বই উৎসব : নতুন উদ্দীপনা নতুন উচ্ছ্বাস

শরীফুল্লাহ মুক্তি

নতুন বছর। প্রথম দিন। বই উৎসব। বিষয়গুলো যেন এখন একই সুতোয় গাঁথা। সকলেই আনন্দে একাকার। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ ছড়িয়ে সারা দেশে বছরের প্রথম দিনে একযোগে পালিত হলো বই উৎসব। বছরের শুভ সূচনালগ্নে শিশুর কাছে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ যেন এক সুখবার্তা বয়ে নিয়ে আসে। আনন্দমুখর এ বই উৎসবে অংশ নেয়ার জন্য ছোট্ট ছোট্ট কোমলমতি শিশুরা কেউ নিজে নিজে, কেউ সহপাঠীদের সাথে, কেউ বন্ধুদের সাথে, কেউ-বা বাবা-মায়ের আঙুল ধরে ছুটে আসে স্কুলে। নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বই পেয়ে বাঁধভাঙা আনন্দে উচ্ছ্বসিত তারা। কোমলমতি শিশুদের চোখেমুখে নতুন সুর- নতুন ভাবনা। ‘বছরের প্রথম দিনে, বই হাতে পাই খুশি মনে’/‘নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে ফুলের মতো ফুটব, বর্ণমালার গরব নিয়ে আকাশ জুড়ে উঠব’/‘মনোযোগ দিয়ে পড়বো, সোনার বাংলা গড়বো’- ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকে শিক্ষার্থীরা। কারো হাতে রঙিন ফিতা, কারও এক হাতে বেলুন, অন্য হাতে বই। সবার মুখে যেন আনন্দের ছাপ। এ এক নতুন উদ্দীপনা- নতুন উচ্ছ্বাস। সব কিছুই যেন বই উৎসবকে ঘিরে। বছরের প্রথম দিনে নতুন বই হাতে পেয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা ছিল সারাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী। এই উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের রাজধানী, নগর, শহর, বন্দর, গ্রাম, নিভৃত পল্লী, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা, বস্তি, চর, হাওর, বাঁওড়সহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নতুন বই পেয়ে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে নিজ নিজ ঘরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফিরছে আগামী দিনের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কারিগররা।

গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কর্মসূচি-২০২০ উদ্বোধন করেন। তাছাড়া বছরের প্রথম দিনে পৃথকভাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সাভারের অধরচন্দ্র সবকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক স্তরের এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক উৎসবের শুভ উদ্বোধন করেন। দেশব্যাপী ২০২০ শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, ইবতেদায়ী, মাধ্যমিক, দাখিল, এসএসসি-ভোকেশনাল, দাখিল-ভোকেশনাল, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (স্মল এনথ্রোপলোজিকেল গ্রুপ) এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ (ভিজুয়ালিটি চ্যালেঞ্জ) ৪ কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ১৯৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৭টি নতুন পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়।

সারা দেশের শিক্ষার্থীরা যেন বছরের প্রথমদিনেই বই হাতে পায় এবং প্রতিটি স্কুলে যেন বই সময়মতো পৌঁছে সেই জন্য গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর মাসেই কেন্দ্রীয়ভাবে সকল উপজেলা পর্যায়ে বই বিতরণ নিশ্চিত করা হয়েছে। আমার কর্মস্থল নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলায় বছরের প্রথম দিনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল শিশু যেন বই হাতে পায় সেজন্য ২০-২৪ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখের মধ্যে বিদ্যালয় পর্যায়ে বই বিতরণ সম্পন্ন করা হয়েছিল। বই উৎসবকে ঘিরে বছরের প্রথম দিনে বর্ণিল সাজে সাজানো হয় বারহাট্টা উপজেলার প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমার কয়েকটি স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। প্রথমে গিয়েছিলাম বারহাট্টা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোমলমতি শিশুদের সাথে উৎসবে যোগ দিতে। সেখানেও শিক্ষার্থীরা নেচে-গেয়ে, আনন্দ-উল্লাস করে, লাল-সবুজ প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন নেড়ে ও বেলুন উড়িয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে বই উৎসব পালন করে। বই উৎসবে উপস্থিত ছিলেন বারহাট্টা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাইনুল হক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার গোলাম মোরশেদ। পরে গিয়েছিলাম বারহাট্টা উপজেলার বরুহাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. রিফাত শেখ চতুর্থ শ্রেণির গণ্ডি পেরিয়ে এ বছর পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে। সেও সকলের মতো বছরের প্রথম দিনে বিদ্যালয়ে এসেছিল নতুন বই নেয়ার জন্য। ছেলের এ আনন্দে ভাগ বসাতে স্কুলে এসেছেন তার মা। মা মাজেদা আক্তার জানান, ‘বছরের প্রথম দিনের বই যেমন উৎসব-আমেজ তৈরি করেছে তেমনি ছেলেমেয়েদের মনে সারা বছর এ উৎসব লেগে থাকে এবং ছেলেমেয়েরা বছরের শুরু থেকেই নতুন উদ্যমে পড়ালেখা শুরু করতে পারে।’ আরেক শিক্ষার্থী ফারজানা আক্তার নিপুন- এ বছর সে চতুর্থ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। সে এসেছে তার বাবাকে নিয়ে বই উৎসবে শামিল হওয়ার জন্য। তার বাবা মো. বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমাদের সময় বছরের শুরুতে বিনামূল্যে বই দেয়া হতো না। অনেক কষ্ট করে বই সংগ্রহ করতে হতো। এ রকম বই-উৎসবের তো প্রশ্নই আসে না। তাই বই উৎসবের মাতোয়ারা হতে আমি নিজে চলে এসেছি।’ বরুহাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমা সিদ্দিকা আবেগের সাথে জানান, ‘নতুন বই পেয়ে কোমলমতি শিশুরা খুবই খুশি। এ উৎসব শিশু-শিক্ষার্থীদের মনে উৎসাহ ও প্রেরণা জোগাবে। শিক্ষার্থীরা বছরের শুরু থেকেই পড়াশুনায় মনোযোগী হবে।’ রিফাত-ফারজানার চোখেমুখেও আনন্দের ছাপ। প্রতিবছর বিনামূল্যে বই পায় তারা। কিন্তু এবার এ উৎসবে বাবা-মাকে পেয়ে তাদের আনন্দের মাত্রা একটু বেশি। নতুন বই পেয়ে খুব খুশি এমন কথা জানিয়ে ফারজানা বলে, ‘নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বই পেয়েছি। অনেক আনন্দ লাগছে।’

বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ বর্তমান সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন বছরের প্রথম দিনে নতুন বই হাতে পাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারতাম না। পকেটের টাকা খরচ করেও না। সেই সময় আমরা মার্চ বা এপ্রিল মাসের আগে কোনোভাবেই পাঠ্যবই কিনতে পারতাম না। আমরা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও এলাকার বড় ভাই-বোনদের নিকট থেকে পুরাতন ও ছেঁড়া বই অর্ধমূল্যে বা স্বল্পমূল্যে কিনতাম। শুধু তাই নয়, পুরাতন বই পাওয়ার জন্য বা কেনার জন্য বার্ষিক পরীক্ষার পূর্বেই যোগাযোগ করতে হতো। কিন্তু পুরাতন বই হাতে পেলেও মন ভরতো না- নতুন বইয়ের জন্য মন হাহাকার করতো। আসলে বছরের শুরুতে নতুন ক্লাসে নতুন বই না হলে হৃদয় ভরে না- মন পুলকিত হয় না। তাছাড়া সে সময় বছরের তিন-চার মাস চলে যাওয়ার পরেও অসৎ বই ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হয়রানির মুখে ঠেলে দিত। কোনো কোনো ব্যবসায়ী পাঠ্যবইয়ের সাথে নোটবই কিনতেও বাধ্য করতেন। বর্তমানে পহেলা জানুয়ারিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করায় সে অবস্থার অবসান ঘটেছে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যবই প্রদান সমাজের পিছিয়ে পড়া ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখছে। তাছাড়া বর্তমানে সরকার শিক্ষার জন্য বিনিয়োগকে সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ মনে করছে। সরকার শিক্ষাকে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে মনে করছে। এটি যে দারিদ্র্যমুক্তির ফলপ্রসূ অস্ত্র তা প্রমাণিত হয়েছে শিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে দারিদ্র্যমুক্তির ক্ষেত্রে গতি আসায়। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণসহ শিক্ষাখাতে বাজেটের এক উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ যে জাতির জন্য সত্যিকার অর্থেই লাভজনক তা বাস্তবতার নিরিখে প্রমাণিত হয়েছে। সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার জন্য বিনামূল্যে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই বিতরণ ও নারীদের অবৈতনিক শিক্ষার যে পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে তা বিশ্বসমাজেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। শিক্ষিত জাতি গঠন করতে হলে শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতেই হবে, পাশাপাশি শিক্ষায় আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

নতুন বই শিশুদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। এ সুযোগে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মাঝেও পড়াশুনার বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে- শিক্ষার্থীদের শুধু বিনামূল্যে বই বিতরণই সুষ্ঠু শিক্ষার একমাত্র নিয়ামক নয়। শিশুদের জন্য বহনযোগ্য বই, সহজ বোধযোগ্য সিলেবাস, শিক্ষাদান পদ্ধতি, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন পদ্ধতি, কোমলমতি শিশুদের মূল্যায়ন কৌশল, সময়ে সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ফলাফল নিয়ে নানা বিতর্ক যেন আমাদের পিছু ছাড়ছে না। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের সিলেবাসে অতিরিক্ত বই সংযোজনের কারণে শিশুকে ভারি ব্যাগের বোঝা বহন করতে হচ্ছে। এছাড়া আছে গাইড বইয়ের লাগামহীন ছড়াছড়ি। শিশু শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট লেখক বা প্রকাশনার গাইড বই কিনতে বাধ্য করার মতো অভিযোগও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এমনকি অর্থের বিনিময়ে তথাকথিত কিছু শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট লেখক ও প্রকাশকের বই শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেন মর্মেও অভিযোগ রয়েছে। অথচ কোনো শিক্ষক যদি ক্লাসে শিশুকে পাঠ্যবই অনুযায়ী নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুটি আন্তরিকভাবে বোঝাতে চান এবং বোঝাতে সক্ষম হন, তাহলে একজন সাধারণ মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর জন্য কোনো সহায়ক/গাইড বইয়ের প্রয়োজন পড়ার কথা নয়। এখনও অনেক শিক্ষককে শ্রম লাঘবের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সক্রিয় থেকে ক্লাসে না পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই পড়তে দিয়ে নিশ্চিন্তে শ্রেণিকক্ষে বসে থাকতে দেখা যায়। এছাড়াও আছে শিক্ষক কর্তৃক শিশুশিক্ষার্থীকে প্রাইভেট-কোচিংয়ে বাধ্য করার মতো অভিযোগ। একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থায় এটি কোনোমতেই কাম্য নয়। তাছাড়া প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় এত বেশি বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি ও বিষয়বস্তুর গভীরতা নিয়েও অনেকের মধ্যে মতভেদ আছে। একটি প্রাথমিক স্তরের শিশুর বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, বাংলদেশ ও বিশ্বপরিচয়, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা সম্বন্ধে কতটুকু জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন তা পুনঃবিবেচনার অবকাশ আছে বলে অনেকে মনে করেন।

শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় আমরা কতটা সফল তা সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়। বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত দৈন্য, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক না থাকা, শিক্ষকের প্রয়োজনীয় বিষয়জ্ঞানের অভাব, শিক্ষকের সময়মতো ও নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত না হওয়া, আনন্দঘন পরিবেশ নিশ্চিত না করা, শিক্ষকের ইতিবাচক মনোভাবের অভাবের মতো অনেক বিষয় আমাদের মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার অন্তরায় হয়ে আছে। বর্তমানে প্রতিটি শিশুর হাতে শিক্ষাবছরের প্রথম দিনেই নতুন পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়া হয়- নিঃসন্দেহে এটি একটি মাইলফলক। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের মান, তথ্য-বিভ্রান্তি, সংযোজন, বিয়োজন, মুদ্রণক্রটি- এ ধরনের বিশেষ কিছু বিষয় প্রতি বছরই জনমনে নানা সংশয় সৃষ্টি করে। প্রতি বছর নতুন বই এলেই তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই এসব জায়গায় যোগ্য ও দক্ষ লোকদের নিয়োগ বা পদায়ন করতে হবে। শিশুর বয়স, মেধা ও দৈহিক সামর্থ্য অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা, গুণগতমান ও বিষয়বস্তুর পরিধি নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজানো যেতে পারে। শিক্ষাক্রম যেন সত্যিকারেই সৃজনশীল ও সুখপাঠ্য হয়। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম সৃষ্টির পাশাপাশি উগ্রবাদ ও নৈতিক-মানবিক অবক্ষয়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মতো নতুন নতুন বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে শিক্ষাক্রমকে নতুন করে সাজানো প্রয়োজন।

বর্তমানে অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও বাংলাদেশ সরকারের বিনামূল্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পাঠ্যবই বিতরণ কার্যক্রম নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। সরকার প্রতি বছর উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনই দেশের প্রতিটি স্কুলে সকল শিশুর হাতে শতভাগ নতুন পাঠ্যবই তুলে দেয়া বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণকে অনেকাংশে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। অনেক আগে থেকেই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের স্বল্প পরিসরে বিনামূল্যে বই দেয়া হলেও সরকার ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ শুরু করে। পাশাপাশি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বেতন ফ্রি করে দেয়া এবং শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির আওতায় নিয়ে আসা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে ও ঝরে পড়া রোধে কাজ করছে। এ সুযোগ থেকে বাদ যাচ্ছে না দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিও। এসব অনুপ্রেরণামূলক কার্যক্রম শিশুদের ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্যেরও সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারের সন্তানদের মাঝেও পড়ালেখার প্রতি বিপুল আগ্রহ ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ এবং প্রণোদনা দিয়ে উপস্থিতি বৃদ্ধি করা সুষ্ঠু শিক্ষাদানের মূল নিয়ামক নয়। মানসম্মত ও একীভূত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নতুবা সরকারের এ অর্জন দীর্ঘমেয়াদি সুফল বিস্তারে তেমন কোনো কাজে আসবে না।

বছরের শুরুতে নতুন বইয়ের উৎসবে শিশুরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়; প্রাণচাঞ্চল্যেও মুখরিত হয়। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও শিক্ষার গুণগত মানে পরিবর্তন আনা না গেলে বই উৎসবের আয়োজন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হবে। তাই আমাদের মানসম্মত বিদ্যালয় তৈরির মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। আর এজন্য সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনের সামগ্রিক পরিবেশে এমন আবহ তৈরি করতে হবে যেন নতুন বই হাতে পেয়ে প্রতিটি শিশু পাঠ-প্রবৃত্তির উদ্দীপনায় মনে মনে উচ্চারণ করে- ‘বইয়ের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতো পড়ি বই।’

[লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষা-গবেষক ও ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি),বারহাট্টা, নেত্রকোনা]

ahmsharifullah@yahoo.com

রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২০ , ১২ মাঘ ১৪২৬, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

বই উৎসব : নতুন উদ্দীপনা নতুন উচ্ছ্বাস

শরীফুল্লাহ মুক্তি

নতুন বছর। প্রথম দিন। বই উৎসব। বিষয়গুলো যেন এখন একই সুতোয় গাঁথা। সকলেই আনন্দে একাকার। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ ছড়িয়ে সারা দেশে বছরের প্রথম দিনে একযোগে পালিত হলো বই উৎসব। বছরের শুভ সূচনালগ্নে শিশুর কাছে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ যেন এক সুখবার্তা বয়ে নিয়ে আসে। আনন্দমুখর এ বই উৎসবে অংশ নেয়ার জন্য ছোট্ট ছোট্ট কোমলমতি শিশুরা কেউ নিজে নিজে, কেউ সহপাঠীদের সাথে, কেউ বন্ধুদের সাথে, কেউ-বা বাবা-মায়ের আঙুল ধরে ছুটে আসে স্কুলে। নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বই পেয়ে বাঁধভাঙা আনন্দে উচ্ছ্বসিত তারা। কোমলমতি শিশুদের চোখেমুখে নতুন সুর- নতুন ভাবনা। ‘বছরের প্রথম দিনে, বই হাতে পাই খুশি মনে’/‘নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে ফুলের মতো ফুটব, বর্ণমালার গরব নিয়ে আকাশ জুড়ে উঠব’/‘মনোযোগ দিয়ে পড়বো, সোনার বাংলা গড়বো’- ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকে শিক্ষার্থীরা। কারো হাতে রঙিন ফিতা, কারও এক হাতে বেলুন, অন্য হাতে বই। সবার মুখে যেন আনন্দের ছাপ। এ এক নতুন উদ্দীপনা- নতুন উচ্ছ্বাস। সব কিছুই যেন বই উৎসবকে ঘিরে। বছরের প্রথম দিনে নতুন বই হাতে পেয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা ছিল সারাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী। এই উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের রাজধানী, নগর, শহর, বন্দর, গ্রাম, নিভৃত পল্লী, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা, বস্তি, চর, হাওর, বাঁওড়সহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নতুন বই পেয়ে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে নিজ নিজ ঘরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফিরছে আগামী দিনের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কারিগররা।

গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কর্মসূচি-২০২০ উদ্বোধন করেন। তাছাড়া বছরের প্রথম দিনে পৃথকভাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সাভারের অধরচন্দ্র সবকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক স্তরের এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক উৎসবের শুভ উদ্বোধন করেন। দেশব্যাপী ২০২০ শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, ইবতেদায়ী, মাধ্যমিক, দাখিল, এসএসসি-ভোকেশনাল, দাখিল-ভোকেশনাল, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (স্মল এনথ্রোপলোজিকেল গ্রুপ) এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ (ভিজুয়ালিটি চ্যালেঞ্জ) ৪ কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ১৯৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৭টি নতুন পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়।

সারা দেশের শিক্ষার্থীরা যেন বছরের প্রথমদিনেই বই হাতে পায় এবং প্রতিটি স্কুলে যেন বই সময়মতো পৌঁছে সেই জন্য গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর মাসেই কেন্দ্রীয়ভাবে সকল উপজেলা পর্যায়ে বই বিতরণ নিশ্চিত করা হয়েছে। আমার কর্মস্থল নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলায় বছরের প্রথম দিনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল শিশু যেন বই হাতে পায় সেজন্য ২০-২৪ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখের মধ্যে বিদ্যালয় পর্যায়ে বই বিতরণ সম্পন্ন করা হয়েছিল। বই উৎসবকে ঘিরে বছরের প্রথম দিনে বর্ণিল সাজে সাজানো হয় বারহাট্টা উপজেলার প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমার কয়েকটি স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। প্রথমে গিয়েছিলাম বারহাট্টা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোমলমতি শিশুদের সাথে উৎসবে যোগ দিতে। সেখানেও শিক্ষার্থীরা নেচে-গেয়ে, আনন্দ-উল্লাস করে, লাল-সবুজ প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন নেড়ে ও বেলুন উড়িয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে বই উৎসব পালন করে। বই উৎসবে উপস্থিত ছিলেন বারহাট্টা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাইনুল হক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার গোলাম মোরশেদ। পরে গিয়েছিলাম বারহাট্টা উপজেলার বরুহাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. রিফাত শেখ চতুর্থ শ্রেণির গণ্ডি পেরিয়ে এ বছর পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে। সেও সকলের মতো বছরের প্রথম দিনে বিদ্যালয়ে এসেছিল নতুন বই নেয়ার জন্য। ছেলের এ আনন্দে ভাগ বসাতে স্কুলে এসেছেন তার মা। মা মাজেদা আক্তার জানান, ‘বছরের প্রথম দিনের বই যেমন উৎসব-আমেজ তৈরি করেছে তেমনি ছেলেমেয়েদের মনে সারা বছর এ উৎসব লেগে থাকে এবং ছেলেমেয়েরা বছরের শুরু থেকেই নতুন উদ্যমে পড়ালেখা শুরু করতে পারে।’ আরেক শিক্ষার্থী ফারজানা আক্তার নিপুন- এ বছর সে চতুর্থ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। সে এসেছে তার বাবাকে নিয়ে বই উৎসবে শামিল হওয়ার জন্য। তার বাবা মো. বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমাদের সময় বছরের শুরুতে বিনামূল্যে বই দেয়া হতো না। অনেক কষ্ট করে বই সংগ্রহ করতে হতো। এ রকম বই-উৎসবের তো প্রশ্নই আসে না। তাই বই উৎসবের মাতোয়ারা হতে আমি নিজে চলে এসেছি।’ বরুহাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমা সিদ্দিকা আবেগের সাথে জানান, ‘নতুন বই পেয়ে কোমলমতি শিশুরা খুবই খুশি। এ উৎসব শিশু-শিক্ষার্থীদের মনে উৎসাহ ও প্রেরণা জোগাবে। শিক্ষার্থীরা বছরের শুরু থেকেই পড়াশুনায় মনোযোগী হবে।’ রিফাত-ফারজানার চোখেমুখেও আনন্দের ছাপ। প্রতিবছর বিনামূল্যে বই পায় তারা। কিন্তু এবার এ উৎসবে বাবা-মাকে পেয়ে তাদের আনন্দের মাত্রা একটু বেশি। নতুন বই পেয়ে খুব খুশি এমন কথা জানিয়ে ফারজানা বলে, ‘নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বই পেয়েছি। অনেক আনন্দ লাগছে।’

বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ বর্তমান সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন বছরের প্রথম দিনে নতুন বই হাতে পাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারতাম না। পকেটের টাকা খরচ করেও না। সেই সময় আমরা মার্চ বা এপ্রিল মাসের আগে কোনোভাবেই পাঠ্যবই কিনতে পারতাম না। আমরা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও এলাকার বড় ভাই-বোনদের নিকট থেকে পুরাতন ও ছেঁড়া বই অর্ধমূল্যে বা স্বল্পমূল্যে কিনতাম। শুধু তাই নয়, পুরাতন বই পাওয়ার জন্য বা কেনার জন্য বার্ষিক পরীক্ষার পূর্বেই যোগাযোগ করতে হতো। কিন্তু পুরাতন বই হাতে পেলেও মন ভরতো না- নতুন বইয়ের জন্য মন হাহাকার করতো। আসলে বছরের শুরুতে নতুন ক্লাসে নতুন বই না হলে হৃদয় ভরে না- মন পুলকিত হয় না। তাছাড়া সে সময় বছরের তিন-চার মাস চলে যাওয়ার পরেও অসৎ বই ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হয়রানির মুখে ঠেলে দিত। কোনো কোনো ব্যবসায়ী পাঠ্যবইয়ের সাথে নোটবই কিনতেও বাধ্য করতেন। বর্তমানে পহেলা জানুয়ারিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করায় সে অবস্থার অবসান ঘটেছে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যবই প্রদান সমাজের পিছিয়ে পড়া ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখছে। তাছাড়া বর্তমানে সরকার শিক্ষার জন্য বিনিয়োগকে সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ মনে করছে। সরকার শিক্ষাকে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে মনে করছে। এটি যে দারিদ্র্যমুক্তির ফলপ্রসূ অস্ত্র তা প্রমাণিত হয়েছে শিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে দারিদ্র্যমুক্তির ক্ষেত্রে গতি আসায়। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণসহ শিক্ষাখাতে বাজেটের এক উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ যে জাতির জন্য সত্যিকার অর্থেই লাভজনক তা বাস্তবতার নিরিখে প্রমাণিত হয়েছে। সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার জন্য বিনামূল্যে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই বিতরণ ও নারীদের অবৈতনিক শিক্ষার যে পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে তা বিশ্বসমাজেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। শিক্ষিত জাতি গঠন করতে হলে শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতেই হবে, পাশাপাশি শিক্ষায় আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

নতুন বই শিশুদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। এ সুযোগে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মাঝেও পড়াশুনার বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে- শিক্ষার্থীদের শুধু বিনামূল্যে বই বিতরণই সুষ্ঠু শিক্ষার একমাত্র নিয়ামক নয়। শিশুদের জন্য বহনযোগ্য বই, সহজ বোধযোগ্য সিলেবাস, শিক্ষাদান পদ্ধতি, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন পদ্ধতি, কোমলমতি শিশুদের মূল্যায়ন কৌশল, সময়ে সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ফলাফল নিয়ে নানা বিতর্ক যেন আমাদের পিছু ছাড়ছে না। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের সিলেবাসে অতিরিক্ত বই সংযোজনের কারণে শিশুকে ভারি ব্যাগের বোঝা বহন করতে হচ্ছে। এছাড়া আছে গাইড বইয়ের লাগামহীন ছড়াছড়ি। শিশু শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট লেখক বা প্রকাশনার গাইড বই কিনতে বাধ্য করার মতো অভিযোগও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এমনকি অর্থের বিনিময়ে তথাকথিত কিছু শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট লেখক ও প্রকাশকের বই শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেন মর্মেও অভিযোগ রয়েছে। অথচ কোনো শিক্ষক যদি ক্লাসে শিশুকে পাঠ্যবই অনুযায়ী নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুটি আন্তরিকভাবে বোঝাতে চান এবং বোঝাতে সক্ষম হন, তাহলে একজন সাধারণ মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর জন্য কোনো সহায়ক/গাইড বইয়ের প্রয়োজন পড়ার কথা নয়। এখনও অনেক শিক্ষককে শ্রম লাঘবের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সক্রিয় থেকে ক্লাসে না পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই পড়তে দিয়ে নিশ্চিন্তে শ্রেণিকক্ষে বসে থাকতে দেখা যায়। এছাড়াও আছে শিক্ষক কর্তৃক শিশুশিক্ষার্থীকে প্রাইভেট-কোচিংয়ে বাধ্য করার মতো অভিযোগ। একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থায় এটি কোনোমতেই কাম্য নয়। তাছাড়া প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় এত বেশি বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি ও বিষয়বস্তুর গভীরতা নিয়েও অনেকের মধ্যে মতভেদ আছে। একটি প্রাথমিক স্তরের শিশুর বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, বাংলদেশ ও বিশ্বপরিচয়, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা সম্বন্ধে কতটুকু জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন তা পুনঃবিবেচনার অবকাশ আছে বলে অনেকে মনে করেন।

শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় আমরা কতটা সফল তা সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়। বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত দৈন্য, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক না থাকা, শিক্ষকের প্রয়োজনীয় বিষয়জ্ঞানের অভাব, শিক্ষকের সময়মতো ও নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত না হওয়া, আনন্দঘন পরিবেশ নিশ্চিত না করা, শিক্ষকের ইতিবাচক মনোভাবের অভাবের মতো অনেক বিষয় আমাদের মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার অন্তরায় হয়ে আছে। বর্তমানে প্রতিটি শিশুর হাতে শিক্ষাবছরের প্রথম দিনেই নতুন পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়া হয়- নিঃসন্দেহে এটি একটি মাইলফলক। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের মান, তথ্য-বিভ্রান্তি, সংযোজন, বিয়োজন, মুদ্রণক্রটি- এ ধরনের বিশেষ কিছু বিষয় প্রতি বছরই জনমনে নানা সংশয় সৃষ্টি করে। প্রতি বছর নতুন বই এলেই তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই এসব জায়গায় যোগ্য ও দক্ষ লোকদের নিয়োগ বা পদায়ন করতে হবে। শিশুর বয়স, মেধা ও দৈহিক সামর্থ্য অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা, গুণগতমান ও বিষয়বস্তুর পরিধি নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজানো যেতে পারে। শিক্ষাক্রম যেন সত্যিকারেই সৃজনশীল ও সুখপাঠ্য হয়। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম সৃষ্টির পাশাপাশি উগ্রবাদ ও নৈতিক-মানবিক অবক্ষয়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মতো নতুন নতুন বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে শিক্ষাক্রমকে নতুন করে সাজানো প্রয়োজন।

বর্তমানে অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও বাংলাদেশ সরকারের বিনামূল্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পাঠ্যবই বিতরণ কার্যক্রম নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। সরকার প্রতি বছর উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনই দেশের প্রতিটি স্কুলে সকল শিশুর হাতে শতভাগ নতুন পাঠ্যবই তুলে দেয়া বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণকে অনেকাংশে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। অনেক আগে থেকেই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের স্বল্প পরিসরে বিনামূল্যে বই দেয়া হলেও সরকার ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ শুরু করে। পাশাপাশি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বেতন ফ্রি করে দেয়া এবং শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির আওতায় নিয়ে আসা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে ও ঝরে পড়া রোধে কাজ করছে। এ সুযোগ থেকে বাদ যাচ্ছে না দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিও। এসব অনুপ্রেরণামূলক কার্যক্রম শিশুদের ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্যেরও সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারের সন্তানদের মাঝেও পড়ালেখার প্রতি বিপুল আগ্রহ ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ এবং প্রণোদনা দিয়ে উপস্থিতি বৃদ্ধি করা সুষ্ঠু শিক্ষাদানের মূল নিয়ামক নয়। মানসম্মত ও একীভূত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নতুবা সরকারের এ অর্জন দীর্ঘমেয়াদি সুফল বিস্তারে তেমন কোনো কাজে আসবে না।

বছরের শুরুতে নতুন বইয়ের উৎসবে শিশুরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়; প্রাণচাঞ্চল্যেও মুখরিত হয়। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও শিক্ষার গুণগত মানে পরিবর্তন আনা না গেলে বই উৎসবের আয়োজন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হবে। তাই আমাদের মানসম্মত বিদ্যালয় তৈরির মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। আর এজন্য সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনের সামগ্রিক পরিবেশে এমন আবহ তৈরি করতে হবে যেন নতুন বই হাতে পেয়ে প্রতিটি শিশু পাঠ-প্রবৃত্তির উদ্দীপনায় মনে মনে উচ্চারণ করে- ‘বইয়ের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতো পড়ি বই।’

[লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষা-গবেষক ও ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি),বারহাট্টা, নেত্রকোনা]

ahmsharifullah@yahoo.com