প্রাক-যুগের মুসলিম নারী গীতিকার

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল

বাংলা গানের যাত্রা শুরু মূলত ‘চর্যাপদ’ থেকেই। ১৯০৭ সালে নেপালের রাজ দরবার থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক উদ্ধারকৃত ৫১টি গানের সংকলন ‘চর্যাগীতি’। তারপর এক অন্ধকার যুগ (১২০১-১৩৫০ খ্রি.) পেরিয়ে মধ্য যুগে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়। বড়–চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ ও বিভিন্ন স্তুতি ধর্মী মঙ্গল কাব্য। গানের এই আদি পর্ব শেষে মধ্যপর্বে রচিত হয় তুলসী দাস, চৈতন্যদেব প্রমুখ কবিদের গীতিকবিতা। ক্রমশ সমৃদ্ধ হতে থাকে বাংলা গানের ভান্ডার। এছাড়াও রয়েছে বাংলা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা কবি গান, বাউল গান ও যাত্রা গানের পাশাপাশি লোকগান। এসব গানে মূলত হিন্দুরাই ছিলেন সব সময় অগ্রগামী। অবিভক্ত বাংলায় হিন্দুরা যখন গায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তখন মুসলমান জাতির গীত রচনা ও গান গাওয়া ছিল হারাম। কিন্তু প্রাক যুগে সেই অসম্ভব কে সম্ভব করতে এগিয়ে এসেছিলেন দু’জন প্রতিভাবান মুসলিম নারী গীতিকার, এরা হলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ও হাজী সহিফা বিবি।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী (১৮৩৪-১৯০৩ খ্রি.)

নওয়ার ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লা (ত্রিপুরা) জেলার পশ্চিমগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ শাসনাধীন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান মহিলা নওয়াব ও নারী শিক্ষার রূপকার ও প্রজাবৎসল জমিদার। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী বাংলাদেশে তিনি একমাত্র মহিলা যিনি এই উপাধি পান। তার পিতা আহমেদ আলী চৌধুরী (মৃত্যু ১৮৪৪ খ্রি.) ছিলেন একজন নামকরা জমিদার। মা আফরুন্নেসা (মৃত্যু ১৮৮৫ খ্রি.)।

আহমেদ আলীর পূর্বপুরুষ দিল্লীর বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে সনদ লাভ করে হোমনাবাদ পরগণার জমিদান হন। ফয়জুন্নেসার বড় দুই ভাই ছিলেন এয়াকুব আলী চৌধুরী ও ইউসুফ আলী চৌধুরী। তার ছোট বোন লতিফুন্নেসা চৌধুরানী ও আমিরুন্নেসা চৌধুরানী।

ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী বাউক সারের জমিদার মোহাম্মদ গাজী চৌধুরীর সঙ্গে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পিতার দিকে থেকে তিনি তার দুর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন। গাজী চৌধুরীর একান্ত আগ্রহে এই বিয়ে সুসম্পন্ন হয়। ফয়জুন্নেসা স্বামীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন। তার দুটি কন্যা সন্তান ছিল আরশাদুন্নেসা ও বদরুন্নেসা। ফয়জুন্নেসার দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। ৬-৭ বছরের মাথায় স্বপত্নী বিদ্বেষের কারণে তার স্বামী থেকে বিচ্ছেদ ঘটে। তিনি পিতৃগৃহে ফিরে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। দ্বিতীয় কন্যা বদরুন্নেসা তার সঙ্গেই ছিল। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দ স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। ফয়জুন্নেসা নিজ চেষ্টায় বাংলা শেখেন এবং সংস্কৃতি ভাষায়ও শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ইংরেজি ভাষা জানতেন কিনা জানা যায়নি। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তার বিশেষ অনুরাগ ছিল তা প্রমাণিত। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে নিজ খরচে তিনি কুমিল্লায় ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাজউদ্দীন মিয়া তার গৃহশিক্ষক ছিলেন। শৈশবে তার নিকট তিনি শিক্ষা লাভ করেন। তার গৃহে পরিবারিক লাইব্রেরি ছিল। এই লাইব্রেরিতে তিনি নিয়মিত লেখাপড়া করতেন। ফয়জুন্নেসার বাংলা ভাষা শিক্ষার এবং বাংলা গ্রন্থ রচনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এদিক থেকে তিনি বেগম রোকেয়ার অগ্রগামী ছিলেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুসলমান নারী জাগরণের পথিকৃৎ। বাংলাদেশের নারী সমাজ যখন অবহেলিত তখন তিনি ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে নিজগ্রামে কুমিল্লা (ত্রিপুরা) জেলার লাকসামে মহিলাদের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করে নিজেই তাদের শিক্ষা দেবার জন্য শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত হন। এটি উপমহাদেশের বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীনতম স্কুলগুলির অন্যতম। কালক্রমে এটি একটি কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং এর নাম হয় নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজ।

জমিদার হওয়ার পর তার সেবার হাত আরও প্রসারিত হয়। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে পর্দানশীন বিশেষত দরিদ্র মহিলাদের চিকিৎসার জন্য তিনি নিজ গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি ‘ফয়জুন্নেসা জেনানা হাসপাতাল’ নামে একটি চিকিৎসালয় ও স্থাপন করেন। এছাড়া শিক্ষা বিস্তারে তিনি মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। দুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল নির্মাণে ও অন্যান্য জনহিতকর কাজে অর্থ দান করেন। মসজিদ নির্মাণেও তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ, দিঘী-পুস্করিণী খনন প্রভৃতি জনহিতকর কাজে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এতে তার নাগরিক ও প্রগতিশীল চেতনার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি যুগের প্রভাবে বাইরের পর্দা মেনে চললেও মনের পর্দা ভেঙ্গে ফেলেন। এক্ষেত্রে ও তিনি বেগম রোকেয়ার অগ্রবর্তিনী ছিলেন। তবে বেগম রোকেয়ার কাজের ও চিন্তার অধিক গভীরতা ও ব্যাপকতা ছিল।

ফয়জুন্নেসা ছিলেন অত্যন্ত পরোপকারী ও সমাজ সেবিকা। কুমিল্লা (ত্রিপুরা) জেলার উন্নতিকল্পে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিরাট পরিকল্পনার সমস্ত ব্যয়ভার তিনি গ্রহণ করেছিলেন বলে তৎকালীন মহারাণী ভিক্টোরিয়া ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে তাকে নওয়াব উপাধিতে ভূষিত করেন। মহারানী ভিক্টোরিয়া ‘নওয়াব’ উপাধি সংবলিত সনদ ও হীরক খঁচিত মূল্যবান পদক তাকে প্রদান করেন। তৎকালীন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মিস্টার ডগলাস আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে এই পদক প্রদান করেন। হোমনাবাদের মতো অখ্যাত স্থানের একজন মহিলা জমিদারের জন্য এ ছিল এক দুর্লভ সম্মান। সে যুগের নারী পুরুষ সকলের জন্য এরূপ উপাধি শ্লাঘার বিষয়। ফয়জুন্নেসা নিজ কর্মগুণেই তা অর্জন করেন। ১৮৩৪ থেকে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৩৩ বছর ফয়জুন্নেসা ব্যক্তিগত জীবনের প্রথম পর্ব। এ সময়ে তার প্রধান পরিচয় কন্যা, জায়া ও জননী রূপে। ১৮৬৭ থেকে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৬ বছরকে তার জীবনের দ্বিতীয় পর্ব বলা হয়। এ পর্বে তিনি লেখিকা, শিক্ষাব্রতী, সংস্কৃতি অনুরাগিনী, সমাজসেবিকা ও জমিদার। অর্থাৎ এই ছিল তার সৃষ্টি ও কর্মের জীবন।

ফয়জুন্নেসা ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে কন্যা বদরুন্নেসা ও দৌহিত্রের সঙ্গে পবিত্র হজ্ব পালনের জন্য মক্কা গমন করেন। তিনি সেখানেও মুসাফিরখানা ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তিনি পত্র-পত্রিকা প্রকাশনায় ও সভা সমিতিতে অকাতরে অর্থ দান করেন। সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ (১৮৬১ খ্রি. প্রকাশিত) কে নগদ অর্থ সাহায্য দেন। কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতি স্বরূপ তার দানের কথা উল্লেখ করে ‘ঢাকা প্রকাশ’ (৫ মাঘ ১২৮১ বঙ্গাব্দ) মন্তব্য করেন ‘অদ্য আমরা আমাদিগের পূর্ব বাঙ্গলার একটি মহিলা রত্নের পরিচয় দান করিয়া ক্ষান্ত থাকিতে পারিলাম না। ...ইনি যেমন বিদ্যানুরাগিনী ও সর্ববিষয়ে কার্যপারদর্শিনী সেইরূপ সৎকার্যেও সমুৎসাহিনী। ...শুনিলাম ইহার আবাসস্থানে সচরাচর যেরূপ করিয়া থাকেন, এখানেও সেইরূপ বিনাড়ম্বরে নিরুপায় দরিদ্রদিগকে দান করিয়াছেন।’ মৃত্যুর আগে তিনি জমিদারির এক বিশাল অংশ ওয়াকফ করে যান, যা থেকে এলাকার দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা লেখপড়ার জন্য আজও অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে।

ফয়জুন্নেসা বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীর ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ‘ঢাকা প্রকাশ’ ছাড়াও তিনি বান্ধব, মুসলমান বন্ধু, সুধাকর, ইসলাম প্রচারক প্রভৃতি বাংলা পত্র-পত্রিকা তার আর্থিক সহায়তা লাভ করে।

ফয়জুন্নেসার সৃজনশীল প্রতিভার দিকটি নিহিত আছে তার সাহিত্যকর্মে। তার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘রূপজালাল’ গ্রন্থটি ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা গিরিশ চন্দ্র মুদ্রন যন্ত্র থেকে প্রকাশিত হয়। তার চারখানি পুস্তক-পুস্তিকার সন্ধান পাওয়া যায়- ‘রূপজালাল (১৮৭৬ খ্রি.), তত্ত্ব ও জাতীয় সঙ্গীত (১৮৮৭ খ্রি.), সঙ্গীত সার ও সঙ্গীত লহরী’। তার তত্ত্ব ও জাতীয় সঙ্গীত একটি সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ। এর প্রথম সংস্করণ ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ও মুদ্রক হরিমোহন বসাক, ঢাকা বাঙ্গলা প্রেস। তার ‘রূপ জালাল’ ব্যতীত অন্যান্য গ্রন্থের কপি পাওয়া যায় নাই।

‘রূপজালাল’ গদ্যে-পদ্যে রচিত রূপকধর্মী রচনা। গ্রন্থখানি ব্যতিক্রমধর্মী। সংস্কৃত গদ্য-পদ্য মিশ্রিত চম্পু কাব্যের নিদর্শন থাকলেও বাংলাতে তা বিরল। মধ্যযুগে বৈষ্ণব ভাবধারায় দু’একখানি চম্পু কাব্য রচিত হলেও উনিশ শতকে এ ধরনের দ্বিতীয় গ্রন্থ রচিত হয়নি। দ্বিতীয়ত ফয়জুন্নেসার গদ্য-পদ্য উভয় অংশ বিশুদ্ধ বাংলায় রচিত। আরবী-ফারসী শব্দের মিশ্রন নেই বললে চলে। ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী গল্পের নায়ক জালাল ও নায়িকা রূপবানুর প্রণয় কাহিনীর মধ্যে কৌশলে স্বীয় জীবনের ছায়াপাত ঘটিয়েছেন। ব্যতিক্রম একটি ক্ষেত্রে যে নিজের দাম্পত্য জীবন ব্যর্থতা ও বেদনায় পূর্ণ। ‘রূপজালালের’ প্রেম ও দাম্পত্য জীবন সুখ ও আনন্দেপূর্ণ। সৃষ্টির এখানেই স্বার্থকতা। ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতাকে সৃষ্টি কর্মে সফল হতে দেখেছেন। তিনি অন্তর্দাহ প্রকাশ করতে গিয়ে ‘রূপজালাল’ উপন্যাস রচনায় মাঝে মাঝে কবিতার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ‘রূপজালাল’ এ ফুটে উঠেছে ফয়জুন্নেসার কবি প্রতিভা।

এই গ্রন্থটি বেগম রোকেয়ার জন্মের অন্তত: চার বছর আগে প্রকাশিত হয়। সতীন বিদ্বেষের কারণেই ফয়জুন্নেসার বিবাহিত জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়। রূপবানুর সতীন হুরবানু তাদের পরিণতি কিরূপ ছিল ? গ্রন্থের শেষ কয়েকটি চরণে তা প্রকাশ পেয়েছে-

হুরবানু নিয়ে রানী, রূপবানু মনে।

মিলন করিয়া দিল প্রবোদ বচনে ॥

দোহে সম রূপবতী সম বুদ্ধিমতী।

বিভূকৃত ভেবে দোহে জন্মিল সম্প্রীতি ॥

উভয় সপত্মী নানা গুণে গুণবতী।

আনন্দে বিহরে দোহে পতির সঙ্গতি ॥

দুইজন নিয়ে সমদৃষ্টিতে রাজন।

নিত্য সকৌতুকে কাল করয়ে যাপন ॥

সিংহাসনে বসি সদা হরিষ অন্তরে।

বিধি বিধানেতে ভূপ রাজ কার্য্য করে ॥

বিচার কৌশলে দূর হৈল অবিচার।

প্রজার জন্মিল ভক্তি সুখ্যাতি প্রচার ॥

রাজা ন্যায় বিচারক ও প্রজানুরঞ্জন হবেন- এটাও তার কাম্য ছিল। স্বামী বিচ্ছেদের প্রায় নয় বছর পরে ‘রূপ জালাল’ প্রকাশিত হয়। তিনি গ্রন্থখানি স্বামীর নামেই উৎসর্গ করেন। বাস্তবে দুঃখ যন্ত্রণার পঙ্কে থেকে তিনি কল্পনায় প্রেমানন্দের পদ্মফুল ফুটিয়েছেন। ‘জাতীয় ভাষা অপরিহার্য’ ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী এটি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। এরূপ সাহসী উচ্চারণের জন্য তিনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধার পাত্রী। এই ভাষার পথ ধরেই আমরা জাতীয়তা, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হয়েছি।

ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী গান ও লিখেছেন। রূপজালাল কাব্যে গান আছে। ‘মূলতান’ রাগিনীতে রূপবানুর গান ও অন্যত্র ‘মালঝাপ’ রাগিনীতে কন্যার স্বীয় বৃত্তান্তের বিবরণ আছে। এছাড়া বার মাসি, সহেলা, বিরহ-বিলাপ, খেদোক্তি ইত্যাদি শিরোনামে যেসব পদ আছে সেগুলোও সঙ্গীত। সঙ্গীত সম্পর্কিত তার স্বতন্ত্র গ্রন্থও আছে। এসব দৃষ্টান্ত থেকে প্রমানিত হয় ফয়জুন্নেসা সঙ্গীতানুরাগিনী ছিলেন। সঙ্গীতের সমর্থক ছিলেন তিনি। বনেদী মুসলিম পরিবারের একজন মহিলার জন্য এটিও একটি সাহসী পদক্ষেপ।

গ্রন্থের শুরুতে তিনি ‘রূপজালাল’ গ্রন্থে স্বল্প পরিসরে গদ্যে স্বীয় বংশের বিবরণ ও পুস্তক লিখবার উদ্দেশ্য অধ্যায় রচনা করেন। এটি তথ্যপূর্ণ, আবেগ মিশ্রিত ও হৃদয়গ্রাহী। একে বাংলা আত্মজীবনী রচনার প্রাথমিক প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

‘রূপজালাল’ এর গদ্য ও পদ্য থেকে উদ্ধৃত করার মতো অনেক অংশ আছে। ‘রূপজালাল’ গ্রন্থে গদ্যের একটি অংশ-

‘বিধাতা রমণীদিগের মন কি অদ্ভুত দ্রব্য দ্বারা সৃজন করিয়াছেন, যাহা স্বাভাবিক সরল ও নম্র। তাহাতে কিঞ্চিৎ মাত্র ক্রোধানল প্রজ্জ্বলিত হইলেও লৌহ বা প্রস্তর বৎ কঠিন হইয়া উঠে। আমার এই বাক্য শ্রবণে মহিষী উত্তর করিল, হ্যাঁ ভাল বলিয়াছেন, তাই তো বটে, কোথায় দেখিয়াছেন, রমণীগণ এক পুরুষকে পরিত্যাগ করিয়া, পুরুষান্তর আশ্রয় করে। বরং পুরুষেরা একটি রূপবতী যুবতী দেখিলেই পূর্বপ্রেম এবং ধর্ম বিসর্জন দিয়া তাদের প্রতি আসক্তি হয় এবং তাহাকে প্রণয়িনী করিবার জন্য নানা প্রকার চেষ্টা করে। প্রভুর ইচ্ছায় যদি কোনক্রমে ঐ কার্য সুসম্পন্ন করিতে না পারে, তবে পূর্ব প্রণয়িনীর নিকট আসিয়া সহস্র শপথ করিয়া বলে, তোমাকে বিনা আমি আর কাহাকেও জানি না। অধিক কি অন্য বামার রূপলাবণ্য আমার চক্ষে গরল প্রায় জ্ঞান হয়। পুরুষদিগের অন্তঃকরণের স্নেহ চিরস্থায়ী নহে।’

এই উপন্যাসের ভাষা চিত্র বহুল ও জীবনধর্মী। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর (১০ আশ্বিন, ১৩১৪ বঙ্গাব্দ) নওয়ার ফয়জুন্নেসা চৌধূরানী লোকান্তরিত হন। পশ্চিম গাঁয়ের নিজ বাড়িতে নিজ কন্য আরশাদুন্নেসার পাশে তিনি চিরশয্যায় শায়িত আছেন।

মৃত্যুর ১০০ বছর পরে বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে সমাজ সেবার ক্ষেত্রে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ একুশে পদক ও সম্মাননা পত্র (মরণোত্তর) প্রদান করেন।

হাজী সহিফা বিবি (১৮৫০-১৯২৬ খ্রি.)

হাজী সহিফা বিবি বেগম রোকেয়ার জন্মের আনুমানিক প্রায় দুই যুগ আগে সিলেট জেলার কুয়ারপাড় এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম জমিদার আলী রেজা। তার পিতা ছিলেন লক্ষণ ছিরি ও কৌড়িয়ার জমিদার। সহিফা বিবি ছিলেন হাছন রাজার বৈমাত্রেয় বোন। তার স্বামী ছিলেন হাজী মোজাফফর চৌধূরী। সহিফা বিবি সঙ্গীতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি ছিলেন নি:সন্তান। সহিফা বিবির ৩ খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়- ১. সহিফা সঙ্গীত, ২. ইয়াদ গায়ে, ৩. সইফা ও ছাহেবানের জারি। ছহিফা সঙ্গীত ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে সিলেট থেকে আব্দুল জব্বার কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এটি একটি সঙ্গীত গ্রন্থ। এতে ৪৮টি গান স্থান পেয়েছে। তার গ্রন্থে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মরমী কবিদের কোন নির্দিষ্ট ধর্ম নেই। সহিফা বিবির কাব্যে তা লক্ষণীয়। এ গ্রন্থের প্রথমে তিনি সরস্বতী বন্দনা করেছেন। পরবর্তী সঙ্গীতটি আবার কাওয়ালী। তার এই গ্রন্থে সুফীতত্ত্ব ও বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাবও লক্ষনীয়। তিনি উর্দু, হিন্দী ও বাংলা ভাষায় সমান পারদর্শী ছিলেন। একমাত্র সহিফা সঙ্গীত বাদে তার অন্য দুটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়না। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত এবং নারীদের শিক্ষার জন্য তার কবিতা ও গানে নারীদের জীবনের অনেক অবহেলিত ও সামাজিক চিত্র ফুটে উঠেছে। যে কালে মেয়েরা কাব্য রচনার কথা দুরে থাক তাদের লেখপড়ার সুযোগ ছিলনা, সে সময়ে নারী জাগরণে সহিফা বিবির এমন সাহিত্য রচনা কৃতিত্বের দাবি রাখে। তার কবিতা ও বহু গানে সে কালের সমাজের সামাজিক বৈষম্য ও নানা অসঙ্গতির চিত্র ফুটে উঠেছে। সমাজের উদ্দেশ্যে তিনি ব্যঙ্গ করে লিখেছেন-

ধনে জনে ভাল যারা

মিথ্যা হইলে জয়ী তারা,

দুঃখিত এতিম বিধবারা।

চোরা যারা ভাল তারা

চোরা ধনে বুক তার পুরা।

টাকায় বলে যা না

ধরা কি বুঝিবে বেচারীরা।

সহিফা ভাবিয়া বলে সারা

তেলেঙ্গী বিষম চোরা।

নারী জাগরণে সহিফা বিবির রচনার সুর মাধুরী সহজভাবে মনকে ছুয়ে যায়। তিনি বহুবার হজ্বব্রত পালন করেছিলেন বলে সিলেট অঞ্চলে তিনি ‘হাজী বিবি’ নামে পরিচিত ছিলেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।

[লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা]

jewelwriter53@gmail.com

রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২০ , ৫ মাঘ ১৪২৬, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

প্রাক-যুগের মুসলিম নারী গীতিকার

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল

বাংলা গানের যাত্রা শুরু মূলত ‘চর্যাপদ’ থেকেই। ১৯০৭ সালে নেপালের রাজ দরবার থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক উদ্ধারকৃত ৫১টি গানের সংকলন ‘চর্যাগীতি’। তারপর এক অন্ধকার যুগ (১২০১-১৩৫০ খ্রি.) পেরিয়ে মধ্য যুগে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়। বড়–চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ ও বিভিন্ন স্তুতি ধর্মী মঙ্গল কাব্য। গানের এই আদি পর্ব শেষে মধ্যপর্বে রচিত হয় তুলসী দাস, চৈতন্যদেব প্রমুখ কবিদের গীতিকবিতা। ক্রমশ সমৃদ্ধ হতে থাকে বাংলা গানের ভান্ডার। এছাড়াও রয়েছে বাংলা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা কবি গান, বাউল গান ও যাত্রা গানের পাশাপাশি লোকগান। এসব গানে মূলত হিন্দুরাই ছিলেন সব সময় অগ্রগামী। অবিভক্ত বাংলায় হিন্দুরা যখন গায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তখন মুসলমান জাতির গীত রচনা ও গান গাওয়া ছিল হারাম। কিন্তু প্রাক যুগে সেই অসম্ভব কে সম্ভব করতে এগিয়ে এসেছিলেন দু’জন প্রতিভাবান মুসলিম নারী গীতিকার, এরা হলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ও হাজী সহিফা বিবি।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী (১৮৩৪-১৯০৩ খ্রি.)

নওয়ার ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লা (ত্রিপুরা) জেলার পশ্চিমগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ শাসনাধীন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান মহিলা নওয়াব ও নারী শিক্ষার রূপকার ও প্রজাবৎসল জমিদার। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী বাংলাদেশে তিনি একমাত্র মহিলা যিনি এই উপাধি পান। তার পিতা আহমেদ আলী চৌধুরী (মৃত্যু ১৮৪৪ খ্রি.) ছিলেন একজন নামকরা জমিদার। মা আফরুন্নেসা (মৃত্যু ১৮৮৫ খ্রি.)।

আহমেদ আলীর পূর্বপুরুষ দিল্লীর বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে সনদ লাভ করে হোমনাবাদ পরগণার জমিদান হন। ফয়জুন্নেসার বড় দুই ভাই ছিলেন এয়াকুব আলী চৌধুরী ও ইউসুফ আলী চৌধুরী। তার ছোট বোন লতিফুন্নেসা চৌধুরানী ও আমিরুন্নেসা চৌধুরানী।

ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী বাউক সারের জমিদার মোহাম্মদ গাজী চৌধুরীর সঙ্গে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পিতার দিকে থেকে তিনি তার দুর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন। গাজী চৌধুরীর একান্ত আগ্রহে এই বিয়ে সুসম্পন্ন হয়। ফয়জুন্নেসা স্বামীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন। তার দুটি কন্যা সন্তান ছিল আরশাদুন্নেসা ও বদরুন্নেসা। ফয়জুন্নেসার দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। ৬-৭ বছরের মাথায় স্বপত্নী বিদ্বেষের কারণে তার স্বামী থেকে বিচ্ছেদ ঘটে। তিনি পিতৃগৃহে ফিরে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। দ্বিতীয় কন্যা বদরুন্নেসা তার সঙ্গেই ছিল। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দ স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। ফয়জুন্নেসা নিজ চেষ্টায় বাংলা শেখেন এবং সংস্কৃতি ভাষায়ও শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ইংরেজি ভাষা জানতেন কিনা জানা যায়নি। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তার বিশেষ অনুরাগ ছিল তা প্রমাণিত। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে নিজ খরচে তিনি কুমিল্লায় ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাজউদ্দীন মিয়া তার গৃহশিক্ষক ছিলেন। শৈশবে তার নিকট তিনি শিক্ষা লাভ করেন। তার গৃহে পরিবারিক লাইব্রেরি ছিল। এই লাইব্রেরিতে তিনি নিয়মিত লেখাপড়া করতেন। ফয়জুন্নেসার বাংলা ভাষা শিক্ষার এবং বাংলা গ্রন্থ রচনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এদিক থেকে তিনি বেগম রোকেয়ার অগ্রগামী ছিলেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুসলমান নারী জাগরণের পথিকৃৎ। বাংলাদেশের নারী সমাজ যখন অবহেলিত তখন তিনি ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে নিজগ্রামে কুমিল্লা (ত্রিপুরা) জেলার লাকসামে মহিলাদের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করে নিজেই তাদের শিক্ষা দেবার জন্য শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত হন। এটি উপমহাদেশের বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীনতম স্কুলগুলির অন্যতম। কালক্রমে এটি একটি কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং এর নাম হয় নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজ।

জমিদার হওয়ার পর তার সেবার হাত আরও প্রসারিত হয়। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে পর্দানশীন বিশেষত দরিদ্র মহিলাদের চিকিৎসার জন্য তিনি নিজ গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি ‘ফয়জুন্নেসা জেনানা হাসপাতাল’ নামে একটি চিকিৎসালয় ও স্থাপন করেন। এছাড়া শিক্ষা বিস্তারে তিনি মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। দুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল নির্মাণে ও অন্যান্য জনহিতকর কাজে অর্থ দান করেন। মসজিদ নির্মাণেও তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ, দিঘী-পুস্করিণী খনন প্রভৃতি জনহিতকর কাজে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এতে তার নাগরিক ও প্রগতিশীল চেতনার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি যুগের প্রভাবে বাইরের পর্দা মেনে চললেও মনের পর্দা ভেঙ্গে ফেলেন। এক্ষেত্রে ও তিনি বেগম রোকেয়ার অগ্রবর্তিনী ছিলেন। তবে বেগম রোকেয়ার কাজের ও চিন্তার অধিক গভীরতা ও ব্যাপকতা ছিল।

ফয়জুন্নেসা ছিলেন অত্যন্ত পরোপকারী ও সমাজ সেবিকা। কুমিল্লা (ত্রিপুরা) জেলার উন্নতিকল্পে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিরাট পরিকল্পনার সমস্ত ব্যয়ভার তিনি গ্রহণ করেছিলেন বলে তৎকালীন মহারাণী ভিক্টোরিয়া ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে তাকে নওয়াব উপাধিতে ভূষিত করেন। মহারানী ভিক্টোরিয়া ‘নওয়াব’ উপাধি সংবলিত সনদ ও হীরক খঁচিত মূল্যবান পদক তাকে প্রদান করেন। তৎকালীন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মিস্টার ডগলাস আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে এই পদক প্রদান করেন। হোমনাবাদের মতো অখ্যাত স্থানের একজন মহিলা জমিদারের জন্য এ ছিল এক দুর্লভ সম্মান। সে যুগের নারী পুরুষ সকলের জন্য এরূপ উপাধি শ্লাঘার বিষয়। ফয়জুন্নেসা নিজ কর্মগুণেই তা অর্জন করেন। ১৮৩৪ থেকে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৩৩ বছর ফয়জুন্নেসা ব্যক্তিগত জীবনের প্রথম পর্ব। এ সময়ে তার প্রধান পরিচয় কন্যা, জায়া ও জননী রূপে। ১৮৬৭ থেকে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৬ বছরকে তার জীবনের দ্বিতীয় পর্ব বলা হয়। এ পর্বে তিনি লেখিকা, শিক্ষাব্রতী, সংস্কৃতি অনুরাগিনী, সমাজসেবিকা ও জমিদার। অর্থাৎ এই ছিল তার সৃষ্টি ও কর্মের জীবন।

ফয়জুন্নেসা ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে কন্যা বদরুন্নেসা ও দৌহিত্রের সঙ্গে পবিত্র হজ্ব পালনের জন্য মক্কা গমন করেন। তিনি সেখানেও মুসাফিরখানা ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তিনি পত্র-পত্রিকা প্রকাশনায় ও সভা সমিতিতে অকাতরে অর্থ দান করেন। সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ (১৮৬১ খ্রি. প্রকাশিত) কে নগদ অর্থ সাহায্য দেন। কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতি স্বরূপ তার দানের কথা উল্লেখ করে ‘ঢাকা প্রকাশ’ (৫ মাঘ ১২৮১ বঙ্গাব্দ) মন্তব্য করেন ‘অদ্য আমরা আমাদিগের পূর্ব বাঙ্গলার একটি মহিলা রত্নের পরিচয় দান করিয়া ক্ষান্ত থাকিতে পারিলাম না। ...ইনি যেমন বিদ্যানুরাগিনী ও সর্ববিষয়ে কার্যপারদর্শিনী সেইরূপ সৎকার্যেও সমুৎসাহিনী। ...শুনিলাম ইহার আবাসস্থানে সচরাচর যেরূপ করিয়া থাকেন, এখানেও সেইরূপ বিনাড়ম্বরে নিরুপায় দরিদ্রদিগকে দান করিয়াছেন।’ মৃত্যুর আগে তিনি জমিদারির এক বিশাল অংশ ওয়াকফ করে যান, যা থেকে এলাকার দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা লেখপড়ার জন্য আজও অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে।

ফয়জুন্নেসা বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীর ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ‘ঢাকা প্রকাশ’ ছাড়াও তিনি বান্ধব, মুসলমান বন্ধু, সুধাকর, ইসলাম প্রচারক প্রভৃতি বাংলা পত্র-পত্রিকা তার আর্থিক সহায়তা লাভ করে।

ফয়জুন্নেসার সৃজনশীল প্রতিভার দিকটি নিহিত আছে তার সাহিত্যকর্মে। তার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘রূপজালাল’ গ্রন্থটি ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা গিরিশ চন্দ্র মুদ্রন যন্ত্র থেকে প্রকাশিত হয়। তার চারখানি পুস্তক-পুস্তিকার সন্ধান পাওয়া যায়- ‘রূপজালাল (১৮৭৬ খ্রি.), তত্ত্ব ও জাতীয় সঙ্গীত (১৮৮৭ খ্রি.), সঙ্গীত সার ও সঙ্গীত লহরী’। তার তত্ত্ব ও জাতীয় সঙ্গীত একটি সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ। এর প্রথম সংস্করণ ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ও মুদ্রক হরিমোহন বসাক, ঢাকা বাঙ্গলা প্রেস। তার ‘রূপ জালাল’ ব্যতীত অন্যান্য গ্রন্থের কপি পাওয়া যায় নাই।

‘রূপজালাল’ গদ্যে-পদ্যে রচিত রূপকধর্মী রচনা। গ্রন্থখানি ব্যতিক্রমধর্মী। সংস্কৃত গদ্য-পদ্য মিশ্রিত চম্পু কাব্যের নিদর্শন থাকলেও বাংলাতে তা বিরল। মধ্যযুগে বৈষ্ণব ভাবধারায় দু’একখানি চম্পু কাব্য রচিত হলেও উনিশ শতকে এ ধরনের দ্বিতীয় গ্রন্থ রচিত হয়নি। দ্বিতীয়ত ফয়জুন্নেসার গদ্য-পদ্য উভয় অংশ বিশুদ্ধ বাংলায় রচিত। আরবী-ফারসী শব্দের মিশ্রন নেই বললে চলে। ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী গল্পের নায়ক জালাল ও নায়িকা রূপবানুর প্রণয় কাহিনীর মধ্যে কৌশলে স্বীয় জীবনের ছায়াপাত ঘটিয়েছেন। ব্যতিক্রম একটি ক্ষেত্রে যে নিজের দাম্পত্য জীবন ব্যর্থতা ও বেদনায় পূর্ণ। ‘রূপজালালের’ প্রেম ও দাম্পত্য জীবন সুখ ও আনন্দেপূর্ণ। সৃষ্টির এখানেই স্বার্থকতা। ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতাকে সৃষ্টি কর্মে সফল হতে দেখেছেন। তিনি অন্তর্দাহ প্রকাশ করতে গিয়ে ‘রূপজালাল’ উপন্যাস রচনায় মাঝে মাঝে কবিতার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ‘রূপজালাল’ এ ফুটে উঠেছে ফয়জুন্নেসার কবি প্রতিভা।

এই গ্রন্থটি বেগম রোকেয়ার জন্মের অন্তত: চার বছর আগে প্রকাশিত হয়। সতীন বিদ্বেষের কারণেই ফয়জুন্নেসার বিবাহিত জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়। রূপবানুর সতীন হুরবানু তাদের পরিণতি কিরূপ ছিল ? গ্রন্থের শেষ কয়েকটি চরণে তা প্রকাশ পেয়েছে-

হুরবানু নিয়ে রানী, রূপবানু মনে।

মিলন করিয়া দিল প্রবোদ বচনে ॥

দোহে সম রূপবতী সম বুদ্ধিমতী।

বিভূকৃত ভেবে দোহে জন্মিল সম্প্রীতি ॥

উভয় সপত্মী নানা গুণে গুণবতী।

আনন্দে বিহরে দোহে পতির সঙ্গতি ॥

দুইজন নিয়ে সমদৃষ্টিতে রাজন।

নিত্য সকৌতুকে কাল করয়ে যাপন ॥

সিংহাসনে বসি সদা হরিষ অন্তরে।

বিধি বিধানেতে ভূপ রাজ কার্য্য করে ॥

বিচার কৌশলে দূর হৈল অবিচার।

প্রজার জন্মিল ভক্তি সুখ্যাতি প্রচার ॥

রাজা ন্যায় বিচারক ও প্রজানুরঞ্জন হবেন- এটাও তার কাম্য ছিল। স্বামী বিচ্ছেদের প্রায় নয় বছর পরে ‘রূপ জালাল’ প্রকাশিত হয়। তিনি গ্রন্থখানি স্বামীর নামেই উৎসর্গ করেন। বাস্তবে দুঃখ যন্ত্রণার পঙ্কে থেকে তিনি কল্পনায় প্রেমানন্দের পদ্মফুল ফুটিয়েছেন। ‘জাতীয় ভাষা অপরিহার্য’ ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী এটি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। এরূপ সাহসী উচ্চারণের জন্য তিনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধার পাত্রী। এই ভাষার পথ ধরেই আমরা জাতীয়তা, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হয়েছি।

ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী গান ও লিখেছেন। রূপজালাল কাব্যে গান আছে। ‘মূলতান’ রাগিনীতে রূপবানুর গান ও অন্যত্র ‘মালঝাপ’ রাগিনীতে কন্যার স্বীয় বৃত্তান্তের বিবরণ আছে। এছাড়া বার মাসি, সহেলা, বিরহ-বিলাপ, খেদোক্তি ইত্যাদি শিরোনামে যেসব পদ আছে সেগুলোও সঙ্গীত। সঙ্গীত সম্পর্কিত তার স্বতন্ত্র গ্রন্থও আছে। এসব দৃষ্টান্ত থেকে প্রমানিত হয় ফয়জুন্নেসা সঙ্গীতানুরাগিনী ছিলেন। সঙ্গীতের সমর্থক ছিলেন তিনি। বনেদী মুসলিম পরিবারের একজন মহিলার জন্য এটিও একটি সাহসী পদক্ষেপ।

গ্রন্থের শুরুতে তিনি ‘রূপজালাল’ গ্রন্থে স্বল্প পরিসরে গদ্যে স্বীয় বংশের বিবরণ ও পুস্তক লিখবার উদ্দেশ্য অধ্যায় রচনা করেন। এটি তথ্যপূর্ণ, আবেগ মিশ্রিত ও হৃদয়গ্রাহী। একে বাংলা আত্মজীবনী রচনার প্রাথমিক প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

‘রূপজালাল’ এর গদ্য ও পদ্য থেকে উদ্ধৃত করার মতো অনেক অংশ আছে। ‘রূপজালাল’ গ্রন্থে গদ্যের একটি অংশ-

‘বিধাতা রমণীদিগের মন কি অদ্ভুত দ্রব্য দ্বারা সৃজন করিয়াছেন, যাহা স্বাভাবিক সরল ও নম্র। তাহাতে কিঞ্চিৎ মাত্র ক্রোধানল প্রজ্জ্বলিত হইলেও লৌহ বা প্রস্তর বৎ কঠিন হইয়া উঠে। আমার এই বাক্য শ্রবণে মহিষী উত্তর করিল, হ্যাঁ ভাল বলিয়াছেন, তাই তো বটে, কোথায় দেখিয়াছেন, রমণীগণ এক পুরুষকে পরিত্যাগ করিয়া, পুরুষান্তর আশ্রয় করে। বরং পুরুষেরা একটি রূপবতী যুবতী দেখিলেই পূর্বপ্রেম এবং ধর্ম বিসর্জন দিয়া তাদের প্রতি আসক্তি হয় এবং তাহাকে প্রণয়িনী করিবার জন্য নানা প্রকার চেষ্টা করে। প্রভুর ইচ্ছায় যদি কোনক্রমে ঐ কার্য সুসম্পন্ন করিতে না পারে, তবে পূর্ব প্রণয়িনীর নিকট আসিয়া সহস্র শপথ করিয়া বলে, তোমাকে বিনা আমি আর কাহাকেও জানি না। অধিক কি অন্য বামার রূপলাবণ্য আমার চক্ষে গরল প্রায় জ্ঞান হয়। পুরুষদিগের অন্তঃকরণের স্নেহ চিরস্থায়ী নহে।’

এই উপন্যাসের ভাষা চিত্র বহুল ও জীবনধর্মী। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর (১০ আশ্বিন, ১৩১৪ বঙ্গাব্দ) নওয়ার ফয়জুন্নেসা চৌধূরানী লোকান্তরিত হন। পশ্চিম গাঁয়ের নিজ বাড়িতে নিজ কন্য আরশাদুন্নেসার পাশে তিনি চিরশয্যায় শায়িত আছেন।

মৃত্যুর ১০০ বছর পরে বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে সমাজ সেবার ক্ষেত্রে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ একুশে পদক ও সম্মাননা পত্র (মরণোত্তর) প্রদান করেন।

হাজী সহিফা বিবি (১৮৫০-১৯২৬ খ্রি.)

হাজী সহিফা বিবি বেগম রোকেয়ার জন্মের আনুমানিক প্রায় দুই যুগ আগে সিলেট জেলার কুয়ারপাড় এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম জমিদার আলী রেজা। তার পিতা ছিলেন লক্ষণ ছিরি ও কৌড়িয়ার জমিদার। সহিফা বিবি ছিলেন হাছন রাজার বৈমাত্রেয় বোন। তার স্বামী ছিলেন হাজী মোজাফফর চৌধূরী। সহিফা বিবি সঙ্গীতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি ছিলেন নি:সন্তান। সহিফা বিবির ৩ খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়- ১. সহিফা সঙ্গীত, ২. ইয়াদ গায়ে, ৩. সইফা ও ছাহেবানের জারি। ছহিফা সঙ্গীত ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে সিলেট থেকে আব্দুল জব্বার কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এটি একটি সঙ্গীত গ্রন্থ। এতে ৪৮টি গান স্থান পেয়েছে। তার গ্রন্থে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মরমী কবিদের কোন নির্দিষ্ট ধর্ম নেই। সহিফা বিবির কাব্যে তা লক্ষণীয়। এ গ্রন্থের প্রথমে তিনি সরস্বতী বন্দনা করেছেন। পরবর্তী সঙ্গীতটি আবার কাওয়ালী। তার এই গ্রন্থে সুফীতত্ত্ব ও বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাবও লক্ষনীয়। তিনি উর্দু, হিন্দী ও বাংলা ভাষায় সমান পারদর্শী ছিলেন। একমাত্র সহিফা সঙ্গীত বাদে তার অন্য দুটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়না। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত এবং নারীদের শিক্ষার জন্য তার কবিতা ও গানে নারীদের জীবনের অনেক অবহেলিত ও সামাজিক চিত্র ফুটে উঠেছে। যে কালে মেয়েরা কাব্য রচনার কথা দুরে থাক তাদের লেখপড়ার সুযোগ ছিলনা, সে সময়ে নারী জাগরণে সহিফা বিবির এমন সাহিত্য রচনা কৃতিত্বের দাবি রাখে। তার কবিতা ও বহু গানে সে কালের সমাজের সামাজিক বৈষম্য ও নানা অসঙ্গতির চিত্র ফুটে উঠেছে। সমাজের উদ্দেশ্যে তিনি ব্যঙ্গ করে লিখেছেন-

ধনে জনে ভাল যারা

মিথ্যা হইলে জয়ী তারা,

দুঃখিত এতিম বিধবারা।

চোরা যারা ভাল তারা

চোরা ধনে বুক তার পুরা।

টাকায় বলে যা না

ধরা কি বুঝিবে বেচারীরা।

সহিফা ভাবিয়া বলে সারা

তেলেঙ্গী বিষম চোরা।

নারী জাগরণে সহিফা বিবির রচনার সুর মাধুরী সহজভাবে মনকে ছুয়ে যায়। তিনি বহুবার হজ্বব্রত পালন করেছিলেন বলে সিলেট অঞ্চলে তিনি ‘হাজী বিবি’ নামে পরিচিত ছিলেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।

[লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা]

jewelwriter53@gmail.com