ঢাকার বায়ুদূষণ ও আমাদের শিশুরা

আবদুল মান্নান খান

স্বতঃসিদ্ধ কথা, শিশুরা দেশের ভবিষ্যৎ। ওদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়া তাই অন্যতম প্রধান একটা জরুরি কাজ। এর সঙ্গে অন্য কোন কাজের তুলনা চলে না। ভালো মানুষ ভালো লেখাপড়া ভালো খেলোয়াড় ভালো শ্রমিক যেটাই আমরা চাই না কেন এর জন্য প্রয়োজন সুস্থ-সবল মানবসম্পদ। শিশুরাই আমাদের সেই আগামী দিনের মানবসম্পদ। ঠিকমতো বেড়ে উঠতে ওদের তাই প্রয়োজন নির্মল বায়ু ও পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাবার। খাবারের কথা এখানে বিষয় না, বিষয় বায়ুদূষণ। ফুসফুস-শ্বাসনালী, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক রেখে তো পরে অন্য কথা এবং এজন্যই যতদূর সম্ভব গ্রামাঞ্চলে আবাসিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা প্রয়োজন।

এর মাঝে একদিন ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জের পথে। স্বভাব হয়ে গেছে পথ চলতে ইটের ভাটা গণনা করা এবং তা বেশ আগে থেকেই। দেখতে থাকি আর হিসাব করতে থাকি কতটুকু দূরত্বে কতগুলো ইটভাটা চোখে পড়ে। কখনো অবস্থা এমন হয় যে গুনে সারা যায় না। এক সময় ইটভাটায় গাছ ধ্বংস হচ্ছে দেখে খুব বিচলিত হতাম। মন খারাপ করতাম। খারাপ লাগত বিশেষ করে একথা ভেবে যে, বৃক্ষরা যে ইটের ভাটায় চলে যাচ্ছে সে তো সবাই দেখছে। গোপনে আর যায়-ই করা যাক ইট পোড়ান যায় না। ‘মুখে শেখ ফরিদ বগলে ইট’ অবস্থা দেখে আরো খারাপ লাগত। দেখা গেছে একদিকে পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে সে কী আহাজারি। অন্যদিকে চোখের সামনে ইটভাটায় গাছ সব সাফ হয়ে যাচ্ছে কেউ কিছু করছে না। বিশেষ করে খেজুরগাছ সব ইটভাটায় চলে যাচ্ছে দেখে আমি বেশি বিচলিত হতাম। এখন সব সয়ে গেছে।

এখন চলছে কয়লায় ইট পোড়ানো এবং ইটভাটাই এখন ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। দুঃখের বিষয় হলো যেখানে কাজ হবে সেখানেই ইট বানাতে হবে এমন মনোভাবের কারণেই আজ ঢাকা মহানগর দূষণে ডুবতে বসেছে। বেশি দূরে যেতে হবে না সংসদ ভবন থেকে দুই কিলোমিটারও হবে না পশ্চিম দিকে গেলে গুনে সারা যাবে না ইটভাটার সংখ্যা। এটা কেন হবে। দূর থেকে লাখ লাখ টন সিলেট বালু, পাথর এনে কাজ করা গেলে ইট কেন আনা গেল না! একটা রাজধানী শহর গড়ে তুলতে ইট পোড়াতে হচ্ছে সেই শহরের গায়ে! বহু ব্যবহৃত সেকথাটা এখানে এসেই যায়- কী বিচিত্র এ দেশ সেলুকাস। একবার শুনলাম কে জানি বললেন, আমরা ইটও রফতানি করতে পারি- বোঝেন ঠেলা।

তবে এটা ঠিক ইট আমাদের লাগবেই। উপরে আমাদের উঠতেই হবে। জায়গা কম কাজেই আকাশ ধরতে হবে। তাই বলে সেটা এভাবে হতে পারে না যে, ফসলের জমিতে ইটভাটা বানাতে হবে। ধানি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে এনে ইটের ভাটায় ব্যবহার করতে হবে। রাজধানীর মতো শহর ঘেষেও ইটভাটা করতে হবে। কেন ভাটার মাটির জন্য নির্ধারিত জায়গা খনন করে গভীরে চলে যাওয়া হচ্ছে না। এটা করা হলে তো ভাটার পাশে একেকটা পুকুর হয়ে পরে সেটা কাজে লাগতে পারে। মরা নদী খনন করে সে মাটি দিয়ে ইট বানান যায় কিনা সেদিকেও নজর দেয়া যেতে পারে। আর পোড়ান ছাড়া ইট তৈরির যে প্রযুক্তি বেরিয়েছে সেদিকে জোর দিতে হবে।

আগে থেকেই শুনে আসছি বায়ুদূষণে সবার ওপরে রয়েছে দিল্লির শহর। আমরা ঢাকাবাসী আছি দ্বিতীয় স্থানে। দ্বিতীয় স্থানে বলতে দু’এক নম্বর কমবেশিতে ক্লাসে প্রথম-দ্বিতীয় হওয়ার মতো আর কি। কিন্তু এখন আবার শুনছি আমরাই নাকি চ্যাম্পিয়ন। দিল্লি পিছনে পড়ে গেছে। প্রতিযোগিতা দু’জনের মধ্যে হলে এমন তো হতেই পারে। মাস কয়েক আগে দিল্লি ভয়াবহ বায়ুদূষণের কবলে পড়েছিল। সেটা এতটাই ভয়ঙ্কর হয়েছিল যে, স্কুলগুলো সব বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছিল। লাখ লাখ মানুষকে মাস্ক পরতে হয়েছিল। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল দিল্লিবাসী। ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি বসিয়ে তারা বিশুদ্ধ বায়ু বাজারে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। দিল্লিতে ওই ভয়াবহ বায়ুদূষণের কারণ নাকি ছিল পার্শ্ববর্তী পাঞ্চাব ও হরিয়ানা রাজ্যের ক্ষেতের ফসলের খড় পোড়ানোর ধোয়া। ক্ষেতের খড় সারা বছর পোড়ায় না। যখন পুড়িয়েছে তখন তার ধোঁয়া মেঘের মতো ছেয়ে গেছে চারদিক দিল্লিও তার ভেতরে পড়েছে। এমনিতে দূষণে ভরা তারপর খড় পোড়ানো ধোঁয়া। লক্ষ্য করার বিষয় দিল্লির বায়ুদূষণের কারণগুলোর সঙ্গে ইটভাটার কালো ধোঁয়ার কোন কথা কিন্তু আসেনি।

আমি দুই-আড়াই বছর আগে দিল্লি গিয়েছিলাম ট্যুরিস্ট ভিসায়। দিল্লির গাছপালা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি, এতো গাছপালা দিল্লিতে! তারপরও এতো বায়ুদূষণ কীভাবে হয়। আমার অবশ্য এব্যাপারে তেমন কিছু মনেই হযনি। হবে কী করে আমি ঢাকা থেকে গেছি না। আমরা ঢাকাবাসী সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা বোধ হয় একটু বেশিই রাখি। অথবা সব কিছু অগ্রাহ্য করে চলার একটা মনোভাব আমাদের ভেতরে কাজ করে। আমরা কিছু পরোয়া করি না তাই হয়তো কিছু মনে হয়নি। এর কারণ এমন হতে পারে, সবাই তো এক সঙ্গে রোগবালাইতে পড়ি না এক সঙ্গে দুর্ঘটনার শিকারও হই না। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি, আমি তো ভালো আছি। আমার ঘাড়ে না পড়লেই হলো। তারপর এক সময় নিজের ঘাড়েও পড়ে। নৌ ও সড়ক পথের দুর্ঘটনার কথাই ধরুন। এমন পরিবার কমই আছে যাদের স্বজনরা কেউ না কেউ কোন রকম দুর্ঘটনার শিকার হয়নি এসব পথে। তারপরও দেখা যায় আমরা কোন কিছু গায় মাখি না।

বায়ুদূষণে শিশুরা আক্রান্ত হয় বেশি। এদিকে ঢাকা শহর থেকে বায়ুদূষণের পরিমাণ অচিরেই কমে যাবে শিশুদের কাছে সহনীয় হয়ে উঠবে একথা কেউ বললে শুনতে ভালোই লাগে। আমি কোন বিশেষজ্ঞ নই তবু মনে হয় সেটা বাস্তবে বহুত দূর। এর সঙ্গে রয়েছে শব্দদূষণ যা ক্রমে মাত্রা ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে ভয়াবহ পর্যায়ে। এখন তাহলে কী হবে। বলতে চাচ্ছি ব্যাপক হারে গ্রামাঞ্চলে শিশুদের জন্য আবাসিক স্কুল গড়ে উঠলে কিছু শিশুকে তো ঢাকা শহরের এ দূষণ থেকে দুরে রাখা যাবে। সেটাই বা কম কী। ঢাকার শিশুদের জন্য এটা করা গেলে জায়গা দিয়ে সারা যাবে না সে বাংলাদেশের যেখানেই করা হোক না কেন। আর সেটা সরকারি বা বেসরকারি যেভাবেই গড়ে উঠুক না কেন। তাই বলে সেটা ঢাকা নারায়ণগঞ্জ মুন্সীগঞ্জ গাজীপুর মানিকগঞ্জ এসব জেলায় করা যাবে না। কেন করা যাবে না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাই দেখছেন এ জেলাগুলো ইট চাষে ভয়ানক উর্বর হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে সরকারের সদিচ্ছায় অবৈধ ইটভাটা ধ্বংস করা শুরু করা হয়েছে। আমরা একে স্বাগত জানাই। আশা করি এই ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলবে। আর বৈধ অবৈধ কী রাজধানী বেড়ে থাকা কোন জেলায় কোন ইটভাটা থাকতে পারবে না এমনই হতে হবে সেটা।

গ্রামাঞ্চলে আবাসিক স্কুল করার পরিবেশ অনেকটাই তৈরি হয়ে আছে। আজ এমন কোন গ্রাম নেই যে গ্রামে প্রাইমারি স্কুল নেই। ওই স্কুলকে আবাসিক স্কুলে উন্নীত করে হোক বা নতুন করে স্কুল নির্মাণ করে হোক সুযোগটা করে দিতে পারলে সেটা হবে একটা বড় মাপের কাজ। হোক না এমন একটা মেগা প্রকল্প। ভেবে বলুন তো এর চেয়ে বড় লগ্নি আর কিসে হতে পারে। আমি তো বলি আর কিছুতে হতে পারে না।

শিক্ষার মান নিয়ে কথা রয়েছে তবে এটা পাশে রেখেই বলতে হয় প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি আকাশ সমান। স্কুলে যওয়ার বয়স হয়েছে কিন্তু স্কুলে যায় না এ সংখ্যা এখন নগণ্য। যে কারণগুলোতে সব শিশুকে এখন স্কুলমুখী করা গেছে তা হলো দু’এক কথায় এরকম- ১. বিনামূল্যে বছরের প্রথম দিন সকল শিশুশিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়া; ২. গরিব দুস্থ পরিবারের শিশুদের উপবৃত্তি দেয়া; ৩. স্কুলে ওদের হাতে কিছু খাবার তুলে দেয়া। দেশের সীমিত এলাকায় হলেও বিষয়টা খুব কাজ করেছে। বেশি না ৭০ গ্রাম ওজনের মানসম্মত-পুষ্টিকর এক প্যাকেট বিস্কুট দেয়া হয় ‘স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম’-এর আওতায়। এতেই কত সাফল্য। এখন এটাকে ধরে রাখা এবং সকল স্কুল পর্যন্ত পৌছানোর কাজটাও নিশ্চয় ঠেকে থাকবে না। বলতে চাচ্ছি এতকিছু করা যেখানে সম্ভব হয়েছে সেখানে গ্রামে আবাসিক স্কুল করা মোঠেই অসম্ভব কাজ হবে না। এ কাজে আরও একটা সহায়ক দিক আছে তা হলো আজকাল এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে সহজে পৌঁছা যায় না বা রাস্তাঘাট নেই।

শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা এখন মজবুত ব্যবসা। কাজেই ব্যবসা করুক ব্যবসায়ীরা প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে খেলার মাঠসহ একেকটা আবাসিক স্কুল বানিয়ে। দীর্ঘমেয়াদে করুক এ ব্যবসা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরেই কেবল দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা করে যাবেন তা কেন হবে। হলো তো বহুত দিন আর কত।

ঢাকা শহরের বিরাট একটা জনগোষ্ঠী আছে যারা তাদের সন্তানদের ঢাকার বাইরে গ্রাম্য পরিবেশে আবাসিক স্কুলে রেখে লেখাপড়া করানোর সুযোগ পেলে সেটা মাথা পেতে নেবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। সন্তানের জন্যই সবকিছু। সন্তানের সুস্থতার জন্য সন্তানের লেখাপড়ার জন্য বাবা-মা সব কিছুই করতে রাজি। করছেনও। কেবল সুযোগ করে দিতে হবে।

শেষ করব আমার সেই পুরানো সারিন্দাটা আবার একটু বাজিয়ে। চীন দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা দেখার একবার সুযোগ হয়েছিল আমার। কী সমতলে কী পাহাড়ে কী বড় জনপদে কী ছোট জনপদে আবাসিক স্কুলেরই প্রাধান্য সেদেশে। চীনে নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক এবং সেটা সবই সরকারি খরচে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তবে ওরা দেশের মানুষকে আগে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে নিয়েছে। যে অভিভাবকের সমর্থ নেই তার সন্তান সম্পূর্ণ নিখরচায় লেখাপড়া করে আর যার সমর্থ আছে তাকে সব খরচ বহন করতে হয়। আরেকটা বিত্তবান শ্রেণী আছে তাদের লেখাপড়ার সব খরচ বহন করেও স্কুলে টাকা ‘ডনেট’ করতে হয় ছেলেমেয়ে পড়াতে। প্রথম সমাপনি পরীক্ষাটা নেয়া হয় নবম শ্রেণীতে।

আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হতে হতেও হলো না। আমরা চাই এটা হোক। আমরা আরও চাই আমাদের সকল শিশুর জন্য অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া বাধ্যতামূলক হোক। গ্রামাঞ্চলে আবাসিক স্কুল গড়ে উঠুক। শব্দদূষণে বায়ুদূষণে জর্জরিত ঢাকা শহরের শিশুরা সে পরিবেশে থেকে বড় হয়ে উঠুক।

সোমবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২০ , ১৩ মাঘ ১৪২৬, ১ জমাদিউস সানি ১৪৪১

সবাই যা দেখে

ঢাকার বায়ুদূষণ ও আমাদের শিশুরা

আবদুল মান্নান খান

স্বতঃসিদ্ধ কথা, শিশুরা দেশের ভবিষ্যৎ। ওদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়া তাই অন্যতম প্রধান একটা জরুরি কাজ। এর সঙ্গে অন্য কোন কাজের তুলনা চলে না। ভালো মানুষ ভালো লেখাপড়া ভালো খেলোয়াড় ভালো শ্রমিক যেটাই আমরা চাই না কেন এর জন্য প্রয়োজন সুস্থ-সবল মানবসম্পদ। শিশুরাই আমাদের সেই আগামী দিনের মানবসম্পদ। ঠিকমতো বেড়ে উঠতে ওদের তাই প্রয়োজন নির্মল বায়ু ও পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাবার। খাবারের কথা এখানে বিষয় না, বিষয় বায়ুদূষণ। ফুসফুস-শ্বাসনালী, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক রেখে তো পরে অন্য কথা এবং এজন্যই যতদূর সম্ভব গ্রামাঞ্চলে আবাসিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা প্রয়োজন।

এর মাঝে একদিন ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জের পথে। স্বভাব হয়ে গেছে পথ চলতে ইটের ভাটা গণনা করা এবং তা বেশ আগে থেকেই। দেখতে থাকি আর হিসাব করতে থাকি কতটুকু দূরত্বে কতগুলো ইটভাটা চোখে পড়ে। কখনো অবস্থা এমন হয় যে গুনে সারা যায় না। এক সময় ইটভাটায় গাছ ধ্বংস হচ্ছে দেখে খুব বিচলিত হতাম। মন খারাপ করতাম। খারাপ লাগত বিশেষ করে একথা ভেবে যে, বৃক্ষরা যে ইটের ভাটায় চলে যাচ্ছে সে তো সবাই দেখছে। গোপনে আর যায়-ই করা যাক ইট পোড়ান যায় না। ‘মুখে শেখ ফরিদ বগলে ইট’ অবস্থা দেখে আরো খারাপ লাগত। দেখা গেছে একদিকে পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে সে কী আহাজারি। অন্যদিকে চোখের সামনে ইটভাটায় গাছ সব সাফ হয়ে যাচ্ছে কেউ কিছু করছে না। বিশেষ করে খেজুরগাছ সব ইটভাটায় চলে যাচ্ছে দেখে আমি বেশি বিচলিত হতাম। এখন সব সয়ে গেছে।

এখন চলছে কয়লায় ইট পোড়ানো এবং ইটভাটাই এখন ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। দুঃখের বিষয় হলো যেখানে কাজ হবে সেখানেই ইট বানাতে হবে এমন মনোভাবের কারণেই আজ ঢাকা মহানগর দূষণে ডুবতে বসেছে। বেশি দূরে যেতে হবে না সংসদ ভবন থেকে দুই কিলোমিটারও হবে না পশ্চিম দিকে গেলে গুনে সারা যাবে না ইটভাটার সংখ্যা। এটা কেন হবে। দূর থেকে লাখ লাখ টন সিলেট বালু, পাথর এনে কাজ করা গেলে ইট কেন আনা গেল না! একটা রাজধানী শহর গড়ে তুলতে ইট পোড়াতে হচ্ছে সেই শহরের গায়ে! বহু ব্যবহৃত সেকথাটা এখানে এসেই যায়- কী বিচিত্র এ দেশ সেলুকাস। একবার শুনলাম কে জানি বললেন, আমরা ইটও রফতানি করতে পারি- বোঝেন ঠেলা।

তবে এটা ঠিক ইট আমাদের লাগবেই। উপরে আমাদের উঠতেই হবে। জায়গা কম কাজেই আকাশ ধরতে হবে। তাই বলে সেটা এভাবে হতে পারে না যে, ফসলের জমিতে ইটভাটা বানাতে হবে। ধানি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে এনে ইটের ভাটায় ব্যবহার করতে হবে। রাজধানীর মতো শহর ঘেষেও ইটভাটা করতে হবে। কেন ভাটার মাটির জন্য নির্ধারিত জায়গা খনন করে গভীরে চলে যাওয়া হচ্ছে না। এটা করা হলে তো ভাটার পাশে একেকটা পুকুর হয়ে পরে সেটা কাজে লাগতে পারে। মরা নদী খনন করে সে মাটি দিয়ে ইট বানান যায় কিনা সেদিকেও নজর দেয়া যেতে পারে। আর পোড়ান ছাড়া ইট তৈরির যে প্রযুক্তি বেরিয়েছে সেদিকে জোর দিতে হবে।

আগে থেকেই শুনে আসছি বায়ুদূষণে সবার ওপরে রয়েছে দিল্লির শহর। আমরা ঢাকাবাসী আছি দ্বিতীয় স্থানে। দ্বিতীয় স্থানে বলতে দু’এক নম্বর কমবেশিতে ক্লাসে প্রথম-দ্বিতীয় হওয়ার মতো আর কি। কিন্তু এখন আবার শুনছি আমরাই নাকি চ্যাম্পিয়ন। দিল্লি পিছনে পড়ে গেছে। প্রতিযোগিতা দু’জনের মধ্যে হলে এমন তো হতেই পারে। মাস কয়েক আগে দিল্লি ভয়াবহ বায়ুদূষণের কবলে পড়েছিল। সেটা এতটাই ভয়ঙ্কর হয়েছিল যে, স্কুলগুলো সব বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছিল। লাখ লাখ মানুষকে মাস্ক পরতে হয়েছিল। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল দিল্লিবাসী। ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি বসিয়ে তারা বিশুদ্ধ বায়ু বাজারে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। দিল্লিতে ওই ভয়াবহ বায়ুদূষণের কারণ নাকি ছিল পার্শ্ববর্তী পাঞ্চাব ও হরিয়ানা রাজ্যের ক্ষেতের ফসলের খড় পোড়ানোর ধোয়া। ক্ষেতের খড় সারা বছর পোড়ায় না। যখন পুড়িয়েছে তখন তার ধোঁয়া মেঘের মতো ছেয়ে গেছে চারদিক দিল্লিও তার ভেতরে পড়েছে। এমনিতে দূষণে ভরা তারপর খড় পোড়ানো ধোঁয়া। লক্ষ্য করার বিষয় দিল্লির বায়ুদূষণের কারণগুলোর সঙ্গে ইটভাটার কালো ধোঁয়ার কোন কথা কিন্তু আসেনি।

আমি দুই-আড়াই বছর আগে দিল্লি গিয়েছিলাম ট্যুরিস্ট ভিসায়। দিল্লির গাছপালা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি, এতো গাছপালা দিল্লিতে! তারপরও এতো বায়ুদূষণ কীভাবে হয়। আমার অবশ্য এব্যাপারে তেমন কিছু মনেই হযনি। হবে কী করে আমি ঢাকা থেকে গেছি না। আমরা ঢাকাবাসী সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা বোধ হয় একটু বেশিই রাখি। অথবা সব কিছু অগ্রাহ্য করে চলার একটা মনোভাব আমাদের ভেতরে কাজ করে। আমরা কিছু পরোয়া করি না তাই হয়তো কিছু মনে হয়নি। এর কারণ এমন হতে পারে, সবাই তো এক সঙ্গে রোগবালাইতে পড়ি না এক সঙ্গে দুর্ঘটনার শিকারও হই না। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি, আমি তো ভালো আছি। আমার ঘাড়ে না পড়লেই হলো। তারপর এক সময় নিজের ঘাড়েও পড়ে। নৌ ও সড়ক পথের দুর্ঘটনার কথাই ধরুন। এমন পরিবার কমই আছে যাদের স্বজনরা কেউ না কেউ কোন রকম দুর্ঘটনার শিকার হয়নি এসব পথে। তারপরও দেখা যায় আমরা কোন কিছু গায় মাখি না।

বায়ুদূষণে শিশুরা আক্রান্ত হয় বেশি। এদিকে ঢাকা শহর থেকে বায়ুদূষণের পরিমাণ অচিরেই কমে যাবে শিশুদের কাছে সহনীয় হয়ে উঠবে একথা কেউ বললে শুনতে ভালোই লাগে। আমি কোন বিশেষজ্ঞ নই তবু মনে হয় সেটা বাস্তবে বহুত দূর। এর সঙ্গে রয়েছে শব্দদূষণ যা ক্রমে মাত্রা ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে ভয়াবহ পর্যায়ে। এখন তাহলে কী হবে। বলতে চাচ্ছি ব্যাপক হারে গ্রামাঞ্চলে শিশুদের জন্য আবাসিক স্কুল গড়ে উঠলে কিছু শিশুকে তো ঢাকা শহরের এ দূষণ থেকে দুরে রাখা যাবে। সেটাই বা কম কী। ঢাকার শিশুদের জন্য এটা করা গেলে জায়গা দিয়ে সারা যাবে না সে বাংলাদেশের যেখানেই করা হোক না কেন। আর সেটা সরকারি বা বেসরকারি যেভাবেই গড়ে উঠুক না কেন। তাই বলে সেটা ঢাকা নারায়ণগঞ্জ মুন্সীগঞ্জ গাজীপুর মানিকগঞ্জ এসব জেলায় করা যাবে না। কেন করা যাবে না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাই দেখছেন এ জেলাগুলো ইট চাষে ভয়ানক উর্বর হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে সরকারের সদিচ্ছায় অবৈধ ইটভাটা ধ্বংস করা শুরু করা হয়েছে। আমরা একে স্বাগত জানাই। আশা করি এই ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলবে। আর বৈধ অবৈধ কী রাজধানী বেড়ে থাকা কোন জেলায় কোন ইটভাটা থাকতে পারবে না এমনই হতে হবে সেটা।

গ্রামাঞ্চলে আবাসিক স্কুল করার পরিবেশ অনেকটাই তৈরি হয়ে আছে। আজ এমন কোন গ্রাম নেই যে গ্রামে প্রাইমারি স্কুল নেই। ওই স্কুলকে আবাসিক স্কুলে উন্নীত করে হোক বা নতুন করে স্কুল নির্মাণ করে হোক সুযোগটা করে দিতে পারলে সেটা হবে একটা বড় মাপের কাজ। হোক না এমন একটা মেগা প্রকল্প। ভেবে বলুন তো এর চেয়ে বড় লগ্নি আর কিসে হতে পারে। আমি তো বলি আর কিছুতে হতে পারে না।

শিক্ষার মান নিয়ে কথা রয়েছে তবে এটা পাশে রেখেই বলতে হয় প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি আকাশ সমান। স্কুলে যওয়ার বয়স হয়েছে কিন্তু স্কুলে যায় না এ সংখ্যা এখন নগণ্য। যে কারণগুলোতে সব শিশুকে এখন স্কুলমুখী করা গেছে তা হলো দু’এক কথায় এরকম- ১. বিনামূল্যে বছরের প্রথম দিন সকল শিশুশিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়া; ২. গরিব দুস্থ পরিবারের শিশুদের উপবৃত্তি দেয়া; ৩. স্কুলে ওদের হাতে কিছু খাবার তুলে দেয়া। দেশের সীমিত এলাকায় হলেও বিষয়টা খুব কাজ করেছে। বেশি না ৭০ গ্রাম ওজনের মানসম্মত-পুষ্টিকর এক প্যাকেট বিস্কুট দেয়া হয় ‘স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম’-এর আওতায়। এতেই কত সাফল্য। এখন এটাকে ধরে রাখা এবং সকল স্কুল পর্যন্ত পৌছানোর কাজটাও নিশ্চয় ঠেকে থাকবে না। বলতে চাচ্ছি এতকিছু করা যেখানে সম্ভব হয়েছে সেখানে গ্রামে আবাসিক স্কুল করা মোঠেই অসম্ভব কাজ হবে না। এ কাজে আরও একটা সহায়ক দিক আছে তা হলো আজকাল এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে সহজে পৌঁছা যায় না বা রাস্তাঘাট নেই।

শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা এখন মজবুত ব্যবসা। কাজেই ব্যবসা করুক ব্যবসায়ীরা প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে খেলার মাঠসহ একেকটা আবাসিক স্কুল বানিয়ে। দীর্ঘমেয়াদে করুক এ ব্যবসা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরেই কেবল দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা করে যাবেন তা কেন হবে। হলো তো বহুত দিন আর কত।

ঢাকা শহরের বিরাট একটা জনগোষ্ঠী আছে যারা তাদের সন্তানদের ঢাকার বাইরে গ্রাম্য পরিবেশে আবাসিক স্কুলে রেখে লেখাপড়া করানোর সুযোগ পেলে সেটা মাথা পেতে নেবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। সন্তানের জন্যই সবকিছু। সন্তানের সুস্থতার জন্য সন্তানের লেখাপড়ার জন্য বাবা-মা সব কিছুই করতে রাজি। করছেনও। কেবল সুযোগ করে দিতে হবে।

শেষ করব আমার সেই পুরানো সারিন্দাটা আবার একটু বাজিয়ে। চীন দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা দেখার একবার সুযোগ হয়েছিল আমার। কী সমতলে কী পাহাড়ে কী বড় জনপদে কী ছোট জনপদে আবাসিক স্কুলেরই প্রাধান্য সেদেশে। চীনে নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক এবং সেটা সবই সরকারি খরচে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তবে ওরা দেশের মানুষকে আগে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে নিয়েছে। যে অভিভাবকের সমর্থ নেই তার সন্তান সম্পূর্ণ নিখরচায় লেখাপড়া করে আর যার সমর্থ আছে তাকে সব খরচ বহন করতে হয়। আরেকটা বিত্তবান শ্রেণী আছে তাদের লেখাপড়ার সব খরচ বহন করেও স্কুলে টাকা ‘ডনেট’ করতে হয় ছেলেমেয়ে পড়াতে। প্রথম সমাপনি পরীক্ষাটা নেয়া হয় নবম শ্রেণীতে।

আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হতে হতেও হলো না। আমরা চাই এটা হোক। আমরা আরও চাই আমাদের সকল শিশুর জন্য অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া বাধ্যতামূলক হোক। গ্রামাঞ্চলে আবাসিক স্কুল গড়ে উঠুক। শব্দদূষণে বায়ুদূষণে জর্জরিত ঢাকা শহরের শিশুরা সে পরিবেশে থেকে বড় হয়ে উঠুক।