জন, সামাজিক উন্নতি কিংবা শিক্ষায় সাফল্য সর্বোপরি ভবিষ্যত পেশাজীবনে উন্নতির পিছনে পড়ার দক্ষতা ব্যাপকভাবে ভুমিকা রাখে। বিশেষত পড়ার দক্ষতা ব্যতীত ভাষাশিক্ষার অর্জন ও খ্যাতি অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়। পড়ার দক্ষতা শিশুর সামনে জ্ঞানের দরজা উন্মুক্ত করে দেয় এবং মানুষ হিসেবে সীমাবদ্ধতা দূরীভূত করতে সহায়তা করে। প্রাথমিক স্তরের পড়া দুটি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে হয়। প্রথমত পড়ার জন্য শিখন এবং দ্বিতীয়ত শিখনের জন্য পড়া। প্রথম পর্যায়ে শিশু কিভাবে পড়তে হয় তা আয়ত্ত করে, দ্বিতীয় পর্যায়ে শিশু তার অর্জিত দক্ষতা ব্যবহার করে বিষয়জ্ঞান লাভ করে। প্রথম পর্যায় থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত হতে পারাটাই হচ্ছে প্রাথমিক স্তরের শিশুর জন্য শ্রেষ্ঠ অর্জন।

বাংলার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশটি স্বাধীন না করলে আমরা প্রিয় বাংলাদেশ পেতাম না। তিনি ক্ষণজন্মা জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ ও একটি পতাকা উপহার দিয়ে গেছেন। তার জন্ম না হলে হয়তো আজও আমাদের পরাধীন হয়ে থাকতে হতো। আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারতাম না, আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারতাম না। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীভাষা হিসেবে পেতে, স্বাধীন বাংলাদেশকে পেতে আমাদের অনেক কিছু হারাতে হয়েছে। কাজেই দাম দিয়ে কেনা বাংলাভাষার প্রতি আমাদের আরও গুরুত্ব দেয়া এবং যতœশীল হওয়া উচিত। মুজিববর্ষে সকল শিশুকে তার বাংলা পাঠ্যবই বা সমমানের সম্পুরক পঠনসামগ্রী স্পষ্ট, শুদ্ধ ও সাবলীলভাবে পড়তে পারার যোগ্যতা অর্জন করানোর মাধ্যমে জাতির পিতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে। আর আমরা এটা সফল করবো- এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। এর জন্য সকলকেই যার যার অবস্থান থেকে কাজ করা উচিত।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষা-গবেষক ও ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি), বারহাট্টা, নেত্রকোনা।

ahmsharifullah@yahoo.com

বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২০ , ২ মাঘ ১৪২৬, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

মুজিববর্ষ ও শিশুর সাবলীল পঠন

শরীফুল্লাহ মুক্তি

২০২০ সাল। মুজিববর্ষ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। মুজিববর্ষকে ঘিরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও মুজিববর্ষকে সামনে রেখে নানা ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো মুজিবর্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিশু তাদের বাংলা পাঠ্যবইটি সাবলীলভাবে পড়তে পারবে। এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। এ লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পরিবীক্ষণও করছে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এই মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্যও আমাদের রক্ত দিতে হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা বিরল। কিন্তু বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের একটা বড় অংশ বাংলা ঠিকমতো পড়তে ও লিখতে পারে না। আর নিজ মাতৃভাষায় দুর্বলতার কারণে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য পাঠ্য বিষয়েও কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। তাই মুজিববর্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিশুকে তাদের বাংলা পাঠ্যবইটি স্পষ্ট এবং শুদ্ধ উচ্চারণসহ সাবলীলভাবে পড়তে পারার যোগ্যতা অর্জন করানোর উদ্যোগ অবশ্যই প্রাসঙ্গিক।

ভাষার মাধ্যমে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করি। মানুষ ভাষাকে ব্যবহার করে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে। বাংলা কেবল একটি ভাষাই নয়, শেখার মাধ্যমও বটে। আমাদের দেশে মাতৃভাষা ছাড়াও অন্যান্য বিষয় শেখার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাই ব্যবহৃত হয়। তাই বাংলা ভাষা চর্চার সঙ্গে শিক্ষার পুরো বিষয়টিই অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই মাতৃভাষার ভিত্তিটা মজবুত হওয়া খুবই জরুরি। বিখ্যাত মনীষীদের বিভিন্ন উদ্ধৃতি থেকে মাতৃভাষার ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন’। রামনিধি গুপ্ত বলেছেন, ‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশি ভাষা পুরে কি আশা’।

মনের ভাব প্রকাশ ও যোগাযোগের জন্য আমরা শোনা, বলা, পড়া, লেখা- এই চারটি ভাষাদক্ষতা ব্যবহার করে থাকি। কোন ভাষা আয়ত্ত করার অর্থ হলো ভাষার এই চারটি মৌলিক দক্ষতায় পারদর্শিতা থাকা। ভাষার চারটি মৌলিক দক্ষতার মধ্যে শোনা এবং পড়া হচ্ছে গ্রহণমূলক দক্ষতা, পক্ষান্তরে বলা এবং লেখা হচ্ছে প্রকাশমূলক দক্ষতা। কোন বিষয়বস্তু সম্পর্কে সার্বিক ধারণা লাভের জন্য ভাষার দক্ষতাগুলোর মধ্যে পড়া অন্যমত। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাক্রম একটি যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম। প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে বাংলা বিষয়ে ১৪টি বিষয়ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার মধ্যে পড়ার দক্ষতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৩টি। পড়া সংশ্লিষ্ট বাংলা বিষয়ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতাগুলো হলো- (১) স্পষ্ট, শুদ্ধ ও প্রমিত উচ্চারণে সাবলীলভাবে পড়তে পারা, (২) ছড়া, কবিতা, রূপকথা, গল্প, কথোপকথন, বর্ণনা ইত্যাদি পড়ে মূলভাব বুঝতে পারা, (৩) হাতের লেখা ও মুদ্রিত লেখা পড়তে পারা। কিন্তু আমাদের কোমলমতি শিশুদের অনেকেই বাংলা ঠিকমতো পড়তে ও লিখতে পারে না। আর নিজ মাতৃভাষায় দুর্বলতার কারণে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য পাঠ্য বিষয়েও (যেমন- বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ধর্ম ও মৌলিক শিক্ষা, প্রাথমিক গণিত ইত্যাদি) কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। প্রাথমিক পর্যায়ের কোমলমতি শিশুদের মাতৃভাষায় পড়ার দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করার জন্য এ প্রবন্ধে কতিপয় কৌশল সন্নিবেশ করা হয়েছে। শিক্ষকগণ এ কৌশলগুলো শ্রেণীকক্ষে ব্যবহার করলে পড়ার দক্ষতা অর্জনে শিশুরা স্বাবলম্বী হবে বলে আশা করা যায়।

আমাদের দেশে বিদ্যালয়গুলোতে একই শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীর মেধা ও পাঠগত অবস্থান এক রকম নয়। কাজেই শ্রেণীতে সব শিশুকে একভাবে শেখানো যুক্তিসঙ্গত নয়। তাই বছরের শুরুতেই বেইজলাইন সার্ভের মাধ্যমে শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের শ্রেণীতে পাঠগত অবস্থান যাচাই করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে স্তরভিত্তিক/লেভেলভিত্তিক পাঠদানের ব্যবস্থা করবেন। যেমন- সাবলীলভাবে পড়তে পারা দল, শিক্ষকের আংশিক সহায়তায় পড়তে পারা দল, শিক্ষকের সম্পূর্ণ সহায়তায় পড়তে পারা দল, বর্ণ চিনতে অক্ষম দল।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রারম্ভে শিশুকে ভাষা শিক্ষাদানে যে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হোক না কেন, তাকে বর্ণের ধ্বনি, শব্দ, বাক্য ইত্যাদি প্রমিত উচ্চরণে পড়তে হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে তার পড়ার পরিসর বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে যোগ হয় নতুন নতুন মাত্রা। এক্ষেত্রে শিশুকে যতিচিহ্ন অনুসরণ করে এবং স্বরভঙ্গি ও স্বরাঘাত বজায় রেখে বিষয়বস্তুর অর্থ বা মূলভাব বুঝে পড়তে হয়। পড়ার দক্ষতার ভূমিকা অনেক। পড়ার দক্ষতা শিশুকে বর্ণ ও শব্দ সঠিক উচ্চারণে পড়তে সহায়তা করে, শব্দকে দৃশ্যমান করতে সহায়তা করে, যতিচিহ্ন বজায় রেখে সঠিকভাবে বাক্য ও অনুচ্ছেদ পড়তে আগ্রহী করে। জ্ঞান আহরণ ও তথ্য সংগ্রহে উৎসাহিত করে। ভাবের আদান-প্রদান/যোগাযোগ রক্ষা করতে সহায়তা করে। বিষয়বস্তুর মর্ম অনুধাবনে সহায়তা করে এবং গল্প, কবিতা, নাটক, প্রভৃতি পড়তে কৌতূহলি করে।

পড়ার দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষককে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হয়। কোমলমতি শিশুদের পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি ও ধরে রাখার জন্য শিক্ষকগণ পড়ানোর আগে. পড়ানোর সময়, পড়ানোর পরে কতিপয় কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন-

পড়ানোর আগে আমরা প্রস্ততিমূলক কিছু কাজ করতে পারি। কোনো পাঠাংশ পড়ার জন্য শিশুকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা দরকার। কেননা পাঠের প্রতি শিশুর আগ্রহ সৃষ্টি হলে পড়ার অন্তর্নিহিত সাফল্য অর্জিত হয়। এ জন্য পড়ার পূর্বে শিক্ষককে কতগুলো কাজ অনুসরণ করা দরকার। আনুষ্ঠানিকভাবে পড়া শুরু করার পূর্বে শিক্ষক পাঠসংশ্লিষ্ট ছবি বা পাঠের শিরোনাম প্রদর্শনপূর্বক পাঠের বিষয়বস্তু কী হতে পারে সে সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করবেন। এতে পড়ার প্রতি শিশুর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। শিক্ষক পাঠ্যাংশটির পূর্বে প্রস্তুতকৃত সহজ পাঠ, মূলভাব বা সারমর্ম তুলে ধরবেন যা শিশুকে পড়ার প্রতি কৌতূহলি করে তুলবে। পাঠ্যাংশ থেকে বাছাইকৃত অজানা/নতুন শব্দের অর্থ, প্রতিশব্দ, যুক্তবর্ণ সম্বলিত শব্দ, সম-উচ্চরিত শব্দ, সমার্থক শব্দ, বিপরীত শব্দ ইত্যাদি শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধির কৌশলগুলো শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে উপস্থাপন করবেন। এতে শিশুর সহজেই বিষয়বস্তুর প্রাথমিক ধারণা লাভ করবে, পড়ার শিশুর আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য পাঠের কোনো মজার ঘটনা বা আনন্দদায়ক অংশের ইঙ্গিত প্রদান করা, পাঠ্যাংশের শেষ দিকের অংশ থেকে দু’একটি প্রশ্ন করা যার উত্তর সরাসরি পাঠে রয়েছে।

পড়ানোর সময় আমাদের কিছু বিশেষ দিকের প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন। শিক্ষক প্রমিত উচ্চরণে স্বরভঙ্গী ও স্বরাঘাত বজায় রেখে পাঠ্যাংশটি সরবে পড়বেন। শিশুরা মনোযোগ সহকারে শুনবে। পরে তাকে অনুসরণ করে শিশুরা পাঠ্যাংশের অন্তর্ভুক্ত বাক্যের প্রতিটি শব্দ আঙুল দ্বারা নির্দেশপূর্বক প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্ষেত্রে সমস্বরে এবং ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণীর ক্ষেত্রে কয়েকবার সরবে পড়বে। এ সময় শিশুরা শব্দগুলো টিকমতো নির্দেশ করে পড়ছে কিনা তা নিশ্চিত করা জরুরি। অতঃপর দল গঠন করে দলনেতা/পরাগ শিশুর সহযোগিতায় দলে একটি বই ব্যবহার করে পড়তে বলবেন। পরে শ্রবণযোগ্য স্বরে ও প্রমিত উচ্চারণে প্রায় সব শিশুকে এক এক করে পাঠ্যাংশটি পড়তে বলবেন অন্যরা শুনবে ও প্রতিটি শব্দ আঙুল দ্বারা নির্দেশ করে পড়া অনুসরণ করবে। বিষয়বস্তু সাধারণভাবে বোঝার জন্য শিশুর পড়ার ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষককে প্রশ্নোত্তরে আলোচনার সুযোগ রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন- বিষয়স্তুর সংগে সঙ্গতি রেখে এরপর কী হতে পারে? মাঝে মাঝে তা জিজ্ঞাসা করা, বিষয়বস্তুর সূত্র ধরে তুমি হলে কী করতে?-এ ধরনের প্রশ্ন করা, বিষয়স্তু সম্পর্কে সাধারণ ধারণা লাভ ও পাঠ্যাংশের ধারবাহিকতা রক্ষার জন্য কতগুলো প্রশ্ন করা। যেমন- এরপর কী হলো? কোন পাঠ্যাংশ শিক্ষার্থী পড়ে কতটুকু বুঝেছে তা যাচাইয়ের জন্য কতকগুলো প্রশ্ন করা দরকার। যেমন: কেন এসব হলো? বা কীভাবে হলো? ইত্যাদি।

পড়ানোর পরেও আরও কিছু কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। যেমন- বিষয়স্তুর মূলভাব গভীরভাবে বুঝার জন্য কয়েকবার (৩য়-৫ম শ্রেণীর ক্ষেত্রে) নীরব পাঠের ব্যবস্থা করা দরকার। এরপর পাঠের কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য বের করার জন্য কিছু প্রশ্ন করা যায় উত্তর সরাসরি পাঠ্যাংশে আছে। অতঃপর কয়েকটি উন্মুক্ত প্রশ্ন করা যার উত্তর সরাসরি পাঠ্যাংশে দেয়া নেই। যে ধরনের প্রশ্নের উত্তর শুধু পাঠ্যাংশের মূলভাব অনুধাবন করে দেয়া সম্ভব। এছাড়া পাঠ্যাংশটি গভীরভাবে বোঝার জন্য আলোচনার ব্যবস্থা করা যায় যা শিশুর নিজস্ব চিন্তাশক্তি বা মননের সমন্বয় সাধন করতে সহায়তা করে। পড়ার পর অনুসরণীয় কতিপয় দিক নি¤েœ দেয়া হলো-কোনো কিছু পড়ে তার সুনির্দিষ্ট বা বিশেষ তথ্য প্রশ্নের মাধ্যমে খুঁজে বের করা। যেমন: কত সালে, কোন রোগ, কোন কারণে ইত্যাদি। গল্পের মূল চরিত্র/ঘটনাগুলো শিশুর সহযোগিতায় বোর্ডে লেখা, গল্পের অনুভূতি বা মূলভাবকে ব্যক্ত করার জন্য শিশুদের দ্বারা চরিত্র রূপায়ণ করা। এক্ষেত্রে শিক্ষক ‘কেন’ দ্বারা প্রশ্ন করবেন, পঠিত পাঠ্যাংশটির সঙ্গে শিশুর দৈনন্দিন জীবনকে সম্পৃক্ত করে পাঠবহির্ভূত বিভিন্ন ধরনের বাক্য তৈরি। মূলভাব ঠিক রেখে নতুন গল্প, কবিতা বলা বা লেখার ব্যবস্থা করা।

শিশুরা সবাই মৌখিক ভাষার ব্যবহার জানে। তাদের আয়ত্তে একটি সমৃদ্ধ মৌখিক শব্দভা-ার ও বাক্য-কাঠামো থাকে। এ সব শব্দ দিয়ে সে বয়স ও সামর্থ্য অনুযায়ী শব্দ ব্যবহার করে ছোট ছোট বাক্য গঠন করতে পারে। প্রথমে শিশুর এ দক্ষতা শুধু বলা ও শোনার মধ্যেই সীমিত থাকে। শিক্ষকগণ ধীরে ধীরে মৌখিক ভাষার যে একটি লিখিত রূপ আছে তার সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করান। লিখিত কোন কিছু কারো কোনো রকম সাহায্য ছাড়া অর্থ বুঝে, বিরামচিহ্ন ঠিক রেখে সাবলীলভাবে পড়তে পারার ক্ষমতাকে পঠন-দক্ষতা বলা যেতে পারে। মানসম্মত পঠন-দক্ষতা হলো প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণী বয়সী শিশুদের প্রতি মিনিটে ৪৫-৬০টি শব্দ পড়ে তার অর্থ বুঝতে পারা।

শব্দ শেখানোর সময় শিক্ষককে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। যেমন- একসঙ্গে খুব বেশি শব্দ শেখানো উচিত নয়, প্রতিদিন একটি করে নতুন শব্দ শেখানো, শিক্ষার্থীর চাহিদা অনুযায়ী শব্দ শেখানো, ধারাবাহিক ও নিয়মিতভাবে নতুন শব্দ শেখানো। শব্দভা-ার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভাষার চারটি দক্ষতারই সমন্বয় করা আবশ্যক। শিক্ষার্থীর সরব পাঠের পূর্বেই পাঠ্যাংশে ব্যবহৃত নতুন শব্দগুলো শেখানো প্রয়োজন, পর্যায়ক্রমে শব্দের প্রমিত উচ্চারণ, বানান, অর্থ ও পাঠ্যাংশ বহির্ভূত বাক্যে প্রয়োগ শেখানো আবশ্যক। ধারণামূলক শব্দ (মমতা, আনন্দ, অসীম ইত্যাদি) সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা/বিশ্লেষণ/তুলনা করে বোঝানো প্রয়োজন। শিশুর শব্দভা-ার বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক অনুশীলনের সুযোগ থাকা প্রয়োজন।

শব্দ শেখানোর ক্ষেত্রে শিক্ষককে কিছু কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হয়। যেমন- অজানা বা নতুন শব্দগুলো বাছাই করে একটি একটি করে বোর্ডে লেখা, বস্তুবাচক শব্দ হলে প্রথমে ছবি, পরে শব্দকার্ড দেখানো বা শব্দ বোর্ডে লেখা, ভাবমূলক/ধারণামূলক শব্দ হলে সাধারণত: ব্যাখ্যা করা, তুলনা করা বা বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা (যেমন: ‘স্বচ্ছ’ শব্দটি বুঝানোর জন্য দুইটি কাঁচের গ্লাস ব্যবহার করা যেতে পারে যার একটিতে ঘোলা পানি এবং অন্যটিতে পরিস্কার পানি)। শব্দটি প্রমিত উচ্চরণে বরাবর অনুশীলন করানো। যুক্তবর্ণ থাকলে ভেঙে দেখানো, শব্দস্থিত প্রতিটি বর্ণের ধ্বনি সহযোগে বানান অনুশীলন করানো। প্রথম শ্রেণীর ক্ষেত্রে শব্দটি ভেঙে নির্দিষ্ট বর্ণটি শেখানো। শব্দটির অর্থ বলতে শিশুদের উৎসাহিত করা। শব্দটির প্রতিশব্দ, সম-উচ্চারিত শব্দ, বিপরীত শব্দ বলতে উৎসাহিত করা। শব্দ দিয়ে বাক্য রচনা করতে দেয়া। এটি কোন পদের অন্তর্গত তা নির্ণয় করতে সহায়তা করা। শব্দটি দিয়ে পাঠের বহির্ভূত বাক্য রচনা করতে দেয়া। শিক্ষকগণ শ্রেণী ও পাঠ-অনুযায়ী শব্দভা-ার বৃদ্ধির কৌশলগুলো শনাক্ত করে শ্রেণীকক্ষে প্রয়োগ করবেন।

যে সব শব্দ বর্ণ না চিনেও শিশু বার বার দেখে ও শুনে চিহ্নিত করতে পারে সেগুলোকে দৃশ্যমান শব্দ (Sight vocbulary) বলা যায়। সাধারণত দৃশ্যমান শব্দগুলোকে শিশুমনে জীবন্ত ছবির মত ভেসে ওঠে। এ ধরনের শব্দ শিশু কখনও বানান করে পড়ে না। শব্দটাই তার কাছে সমগ্ররূপে ধরা পড়ে। যেমন: শিশুরা ‘আমার’ শব্দটি দেখেই আমার বলতে পারে, কিন্তু সে বানান করতে পারে না। শিশুরা কোনো শব্দ আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে শব্দটি পড়ে শেখে না। অর্থাৎ শিশুরা কোন পরিচিত শব্দ, বর্ণ-বিন্যাসের ক্রম অনুযায়ী ভেঙে বানান করে পড়ে না। পুরো শব্দটিকেই ধারণ করে একত্রে পড়ে। যেমন- একটি হরিণের ছবি দেখেই ‘হরিণ’ বলতে পারে। তার হাত, পা, নখ, চোখ ইত্যাদি আলাদাভাবে বিবেচনা করে ছবিটিকে হরিণ বলে না। শিশুর শব্দ ভা-ার বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটি একটি কার্যকর কৌশল। দৃশ্যমান শব্দ পদ্ধতিতে বহুল ব্যবহৃত শব্দসমূহের প্রতি বেশি জোর দেয়া হয়। প্রতিটি ভাষায় ১০০ থেকে ১৫০টির মতো শব্দ আছে যেগুলো সাধারণ কথা-বার্তায় ব্যবহৃত শব্দের ৮০% হয়ে থাকে। সাধারণ বাক্যের মধ্যে ব্যবহার করে এই শব্দ দেখতে ও বলতে শেখানো হয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ বাক্য বারবার ব্যবহার করে শেখানো, যাতে নব্য পড়–য়ারা সহজেই শব্দগুলো শনাক্ত করতে পারে। বাক্যে শব্দগুলো বারবার ব্যবহারের ফলে এটা শিক্ষার্থীদের দৃশ্যমান শব্দভা-ারে পরিণত হয়। তবে এর জন্য যথেষ্ট অনুশীলনের প্রয়োজন। ১ম পাঠে প্রতিটি শব্দ ৫ বার থেকে ১৫ বার পুনরাবৃত্তি করা প্রয়োজন। এইভাবে শিক্ষার্থীর দৃশ্যমান শব্দভা-ার গড়ে উঠবে।

শিশুর পড়ার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য রিডিং-চার্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। পাঠ্য বইয়ের পড়ানো গল্পের সংক্ষিপ্তসার বড় কাগজে লিখে রিডিং-চার্ট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এই চার্ট বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া শ্রেণীতে পঠিত অংশের শব্দ নিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক গল্প, ছড়া, কবিতা তৈরি করতে পারেন এবং সেগুলো বড় বড় করে চার্ট ও কার্ডে লিখে রিডিং চার্ট ও রিডিং কার্ড তৈরি করবেন। শ্রেণীকক্ষে চার্ট টানিয়ে শিক্ষক নির্দেশক কাঠি ব্যবহার করে জোরে জোরে পড়বেন। সঙ্গে শিক্ষার্থীরাও পড়বে। প্রতি বেঞ্চে তিনজন শিক্ষার্থী বসিয়ে একটি করে কার্ড দিয়ে পড়ানো যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একজন পড়বে অন্যরা দেখবে। শিক্ষক পুরো শ্রেণীকক্ষ ঘুরে ঘুরে দেখবেন। প্রয়োজনে শিক্ষক যাচাই করে দেখতে পারেন শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে পড়ছে কি না। রিডিং-চার্ট থেকে একটি অনুচ্ছেদ বোর্ডে লেখা যেতে পারে যাতে মাঝে মাঝে শব্দ বাদ দিয়ে লেখা থাকবে। শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শব্দ দিয়ে শূন্যস্থান পুরণ করবে। এক্ষেত্রে বইয়ের শব্দ হুবহু না এসে নতুন শব্দ আসতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার পরিচয়ও পাওয়া যাবে।

শিশুদের পঠন-দক্ষতা বাড়ানার জন্য বেশি বেশি বই পড়তে দিতে হবে। তবে শিশুদের যে কোনো বই পড়তে দিলেই হবে না- এতে হিতে বিপরীতও হতে পারে। শিশুদের বই নির্বাচনের সময় কিছু বিশেষ দিকে লক্ষ রাখা দরকার। যেমন- বইটি বড় বড় অক্ষরে স্পষ্ট করে লেখা থাকবে, শিশুদের বইয়ে শিশুদের পরিচিত শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরি থাকবে, বাক্যগুলো অর্থপূর্ণ হবে, বাক্যের মধ্যে ধারাবাহিকতা থাকতে হবে, শিশুদের পরিচিত জগৎ সম্পর্কে কথা থাকতে হবে, বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল রেখে আকর্ষণীয় রঙ্গিন ছবি থাকতে হবে, শব্দের পুনরাবৃত্তি থাকতে হবে, বইয়ের লেখাগুলো পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ামূলক হতে হবে। শিশুদের জন্য বইয়ের লেখাগুলো যেন মুখের কথার মতো মনে হয়।

শিশুদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বিবেচনা করে বিভিন্ন শিশুতোষ গল্প ও কবিতার বই সংগ্রহ করে শিশুদের নিয়মিত পড়তে দিতে হবে। এ ব্যাপারে শিশু একাডেমি, ব্র্যাক, সংবাদপত্রের শিশু-কিশোর কলাম বা অন্য যে কোনো প্রকাশনার উপকরণ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি বইয়ে যতগুলো গল্প আছে তা কেটে নিয়ে শক্ত কাগছে পেস্ট করে অপর পৃষ্ঠায় ওই গল্পের উপর কিছু প্রশ্ন লিখে দিতে হবে। প্রতিটি গল্প লেমিনেটিং করে বা পলিথিনের স্বচ্ছ প্যাকেটে মুড়ে দিলে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যেতে পারে। সপ্তাহে এক বা দুইদিন এই উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে। দলগতভাবে পড়তে দিলে অল্প সংখ্যক বই দিয়ে অনেক শিক্ষার্থী পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে। কিছু কিছু উপকরণ সংশ্লিষ্ট শিক্ষক নিজে তৈরি করবেন। তখন লক্ষ রাখবেন যেন গল্পে ব্যবহৃত শব্দ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের উপযোগী শব্দ হয়। দলগতভাবে পড়তে দেয়ার ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে দলীয় সদস্যগণের মধ্যে যেন সবল ও দুর্বল শিক্ষার্থীর মিশ্রণ থাকে। শ্রেণীর সকল শিক্ষার্থীর পঠন-দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষক পালাক্রমে সকল শিক্ষার্থীর ১ মিনিট রিডিং এককভাবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবেন (ঙহব ঃড় ড়হব ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয) এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করবেন। অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দেবেন।

কোমলমতি শিশুদের পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। বইয়ের ছবি দেখিয়ে গল্প বলা, পাঠ্য বইয়ের ছবি নিয়ে আলোচনা করা, প্রতিদিন রিডিং পড়ানো, বেশি করে ছবির বই দেখতে দেয়া, পছন্দমতো বই দেখতে দেয়া, শিশুদের উপযোগী পত্র-পত্রিকা পড়তে দেয়া, কোনো লেখা পড়তে দেয়া, দেশ-বিদেশের খবর শোনানো ইত্যাদি উপায়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায়।

শিশুকে সাবলীল পাঠক তৈরিতে বিদ্যালয়ের পাশাপাশি পরিবারকেও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। প্রতিদিন পারিবারিকভাবেও একটি নির্দিষ্ট সময় পড়ার অভ্যাস করতে হবে। বড়দের পড়তে দেখলে শিশুরাও পড়তে উৎসাহিত বোধ করে এবং শিশুর আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। শিশুর বই রাখতে হবে হাতের কাছে- তার যখন ইচ্ছে তখন যেন পড়তে পারে। যেমন- বেডরুমে, ড্রয়িংরুমে, গাড়িতে, রিডিং-কর্নারে। পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য শিশুকে মাঝে মাঝে বইয়ের দোকানে বা পাঠাগারে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে এবং তার পছন্দ মতো বই কিনে দিতে হবে। নতুন বই পেলে শিশুর পড়ার আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। বাবা-মা/অভিভাবকদের উচিত শিশুকে পড়ার জন্য উৎসাহিত করা। আবার পড়তে না পারার জন্য কখনও তিরস্কার করা যাবে না।

শিশুর সার্বিক মঙ্গল ও উন্নতি সাধনের জন্য পড়ার দক্ষতা অর্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। শিশুর ব্যক্তিগত অর্জন, সামাজিক উন্নতি কিংবা শিক্ষায় সাফল্য সর্বোপরি ভবিষ্যত পেশাজীবনে উন্নতির পিছনে পড়ার দক্ষতা ব্যাপকভাবে ভুমিকা রাখে। বিশেষত পড়ার দক্ষতা ব্যতীত ভাষাশিক্ষার অর্জন ও খ্যাতি অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়। পড়ার দক্ষতা শিশুর সামনে জ্ঞানের দরজা উন্মুক্ত করে দেয় এবং মানুষ হিসেবে সীমাবদ্ধতা দূরীভূত করতে সহায়তা করে। প্রাথমিক স্তরের পড়া দুটি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে হয়। প্রথমত পড়ার জন্য শিখন এবং দ্বিতীয়ত শিখনের জন্য পড়া। প্রথম পর্যায়ে শিশু কিভাবে পড়তে হয় তা আয়ত্ত করে, দ্বিতীয় পর্যায়ে শিশু তার অর্জিত দক্ষতা ব্যবহার করে বিষয়জ্ঞান লাভ করে। প্রথম পর্যায় থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত হতে পারাটাই হচ্ছে প্রাথমিক স্তরের শিশুর জন্য শ্রেষ্ঠ অর্জন।

বাংলার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশটি স্বাধীন না করলে আমরা প্রিয় বাংলাদেশ পেতাম না। তিনি ক্ষণজন্মা জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ ও একটি পতাকা উপহার দিয়ে গেছেন। তার জন্ম না হলে হয়তো আজও আমাদের পরাধীন হয়ে থাকতে হতো। আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারতাম না, আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারতাম না। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীভাষা হিসেবে পেতে, স্বাধীন বাংলাদেশকে পেতে আমাদের অনেক কিছু হারাতে হয়েছে। কাজেই দাম দিয়ে কেনা বাংলাভাষার প্রতি আমাদের আরও গুরুত্ব দেয়া এবং যতœশীল হওয়া উচিত। মুজিববর্ষে সকল শিশুকে তার বাংলা পাঠ্যবই বা সমমানের সম্পুরক পঠনসামগ্রী স্পষ্ট, শুদ্ধ ও সাবলীলভাবে পড়তে পারার যোগ্যতা অর্জন করানোর মাধ্যমে জাতির পিতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে। আর আমরা এটা সফল করবো- এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। এর জন্য সকলকেই যার যার অবস্থান থেকে কাজ করা উচিত।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষা-গবেষক ও ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি), বারহাট্টা, নেত্রকোনা।

ahmsharifullah@yahoo.com