জনগণের অর্থে বিলাস ভ্রমণ বন্ধ করুন

প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন করতে ৪০টি দেশে যেতে চান নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। ওই সব দেশে যাতায়াতের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতিটি দেশে যাতায়াতের জন্য খরচ ধরা হয়েছে আড়াই কোটি টাকা করে। প্রবাসী ভোটার নিবন্ধনের জন্যই শুধু বিদেশ নয়, শিক্ষা সফরে ইউরোপ ও আমেরিকায় যেতে চান নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। ৫৫ জন কর্মকর্তার এমন সফরের জন্য আলাদা করে পাঁচ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ব্যয়ে খরচ চাওয়া হয়েছে আরো দুই কোটি টাকা। একটি প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণের জন্য এমন টাকা চেয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা।

প্রবাসী ভোটার নিবন্ধনের জন্য ৪০ দেশে যাওয়ার যৌক্তিকতা কি সেটা একটা বড় প্রশ্ন। প্রতিটি দেশে যাতায়াতের জন্য কেন সমান আড়াই কোটি টাকা করে বরাদ্দ রাখা হলো- সে প্রশ্নের উত্তরও মেলেনি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসে এখন এক কোটি বাংলাদেশি আছেন। এই এক কোটি জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশ বাংলাদেশিই সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের ১১টি দেশে অবস্থান করছেন। বাকি ৫ শতাংশ বাংলাদেশির অবস্থান অন্যান্য দেশে। এমন অনেক দেশ আছে, যেসব দেশে এক থেকে দুই হাজার কোথাও সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার বাংলাদেশি পাওয়া যাবে। ওই সব দেশে কেন যেতে হবে। যেসব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা এক থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে, সেসব প্রবাসীকে ভোটার নিবন্ধন করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে করা যেতে পারে। অথচ সেখানেও আড়াই কোটি টাকা খরচ করে যেতে চাইছেন ইসি কর্মকর্তারা।

অবশ্য সরকারি কর্মকর্তাদের অহেতুক বিদেশ সফরের কারণে জনগণের অর্থের অপচয়ের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। শিউরে ওঠার মতো তথ্য হলো- আলু চাষ, লিফট ক্রয়, নিরাপদ পানি এবং পুকুর খননের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যও বিদেশ ভ্রমণ করার নজির আছে এ দেশের সরকারি কর্তাদের। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, নাসার একটি মহাকাশ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্যদের (বিজয়ী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র) বাদ দিয়ে এবং ভিসার ব্যবস্থা না করে সেখানে চলে গেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এমনকি কারো কারো মধ্যে বিদেশ সফর এক ধরনের নেশায় পরিণত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বিদেশ থেকে ঘুরে আসার আগেই আরেকটি সফর কর্মসূচি তৈরি করে রেখেছেন। কোনো কোনো কর্মকর্তার বছরে ১২ বারেরও অধিক বিদেশ সফরের রেকর্ড রয়েছে। এসব সফরে তার যাওয়া উচিত কি উচিত না, নীতিমালায় পড়ে কিনা- কিছুই বিবেচনা করছেন না। যেসব সফরে সিনিয়র কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে এবং অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তাদের দিতে বলা হয়েছে সেগুলোতেও অহরহ সিনিয়র কর্মকর্তা অর্থাৎ সচিবরা যাচ্ছেন। কোনো বাছ-বিচার নেই। অর্থাৎ ‘সরকার কা মাল দরিয়া মে ঢাল’- এটাই যেন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর এভাবেই জনগণের ট্যাক্সের টাকা জলাঞ্জলি দেয়া হচ্ছে।

যে কোনো প্রকল্পে অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ ভ্রমণ এবং এ খাতে মোটা অঙ্ক বরাদ্দ রাখার প্রবণতা রোধেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এজন্য আগে বিদেশ ভ্রমণের উপকারিতা কী, প্রকৃত প্রয়োজনীয় ব্যক্তিরা বিদেশ ভ্রমণে গেছেন কিনা এবং এ খাতে খরচের বিষয়গুলো অডিট করে দেখা প্রয়োজন। এর মানে এই নয় যে, সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশ সফরে যাবেন না। অত্যাবশ্যকীয় কাজে, প্রশিক্ষণের জন্য, বিশেষ কোনো বিষয়ে কারিগরি বা ব্যবস্থাপনার জ্ঞান আহরণে অথবা কোনো কিছু ক্রয়ের উদ্দেশ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর করার বিষয়টি যৌক্তিক। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের বিদেশ সফর হয়ে থাকে অপ্রয়োজনে অথবা অযৌক্তিক কারণে। আবার অনেক সময় সফরে যাওয়া কর্মকর্তার সংখ্যা অত্যধিক হয়। প্রয়োজনের তুলনায় টাকার অঙ্কও অনেক বেশি দেখানো হয়। এসব ঘটনাই জন্ম দেয় প্রশ্নের। তাই আমরা আশা করব, সরকারি অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে অহেতুক বিদেশ ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হবে।

ভোটার নিবন্ধনের কাজে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ায় যে টাকা খরচ হবে, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় সমপরিমাণ টাকা খরচ হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ প্রবাসী ভোটার নিবন্ধনের জন্য সরকারি টাকা খরচ করে কেন এত দেশে যেতে হবে- সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার। জানা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় যানবাহন কেনার অস্বাভাবিক প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এর আগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নাগরিকদের স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার জন্য নেয়া একটি প্রকল্পের আওতায় অনেক যানবাহন কিনেছে। নতুন করে আরো ৩২টি যানবাহন কি কারণে কিনতে হবে- সেটাও তদন্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে কারও অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে এবং সেটা প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া বাঞ্ছনীয়।

রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২০ , ১২ মাঘ ১৪২৬, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের বিলাসিতা

জনগণের অর্থে বিলাস ভ্রমণ বন্ধ করুন

প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন করতে ৪০টি দেশে যেতে চান নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। ওই সব দেশে যাতায়াতের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতিটি দেশে যাতায়াতের জন্য খরচ ধরা হয়েছে আড়াই কোটি টাকা করে। প্রবাসী ভোটার নিবন্ধনের জন্যই শুধু বিদেশ নয়, শিক্ষা সফরে ইউরোপ ও আমেরিকায় যেতে চান নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। ৫৫ জন কর্মকর্তার এমন সফরের জন্য আলাদা করে পাঁচ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ব্যয়ে খরচ চাওয়া হয়েছে আরো দুই কোটি টাকা। একটি প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণের জন্য এমন টাকা চেয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা।

প্রবাসী ভোটার নিবন্ধনের জন্য ৪০ দেশে যাওয়ার যৌক্তিকতা কি সেটা একটা বড় প্রশ্ন। প্রতিটি দেশে যাতায়াতের জন্য কেন সমান আড়াই কোটি টাকা করে বরাদ্দ রাখা হলো- সে প্রশ্নের উত্তরও মেলেনি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসে এখন এক কোটি বাংলাদেশি আছেন। এই এক কোটি জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশ বাংলাদেশিই সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের ১১টি দেশে অবস্থান করছেন। বাকি ৫ শতাংশ বাংলাদেশির অবস্থান অন্যান্য দেশে। এমন অনেক দেশ আছে, যেসব দেশে এক থেকে দুই হাজার কোথাও সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার বাংলাদেশি পাওয়া যাবে। ওই সব দেশে কেন যেতে হবে। যেসব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা এক থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে, সেসব প্রবাসীকে ভোটার নিবন্ধন করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে করা যেতে পারে। অথচ সেখানেও আড়াই কোটি টাকা খরচ করে যেতে চাইছেন ইসি কর্মকর্তারা।

অবশ্য সরকারি কর্মকর্তাদের অহেতুক বিদেশ সফরের কারণে জনগণের অর্থের অপচয়ের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। শিউরে ওঠার মতো তথ্য হলো- আলু চাষ, লিফট ক্রয়, নিরাপদ পানি এবং পুকুর খননের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যও বিদেশ ভ্রমণ করার নজির আছে এ দেশের সরকারি কর্তাদের। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, নাসার একটি মহাকাশ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্যদের (বিজয়ী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র) বাদ দিয়ে এবং ভিসার ব্যবস্থা না করে সেখানে চলে গেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এমনকি কারো কারো মধ্যে বিদেশ সফর এক ধরনের নেশায় পরিণত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বিদেশ থেকে ঘুরে আসার আগেই আরেকটি সফর কর্মসূচি তৈরি করে রেখেছেন। কোনো কোনো কর্মকর্তার বছরে ১২ বারেরও অধিক বিদেশ সফরের রেকর্ড রয়েছে। এসব সফরে তার যাওয়া উচিত কি উচিত না, নীতিমালায় পড়ে কিনা- কিছুই বিবেচনা করছেন না। যেসব সফরে সিনিয়র কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে এবং অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তাদের দিতে বলা হয়েছে সেগুলোতেও অহরহ সিনিয়র কর্মকর্তা অর্থাৎ সচিবরা যাচ্ছেন। কোনো বাছ-বিচার নেই। অর্থাৎ ‘সরকার কা মাল দরিয়া মে ঢাল’- এটাই যেন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর এভাবেই জনগণের ট্যাক্সের টাকা জলাঞ্জলি দেয়া হচ্ছে।

যে কোনো প্রকল্পে অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ ভ্রমণ এবং এ খাতে মোটা অঙ্ক বরাদ্দ রাখার প্রবণতা রোধেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এজন্য আগে বিদেশ ভ্রমণের উপকারিতা কী, প্রকৃত প্রয়োজনীয় ব্যক্তিরা বিদেশ ভ্রমণে গেছেন কিনা এবং এ খাতে খরচের বিষয়গুলো অডিট করে দেখা প্রয়োজন। এর মানে এই নয় যে, সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশ সফরে যাবেন না। অত্যাবশ্যকীয় কাজে, প্রশিক্ষণের জন্য, বিশেষ কোনো বিষয়ে কারিগরি বা ব্যবস্থাপনার জ্ঞান আহরণে অথবা কোনো কিছু ক্রয়ের উদ্দেশ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর করার বিষয়টি যৌক্তিক। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের বিদেশ সফর হয়ে থাকে অপ্রয়োজনে অথবা অযৌক্তিক কারণে। আবার অনেক সময় সফরে যাওয়া কর্মকর্তার সংখ্যা অত্যধিক হয়। প্রয়োজনের তুলনায় টাকার অঙ্কও অনেক বেশি দেখানো হয়। এসব ঘটনাই জন্ম দেয় প্রশ্নের। তাই আমরা আশা করব, সরকারি অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে অহেতুক বিদেশ ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হবে।

ভোটার নিবন্ধনের কাজে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ায় যে টাকা খরচ হবে, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় সমপরিমাণ টাকা খরচ হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ প্রবাসী ভোটার নিবন্ধনের জন্য সরকারি টাকা খরচ করে কেন এত দেশে যেতে হবে- সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার। জানা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় যানবাহন কেনার অস্বাভাবিক প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এর আগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নাগরিকদের স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার জন্য নেয়া একটি প্রকল্পের আওতায় অনেক যানবাহন কিনেছে। নতুন করে আরো ৩২টি যানবাহন কি কারণে কিনতে হবে- সেটাও তদন্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে কারও অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে এবং সেটা প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া বাঞ্ছনীয়।