কমরেড অমল সেনের গোটা ছয়েক কবিতা ও বিপ্লব

আলম সাইফুল

কমরেড অমল সেনের গোটা ছয়েক কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল সাপ্তাহিক নতুন কথার বিশেষ সংখ্যায় দু’হাজার তিন সালে। কবিতাগুলো সংগৃহীত হয়েছিল অরুণা চৌধুরীর কাছ থেকে পাদদেশ-সূত্র থেকে এমনটিই জানা যায়। পরবর্তীকালে হয়ত কমরেড অমল সেনের আরও কবিতা তার অন্যান্য রচনাবলীর সাথে মুদ্রিত হয়ে থাকতে পারে; আমার জানা নেই। হন্যে হয়ে কিছু-একটা খুঁজতে গিয়ে ওই সংখ্যাটি এত বছর পরে পুরাতন কাগজপত্রের বস্তা থেকে হাতে আসায় এবং পুরাতন স্মৃতি মনে পড়ায় বাঙলা সিনেমার আপাত ব্যর্থ নায়কের মতো এক নস্টালজিক আবেশে কবিতাগুলো পড়তে পড়তে এক বিশেষভাব উদয় হয়, আর অন্যদের কাছে তা ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাকুলতা থেকে এ ছোট্ট নিবন্ধটির সূত্রপাত। সজ্ঞানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বর্জন করায় এবং তা থেকে দূরে থাকায় এছাড়া যে উপায় নেই। সমাজ বিচ্ছিন্ন আত্মকেন্দ্রিক এক যান্ত্রিক মাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম; যা বাস্তব ও ব্যক্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্তরায়। হয়তবা এ কারণে আমাদের সন্তানদের মনে কিংবা স্মৃতিপটে আমাদের মতো প্রাণোচ্ছল সময়গুলোর স্মৃতি জমবে না, স্মৃতিকাতরতা বা স্মৃতিবিধুরতায় কাতর হবে না। প্রযুক্তির ব্যবসায়িক সুচতুর ব্যবহার আমাদের সন্তানদের আসক্ত করছে, বাস্তব ও ব্যক্তিক সম্পর্কের সামাজিক যোগাযোগ হ্রাস করছে। তাহলে এমন সোনালি স্মৃতি তারা কিভাবে নির্মাণ করবে, কিভাবে মানবিক মমতায় উদ্ভাসিত হবে, কিভাবে জানবে মাটির স্পর্শে সোনা-ধান ফলে, কৃষক-কৃষাণীর গায়ের ঘাম তারা চিনবে কী করে। সমাজতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র দিয়ে কি করব যদি মমতা না থাকে, যদি ঘামের গন্ধে ফলানো ফসলের অধিকার নিয়ে আমাদের সন্তানরা কথা না বলে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই সুচতুর ব্যবসায়িক চক্রকে মানুষের কল্যাণে ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণে নিয়োজিত করার লড়াইটাই এখন ক্রমান্বয়ে মুখ্য হয়ে উঠছে, সমাজতন্ত্রী কিংবা গণতন্ত্রী তথা অন্য কোনো তন্ত্রী- সবার লড়াই এখন এটাই হওয়া উচিত বৈকি, এটাই এ সময়ের অন্যতম দাবি। যেন মাটির গন্ধে মুগ্ধ থাকি, মাটির সংস্কৃতিতে নাড়ি পুঁতে রাখি। আকাশ সংস্কৃতি তথা মেঘমালা-সংস্কৃতিতে (ক্লাউড-নেট) কিছুক্ষণের জন্যে ভাসতে পারি; তবে তা যেন শেকড়কে উপড়ে না ফেলতে পারে। এ সাবধানতা আমাদের রক্ষা করতে হবে। তা না হলে বিপদ এড়ানো যাবে না। বিশ্ব-নাগরিকের রঙিন স্বপ্নে বিভোর তথা তার পিছনে দৌড়ানোর যুক্তির মারপ্যাচে, নিজের নগর-নাগরিকতার গ্রাম-গ্রামীণতার প্রবহমান শিকড় তথা মনো-সংস্কৃতিচ্যুত যেন না হই। তা না হলে অনেক খেসারত দিতে হবে আমাদের সন্তানদের।

যাই হোক, কমরেড অমল সেন চিরবিপ্লবী ও চিরসবুজ এক সত্তা। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, এর জন্য গবেষণা-বিশ্নেষণেরও দরকার হয় না। মেধায়-চিন্তায়-চরিত্রে একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট আদর্শ ধারণ ও বহন করেছেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, সাক্ষ্য দিচ্ছি। পরিশেষে তিনি তার চিন্তা-চেতনাকে লিখে গেছেন পরিমাণে স্বল্প হলেও; বিশ্লেষণ করে গেছেন সমাজ-রাষ্ট্র-কমিউনিস্ট আদর্শকে, সংগ্রামের রণকৌশলকে। তেমনি ছন্দবদ্ধ করে গেছেন মনের আবেগও। আজীবন লড়াই করেছেন, সে কারণে বোধহয় লিখেছেন কম, তবে লেখার বাসনা ছিল। অনুরূপ নিবেদিতপ্রাণ ও মহান মানুষগুলোর লড়াই-সংগ্রাম চিন্তা-চেতনার পথ ধরেই আজ আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম। পৃথিবীর মানচিত্রে আজ অবস্থান করছি মর্যাদায় মাথা উঁচু করে। এ নিবন্ধ তার সংগ্রামী জীবন নিয়ে নয়। তাই ও-পথে পা না বাড়িয়ে, আসল কথা বলতে এক্ষণে প্রয়াসী হচ্ছি। আর তা হল- ওই ছয়খানা কবিতা পাঠের রেশ বা আবেশ। কবিতাগুলোর শিরোনাম হলÑ হেই আব্বার কাস্তেখানা, যদিও, যুৎসই স্বপ্ন, সতীন, মায়ের চোখে বৃষ্টি ও গতর ভাঙলে।

লাঙ্গল, জমি ও ফসলের সুষম বণ্টন, দেশ গঠন, দরিদ্রতা-শোষণ ও নিষ্ঠুরতার অবসানের আশায় ও লক্ষ্যে যেমন লড়াই সংগ্রাম চালিয়েছেন আজীবনের এই বিপ্লবী, তেমনি কবিতা লিখেছেন আপন-মনের রঙে ও বিশ্বাসে। কৃষক-শ্রমিকের গতরের শ্রম ছন্দায়িত হয়ে সৃষ্টি হয় যে-শব্দ তা হল ‘হেঁইও’; আদিম শ্রম-সমাজের প্রগতি ও সৃষ্টির মন্ত্রও বটে। সৃষ্টিশীলতার এই বীজ রূপবৈচিত্র্যে কাব্যময় হয়ে ওঠে অমল সেনের কবিতার ধ্বনিতে ধ্বনিতে, শব্দে-বাক্যে ছন্দে।

কৃষক-ক্ষেতমজুর ধান কাটছে আর তার ছোট্ট মেয়েটি ধান ক্ষেতে পড়ে থাকা ধানের শীষ, ঝরে পড়া ধান কুড়াচ্ছে; কচি মনের আনন্দে, অবুঝ মনের আনন্দে। এ-চিত্রপটে অমল সেনের কবিতা ‘হেই আব্বার কাস্তেখানা’। ছোট্ট মেয়েটি তার আব্বার কাস্তের কাছে মনের আকুতি কিংবা প্রার্থনা প্রকাশ করছে এভাবে-

হেই আব্বার কাস্তেখানা

ছেড়ে যায় না দু’একটি শীষ লক্ষ্মীটি

অন্যদিকে জমিদারের শকুন-চোখ এড়ায় না ছোট্ট মেয়েটির চঞ্চলা হৃদয়ের আকুতির ক্রিয়াকর্মেÑ

ম-লের ছোট ব্যাটা আবার কেমন চায়

যেন আঁটি থেকেই কেটে নিচ্ছি শীষ

সকল দুঃখ, কষ্ট আর জীবন বাস্তবতার পথে চলতে চলতে আশা-আকাক্সক্ষার যে সুখপাখী তা ছোট্ট মেয়েটির চোখে ধরা দেয়নি। সে তার স্বাধীন হৃদয়ে স্বপ্ন বোনে, স্বপ্ন ধারণ করে এগিয়ে যেতে চায়-

দেখিস আমাদেরও একখানা জমি হবে

আব্বা বলেছে সেখানে যখন ধান কাটবে

একটি আঁটিও কাউকে দিতে হবে না

তখন আর তোকে সাধতে যাব না

হেই আব্বার কাস্তেখানা।

ছোট্ট মেয়েটির চাওয়া পাওয়ার যোগ-বিয়োগের সাথে মিশে আছে কৃষক-শ্রমিক-ক্ষেতমজুরের প্রাণের দাবি ও চির-আকাঙ্খা; গ্রামীণ নিম্নবিত্তই শুধু নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তানদেরও এমন স্মৃতি নাড়া দেয় জীবনের কোন এক পরতে; এ যে গ্রাম-বাংলার চিত্রপট। নাগরিক-আমাদের অনেকের শৈশব স্মৃতিতে মিশে আছে এমন দৃশ্যপট, অম্ল-মধুর শিল্পপট। বিশেষকরে যাদের জীবনে সামান্য কিছু কালের জন্য হলেও গ্রামের ছোঁয়া আছে, ধানক্ষেতের ছোঁয়া আছে। অভাব ছিল না আমাদের সংসারে; তারপরও রোদেলা দুপুরে কিংবা শীতার্ত কুয়াশার ভোরে খেলার ছলে, আনন্দের ছলে ঘুরে বেড়িয়েছি ধু-ধু মাঠে, ধানক্ষেতে, আলুক্ষেতে, আম বাগানে। আমাদের এমন স্মৃতিপটে বাস্তবের নিষ্ঠুরতা না থাকলেও, অনেক কিশোর-কিশোরীর জীবন বাস্তবতায় দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কশাঘাতের স্মৃতি কাঁদায়-পোড়ায়। জীবন পোড়ানোর এক অপরূপ নিষ্ঠুর রূপায়ন এই কবিতাটি। পাঠকের মনে শিহরণ জাগায়। বাঙলার সামন্ত-জমিদার-জোতদার আর দিনমজুর-ক্ষেতমজুরদের শোষণ-শাসনের চিরদ্বন্দ্বময় সামাজিক ধারার চিত্র সর্বত্র ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন অমল সেন এ কবিতায়; এবং তার সমগ্র লেখনীমালায় এ দুই উপাদান ভিন্ন অন্য উপাদানের আনাগোনা কম, দেখা যায় না বললেই চলে।

কৃষক তার জমির ফসল তার ঘরে তুলবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ঐতিহাসিককাল থেকে সমাজে এ স্বাভাবিক কাজটি যে স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হয়নি তা বিদিত। তাই তো এত সংগ্রাম, এত লড়াই। আর এ লড়াই শাসক আর শোষিতের। এটি চিরদ্বন্দ্বময়, সংঘাতময়। কবি অমল সেনের উপলব্ধি এরূপ-

গোলামীর কবুলিয়ত নামায়

আজও দিয়ে যাই বৃদ্ধ আঙ্গুলের স্বাক্ষর

আক্রোশের আগুনে একদিন

এ নাঙ্গল হবে নাঙ্গা-তলোয়ার। (যদিও)

তেভাগা আন্দোলনের অগ্রপথিক কমরেড অমল সেনের কলমে এমন আশাবাদী কবিতাই স্বাভাবিক। আজীবন কৃষক শ্রমিকের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে প্রত্যয়ী। কৃষক-কৃষাণীর সাথে একাত্ম হয়ে গড়ে তোলেন আন্দোলন, লড়াই ও সংগ্রাম জীবনভর মনুষের-সমাজের ন্যায্য হিস্যার জন্যে। অন্যদিকে সমাজের অসঙ্গতিগুলোকেও ছন্দময় করতে চেয়েছেন আজীবন।

কৃষক-জমি-ফসল আর সামন্ত জমিদারের শোষণে চির ক্ষুধার্ত কৃষকের কাছে জমি আর ফসল যেন সতীন, অপূর্ব এক রূপকের আশ্রয়ে তিনি যেন ঘরের সতীনের রোমান্টিক অম্ল-মধুর সম্পর্ককে উপস্থাপন করেছেন সামন্তবাদী সমাজের বাঙলার কৃষক-কৃষকবধূর গতর খাটা জমি আর ফসলের দ্বান্দ্বিকরূপে। অপূর্ব বিষয়-বাস্তবতা ও সংগ্রামের শানিত চেতনার প্রকাশ সতীন কবিতাটি। যৌক্তিক কারণে কবিতাটির একটু দীর্ঘ উদ্ধৃতি তুলে ধরছি-

বসন্তের কোন রাতে

যদিও বা বউ এর বুকে জাগে সাড়া

আমি তখন

সারাদিন চৈতে ঢেলার সাথে ধস্তাধস্তির পর

ঘুমিয়ে থাকার মড়া।

জোবৃষ্টির পরে আমার জমি যখন

আমার লাঙ্গলের মুখে বুক এলিয়ে দিতে উন্মুখ।

ভিজে মাটির গন্ধে মন যখন আমার উতাল,

সপসপে মেঝের কোণে

বউটি আমার তখন গোমড়া মুখ!

মাঠের হাওয়ায় আর ফসলের ছোঁয়ায়

মনের মধ্যে যতসব সুন্দর কথা গোছানো গেল

উঠনে পা দিতেই সব হয়ে যায় ঝাঁঝালো।

মাঠের গান ঘরে যেতেই হয়ে যায় কান্না

মাঠখানা কখনোই ঘরে আনা গেল না

মাঠের ফসল ঘরে যাবে না

পথ থেকে পালালো

মাঠ আর ঘর

চিরদিন সতীন হয়েই রইলো। (সতীন)

মাঠ আর ফসল যেন চির সতীন না হয়ে কৃষকের বধূ হয়ে ঘরের লক্ষ্মী হয়; হয় স্বর্বধূ। সেই স্বপ্নের জন্য লড়ে গেছেন জীবনভর, চিরকুমার কমরেড অমল সেন। ব্যক্তি সম্পত্তিতে অবিশ^াসী কমিউনিস্ট অমল সেন; রাজনৈতিক চেতনায় ও বিশ^াসে নিজে যে স্বপ্ন দেখেছেন, সে স্বপ্ন দেখিয়েছেন শোষিত গণমানুষকে, বলেছেন তার কবিতায় উদাত্তভাবে।

জীবনের আইলের এই চৌহদ্দির মধ্যেই ফলতে পারে

এমনিতর কোন একটি যুৎসই স্বপ্ন

সত্যিই কি দেখা চলে না। (যুৎসই স্বপ্ন)

কুড়েঘরে মাদুর পেতে স্বপ্নহীন রাত কেটে যায় কৃষকের কিন্তু বর্ষার টপাস টপাস বৃষ্টির শব্দ কৃষক-কন্যার হৃদয়ে যে রসায়ন সৃষ্টি করে তা করুণ কন্ঠে ধ্বনিত হয় অজানা এক সুরে, গুমড়ে ওঠে জীবনের অস্ফুট ভাষা, সামাজিক বন্দীদশায়। ভাঙ্গতে পারে না শিকল; শুধু ভেঙ্গে যায়, ক্ষয়ে যায় কুড়েঘর। বর্ষায় গতরখাটা খাটি মাটির মানুষদের অব্যক্ত করুণ জীবনযাপন অমল সেন গভীরভাবে নিরীক্ষা করেছেন এবং জীবনের এই অনুভূতিকে ব্যক্ত করতে, ছন্দায়িত করতে প্রয়াসী হয়েছেন, এই ভেবে যেন শোষিতের প্রতি আমাদের যে দায় তা যেন আমরা এড়িয়ে না যাই, ভুলে না যাই, তাদের স্বপ্নগুলোকে পুঁজি বানিয়ে আত্মসাৎ না করি, চুরি না করি।

আবার টপাস পড়ছে এই

মাদুর সরার আর জায়গা নেই।

...

বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে

মায়ের চোখে বৃষ্টি ঝরে।

কৃষক-কৃষাণীর আর কৃষক-কন্যার জীবনে বর্ষার রাতের ধারা রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান না হয়ে, যেন ডোবা থেকে লাফ দিয়ে আসা ছোট্ট কন্যার কোলে পড়া ব্যাঙের দাঁত কিড়মিড় ছাড়া আর কী-বা অনুভূতির উদ্রেক করতে পারে। পৃথিবীর কোণে কোণে ছোট ছোট ঘরগুলির ছোট ছোট স্বপ্নগুলো কবে পাখা মেলে উড়তে পারবে, জানে কি কোনো লৌকিক রাজনৈতিক দর্শন!

স্বপ্নই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়, বাঁচতে শেখায় নতুনভাবে। রোমান্টিক এই বিপ্লবীর জীবন-কর্ম নিয়ে এখনও বিশদ গবেষণা হয়নি। জানি না এত দৈন্য কেন? গবেষণা তো প্রগতির সোপান। তবে কেন এত নীরবতা বাংলার প্রগতির ইতিহাসে। প্রগতিতে এত কার্পণ্য কিংবা এত সংকীর্ণতা কেন? প্রগতিশীল রাজনীতি ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের চিন্তা-চেতনা নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের আবশ্যকতা রয়েছে।

[লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক]

শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২০ , ৩ মাঘ ১৪২৬, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

কমরেড অমল সেনের গোটা ছয়েক কবিতা ও বিপ্লব

আলম সাইফুল

কমরেড অমল সেনের গোটা ছয়েক কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল সাপ্তাহিক নতুন কথার বিশেষ সংখ্যায় দু’হাজার তিন সালে। কবিতাগুলো সংগৃহীত হয়েছিল অরুণা চৌধুরীর কাছ থেকে পাদদেশ-সূত্র থেকে এমনটিই জানা যায়। পরবর্তীকালে হয়ত কমরেড অমল সেনের আরও কবিতা তার অন্যান্য রচনাবলীর সাথে মুদ্রিত হয়ে থাকতে পারে; আমার জানা নেই। হন্যে হয়ে কিছু-একটা খুঁজতে গিয়ে ওই সংখ্যাটি এত বছর পরে পুরাতন কাগজপত্রের বস্তা থেকে হাতে আসায় এবং পুরাতন স্মৃতি মনে পড়ায় বাঙলা সিনেমার আপাত ব্যর্থ নায়কের মতো এক নস্টালজিক আবেশে কবিতাগুলো পড়তে পড়তে এক বিশেষভাব উদয় হয়, আর অন্যদের কাছে তা ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাকুলতা থেকে এ ছোট্ট নিবন্ধটির সূত্রপাত। সজ্ঞানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বর্জন করায় এবং তা থেকে দূরে থাকায় এছাড়া যে উপায় নেই। সমাজ বিচ্ছিন্ন আত্মকেন্দ্রিক এক যান্ত্রিক মাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম; যা বাস্তব ও ব্যক্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্তরায়। হয়তবা এ কারণে আমাদের সন্তানদের মনে কিংবা স্মৃতিপটে আমাদের মতো প্রাণোচ্ছল সময়গুলোর স্মৃতি জমবে না, স্মৃতিকাতরতা বা স্মৃতিবিধুরতায় কাতর হবে না। প্রযুক্তির ব্যবসায়িক সুচতুর ব্যবহার আমাদের সন্তানদের আসক্ত করছে, বাস্তব ও ব্যক্তিক সম্পর্কের সামাজিক যোগাযোগ হ্রাস করছে। তাহলে এমন সোনালি স্মৃতি তারা কিভাবে নির্মাণ করবে, কিভাবে মানবিক মমতায় উদ্ভাসিত হবে, কিভাবে জানবে মাটির স্পর্শে সোনা-ধান ফলে, কৃষক-কৃষাণীর গায়ের ঘাম তারা চিনবে কী করে। সমাজতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্র দিয়ে কি করব যদি মমতা না থাকে, যদি ঘামের গন্ধে ফলানো ফসলের অধিকার নিয়ে আমাদের সন্তানরা কথা না বলে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই সুচতুর ব্যবসায়িক চক্রকে মানুষের কল্যাণে ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণে নিয়োজিত করার লড়াইটাই এখন ক্রমান্বয়ে মুখ্য হয়ে উঠছে, সমাজতন্ত্রী কিংবা গণতন্ত্রী তথা অন্য কোনো তন্ত্রী- সবার লড়াই এখন এটাই হওয়া উচিত বৈকি, এটাই এ সময়ের অন্যতম দাবি। যেন মাটির গন্ধে মুগ্ধ থাকি, মাটির সংস্কৃতিতে নাড়ি পুঁতে রাখি। আকাশ সংস্কৃতি তথা মেঘমালা-সংস্কৃতিতে (ক্লাউড-নেট) কিছুক্ষণের জন্যে ভাসতে পারি; তবে তা যেন শেকড়কে উপড়ে না ফেলতে পারে। এ সাবধানতা আমাদের রক্ষা করতে হবে। তা না হলে বিপদ এড়ানো যাবে না। বিশ্ব-নাগরিকের রঙিন স্বপ্নে বিভোর তথা তার পিছনে দৌড়ানোর যুক্তির মারপ্যাচে, নিজের নগর-নাগরিকতার গ্রাম-গ্রামীণতার প্রবহমান শিকড় তথা মনো-সংস্কৃতিচ্যুত যেন না হই। তা না হলে অনেক খেসারত দিতে হবে আমাদের সন্তানদের।

যাই হোক, কমরেড অমল সেন চিরবিপ্লবী ও চিরসবুজ এক সত্তা। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, এর জন্য গবেষণা-বিশ্নেষণেরও দরকার হয় না। মেধায়-চিন্তায়-চরিত্রে একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট আদর্শ ধারণ ও বহন করেছেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, সাক্ষ্য দিচ্ছি। পরিশেষে তিনি তার চিন্তা-চেতনাকে লিখে গেছেন পরিমাণে স্বল্প হলেও; বিশ্লেষণ করে গেছেন সমাজ-রাষ্ট্র-কমিউনিস্ট আদর্শকে, সংগ্রামের রণকৌশলকে। তেমনি ছন্দবদ্ধ করে গেছেন মনের আবেগও। আজীবন লড়াই করেছেন, সে কারণে বোধহয় লিখেছেন কম, তবে লেখার বাসনা ছিল। অনুরূপ নিবেদিতপ্রাণ ও মহান মানুষগুলোর লড়াই-সংগ্রাম চিন্তা-চেতনার পথ ধরেই আজ আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম। পৃথিবীর মানচিত্রে আজ অবস্থান করছি মর্যাদায় মাথা উঁচু করে। এ নিবন্ধ তার সংগ্রামী জীবন নিয়ে নয়। তাই ও-পথে পা না বাড়িয়ে, আসল কথা বলতে এক্ষণে প্রয়াসী হচ্ছি। আর তা হল- ওই ছয়খানা কবিতা পাঠের রেশ বা আবেশ। কবিতাগুলোর শিরোনাম হলÑ হেই আব্বার কাস্তেখানা, যদিও, যুৎসই স্বপ্ন, সতীন, মায়ের চোখে বৃষ্টি ও গতর ভাঙলে।

লাঙ্গল, জমি ও ফসলের সুষম বণ্টন, দেশ গঠন, দরিদ্রতা-শোষণ ও নিষ্ঠুরতার অবসানের আশায় ও লক্ষ্যে যেমন লড়াই সংগ্রাম চালিয়েছেন আজীবনের এই বিপ্লবী, তেমনি কবিতা লিখেছেন আপন-মনের রঙে ও বিশ্বাসে। কৃষক-শ্রমিকের গতরের শ্রম ছন্দায়িত হয়ে সৃষ্টি হয় যে-শব্দ তা হল ‘হেঁইও’; আদিম শ্রম-সমাজের প্রগতি ও সৃষ্টির মন্ত্রও বটে। সৃষ্টিশীলতার এই বীজ রূপবৈচিত্র্যে কাব্যময় হয়ে ওঠে অমল সেনের কবিতার ধ্বনিতে ধ্বনিতে, শব্দে-বাক্যে ছন্দে।

কৃষক-ক্ষেতমজুর ধান কাটছে আর তার ছোট্ট মেয়েটি ধান ক্ষেতে পড়ে থাকা ধানের শীষ, ঝরে পড়া ধান কুড়াচ্ছে; কচি মনের আনন্দে, অবুঝ মনের আনন্দে। এ-চিত্রপটে অমল সেনের কবিতা ‘হেই আব্বার কাস্তেখানা’। ছোট্ট মেয়েটি তার আব্বার কাস্তের কাছে মনের আকুতি কিংবা প্রার্থনা প্রকাশ করছে এভাবে-

হেই আব্বার কাস্তেখানা

ছেড়ে যায় না দু’একটি শীষ লক্ষ্মীটি

অন্যদিকে জমিদারের শকুন-চোখ এড়ায় না ছোট্ট মেয়েটির চঞ্চলা হৃদয়ের আকুতির ক্রিয়াকর্মেÑ

ম-লের ছোট ব্যাটা আবার কেমন চায়

যেন আঁটি থেকেই কেটে নিচ্ছি শীষ

সকল দুঃখ, কষ্ট আর জীবন বাস্তবতার পথে চলতে চলতে আশা-আকাক্সক্ষার যে সুখপাখী তা ছোট্ট মেয়েটির চোখে ধরা দেয়নি। সে তার স্বাধীন হৃদয়ে স্বপ্ন বোনে, স্বপ্ন ধারণ করে এগিয়ে যেতে চায়-

দেখিস আমাদেরও একখানা জমি হবে

আব্বা বলেছে সেখানে যখন ধান কাটবে

একটি আঁটিও কাউকে দিতে হবে না

তখন আর তোকে সাধতে যাব না

হেই আব্বার কাস্তেখানা।

ছোট্ট মেয়েটির চাওয়া পাওয়ার যোগ-বিয়োগের সাথে মিশে আছে কৃষক-শ্রমিক-ক্ষেতমজুরের প্রাণের দাবি ও চির-আকাঙ্খা; গ্রামীণ নিম্নবিত্তই শুধু নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তানদেরও এমন স্মৃতি নাড়া দেয় জীবনের কোন এক পরতে; এ যে গ্রাম-বাংলার চিত্রপট। নাগরিক-আমাদের অনেকের শৈশব স্মৃতিতে মিশে আছে এমন দৃশ্যপট, অম্ল-মধুর শিল্পপট। বিশেষকরে যাদের জীবনে সামান্য কিছু কালের জন্য হলেও গ্রামের ছোঁয়া আছে, ধানক্ষেতের ছোঁয়া আছে। অভাব ছিল না আমাদের সংসারে; তারপরও রোদেলা দুপুরে কিংবা শীতার্ত কুয়াশার ভোরে খেলার ছলে, আনন্দের ছলে ঘুরে বেড়িয়েছি ধু-ধু মাঠে, ধানক্ষেতে, আলুক্ষেতে, আম বাগানে। আমাদের এমন স্মৃতিপটে বাস্তবের নিষ্ঠুরতা না থাকলেও, অনেক কিশোর-কিশোরীর জীবন বাস্তবতায় দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কশাঘাতের স্মৃতি কাঁদায়-পোড়ায়। জীবন পোড়ানোর এক অপরূপ নিষ্ঠুর রূপায়ন এই কবিতাটি। পাঠকের মনে শিহরণ জাগায়। বাঙলার সামন্ত-জমিদার-জোতদার আর দিনমজুর-ক্ষেতমজুরদের শোষণ-শাসনের চিরদ্বন্দ্বময় সামাজিক ধারার চিত্র সর্বত্র ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন অমল সেন এ কবিতায়; এবং তার সমগ্র লেখনীমালায় এ দুই উপাদান ভিন্ন অন্য উপাদানের আনাগোনা কম, দেখা যায় না বললেই চলে।

কৃষক তার জমির ফসল তার ঘরে তুলবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ঐতিহাসিককাল থেকে সমাজে এ স্বাভাবিক কাজটি যে স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হয়নি তা বিদিত। তাই তো এত সংগ্রাম, এত লড়াই। আর এ লড়াই শাসক আর শোষিতের। এটি চিরদ্বন্দ্বময়, সংঘাতময়। কবি অমল সেনের উপলব্ধি এরূপ-

গোলামীর কবুলিয়ত নামায়

আজও দিয়ে যাই বৃদ্ধ আঙ্গুলের স্বাক্ষর

আক্রোশের আগুনে একদিন

এ নাঙ্গল হবে নাঙ্গা-তলোয়ার। (যদিও)

তেভাগা আন্দোলনের অগ্রপথিক কমরেড অমল সেনের কলমে এমন আশাবাদী কবিতাই স্বাভাবিক। আজীবন কৃষক শ্রমিকের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে প্রত্যয়ী। কৃষক-কৃষাণীর সাথে একাত্ম হয়ে গড়ে তোলেন আন্দোলন, লড়াই ও সংগ্রাম জীবনভর মনুষের-সমাজের ন্যায্য হিস্যার জন্যে। অন্যদিকে সমাজের অসঙ্গতিগুলোকেও ছন্দময় করতে চেয়েছেন আজীবন।

কৃষক-জমি-ফসল আর সামন্ত জমিদারের শোষণে চির ক্ষুধার্ত কৃষকের কাছে জমি আর ফসল যেন সতীন, অপূর্ব এক রূপকের আশ্রয়ে তিনি যেন ঘরের সতীনের রোমান্টিক অম্ল-মধুর সম্পর্ককে উপস্থাপন করেছেন সামন্তবাদী সমাজের বাঙলার কৃষক-কৃষকবধূর গতর খাটা জমি আর ফসলের দ্বান্দ্বিকরূপে। অপূর্ব বিষয়-বাস্তবতা ও সংগ্রামের শানিত চেতনার প্রকাশ সতীন কবিতাটি। যৌক্তিক কারণে কবিতাটির একটু দীর্ঘ উদ্ধৃতি তুলে ধরছি-

বসন্তের কোন রাতে

যদিও বা বউ এর বুকে জাগে সাড়া

আমি তখন

সারাদিন চৈতে ঢেলার সাথে ধস্তাধস্তির পর

ঘুমিয়ে থাকার মড়া।

জোবৃষ্টির পরে আমার জমি যখন

আমার লাঙ্গলের মুখে বুক এলিয়ে দিতে উন্মুখ।

ভিজে মাটির গন্ধে মন যখন আমার উতাল,

সপসপে মেঝের কোণে

বউটি আমার তখন গোমড়া মুখ!

মাঠের হাওয়ায় আর ফসলের ছোঁয়ায়

মনের মধ্যে যতসব সুন্দর কথা গোছানো গেল

উঠনে পা দিতেই সব হয়ে যায় ঝাঁঝালো।

মাঠের গান ঘরে যেতেই হয়ে যায় কান্না

মাঠখানা কখনোই ঘরে আনা গেল না

মাঠের ফসল ঘরে যাবে না

পথ থেকে পালালো

মাঠ আর ঘর

চিরদিন সতীন হয়েই রইলো। (সতীন)

মাঠ আর ফসল যেন চির সতীন না হয়ে কৃষকের বধূ হয়ে ঘরের লক্ষ্মী হয়; হয় স্বর্বধূ। সেই স্বপ্নের জন্য লড়ে গেছেন জীবনভর, চিরকুমার কমরেড অমল সেন। ব্যক্তি সম্পত্তিতে অবিশ^াসী কমিউনিস্ট অমল সেন; রাজনৈতিক চেতনায় ও বিশ^াসে নিজে যে স্বপ্ন দেখেছেন, সে স্বপ্ন দেখিয়েছেন শোষিত গণমানুষকে, বলেছেন তার কবিতায় উদাত্তভাবে।

জীবনের আইলের এই চৌহদ্দির মধ্যেই ফলতে পারে

এমনিতর কোন একটি যুৎসই স্বপ্ন

সত্যিই কি দেখা চলে না। (যুৎসই স্বপ্ন)

কুড়েঘরে মাদুর পেতে স্বপ্নহীন রাত কেটে যায় কৃষকের কিন্তু বর্ষার টপাস টপাস বৃষ্টির শব্দ কৃষক-কন্যার হৃদয়ে যে রসায়ন সৃষ্টি করে তা করুণ কন্ঠে ধ্বনিত হয় অজানা এক সুরে, গুমড়ে ওঠে জীবনের অস্ফুট ভাষা, সামাজিক বন্দীদশায়। ভাঙ্গতে পারে না শিকল; শুধু ভেঙ্গে যায়, ক্ষয়ে যায় কুড়েঘর। বর্ষায় গতরখাটা খাটি মাটির মানুষদের অব্যক্ত করুণ জীবনযাপন অমল সেন গভীরভাবে নিরীক্ষা করেছেন এবং জীবনের এই অনুভূতিকে ব্যক্ত করতে, ছন্দায়িত করতে প্রয়াসী হয়েছেন, এই ভেবে যেন শোষিতের প্রতি আমাদের যে দায় তা যেন আমরা এড়িয়ে না যাই, ভুলে না যাই, তাদের স্বপ্নগুলোকে পুঁজি বানিয়ে আত্মসাৎ না করি, চুরি না করি।

আবার টপাস পড়ছে এই

মাদুর সরার আর জায়গা নেই।

...

বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে

মায়ের চোখে বৃষ্টি ঝরে।

কৃষক-কৃষাণীর আর কৃষক-কন্যার জীবনে বর্ষার রাতের ধারা রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান না হয়ে, যেন ডোবা থেকে লাফ দিয়ে আসা ছোট্ট কন্যার কোলে পড়া ব্যাঙের দাঁত কিড়মিড় ছাড়া আর কী-বা অনুভূতির উদ্রেক করতে পারে। পৃথিবীর কোণে কোণে ছোট ছোট ঘরগুলির ছোট ছোট স্বপ্নগুলো কবে পাখা মেলে উড়তে পারবে, জানে কি কোনো লৌকিক রাজনৈতিক দর্শন!

স্বপ্নই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়, বাঁচতে শেখায় নতুনভাবে। রোমান্টিক এই বিপ্লবীর জীবন-কর্ম নিয়ে এখনও বিশদ গবেষণা হয়নি। জানি না এত দৈন্য কেন? গবেষণা তো প্রগতির সোপান। তবে কেন এত নীরবতা বাংলার প্রগতির ইতিহাসে। প্রগতিতে এত কার্পণ্য কিংবা এত সংকীর্ণতা কেন? প্রগতিশীল রাজনীতি ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের চিন্তা-চেতনা নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের আবশ্যকতা রয়েছে।

[লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক]