মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

১৫ জানুয়ারি

মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদানের স্মরণে রেসকোর্স ময়দানে স্মৃতিসৌধ -বঙ্গবন্ধু

সমগ্র দেশব্যাপী জাতীয় শোক দিবস পালনের প্রাক্কালে শনিবার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, মুক্তিযুদ্ধে দেশ মাতৃকার যেসব কৃতী সন্তান শহীদ হয়েছেন তাদের স্মরণে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ অফিসে এক কর্মীসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। নয় মাসাধিককাল কারাবাসের পর শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলায় ফিরে তিনি প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ অফিসে পদার্পণ করেন। এই কর্মসমাবেশে বক্তৃতাকালে বঙ্গবন্ধু গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে হানাদারবাহিনীর গণহত্যাযজ্ঞ বর্বরতায় ক্ষয়-ক্ষতি ব্যাপকতা নির্ধারণ ও ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের জন্য দলের কর্মী এবং পরিষদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান। আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারও আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়। দুষ্কৃতিকারীদের বিচার ও শাস্তি প্রদানের ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করে শেখ সাহেব বলেন, কোনো জাতিই উদার মানসিকতার অধিকারী না হয়ে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য দলীয় কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু তাদের প্রতি দেশ গঠনের কাজে সহায়তা করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তার উদ্দেশ্য ছিল সরকারের বাইরে থেকে জনগণের কল্যাণার্থে গ্রাম হতে গ্রামে ছুটে যাওয়া। কিন্তু গণদুশমনদের চক্রান্তে সে বাসনা তার বাস্তবায়িত হতে পারে নাই। বঙ্গবন্ধু বাংলার জনগণ ও সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে হুঁশিয়ার থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের জনগণও এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ রয়েছে। এবং কষ্টার্জিত স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করার জন্যই তাকে ক্ষমতার আসনে বসতে হয়েছে। তিনি প্রত্যয়দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, বাংলাদেশ হবে ষড়যন্ত্রকারীদের গোরস্থান।

আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি কোলকাতা সফরে ইচ্ছা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, কোলকাতা যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে পশ্চিম বাংলার মহান জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, কোলকাতা যাবার আগে আমি আমার সোনার বাংলাকে একবার প্রাণভরে দেখে যেতে চাই। তিনি ১৯টি জেলার সব কয়টিই সফরের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এখনও আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে কার্যরত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, তিনি এক পাকিস্তানের স্মৃতিবাহী দলীয় পতাকা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে চিরতরে সম্পর্কচ্ছেদের দরুন দলের পতাকা পরিবর্তিত হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, শয়তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা যায় না, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্বের প্রশ্নই ওঠে না।

আইনশৃংখলা প্রশ্নে সরকারি নির্দেশ

শনিবার জারিকৃত বাংলাদেশ সরকারের এক প্রেসনোটে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব বেসামরিক কর্তৃপক্ষের এবং আইন ও শৃঙ্খলা লঙ্ঘন অথবা শান্তি ভঙ্গের ক্ষেত্রে কেবল তারাই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। দালাল ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বেসামরিক এজেন্সিগুলোকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আইন ভঙ্গকারী সকল ব্যক্তিরই আইন মোতাবেক বিচার হবে এবং কারও স্বহস্তে আইন তুলে নেয়া উচিত হবে না। বেসামরিক পুলিশ অথবা সরকার কর্তৃক বিশেষভাবে ক্ষমতা প্রাপ্ত এজেন্সিসমূহ ছাড়া গ্রেফতার, তল্লাশি অথবা ঘর-বাড়ি ও যানবাহনসহ কোনো সম্পত্তি দখল বা আটক করা চলবে না। দালাল অথবা অপরাধীদের সন্ধান পেলে তাদের প্রতি নজর রাখা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বেসামরিক পুলিশকে খবর দেওয়ার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সাহায্যার্থে এবং অন্যকোনো প্রয়োজনে তাদের সাহায্যের জন্য অনুরোধ না জানানো পর্যন্ত দল, রাজনীতি অথবা গ্রুপ নির্বিশেষে কোনো অনিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাই সশস্ত্র অবস্থায় জনসম্মুখে বাহির হতে পারবে না।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২

শনিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২০ , ৪ মাঘ ১৪২৬, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

মুজিব শতবর্ষ

মুজিব শাসন আমল : ১৯৭২

১৫ জানুয়ারি

মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদানের স্মরণে রেসকোর্স ময়দানে স্মৃতিসৌধ -বঙ্গবন্ধু

সমগ্র দেশব্যাপী জাতীয় শোক দিবস পালনের প্রাক্কালে শনিবার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, মুক্তিযুদ্ধে দেশ মাতৃকার যেসব কৃতী সন্তান শহীদ হয়েছেন তাদের স্মরণে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ অফিসে এক কর্মীসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। নয় মাসাধিককাল কারাবাসের পর শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলায় ফিরে তিনি প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ অফিসে পদার্পণ করেন। এই কর্মসমাবেশে বক্তৃতাকালে বঙ্গবন্ধু গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে হানাদারবাহিনীর গণহত্যাযজ্ঞ বর্বরতায় ক্ষয়-ক্ষতি ব্যাপকতা নির্ধারণ ও ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের জন্য দলের কর্মী এবং পরিষদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান। আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারও আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়। দুষ্কৃতিকারীদের বিচার ও শাস্তি প্রদানের ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করে শেখ সাহেব বলেন, কোনো জাতিই উদার মানসিকতার অধিকারী না হয়ে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য দলীয় কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু তাদের প্রতি দেশ গঠনের কাজে সহায়তা করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তার উদ্দেশ্য ছিল সরকারের বাইরে থেকে জনগণের কল্যাণার্থে গ্রাম হতে গ্রামে ছুটে যাওয়া। কিন্তু গণদুশমনদের চক্রান্তে সে বাসনা তার বাস্তবায়িত হতে পারে নাই। বঙ্গবন্ধু বাংলার জনগণ ও সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে হুঁশিয়ার থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের জনগণও এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ রয়েছে। এবং কষ্টার্জিত স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করার জন্যই তাকে ক্ষমতার আসনে বসতে হয়েছে। তিনি প্রত্যয়দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, বাংলাদেশ হবে ষড়যন্ত্রকারীদের গোরস্থান।

আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি কোলকাতা সফরে ইচ্ছা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, কোলকাতা যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে পশ্চিম বাংলার মহান জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, কোলকাতা যাবার আগে আমি আমার সোনার বাংলাকে একবার প্রাণভরে দেখে যেতে চাই। তিনি ১৯টি জেলার সব কয়টিই সফরের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এখনও আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে কার্যরত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, তিনি এক পাকিস্তানের স্মৃতিবাহী দলীয় পতাকা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে চিরতরে সম্পর্কচ্ছেদের দরুন দলের পতাকা পরিবর্তিত হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, শয়তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা যায় না, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্বের প্রশ্নই ওঠে না।

আইনশৃংখলা প্রশ্নে সরকারি নির্দেশ

শনিবার জারিকৃত বাংলাদেশ সরকারের এক প্রেসনোটে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব বেসামরিক কর্তৃপক্ষের এবং আইন ও শৃঙ্খলা লঙ্ঘন অথবা শান্তি ভঙ্গের ক্ষেত্রে কেবল তারাই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। দালাল ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বেসামরিক এজেন্সিগুলোকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আইন ভঙ্গকারী সকল ব্যক্তিরই আইন মোতাবেক বিচার হবে এবং কারও স্বহস্তে আইন তুলে নেয়া উচিত হবে না। বেসামরিক পুলিশ অথবা সরকার কর্তৃক বিশেষভাবে ক্ষমতা প্রাপ্ত এজেন্সিসমূহ ছাড়া গ্রেফতার, তল্লাশি অথবা ঘর-বাড়ি ও যানবাহনসহ কোনো সম্পত্তি দখল বা আটক করা চলবে না। দালাল অথবা অপরাধীদের সন্ধান পেলে তাদের প্রতি নজর রাখা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বেসামরিক পুলিশকে খবর দেওয়ার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সাহায্যার্থে এবং অন্যকোনো প্রয়োজনে তাদের সাহায্যের জন্য অনুরোধ না জানানো পর্যন্ত দল, রাজনীতি অথবা গ্রুপ নির্বিশেষে কোনো অনিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাই সশস্ত্র অবস্থায় জনসম্মুখে বাহির হতে পারবে না।

সূত্র : দিনলিপি, বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়, ১৯৭২