প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বাংলাদেশ

এম আর খায়রুল উমাম

‘শোনো বাংলাদেশ, স্বপ্নের ফেনা লেগে তোমার চোখ

এমন অন্ধ হয়ে যায়নি যে, তুমি

দেখতে পাচ্ছো না শকুনের ঝাঁক বড়শির মতো নখ দিয়ে

আকাশের উদর ছিঁড়ে খুঁড়ে হিঁচড়ে টেনে আনছে

মেঘের নাড়ি-ভুঁড়ি;

দেখতে পাচ্ছো না সংসদ ভবন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে,

রাজনীতিবিদগণ জনগণের কাছ থেকে

বিচ্ছিন্ন হয়ে বনভোজন করছেন দীর্ঘকাল;

শাসনতন্ত্র কাঁটা ঘুড়ির মতো ভাসমান,

উন্নয়ন বিশারদগণ পাঁচসালা পরিকল্পনাকে

কুরে কুরে খাচ্ছেন ঘুণের ধরনে।’

-গুড মর্নিং বাংলাদেশ, কবি শামসুর রাহমান

আমরা দু’শ বছর ব্রিটিশদের অধীনে ছিলাম। আমরা ২৪ বছর পাকিস্তানিদের অধীনে ছিলাম। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করেছি। ৩০ লক্ষ জীবন উৎসর্গ করেছি, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম দিয়েছি। আমরা আমাদের একটা রাষ্ট্রের মালিক হতে নির্যাতন ভোগ করেছি। আমরা আমাদের ভাগ্য নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টির জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। নিজ দেশে পরাধীন জীবন থেকে মুক্তি চেয়েছি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সুশাসন ভিত্তিক সমাজ ও নিজ সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশকে বাধাহীনভাবে অর্জনের জন্য, প্রাপ্তির জন্য আমাদের উদগ্র বাসনার একাগ্রতাই বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। আজ বাঙালি স্বাধীন। ব্রিটিশরা নেই, পাকিস্তানিরা নেই, জমিদাররা নেই। তাও দেশের প্রধান কবিকে আফসোস করতে দেখা যায় বর্ণিত কবিতায়। কারণ সার্বিক বিচারে স্বাধীনতার সুফল হিসেবে আমাদের একমাত্র অর্জন স্বজাতির শাসন।

সামনে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করবো। কিন্তু সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো এখনো সোনার হরিণের মতো অধরাই থেকে গেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী প্রতিটা জাতীয় বাজেটে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনকে গুরুত্ব প্রদান করা হলেও পরিস্থিতির অবনতি ছাড়া উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়নি। জনসংখ্যা বেড়েছে, বাজেটের আকার বেড়েছে, যেসব খাতের ব্যয় বরাদ্দ বাড়লে জনগণের মুক্তিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতো তার প্রতিটা খাতে শতাংশের হারে ব্যয় বৃদ্ধি তো ঘটেইনি বরং দিনে দিনে শতাংশ হারে কমে গিয়েছে। ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে জীবন সংগ্রামে পরাজিতবোধের লক্ষণ ফুটে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের মনে আপোষকামিতা সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করে সকলকে যে দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ একটা দেশের জন্য, সমতাভিত্তিক সমাজের জন্য, উদার গণতন্ত্রের জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য- আন্দোলন সংগ্রামে তারা আজ বিমুখ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে রেখে ধর্মনিরপেক্ষতা ধরে রাখা, আয় বৈষম্যের শিকার হয়ে বিপর্যয়ের মধ্যে থেকেও সাম্যের কথা না বলা, আন্দোলন-সংগ্রাম বলতে মানববন্ধন সংস্কৃতি, মুক্তি বলতে এনজিও কর্মকা- আর সামর্থ অনুয়ায়ী বিদেশ যাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ মানুষের জীবন সংগ্রাম।

বাংলাদেশে গত প্রায় ৫০ বছরে আর্থিক ক্ষেত্রে অগগ্রতি চলমান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত, সাহায্যনির্ভর, ঋণ নির্ভর স্বাধীন দেশটি আর্থিক উপার্জনের কৌশল বাড়িয়ে আজ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশ জাতীয় আয়ের প্রধান উৎসকে কৃষি থেকে তৈরি পোশাক আর জনশক্তিতে রূপান্তর ঘটিয়ে ব্যাপক উন্নয়নের দ্বার খুলেছে। ১৯৭১ সালের মাথাপিছু আয় ৬৭১ টাকা আজ বেড়ে দাড়িয়েছে দেড় লাখ টাকার উপরে। ১৯৭১ সালের দেশের বার্ষিক রপ্তানিকেও বাড়িয়ে আকাশ ছোঁয়া করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা ও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এত অগ্রগতির মধ্যে আর্থিক বৈষম্য প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কল্যাণে আমদানি নীতি উদার হয়েছে, ফলশ্রুতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পাশাপাশি বৃহৎ শিল্পও হুমকির মুখে পড়েছে। ঋণখেলাপির সংস্কৃতির সঙ্গে অবাধ সম্পদ ও কালো টাকা অর্জনের প্রতিযোগিতায় নৈরাজ্য বেড়েছে। সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে এবং গার্মেন্টস শিল্প নির্ভর কর্মসংস্থানের মধ্যেই জীবন সংগ্রামে নিবেদিত। এর সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে ৫০০ টাকার সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। অবস্থা উত্তরণে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে গ্রামীণ অর্থনীতিকে রক্ষা, নারী পুরুষের মজুরি বৈষম্য নিরসন করা, আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে রফতানি বাড়ানো, দেশজ শিল্পকে সমৃদ্ধ করা, কৃষির আধুনিকায়ন ও বিজ্ঞান নির্ভর সংস্কার করা, সম্পদের অসম বন্টন রোধ করা, ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে জালিয়াতি বন্ধ করা, বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রসার ঘটিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা, মানবসম্পদ পরিকল্পনা করে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা, পরিবেশ দূষণ রোধের উদ্যোগ নেয়া জরুরি; যা অর্থনীতির প্রবাহকে গতিশীল এবং কর্মমুখী মানুষের ¯স্রোতকে বেগবান করবে।

স্বাধীনতার পাঁচ দশকে শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় অর্জন শিক্ষানীতি। জনগণের দীর্ঘদিনের চাহিদা জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০। দেশে প্রাথমিক শিক্ষার হার বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, স্বাক্ষরতার হার বেড়েছে, নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হয়েছে, ঝরে পড়ার হার কমেছে, সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে প্রকৌশল, কৃষি, মেডিকেল, বস্ত্র, চামড়া ইত্যাদি শিক্ষার ক্ষেত্রে। শিক্ষা সম্পর্কিত অঙ্গীকার পূরণে সরকার বদ্ধপরিকর। শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন বই সরবরাহসহ আশু সমস্যার আশু সমাধান হিসেবে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে। কিন্তু এত কর্মযজ্ঞ চলমান থাকার পরও মানসম্মত শিক্ষার চাহিদা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা সর্বত্র আজ একই অবস্থা। জাতীয় শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারিত আছে ‘জাতীয় জীবনের সর্বত্র নেতৃত্বদানের উপযোগী, বিজ্ঞান মনষ্ক, প্রগতিশীল, মানবমুখী, দূরদর্শী, অসাম্প্রদায়িক ও উদারনৈতিক সুনাগরিক সৃষ্টিই হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বমানের শিক্ষার লক্ষ্য।’ অথচ আজ আমাদের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চশিক্ষার মানক্রমে বিশ্বে খুঁজতে ম্যাগনিফায়িং গ্লাসের প্রয়োজন পড়ছে। আর নিয়মিত হানাহানি মারামারিতে সহপাঠীকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে কোনো দ্বিধা জাগছে না শিক্ষার্থীদেও মনে।

ছাত্র ও শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তিধারী সংগঠন করা ফলে দ্বন্দ-সংঘাত ব্যাপকতর হয়ে পড়ছে। এতে শিক্ষায় সেশনজট সৃষ্টি করছে, শিক্ষা আর সংস্কৃতি বোধকে জাগ্রত করছে না, ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত করে তুলছে না, দেশপ্রেমকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাচ্ছে না। জাতীয় জীবনে শিক্ষার সুফল দ্রুত পৌছে দিতে শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন করা, বৈশ্বিকভাবে বর্তমানের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো, মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, সংবিধান অনুযায়ী বহুধারার সব শিক্ষা ব্যবস্থাকে দেশপ্রেমমূলক বাঙালি জাতীয়তাবোধ সম্পন্ন একই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন, যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ, জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে কর্মদক্ষতা অর্জন ও সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ করার মতো ক্ষমতা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

সরকার দাবি করে উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতু, প্রশস্তকরণসহ মহাসড়ক সংস্কার, মেট্রোরেল, ট্যানেল, উড়াল সেতু, ওভার ব্রিজ, ফ্লাইওভার, অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবন, রেল উন্নয়ন, নৌপথ উদ্ধার, নতুন রাস্তা নির্মাণ ও পুরনো রাস্তা সংস্কার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মানুষের নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবনের ভারসাম্য আনতে উদ্যোগী সরকার। শিক্ষানীতি, নারী উন্নয়ন নীতি, তথ্য অধিকার আইন, সড়ক নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতি, শিল্প নীতি, বাণিজ্য নীতি ইত্যাদি জনগণের সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় গাইড লাইন হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিদিনকার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারছে বর্তমান উন্নয়নের ধারা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্যর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিতি, দুর্নীতি আর নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রতিযোগিতার কারণে। স্বাধীনতা বিরোধীদের দেশে অস্থিতি পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টার পাশাপাশি সরকারি দলের কর্মীরা ব্যক্তিগত আধিপত্য বিস্তারে সারাদেশে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সরকারি উন্নয়নের ওয়াচডগ না হয়ে তারা সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়িছে। পর্দা-বালিশ-চেয়ার কেলেংকারি চলমান, উন্নয়ন প্রকল্প প্রাক্কলিক ব্যয় ও সময়ে শেষ হচ্ছে না, ব্যাংক জালিয়াতি ও শেয়ার ধস ঘটছে, সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ নষ্ট করছে, আলু চাষ -পুকুর কাটা-গ্রাম উন্নয়ন প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ ভ্রমণ চলছে, কমিশন বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। সরকার এসব ব্যাপারে সতর্ক হলে, যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন হবে এবং দেশ আরও এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলের ভালো অঙ্গীকারগুলো সরল বিশ্বাসে গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না। যদিও সহজে কোনোকিছু পাওয়া যায় না, কষ্ট করে অর্জন করতে হয়। কিন্তু আমাদের আকাক্সক্ষায় কষ্টসহিষ্ণুতার প্রবণতা কম। একশ্রেণীর মানুষ ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় নীতি-নৈতিকতাকে পাশে রেখে ছুটে চলেছে। আর একশ্রেণীর মানুষ জীবনসংগ্রামে পরাজিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে নগরমুখী হচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্য দেয়া উন্নয়ন ধারার কারণে আয়বৈষম্য বেড়ে চলেছে। বেকারত্ব আর দারিদ্র্যে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ হারিয়ে ফেলেছে। মানবসভ্যতার কৃষিযুগ থেকে শিল্পযুগ হয়ে এখন ডিজিটাল যুগ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অগ্রসরমান বিশ্বের যুগোপযোগী কর্মসূচি ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটা নতুন অর্থনীতি, একটা নতুন জীবনধারা সৃষ্টির অঙ্গীকার বাস্তবায়নে নিবেদিত। সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র সরকারি প্রচেষ্টার দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত প্রয়াস প্রত্যাশা করে।

[লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)]

khairulumam1950@gmail.com

শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২০ , ১১ মাঘ ১৪২৬, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বাংলাদেশ

এম আর খায়রুল উমাম

‘শোনো বাংলাদেশ, স্বপ্নের ফেনা লেগে তোমার চোখ

এমন অন্ধ হয়ে যায়নি যে, তুমি

দেখতে পাচ্ছো না শকুনের ঝাঁক বড়শির মতো নখ দিয়ে

আকাশের উদর ছিঁড়ে খুঁড়ে হিঁচড়ে টেনে আনছে

মেঘের নাড়ি-ভুঁড়ি;

দেখতে পাচ্ছো না সংসদ ভবন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে,

রাজনীতিবিদগণ জনগণের কাছ থেকে

বিচ্ছিন্ন হয়ে বনভোজন করছেন দীর্ঘকাল;

শাসনতন্ত্র কাঁটা ঘুড়ির মতো ভাসমান,

উন্নয়ন বিশারদগণ পাঁচসালা পরিকল্পনাকে

কুরে কুরে খাচ্ছেন ঘুণের ধরনে।’

-গুড মর্নিং বাংলাদেশ, কবি শামসুর রাহমান

আমরা দু’শ বছর ব্রিটিশদের অধীনে ছিলাম। আমরা ২৪ বছর পাকিস্তানিদের অধীনে ছিলাম। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করেছি। ৩০ লক্ষ জীবন উৎসর্গ করেছি, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম দিয়েছি। আমরা আমাদের একটা রাষ্ট্রের মালিক হতে নির্যাতন ভোগ করেছি। আমরা আমাদের ভাগ্য নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টির জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। নিজ দেশে পরাধীন জীবন থেকে মুক্তি চেয়েছি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সুশাসন ভিত্তিক সমাজ ও নিজ সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশকে বাধাহীনভাবে অর্জনের জন্য, প্রাপ্তির জন্য আমাদের উদগ্র বাসনার একাগ্রতাই বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। আজ বাঙালি স্বাধীন। ব্রিটিশরা নেই, পাকিস্তানিরা নেই, জমিদাররা নেই। তাও দেশের প্রধান কবিকে আফসোস করতে দেখা যায় বর্ণিত কবিতায়। কারণ সার্বিক বিচারে স্বাধীনতার সুফল হিসেবে আমাদের একমাত্র অর্জন স্বজাতির শাসন।

সামনে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করবো। কিন্তু সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো এখনো সোনার হরিণের মতো অধরাই থেকে গেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী প্রতিটা জাতীয় বাজেটে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনকে গুরুত্ব প্রদান করা হলেও পরিস্থিতির অবনতি ছাড়া উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়নি। জনসংখ্যা বেড়েছে, বাজেটের আকার বেড়েছে, যেসব খাতের ব্যয় বরাদ্দ বাড়লে জনগণের মুক্তিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতো তার প্রতিটা খাতে শতাংশের হারে ব্যয় বৃদ্ধি তো ঘটেইনি বরং দিনে দিনে শতাংশ হারে কমে গিয়েছে। ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে জীবন সংগ্রামে পরাজিতবোধের লক্ষণ ফুটে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের মনে আপোষকামিতা সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করে সকলকে যে দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ একটা দেশের জন্য, সমতাভিত্তিক সমাজের জন্য, উদার গণতন্ত্রের জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য- আন্দোলন সংগ্রামে তারা আজ বিমুখ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে রেখে ধর্মনিরপেক্ষতা ধরে রাখা, আয় বৈষম্যের শিকার হয়ে বিপর্যয়ের মধ্যে থেকেও সাম্যের কথা না বলা, আন্দোলন-সংগ্রাম বলতে মানববন্ধন সংস্কৃতি, মুক্তি বলতে এনজিও কর্মকা- আর সামর্থ অনুয়ায়ী বিদেশ যাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ মানুষের জীবন সংগ্রাম।

বাংলাদেশে গত প্রায় ৫০ বছরে আর্থিক ক্ষেত্রে অগগ্রতি চলমান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত, সাহায্যনির্ভর, ঋণ নির্ভর স্বাধীন দেশটি আর্থিক উপার্জনের কৌশল বাড়িয়ে আজ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশ জাতীয় আয়ের প্রধান উৎসকে কৃষি থেকে তৈরি পোশাক আর জনশক্তিতে রূপান্তর ঘটিয়ে ব্যাপক উন্নয়নের দ্বার খুলেছে। ১৯৭১ সালের মাথাপিছু আয় ৬৭১ টাকা আজ বেড়ে দাড়িয়েছে দেড় লাখ টাকার উপরে। ১৯৭১ সালের দেশের বার্ষিক রপ্তানিকেও বাড়িয়ে আকাশ ছোঁয়া করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা ও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এত অগ্রগতির মধ্যে আর্থিক বৈষম্য প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কল্যাণে আমদানি নীতি উদার হয়েছে, ফলশ্রুতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পাশাপাশি বৃহৎ শিল্পও হুমকির মুখে পড়েছে। ঋণখেলাপির সংস্কৃতির সঙ্গে অবাধ সম্পদ ও কালো টাকা অর্জনের প্রতিযোগিতায় নৈরাজ্য বেড়েছে। সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে এবং গার্মেন্টস শিল্প নির্ভর কর্মসংস্থানের মধ্যেই জীবন সংগ্রামে নিবেদিত। এর সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে ৫০০ টাকার সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। অবস্থা উত্তরণে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে গ্রামীণ অর্থনীতিকে রক্ষা, নারী পুরুষের মজুরি বৈষম্য নিরসন করা, আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে রফতানি বাড়ানো, দেশজ শিল্পকে সমৃদ্ধ করা, কৃষির আধুনিকায়ন ও বিজ্ঞান নির্ভর সংস্কার করা, সম্পদের অসম বন্টন রোধ করা, ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে জালিয়াতি বন্ধ করা, বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রসার ঘটিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা, মানবসম্পদ পরিকল্পনা করে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা, পরিবেশ দূষণ রোধের উদ্যোগ নেয়া জরুরি; যা অর্থনীতির প্রবাহকে গতিশীল এবং কর্মমুখী মানুষের ¯স্রোতকে বেগবান করবে।

স্বাধীনতার পাঁচ দশকে শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় অর্জন শিক্ষানীতি। জনগণের দীর্ঘদিনের চাহিদা জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০। দেশে প্রাথমিক শিক্ষার হার বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, স্বাক্ষরতার হার বেড়েছে, নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হয়েছে, ঝরে পড়ার হার কমেছে, সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে প্রকৌশল, কৃষি, মেডিকেল, বস্ত্র, চামড়া ইত্যাদি শিক্ষার ক্ষেত্রে। শিক্ষা সম্পর্কিত অঙ্গীকার পূরণে সরকার বদ্ধপরিকর। শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন বই সরবরাহসহ আশু সমস্যার আশু সমাধান হিসেবে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে। কিন্তু এত কর্মযজ্ঞ চলমান থাকার পরও মানসম্মত শিক্ষার চাহিদা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা সর্বত্র আজ একই অবস্থা। জাতীয় শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারিত আছে ‘জাতীয় জীবনের সর্বত্র নেতৃত্বদানের উপযোগী, বিজ্ঞান মনষ্ক, প্রগতিশীল, মানবমুখী, দূরদর্শী, অসাম্প্রদায়িক ও উদারনৈতিক সুনাগরিক সৃষ্টিই হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বমানের শিক্ষার লক্ষ্য।’ অথচ আজ আমাদের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চশিক্ষার মানক্রমে বিশ্বে খুঁজতে ম্যাগনিফায়িং গ্লাসের প্রয়োজন পড়ছে। আর নিয়মিত হানাহানি মারামারিতে সহপাঠীকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে কোনো দ্বিধা জাগছে না শিক্ষার্থীদেও মনে।

ছাত্র ও শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তিধারী সংগঠন করা ফলে দ্বন্দ-সংঘাত ব্যাপকতর হয়ে পড়ছে। এতে শিক্ষায় সেশনজট সৃষ্টি করছে, শিক্ষা আর সংস্কৃতি বোধকে জাগ্রত করছে না, ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত করে তুলছে না, দেশপ্রেমকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাচ্ছে না। জাতীয় জীবনে শিক্ষার সুফল দ্রুত পৌছে দিতে শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন করা, বৈশ্বিকভাবে বর্তমানের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো, মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, সংবিধান অনুযায়ী বহুধারার সব শিক্ষা ব্যবস্থাকে দেশপ্রেমমূলক বাঙালি জাতীয়তাবোধ সম্পন্ন একই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন, যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ, জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে কর্মদক্ষতা অর্জন ও সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ করার মতো ক্ষমতা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

সরকার দাবি করে উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতু, প্রশস্তকরণসহ মহাসড়ক সংস্কার, মেট্রোরেল, ট্যানেল, উড়াল সেতু, ওভার ব্রিজ, ফ্লাইওভার, অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবন, রেল উন্নয়ন, নৌপথ উদ্ধার, নতুন রাস্তা নির্মাণ ও পুরনো রাস্তা সংস্কার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মানুষের নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবনের ভারসাম্য আনতে উদ্যোগী সরকার। শিক্ষানীতি, নারী উন্নয়ন নীতি, তথ্য অধিকার আইন, সড়ক নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতি, শিল্প নীতি, বাণিজ্য নীতি ইত্যাদি জনগণের সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় গাইড লাইন হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিদিনকার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারছে বর্তমান উন্নয়নের ধারা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্যর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিতি, দুর্নীতি আর নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রতিযোগিতার কারণে। স্বাধীনতা বিরোধীদের দেশে অস্থিতি পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টার পাশাপাশি সরকারি দলের কর্মীরা ব্যক্তিগত আধিপত্য বিস্তারে সারাদেশে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সরকারি উন্নয়নের ওয়াচডগ না হয়ে তারা সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়িছে। পর্দা-বালিশ-চেয়ার কেলেংকারি চলমান, উন্নয়ন প্রকল্প প্রাক্কলিক ব্যয় ও সময়ে শেষ হচ্ছে না, ব্যাংক জালিয়াতি ও শেয়ার ধস ঘটছে, সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ নষ্ট করছে, আলু চাষ -পুকুর কাটা-গ্রাম উন্নয়ন প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ ভ্রমণ চলছে, কমিশন বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। সরকার এসব ব্যাপারে সতর্ক হলে, যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন হবে এবং দেশ আরও এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলের ভালো অঙ্গীকারগুলো সরল বিশ্বাসে গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না। যদিও সহজে কোনোকিছু পাওয়া যায় না, কষ্ট করে অর্জন করতে হয়। কিন্তু আমাদের আকাক্সক্ষায় কষ্টসহিষ্ণুতার প্রবণতা কম। একশ্রেণীর মানুষ ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় নীতি-নৈতিকতাকে পাশে রেখে ছুটে চলেছে। আর একশ্রেণীর মানুষ জীবনসংগ্রামে পরাজিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে নগরমুখী হচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্য দেয়া উন্নয়ন ধারার কারণে আয়বৈষম্য বেড়ে চলেছে। বেকারত্ব আর দারিদ্র্যে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ হারিয়ে ফেলেছে। মানবসভ্যতার কৃষিযুগ থেকে শিল্পযুগ হয়ে এখন ডিজিটাল যুগ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অগ্রসরমান বিশ্বের যুগোপযোগী কর্মসূচি ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটা নতুন অর্থনীতি, একটা নতুন জীবনধারা সৃষ্টির অঙ্গীকার বাস্তবায়নে নিবেদিত। সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র সরকারি প্রচেষ্টার দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত প্রয়াস প্রত্যাশা করে।

[লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)]

khairulumam1950@gmail.com