মুজিববর্ষ ও আদর্শিক রাজনীতি

বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিগত ৮ জানুয়ারি, ২০২০ সালে ৭৫ পরবর্তী সময়ে চতুর্থবারের মতো সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ নেয়ার এক বছরপূর্তি উপলক্ষে ভাষণে বলেছিলেন, আগামী ১৭ মার্চ, ২০২০ ইং তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালনের অংশ হিসেবে এ তারিখে বর্ণাট্য উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বছরব্যাপী অনুষ্ঠান মালার সূচনা হবে। সককার ইতোমধ্যেই ২০২০-২০২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী তথা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের অনুষ্ঠানমালা যুগপৎভাবে চলতে থাকবে। এ উৎসবের লক্ষ্য জাতীয় জীবনে নতুন জীবনীশক্তি সঞ্চারিত করা, জাতিকে নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করা এবং সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যার টার্গেট সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে অধিষ্ঠিত তার সরকারের প্রধান কর্মসূচিগুলো ছিল দারিদ্র /প্রান্তিক গোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ভাতা চালু করা, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ঘরে ফেরা, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ইত্যাদি।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর দেশ আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরও কয়েক ধাপ এগিয়েছে, যা পরবর্তীতে ২০১৪ এবং ২০১৯ নির্বাচনে জয়লাভের পর অব্যাহত রয়েছে যেমন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.৩ শতাংশ, দারিদ্র হার ২১.৮ শতাংশ, মাথাপিছু আয় (২০১৮) বেড়েছে ১৯০৯ মার্কিন ডলার, মূল্যস্ফৃীতি ৬ শতাংশ নিচে, শিশু মৃত্যুর হার ১২ জন, মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১০৫, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ বৈষম্য দূরিকরণ, শিক্ষার হার শতকরা ৭৩ ভাগ, গড় আয়ু ৭২ বছর, চাল উৎপাদনে বিশ্বের ৪র্থ স্থান, মাছ ও সবজি উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় স্থান ইত্যাদি যা দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও উন্নত দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালে বাংলাদেশেকে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং ২০১৮ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থান দিয়েছে। রূপকল্প ২০২১ অনুসারে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের যাওয়ার স্বপ্ন রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি যথা গণতন্ত্র, সামাজতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতা এর ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক কাঠামো অর্থাৎ জনগণের উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজকল্যাণ, যা নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য কুমার সেন ও জার্মান অর্থনীতিবিদ রিচার্ড এইচ যাপারের মানবিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর সমাজ কল্যাণ ধারণার সম্প্রসারণ রূপ হলো সম্পদের সুষম বণ্টন ও সম্পদ সৃষ্টি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষায় বিনিয়োগ, কৃষি ও শিক্ষার সংস্কার ও গণমুখী বাধ্যতামূলক সমবায় প্রতিষ্ঠা। তার মূল ভিত্তি ছিল সামাজিক, সংস্কৃতিক ও প্রশাসানিক উন্নয়নের মাধ্যমে মাটি ও মানুষের সমন্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

১৯৭২ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট জাতির জনককে প্রশ্ন করেছিলেন আপনার শক্তি কোথায় এবং এর জবাবটি ছিল আমি আমার জনগণকে খুব ভালোবাসি তারপর আমার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও আত্মীয় সজন। তারই উত্তরসূরি বঙ্গবন্ধু কন্যা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক নীতিকে ধরেই ধারাবাহিকভাবে সফল রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছেন। তার বদৌলতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ যার জিডিপি আকার ২০১৯ সালে ৩১৭.৪৭৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটের আকার পূর্বের চেয়ে সাড়ে আটগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকায় যার ৯০ ভাগই বাস্তবায়ন হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। এরই মধ্যে ৯৫ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ও ৯৭ শতাংশ মানুষ উন্নত স্যানিটেশনের আওতায় এসছে। ৮৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়নক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বস্থ্যাসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় রয়েছে অর্থাৎ বিগত ১১ বছরে এ সরকারের আমলে স্বাস্থ্যসেবার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে যা মানবিকতার স্বাক্ষর। শিক্ষার ক্ষেত্রেও এসেছে গতিশীলতা যেমন প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষায় উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ও এমপিওভুক্তকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা, গৃহদান, সর্বস্তরে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় দান ইত্যাদি। এই ধরনের সাহসী ও বলিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার মতো উৎসাহ তিনি পেয়েছেন পিতার কাছ থেকে। বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নের রোল মডেলই নয় একটি মানবিক রাষ্ট্রও বটে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে সমুদ্র বিজয়, ছিটমহল সমস্যার সমাধান ও রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য প্রধানমন্ত্রী মাদার অব হিউম্যানিটি উপাদিতে ভূষিত হয়েছেন। পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স বিশ্বের পাঁচ সৎ রাষ্ট্রপ্রাধান ও সরকারপ্রধানকে চিহিৃত করেছেন যাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় স্থানে রয়েছেন। ২০১৪ সালে ইউনেস্কোর শান্তি বৃক্ষ, নারীর ক্ষমতায়নের গ্লোবেল সাউথ সাউথ ডেভেলপমেন্ট এক্সপো ২০১৪ টেকসই উন্নয়নে চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ ২০১৫ অর্জনসহ পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ৩৭টি পদকে ভূষিত হয়েছেন। অতি সম্প্রতি ভারতের পশ্চিম বাংলায় বর্ধমানে অবস্থিত কাজী নজরুল বিশ্ব বিদ্যালয় প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করেছেন। এবং বোলপুরে অবস্থিত বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ ভবন স্থাপন করেছেন যেখানে বাংলাদেশের ছাত্ররা রবীন্দ্র সাহিত্যের বিভিন্ন দিকের ওপর উচ্চতর গবেষণার সুযোগ পাবেন ভারত সরকারের বৃত্তি পেয়ে। বাংলাদেশ রূপকল্প ২০২১ এবং সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষিতে পরিকল্পনা (২০১০-২০২০), বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ নামে শতবর্ষের একটি পরিকল্পনা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সঙ্গে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলো সম্পৃক্তকরণ। অষ্টম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনা কাজ শুরু ইত্যাদি সরকারের উল্লেখ্যযোগ্য কাজের স্বাক্ষর। তারপর রয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, রূপপুর ২৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণকাজ, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও নতুন ট্রেন চালু, পদ্মা সেতু নির্মাণ নিজস্ব অর্থয়নে ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা। প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখতে শিখেছে উন্নততর জীবনযাপনের জন্য যার জন্য সরকার কাজ করে চলেছে। এ বছর জাতিসংঘে বাংলাদেশ উদ্ভাপিত শান্তির সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক উদ্ভিজ ও টেকসই উন্নয়ন শীর্ষক রেজুলেশনসহ রোহিঙ্গাবিষয়ক বেশ কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহীত হয়েছে। অতি ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ এরি মধ্যে বহির্বিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন ইত্যাদি অনুসরণের দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ সব দৃষ্টান্ত নিয়েই আমরা একটি নতুন বছরে উন্নীত হয়েছি অর্থনীতিতে কতগুলো আশাবাদ নিয়ে যেমন মাথাপিছু আয় বাড়বে দু হাজার (২০০০) মার্কিন ডলার, সুদের হার ৯ ছয়ে নামবে, এক জায়গায় নতুন সেবা, ব্যবসায়ে পরিবেশ উন্নতি, শেয়ার বাজারে নতুন আশা, উন্নয়নশীল দেশে পথে (২০২১ সালের মার্চে স্বীকৃতি পাওয়ার পর্যালোচনা), বিনিয়োগ জমি (২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরসহ সরকারের কয়েকটি অর্থনীতি অঞ্চলে আরও বিনিয়োগ উপযোগী জমি), হবে চামড়াশিল্প নগরী, বন্দরে নতুন টার্মিনাল ও ব্যাংক যাবে বাড়ির কাছে (ব্যাংকগুলো শাখা ব্যাংকিংয়ের বদলে এজেন্ট ব্যাংকিং বেশি মনোযোগী হবে) ইত্যাদি। মরগ্যান স্টারলির গ্লোবাল ম্যাক্রো আউটলুক (২০২০) বৈশিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে বলছে এ বছরে মূল চালিকাশক্তি হবে বাণিজ্য যুদ্ধের তিব্রতা হ্রাস, মুদ্রানীতির শিথিলতা, ভোক্তার ব্যায় বৃদ্ধি, বাণিজ্য বাধা কমলে, বাড়বে বিনিয়োগ, কর্মসংস্তান ও রপ্তানি আয় ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থনীতিও এ বৈশিক পূর্বাভাসের বাহির না থাকলেও এর সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেমন বিনিয়োগ স্থবিরতা, খেলাপি ঋণের প্রাদুর্ভাব, দুর্নীতির প্রবণতা, জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাতসহ সুশাসনের স্বল্পতা। এখানে উল্লেখ্য যে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে এরইমধ্যে জিহাদ ঘোষণা করছেন যা আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে।

বর্তমান সরকারপ্রধান খুব সফলতার সঙ্গে তার রাজনৈতিক দলের সংস্কারের কাজ হাতে নিয়েছে এবং এরই মধ্যে দলে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটিগুলোর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রীর দুরদর্শিতারই প্রমাণ। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার অন্তর্নিহিত দর্শনগুলো হলো এদেশের মানুষ অসাধারণ পরিশ্রমী, উদ্ভাবনক্ষমতা সম্পন্ন, অল্পতেই সন্তুষ্ট, বিনয়ী ও আদর্শিক চিন্তার অনুসারি। মুজিববর্ষের শুরুতেই যে সব প্রত্যাশাগুলো জাতি লালন করছে যেমন বিজ্ঞান প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ, মানবিক ও নিরক্ষর মুক্ত বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক, সুশৃঙ্খল, প্রগতিশীল, দরিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ ইত্যাদি তা সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গিকারের বহিঃপ্রকাশ। প্রধানমন্ত্রী আশার করেছেন জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকীতে দল-মত নির্বিশেষে সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা, দারিদ্র ও নিরক্ষতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ার এগিযে আসবে, যা এ দেশের সহজ-সরল মানুষ, যার শপথ নেয়ার সময় এসেছে।

[লেখক : গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]

mihir.city@gmail.com

শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২০ , ৩ মাঘ ১৪২৬, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

মুজিববর্ষ ও আদর্শিক রাজনীতি

ড. মিহির কুমার রায়

বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিগত ৮ জানুয়ারি, ২০২০ সালে ৭৫ পরবর্তী সময়ে চতুর্থবারের মতো সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ নেয়ার এক বছরপূর্তি উপলক্ষে ভাষণে বলেছিলেন, আগামী ১৭ মার্চ, ২০২০ ইং তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালনের অংশ হিসেবে এ তারিখে বর্ণাট্য উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বছরব্যাপী অনুষ্ঠান মালার সূচনা হবে। সককার ইতোমধ্যেই ২০২০-২০২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী তথা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের অনুষ্ঠানমালা যুগপৎভাবে চলতে থাকবে। এ উৎসবের লক্ষ্য জাতীয় জীবনে নতুন জীবনীশক্তি সঞ্চারিত করা, জাতিকে নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করা এবং সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যার টার্গেট সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে অধিষ্ঠিত তার সরকারের প্রধান কর্মসূচিগুলো ছিল দারিদ্র /প্রান্তিক গোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ভাতা চালু করা, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ঘরে ফেরা, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ইত্যাদি।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর দেশ আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরও কয়েক ধাপ এগিয়েছে, যা পরবর্তীতে ২০১৪ এবং ২০১৯ নির্বাচনে জয়লাভের পর অব্যাহত রয়েছে যেমন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.৩ শতাংশ, দারিদ্র হার ২১.৮ শতাংশ, মাথাপিছু আয় (২০১৮) বেড়েছে ১৯০৯ মার্কিন ডলার, মূল্যস্ফৃীতি ৬ শতাংশ নিচে, শিশু মৃত্যুর হার ১২ জন, মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১০৫, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ বৈষম্য দূরিকরণ, শিক্ষার হার শতকরা ৭৩ ভাগ, গড় আয়ু ৭২ বছর, চাল উৎপাদনে বিশ্বের ৪র্থ স্থান, মাছ ও সবজি উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় স্থান ইত্যাদি যা দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও উন্নত দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালে বাংলাদেশেকে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং ২০১৮ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থান দিয়েছে। রূপকল্প ২০২১ অনুসারে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের যাওয়ার স্বপ্ন রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি যথা গণতন্ত্র, সামাজতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতা এর ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক কাঠামো অর্থাৎ জনগণের উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজকল্যাণ, যা নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য কুমার সেন ও জার্মান অর্থনীতিবিদ রিচার্ড এইচ যাপারের মানবিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর সমাজ কল্যাণ ধারণার সম্প্রসারণ রূপ হলো সম্পদের সুষম বণ্টন ও সম্পদ সৃষ্টি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষায় বিনিয়োগ, কৃষি ও শিক্ষার সংস্কার ও গণমুখী বাধ্যতামূলক সমবায় প্রতিষ্ঠা। তার মূল ভিত্তি ছিল সামাজিক, সংস্কৃতিক ও প্রশাসানিক উন্নয়নের মাধ্যমে মাটি ও মানুষের সমন্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

১৯৭২ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট জাতির জনককে প্রশ্ন করেছিলেন আপনার শক্তি কোথায় এবং এর জবাবটি ছিল আমি আমার জনগণকে খুব ভালোবাসি তারপর আমার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও আত্মীয় সজন। তারই উত্তরসূরি বঙ্গবন্ধু কন্যা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক নীতিকে ধরেই ধারাবাহিকভাবে সফল রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছেন। তার বদৌলতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ যার জিডিপি আকার ২০১৯ সালে ৩১৭.৪৭৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটের আকার পূর্বের চেয়ে সাড়ে আটগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকায় যার ৯০ ভাগই বাস্তবায়ন হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। এরই মধ্যে ৯৫ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ও ৯৭ শতাংশ মানুষ উন্নত স্যানিটেশনের আওতায় এসছে। ৮৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়নক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বস্থ্যাসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় রয়েছে অর্থাৎ বিগত ১১ বছরে এ সরকারের আমলে স্বাস্থ্যসেবার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে যা মানবিকতার স্বাক্ষর। শিক্ষার ক্ষেত্রেও এসেছে গতিশীলতা যেমন প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষায় উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ও এমপিওভুক্তকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা, গৃহদান, সর্বস্তরে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় দান ইত্যাদি। এই ধরনের সাহসী ও বলিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার মতো উৎসাহ তিনি পেয়েছেন পিতার কাছ থেকে। বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নের রোল মডেলই নয় একটি মানবিক রাষ্ট্রও বটে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে সমুদ্র বিজয়, ছিটমহল সমস্যার সমাধান ও রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য প্রধানমন্ত্রী মাদার অব হিউম্যানিটি উপাদিতে ভূষিত হয়েছেন। পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স বিশ্বের পাঁচ সৎ রাষ্ট্রপ্রাধান ও সরকারপ্রধানকে চিহিৃত করেছেন যাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় স্থানে রয়েছেন। ২০১৪ সালে ইউনেস্কোর শান্তি বৃক্ষ, নারীর ক্ষমতায়নের গ্লোবেল সাউথ সাউথ ডেভেলপমেন্ট এক্সপো ২০১৪ টেকসই উন্নয়নে চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ ২০১৫ অর্জনসহ পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ৩৭টি পদকে ভূষিত হয়েছেন। অতি সম্প্রতি ভারতের পশ্চিম বাংলায় বর্ধমানে অবস্থিত কাজী নজরুল বিশ্ব বিদ্যালয় প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করেছেন। এবং বোলপুরে অবস্থিত বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ ভবন স্থাপন করেছেন যেখানে বাংলাদেশের ছাত্ররা রবীন্দ্র সাহিত্যের বিভিন্ন দিকের ওপর উচ্চতর গবেষণার সুযোগ পাবেন ভারত সরকারের বৃত্তি পেয়ে। বাংলাদেশ রূপকল্প ২০২১ এবং সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষিতে পরিকল্পনা (২০১০-২০২০), বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ নামে শতবর্ষের একটি পরিকল্পনা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সঙ্গে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলো সম্পৃক্তকরণ। অষ্টম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনা কাজ শুরু ইত্যাদি সরকারের উল্লেখ্যযোগ্য কাজের স্বাক্ষর। তারপর রয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, রূপপুর ২৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণকাজ, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও নতুন ট্রেন চালু, পদ্মা সেতু নির্মাণ নিজস্ব অর্থয়নে ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা। প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখতে শিখেছে উন্নততর জীবনযাপনের জন্য যার জন্য সরকার কাজ করে চলেছে। এ বছর জাতিসংঘে বাংলাদেশ উদ্ভাপিত শান্তির সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক উদ্ভিজ ও টেকসই উন্নয়ন শীর্ষক রেজুলেশনসহ রোহিঙ্গাবিষয়ক বেশ কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহীত হয়েছে। অতি ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ এরি মধ্যে বহির্বিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন ইত্যাদি অনুসরণের দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ সব দৃষ্টান্ত নিয়েই আমরা একটি নতুন বছরে উন্নীত হয়েছি অর্থনীতিতে কতগুলো আশাবাদ নিয়ে যেমন মাথাপিছু আয় বাড়বে দু হাজার (২০০০) মার্কিন ডলার, সুদের হার ৯ ছয়ে নামবে, এক জায়গায় নতুন সেবা, ব্যবসায়ে পরিবেশ উন্নতি, শেয়ার বাজারে নতুন আশা, উন্নয়নশীল দেশে পথে (২০২১ সালের মার্চে স্বীকৃতি পাওয়ার পর্যালোচনা), বিনিয়োগ জমি (২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরসহ সরকারের কয়েকটি অর্থনীতি অঞ্চলে আরও বিনিয়োগ উপযোগী জমি), হবে চামড়াশিল্প নগরী, বন্দরে নতুন টার্মিনাল ও ব্যাংক যাবে বাড়ির কাছে (ব্যাংকগুলো শাখা ব্যাংকিংয়ের বদলে এজেন্ট ব্যাংকিং বেশি মনোযোগী হবে) ইত্যাদি। মরগ্যান স্টারলির গ্লোবাল ম্যাক্রো আউটলুক (২০২০) বৈশিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে বলছে এ বছরে মূল চালিকাশক্তি হবে বাণিজ্য যুদ্ধের তিব্রতা হ্রাস, মুদ্রানীতির শিথিলতা, ভোক্তার ব্যায় বৃদ্ধি, বাণিজ্য বাধা কমলে, বাড়বে বিনিয়োগ, কর্মসংস্তান ও রপ্তানি আয় ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থনীতিও এ বৈশিক পূর্বাভাসের বাহির না থাকলেও এর সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেমন বিনিয়োগ স্থবিরতা, খেলাপি ঋণের প্রাদুর্ভাব, দুর্নীতির প্রবণতা, জলবায়ু পরিবর্তন অভিঘাতসহ সুশাসনের স্বল্পতা। এখানে উল্লেখ্য যে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে এরইমধ্যে জিহাদ ঘোষণা করছেন যা আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে।

বর্তমান সরকারপ্রধান খুব সফলতার সঙ্গে তার রাজনৈতিক দলের সংস্কারের কাজ হাতে নিয়েছে এবং এরই মধ্যে দলে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটিগুলোর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রীর দুরদর্শিতারই প্রমাণ। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার অন্তর্নিহিত দর্শনগুলো হলো এদেশের মানুষ অসাধারণ পরিশ্রমী, উদ্ভাবনক্ষমতা সম্পন্ন, অল্পতেই সন্তুষ্ট, বিনয়ী ও আদর্শিক চিন্তার অনুসারি। মুজিববর্ষের শুরুতেই যে সব প্রত্যাশাগুলো জাতি লালন করছে যেমন বিজ্ঞান প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ, মানবিক ও নিরক্ষর মুক্ত বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক, সুশৃঙ্খল, প্রগতিশীল, দরিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ ইত্যাদি তা সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গিকারের বহিঃপ্রকাশ। প্রধানমন্ত্রী আশার করেছেন জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকীতে দল-মত নির্বিশেষে সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা, দারিদ্র ও নিরক্ষতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ার এগিযে আসবে, যা এ দেশের সহজ-সরল মানুষ, যার শপথ নেয়ার সময় এসেছে।

[লেখক : গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]

mihir.city@gmail.com