পরামর্শদাতা অনেক হিতাকাক্সক্ষীর

মোহাম্মদ আবু নোমান

জগতে পরামর্শদাতার অভাব নেই। প্রকৃত হিতাকাক্সক্ষীর বড়ই অভাব। পরামর্শ না চাইতেই পাওয়া যায়। অনেকেই কথায় কথায় মিথ্যা বলেন, অথচ সে-ই মানুষকে মিথ্যা কথা না বলার জন্য উপদেশ দেন। এজন্য বলা হয়- ‘নিজের বুদ্ধিতে রাজা, পরের বুদ্ধিতে প্রজা’। সে যাই হোক, প্রত্যেককে নিজের নিরাপদ পথ নিশ্চিত করে সে পথেই চলা উচিত। প্রবাদ আছে ‘নিজের বুদ্ধিতে পেটে ভাত, অন্যের বুদ্ধিতে কপালে হাত’। বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মায়ানমারের পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্ক, আর্থিক ও কৌশলগত এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে।

চীন বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে আগ্রহী ছিল। কয়েক বছর আগে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় চীন প্রাথমিকভাবে ৭ বিলিয়ন ডলার বা ৫৬ হাজার কোটি টাকার অর্থায়নে গভীর সমুদ্রবন্দর করতে প্রস্তাব দিয়েছিল। বাংলাদেশ রাজিও হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেশী কোনো দেশের পরামর্শে বলা হল, যৌথভাবে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হবে। আবার বলা হয় অন্য এলাকায় নির্মাণ হবে। এভাবে সময়ক্ষেপণ করে করে চীনকে বুঝিয়ে দেয়া হলো, আমরা তোমাদের এ প্রস্তাবে সম্মত নই। চীনও তার বিনিয়োগ নিয়ে বসে থাকেনি। তারা আমাদের দেয়া সেই প্রস্তাবই এখন মায়ানমারে রোহিঙ্গা অধুষিত রাখাইন স্টেটে করার চুক্তি করেছে। অন্যের কূটচালে (এক রকম অসহায় প্রজা হয়ে) আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে বঞ্চিত হলাম। তা হলো- বিনিয়োগ, গভীর সমুদ্রবন্দর, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। যাদের বুদ্ধিতে আমাদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া হলো, বর্তমানে তারা আমাদের পাশে নেই। বাংলাদেশে চীন যে বিশাল বিনিয়োগে আগ্রহী ছিলো, বিনিয়োগ রক্ষার স্বার্থে হলেও এখন হয়তো রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিত।

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়ার মুহূর্তে মায়ানমারের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের অঙ্গীকার ও একগুচ্ছ চুক্তি করে দেশে ফিরেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং। এর মধ্যে বঙ্গোপসাগর এলাকায় ‘কাইয়ুকপাইউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বিষয়ক চুক্তিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। সফরকালে অং সান সুচির সঙ্গে সাক্ষাতের পাশাপাশি ৩৩টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তিনি। এসব চুক্তির মধ্যে তথ্যবিনিময় থেকে শুরু করে শিল্প, কৃষি, নিরাপত্তা এবং চীন সীমান্তে অবস্থিত মায়ানমারের কাচিন প্রদেশের গৃহহীনদের পুনর্বাসনের মতো বিষয়ও রয়েছে।

রাখাইনে গণহত্যা, গণধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের ও দেশত্যাগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিস্তর অভিযোগ ও অন্যায়কে না দেখার ভান করে, চীন নির্লজ্জভাবে আন্তর্জাতিক আঙিনায় মায়ানমারের ঢাল হওয়ার বিনিময়ে যা চেয়েছে, তা-ই পেয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের এবার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো প্রকল্পের তহবিল নিয়ে বার্মায় হাজির। যদিও এসব প্রকল্পে মায়ানমার যতটা লাভবান হবে, তার চেয়ে বেশি লাভ হবে চীনের। এর মধ্যে অশান্ত রাখাইন প্রদেশে কিয়াউকফুতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকে বলা হচ্ছে ‘চীনা মুকুটের রত্ন’। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক সত্ত্বেও চীন মিয়ানমারের পাশে থাকবে বলে অঙ্গীকার করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় মানবিক সঙ্কট বলে স্বীকৃত। রাখাইনের ২০১৭ সালের ওই নৃশংসতাকে খোদ জাতিসংঘ গণহত্যা বলছে অভিহিত করেছে। ব্যবসা, সম্পদ আর ক্ষমতার কাছে আজ মানবতা মূল্যহীন! রাজনীতি আর কূটনীতির কোনো সরল হিসাব-নিকাশ নেই। মূল হিসাবটি স্বার্থ। মানবিকতা অর্থহীন বলেই চীন আজ খুনি মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে।

ইসলামী জঙ্গিবাদের বিপদ মাথায় রেখে ভারত ও চীন যদি মায়ানমারের পক্ষ নিয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশেরও বলতে হবে, মায়ানমারের আরাকান বা রোহিঙ্গা নীতি এ অঞ্চলে বিপদকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তখন এ বিপদ থেকে কেউই গা বাঁচাতে পারবে না। এত বড় একটি মুসলিম জনগোষ্ঠী যেখানে ধারাবাহিকভাবে অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যে যুবক নিজের মাকে, বোনকে, স্ত্রীকে ধর্ষিতা হতে দেখেছে। যে মা-বাবা তার সন্তানকে পুড়িয়ে মারতে দেখেছে। তারা এখন জীবন দিয়ে হলেও প্রতিরোধ, প্রতিশোধস্পৃহা হবে না, তা কে নিশ্চিত করে বলতে পারবে? বিশ্বকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের পরের সমস্যাগুলো কীভাবে আঘাত হানবে তা বাংলাদেশকে বোঝাতে হবে। চীন-ভারতের অর্থনৈতিক লাভের হিসাব-নিকাশ তখন আর মিলবে না।

সমগ্র বিশ্ব যেখানে বর্মার সামরিক জান্তার নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্ছার। সেখানে চীন তার অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থে নিয়ে ব্যস্ত। চরম অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে গ্রহণ না করে বাংলাদেশের কোনো পথও ছিল না। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মায়ানমারের যে নীতি ও পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে, তাতে এদের ফেরত পাঠানো যে সহজ হবে না, সেটাও টের পাওয়া যাচ্ছে।

চীন অনেক বছর ধরেই মায়ানমারকে ব্যবহারের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে অবাধে বাণিজ্যের সুযোগ ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগরে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় রয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে মায়ানমারের প্রতি চীনের যে সমর্থন, এটিই তার অন্যতম কারণ।

মিয়ানমার যখনই বিশ্বসম্প্রদায়ের কোনো চাপের মুখোমুখি হয়েছে, তখনই চীন মায়ানমারের প্রতি তার সহায়তা, সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মায়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। কিন্তু চীন কখনো মায়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করবে না বলেই মনে হয়। চীন অবশ্যই মায়ানমারকে হাতে রাখতে চাইবে। কারণ, সেখানে তার দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থের চিন্তা রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্ব মায়ানমারকে যতই চেপে ধরেছে, চীন মায়ানমারকে ততই কাছে টেনেছে। মায়ানমার সেনাবাহিনী চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গেও বর্তমানে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। গত বছরের এপ্রিলে মায়ানমার সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ মিন অং হ্লাইং চীনের পাশাপাশি রাশিয়াও সফর করেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্য বাড়ানোর লক্ষ্যেই মায়ানমারের সঙ্গে চীন সুসম্পর্ক ধরে রেখেছে। ইউরোপের পাশাপাশি এশিয়া ও আফ্রিকার সঙ্গে সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথে যোগাযোগ স্থাপন করাও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে মায়ানমারে করিডর বানাতে পারলে খুব সহজেই ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে চীন। ভারত মহাসাগরে পৌঁছতে পারলে পারস্য উপসাগর দিয়ে জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি করা তাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে। তখন মালাক্কা প্রণালির ওপর চীনকে নির্ভর করতে হবে না।

ইতোপূর্বে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বাত্মক হামলা শুরুর প্রথম বার্ষিকীতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আয়োজিত এক উন্মুক্ত বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, মায়ানমার যত যুক্তিই দেখাক না কেন, সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও তাদের দোসররা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে নির্বিচার শক্তি প্রয়োগ ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন করেছে, কোনো যুক্তি দিয়েই তা ন্যায়সংগত প্রমাণ করা যাবে না। আন্তর্জাতিক তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয় উল্লেখ করে মহাসচিব বলেন, এই মিশন মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে প্রমাণ পেয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহই থাকে না, মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী আন্তর্জাতিক আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ করেছে। মহাসচিব আরো বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের স্বেচ্ছায় নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে মায়ানমার সরকার বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবায়নে যে অঙ্গীকার প্রয়োজন, তার কোনো লক্ষণ তিনি দেখেন না।

রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ায় শান্তিপ্রিয় বিশ্ব নেতারা বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত নিকি হেইলি বলেন, প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে মহানুভবতা দেখিয়েছে, তার ফলে অসংখ্য মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে। তিনি সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, কক্সবাজারে ১ হাজার ২৪ জন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর সরাসরি সাক্ষাতের ভিত্তিতে প্রস্তুত এই প্রতিবেদনে ‘জাতি নির্মূলকরণের’ স্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠেছে। এই পরিকল্পিত জাতি নির্মূলকরণের জন্য একমাত্র দায়ী মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী।

বিশিষ্ট চলচ্চিত্রশিল্পী ও জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংস্থার শুভেচ্ছাদূত কেট ব্লানচেট, যিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবিরে তার সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘আমি একজন মা। উদ্বাস্তু শিশুদের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি নিজের সন্তানদের দেখতে পেয়েছি।’ লায়লা নামের এক উদ্বাস্তু ও তার ছেলে ইউসুফের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে ব্লানচেট বলেন, তারা স্বচক্ষে নিজের ঘরবাড়ি পুড়ে যেতে দেখেছেন। মানুষকে আগুনকে পুড়িয়ে মারা ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘একজন মা কীভাবে নিজ চোখে তার সন্তানদের আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা দেখে তা সহ্য করবে, বলতে পারেন?’

আমাদের দুর্ভাগ্য, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ও ভারতকে পাশে পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এটা অনেকের কাছেই সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও চীনের দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনৈতিক স্বার্থ, বিনিয়োগ ও ভূরাজনীতির হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে হওয়ায়, বাংলাদেশ দুই দেশের কাউকেই পক্ষে পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে স্বার্থ তো অবশ্যই একটি বড় পয়েন্ট। সবাই সবার স্বার্থ দেখবে এটাই স্বাভাবিক। সে হিসেবে অবশ্যই বলা যায় যে আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা আছে। তবে থেমে থাকলে চলবে না। সমস্যা যখন হয়েছে, সমাধানও বের করে আনতে হবে। ধৈর্য্য ধরে মোকাবেলা করলে ভালো সমাধান অবশ্যই আসবে। বাংলাদেশকে আর হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বিষয়টির যাতে জোরালো আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটে, সেদিকে নজর দিতে হবে। শুধু মানবিক বিপর্যয়ের নয়, জঙ্গিবাদ বা উগ্রপন্থা কোথায় যেতে পারে, তার একটা সম্ভাব্য চিত্রও তাদের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে।

abunoman1972@gmail.com

বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২০ , ৮ মাঘ ১৪২৬, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

পরামর্শদাতা অনেক হিতাকাক্সক্ষীর

মোহাম্মদ আবু নোমান

জগতে পরামর্শদাতার অভাব নেই। প্রকৃত হিতাকাক্সক্ষীর বড়ই অভাব। পরামর্শ না চাইতেই পাওয়া যায়। অনেকেই কথায় কথায় মিথ্যা বলেন, অথচ সে-ই মানুষকে মিথ্যা কথা না বলার জন্য উপদেশ দেন। এজন্য বলা হয়- ‘নিজের বুদ্ধিতে রাজা, পরের বুদ্ধিতে প্রজা’। সে যাই হোক, প্রত্যেককে নিজের নিরাপদ পথ নিশ্চিত করে সে পথেই চলা উচিত। প্রবাদ আছে ‘নিজের বুদ্ধিতে পেটে ভাত, অন্যের বুদ্ধিতে কপালে হাত’। বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মায়ানমারের পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্ক, আর্থিক ও কৌশলগত এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে।

চীন বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে আগ্রহী ছিল। কয়েক বছর আগে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় চীন প্রাথমিকভাবে ৭ বিলিয়ন ডলার বা ৫৬ হাজার কোটি টাকার অর্থায়নে গভীর সমুদ্রবন্দর করতে প্রস্তাব দিয়েছিল। বাংলাদেশ রাজিও হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেশী কোনো দেশের পরামর্শে বলা হল, যৌথভাবে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হবে। আবার বলা হয় অন্য এলাকায় নির্মাণ হবে। এভাবে সময়ক্ষেপণ করে করে চীনকে বুঝিয়ে দেয়া হলো, আমরা তোমাদের এ প্রস্তাবে সম্মত নই। চীনও তার বিনিয়োগ নিয়ে বসে থাকেনি। তারা আমাদের দেয়া সেই প্রস্তাবই এখন মায়ানমারে রোহিঙ্গা অধুষিত রাখাইন স্টেটে করার চুক্তি করেছে। অন্যের কূটচালে (এক রকম অসহায় প্রজা হয়ে) আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে বঞ্চিত হলাম। তা হলো- বিনিয়োগ, গভীর সমুদ্রবন্দর, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। যাদের বুদ্ধিতে আমাদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া হলো, বর্তমানে তারা আমাদের পাশে নেই। বাংলাদেশে চীন যে বিশাল বিনিয়োগে আগ্রহী ছিলো, বিনিয়োগ রক্ষার স্বার্থে হলেও এখন হয়তো রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিত।

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়ার মুহূর্তে মায়ানমারের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের অঙ্গীকার ও একগুচ্ছ চুক্তি করে দেশে ফিরেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং। এর মধ্যে বঙ্গোপসাগর এলাকায় ‘কাইয়ুকপাইউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বিষয়ক চুক্তিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। সফরকালে অং সান সুচির সঙ্গে সাক্ষাতের পাশাপাশি ৩৩টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তিনি। এসব চুক্তির মধ্যে তথ্যবিনিময় থেকে শুরু করে শিল্প, কৃষি, নিরাপত্তা এবং চীন সীমান্তে অবস্থিত মায়ানমারের কাচিন প্রদেশের গৃহহীনদের পুনর্বাসনের মতো বিষয়ও রয়েছে।

রাখাইনে গণহত্যা, গণধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের ও দেশত্যাগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিস্তর অভিযোগ ও অন্যায়কে না দেখার ভান করে, চীন নির্লজ্জভাবে আন্তর্জাতিক আঙিনায় মায়ানমারের ঢাল হওয়ার বিনিময়ে যা চেয়েছে, তা-ই পেয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের এবার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো প্রকল্পের তহবিল নিয়ে বার্মায় হাজির। যদিও এসব প্রকল্পে মায়ানমার যতটা লাভবান হবে, তার চেয়ে বেশি লাভ হবে চীনের। এর মধ্যে অশান্ত রাখাইন প্রদেশে কিয়াউকফুতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকে বলা হচ্ছে ‘চীনা মুকুটের রত্ন’। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক সত্ত্বেও চীন মিয়ানমারের পাশে থাকবে বলে অঙ্গীকার করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় মানবিক সঙ্কট বলে স্বীকৃত। রাখাইনের ২০১৭ সালের ওই নৃশংসতাকে খোদ জাতিসংঘ গণহত্যা বলছে অভিহিত করেছে। ব্যবসা, সম্পদ আর ক্ষমতার কাছে আজ মানবতা মূল্যহীন! রাজনীতি আর কূটনীতির কোনো সরল হিসাব-নিকাশ নেই। মূল হিসাবটি স্বার্থ। মানবিকতা অর্থহীন বলেই চীন আজ খুনি মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে।

ইসলামী জঙ্গিবাদের বিপদ মাথায় রেখে ভারত ও চীন যদি মায়ানমারের পক্ষ নিয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশেরও বলতে হবে, মায়ানমারের আরাকান বা রোহিঙ্গা নীতি এ অঞ্চলে বিপদকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তখন এ বিপদ থেকে কেউই গা বাঁচাতে পারবে না। এত বড় একটি মুসলিম জনগোষ্ঠী যেখানে ধারাবাহিকভাবে অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যে যুবক নিজের মাকে, বোনকে, স্ত্রীকে ধর্ষিতা হতে দেখেছে। যে মা-বাবা তার সন্তানকে পুড়িয়ে মারতে দেখেছে। তারা এখন জীবন দিয়ে হলেও প্রতিরোধ, প্রতিশোধস্পৃহা হবে না, তা কে নিশ্চিত করে বলতে পারবে? বিশ্বকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের পরের সমস্যাগুলো কীভাবে আঘাত হানবে তা বাংলাদেশকে বোঝাতে হবে। চীন-ভারতের অর্থনৈতিক লাভের হিসাব-নিকাশ তখন আর মিলবে না।

সমগ্র বিশ্ব যেখানে বর্মার সামরিক জান্তার নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্ছার। সেখানে চীন তার অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থে নিয়ে ব্যস্ত। চরম অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে গ্রহণ না করে বাংলাদেশের কোনো পথও ছিল না। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মায়ানমারের যে নীতি ও পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে, তাতে এদের ফেরত পাঠানো যে সহজ হবে না, সেটাও টের পাওয়া যাচ্ছে।

চীন অনেক বছর ধরেই মায়ানমারকে ব্যবহারের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে অবাধে বাণিজ্যের সুযোগ ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগরে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় রয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে মায়ানমারের প্রতি চীনের যে সমর্থন, এটিই তার অন্যতম কারণ।

মিয়ানমার যখনই বিশ্বসম্প্রদায়ের কোনো চাপের মুখোমুখি হয়েছে, তখনই চীন মায়ানমারের প্রতি তার সহায়তা, সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মায়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। কিন্তু চীন কখনো মায়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করবে না বলেই মনে হয়। চীন অবশ্যই মায়ানমারকে হাতে রাখতে চাইবে। কারণ, সেখানে তার দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থের চিন্তা রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্ব মায়ানমারকে যতই চেপে ধরেছে, চীন মায়ানমারকে ততই কাছে টেনেছে। মায়ানমার সেনাবাহিনী চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গেও বর্তমানে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। গত বছরের এপ্রিলে মায়ানমার সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ মিন অং হ্লাইং চীনের পাশাপাশি রাশিয়াও সফর করেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্য বাড়ানোর লক্ষ্যেই মায়ানমারের সঙ্গে চীন সুসম্পর্ক ধরে রেখেছে। ইউরোপের পাশাপাশি এশিয়া ও আফ্রিকার সঙ্গে সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথে যোগাযোগ স্থাপন করাও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে মায়ানমারে করিডর বানাতে পারলে খুব সহজেই ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে চীন। ভারত মহাসাগরে পৌঁছতে পারলে পারস্য উপসাগর দিয়ে জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি করা তাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে। তখন মালাক্কা প্রণালির ওপর চীনকে নির্ভর করতে হবে না।

ইতোপূর্বে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বাত্মক হামলা শুরুর প্রথম বার্ষিকীতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আয়োজিত এক উন্মুক্ত বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, মায়ানমার যত যুক্তিই দেখাক না কেন, সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও তাদের দোসররা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে নির্বিচার শক্তি প্রয়োগ ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন করেছে, কোনো যুক্তি দিয়েই তা ন্যায়সংগত প্রমাণ করা যাবে না। আন্তর্জাতিক তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয় উল্লেখ করে মহাসচিব বলেন, এই মিশন মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে প্রমাণ পেয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহই থাকে না, মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী আন্তর্জাতিক আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ করেছে। মহাসচিব আরো বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের স্বেচ্ছায় নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে মায়ানমার সরকার বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবায়নে যে অঙ্গীকার প্রয়োজন, তার কোনো লক্ষণ তিনি দেখেন না।

রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ায় শান্তিপ্রিয় বিশ্ব নেতারা বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত নিকি হেইলি বলেন, প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে মহানুভবতা দেখিয়েছে, তার ফলে অসংখ্য মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে। তিনি সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, কক্সবাজারে ১ হাজার ২৪ জন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর সরাসরি সাক্ষাতের ভিত্তিতে প্রস্তুত এই প্রতিবেদনে ‘জাতি নির্মূলকরণের’ স্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠেছে। এই পরিকল্পিত জাতি নির্মূলকরণের জন্য একমাত্র দায়ী মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী।

বিশিষ্ট চলচ্চিত্রশিল্পী ও জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংস্থার শুভেচ্ছাদূত কেট ব্লানচেট, যিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবিরে তার সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘আমি একজন মা। উদ্বাস্তু শিশুদের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি নিজের সন্তানদের দেখতে পেয়েছি।’ লায়লা নামের এক উদ্বাস্তু ও তার ছেলে ইউসুফের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে ব্লানচেট বলেন, তারা স্বচক্ষে নিজের ঘরবাড়ি পুড়ে যেতে দেখেছেন। মানুষকে আগুনকে পুড়িয়ে মারা ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘একজন মা কীভাবে নিজ চোখে তার সন্তানদের আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা দেখে তা সহ্য করবে, বলতে পারেন?’

আমাদের দুর্ভাগ্য, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ও ভারতকে পাশে পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এটা অনেকের কাছেই সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও চীনের দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনৈতিক স্বার্থ, বিনিয়োগ ও ভূরাজনীতির হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে হওয়ায়, বাংলাদেশ দুই দেশের কাউকেই পক্ষে পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে স্বার্থ তো অবশ্যই একটি বড় পয়েন্ট। সবাই সবার স্বার্থ দেখবে এটাই স্বাভাবিক। সে হিসেবে অবশ্যই বলা যায় যে আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা আছে। তবে থেমে থাকলে চলবে না। সমস্যা যখন হয়েছে, সমাধানও বের করে আনতে হবে। ধৈর্য্য ধরে মোকাবেলা করলে ভালো সমাধান অবশ্যই আসবে। বাংলাদেশকে আর হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বিষয়টির যাতে জোরালো আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটে, সেদিকে নজর দিতে হবে। শুধু মানবিক বিপর্যয়ের নয়, জঙ্গিবাদ বা উগ্রপন্থা কোথায় যেতে পারে, তার একটা সম্ভাব্য চিত্রও তাদের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে।

abunoman1972@gmail.com