গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু

শেখ মুজিবের বক্তৃতা

(গতকালের পর) ...কথায় কর্ণপাত করেননি। অতঃপর পূর্ববাংলায় ফিরে আমি ও পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান ব্যাপক সফরে বের হই। প্রায় চার মাস কাল ব্যাপক সফরের ফলে প্রায় প্রত্যেকটি জেলা ও মহকুমার আওয়ামী লীগের ইউনিট গড়ে উঠে। এ সময় জেলের অভ্যন্তরে শ্রদ্ধেয় নেতা মওলানা ভাসানী ও জনাব শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে জনাব সোহরাওয়ার্দী পূর্ববঙ্গে আসেন এবং জেলখানায় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর এক ব্যাপক সফরে তিনি প্রদেশে একাধিকক্রমে ৩৪টি সভায় বক্তৃতা করেন। তার এই সফরের ফলে রাজবন্দীদের মুক্তির আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠে। তার সভায় হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। রাজবন্দীদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক শাসন দাবি করে সর্বত্র প্রস্তাবাদি গৃহীত হয়।

প্রচ- গতিতে আমাদের সংগঠনী কার্য চলতে থাকে। মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কর্মীগণ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। ইউনিয়নে ইউনিয়নে থানায় থানায় শহরে বন্দরে সর্বত্র আওয়ামী লীগ গড়ে উঠলো। নির্বাচিত জনগণের আপন প্রতিষ্ঠান হিসেবে।

দীর্ঘ সাত বৎসরাধিককাল ফ্যসিস্ট শাসন পরিচালনা করার পর জনমতের চাপে বাধ্য হয়ে লীগ সরকার ১৯৫৪ সালে সাধারন নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করলেন। সে সময়ে জনাব ফজলুল হক সাহেব পূর্ববাংলার এডভোকেট জেনারেল। তিনি ঢাকা জেলে মওলানা সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনকালে আওয়ামী লীগে যোগদান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরে চাঁদপুরে এক বিরাট জনসভায় তিনি একথা জনসমক্ষেও ঘোষণা করেন। বলাবাহুল্য তিনি তার স্বভাবসুলভ নীতি অনুযায়ী তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি।

দীর্ঘ ২৩ মাস কাল বিনাবিচারে আটক থাকার পর মওলানা সাহেবকে ১৯৫৩ সালে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৫৩ সালেরই অক্টোবর মাসে নব সংগঠিত জনাব সোহরাওয়ার্দী কাউন্সিলের যে প্রথম প্রতিনিধিত্বমূলক সভা হয় তাতে আমি সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হই। এ সভায় আমি আওয়ামীলীগকে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান করার প্রস্তাব করি। এ ব্যাপারে আমি আমার নিজ মত ব্যক্ত করা প্রসঙ্গে বলি যে, দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর ও সত্যিকার পাকিস্তান জাতি গঠনের জন্য আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান করা প্রয়োজন। আমাদের কিছু সংখ্যক সহকর্মী ও পু?্ব্ব বাংলার জনসাধরণ যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য প্রস্তুত তা সেদিন বুঝতে পারেনি বলে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। জনাব মওলানা ভাসানী আমাদের এ প্রস্তাব অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করেন। বহু আলোচনার পর এ ব্যাপারে জনমত যাচাই করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার মওলানা সাহেবের উপর ন্যস্ত করা হয়।

নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে। দেশের যুবশ্রেণীর সম্মিলিতভাবে নির্বাচন যুদ্ধে লীগ শাহীর মোকাবেলা করার দাবি জ্ঞাপন করেন। ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত ১৭ ও ১৮ নবেম্বর তারিখে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সভায় সাধারণ নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলিম লীগ সরকারের মোকাবেলা করার দাবি উত্থিত হয়। প্রয়োজনবোধে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিয়ে লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের ক্ষমতা জনাব মওলানা ভাসানী ও জনাব সোহরাওয়ার্দীর উপর ...।

দৈনিক সংবাদ : ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭

আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে শেখ মুজিবের বক্তৃতার বিবরণ

... আমরা আওয়ামী লীগ থেকে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রস্তাব পেশ করি।

এ সময় খাদ্য সঙ্কট চরমে উঠে এবং দেশব্যাপী গণবিক্ষোভ দেখা দেয়। প্রায় প্রত্যেক জেলা সদরে গ্রামাঞ্চল থেকে ভুখা মিছিল আসতে আরম্ভ করে। রাজধানীর বুকেও ভুখা মিছিল আসতে আরম্ভ করে। দিশেহারা আবু হোসেন মন্ত্রিসভা নিজেদের আত্মরক্ষার আর কোন উপায় নেই বলে পদত্যাগ করে। বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পার জিঞ্জিরা এলাকা থেকে আগত এক ভুখা মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। চকবাজারের এই গুলিতে খাদ্যের কাঙ্গাল কঙ্কালসার কয়েক ব্যক্তি-নিহত হয়। এ খবর মুহূর্তে সমগ্র ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং বিপুল জনতা গুলিতে নিহত এক ব্যাক্তির মৃতদেহ নিয়ে বিরাট মিছিল সহকারে চকবাজার হইতে কাচারির দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। জনসাধারণের এই বিপদের দিনে আওয়ামী লীগ তাদের কাতারে শামিল হয়। গুলিবর্ষণের খবর প্রাপ্তির অল্পক্ষণ মধ্যেই জনাব আতাউর রহমান খান, আমি, ইয়ার মুহাম্মদ খান, দবির উদ্দিন, আবুল মনসুর সাহেব ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। জনতার মিছিল যাতে শান্তিপূর্ণভাবে শহর প্রদক্ষিণ করে সেজন্য আমি ও ইয়ার মুহাম্মদ খান মিছিলের সঙ্গে অগ্রসর হই।

জনাব আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমেদ আহত ব্যাক্তিদের শত্রুর ব্যবস্থার জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে গমন করেন। মিছিল সদরঘাটে পৌঁছলে পুলিশ আবার গুলিবর্ষণ করে। ওখানেও কয়েক ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়। এ সংবাদ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদে ঢাকা শহরে সর্বাত্মক হরতাল প্রতিপালিত হয়। মফস্বলেও তার অনুসরণ হতে থাকে। পূর্ববাংলার শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। বাধ্য হয়ে সরকার জনাব আতাউর রহমান খানকে একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করার আহবান করেন। দেশের নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দল হিসেবে শত বিপদও প্রায় অপ্রতিরোধ্য দুর্ভিক্ষ এবং তজ্জন্য শত শত লোকের মৃত্যুর সম্ভাবনা সামনে দেখেও আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি গভর্ণরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে দীর্ঘ ৯ বৎসর বিরোধীদল হিসেবে অবস্থান করার পর সত্যিকার আওয়ামী লীগ হিসেবে প্রদেশের শাসনকার্য চালাইবার দায়িত্ব গ্রহণ করে। যদিও আওয়ামী লীগের কাছে মন্ত্রিত্ব কিছুই নয় দেশের নিঃস্বার্থ সেবাই আদর্শ। ... বলবো।

... কাজেই মন্ত্রিসভার অন্যতম সভ্য হিসাবে, আমার মুখে আমরা যতটুকু করতে পেরেছি তার বিবরণ নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না। তাছাড়া এরূপ বিবরণ কতকটা শালীনতা বিরুদ্ধও বটে। মাত্র পাঁচ মাস সময় আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে চার মাস ব্যয় হয়েছে দুর্ভিক্ষাবস্থা থেকে দেশের জনসাধারণকে বাঁচাবার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে খাদ্যশস্য এনে তার সুষ্ঠু ও দ্রুত বিলিব্যবস্থার কাজে। সকলেই স্বীকার করবেন সকল কাজের ঊর্ধ্বে ছিল এ কাজ। আল্লাহর মেহেরবাণীতে এবং জনসাধারণের সমর্থন এবং সহকর্মীদের সহযোগিতায় আমাদের মন্ত্রিসভা তাদের এ গুরুদায়িত্ব প্রতিপালন করিতে সমর্থ হয়েছে। ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ত কিছু কিছু হয়েছে; কিন্তু তা সদিচ্ছার অভাবে নয়, দুরতিক্রম্য বাধা বিপত্তির জন্য। তাছাড়া একথাও আপনারা স্মরণ রাখবেন যে শাসনভার পরিচালনার জন্য আমাদের কারও কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নিতেও কিছুটা সময় লেগেছে।

প্রসঙ্গত আর একটি কথার এখানে উল্লেখ করতে হয়। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করার অব্যবহিত পরেই কেন্দ্রে মুসলিম লীগ কৃষক শ্রমিক কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তখন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্র মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য প্রেসিডেন্ট আমন্ত্রণ করেন। সোহরাওয়ার্দী এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কেন্দ্রে ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে জনাব সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভা পূর্ববঙ্গের খাদ্য সংকট সমাধানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সরকারকে অর্থ সাহায্য ছাড়াও তাদের সঙ্গে মনে প্রাণে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করেছেন। এজন্য সোহরাওয়ার্দী ও তার মন্ত্রিসভার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ এবং তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এ সময়ের মধ্যে খাদ্য সমস্যার সমাধান ছাড়াও আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভা সর্ব্বাপেক্ষা বেশি উল্লেখযোগ্য যে কাজ করেছে তা হলো, বিপুল ভোটাধিক্যে যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের এসেম্বলিতে প্রস্তাব গ্রহণ। কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টেও এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। ফলে আগামী নির্বাচন যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে হচ্ছে এবং সত্যিকার পাকিস্তানি জাতি সৃষ্টি হওয়ার সূত্রপাত হচ্ছে।

ভাইসব এখন ভবিষ্যত সম্পর্কে দুচারটি কথা আমাকে বলতে হচ্ছে। আগামী মার্চ-এপ্রিল মাসে সাধারণ নির্বাচন হবে বলে আশা করা যায়। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হবে। এই পরিষদের জন্য ৪৬৫ জন প্রতিনিধিকে আমাদের মনোনয়ন প্রদান করতে হবে। তাদের বাছাই ছাড়াও দেশের সর্বপ্রথম এই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে পার্টিকে সাফল্যম-িত করা যে কি বিরাট দায়িত্বপূর্ণ কাজ তা আশা করি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। এখন হতে সেজন্য বিপুল উদ্যম নিয়ে কাজে নামতে হবে। মনে রাখবেন, এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কোথাও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করেনি। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভের পূর্বে পার্টির নির্দেশিত সমস্ত কাজ করা যেসব সময়ে সম্ভবপর হয়ে উঠে না তা আপনারা জ্ঞাত আছেন। কাজেই আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিক দিক থেকে আরো শক্তিশালী ও দুর্জয় করে তুলতে হবে। জনগণকে আওয়ামী লীগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার জন্য দিবারাত্রি চালাতে হবে প্রচার। তাদের দৈনন্দিন দুঃখ দুর্দশার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সহানুভূতি ও সমর্থন আনতে হবে পার্টির জন্য। তাদের অভাব-অভিযোগ মন্ত্রিসভার কাছে পেশ করতে হবে আওয়ামী লীগকেই। এক কথায় জনসাধারণের সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকেই গ্রহণ করতে হবে। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের বৈপ্লবিক রূপ বদলানো চলবে না। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পূর্বে আওয়ামী লীগ যেমন জনসাধারণের সকল আন্দোলনের পুরোধায় রয়েছে এখনও তেমনি পুরোধায় থাকতে হবে তাকে। একমাত্র এই পন্থায় আওয়ামী লীগ দেশের রাজনৈতিক জীবনে জীবিত থাকবে।

ইউনিয়ন, থানা ও মহকুমা আওয়ামী লীগগুলোকে বর্তমান অপেক্ষা বেশি সক্রিয় করে তুলতে হবে। যেসব স্থানে আওয়ামী লীগের কমিটি এখন পর্যন্ত গঠিত হয়নি কর্মীগণকে যেসব জায়গায় কমিটি গঠনের কার্যে করতে হবে আত্মনিয়োগ। আওয়ামী লীগ গড়তে হবে দেশের সর্বত্র। আমাদের রয়েছে মহান ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে জনহিতকর মহান কর্মসূচি। সে কর্মসূচি জনসাধারণ গ্রহণ করেছে। আমাদের প্রোগ্রামের ডাকে তারা সাড়া দিয়েছেন। আমাদের সাফল্য অনিবার্য।

শেষ করার পূর্বে যে কথাটির উল্লেখ করতে চাই, তা হলো আওয়ামী লীগ এখন অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। কাজেই প্রতিষ্ঠানে সকল সম্প্রদায়ের লোক যোগদান করতে পারে সেদিকেও কর্মীদের লক্ষ্য রাখতে হবে।

উপসংহারে আমি আর সামান্য দু’চারটি কথা বলতে চাই- আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি ও সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে আমি আপনাদের সাধারণ সম্পাদকের কাজ করে এসেছি। একাজ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানের ওপর দিয়ে। আপনাদের সহায়তায় যথাসাধ্য মোকাবেলা করেছি। কিন্তু শত চেষ্টা ও শত সদিচ্ছা থাকলেও অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি হয়েছে হয়তো অনেক ব্যাপারে। অনেকক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ গতিকেই আপনারা আমার কাছ থেকে আশা করেছেন ততটুকু পাননি। আপনারা নিজগুণে তা ক্ষমা করে নিয়েছেন। আজ বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে, আমার কার্যকালে আমি আপনাদের সকলের যে অগাধ স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি। তজ্জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

আজ থেকে আবার আমি কোনরকম পদমর্যাদা ব্যতিরেকে সাধারণ একজন কর্মী হিসেবে আওয়ামী লীগের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারবো, সে আমার আনন্দ। শেষ করার পূর্বে আওয়ামী লীগের ভূতপূর্ব সাধারণ সম্পাদক জনাব সামসুল হক সম্পর্কে দু’চারটি কথা বলতে চাই। পূর্ব বাংলার সবচাইতে বিপদের দিনে তিনি মওলানা ভাসানীর সহকর্মী হিসেবে লীগ সরকারের চ-নীতির বিরুদ্ধে দ-ায়মান হন। দীর্ঘকাল কারাবরণের ফলে তিনি আজ গুরুতর অসুস্থ। বর্তমানে তিনি লাহোর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। প্রয়োজনবোধে তাকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপে পাঠাবার জন্য আমরা জনাব সোহরাওয়ার্দীকে অনুরোধ করেছি।

আসুন আমরা সকলে মিলে তার রোগমুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। আমাদের অফিস সম্পাদক জনাব আহমদুল্লাহ সাহেব ছয়মাস পূর্বে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন তিনি নিজের শরীরের প্রতি দৃকপাত না করে আওয়ামী লীগের অফিস সম্পাদকের ...যথেষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে করিয়াছেন। অসমাপ্ত।

সংবাদ : ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭

শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২০ , ৩ মাঘ ১৪২৬, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু

শেখ মুজিবের বক্তৃতা

(গতকালের পর) ...কথায় কর্ণপাত করেননি। অতঃপর পূর্ববাংলায় ফিরে আমি ও পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান ব্যাপক সফরে বের হই। প্রায় চার মাস কাল ব্যাপক সফরের ফলে প্রায় প্রত্যেকটি জেলা ও মহকুমার আওয়ামী লীগের ইউনিট গড়ে উঠে। এ সময় জেলের অভ্যন্তরে শ্রদ্ধেয় নেতা মওলানা ভাসানী ও জনাব শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে জনাব সোহরাওয়ার্দী পূর্ববঙ্গে আসেন এবং জেলখানায় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর এক ব্যাপক সফরে তিনি প্রদেশে একাধিকক্রমে ৩৪টি সভায় বক্তৃতা করেন। তার এই সফরের ফলে রাজবন্দীদের মুক্তির আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠে। তার সভায় হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। রাজবন্দীদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক শাসন দাবি করে সর্বত্র প্রস্তাবাদি গৃহীত হয়।

প্রচ- গতিতে আমাদের সংগঠনী কার্য চলতে থাকে। মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কর্মীগণ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। ইউনিয়নে ইউনিয়নে থানায় থানায় শহরে বন্দরে সর্বত্র আওয়ামী লীগ গড়ে উঠলো। নির্বাচিত জনগণের আপন প্রতিষ্ঠান হিসেবে।

দীর্ঘ সাত বৎসরাধিককাল ফ্যসিস্ট শাসন পরিচালনা করার পর জনমতের চাপে বাধ্য হয়ে লীগ সরকার ১৯৫৪ সালে সাধারন নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করলেন। সে সময়ে জনাব ফজলুল হক সাহেব পূর্ববাংলার এডভোকেট জেনারেল। তিনি ঢাকা জেলে মওলানা সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনকালে আওয়ামী লীগে যোগদান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরে চাঁদপুরে এক বিরাট জনসভায় তিনি একথা জনসমক্ষেও ঘোষণা করেন। বলাবাহুল্য তিনি তার স্বভাবসুলভ নীতি অনুযায়ী তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি।

দীর্ঘ ২৩ মাস কাল বিনাবিচারে আটক থাকার পর মওলানা সাহেবকে ১৯৫৩ সালে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৫৩ সালেরই অক্টোবর মাসে নব সংগঠিত জনাব সোহরাওয়ার্দী কাউন্সিলের যে প্রথম প্রতিনিধিত্বমূলক সভা হয় তাতে আমি সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হই। এ সভায় আমি আওয়ামীলীগকে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান করার প্রস্তাব করি। এ ব্যাপারে আমি আমার নিজ মত ব্যক্ত করা প্রসঙ্গে বলি যে, দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর ও সত্যিকার পাকিস্তান জাতি গঠনের জন্য আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান করা প্রয়োজন। আমাদের কিছু সংখ্যক সহকর্মী ও পু?্ব্ব বাংলার জনসাধরণ যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য প্রস্তুত তা সেদিন বুঝতে পারেনি বলে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। জনাব মওলানা ভাসানী আমাদের এ প্রস্তাব অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করেন। বহু আলোচনার পর এ ব্যাপারে জনমত যাচাই করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার মওলানা সাহেবের উপর ন্যস্ত করা হয়।

নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে। দেশের যুবশ্রেণীর সম্মিলিতভাবে নির্বাচন যুদ্ধে লীগ শাহীর মোকাবেলা করার দাবি জ্ঞাপন করেন। ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত ১৭ ও ১৮ নবেম্বর তারিখে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সভায় সাধারণ নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলিম লীগ সরকারের মোকাবেলা করার দাবি উত্থিত হয়। প্রয়োজনবোধে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিয়ে লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের ক্ষমতা জনাব মওলানা ভাসানী ও জনাব সোহরাওয়ার্দীর উপর ...।

দৈনিক সংবাদ : ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭

আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে শেখ মুজিবের বক্তৃতার বিবরণ

... আমরা আওয়ামী লীগ থেকে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রস্তাব পেশ করি।

এ সময় খাদ্য সঙ্কট চরমে উঠে এবং দেশব্যাপী গণবিক্ষোভ দেখা দেয়। প্রায় প্রত্যেক জেলা সদরে গ্রামাঞ্চল থেকে ভুখা মিছিল আসতে আরম্ভ করে। রাজধানীর বুকেও ভুখা মিছিল আসতে আরম্ভ করে। দিশেহারা আবু হোসেন মন্ত্রিসভা নিজেদের আত্মরক্ষার আর কোন উপায় নেই বলে পদত্যাগ করে। বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পার জিঞ্জিরা এলাকা থেকে আগত এক ভুখা মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। চকবাজারের এই গুলিতে খাদ্যের কাঙ্গাল কঙ্কালসার কয়েক ব্যক্তি-নিহত হয়। এ খবর মুহূর্তে সমগ্র ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং বিপুল জনতা গুলিতে নিহত এক ব্যাক্তির মৃতদেহ নিয়ে বিরাট মিছিল সহকারে চকবাজার হইতে কাচারির দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। জনসাধারণের এই বিপদের দিনে আওয়ামী লীগ তাদের কাতারে শামিল হয়। গুলিবর্ষণের খবর প্রাপ্তির অল্পক্ষণ মধ্যেই জনাব আতাউর রহমান খান, আমি, ইয়ার মুহাম্মদ খান, দবির উদ্দিন, আবুল মনসুর সাহেব ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। জনতার মিছিল যাতে শান্তিপূর্ণভাবে শহর প্রদক্ষিণ করে সেজন্য আমি ও ইয়ার মুহাম্মদ খান মিছিলের সঙ্গে অগ্রসর হই।

জনাব আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমেদ আহত ব্যাক্তিদের শত্রুর ব্যবস্থার জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে গমন করেন। মিছিল সদরঘাটে পৌঁছলে পুলিশ আবার গুলিবর্ষণ করে। ওখানেও কয়েক ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়। এ সংবাদ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদে ঢাকা শহরে সর্বাত্মক হরতাল প্রতিপালিত হয়। মফস্বলেও তার অনুসরণ হতে থাকে। পূর্ববাংলার শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। বাধ্য হয়ে সরকার জনাব আতাউর রহমান খানকে একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করার আহবান করেন। দেশের নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দল হিসেবে শত বিপদও প্রায় অপ্রতিরোধ্য দুর্ভিক্ষ এবং তজ্জন্য শত শত লোকের মৃত্যুর সম্ভাবনা সামনে দেখেও আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি গভর্ণরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে দীর্ঘ ৯ বৎসর বিরোধীদল হিসেবে অবস্থান করার পর সত্যিকার আওয়ামী লীগ হিসেবে প্রদেশের শাসনকার্য চালাইবার দায়িত্ব গ্রহণ করে। যদিও আওয়ামী লীগের কাছে মন্ত্রিত্ব কিছুই নয় দেশের নিঃস্বার্থ সেবাই আদর্শ। ... বলবো।

... কাজেই মন্ত্রিসভার অন্যতম সভ্য হিসাবে, আমার মুখে আমরা যতটুকু করতে পেরেছি তার বিবরণ নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না। তাছাড়া এরূপ বিবরণ কতকটা শালীনতা বিরুদ্ধও বটে। মাত্র পাঁচ মাস সময় আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে চার মাস ব্যয় হয়েছে দুর্ভিক্ষাবস্থা থেকে দেশের জনসাধারণকে বাঁচাবার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে খাদ্যশস্য এনে তার সুষ্ঠু ও দ্রুত বিলিব্যবস্থার কাজে। সকলেই স্বীকার করবেন সকল কাজের ঊর্ধ্বে ছিল এ কাজ। আল্লাহর মেহেরবাণীতে এবং জনসাধারণের সমর্থন এবং সহকর্মীদের সহযোগিতায় আমাদের মন্ত্রিসভা তাদের এ গুরুদায়িত্ব প্রতিপালন করিতে সমর্থ হয়েছে। ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ত কিছু কিছু হয়েছে; কিন্তু তা সদিচ্ছার অভাবে নয়, দুরতিক্রম্য বাধা বিপত্তির জন্য। তাছাড়া একথাও আপনারা স্মরণ রাখবেন যে শাসনভার পরিচালনার জন্য আমাদের কারও কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নিতেও কিছুটা সময় লেগেছে।

প্রসঙ্গত আর একটি কথার এখানে উল্লেখ করতে হয়। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করার অব্যবহিত পরেই কেন্দ্রে মুসলিম লীগ কৃষক শ্রমিক কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তখন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্র মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য প্রেসিডেন্ট আমন্ত্রণ করেন। সোহরাওয়ার্দী এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। কেন্দ্রে ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে জনাব সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভা পূর্ববঙ্গের খাদ্য সংকট সমাধানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সরকারকে অর্থ সাহায্য ছাড়াও তাদের সঙ্গে মনে প্রাণে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করেছেন। এজন্য সোহরাওয়ার্দী ও তার মন্ত্রিসভার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ এবং তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এ সময়ের মধ্যে খাদ্য সমস্যার সমাধান ছাড়াও আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভা সর্ব্বাপেক্ষা বেশি উল্লেখযোগ্য যে কাজ করেছে তা হলো, বিপুল ভোটাধিক্যে যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের এসেম্বলিতে প্রস্তাব গ্রহণ। কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টেও এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। ফলে আগামী নির্বাচন যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে হচ্ছে এবং সত্যিকার পাকিস্তানি জাতি সৃষ্টি হওয়ার সূত্রপাত হচ্ছে।

ভাইসব এখন ভবিষ্যত সম্পর্কে দুচারটি কথা আমাকে বলতে হচ্ছে। আগামী মার্চ-এপ্রিল মাসে সাধারণ নির্বাচন হবে বলে আশা করা যায়। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হবে। এই পরিষদের জন্য ৪৬৫ জন প্রতিনিধিকে আমাদের মনোনয়ন প্রদান করতে হবে। তাদের বাছাই ছাড়াও দেশের সর্বপ্রথম এই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে পার্টিকে সাফল্যম-িত করা যে কি বিরাট দায়িত্বপূর্ণ কাজ তা আশা করি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। এখন হতে সেজন্য বিপুল উদ্যম নিয়ে কাজে নামতে হবে। মনে রাখবেন, এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কোথাও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করেনি। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভের পূর্বে পার্টির নির্দেশিত সমস্ত কাজ করা যেসব সময়ে সম্ভবপর হয়ে উঠে না তা আপনারা জ্ঞাত আছেন। কাজেই আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিক দিক থেকে আরো শক্তিশালী ও দুর্জয় করে তুলতে হবে। জনগণকে আওয়ামী লীগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার জন্য দিবারাত্রি চালাতে হবে প্রচার। তাদের দৈনন্দিন দুঃখ দুর্দশার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সহানুভূতি ও সমর্থন আনতে হবে পার্টির জন্য। তাদের অভাব-অভিযোগ মন্ত্রিসভার কাছে পেশ করতে হবে আওয়ামী লীগকেই। এক কথায় জনসাধারণের সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকেই গ্রহণ করতে হবে। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের বৈপ্লবিক রূপ বদলানো চলবে না। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পূর্বে আওয়ামী লীগ যেমন জনসাধারণের সকল আন্দোলনের পুরোধায় রয়েছে এখনও তেমনি পুরোধায় থাকতে হবে তাকে। একমাত্র এই পন্থায় আওয়ামী লীগ দেশের রাজনৈতিক জীবনে জীবিত থাকবে।

ইউনিয়ন, থানা ও মহকুমা আওয়ামী লীগগুলোকে বর্তমান অপেক্ষা বেশি সক্রিয় করে তুলতে হবে। যেসব স্থানে আওয়ামী লীগের কমিটি এখন পর্যন্ত গঠিত হয়নি কর্মীগণকে যেসব জায়গায় কমিটি গঠনের কার্যে করতে হবে আত্মনিয়োগ। আওয়ামী লীগ গড়তে হবে দেশের সর্বত্র। আমাদের রয়েছে মহান ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে জনহিতকর মহান কর্মসূচি। সে কর্মসূচি জনসাধারণ গ্রহণ করেছে। আমাদের প্রোগ্রামের ডাকে তারা সাড়া দিয়েছেন। আমাদের সাফল্য অনিবার্য।

শেষ করার পূর্বে যে কথাটির উল্লেখ করতে চাই, তা হলো আওয়ামী লীগ এখন অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। কাজেই প্রতিষ্ঠানে সকল সম্প্রদায়ের লোক যোগদান করতে পারে সেদিকেও কর্মীদের লক্ষ্য রাখতে হবে।

উপসংহারে আমি আর সামান্য দু’চারটি কথা বলতে চাই- আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি ও সীমাবদ্ধ ক্ষমতা নিয়ে আমি আপনাদের সাধারণ সম্পাদকের কাজ করে এসেছি। একাজ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানের ওপর দিয়ে। আপনাদের সহায়তায় যথাসাধ্য মোকাবেলা করেছি। কিন্তু শত চেষ্টা ও শত সদিচ্ছা থাকলেও অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি হয়েছে হয়তো অনেক ব্যাপারে। অনেকক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ গতিকেই আপনারা আমার কাছ থেকে আশা করেছেন ততটুকু পাননি। আপনারা নিজগুণে তা ক্ষমা করে নিয়েছেন। আজ বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে, আমার কার্যকালে আমি আপনাদের সকলের যে অগাধ স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি। তজ্জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

আজ থেকে আবার আমি কোনরকম পদমর্যাদা ব্যতিরেকে সাধারণ একজন কর্মী হিসেবে আওয়ামী লীগের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারবো, সে আমার আনন্দ। শেষ করার পূর্বে আওয়ামী লীগের ভূতপূর্ব সাধারণ সম্পাদক জনাব সামসুল হক সম্পর্কে দু’চারটি কথা বলতে চাই। পূর্ব বাংলার সবচাইতে বিপদের দিনে তিনি মওলানা ভাসানীর সহকর্মী হিসেবে লীগ সরকারের চ-নীতির বিরুদ্ধে দ-ায়মান হন। দীর্ঘকাল কারাবরণের ফলে তিনি আজ গুরুতর অসুস্থ। বর্তমানে তিনি লাহোর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। প্রয়োজনবোধে তাকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপে পাঠাবার জন্য আমরা জনাব সোহরাওয়ার্দীকে অনুরোধ করেছি।

আসুন আমরা সকলে মিলে তার রোগমুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। আমাদের অফিস সম্পাদক জনাব আহমদুল্লাহ সাহেব ছয়মাস পূর্বে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন তিনি নিজের শরীরের প্রতি দৃকপাত না করে আওয়ামী লীগের অফিস সম্পাদকের ...যথেষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে করিয়াছেন। অসমাপ্ত।

সংবাদ : ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭